0

প্রাচীন কথাঃ কৃষ্ণ দেবরায়

Posted in


প্রাচীন কথা


বিন্দুতে সিন্ধু দর্শন - ৪
কৃষ্ণ দেবরায়




আগের কিস্তিতে উল্লিখিত ঋক বেদ, জেন্দ-আবেস্তা আর হোমারের ইলিয়াস ও অডিসিতে ঐতিহাসিক বিবরণ বলতে আমরা যা বুঝি, তেমন বিবরণ কিছু পাওয়া না গেলেও এগুলিকে আকরগ্রন্থ হিসেবে অবশ্যই ব্যবহার করা চলে। গ্রন্থগুলি ভিন্নভিন্ন অঞ্চলের হলেও সেগুলি থেকে একটা যুগ বেরিয়ে আসে যখন তামা ও ব্রোঞ্জ ব্যবহার করা হত। হোমারের লেখায় তো শেষেরদিকে লোহারও উল্লেখ আছে। এই সব গ্রন্থগুলি খুব মন দিয়ে পড়লে আর সেই সঙ্গে আদি ইন্দো-ইয়োরোপীয় ভাষাসমূহে সমগোত্রীয় শব্দগুলি পর্যবেক্ষণ করলে আর্যদের জীবনযাত্রার স্বাতন্ত্রসূচক বেশ কিছু বৈশিষ্টের সন্ধান পাওয়া যায়।আসুন আমরা সেই বৈশিষ্টগুলি কী, তা জানার চেষ্টা করি। আর সিন্ধুসভ্যতায় এদের কতটা অস্তিত্ব ছিল বা আদৌ ছিল কিনা সেটা দেখে নিলেই সিন্ধুসভ্যতায় আর্যদের অবদানের বিষয়ে সংশয়ের নিরসন সম্ভব হবে।

অশ্বকে আর্য সংস্কৃতির এক অচ্ছেদ্য চিহ্ন বলে ধরে নেওয়া হয়। আর্যদের প্রধাণ দেবতা ইন্দ্রের বাহন এই অশ্ব। এই প্রাণীটি আদি ইন্দো-ইউরোপীয় জনগণের জীবনে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। অশ্ব শব্দটি এবং তার সমধর্মী প্রতিশব্দ পাওয়া যায় সংস্কৃত, আবেস্তান, গ্রীক, ল্যাটিন এবং অন্যান্য ইন্দো-ইয়োরোপীয় ভাষায়। বিভিন্ন রূপে অশ্ব শব্দটি ২১৫ বার ঋক বেদে উল্লিখিত হয়েছে। এত বেশী উল্লেখ আর কোনও প্রাণীর নেই। ঋক বেদে গো শব্দটি ১৭৬ বার এবং বৃষভ শব্দটি ১৭০ বার উল্লিখিত হয়েছে। কিন্তু ভারতের মতন উষ্ণতা প্রধান এবং সাধারণ মানের নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে যে প্রাণী খুব দেখা যায়,সেই বাঘ এবং গণ্ডারের কিন্তু কোনও উল্লেখ নেই ঋক বেদে। তার কারণ মধ্য এশিয়ার শীতের আবহাওয়ায় এদের খুব একটা দেখা যায়না। আমি নিশ্চয় বোঝাতে পেরেছি যে অশ্বের সঙ্গে আর্যদের এক নিবিড় যোগাযোগ ছিল। এখন প্রশ্ন, যদি তাই হয়,তাহলে সমগ্র সিন্ধু সভ্যতার বিস্তীর্ন অঞ্চলে কোথাও অশ্বের চিত্র সংবলিত কোন শিলমোহর নেই কেন? কেন নেই অন্যান্য প্রাণীর কংকালের সাথে অশ্বের কংকাল? এই অবশ্যম্ভাবী প্রশ্নটা যে উঠতে পারে, সম্ভবত এটি আঁচ করেই যে সমস্ত হিন্দু মৌলবাদী আর তাঁদের পশ্চিমী মদতদাতারা সিন্ধুসভ্যতা যে আর্যদের দ্বারাই সৃষ্ট এটা প্রমাণ করার জন্যে দুটি শীল মোহরে অশ্বের ছাপ আছে বলে প্রচার শুরু করেছিলেন। রেডিও-কার্বন পরীক্ষায় তাঁদের সে জালিয়াতি ধরা পড়ে যাওয়ায়, গোটা বিশ্বের প্রত্নতাত্বিক, ঐতিহাসিকরা নিন্দা করলেও তাঁরা এখনো রণে ভঙ্গ দেন নি।

অশ্বের ব্যবহারের মতনই আর্যদের একটি বিশেষত্ব ছিল অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়ার। হরপ্পার মানুষজন মাটিতে কবর দিতেন। সাধারণতমৃতদেহগুলির মাথা দক্ষিণে রেখে তাদের সমাধিস্থ করা হত। তার সঙ্গে দেওয়া হত গড়ে পনেরোটি পাত্র এবং পশুর সন্ধিস্থলের মাংস (সমাধিতে প্রায়শই পশু-পাখির হাড়গোড় পাওয়া গিয়েছে)। কিন্তু আর্যরা এদেশে আসার পরে তাঁদের অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়ার বিকাশ লক্ষ্য করা যায়। হরপ্পার সমকালীন অন্ত্যেষ্টি প্রথার সঙ্গে আর্য পরবর্তী অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়ার আমূল পরিবর্তন ঘটে। এই পরিবর্তিত সমাধি ক্রিয়ার নাম দেওয়া হয়েছে, ‘সমাধিক্ষেত্র-এইচ’। এই নতুন সমাধি-ব্যবস্থায় পাত্রাধারের মধ্যে রেখে সমাধি দেওয়া হত। কোনও কোনও ক্ষেত্রে এই নতুন সমাধি ব্যবস্থায় পাত্রের মধ্যে জমিয়ে রাখা পোড়া হাড়ও লক্ষ্য করা গেছে। আগে সমাধিক্ষেত্র এইচ শুধু হরপ্পাতেই সীমাবদ্ধ বলে মনে করা হত। কিন্তু বর্তমানে আমরা প্রায় বাহাত্তরটি সমাধিক্ষেত্র এইচ উপকরণ সমৃদ্ধ ক্ষেত্রের কথা জানি। হুইলার মনে করেন ‘সমাধিক্ষেত্র এইচ’ হলো ‘বহিরাগত’ এবং ‘অতি অবশ্যই হরপ্পা পরবর্তী যুগের’ এবং এটি এক নতুন মানবগোষ্ঠীর আগমনের প্রতীক বলে ধরা হয়।

ইন্দ্র ছাড়া আর্যদের আরেক দেবতা হলেন অগ্নি। অগ্নি উপাসনাকে আর্যদের এক বৈশিষ্ট বলে মনে করা হয়। ঋক বেদে অগ্নির স্থানের (বেদী) উল্লেখ আছে এবং আবেস্তাতে অগ্নিপূজা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। যেহেতু মানবসমাজে জীবনযাত্রায় অগ্নির ভূমিকা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ, তাই সিন্ধু উপত্যকা সহ অনেক অঞ্চলেই হয়তো অগ্নিকে পূজা করা হত, কিন্তু ঐ সব এলাকায় ঋক বেদে বর্ণিত অগ্নি-বেদীর অস্তিত্ব সম্ভবত ছিলনা। গুজরাটের লোথালে কিংবা রাজস্থানের কালিবঙ্গানে প্রাপ্ত ‘অগ্নি-বেদী’গুলিকে উৎখননকারীরাই সন্দেহের চোখে দেখেছেন। এস আর রাও মনে করেন লোথালের অগ্নিবেদীগুলি আসলে রান্নার চুল্লি। সে যাই হোক না কেন, একথা খুবই স্পষ্ট যে হরপ্পায় আবিষ্কৃত অগ্নিবেদীগুলি ঋকবেদ সহ সাহিত্যের বর্ণনার সঙ্গে কিংবা দীর্ঘকালীন ঐতিহ্যবাহী প্রথার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।

পশুবলি হয়তো অনেক জনগোষ্ঠীর মানুষদের মধ্যেই প্রচলিত ছিল। কিন্তু অশ্বমেধ একমাত্র আর্যদের নিজস্ব স্বতন্ত্র প্রথা। বিশেষ করে বৈদিক মানুষজনের ক্ষেত্রে একথা সত্য। বৈদিক যুগ বিষয়ে ফরাসী পণ্ডিত লুই রেনো এটিকে একটি ইন্দো-ইয়োরোপীয়ান প্রথা বলেই মনে করেন। অশ্ববলির প্রভূত পরিমাণ প্রত্নতাত্বিক প্রমাণ পূর্ব, মধ্য, পশ্চিম এবং উত্তর ইয়োরোপে এবং ককেশাস অঞ্চলে এবং মধ্য এশিয়ায় পাওয়া যায়। ইউক্রেন এবং মধ্য রাশিয়ার অনেক কবরখানা একাধিক অশ্ববলির সাক্ষ্য দেয়।ঋকবেদ এর দশম মণ্ডলে মাত্র দুটি সূক্ত(১৬২-১৬৩)অশ্ববলি সম্পর্কে রচিত কিন্তু পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে প্রথাটি অশ্বমেধ নামে বিশেষ জনপ্রিয়তা পায়। এই অশ্ববলি বা অশ্বমেধের ব্যাপারে যেমন ইয়োরোপে এবং মধ্য এশিয়াতে সুস্পষ্ট প্রত্নতাত্বিক প্রমাণ পাওয়া যায়, ভারতে অথবা হরপ্পা সভ্যতায় কিন্তু এর কোনও প্রত্নতাত্বিক প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

সোম পূজা পদ্ধতি, যাকে আবেস্তার ভাষায় হাওমা বলা হয়, তা কেবলমাত্র ইরানীয় এবং বৈদিক জনগণের মধ্যেই সীমিত ছিল।বর্তমানে এফেড্রা নামক এক উদ্ভিদকে সোম বলে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে এবং ভারতে নয়, এই এফেড্রার পল্লবগুলি দক্ষিণ-পূর্ব তুর্কমেনিস্তানের মারজিয়ানাতে টোগোলোক ২১ মন্দিরের চত্বরে পান-অনুষ্ঠানের পানপাত্রের গায়ে লক্ষ্য করা যায়।

যদিও হরপ্পালিপির পাঠোদ্ধার সম্ভব হয়নি এখনও, কিন্তু তাদের যে নিজস্ব একটা লিপি ছিল সেটা অভ্রান্ত ভাবেই প্রমাণিত।অপর দিকে, ভারতে আসার আগে পর্যন্ত আর্যদের কোনও লেখ্য লিপি বা লিখন পদ্ধতি ছিলনা। ঋক বেদ গ্রন্থিত হয় ভারতবর্ষে অনেক পরে। প্রায় ১৭০০-১৫০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে। তার আগে ছিল শুধুই স্মৃতি এবং শ্রুতি পদ্ধতি।

ওপরে আমি আর্যদের যে যে বৈশিষ্ট এবং ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক এবং অশ্বের বিবরণ দিলাম, তার কোনওটাই কিন্তু সিন্ধুসভ্যতার মধ্যে পাওয়া যায়নি। হিন্দু মৌলবাদীরা এতেও না দমে এবার প্রচার শুরু করল, হরপ্পা সভ্যতা হল আসলে ঋকবেদে বর্ণিত সরস্বতী ভিত্তিক সভ্যতা এবং এটাই ঋক বৈদিক সভ্যতা। আসবো সে কথায় পরের কিস্তিতে। তার আগে আর একটা কথা জেনে নিই আমরা। সিন্ধুসভ্যতায় যে বহিবার্ণিজ্যের প্রচলন হয়েছিল সেটা আর কোনও রহস্য নয়, প্রমাণিত সত্য। মেসোপটেমিয়ার সঙ্গেও ছিল এই বাণিজ্য যোগ। সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসীদের মেসোপটেমিয়ানরা বলত ‘মেলুহা’ (আমিশ ত্রিপাঠির দ্য ইমমর্টালস অফ মেলুহা মনে পড়ছে?)। তো, এই মেলুহাদের জাহাজ মেসোপটেমিয়ার বন্দরে ভিড়লে সেখানকার উচ্চবিত্ত মানুষজন খুব খুশি আর উত্তেজিত হতেন নতুন পণ্য সামগ্রী কেনার জন্যে। মেসোপটেমিয়ার বাসিন্দাদের কাছে দক্ষিণ এশিয়া যে ‘মেলুহা’দের বাসভূমি ছিল একথা জানার সৌভাগ্য হয়েছে আমাদের। পৌরাণিক কাহিনী, লৌকিক উপাখ্যান, এবং রাজকীয় উৎকীর্ণ লিপিতে এই মেলুহহাদের বিষয়ে পরোক্ষভাবে ছড়ানো ছেটানো তথ্য আমাদের আশা-নিরাশার দোলায় দুলিয়ে যায়। কখনো-সখনো কোন মেসোপটেমিয়ার রাজা মন্দিরের গায়ে তাঁর উৎকীর্ণ লিপিতে জানিয়ে দেন যে, মেলুহাদের জাহাজ (ভিনদেশী জাহাজ সেটি ) ইউফ্রেটিসের তীরে তাঁর রাজধানীর জেটিতে এসে ভিড়েছে।

হাতির দাঁত, কাঠ, সোনা, গাঢ় নীল রঙের দামী পাথর লাপিস-লাজোলি, ‘মূল্যবান লোভনীয় করনেলিয়ান’, এসব সামগ্রীর ভাণ্ডার হিসেবে নানান বিচিত্র সব প্রসঙ্গে বারবার মেলুহাদের নাম রয়েছে।

মেসোপোটেমিয়ার পৌরাণিক কাহিনীতে পাতালের দেবতার নাম এনকি। এই পাতালের দেবতা এনকি যে কয়েকটা এলাকায় তাঁর আশীর্বাদ বর্ষণ করছেন, তার মধ্যে রয়েছে মেসোপোটেমিয়া, পশ্চিম আর উত্তরের স্তেপভূমি আর মেলুহাদের দেশ।মেলুহাদের উদ্দেশ্যে এনকির আশির্বাণী হল, “কালো দেশ, তোমার বৃক্ষরাজি হোক সু-উচ্চ, রাজপ্রাসাদে সিংহাসন সদাপূর্ণ থাকুক…যুদ্ধক্ষেত্রে তোমার বীর নায়করা তাদের অস্ত্রে ভূলোকজয়ী হোক; তোমার বৃষদল হয়ে উঠুক বিশাল আকৃতির…তোমার পক্ষীকূল হোক ‘হাজা’ পক্ষী, তাদের কলরবে সদা মুখরিত হোক রাজপ্রাসাদ।” আমাদের অব্যবহিত সিদ্ধান্ত হতে পারে যে, গবাদি পশুরা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, আবার সেই সঙ্গে বিশেষ বিশেষ আসবাবের জন্যে ভালো কাঠ ও খুব জরুরী। ‘হাজা’ পক্ষী সম্ভবত ময়ূর। কিন্তু দেশের রঙ কালো কেন? সহজতম ব্যাখ্যাটি হল, দেশের মানুষগুলো বা মেলুহারা যেহেতু কালো চামড়ার।সুতরাং এক্ষেত্রেও আর্য উপস্থিতির কোন প্রমাণ নেই। (চলবে)

0 comments: