0

ছোটগল্পঃ মুস্তাইন সুজাত

Posted in


ছোটগল্প


বেঁচে থাকা
মুস্তাইন সুজাত 





এক 


সংসারে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক গরল-মধুর। কোনটা কখন উপচায় ঠাহর করা মুশকিল। এ সংসার যেমন একটা রঙ্গমঞ্চ, তেমনি এখানে সমস্ত সম্পর্কের শৃঙ্খল বেড়ি পরা মানব-মানবীরা এক একজন কুশলী নট-নটী।প্রথম দেখায় হুট করে বোঝা যায় না যাপিত জীবনে কে কতটা সুখী আর কে কতটা দুঃখী! ওরা সহজে বাইরের জগতে দাম্পত্য কলহ বুঝতে দেয় না। এই বুঝতে না দেয়া যেমন ওদের সহজাত, তেমনি ধরা পড়ে যাবার ভয়টাও এই সমাজে ভীতিকর।

সরকারি প্রাইমারি স্কুলের রিটায়ার্ড প্রধান শিক্ষক রুসাফ হুসাইন একসময় ধরা পড়ে যায় নিজের কাছে।যখন বুঝতে পারে এই সংসার অর্থহীন, তখন অতিক্রান্ত দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ফিরে আসার আর কোনও সুযোগ থাকে না।

রুসাফ হুসাইন তেষট্টিতে এসে এটুকুও বুঝতে পেরেছে, যৌবনে যে মানুষটা প্রচণ্ড প্রতাপে সংসার সামলেছে–সংসারের প্রতিটা সুতো টান টান করে ধরে সাধ্যমত ঠিক রেখেছে সাম্যতা–শেষ বয়সে সে মানুষটাই অদ্ভুত রকম নিঃসঙ্গ।আগের মত ঠিক তালে লয়ে আর মিলছে না। কোথায় যেন ভাঙ্গনের সুর, চিনচনে একফালি দুঃখ বুক এফোঁড় ওফোঁড় করা, করুণ হয়ে বাজে।এই দুঃখ প্রতিনিয়ত সর্বত্র ছড়িয়ে যাচ্ছে। তখন পরিচিত চারপাশ যেন উপহাস করতে থাকে বুড়ো মানুষটাকে।রুসাফ হুসাইনের মনে হয়, এই যে উপহাস করা, এ করুণাও নয় কি? তবে উপহাসই হোক আর করুণাই–এবয়সে সবই মেনে নিতে হয় কিংবা গ্রহণ করতে হয়।

বিয়েটা বড্ড কম বয়সে হয়েছিল রুসাফ হুসাইনের।এতো তাড়াতাড়ি বিয়েতে ইচ্ছে ছিল না তার মোটেও। তবু বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়েছিল মায়ের জোরাজুরিতে।বাবারও অনীহা ছিলএই অল্প বয়সের বিয়েতে।তিনি চাইছিলেন আর ক’টা দিন যাক! এতো তাড়াহুড়া কিসের? অদৃষ্টের কারণেই হোক আর ভাগ্যের নির্মম পরিহাসেই হোক, বাবার মৃত্যুটা হয়েছিল হঠাৎই। তাছাড়া জ্ঞান হবার পর থেকে সে তো দেখে আসছে, বাইরে প্রচণ্ড প্রতাপশালী পিতা মাহতাব হুসাইন স্ত্রীর কাছে ছিলেন কতটা অসহায়! মৃত্যু না হলেও এ বিয়ে ঠেকানো যে মাহতাব হুসাইনের সাধ্যের মধ্যে ছিল না, তা রুসাফ ভাল করেই জানতো।উপরন্তু বাবার এ অকস্মাৎ মৃত্যুটা দুই বছর বেশি সময় পাইয়ে দেয় তাকে। বিয়েটা হয় যখন, তার বয়স মোটে বাইশ।প্রমত্ত নদীর মত তার উত্তাল যৌবন। সদ্য পড়াশুনার পাট চুকিয়ে বেরিয়েছে। এ বয়েসেই অনেকের বিয়ে হয়। আরো কমেও হয়।তবে যাদের হয় তারা অন্য সমাজের, অন্য দর্শনের।

মাহতাব হুসাইন তখন জীবিত।নিজ যোগ্যতায় যে চাকরিটা জুটিয়ে ভবিষ্যৎ গড়বে বলে ছেলে জানিয়েছিল, তাতে তাঁর দ্বিমত তো ছিলইনা, বরং তিনি ছেলের উপর সন্তুষ্ট ছিলেন।দুর্নীতির বাজারে সরকারি চাকরি জুটানো চাট্টিখানি কথা নয়, তিনি জানতেন। ছেলেমেয়েদের ইচ্ছের প্রাধান্য তাঁর কাছে বরাবর ছিল। ছিল না ওদের মায়ের কাছে।আর ছিল না বলেই মায়ের কথামত চলতে হয়েছে সবাইকে, এমনকি তাকেও।

রুকসানা রুকিকে বিয়ে করে একচল্লিশ বছর কাটিয়ে দিয়েছে রুসাফ। কত ঝড় ঝাপটা, কত উথাল পাথাল ঢেউ গেছে এই সংসারের উপর দিয়ে–সেদিন গুলোর কথা মনে হলে গা কাঁটা দিয়ে ওঠে। মাথা গোঁজার একখানা ঠাঁই ছিল বটে, বাদ বাকি সব কিছু তো নিজেকেই সামাল দিতে হয়েছে।বাড়িটা না থাকলে কবেই গাছতলায় দাঁড়াতে হত! তার বাবা মাহতাব হুসাইন পৈতৃক সূত্রে যে বাড়িটা পেয়েছিলেন, তা নিতান্ত ছোট নয়। দু’তলা বাড়ির নিচ তলায় পাঁচ রুম। ছাদে চিলেকোঠা। সামনে বিশাল ছাদ। ছাদ ছাড়িয়ে মুক্ত আকাশ।কত বিকেল যে কাটিয়েছে ঘুড়িদের ওড়াউড়ি দেখে! কত চাঁদনি রাত যে ভোর করেছে ছাদে ইজিচেয়ার পেতে আকাশের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে!

মাঝে মধ্যে এই বোধ হয় তার, বিবাহিত দীর্ঘ সময়টা–এই তো সেদিন শুরু হল!ষোল-সতের বছরের এক কিশোরীকে ঘরের বউ করে এনেছিলেন মা। লজ্জায়-আড়ষ্টতায় কেমন কুঁকড়ে ছিল বাসরে মেয়েটি।একসময় লজ্জা কাটে। ক্রমে ক্রমে ভাব হয় দুজনার।বন্ধুত্ব হয়।এরপর মা মারা যান একদিন।ওরা ততদিনে জনক-জননী হয়ে উঠে।দুই মেয়ে তিন ছেলেকে নিয়ে পরিবার।দুইমেয়েই এখন স্বামীর সংসার আগলাচ্ছে।দুই ছেলেরও বিয়ে দিয়েছে।সবার ছোট ছেলেটা বাকি। এরপর ঝাড়া হাত পা।তারপর একদিন চিরবিদায়। দেখতে দেখতে দুই প্রজন্মের ইতি।

ইদানিং স্ত্রীর সাথে শীতল সম্পর্ক রুসাফ হুসাইনের।দরকারে কথা হয়।সংসারে থেকেও যেন সে নেই। অথচ এই সংসারের প্রতিটা জিনিসে আছে তার আয়ের ছোঁয়া। তার উপার্জিত টাকায় এসেছে এখনকার যা কিছু আভিজাত্য। রুকি সে কথা অস্বীকার না করলেও যেন স্বীকার করতে চায় না।ইচ্ছে করেই একটু পাশে ঠেলে রাখে তাকে। কিন্তু কেন? এতোই যখন উপেক্ষা, তখন একই রুমে একই বিছানায় পাশাপাশি শোয়ার তাৎপর্য খুঁজে পায় না রুসাফ হুসাইন।দুই জন বিশাল খাটের দুই পাশে শুয়ে আছে, কথা নেই পরস্পরের, সহবত নেই একে অপরের প্রতি– এ যেন কেবলই কাল যাপনের আয়োজন! কি দরকার এই অভিনয়ের? রুসাফ হুসাইন সম্পর্কের এ নাজুক রেশটুকুও ছিঁড়ে ফেলতে চায়। একেবারে মুক্তি চায় সে।

অথচ সে টের পায়, কোথায় যেন একটা অদৃশ্য সুতো বাঁধা আছে।কার সাথে?স্ত্রী, সন্তান, নাকি এই পৈতৃক বাড়ি? অদৃশ্য সুতোর মূলটা খুঁজতে গিয়ে প্রায়ই হারিয়ে যায় অতীতে। রুকসানাকে দেখতে যাওয়া– প্রথম দেখা–পছন্দ–বিয়ে। সেই থেকে আজ অবধি দীর্ঘ যাপিত সময়ে...


দুই 


সে ছিল সপ্তম বারের মত পাত্রী দেখা। রুসাফের অবশ্যওটা দ্বিতীয়। নিজের জন্য পাত্রী দেখতে যেতে তার বরাবরই অনীহা ছিল। তার মনে হত, হত কি এখনো হয়, পাত্র যেন হাটে তোলা কুরবানির পশু। সেজেগুজে যাও, চুপচাপ বসে থাকো শো-পিসের মত।তবু পাত্রীপক্ষ যখন এতো করে বলে, তখন তো যেতেই হয়।প্রথমবার যখন গিয়েছিল, তখন পাত্রী পছন্দ হয়নি বোনেদের।নিজের অনিচ্ছার কথা বলার আগেই বোনরা নাকচ করে দিয়েছিল।

সপ্তম বারের আয়োজনে রুসাফের সাথের পাঁচজনই ঘরের সদস্য। ঘটক সহ ছ’জন। প্রফেশনাল ঘটক নয়, ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে দূর সম্পর্কের আত্মীয়–দুই কুলেরই।ফলে নিজেদের লোকই বলা যায় তাকে। প্রাথমিক খোঁজ খবর আগেই নেওয়া শেষ উভয় পক্ষের। এরপর অনেকদিন ধরে দেখাদেখির পর্বটা ঝুলছিল। একপক্ষের সুবিধা হয় তো অন্যপক্ষের সমস্যা। অবশেষে স্থির হয় আসছে ঈদের পরদিন দুপুরে পাত্র পক্ষ পাত্রী দেখতে যাবে।

পাত্রীর বাড়ি যেখানে, সেটা ভাটি অঞ্চল।অঞ্চল ভেদে উজান ভাটি ভাগ আছে।এখানে উজান ভাটি চেনা যায় ভরা মৌসুমে জলের স্থায়িত্ব, জলের পরিমাপ, জলের গতিবিধি দেখে।ভাটি অঞ্চল সাধারণত নিচু উজানের চেয়ে, ফলে বর্ষার জল উজান বেয়ে গিয়ে জমা হয় ভাটিতে।এ সময় ভাটি এলাকায় নৌকাই প্রধান যাতায়াত বাহন হয়ে ওঠে।উজান থেকে ভাটি অঞ্চলে যখন কেউ আত্মীয়তা করতে চায় কিংবা যায়, তখন ভাটি অঞ্চলের মানুষজন একটু বেশিই সতর্ক থাকে। খাতির-যত্নে, আদর-আপ্যায়নে যেন কোনও কমতি না হয়।ওরা জানে, উজানের মানুষরা ওদের থেকে অনেকটা এগিয়ে আছে শিক্ষা-দীক্ষায়, আবাসে-পরিবেশে, রস্তা-ঘাটে, কৃষ্টিতে-কালচারে। ফলে উজানের প্রতি তাদের এক ধরনের দুর্বলতা কিংবা মোহ কাজ করে –আর এটাই ওদের তটস্থ করে রাখে সবসময়। উজানের মানুষজনও তা অনুধাবন করতে পারে।

সেদিন সাদা মারুতিটা যখন মূল রাস্তা থেকে নেমে নদীঘাটের কাছাকাছি পৌঁছেছিল, মাঝ বয়সী একজন লোককে দেখতে পায়, ধোপাদুরস্ত শার্ট প্যান্ট পরে দাঁড়িয়ে আছেন। চোখের অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি দেখেই বোঝা যাচ্ছিল তিনি কারো জন্যঅপেক্ষা করছেন।গাড়ি থামতেই এগিয়ে এসে হাসি মুখে পরিচয় দেন নিজের। ইনি পাত্রীর মেজো মামা। তীব্র রোদ তখন।অদূরে নদীঘাটে কয়েকটা ডিঙ্গি আর যাত্রী নৌকা ভেড়ানো ইতস্তত।এখানে ওখানে মাছের জাল শুকাতে দিয়ে উদোম গায়ে মাঝিরা বসে খোশগল্পে মশগুল।বাতাসে মাছের আঁশটে গন্ধ।ওদের ঘর্মাক্ত, রোদে পোড়া শরীর যেন নৌকার গলুইয়ের সাথে মিশে গেছে একাকার হয়ে। বাজারি মানুষজন আর দূর ময়ালের যাত্রীরা রাস্তায় চলাচল করছে। সামগ্রিক পরিবেশের সাথে পাত্রীর মেজো মামার বেশভূষা ঠিক মত খাপ খাচ্ছিল না। তিনি নিজেও বুঝতে পারছিলেন বোধহয়। মেহ্‌মানদের নিতে এসেছেন তাই, নইলে লুঙ্গি পরেই আসতেন–এরকম মনোভাব তাঁর।

রাস্তাটা ছিল যেমন কাঁচা আর সরু, তেমনি সর্পিল। কোথাও দেখা যাচ্ছিল জমাট বাঁধা কাদার দলা, আবার কোথাও কাদার সাথে চিপচিপে পানি।তবে রাস্তার কিনার ছড়িয়েছিল কেবলই জল আর জল।জলে ছোট ঢেউ, ঝিরঝিরে বাতাস বইছে ঢেউগুলোর মাথা ছুঁয়ে।পানকৌড়ির দল ডুবছিল ভাসছিল এক নাগারে। বালি হাঁস, লেঞ্জি হাঁসের ঝাঁক উড়ে যাচ্ছিল দূরের দিকে।চিলতে নদীটা এখানেও ছিল, কিন্তু বোঝা যাচ্ছিল না তার গতিরেখা। মূল রাস্তা থেকে নেমে এই কাঁচা রাস্তা ধরে গাড়িটা যখন ধুঁকে ধুঁকে এসে থেমেছিল কুলিরচর বাজারে কালিচাঁদের মিষ্টির দোকানের সামনে, তখনও নদীটা ছিল একপাশে সরব।এখানে বিলীন-চিহ্নটুকুও আর অবশিষ্ট নেই। রাস্তার পাশের অজস্র জলরাশি নদীকে মুছে দিয়েছে একদম। ভরা মৌসুমে নাকি এমনই হয়, নদী মিশে যায় বিলে আর বিল মিশে যায় নদীতে।

গাড়ি আর সামনে এগোবে না বলে ওখানে নেমে পায়ে হেঁটে খানিকটা পথ যেতে হয়েছিল তাদের। প্রথমে থেমেছিল পাত্রীর মামা বাড়ি। কিছুক্ষণ বিশ্রাম।ওখান থেকে আরও ভেতরের দিকে মিনিট পনেরোর রাস্তা হাঁটলেই মূল গন্তব্য–পাত্রীর বাড়ি।

পাত্রীর মামা বাড়ি থেকে সেদিন আট জনের দলটা যখন হাঁটা দেয় পশ্চিম দিকের সরু অলিগলি ধরে, এ বাড়ির পেছনদিক, ও বাড়ির সামনা খানা মারিয়ে, তখনো তেতানো রোদ ঝরছে খাড়াভাবে। আশ্বিন শেষেও ভ্যাপসা গরমে অস্থির চারদিক। এক বাঁশের যে সাঁকোটা ওরা পার হয়ে এপারে এলো–সাক্ষাৎ পুল সে রাত।অভ্যস্তদের চার-পাঁচ মিনিটের জায়গাতে ওদের লেগেছিল যে দীর্ঘ সময়, মনে হল যেন অনাদিকাল লাগলো পেরোতে, কতকটা ধুঁকে ধুঁকে।

দলের পুরোভাগে রুখসানার মেজোমামি দিলারা হক। দিলারা হক হনহনিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন কিন্তু অন্যদের একটু আস্তে আস্তে এগোতে হচ্ছিল। বিশেষ করে পাত্রপক্ষের মহিলাদের।একে তো সরু, প্যাঁচানো পথ, তার উপর আশপাশের বাড়ি ঘরের জানালায়, বেড়ার ফাঁক ফোঁকরে একাধিক জোড়া করে চোখ নজরে পড়ছে তাকালেই।কাছে পিঠে থেকে যারা দেখছে, তাদের কথার ফুসুর ফাসুর কানে আসছে অস্পষ্ট। গ্রামের পথে হাঁটতে গেলে এই এক অসুবিধে–নতুন কেউ এলেই যেন ওদের চুপিচুপি দেখা চাই। দেখার পর খবর নেওয়া চাই–কার বাড়িতে এসেছে? কেন এসেছে? এরপর নানা আঙ্গিকে কথার যাবর কাটা চাই।অনেক দিন ওদিকে যাওয়া হয় না। রুসাফ ভাবছে, এখনও কি এমন হয়?

যে বাড়িটার উঠানে এসে দাঁড়ালো ওরা, সেটা একতলা পাকাবাড়ি। উপরে টিনের চালা।পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার ছাপ স্পষ্ট। বাড়িতে মানুষের তেমন সাড়া শব্দ নেই। এরকম আয়োজনে ন্যূনতম যেটুকু হাঁকডাক হবার কথা, তার কিছুটাও নেই। কেবল ঘরের লোকগুলো একটু সতর্ক। রুকসানার বাবা এগিয়ে এসে পরিচিত হন এবং তাঁর ছোট দুই ছেলের পরিচয় করিয়ে দেন সবার সাথে।ওরা বসেছিল ড্রয়িং রুমে। দিলারা হক রুখসানার খোঁজ নিতে ভেতর দিকে চলে যান।

রুকসানা তখন তার রুমের জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে। দূরে বিলের পানিতে ভাসমান দুটো ডিঙ্গি দেখা যাচ্ছে। সেদিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ডিঙ্গির মানুষগুলোকে চেনার চেষ্টা করছিল। এতো দূর থেকে কেবল ওদের কুচকুচে কালো শরীরকে বোঝা যাচ্ছে। চেহারা চেনা যাচ্ছে না। জেলে হবে হয়তো। ঠিক তখনই একটা দোয়েল শিস তোলে মাচানের দিকটায়।জানালার সামনে দিয়ে ফুড়ুৎ করে উড়ে গেল কয়েকটা চড়ুই। রুখসানার একাগ্রতা খান খান হয়ে ভেঙ্গে পড়লো কাচের মতন।আর তাতে ভর করেই যেন তার মামীর ডাক কানে পৌঁছল।

রুসাফের ছবিটা রুখসানার পড়ার টেবিলের উপর পড়েছিল কিছুদিন থেকে।পাত্রের ছবি দেখে সবারই পছন্দ হয়েছে। বনেদী শিক্ষিত পরিবারের ছেলে।কোন ঝুট ঝামেলা নেই।বড় বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। রুসাফের জন্য পাত্রী দেখছেন, বিয়েটা হয়ে গেলেই ছোট ভাইকেও বিয়ে দেবেন তার মা। বাবা বেঁচে নেই। এরকম পরিবার সহজে মেলে না। রুখসানার বাবা আগেই একদিন গিয়ে রুসাফের বাড়িঘর দেখে এসেছেন। ভাল লেগেছে তাঁর।এবার রুখসানাকে ওদের পছন্দ হলেই হয়। একখানা ফটোগ্রাফও দিয়েছিল পাত্র পক্ষকে, ওরাও পছন্দ হয়েছে বলে জানিয়েছে। কিন্তু ফটোগ্রাফটা ছিল প্রায় আট বছর আগের, রুখসানা যখন ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দেয়, তখনকার।এই দীর্ঘ সময়ে রুকসানা বদলে গেছে।বাবার দৃষ্টিতেই আমূল পাল্টেছে।এখন দেখতে সে সম্পূর্ণ অন্যরকম হয়ে গেছে।আগের সেই লাবণ্যতা নেই চেহারায়। কেমন যেন উদাসী হয়ে যাচ্ছে দিন দিন।বাবার মনে শংকা উকি দেয়–ওরা এই রুকসানাকে পছন্দ করবে তো!

এরকম আয়োজনে সাজতে হয়–নতুন কাপড় পরে পাত্রীকে নিয়ে যেতে হয় পাত্র পক্ষের সামনে। রুকসানার ক্ষেত্রে এর কিছুই হয়নি সেদিন–না নতুন কাপড়, না সাজগোজ। তবে আপ্যায়ন, আতিথেয়তার কোন কমতি ছিল না ওদের। সমস্ত ফর্মালিটি শেষে রুকসানা যখন চায়ের ট্রে হাতে নিয়ে ড্রয়িং রুমে ঢুকেছিল, তখন পিন পড়ার নীরবতা। রুসাফ একবার আড় চোখে চেয়ে নিয়েছিল সাথে সাথেই। রুকসানাও কি তাকিয়ে ছিল তখন? রুসাফের সাথে যে ক্ষণিকের চোখাচোখি, তাকিয়েছে বলেই তো মনে হল তার! নাকি এ ভ্রম! নাকি ফটোগ্রাফে দেখা রুকসানার আট বছর আগের চোখই ভেসে উঠলো রুসাফে চোখে! তবে সে চোখে ছিল ঘোর বিস্ময়।

চেয়ারে বসার পর অন্যরা যখন রুকসানার দিকে তাকালো, চমকের পালা।একেবারে যেন কোনও মিলই নেই ছবির সাথে, আশ্চর্য! দিলারা হক রুকসানার পাশে। তিনি আজ হালকা সেজেছেন। তাঁর সাজাটা ঠিক হয়নি। পাত্রী তো তিনি নন, ফলে পরিবেশটা বেমানান লাগছে। বয়সের অনেক পার্থক্য থাকলেও দিলারা হককে অনেক সুন্দর লাগছিল দেখতে।

রুসাফের বোনদের নানা প্রশ্নে রুকসানাকে একটু বিব্রত দেখাচ্ছিল।পাত্রী দেখায় এমন হয়। কালেমা-নামাজ, সুরা-কালাম থেকে শুরু করে হাতের লেখা পর্যন্ত দেখা হয়। চুল, হাঁটা সব।কিন্তু সেখানে এরকম হয়নি।কারণ পাত্র পক্ষের সাথে দাদা-নানাগোছের কেউ ছিল না।তা না হলে কত কিছুর উত্তর যে দিতে হত! রুকসানা সম্পর্কে যতটুকু না জানলেই নয় কেবল ততটুকুই জিজ্ঞেস করেছে। প্রথমে একটু নার্ভাস হলেও শেষদিকে নিজেকে বেশ গুছিয়ে নিয়েছিল। তারপরও যেখানে যেখানে আটকে গেছে কিংবা যাচ্ছিল, দিলারা হক পার করে নিয়ে গেছিলেন। ফলে দেখাদেখির পাট চুকিয়ে একটা মতামত জানাবে বলে ওরা সেদিনের মত বিদায় নেয়।


তিন


রুসাফ হুসাইন এখন ছাদে। ঘরকুনো স্বভাবের জন্য কোনও কালেই তার তেমন বন্ধু জোটেনি যে অবসর সময়টা আড্ডায় কাটাবে। ছাদে চিলেকোঠার ব্যাবস্থা নিজেই করেছে।পুরনো যে ইজি চেয়ারটায় হেলান দিয়ে বসে আছে, সেটাও জীর্ণ হয়ে গেছে। চাকরির মাঝামাঝি সময়ে কিনেছিল ওটা। কিছুদিন রুমে ছিল, এরপর চিলেকোঠায় ঠাঁই হয়েছে। চাকরি জীবনে খুব একটা অবসর পেতনা রুসাফ। প্রতিষ্ঠান প্রধানের দায়িত্বে ছিল সে। ছুটিছাটায় মাঝে মধ্যে ছাদে সময় কাটাতো। তখনওই সময়টুকু ছিল তার একান্ত নিজস্ব। এই নিজস্বতা ওখান খান হয়ে যেত ছেলেমেয়েদের কলরবে। রুকসানাও কি ডাকতে আসতো না কখনো সখনো?

তার মনে ভাসে প্রথম সন্তানের জন্মের আগের মুহূর্তের কথা। সে এক চমৎকার অনুভূতি। রুকসানাকে যখন ডেলিভারি রুমে ঢুকানো হয় বলছিল, 

-কেমন ভয় ভয় করছে আমার। যদি মরে যাই?

-আমিও মরে যাব বলে রাখছি।

কত আর বয়েস তখন রুসাফের? বিয়ের দুই বছর সবে গড়াল। এরপর পাঁচ পাঁচটা শিশুর জন্ম দিল রুকু। কিচ্ছু হয়নি। এখন ভাবে, রুকসানা সেদিন মরে গেলে রুসাফও কি মরে যেত? এরকমই তো বলেছিল সে।কি জানি? নিজের মনেই বিড়বিড় করে। হাসে।

এই তেষট্টি বছরেও রুসাফ হুসাইন বেশ আছে।কোনও জটিল রোগ নেই, নিজের কাজটুকু নিজেই করে নিতে পারে।তবে কিছুদিন ধরে হাঁটুতে-কোমরে একটু ব্যথা অনুভব করছে।ডঃ হাসনাতের কাছে গিয়েছিল গেল সপ্তাহে। ডঃ হাসনাত তার বন্ধুসম এবং পারিবারিক চিকিৎসক। দুশ্চিন্তা করতে একদম বারণ করেছে। দুশ্চিন্তা থেকেই নাকি সবরকম রোগের উৎপত্তি। আর এই বয়সে তো আরো চিন্তামুক্ত থাকতে হবে। চাপমুক্ত থাকতে হবে।

একদা ভরাট বাড়িটা এখন খাঁখাঁ করে।বড় দুই ছেলে দেশের বাইরে স্থায়ী হয়েছে বউ-ছেলেমেয়ে নিয়ে। বছর চার-পাঁচ পর একবার আসে। মাস কয়েক থেকে চলে যায়। তখন মেয়েরাও আসে। নাতি নাতনিদের হইহুল্লোড় দাপাদাপিতে চারদিক মুখর থাকে। ওরা চলে গেলে চারদিক শুনশান। কেবল দুটি প্রাণীতে দিনের পর দিন মাসের পর মাস পার করে দিচ্ছে। ছোট ছেলেটা কখন ঘরে ঢোকে আর কখন বেরিয়ে যায় বলতে পারে না রুসাফ। ঠিকে চাকরের সাথে যা কিছু টুকটাক কথা হয়। এটা ওটা জিজ্ঞেস করে নেয় তখন।

-তুমি এখানে বসে আছ? আর আমি খুঁজে খুঁজে হয়রান।

কত কতদিন পর তার রুকু এভাবে খুঁজতে এলো, রুসাফ মনে করতে পারলনা।

চিলেঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে রুকসানা। মেঘলা আকাশে গোটাকয় রঙ্গিন ঘুড়ি এখনও উড়ছে।হয়তো বৃষ্টি নামার আগে শেষ চক্কর খেলিয়ে নিচ্ছে।‘তুমি এখানে বসে আছ? আর আমি খুঁজে খুঁজে হয়রান।’–কথাটার রেশ কাটছে না মন থেকে। কেন সে বসে আছে? কি উত্তর দেবে রুসাফ? নাকি মুখ ফুটে বলেই বসবে–শুধু তোমার জন্য! না থাক।

বৃষ্টি নামছে এখন।ফোঁটা ফোঁটা মুক্তোজল যেন। চেয়ারে ঝিম মেরে বসে সে ভিজছে। রুকসানা এসে তাকে টেনে নিয়ে যেতে চাইছে চিলেঘরের দিকে।তন্দ্রাহতের মত রুসাফ রুকসানার পেছন পেছন হাঁটতে চাইছে। একটু আগে যে মানুষটা চেয়েছিল যে সে বুড়ো হয়ে গেছে এই ভেবে তার জীবনের মায়া কমে গেছে–এক্ষণে, এই মুহূর্তে সে মানুষটারই মনে হচ্ছে–কেন যেন সে আরো আরো অনেকদিন বাঁচতে চায়।



0 comments: