অণুগল্পঃ পিনাকী চক্রবর্তী
Posted in অণুগল্প
অণুগল্প
ঈশ্বরের ভাষা
পিনাকী চক্রবর্তী
আজ শুক্কুরবার, আমাদের সেক্টরের হাটের দিন। বাজার সেরে ফিরছিলাম হাঁটতে হাঁটতে। কিন্তু তরিতরকারি কিছু বেশী পরিমাণ কেনা হয়ে গিয়েছিলো। এদিকে হাটের দিন গাড়ি চুরির প্রবল প্রাদুর্ভাব ঘটে নয়ডাতে, তাই গাড়ি ছেড়ে গেছিলাম বাড়িতেই। কথাতেই বলে, সাবধানের মার নেই। সুতরাং হাঁটি হাঁটি পা পা করে আসছি গাদাগাদি ভীড়ের মধ্যে দিয়ে।
এরমধ্যে একটা সাইকেল রিক্সা টিং টিং করে ঘন্টা বাজিয়ে এসে দাঁড়ালো আমাদের পাশে – একমুখ কাঁচাপাকা দাড়ি আর হাসি নিয়ে প্রবীণ ভদ্রলোক ঘন্টায় হাত রেখে আমাদের ব্যাগের দিকে ইশারা করে চুস্ত উর্দুতে জিজ্ঞেস করলেন, আমি কিছু সাহায্য করতে পারি কি? আমি ভাঙ্গাচোরা হিন্দীতে বললাম, বাড়ী পৌঁছে দেবেন আমাদের? তিনি স্মিত হেসে জানালেন মুসাফিরদের গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্বই আল্লাহ তাঁকে সমর্পণ করেছেন। সহজ কথা, কিন্তু পরিবেশনার ধাক্কায় আমার তো বোলতি বন্ধ!
চুপচাপ উঠে পড়লাম রিক্সায়। কিন্তু হাটের মধ্যে বেশীক্ষণ চুপ থাকা পোষায় না। এত শাক সবজী এক সাথে কেনার কি দরকার ছিল, আর কিনে যখন ফেলাই হয়েছে, তখন ফ্রিজে তাদের কি করে ঢোকানো যাবে সেই নিয়ে বউয়ের সাথে ঈষৎ উত্তেজিত আলাপ আলোচনা শুরু হয়ে গেল। কথায় কথায় রিক্সাচালক ভদ্রলোককে রাস্তা বাতলানোর কথাটা মাথার থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলো। তিনি বাড়ির ঠিক আগের মোড়ে শান্তভাবে রিক্সাটা রাস্তার একপাশে দাঁড় করিয়ে আমাদের দিকে ফিরলেন।
আমরা হঠাৎ ব্যাপারটা খেয়াল করে লজ্জিতভাবে বললাম, হ্যাঁ হ্যাঁ, এইখান থেকে ডানদিকে চলুন। তিনি শান্তভাবেই বললেন, রূমী বলেছেন … বলে একটা শের বললেন যেটা আমাদের মাথার ওপর দিয়ে বেরিয়ে গেল। আমি কিছুক্ষণ পরে সম্বিত ফিরে পেয়ে বললাম, মাফ করবেন। আমরা কথায় কথায় খেয়াল করিনি যে আপনাকে আমাদের গন্তব্যটা ঠিকভাবে বলা হয় নি। আর, কিছু মনে করবেন না, আমরা ফার্সি বুঝি না। তিনি ঘাড় নেড়ে আমাদের আশ্বস্ত করলেন। জানালেন, রূমীর নাম শুনে যখন ভাষাটা ফার্সি বলে চিনেছি, তখন এই বয়েতটার মতলব বুঝতেও আমাদের অসুবিধে হবে না। তাছাড়া এই বয়েতের বক্তব্যটাও খুবই সংক্ষিপ্ত এবং পরিষ্কার। রূমী বলেছেন, চুপচাপ থাকাটা আল্লাহের ভাষা, আর অন্য সব কথাই তার খুব বেমানান তর্জমা।
আমরা কর্তা গিন্নী দুজনেই মাথা হেঁট করে প্রাপ্য তিরস্কারটা গ্রহণ করলাম। বাড়ি পৌঁছে তাঁকে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট দিলাম। তিনি জানালেন খুচরো এখনও জোগাড় করা হয় নি। তিনি লায়লাতুল কাদরের নামাজ পড়ে এই মাত্র রিক্সায় হাত দিয়েছেন। ওই অজানা কথাটার মানেও বলে দিলেন, যে আজ পবিত্র রমজান মাসের শেষ জুম্মেরাত। আমি বললাম ওই টাকাটার সবটাই তাঁর সাম্মানিক অর্থ। তিনি বিনীত ভাবে বললেন তিনি শিক্ষক, একটি স্কুলে উর্দু পড়ান। দুপুরবেলা একটামাত্র ক্লাস নিতে হয়, মাইনেটাও সেই অনুপাতে পান। তাই রাত্তিরে একটু রিক্সা চালিয়ে তিনি সংসার চালানোর জন্যে কিছু সংস্থান করার চেষ্টা করেন। যদিও পবিত্র রমজান মাসে দানধ্যান করা যে কোনও সৎ মুসলমানের কর্তব্য, কিন্তু আমাদের তো সেরকম কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। কাজেই তিনি আমাদের কাছ থেকে ন্যায্য ভাড়াটুকুই শুধু গ্রহণ করতে পারবেন। দুটো দশ টাকার নোট নিয়ে, আদাব জানিয়ে তিনি রিক্সা চালিয়ে চলে গেলেন। আমি রিক্সাটাকে চোখ দিয়ে অনুসরণ করতে থাকলাম হোশিয়ারপুরের মোড় অবধি...
0 comments: