0

অণুগল্পঃ পলাশ কুমার পাল

Posted in


অণুগল্প


বার্তা
পলাশ কুমার পাল




ভোরবেলা ফেসবুকে স্ট্যাটাস আপডেট দিচ্ছিল প্রিয়ম। প্রত্যহ একটা করে সাহিত্যিকের মতো স্ট্যাটাস লিখে চেনা-অচেনা মুখ-পরিচিত বন্ধুদের কদর পাওয়াতে একটা আনন্দ আছে। যদিও সে নিজে জানে নবাগত লেখক হলেও তার মূল্য কেবল ফেসবুকে, সাহিত্যগুণে হয়তো নয়। তবু নিয়মিত সে লেখে।

বেশ কয়েকটা ই-পত্রিকা ও কয়েকটা উপপত্রিকায় তার লেখনী স্থানও করে নিয়েছে। অন্যান্যদের মতো সে এগুলোকে ব্লগ বা লিটল ম্যাগাজিন বলাকে মেনে নিতে পারে না। বাংলা ভাষার প্রতি এটা একটা প্রেমের নমুনামাত্র। প্রিয়ম-এর মতে বাঙালী হয়ে বাংলা ভাষাই তার একমাত্র গর্ব। যে ভাষার জন্য সারাবিশ্ব ভাষাদিবস পেল সেই ভাষা জীবনের অলংকার। ভাষা আন্দোলনে শহীদদের সে সম্মান করে। অথচ এই ভাষাতে ইংরাজী শব্দের অধিক আগমন সে মানতে পারে না। তার মতে এতে ভাষার ঐতিহ্য নষ্ট হচ্ছে, শহীদরা অপমানিত হচ্ছে। তবু সে বাংলাতে লিখে চলে ক্রমশ...

তার মনে জ্বলতে থাকা এই আগুন প্রতিবাদী রূপ নেয় লেখনীতে। আর কিছুদিন পরই ভাষাদিবস। তাই বাংলাভাষা নিয়ে তার মনোভাব শব্দের আবীরে খাতাকে ভর্তি করে। কয়েকটা ই-পত্রিকায় ও উপপত্রিকায় কিছু লেখাও সে পাঠিয়েছে। মন তবু তৃপ্ত হয় না। সব লেখা যদি প্রকাশ করতে পারত...

ক্ষুদ্র মোবাইলের স্ক্রীন স্পর্শ করে এগিয়ে চলে অগণিত বন্ধুর মনোভাবের উত্তল-অবতল তল পেরিয়ে... হঠাৎই একটা বিজ্ঞাপন নজরে আসে। ভাষাদিবস উপলক্ষ্যে 'একুশে' সংকলনে লেখা আহ্বান করেছেন স্বয়ং ভবেশদা, যিনি 'চিত্রা' পত্রিকার সম্পাদক। প্রিয়ং বিজ্ঞাপনটা বারবার পড়ে। তার মনে একটা আশা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

পাশে খোলা খাতায় বর্ণ দিয়ে সজ্জিত শব্দগুচ্ছের দিকে চোখ নামায়। শব্দগুলো যেন খাতা থেকে উড়তে চাইছে নীল আকাশে। যদিও সকাল হয়নি এখনও। প্রিয়ম মনে মনে বলে, 'দাঁড়া, আগে তোদের পাখা জোগাড় করি!'

সে ভবেশদার প্রোফাইলে ঢুকে একটা বার্তা পাঠায়- "দাদা, একুশে সংকলনের জন্য যে লেখা নেওয়া হচ্ছে সেগুলো সবই কি ভাষাদিবস বিষয়ে?"

অপর প্রান্ত তখন নিঃশ্চুপ, নিবিড় ঘুমে আচ্ছন্ন। সকালে উঠে সে টিউশন পড়তে যায়। তারপর সারাদিন নানাকাজের মধ্যে আর ফেসবুক খোলাই হয় না। বিকালের দিকে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার সময় ফেসবুকে অন হতেই ইনবক্সে তারই প্রতীক্ষারত বার্তাকে দেখল। ভবেশদা! কৌতূহলে প্রিয়ম বার্তা দেখল। তৎক্ষণাৎ মুখের মধ্যে নগ্ন বাস্তবের হঠাৎ ধাক্কায় আহত প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠল।

"যেকোনো বিষয়ে লেখা হলেই হবে ৩০-৩৫ লাইনের মধ্যে। সঙ্গে নিজের পরিচয় ১০০ শব্দের মধ্যে। ১৫০ টাকা করে প্রতি পাতা। পাঁচটা লেখা ও পরিচয়ের জন্য মোট ছয়পাতা। মোট ৯৫০ টাকা দিতে হবে।"

বার্তার প্রতিটা শব্দ প্রিয়ম বারবার পড়ছিল। নিজের জিজ্ঞাসার চেয়ে উত্তর যেন অনেক বেশি। 'একুশে'র আড়ালে এটা কী চাইছে ভবেশদা? যদিও তিনি এইজগতেরই মানুষ। নিরুপায়ের মতো বার্তার শব্দগুলো ধুলো হয়ে বিঁধছিল। যে ভাষা নিয়ে সে গর্ব করে, সেই ভাষাকে নিয়ে ব্যবসাসুলভ এই বৃত্তি? যদিও আগে এইরকম নানা কাহিনী শুনেছিল। তবে তার বিশ্বাস দৃঢ় হয়নি। নিজেকে ভাষাশিল্পী মানতে না চাইলেও ভাষাশিল্পীদের প্রতি অন্য ভাষাশিল্পীর আজ এইরূপ ব্যবহার প্রত্যক্ষ করে তার গর্বের জায়গা ক্ষুন্ন হল। এই মনোবৃত্তির মানুষেরা হৃদয় চিকিৎসা করে কিভাবে? তাহলে কি টাকার জোরে নাম? না পত্রিকার জন্য টাকা? তা বলে এইভাবে... না। মানতে পারে না। তার মনে হল, এইসব মানুষের মুখোশগুলো যদি খোলা যায়...

নিজের লেখার ভবিষ্যৎ চিন্তা করে থমকে গেল। এরা তো রাঘববোয়াল। এরা তো জনপ্রিয়- জনগণের লাইকের স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে মোটা ভিতের বাড়ি। জলে থেকে এদের সঙ্গে লড়াই করা... ঠিক হবে কি? যদি সে করে... দ্বিধান্বিত মনে বার্তার প্রত্যুত্তরে কেবল একটা 'লাইক' চিহ্নে আঙুল ছোঁয়াল। সে বার্তা ভবেশের ইনবক্সে চিহ্ন হয়েই গেল, স্পর্শ হয়ে নয়।

0 comments: