0

ধারাবাহিকঃ নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in

ধারাবাহিক

জলরেখা - ৪
নন্দিনী সেনগুপ্ত



‘আমি মাঝে মাঝে তোমার কাজ-কারবার কিছুই বুঝে উঠতে পারি না। তুমি তো জানতে এখানে এসে লাভ নেই। এই পাহাড় সেই পাহাড় নয়। খামকা ... বুঝি না’। এষা নিচুস্বরে বললেও অনুযোগ চাপা থাকেনা।

সুনন্দ এক আঙুল ঠোঁটের উপরে রেখে চোখের ইশারায় দেখিয়ে দেন ঘুমন্ত নীরদার দিকে।

এষা বলেন, ‘ও ঘুমিয়ে পড়েছে। ঐটুকুনি মানুষ। কত আর ধকল সইতে পারে?... কিন্তু আমার কথার জবাব দিলে না তুমি?’

সুনন্দ বলেন,... ‘লাভ লোকসানের কথা নয়। এমনি এমনি বেড়াতে যায় না মানুষ? কত আনন্দ পাচ্ছে দেখ মেয়েটা। আর যতই বল, আমাদেরও তো কতদিন কোথাও যাওয়া হয় না। একঘেয়ে সংসার, দমচাপা শহরের বাইরে খোলা বাতাস, জঙ্গল, পাহাড় - এসব ভাল লাগছে না তোমার?’

এষা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন। তারপর মৃদু হাসেন। বলেন, ‘ভালো, তবু ভালো। নাতনীর জন্য তবু --। নইলে আমার কথা ভেবে কি আর কোনওদিন... একসাথে বেড়াতে যাওয়া শেষ কবে...মনেই পড়ে না। সংসার আর সংসার। মাঝে মাঝে মনে হয় সেটাও তো ঠিকমত গুছিয়ে রাখতে পারলাম না। সব যেন কেমন এলোমেলো হয়ে গেল’।

সুনন্দ বিছানার একপাশে আধশোয়া হয়ে একটা ম্যাপ দেখছিলেন। স্থানীয় রাস্তাঘাটের দিকনির্দেশ। আস্তে আস্তে ভাঁজ করে রাখেন ম্যাপ। বিছানার পাশে টেবিলে সরিয়ে রাখেন আতসকাচ। চশমা খাপের মধ্যে রেখে দিয়ে সরে এসে মৃদু চাপ দেন এষার হাতে। 

এষা আচমকা ফুঁপিয়ে ওঠেন, হাহাকার ছড়িয়ে যায় কণ্ঠে, ‘এক ছেলে থেকেও কাছে নেই... আরেকজন তো নেইই। আমি শুধু তাদের চিহ্ন বয়ে চলেছি’। 

সুনন্দ বলেন, ‘বহন করা বলছ কেন? এটা আমাদের কর্তব্য ছিল। অরূপ আর বড়বউমার এক্সিডেন্টে মৃত্যুর পরে আমরা ছাড়া নয়নের কে ছিল? কে মানুষ করত বল ওকে? আর এ ব্যাপারে তুমি সফল। নয়ন এখন নিজের জীবনে প্রতিষ্ঠিত। বিয়ে করেছে। ওই এখন আমাদের দেখে শুনে রাখে। বহন করার প্রশ্নই ওঠেনা’।

‘কিন্ত নিরূপ?’ হঠাৎ যেন ফুঁসে ওঠেন এষা, ‘ও কি মনে করলে আমাদের কাছে থাকতে পারতো না? মেয়েকে নিজের হাতে মানুষ করতে পারতো না? আমরা তো পাশেই রয়েছি। চিরকাল দায়িত্ব এড়িয়ে এড়িয়ে থাকা, এক অদ্ভুত স্বভাব। দুধের বাচ্চাটাকে নিয়ে এসে তুলে দিল আমার হাতে। কার কাছ থেকে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে ও? নিজের সন্তানের কাছ থেকে না আমাদের কাছ থেকে নাকি সন্তানের মায়ের কাছ থেকে? জগতসংসার ফেলে বনেবাদাড়ে ঘুরে ঘুরে এ কেমন শাস্তি দিচ্ছে ও নিজেকে?’ 

সুনন্দ পিঠে হাত রাখেন এষার। ‘প্লিজ এষা, শান্ত হও। নিরূপ কেন এরকম করল, তার উত্তর ও নিজে ছাড়া কেউ দিতে পারবেনা। কেন পালিয়ে বেড়াচ্ছে একমাত্র ওইই জানে। তবে ও নিজের কাজ নিয়েই আছে। ব্যস্ত আছে। ভাল আছে। ওর কোনওকালেই বাড়িতে মন টেঁকে না। মনে করে দেখ, শিশুবেলা থেকেই সে যে কোনও ছুতোয় বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেত। একবার বৈরাগীদাদার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে সেই শিয়ালদ’ স্টেশন অবধি চলে গিয়েছিল, মনে নেই তোমার?’ 

এষা বলেন, ‘কিসের মধ্যে কি? শিশুবেলায় এরকম অনেকেই করে থাকে। ও তো হারিয়েই যাচ্ছিল। তারপর আমাদের পাড়ার মুদীখানার অসিত পাইকিরি বাজার করতে গিয়ে ওকে দেখতে পেয়ে নিয়ে এসেছিল। চারদিকে হই হই, থানা পুলিশ হয়ে যাচ্ছিল। বাচ্চা মানুষ, বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তা হারিয়ে ফেলেছিল। তার সঙ্গে এখন পালিয়ে বেড়াবার কি সম্পর্ক পেলে তুমি?’

সুনন্দ বলেন, ‘সম্পর্ক যদি টানার চেষ্টা কর, আছে। যদি না পাও, নেই। আসলে আমি বলতে চাইছি ঘরের থেকে বাহির ওকে বেশী টানে বরাবর। শুধু এটা নয়, মনে নেই? আমাদের হুগলীর বাড়ি দেখাশোনা করে রাখত, রতন। রতন একদিন সকালবেলা আমাকে এসে বললে, ‘দাদা, তীর্থ করতে যাচ্ছি শ্রীক্ষেত্র আজ রাতের ট্রেনে। ভাবলাম কলকাতায় এসে আপনার সঙ্গে একটু দেখা করে যাই’। তারপর রতন একটু মজা করে নিরূপকে বলেছিল, ‘কি ছোটবাবু, যাবে নাকি আমাদের সঙ্গে?’ ওমা, নিরূপ ঘাড় কাত করে বলে, ‘হ্যাঁ’। তারপর আমরা চিন্তা করে বাঁচি না, ওরা আনরিজার্ভড কমপার্টমেন্‌টে ট্র্যাভেল করে জ্ঞাতিগুষ্টি সমেত। নিরূপ দিব্য তাদের সঙ্গে সাতদিন ধরে ঘুরে বেরিয়ে চলে এল। কি আহ্লাদ বাবুর! কত আর বয়েস তখন? বছর বারো। এটা কি স্বাভাবিক বলে মনে হয় তোমার? কতটুকু চিনতো ও রতনকে- যে একবার বলতেই সঙ্গে চলল পোঁটলা বেঁধে!’ 

এষা উত্তর দেন-- ‘হতে পারে, জানি না। এত জটিলভাবে আমি বিশ্লেষণ করতে পারি না তোমার মত। মনে হয় নিরূপ কি একটিবার আমার কথাও ভাবে না? ও কি দেখেনি অরূপকে হারিয়ে আমি কিরকম শোকে উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলাম! যদি তখন নয়নকে মানুষ করার দায়িত্ব আমার উপরে না থাকত আমি হয়ত কোনওদিন স্বাভাবিক হতাম না’। 

সুনন্দ যেন হারিয়ে যাওয়া সূত্র খুঁজে পেয়েছেন এইভাবে বলে ওঠেন, ‘হ্যাঁ, দায়িত্ব। একদম। এইটাই বড় কথা।

মাথায় দায়িত্ব থাকলে মানুষ সব পারে। পারতেই হয়। যেমন তোমার এখন দায়িত্ব হল নীরু। এই মেয়েটিকে বড় করে তোলা ঠিকভাবে’। 

‘কিন্তু আমার বড় ভয় করে যে’ এষা উদ্বিগ্ন গলায় বলেন... ‘নয়নের সময় তবু বয়স কম ছিল। শরীরে শক্তি ছিল আমার। আর এখন? মনে হয়, কিছুই যেন ঠিকঠাক পারছি না। আর তোমার? তোমারও তো বয়স বাড়ছে। হাজার একটা শারীরিক সমস্যা। কি হবে, কি করে সব সামলাই, কিছু যেন ভেবে দিশা পাই না। আমার তো শোক করাও যেন বিলাসিতা’। 

‘ঠিক আছে। সব ঠিকই চলছে তো। শান্ত হও’... শুধু যে একথা তিনি এষাকে বলেন তা নয়; সুনন্দ হয়ত বা নিজেকেও বলেন। নিজের মনকেও বলেন শান্ত হতে। পুরুষমানুষের যে এইধরণের পরিস্থিতিতে স্থির থাকা কর্তব্য এরকমটাই বুঝেছেন তিনি শিশুবেলা থেকেই। 

এষা শান্ত হবার চেষ্টা করেন, বোঝা যায়। কিন্তু মনের কষ্ট, আবেগ সবকিছু শরীর ঠেলে বাইরে বেরিয়ে আসার জন্য উদ্গত অশ্রুর রূপ নেয়। সুনন্দ মোছাবার চেষ্টা করেন না। বহে যেতে দেন। যেন মনে মনে বলেন, ‘কাঁদো, এষা, কাঁদো। এই অশ্রু, এই বারি অন্তরের মালিন্য শুধু নয়, ধুয়ে দেবে সব কষ্ট’। প্রবহমান নদীর মত বহে যায় কষ্টগুলি। সুনন্দ পাহাড়ের মত অচঞ্চল হয়ে বসে থাকেন সেই নদীটির পাশে। 




0 comments: