Next
Previous
Showing posts with label প্রপঞ্চ. Show all posts
2

প্রপঞ্চ - শিশির রায় ও পল্লববরন পাল

Posted in
প্রাণে তোমার পরশখানি দিও

বাঁ হাতের বুড়ো আঙুলের ওপর গরম জল পড়ে খানিকটা পুড়ে গেল সেদিন।

পল্লববরন পাল
ফেসবুকের ‘লাইক’ চিহ্নের মতো বুড়ো আঙুলটাকে বাগিয়ে ধরলে, অস্থিসন্ধির যে জায়গাটুকুর চামড়াটা আদুরে পাগ কুকুরের মতো ভাঁজ-ভাঁজ হয়ে থাকে, সেইখানটাই দুর্ঘটনাস্থল। দহনভূমি। বিলক্ষণ জ্বলুনি হলেও, ঠিক করা গেল— বেসিনের কলে জলধারার নীচে আঙুল পাতা হবে না। যন্ত্রণা সহ্য করা হবে। পুড়ে যাওয়া চামড়া, আর তারও বেশি মনকে ভোলাতে— গান শোনা, সিনেমা দেখা হবে। হলও। 

রাতে ঘুমও হল। ঘুমের মধ্যে এল স্বপ্ন। একটা মেয়ে, সালোয়ার-কামিজ পরা। জামার হাতা মণিবন্ধ ছুঁয়েছে, ওড়নায় মাথা, চুল ঢাকা। তার মুখটুকু দেখছি— ক্ষত সেরে-ওঠার পর, পুরনো দুঃসহ স্মৃতি ঢেকে দিতে যেমন নিশপিশ করে ওঠে নতুন চামড়া, তেমন ত্বকেরা তার মুখজোড়া রাজত্ব করতে তৎপর। কিন্তু মুখশ্রী? সে বিদায় নিয়েছে। মেয়েটি কথা বলছে, যদিও কোনও শব্দ শোনা যাচ্ছে না স্বপ্নে। প্রতিটি শব্দ উচ্চারণের সঙ্গে কাঁপছে, লাফিয়ে উঠছে তার মুখের হতকুচ্ছিত রেখাগুলি। তার মুখের দিকে তাকিয়েও চোখ নামিয়ে নিতে বাধ্য হচ্ছি আমি।

ঘুম ভাঙতে মনে পড়ল তাকে। বহরমপুরে গিয়েছিলাম সবন্ধু, সেখানকার এক প্রেক্ষাগৃহে নতুন একটি পত্রিকার প্রকাশ-অনুষ্ঠানের সন্ধ্যা ছিল সেটা। মেয়েদের জন্য, মেয়েদের পরিচালিত-সম্পাদিত সেই পত্রিকার উদ্বোধন উপলক্ষে উদ্যোক্তারা মঞ্চে আসন গ্রহণের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন কয়েক জন নারীকে। প্রত্যেকেই বিশিষ্ট, অনন্য। লব্ধপ্রতিষ্ঠ কবি। সুদক্ষ প্রশাসক। সক্রিয় সমাজকর্মী। উন্নতশির স্বাবলম্বী। প্রত্যেকেই বললেন কিছু না-কিছু।

আর ছিল সেও। সেও বলল। মাইক্রোফোনের সামনে পিঠ টানটান করে, গ্রীবা তুলে, নরম কিন্তু দৃঢ় কণ্ঠস্বরে। তার জামার হাতা মণিবন্ধ ছুঁয়েছে, ওড়নায় চুল ঢাকা। প্রকাশ্য শুধু যে মুখটুকু, ঝলসানো চামড়া নিয়ে সেই মুখ সেই সন্ধ্যায় দর্শকের মুখোমুখি। সে তার নিজের কথা বলল। নিজের জীবনের কথা। সহজ সাধারণ সেই জীবন, বয়ে চলছিল ঘটনাবিহীন। একেবারেই ঘটনাবিহীন কি? যেমন উঠতি বয়সের মেয়েদের পিছনে ঘুরঘুর করে কলার-তোলা ছেলেছোকরারা, তার সঙ্গেও ঘটছিল একই জিনিস। মেয়েটি চায় না, ছেলেটি চায়। ওর না— এ হ্যাঁ করেই ছাড়বে। মেয়ের মন ওঠে না, ছেলের প্রত্যাখ্যান সয় না। সমাধানের সুতোয় বাঁধা পড়তে চায় না যে সমস্যা, তার নিষ্পত্তি কোথায়, কিসে? মগ-ভর্তি অ্যাসিডে। মেয়েটার মুখের উপর ছুড়ে দিয়ে ফেরার হয়েছিল ছেলেটা।

আক্ষরিক অর্থেই মুখ পুড়েছে যার, সে মুখ দেখায় কী করে? মামলা-মকদ্দমা, আইন, থানা-পুলিশ— সব কিছু সামলানোর পরেও তো এক-একটা দিনের, একটা জীবনের অনেকটা সময় বাকি থেকে যায়। সেই সময় একাকী সময়। সেই একাকী সময়ে পোড়ারমুখী মেয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ায় কী করে? নিজের খসে-পড়া, গলে-যাওয়া, ঝুলে-থাকা চামড়া নিজের চোখে দেখে তার কী মনে হয় নিজেকে? মনে কি হয়, এ জিনিস আমাকে নিজের চোখে দেখতে হচ্ছে কেন? আমার চোখদুটো অ্যাসিড থেকে বেঁচে গেল কেন? নাকি আয়নায় আর মুখ দেখে না সে? কাচের আয়নাকে যদি বা সরিয়ে ফেলা যায় জীবন থেকে, সহ-মানুষের চোখের আয়না?

না, দগ্ধ মুখ সে সরিয়ে নেয়নি সমাজ থেকে। বরং ওইটিকেই করে তুলেছে এক আন্দোলনের অভিজ্ঞান। নিজের কথা, নিজের লড়াই নিয়ে বলতে ছুটে ছুটে যায় সে— গ্রাম থেকে শহরে, ঘরোয়া আড্ডা থেকে সুগম্ভীর আলোচনাসভায়। তার মুখ দেখে শিউরে ওঠে দর্শক, সে কিন্তু চোখে চোখ রেখে কথা বলে ঠিক। তার হতশ্রী মুখ তাকে মানুষ চিনতে শিখিয়েছে। তাদের বাড়িতে আসা বন্ধ করা মানুষ, যোগাযোগ ছিন্ন করা মানুষ। আবার— ‘আয়, কাছে এসে বোস’ বলে ডেকে নেওয়া মানুষ, মাঝে মাঝে প্রাণে স্নেহের পরশ দেওয়া মানুষ।

মসৃণ কিংবা বিক্ষত, চামড়ায় যায়-আসে অনেক কিছুই। নিজের বাঁ হাতের বুড়ো আঙুলের দিকে তাকিয়ে আমি সেই মেয়েটির কথা ভাবি।
শিশির রায়
0

প্রপঞ্চ - শিশির রায় ও পল্লববরন পাল

Posted in


পল্লববরন পাল
জিভ না থাকলে কী কী অসুবিধে হত? প্রশ্ন করেছিলাম ক’জনকে। কয়েকটা উত্তর তুলে দেওয়া যাক:

ডাক্তার : ও কী কথা! ভয়ঙ্কর অসুবিধে হত। ‘ম্যাস্টিকেশন’ জানেন? গোদা বাংলায় যাকে বলে চিবোনো। ও কাজটা করে দেয় দাঁত, কিন্তু সুবিধে করে দেয় কে শুনি? জিভ। ও-ই তো মুখের মধ্যে পোরা খাবারদাবারকে আক্ষরিক অর্থে ‘পথে’ নিয়ে আসে। কান টানলে যেমন মাথা আসে, তেমনই জিভ টানলে আসবে ‘টেস্ট বাড’রাও। জিভ না থাকলে তারাই বা কোথায়! জিভে কামড় পড়লে একটুক্ষণের মধ্যেই সেরে যায় তো কী, আন্ডারএস্টিমেট করবেন না মোটেই। জিভে আছে রাজ্যের নার্ভ আর রক্তজালিকা। আর ব্রাশ-ট্রাশ তো অনেক পরের কথা, দাঁতগুলোকে পরিষ্কার রাখার বেসিক কাজটা কিন্তু জিভই করে দেয়। এ একটা পেশি, কিন্তু বাইসেপেরও বেশি!

লিঙ্গুয়িস্ট : হাসালেন মশাই। কথা বলবেন কী করে, জিভটা না থাকলে? কথা বলার ক্ষেত্রে ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর হল গিয়ে দাঁত, ঠোঁট আর জিভ। জিভ না সাহায্য করলে দাঁত আর ঠোঁট মিলে কিচ্ছুটি করতে পারবে না, গলা দিয়ে যে ধ্বনি বা শব্দই বেরোবে, হবে নিতান্ত নিরর্থক। ট, ড, ল, স, ড়— বলতেন কী করে শুনি? ও, একটা মজার কিন্তু জরুরি তথ্য দিই। টিয়েপাখির মানুষের বুলি নকল করা তো দেখেছেন? করে কী করে? ওদের জিভটা অদ্ভুত রকম মোটা। সেই মোটা জিভের ডগাটা মুখের ভেতর নানান জায়গায় দরকার মতো ঠেকিয়ে ওরা ঠিক মানুষের গলা, মানুষের বলা ফুটিয়ে তোলে।

কালীমন্দিরের পূজারি : এই, একান থেকে যান তো! কী সব অলক্ষুণে কতা! মা আমার সামনে দাঁইড়ে আচেন ওই যে, আহা কী সুন্দর লাল টুকটুক জিবখান। বলে কিনা জিব না থাকলে কী অসুবিধে... অসুবিধের বান ডাকত না? এই যে ক’দিন পর কালীপুজো, জিব ছাড়া কালী ভাবা যায়! রক্ষে করো রক্ষেকালী! আরে ওই যে জিব কেটে দাঁইড়ে আচে বোমভোল মহাদেবের গায়ের উপ্‌রে, মায়ের ওই তো স্বরূপ। বলে কিনা জিব না থাকলে... যত্তসব...

ওয়াইন টেস্টার : সাফ কথা, অন্য প্রফেশন দেখুন। জিভ ছাড়া ওয়াইন টেস্টার? আরে কতশত নিয়মে নিজের মুখ আর জিভটা বাঁচাই, জানেন? একগাদা ওষুধের লিস্টি করা আছে, যেগুলো খাওয়া যাবে না। জিভের সেনসেশন ভোঁতা হয়ে যায়, নষ্ট হয়ে যায়। সিগারেট ফুঁকফুঁক? উঁহু, বিলকুল বারণ। মগজের যে অংশ স্বাদ আর গন্ধের অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ করে, তার স্নায়ুর জোর কমে যায়। নিয়ম করে দাঁতের ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে হয়, দাঁত আর মুখের রেগুলার হেলথ চেক-আপ। পরিবেশ দূষণ-টূষণেরও মাপজোখ রাখতে হয় মিস্টার। ও দিকে খাবারে কম নুন, কম চিনি। হাঁইহাঁই করে বিরিয়ানি গিলে নিলাম, নৈব নৈব চ। জিভ আমাদের লক্ষ্মী দাদা, লক্ষ্মী।

ফেবু-কবি : আমার কবিতাজীবন থেকে আপনি জিভ ছিনিয়ে নিতে পারেন না! আগুনের লকলকে জিভ-এর মতো উপমা কোব্তেয় না থাকা মানে সে তো আলুনি উপ্‌মা! উফ্‌, মা! 

খাদ্যরসিক রবীন্দ্রপ্রেমী : আমি একটু-আধটু রবীন্দ্রনাথ জানি মশাই। আমার প্রিয় কবিতা ‘বীথিকা’র ‘নিমন্ত্রণ’। কেন জানেন? গুরুদেব ওখেনেই লিখে গেছেন— ‘উদরবিভাগে দৈহিক পরিতোষ/ সঙ্গী জোটায় মানসিক মধুরতা।/ শোভন হাতের সন্দেশ, পানতোয়া,/ মাছমাংসের পোলাও ইত্যাদিও/ যবে দেখা দেয় শোভামাধুর্যে-ছোঁওয়া/ তখন সে হয় কী অনির্বচনীয়!’ ইত্যাদি। ও, আসল কোটেশনটাই তো বললাম না! ওই কবিতারই লাইন— ‘জেনো, বাসনার সেরা বাসা রসনায়।’ আহা! কী লেখা! এই কে আছিস, আর এক প্লেট মটন কোবরেজি দিয়ে যা এই টেবিলে! 

সাপ : অ্যাই তুই কে রে, আমাদের চেরা জিভে ছাই দিতে এসেছিস? এমন বিষদাঁত ঝাড়ব না...

শিশির রায়
0

প্রপঞ্চ - শিশির রায় ও পল্লববরন পাল

Posted in

প্রপঞ্চ


উত্তরাধিকার
শিশির রায় ও পল্লববরন পাল


ঘরে ঢুকতে দু’আঙুল নিজে থেকেই চলে যাচ্ছে নাকে। নিজেরই অজান্তে টিপে ধরছে দুই নাসারন্ধ্র।

পল্লববরন পাল
আমি তো ছোট তখন, কত হবে, ছয়-সাত! ‘পলিটিক্যালি কারেক্ট’ সহবত শেখা হয়নি তখনও। বড়রা, যাঁরা মুহুর্মুহু ঢুকতেন-বেরোতেন, কে জানে— হয়তো শ্বাসটুকু বন্ধ করে রাখতেন ওই ঘরে থাকা সময়টুকু! নাকি অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল! তা-ই হবে। আর যাকে দিনের অনেকটা সময় ওই ঘরে কাটাতে হচ্ছে, বিছানায় শুয়ে থাকা মানুষটার গা হাত-পা মুছিয়ে দিতে হচ্ছে, খাইয়ে দিতে হচ্ছে খাবার, হাগুমুতু পরিষ্কার করতে হচ্ছে, তার কাছে আবার ওই গন্ধটা কোনও ব্যাপার? মায়েদের, দিদিদের ও সব সয়ে যায়। বা, সইয়ে নিতে হয়। ওদের রান্নাঘর আছে। মশলা, ফোড়নের গন্ধে ও গন্ধ পালিয়ে যাবে। স্নানঘর আছে। নারকোল তেল, কসকো কি তিব্বত সাবানের গন্ধে ও গন্ধ মুছে যাবে। নরম-নরম, ফুলেল লাক্স হলে তো কথাই নেই।

বিছানায় শুয়ে যিনি, তিনি আমার ঠাকুরমা। পক্ষাঘাতে পঙ্গু, প্রকৃতি তাঁর নড়নচড়নে ঢ্যারা টেনে দিয়েছে। গ্রামের বাড়িতে পোষা গরু কী কারণে খেপে গিয়ে ঢুসিয়ে দিয়েছিল, সেই ক্ষত থেকে এই পরিণতি। শহরে আমাদের ভাড়াবাড়িতেই একটা ঘরে তিনি থাকতেন— চিকিৎসার, এবং জীবনেরও শেষ দিকটায়। সেই ঘরেই, ওঁর সঙ্গে থাকত ওই গন্ধটাও। শয্যাশায়ী, মুমূর্ষু রোগীর সামনে এলে যে নাক টিপে ধরে বসতে নেই, আমি কী করে জানব! মা বা দিদিরা নাক থেকে হাত সরিয়ে দিত। তিনি, আমার পিতামহী— কী জানি, দেখেও দেখতেন কি?

গন্ধটার উপকরণ যে কী কী ছিল, এতগুলো বছর পেরিয়ে এসেও বুঝতে পারি না। অনেক ওষুধ, ট্যাবলেট-ক্যাপসুল, সিরাপের শিশি, ইঞ্জেকশন-স্যালাইন একটা ঘরে থাকলে কি ও রকম গন্ধ হয়? তেতো, বিস্বাদ, গা গুলিয়ে-ওঠা একটা গন্ধ? নাকি পেচ্ছাপের গন্ধ, খাটের নীচে রাখা গামলাটা থেকে, বা মানুষটার শরীরে লেগে থাকা ক্যাথিটার থেকে যে গন্ধকণা ছেয়ে যায় ঘরের বাতাসে? বাসি কাপড়-জামার গন্ধ? সময়ে সময়ে বিছানার চাদর, গায়ের সাদা শাড়ি পাল্টে দিলেও যে গন্ধটা আঁকড়ে থাকে খাটের পায়া, টেবিলের কোনা, জানলার পর্দাকে? গজ-ব্যান্ডেজ, টেবিল-খাট মোছার ন্যাতার গন্ধ? নাকি ব্লিচিং পাউডার, ডেটলের— না-জীবনের দিকে মুখ ফিরিয়ে থাকা একটা মানুষকেও যে জীবাণুনাশকের গন্ধও আর জীবনে ফেরাতে পারে না?

তাই আমি নাক টিপে ঠাকুরমার কাছে বসতাম। হাত সরিয়ে দিলেও, আবার সে খুঁজে নিত যথাস্থান। এখন বুঝি, গন্ধ আর ঘ্রাণ, এই দুইয়ের তফাত বুঝতে বড় হতে হয় না। ‘গন্ধ’ শব্দটার মধ্যেই কেমন যেন একটা জৈবিক, একটা পচনশীল ব্যাপার আছে। সুগন্ধের মধ্যে ‘গন্ধ’ থাকলেও সে যেন কেমন খাপছাড়া। ‘গন্ধ’ শব্দটার ওপর একচেটিয়া অধিকার যেন কেবল দুর্গন্ধেরই। আর ‘ঘ্রাণ’ শব্দটা ভালো। জীবনের যা-কিছু কোমল, সুন্দর, সু-স্মৃতি— মনে করায়। জবাকুসুম তেল। মুসুর ডালে পেঁয়াজের সম্বরা। টগবগ ভাতের হাঁড়ি। ইলিশ খেয়ে উঠে হাত শোঁকা। মহাভারতে পড়েছি, বড়রা ছোটদের মস্তক আঘ্রাণ করছেন। আসলে তো স্নেহের স্পর্শ, বাৎসল্যের প্রকাশ। কিন্তু এই ‘আঘ্রাণ’ শব্দটা কী নরম, হালকা!

বহু বছর পরে, এই গেল-ডিসেম্বরে, সেই গন্ধটা ফিরে এল। স্মৃতিটা নয়। সত্যিকারের গন্ধটা। এয়ারপোর্টে নেমেছি, গাড়িতে চেপে বাড়ি পৌঁছেছি, ঢুকেছি ওঁর ঘরে। শুয়ে ছিলেন। শুয়েই থাকতেন দিনের বেশির ভাগ সময়টা। এমন নয় যে অসুখ করেছে মারাত্মক কিছু। জীবন, রোজের রুটিন অমনই হয়ে গিয়েছিল— একটু কাগজ পড়া, কালেভদ্রে বই, নাম কা ওয়াস্তে খাওয়া, ঘরেরই এক কোণে চেয়ার-বাথরুমে পায়খানা-পেচ্ছাপ। ছোড়দি গা মুছিয়ে দেয়, পরিষ্কার করে দেয়। জীবনের চাকা কেমন গড়িয়ে গিয়েও ফিরে ফিরে আসে! ওঁর ঘরে ঢুকতেই, বহু বছর আগের সেই গন্ধটাও ফিরে এল নাকে। এখন তো বড় হয়ে গিয়েছি, ঢাকাচাপায় পারঙ্গম। তাই নাক কুঁচকোল না, হাত চলে গেল না প্রতিবর্ত ক্রিয়ায়। খাটে বসলাম, কথা বললাম, উঠলাম, গেলাম অন্য ঘরে।

আর বুঝলাম। এই এত, এত বছর পর। আমার বাবা, আমার জন্মদাতা বৃদ্ধ পিতার ঘরে যে গন্ধটা ঘুরপাক খাচ্ছিল, সে সেই পিতামহীর ঘরের গন্ধের উত্তরাধিকার। মৃত্যুর গন্ধ।
শিশির রায়
5

প্রপঞ্চ - পল্লববরন পাল ও শিশির রায়

Posted in

প্রপঞ্চ
পল্লববরন পাল ও শিশির রায়



অবাক হয়ে শুনি, কেবল শুনি...

পল্লববরন পাল

মিনার্ভা থিয়েটারে মূকাভিনয় দেখতে গেছি। কিংবদন্তি মূকাভিনেতা শ্রী যোগেশ দত্তের ‘যোগেশ মাইম অ্যাকাডেমি’ এখন ওঁর মেয়ে, আমার বন্ধু-দিদি প্রকৃতি দত্তের হাতে সেজে উঠেছে নবরূপে, অ্যাকাডেমিরই সহধর্মী সংস্থা ‘পদাবলী’র পতাকাতলে সে-দিনের অভিনয়। স্বাধীনতা দিবস এগিয়ে আসছিল সামনে, মুক্তির আবহে তাই ‘পদাবলী’র নিবেদন ‘শহিদ ক্ষুদিরাম’। ১৯৭৭ সালে যোগেশ দত্ত করেছিলেন, নতুন প্রজন্ম নতুন ভাবে আর রূপে সাজিয়েছে তাকে। দর্শকাসনে আমরা ক’বন্ধুও তাই ছিলাম উন্মুখ, উৎকর্ণ।

‘উৎকর্ণ’ বলাটা ঠিক হল? মূকাভিনয় তো নীরব— মূক অভিনয়। সংলাপ আছে, শোনা যাচ্ছে না। মূকাভিনয়ে সংলাপও নিশ্চুপ। এত জন অভিনেতা মঞ্চে, প্রত্যেকের শরীরভাষা আলাদা। কত অনুভূতি আর আবেগ খেলা করছে একসঙ্গে— স্নেহ, ভালোবাসা, ঘৃণা, বন্ধুতা। প্রতিবাদ, প্রতিরোধ। বীরত্ব, শত্রুতা। শরীর‘ভাষা’ যখন, পড়তে তো পারছিই, শুনতেও পাচ্ছি। অথচ অভিনেতাদের মুখ বাঙ্ময় নয়। কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিতে তবু অসুবিধে হয়নি তো কোনও!

মঞ্চে দেখছি ক্ষুদিরামকে। তার বড় হয়ে ওঠা, বিপ্লবী দলে যোগ দেওয়া, বিপ্লবীর প্রশিক্ষণ নেওয়া। সাহেবকে মারতে ভুল করে দুই বিদেশিনি মেমসাহেবকে গুলি ছোঁড়া। পালানো। ধরা পড়ে যাওয়া। একটা আগুনঝরা, সশব্দ, উচ্চকিত সময়কে তো যে কোনও অভিনয়-দল চাইবে স্লোগানে স্লোগানে, বিদ্রোহের আহ্বানে, প্রতিবাদী গর্জনে ভরিয়ে দিতে! পরাধীনতা যেখানে অভিনয়ের বিষয়বস্তু, সেখানে তো মঞ্চ ফেটে পড়ার কথা অনর্গল সশব্দতায়! অথচ, অবাক হয়ে ভাবছিলাম, যেখানে ‘শোনানো’টাই সহজ উদ্দেশ্য হওয়া উচিত ছিল, সেখানে ওঁরা চলে গেলেন ‘না-শোনানো’র রাজ্যে। প্রবল ভাবে সরব হওয়া যেখানে স্বাভাবিক, ইচ্ছে করে সেখানে ওঁরা মূক হয়ে গেলেন। আমি মুখে তোমায় ভোলাব না, ‘মূক’-এ তোমায় ভোলাব। নীরব হয়ে গিয়ে ওঁরা সরবতার দ্বার খুলে দিলেন। নিছক সংলাপের মধ্য দিয়ে যা শুনতাম, কিচ্ছু না-শুনে শুনতে থাকলাম তারও অনেক, অনেক বেশি।

বিস্ময়ের আরও বাকি ছিল। অভিনয়-শেষে, দর্শকের করতালির মধ্যে যখন কুশীলবদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তখন জানলাম, যে অল্পবয়সি ছেলেটি এতক্ষণ ক্ষুদিরামের চরিত্রে অভিনয় করল, সে জন্মবধির! এমনকি, এই নাটকের দুই পরিচালকের একজন— দিলীপ ভট্টাচার্য, যোগেশ মাইম অ্যাকাডেমির বহু দিনের সঙ্গী— তিনিও তা-ই। মনে মনে কল্পনা করার চেষ্টা করছিলাম, অরিন্দম বা দিলীপবাবু রিহার্সালটা কী করে করেন। শ্রবণ-প্রতিবন্ধীদের সাঙ্কেতিক ভাষা আছে, তার ব্যবহারও বহুল প্রচলিত, কে না জানে? কিন্তু যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে কেজো প্রয়োজনীয়তাটুকুর ও-পারে, এক শ্রবণ-প্রতিবন্ধী অভিনেতার সামনে নিজের অভিনয়কে দর্শকদের সামনে শিল্পবস্তু করে তোলার যে চ্যালেঞ্জ থাকে, এত অনায়াসে তা পেরোতে পারলেন কী করে ওঁরা? আক্ষেপ হচ্ছিল, অভিনয়ের আগে ওঁদের রিহার্সাল দেখিনি বলে। তা হলে হয়তো বুঝতে পারতাম: শোনা যায় না যা, তাকে আত্মস্থ, অন্তঃস্থ করা যায় কোন জাদুতে।

ফেরার পথে, ভগিনী নিবেদিতার একটা চিঠির কথা মনে পড়ল— সারদা দেবীকে লেখা। বহু দূর দেশে বসে তাঁর মনে পড়েছে মা’কে, মনে পড়েছে তাঁর ভালোবাসার কথা। সেই নরম, গভীর, নীরব ভালোবাসার তুলনা টানতে গিয়ে নিবেদিতা লিখছেন, ‘...ঈশ্বরের অপূর্ব রচনাগুলি সবই নীরব। তা অজানিতে আমাদের জীবনে প্রবেশ করে— যেমন বাতাস, যেমন সূর্যের আলো, বাগানের মধুগন্ধ, গঙ্গার মাধুরী— এই নীরব জিনিসগুলি সব তোমারই মতো।’

ভাবছিলাম, আমাদের চারপাশের এই চিৎকৃত সময়ের মধ্যে এই নীরবতাগুলিই শ্রেয়। বাইরের কান দিয়ে যা শুনি, সে কি শোনা? যে না-শোনা খুলে দিতে পারে অন্তরপদ্মের পাপড়ি, তাকে চাই— তাকেই।
                                                                                           শিশির রায়
0

প্রপঞ্চ - শিশির রায় ও পল্লববরন পাল

Posted in

প্রপঞ্চ





চোখের বাহিরে...



পল্লববরন পাল
ওই দৃষ্টির সামনে কি দাঁড়াতে পারে কেউ? চোখ রাখতে পারে ওই
চোখে?

শিশুদের চোখ এমনিতেই বড়-বড় লাগে। ছোট্ট মাথা, এট্টুসখানি নাক, গুল্লুমুল্লু ঠোঁট, রেশম-রেশম চুল। এ সৌন্দর্য নয়,একে বলে লাবণ্য। এই বিস্তারের মধ্যে চোখদুটোকে মনে হয় মস্ত একজোড়া আয়না। আর আয়না বলেই তার সামনে দাঁড়ানো যায় না বেশি সময়। নিজেকেই দেখা যায় যে! নিজেকে কি মানুষ অতক্ষণ সহ্য করতে পারে?

এই চোখের সামনে বরং ধরে রাখা যায় একটা জামবাটি। কাঁসার, বা পাথরেরও হতে পারে। ঠান্ডা। ওর ভেতরেই তো জমা হবে বিন্দু-বিন্দু জল। এই মুহূর্তে যে জল টলটল করছে ওই জোড়া-চোখের বাটিতে। একটু ঠেলাতেই কানা ছাপিয়ে গড়িয়ে পড়বে তোমার বাড়িয়ে ধরা জামবাটির মধ্যে। ঠান্ডা বাটির গর্ভে গড়িয়ে আসা গরম জল। তুমি আলতো তর্জনী দিয়ে ছুঁয়ে দেখো! জিভে ঠেকাও একটা মুক্তো! চরণামৃত তো কতই খেয়েছ তুমি, কিন্তু এমন নয়নামৃত?

আপাতত কিন্তু গড়িয়ে পড়ছে না সে-জল। পড়বে-পড়বে করছে, কিন্তু পড়েনি এখনও। চোখের সামনে জামবাটিও ধরা নেই কোনও (ও-সব তো কল্পনা), কিন্তু মুখের সামনে ছোট্ট একটা মাইক্রোফোন আছে। এটা সত্যি। মাথাটা কালো, ছোট্ট—পথেঘাটে হঠাৎ-সাক্ষাৎকারের পরিস্থিতি তৈরি হলে সাংবাদিকদের যেমন দরকার পড়ে, তেমন মাইক। সেটা যাদের সামনে ধরা, তাদের মুখগুলো পাল্টে পাল্টে যাচ্ছে। চোখগুলো কিন্তু একই রকম। টলটল করছে জল। কিংবা আবেগ। ছোট্ট মানুষগুলোর মনের ভেতরের কথাগুলো সব হাত-পা ছুঁড়ে উঠে আসছে চোখে।

মাইকে প্রশ্ন ছিল একটাই। ‘কিছু বলতে চাও, বাবাকে?’ কয়েকটা মোটে শব্দ। তার উত্তরে কী বলল ওই চোখের মালিকরা?‘কেমন আছ, বাবা? ভালো থাকো। খুব ভালোবাসি আমি তোমাকে।’ একজোড়া চোখ প্রশ্নের উত্তরে সপাট সহজ— ‘আমার বাবা মরে গেছে।’ ভালোবাসো বাবাকে? ‘হ্যাঁ।’ কী বলবে বলো, বাবাকে? ‘বলব, ভালোবাসি।’ আর এক জন—দেবদূতের মতো চেহারা, চোখ-মুখ-গাল সব যেন অন্য এক পৃথিবীতে টেনে ধরে রেখেছে কে— বললে, ‘আমি উপহার চাই বাবার কাছ থেকে। খেলনা গাড়ি, খেলনা বন্দুক।’ একজোড়া চোখ তো মাথাই তোলে না। মাটিতে মিশে যেতে চায় যেন।‘আমি চাই, বাবা এসে আমাকে নিয়ে যাক এখান থেকে। গ্রামে, আমাদের বাড়িতে।’ স্ফটিক-স্বচ্ছ দৃষ্টি ফেলে বলে আর এক জন: ‘তুমি এখানে থাকলে কী যে ভালো হত! আমরা একসঙ্গে খেলতাম, খেতাম!’ অন্য একজোড়া চোখ খুব চটপটে— ‘আমরা সবাই আবার একসঙ্গে থাকতে পারলে কী যে ভাল হত! তুমি ফিরে এলে, আমরা আবার বাড়ি যাব, মায়ের কাছে যাব, কেমন? দিদাকে দেখতে যাব— লেবাননে। সেখান থেকে জর্ডন, কেমন হবে?’ খুব মনখারাপিয়া দুটো চোখ বলে, ‘আমি তোমাকে, মা’কে খুব ভালোবাসি। খুউব মিস করি।’ কয়েকটা চোখ তো বলেই না কিছু। তবু, শুধু চেয়ে থেকেই কত কথা যে বলে!

এরা সবাই সিরিয়ার সন্তান। যুদ্ধের ছেলেমেয়ে— চিলড্রেন অব ওয়ার। বাবাকে, মা’কে চোখ মেলে ওরা বলছে বটে কথাগুলো, কিন্তু আমরা জানি, সারা পৃথিবী জানে— ওদের মা-বাবা কেউ বেঁচে নেই আর। কক্ষনও নিতে আসবে না ওদের। বাড়ি নিয়ে যাবে না। ওরা অনিকেত, ওদের বাড়ির নাম ক্যাম্প। শরণার্থী, উদ্বাস্তু— এই শব্দগুলোর মানে ওরা না জেনেও জানে। তবু ওদের চোখগুলো হাসে, ঝকঝক চকচক করে। বাবার কথা শুনলে ওদের ঠোঁটগুলো কমলালেবুর কোয়া হয়ে যায়, চোখগুলো বর্ষার জলে ভরা এক-একটা পুকুর। কেউ অভিমানী চোখের পাতা মেলে ধরে থাকে কেবল। কেউ চোখ সরিয়ে নেয়, অন্য দিকে তাকায়, অন্য কিছু খোঁজার ভান করে শুধু। এতই নিষ্পাপ চোখ, অভিনয় জানে না। ভান— জানে না। 

ওই চোখে কি চোখ রাখতে পারে কেউ? দাঁড়াতে পারে ওই দৃষ্টির সামনে?
শিশির রায়