0

প্রবন্ধঃ রতন বসু মজুমদার

Posted in


প্রবন্ধ


বাঙালি জাতিসত্তার সঙ্কট
রতন বসু মজুমদার



বাংলার বর্ষপঞ্জি ইতিহাসের নিরিখে মাত্র পাঁচটি শতক পেরিয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন বর্ষপঞ্জি কোনও না কোনও ধর্মীয় অনুষঙ্গে যুক্ত। বঙ্গাব্দ শুরু হয়েছিল মোগল বাদশা আকবরের আমলে। শুরু হয়েছিল চোদ্দশ বছর আগের ঘটনাকে যাত্রাবিন্দু হিসেবে গণ্য করে। ভারতবর্ষ, বিশেষত বাংলার ইতিহাসে মিলন-মিশ্রণ-সমন্বয়কারী বিবিধ উপাদানের মতো বাংলা বর্ষ ধারণ করেছিল হিন্দু-মুসলিম ও বিভিন্ন লৌকিক উপাদনের স্মারক। পাঁচশ বছর আগে সুবে বাংলায় ফসল উৎপাদনের চক্রের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে রাজস্ব আদায়ের সুবিধার জন্য সম্রাট আকবর এই বর্ষপঞ্জির প্রবর্তন করেছিলেন। বর্ষপঞ্জির মাস গণনার ভিত্তি হিসেবে ধরা হয়েছে লৌকিক ও হিন্দু দেবতাশ্রিত রীতিনীতি। বিভিন্ন নক্ষত্র স্মারক হিসেবে নির্ধারিত হয়েছে বিভিন্ন মাসের এবং বর্ষসূচক হিসেবে নির্ধারিত হয়েছে মক্কা থেকে মদিনায় হজরত মহম্মদের হিজরতের ঘটনা তথা হিজরি সাল। এই বর্ষপঞ্জি অচিরেই সমগ্র বাংলার মানুষের কাছে আদৃত হয়ে ওঠে। এই বর্ষপঞ্জির গ্রহণযোগ্যতার আর একটি কারণ হল সেই সময় প্রথমবারের মতো মোগল কর্তৃত্ব শিথিল হয়ে এসেছিল। এক পূর্ণাঙ্গ জাতিরাষ্ট্রের আকার নিতে শুরু করেছিল বাংলা। সমতট, পুণ্ড্র, বরেন্দ্র, বাঙাল, হরিকেল, ইত্যাদি অঞ্চল তার ভাষাগত সাযুজ্য সত্বেও কখনোই রাজনৈতিক অখণ্ডতা গড়ে তুলতে সক্ষম হয়নি। মোগল কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা সেই রাজনৈতিক ঐক্যের একটি বাতাবরণ গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিল। সেই সময় থেকেই সমগ্র অঞ্চল ‘বাঙাল’ অভিধায় চিহ্নিত হতে শুরু করে। ফসলি সাল হিসেবে রাজস্ব আদায়ের সময়সূচি চিহ্নিত বঙ্গাব্দের প্রচলন প্রকৃত অর্থেই সমগ্র ভূখণ্ডে সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠেন জনপদের মানুষ। বাঙালির সমন্বয়বাদী জীবনচেতনা এবং হিন্দু-মুসলিম লৌকিক বিভিন্ন ধারার মিশ্রণে উদ্ভূত এই পঞ্জিকা বাঙালির জাতিগত বিকাশের পথ প্রশস্ত করেছিল। ইতিহাসের নানা চড়াই উতরাই পেরিয়ে এই বর্ষপঞ্জি আজ বাঙালির চেতনায় এক নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করে চলেছে।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঋতুভিত্তিক যে উৎসবগুলির সূচনা করেছিলেন, তারও ভিত্তি ছিল এই বর্ষপঞ্জি। বর্ষামঙ্গল, শারদ উৎসব, পৌষমেলা, বসন্ত উৎসব, নববর্ষ উৎসব, বৃক্ষরোপণ, হলকর্ষণ, নবান্ন – এইসব উৎসবই ছিল বাঙালির সপ্রাণ সাংস্কৃতিক উৎসব। আর এই সব উৎসবের মধ্য দিয়েই ধর্ম, শ্রেণী নির্বিশেষে সমগ্র বাঙালি জাতির সাংস্কৃতিক চেতনার প্রকাশ ঘটত। কোনও ধর্মীয় অনুষঙ্গ না থাকায় উৎসবগুলি সমগ্র বাঙালি জাতির মহামিলন ক্ষেত্র হিসেবে পূর্ণ প্রকাশিত হত। নানা লৌকিক উপাচার নানাভাবে বাঙালির সাংস্কৃতিক চেতনার আকর হয়ে উঠত। একাত্ম হয়ে উঠতে পারত বাঙালি জাতির সব অংশের মানুষ। পিরের দরগা, চণ্ডীমণ্ডপ, দরবেশের চামর, সবই ছিল হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সব বাঙালির একান্ত আপন। বাঙালি কখন নিজের অজান্তেই হিন্দুদের সত্যনারায়ণ আর গাজিপিরের সম্মিলনে গড়ে তুলেছে সত্যপিরের আখড়া। সাঁওতাল গ্রামের যে শালগাছটি বিশেষ ভাবে পূজিত হয় সব গ্রামবাসীদের দ্বারা, সেই শালগাছের তলায় নুড়ি পাথরের বৃত্ত গড়ে তোলেন গ্রামবাসীরা। সেই বৃত্তাকার পাথরের স্তূপ থেকে পাথর সংগ্রহ করে কখন কোন এক ব্রাহ্মণ শালগ্রাম শিলা সংগ্রহ করেছিলেন, জানা নেই। অথচ অতি পবিত্র সেই শালগ্রামশিলার সঙ্গে হাজার হাজার বছরের আদিবাসী সাঁওতাল সম্প্রদায়ের নিবিড় সম্পৃক্ততার খবর আমরা ক’জনই বা জানি? বাঙালি হিন্দু রমণীদের মাথার সিঁদুর বা ধান-দুর্বা দিয়ে আশীর্বাদ করার রীতি সেই সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর কাছ থেকেই গৃহীত হয়েছে। ফলে বাঙালির আত্মচেতনায় সমন্বয়বাদী চেতনার প্রকাশ ঘটেছে বহুযুগ আগে থেকে। গ্রামীণ সমাজ চোখের মণির মতো রক্ষা করে চলেছে সেই বিপুল ব্যাপ্ত বৈচিত্র্য ও বৈভবকে। আজও প্রথাগত ধর্মকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেই বাউল ফকিররা মানব ধর্মের প্রচার করে চলেছেন, যা বিপুল সংখ্যক বাঙালির কাছে এক পরম সম্পদ। ‘মানব সত্য’ – এই বার্তাই সৃষ্টি করেছে সেই অমোঘ সত্যের আহ্বান, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’।

ধর্মীয় সঙ্কীর্ণতা বাঙালির এই বিশাল ব্যাপ্ত ঐক্য চেতনায় বারবার আঘাত করেছে। পৈতে-টিকি, টুপি-দাড়ির ধর্মীয় বিভেদের বীজ বারবার চেষ্টা করেছে সমাজের গভীরে আঘাত করার। ধর্মীয় গোঁড়ামি বারবার চেষ্টা করেছে বাঙালির এই স্বতঃসলিলা ঐক্যবোধকে ভেঙে দিতে। যখনই তারা শক্তি সঞ্চয় করেছে, তখনই সম্প্রদায়গত বিভেদ মাথা চাড়া দিয়েছে। আর এই বিভেদই শেষ পর্যন্ত বঙ্গবিভাজনের মতো এক ভয়ঙ্কর অভিশাপ ডেকে এনেছে বাঙালির হাজার বছরের সমন্বয়বাদী সমাজকে দু’টুকরো করে। একসময় বিভাজিত বাংলা পরিচিত হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ ও পূর্ব পাকিস্তান নামে। পরবর্তীকালে বাঙালি জাতিচেতনাই পূর্বপাকিস্তান নামক ভূখণ্ড থেকে পাকিস্তান শব্দটি মুছে দিয়ে এক স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছে। সাতচল্লিশে বঙ্গ বিভাজনের পরের বছর থেকেই দাবি উঠেছিল ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। সেই দাবি দাবানলের মতো আছড়ে পড়লো ১৯৫২ সালে। ভাষা আন্দোলনের রক্তাক্ত ইতিহাস রচিত হল শহিদদের আত্মবলিদানের মধ্য দিয়ে। বাংলাভাষার মর্যাদার দাবিতে সেই সংগ্রাম ক্রমশ জাতিসত্তার সংগ্রামে রূপান্তরিত হয়। শেষ পর্যন্ত দাবি ওঠে ‘বাংলা ভাষার রাষ্ট্র চাই’। ৩০ লক্ষ শহিদের রক্তে রঞ্জিত এই স্বাধীন রাষ্ট্র জন্ম নেয়, যা বাঙালির একান্তই নিজের।

ধর্মের ভিত্ততে ভারত তথা বঙ্গ বিভাজনের ফলে অবিভক্ত বাংলার পশ্চিমাঞ্চল যুক্ত হয় ভারতরাষ্ট্রে। বিভক্ত এই রাজ্যটির নাম হয় ওয়েস্ট বেঙ্গল। ব্রিটিশ ভারতের নর্দার্ন প্রভিন্স বা সেন্ট্রাল প্রভিন্স যথাক্রমে উত্তরপ্রদেশ বা মধ্যপ্রদেশ বলে চিহ্নিত হলেও স্বাধীন ভারতে ওয়েস্ট বেঙ্গল পশ্চিমবঙ্গ হয়ে উঠতে পারেনি আজও। সংবিধানে আজও আমরা ওয়েস্ট বেঙ্গলের অধিবাসী, পশ্চিমবঙ্গের নয়। সাত দশকেও রাজ্যের শাসককুল কখনোই চেষ্টা করেননি এই ভ্রম সংশোধনের। আসলে রাজ্যের নবজন্মের পর থেকেই এই বাংলার শাসন ক্ষমতায় যাঁরা ছিলেন, তাঁরা একটা পর্যায় পর্যন্ত ইন্ডিয়ান বা ভারতীয় হয়ে ওঠার সাধনায় মগ্ন ছিলেন। দ্বিতীয় পর্বে শাসককুল আন্তর্জাতিক হয়ে ওঠায় চেষ্টিত হলেন। ফলে আমাদের বাঙালিত্ব বিসর্জন দিতে কেউই দ্বিধা করেননি। বিপরীতে আবহমান বাংলার লোকজ সংস্কৃতিকে পণ্য করে অনুদান, পুরষ্কার, ভাতা, ইত্যাদির প্রলোভন দেখিয়ে শাসককুল এক ধরনের দাস সংস্কৃতির পরিমণ্ডল তৈরি করেছেন। রাজ-অনুগ্রহ বিতরণের ঢক্কানিনাদে গ্রামীণ সংস্কৃতির পরম্পরা আজ ধ্বংসের মুখে। আমাদের সারি-জারি, আউল-বাউল, ভাওয়াইয়া, গম্ভীরা, টুসু, ভাদু, ভাটিয়ালি, কবিগান, আলকাপ, সবই আজ পণ্য সংস্কৃতির শিকার।

অন্যদিকে মাতৃভাষার মর্যাদার প্রশ্নটি সম্পূর্ণ অবহেলিত। রবীন্দ্র শতবর্ষে প্রণীত রাজ্য সরকারের ভাষা সংক্রান্ত আইন আজও কার্যকর হয়নি। আজও রাজ্য সরকারের অধিকাংশ কাজে বাংলাভাষা ব্রাত্য। এ বিষয়ে যাঁদের অগ্রগণ্য ভূমিকা থাকার কথা, সেই সব তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা নিজেরাই রাজ-অনুগ্রহের প্রত্যাশায় আত্মমর্যাদাকে বন্ধক রেখেছেন। বাংলার দুখিনী বর্ণমালাও তাই এঁদের কাছে শুধুই স্বর্ণমুদ্রা অর্জনের উপকরণ মাত্র।

১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাজপথে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় যাঁরা বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছিলেন, তাঁদের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে সূচনা হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের। ১৯৬১ সালের ১৯শে মে শিলচরের ১১ জন বাংলাভাষাপ্রেমী আসাম পুলিশের বুলেট বক্ষে ধারণ করে বরাক উপত্যকায় বাংলাভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের বাংলাভাষী জনগোষ্ঠী হিন্দি ভাষার, ইংরাজি ভাষার আধিপত্যের কাছে নিজেদের বিকিয়ে দিচ্ছেন, প্রতিদিন। আসুন না, একবার, অন্তত একবার, সবাই মিলে রুখে দাঁড়াই! মিলিত কন্ঠে গেয়ে উঠি ‘যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক আমি তোমায় ছাড়ব না মা’ ।।

0 comments: