0

ধারাবাহিকঃ বিশ্বনাথ রায়

Posted in


ধারাবাহিক

‘যাবনী মিশাল ভাষা’র সন্ধানে
বিশ্বনাথ রায়




দু’টি দৃষ্টান্ত সংগ্রহ করে অনুসন্ধানে অগ্রসর হওয়া যাক:

১ম দৃষ্টান্ত

এই মতে মুনাজাত            করে মর্দ্দ জুর হাত
একি দাতে আল্লার দরগাএ।
এলাহি হইল সখা       এল মর্দ্দ পাইল দেখা
খিজরির মত সেই পথে।।
     পাগুরি আর জুব্বা গাএ       খরম আছিল পাএ
তসবি গলে আসাসে মুছার।
হানিফারে দেখি মর্দ্দ           দিলেত ভাবিয়া দর্দ্দ
পোছে কেনে আছ হে লাচার।।


২য় দৃষ্টান্ত


রামজীর কুদরতে                       মহিম হইল ফতে
কেবল তোমারি কিরামত।
হুকুম শাহন শাহী                      আর কিছু নাহি চাহি
জের হৈল নিমকহারাম।।
গোলাম গোলামী কৈল         গালিম কয়েদ হৈল
বাহাদুরী সাহেবের নাম।
পাতশা হইলা খুশি             কহিতে লাগিলা তুষি
কহ রায় কি চাহ ইনাম।।


আপাতদৃষ্টিতে যে কোনও সাধারণ পাঠকের মনে হতে পারে দুটি দৃষ্টান্তই কোনও একজন কবির কলম থেকে নির্গত কবিতা অংশ। দুটি দৃষ্টান্ত একই ভাষায় লেখা। তফাৎ শুধু প্রথমটির ভাষা একটু অমার্জিত, দ্বিতীয়টি তুলনামূলকভাবে পরিশীলিত।

আসলে দৃষ্টান্ত দু’টি একজন কবির লেখা নয় একেবারেই। দু’জন কবির লেখা দু্’টি কাব্য থেকে চয়ন করা। দু’জন প্রায় একই কালে আবির্ভূত হয়েছিলেন এবং বর্তমান হাওড়া জেলায় তাঁদের বাসস্থানও ছিল খুবই কাছাকাছি, প্রায় একই স্থানে। প্রথম রচনাংশটি গৃহীত হয়েছে শাহ গরীবুল্লাহ-র(জন্ম সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ দিকে; প্রয়াণ ১৯৮০? খ্রিস্টাব্দের মধ্যে) ‘সোনাভান’ কাব্য থেকে; আর দ্বিতীয় দৃষ্টান্তটির (‘অন্নদামঙ্গল’ থেকে গৃহীত) রচয়িতা হলেন অন্ত্য-মধ্যযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র(জন্ম ১৭০৮/১০/১২ খ্রিস্টাব্দ, প্রয়াণ ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দ)। অন্নদামঙ্গলের রচনাকাল (১৭৫২ খ্রি.) নিয়ে কোনও দ্বিমত নেই, কিন্তু সোনাভান অষ্টাদশ শতাব্দীর কোন সময়ে লেখা, তা জানা যায় না। ভারতচন্দ্রের জীবৎকাল মোটামুটি পঞ্চাশ বছর। গরীবুল্লাহ দীর্ঘজীবী ছিলেন। ভারতচন্দ্রের রচনাগুলি কালাঙ্ক চিহ্নিত হওয়ায় মোটামুটি প্রায় প্রত্যেকটির রচনাকাল জানা যায়। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের ফকির গরীবুল্লাহর নামে প্রচলিত পাঁচটি গ্রন্থের (ইউসুফ-জেলেখা, জঙ্গনামা, আমীর হামজা – ১ম পর্ব, সোনাভান ও সত্যপীরের পুঁথি) মধ্যে কোনও রচনাকাল-বাচক তারিখ নেই, যদিও গবেষক-পণ্ডিতরা পাঁচটি রচনাই অষ্টাদশ শতাব্দীর বলে একমত হয়েছেন। উদ্ধৃত দৃষ্টান্ত দু’টি মধ্যযুগে রচিত হলেও তাদের ভাষা মধ্যযুগের প্রচলিত মূলধারার শিষ্ট ভাষা নয়। সুকুমার সেন একে বলছেন ‘এছলামি বাঙ্গালা’। ‘সোনাভান’ পুরো কাব্যটাই ‘এছলামি বাঙ্গালা’য় লেখা; আর ভারতচন্দ্র প্রয়োজনমত স্থান বিশেষে এই ভাষা ব্যবহার করেছেন।

তুর্কি আক্রমণের পরবর্তী সময়ে যতদিন গেছে বাংলাভাষার মধ্যে আরবি ফারসি শব্দের অনুপ্রবেশ অনিবার্য হয়েছে। বঙ্গীয় মুসলমান সমাজের দৈনন্দিন জীবনের ভাষায় এই ধরনের ইসলামিক শব্দের ও উত্তর ভারতের হিন্দুস্থানী ভাষার ব্যবহার ছিল বেশি। ষোড়শ শতাব্দীর মুহম্মদ কবীর কিম্বা শাহ মোহম্মদ সগীর থেকে শুরু করে সপ্তদশ শতাব্দীর সৈয়দ সুলতান, জৈনুদ্দীন, দৌলত কাজী, আলাওল, দৌলত উজীর, বাহরম খান, প্রমুখ চট্টগ্রামের মুসলমান কবিদের ভাষাও সাধারণ শিষ্ট সাধুভাষা থেকে খুব দূরবর্তী ছিল না; তফাতের মধ্যে ছিল আরবি-ফারসি-হিন্দুস্থানী শব্দের বাহুল্য। হিন্দু মসলমান নির্বিশেষে সে ভাষার কদর করেছে।

অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে যে ‘মুসলমানী পুঁথি’ সাহিত্যের সূচনা, তার সিংহভাগই ‘এছলামি বাঙ্গালা’ ভাষায় লেখা। সেই সাহিত্যের সূচনা হয়েছিল শাহ্ গরীবুল্লাহর হাতে এবং তার কেন্দ্রভূমিটি ছিল দক্ষিণরাঢ়ের ভুরশুট পরগনা ও তর চারপাশ। সুকুমার সেন জানিয়েছন:

...ইংরেজ আমলের শুরু হইতে কলিকাতার মজদুর মুসলমানদের ব্যবহার্য গ্রন্থে যখন আরবী-ফারসীর সঙ্গে বাঙ্গালার ও হিন্দির মিশ্রন খুব গাঢ় হইয়াছিল তখনকার সেই গ্রন্থভাষাই যথার্থ ‘এছলামি বাঙ্গালা’।

এই ‘এছলামি বাঙ্গালা’ সহিত্যের চাহিদা একদা নেহাৎ কম ছিল না। সস্তা ছাপাখানার [বটতলা, গরাণহাটা, মেছুয়াবাজার] দৌলতে এবং বাঙ্গালী মুসলমান সমাজে ইংরেজী শিক্ষার প্রতি পরাঙ্মুখতার ফলে এ সাহিত্যভাষা ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত সজীব ও সঞ্চরমান ছিল। এ সাহিত্যের ভাষায় যাঁহারা গাথা-আখ্যায়িকা-গল্প (‘কেচ্ছা’) লিখিতেন তাঁহাদের সাধারণ সাধুভাষায় যে অধিকার ছিল না এমন নয়। কিন্তু তাঁহারা যে ফারসী-হিন্দুস্থানী-হিন্দী আকর হইতে বস্তু গ্রহণ করিতেন সেই আকর হইতে শব্দ ও বাক্যাংশও প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে লইতে দ্বিধা করিতেন না।

ইসলামি বাঙ্গালায় লেখা বইগুলি অধিকাংশ সাধারণ পাঠকের জন্য নয়, শিক্ষিত মুসলমান পাঠকের জন্যও নয়। বিমিশ্র শ্রমিক ও কৃষকের অবসর বিনোদনের জন্য রচিত হইত। তবুও কোন কোন রচনা তুচ্ছ করিবার নয়।

ইসলমি বাংলায় লেখা এই সাহিত্যধারাই ‘মুসলমানী পুঁথি সাহিত্য’ বা ‘মুসলমানী বাংলা সাহিত্য’ নামে পরিচিত। উনিশ শতকের শেষ পর্যন্ত শুধু নয়, তারও পরে বিংশ শতাব্দীর প্রথম দু’তিনটি দশকেও এই সাহিত্যের রমরমা ছিল চোখে পড়ার মতো। আশ্চর্যের বিষয়, আজও, এই একবিংশ শতাব্দীতেও পুরাতন মেছুয়াবাজার-চিৎপুর অঞ্চলে শতাধিক বৎসরের পুরাতন কয়েকটি প্রকাশনা থেকে ‘মুসলমানী পুঁথি সাহিত্য’ তার প্রাচীন ঐতিহ্যমণ্ডিত রূপ নিয়ে মুদ্রিত হয়ে চলেছে।

ইংরেজ আমলে কলকাতার অদূরবর্তী দু’টি অঞ্চলে এই ভাষার সাহিত্যিক নিদর্শন পাওয়া গেছে। প্রথমটির কথা আগেই বলেছি। সুকুমার সেনের পর্যবেক্ষণে তার পরিচয় এই রকম –

পশ্চিমবঙ্গে – বিশেষ করিয়া দক্ষিণ রাঢ়ে, ভুরশুট-মান্দারন অঞ্চলে বাঙ্গালী মুসলমানদের একটি বিশিষ্ট সাহিত্য ও সংস্কৃতির কেন্দ্র গড়িয়া উঠিয়াছিল। তবে এ অঞ্চলের অষ্টাদশ শতাব্দীর আগেকার কোন রচনা হস্তগত হয় নাই।

দ্বিতীয়টি পাওয়া যায় সপ্তদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধের অন্যতম শক্তিশালী প্রতিভাবান কবি কৃষ্ণরাম দাসের একগুচ্ছ মঙ্গলকাব্যে। তাঁর নিবাস ছিল ‘কলিকাতা’ পরগনার নিমতা গ্রামে (‘কলিকাতা বন্দিনু, নিমিতা জন্মস্থান’)। প্রখর ইতিহাস সচেতন এই কবি তাঁর ছটি কাব্যের অনেকগুলিরই রচনাকাল নির্দেশ করে গেছেন। নিজের পরিচয়, সমকালীন ঐতিহাসিক ব্যক্তি ও পরিবারের (যেমন ঔরঙ্গজেব, শায়েস্তা খান, সাবর্ণ চৌধুরী) উল্লেখও তাঁর কাব্যগুলিতে পাওয়া যায়।

সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকেই কলকাতা সংলগ্ন নিম্নভাগীরথী তীরবর্তী স্থানগুলি বিদেশী বণিকদের সঙ্গে নানা অঞ্চলের মানুষের সমাগমে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। কৃষ্ণরাম দাস কলিকাতার বড়িশায় এসেছিলেন জোব চার্নকের আগেই। সুতরাং এসব অঞ্চলে প্রচলিত আরবি-ফারসি-হিন্দুস্থানী মিশ্রিত মাঝি-মাল্লা ও শ্রমজীবী মুসলমানদের মুখের ভাষা সম্পর্কে তিনি অবহিত ছিলেন। ফলত নিজের একাধিক কাব্যে নির্দিষ্ট প্রসঙ্গে উদ্দেশ্যমূলক ভাবে এই ভাষার ব্যবহার করেছিলেন তিনি। তাঁর শ্রেষ্ঠ কাব্য ‘রায়মঙ্গল’ (১৬৮৬-৮৭ খ্রিস্টাব্দ) রচনার পশ্চাৎভূমি অর্থাৎ গ্রন্থ রচনার কারণ বলতে গিয়ে লিখেছেন:


চাষা ভুলাইয়া সেই গীত হইল ভাষা।
মোর গীত না জানিয়া যতেক গায়ন।
অন্যগীত ফিরাইয়া গায়ে জাগরণ।।
ফাকুটি-নাকুটি (ফস্টিনস্টি) আর করে রঙ্গি-ভঙ্গি।
পরম কৌতুক শুনে মউল্যা মলঙ্গি।।
তোমার কবিতা যার মনে নাই লাগে।
সবংশে তাহারে তবে সংহারিবা বাঘে।। 
                                                                       (– রায়মঙ্গল)



ব্যাঘ্রের দেবতা স্বয়ং দক্ষিণরায়ের এই হুমকির পর স্বাভাবিকভাবেই ‘পরম কৌতুকে’ সকলেই তাঁর কাব্যরস আস্বাদন করবেন।

‘রায়মঙ্গল’ কাব্যে গাজীর সংলাপগুলিতে আছে এই ভাষা –


কোপে কহেন গাজী          কাঁহাকা অম্বক পাজি
জঙ্গুলি হয়েগা মহাদাপ
হররোজ চালু কেলা            সাড়ে পাঁচ খায় ডালা
গোসাঞী আপকি কহে আপ।
                                                         (– রায়মঙ্গল)


কিংবা


বেমান কাফের তোম বেসোর কমজাত।
শুনরে আহাম্মক গিধি মেরি এক বাত।।
খাওকে জঙ্গুলি হুয়াকে মাত আলা।
এতো বড়ে কদুরথ দেও এ গালিগালা।।
আভি নাই জান্তেহ বড়ে খাঁ গাজী পীর।
খোদায় মাদার দিয়া দুনিয়াকু জাহির।।

কৃষ্ণরামের গাজী ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে তেড়ে অশ্লীল গালাগালিও দেয়। তাঁর শীতলামঙ্গল থেকে উদ্ধার করা যাক:

জাতে হায় তোম ঘোড়েপর          বহুত দিমাগ ভর
নজরে আয়তে নাহি হাম।
কোন তেরা ডেই সাড়ে          রহো বেটিচোদ ঘাড়ে
খললাক আউ মেরা কাম।। 
                                                          (– শীতলামঙ্গল)

মুসলমানি ভাষায় ফস্টিনস্টি আর রঙ্গি-ভঙ্গিতে ভরা এরকম চাষা-ভোলানো গান সপ্তদশ শতাব্দী থেকেই প্রচলিত ছিল। আর ছিল পীর মাহাত্মের ব্রতকথামূলক পাঁচালি – নারায়ণের সঙ্গে পীরের একাত্ম হওয়ার কাহিনী। সত্যপীর বা সত্যনারায়ণের পাঁচালির মাধ্যমে মুসলমানি ভাষার ব্যবহার অষ্টাদশ শতাব্দীতে গোটা পশ্চিমবঙ্গেই ছড়িয়ে পড়ে।(চলবে)

0 comments: