10

প্রচ্ছদ নিবন্ধঃ রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য

Posted in


প্রচ্ছদ নিবন্ধ

২১শে ফেব্রুয়ারির চিন্তা
রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য



হেনরিক সিয়েন্‌কিয়েভিচ্‌ (১৮৪৬ – ১৯১৬) – কে অনেকেই জানেন ‘কুয়োভাদিস’ (কোথায় চলেছেন)–এর লেখক বলে। পোল্যান্ডের এই লেখকটি ছিলেন বহু গুণের আধার।তাঁর অন্যতম কীর্তি  ‘অ্যাসপিনওয়ালের আলোকস্তম্ভ-রক্ষী’ নামে একটি বড়গল্প।কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের অনুবাদে (মূল পোল ভাষা থেকে নয়, তার ইংরিজি অনুবাদের পুনরনুবাদ) গল্পটি হয়তো অনেকেরই পড়া। 

নানা দেশ ঘুরে স্কাতিন্স্‌কি নামে এক পোল দক্ষিণ আমেরিকার পানামা-য় এসে পৌঁছেছেন। তাঁর বয়েস হয়েছে অনেক। এখন তিনি থিতু হতে চান। তাই তিনি কাজ নিলেন আলোকস্তম্ভ-রক্ষীর। কাজ বলতে আলোকস্তম্ভের লন্ঠন জ্বালা। ছ’দিন কাটে একা; রোববার শহর থেকে নৌকোয় করে আসে খাবার আর পানীয় জল, তার সঙ্গে আসে স্পেনীয় ও ইংরিজি ভাষার খবরের কাগজ। একদিন দেখা গেল একটি বাড়তি মোড়ক এসেছে। তার গায়ে মার্কিন ডাকটিকিট সাঁটা আর লেখা প্রাপকের নাম। সিয়েন্‌কিয়েভিচ্‌ লিখেছেন : 

কৌতূহলী হয়ে [মোড়কের] কাপড়টা কেটে সে দেখলো, বই রয়েছে। একটা বই তুলে একবার চোখ বুলিয়ে সে রেখে দিল। থরথর ক’রে তার হাত দুটো কাঁপতে আরম্ভ করেছে। দু-হাতে চোখ সে ঢেকে ফেলল, যেন যা দেখছে সেটা অবিশ্বাস্য। তার মনে হল সে বুঝি স্বপ্ন দেখছে। 

বইগুলো পোল ভাষায় লেখা - এর মানে কী? কে তাকে বই পাঠাতে পারে? তার মনেই নেই, চাকরির প্রথমে মার্কিন প্রতিনিধির কাছ থেকে ধার করে আনা [নিউ ইয়র্ক] হেরল্ডে, নিউ ইয়র্কে পোলিশ সমিতি প্রবর্তনের কথা পড়ে তৎক্ষণাৎ চাঁদা হিসেবে সে নিজের মাইনের অর্ধেক তাদের পাঠিয়ে দিয়েছিল। এখানে তার টাকা-পয়সার কোনও প্রয়োজন নেই। সেই সমিতি তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বইগুলো পাঠিয়েছে। অতএব বইগুলো নিতান্ত স্বভাবিক উপায়ে এসেছে।

একা থাকতে থাকতে এই বৃদ্ধ পৃথিবী সম্বন্ধেই আস্তে আস্তে নিরুৎসাহ হয়ে পড়েছিলেন। নিজের দেশের জন্যেও কোনও ব্যাকুলতা আর ছিলনা। এই বইগুলি এসে পড়ল হঠাৎ, তাঁর মাথা ঘুরে গেল। মোড়কের ভেতরে ছিল একটি কবিতার বই। লিথুয়ানিয়া-র এক বিখ্যাত কবির কবিতা। পড়তে পড়তে ‘ফুঁপিয়ে উঠে বৃদ্ধ মাটিতে আছড়ে পড়লো। সমুদ্রে বালির সঙ্গে এসে মিশল তার তুষার-ধবল চুল। তার দেশকে শেষ দেখবার পর চল্লিশটি বছর কেটে গেছে। ঈশ্বর জানেন, আরও কত বছর আগে মাতৃভাষা সে শুনেছে। ...হঠাৎ যেন এক আশ্চর্য ঘটনার ভিতর দিয়ে তার স্বদেশ প্রেম ফিরে এলো। তাই আনন্দে নেচে উঠল তার মন।’

তার পর? না, আলোকস্তম্ভ-রক্ষীর গল্পটি বলার জন্যে এখানে কলম ধরিনি। কামাক্ষীপ্রসাদের অনুবাদে গল্পটি প্রথম পড়েছিলুম। হালে তাঁর ‘কিশোর রচনা সম্ভার ৩’ (দে’জ পাবলিশিং, ১৪০১ ব.)-এ আবার সেটি পড়লুম। প্রথম পড়ার যে আনন্দ বেদনা,  সেটিই আবার অনুভব করলুম নতুন করে।

জন্মভূমি আর মাতৃভাষা – যে কোনো মানুষের এই দুটি পরিচয় তার জীবনের সঙ্গে শক্ত গাঁটে বাঁধা, কোনো ভাবেই সে গাঁট খোলা যায় না। মানুষ ধর্ম পাল্টাতে পারে, নিজের দেশ ছেড়ে অন্য দেশের নাগরিক হতে পারে, পোশাক-আশাক, হাঁটাচলার ধরণধারণ সব বদলে ফেলতে পারে, এমনকি আদালতে গিয়ে নাম-পদবিও পালটাতে পারে। আগের মানুষটিকে তার ফলে আর চেনাই যাবে না। কিন্তু বদলানো যায় না ঐ দুটি ব্যাপার : জন্মভূমি আর মাতৃভাষা।

রাজনৈতিক ঘাত-প্রতিঘাতে মানচিত্র বদলে যায়; এক দেশ ভেঙে হয় দুই বা আরও বেশি দেশ। কখনওবা দু-দেশ জুড়ে এক দেশ হয়। কোথাও আবার পর্ব চলতেই থাকে, যেমন হয়েছে এই উপমহাদেশে। প্রথমে ভারত ভেঙে ভারত আর পাকিস্তান। সেই পকিস্তান আবার দু-টুকরো হলো : আগেকার পূর্ব পাকিস্তান হলো স্বাধীন বাংলাদেশ। কিন্তু এত ভাগাভাগির মধ্যেও যাঁর জন্মভূমি ছিল লাহোর বা কুমিল্লা, মাতৃভাষা ছিল উর্দু বা বাংলা, তাঁর জন্মভূমি আর মাতৃভাষা একই থাকবে। এমনকি জন্মভূমির নাম যদি পালটে যায়, তাতেও কিছু যায় আসেনা। যদি ধ্বংসও হয়ে যায়, পরিণত হয় ভাঙাচোরা এক স্তূপে, তাতেই বা কী? মনের মধ্যে সেই জন্মভূমি থেকেই যায়। কোনো আলোড়ন, কোনো বিস্ফোরণ সেখানে একটা আঁচড়ও কাটতে পারেনা।

একই কথা মাতৃভাষা সম্পর্কে। খুব ছোটো বেলায় মা-এর কোলে বসে যে ভাষা শেখা হয়, তারই নাম মাতৃভাষা। ঘটনা চক্রে জন্মভূমি ছেড়ে অন্যদেশে, এমনকি সাত সমুদ্র পেরিয়ে কেউ অন্য মহাদেশে গেলেও তার মাতৃভাষা মাতৃভাষাই থাকে। ভিন্‌ দেশে অন্য ভাষী মানুষদের সঙ্গে থাকতে থাকতে কেউ কেউ আর মাতৃভাষায় কথা বলার সুযোগ পান না, হয়তো ভুলেই যান। কিন্তু সত্যিই কি ভোলেন?  মৃত্যুর আগে তাঁর মুখ থেকে অস্ফুট স্বরে বেরিয়ে আসে বহু দশক আগে শুনে শেখা সেই মাতৃভাষা, এমন উদাহরণ অনেক আছে। আলোকস্তম্ভ-রক্ষীর গল্পটি নিছক গল্প নয়।






10 comments:

  1. রুদ্ধশ্বাসে পড়ে গেলাম! কি অসামান্য ভূমিকা দিয়ে শুরু করেছেন রামু দা! রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য কে পাওয়া মানেই ঋতবাক এক স্বর্ণ-খনির হদিস পেয়ে গেছে!

    ReplyDelete
  2. This comment has been removed by the author.

    ReplyDelete
  3. এক কথায়, চমৎকার! এত সুন্দর সহজ করে মনকে নাড়া দেবার জন্য ।

    ReplyDelete
  4. এক কথায়, চমৎকার! এত সুন্দর সহজ করে মনকে নাড়া দেবার জন্য ।

    ReplyDelete
  5. এক কথায় চমৎকার। ধন্যবাদ রামকৃষ্ণদাকে, এত সহজ কথাহৃ মনকে নাড়া দেবার জন্য।

    ReplyDelete
  6. মায়ের ভাষা মাতৃভাষা না বলে, মাতৃ স্বরূপিনী যে ভাষা তাই মাতৃভাষা বলা অধিক সংগত ও তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ প্রথম শেখা ভাষাটির মাধ্যমেই একজন জৈব মানুষ সামাজিক বা প্রকৃত মানুষে রুপান্তরিত হন। মানুষ হিসাবে তার দ্বিতীয় জন্মটি ঘটে এ-ভাষার জঠরেই। তাই এ-ভাষা মাতৃ স্বরূপিনী।

    ReplyDelete
  7. একেবারে ঠিক কথা! "মাতৃভাষা, মাতৃভূমি- এ দুই মায়ের দরণ চুমি, মাটির দেহে জীবন যতদিন!"

    ReplyDelete
  8. একেবারে ঠিক কথা! "মাতৃভাষা, মাতৃভূমি- এ দুই মায়ের দরণ চুমি, মাটির দেহে জীবন যতদিন!"

    ReplyDelete
    Replies
    1. This comment has been removed by the author.

      Delete
  9. LEKHATA PORE ONUBHOB KORA JAY KENO AMRA BARE BARE SIKORER TANE FIRE ASI..

    ReplyDelete