প্রপঞ্চ - শিশির রায় ও পল্লববরন পাল
Posted in প্রপঞ্চ
প্রাণে তোমার পরশখানি দিও
বাঁ হাতের বুড়ো আঙুলের ওপর গরম জল পড়ে খানিকটা পুড়ে গেল সেদিন।
পল্লববরন পাল |
ফেসবুকের ‘লাইক’ চিহ্নের মতো বুড়ো আঙুলটাকে বাগিয়ে ধরলে, অস্থিসন্ধির যে জায়গাটুকুর চামড়াটা আদুরে পাগ কুকুরের মতো ভাঁজ-ভাঁজ হয়ে থাকে, সেইখানটাই দুর্ঘটনাস্থল। দহনভূমি। বিলক্ষণ জ্বলুনি হলেও, ঠিক করা গেল— বেসিনের কলে জলধারার নীচে আঙুল পাতা হবে না। যন্ত্রণা সহ্য করা হবে। পুড়ে যাওয়া চামড়া, আর তারও বেশি মনকে ভোলাতে— গান শোনা, সিনেমা দেখা হবে। হলও।
রাতে ঘুমও হল। ঘুমের মধ্যে এল স্বপ্ন। একটা মেয়ে, সালোয়ার-কামিজ পরা। জামার হাতা মণিবন্ধ ছুঁয়েছে, ওড়নায় মাথা, চুল ঢাকা। তার মুখটুকু দেখছি— ক্ষত সেরে-ওঠার পর, পুরনো দুঃসহ স্মৃতি ঢেকে দিতে যেমন নিশপিশ করে ওঠে নতুন চামড়া, তেমন ত্বকেরা তার মুখজোড়া রাজত্ব করতে তৎপর। কিন্তু মুখশ্রী? সে বিদায় নিয়েছে। মেয়েটি কথা বলছে, যদিও কোনও শব্দ শোনা যাচ্ছে না স্বপ্নে। প্রতিটি শব্দ উচ্চারণের সঙ্গে কাঁপছে, লাফিয়ে উঠছে তার মুখের হতকুচ্ছিত রেখাগুলি। তার মুখের দিকে তাকিয়েও চোখ নামিয়ে নিতে বাধ্য হচ্ছি আমি।
ঘুম ভাঙতে মনে পড়ল তাকে। বহরমপুরে গিয়েছিলাম সবন্ধু, সেখানকার এক প্রেক্ষাগৃহে নতুন একটি পত্রিকার প্রকাশ-অনুষ্ঠানের সন্ধ্যা ছিল সেটা। মেয়েদের জন্য, মেয়েদের পরিচালিত-সম্পাদিত সেই পত্রিকার উদ্বোধন উপলক্ষে উদ্যোক্তারা মঞ্চে আসন গ্রহণের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন কয়েক জন নারীকে। প্রত্যেকেই বিশিষ্ট, অনন্য। লব্ধপ্রতিষ্ঠ কবি। সুদক্ষ প্রশাসক। সক্রিয় সমাজকর্মী। উন্নতশির স্বাবলম্বী। প্রত্যেকেই বললেন কিছু না-কিছু।
আর ছিল সেও। সেও বলল। মাইক্রোফোনের সামনে পিঠ টানটান করে, গ্রীবা তুলে, নরম কিন্তু দৃঢ় কণ্ঠস্বরে। তার জামার হাতা মণিবন্ধ ছুঁয়েছে, ওড়নায় চুল ঢাকা। প্রকাশ্য শুধু যে মুখটুকু, ঝলসানো চামড়া নিয়ে সেই মুখ সেই সন্ধ্যায় দর্শকের মুখোমুখি। সে তার নিজের কথা বলল। নিজের জীবনের কথা। সহজ সাধারণ সেই জীবন, বয়ে চলছিল ঘটনাবিহীন। একেবারেই ঘটনাবিহীন কি? যেমন উঠতি বয়সের মেয়েদের পিছনে ঘুরঘুর করে কলার-তোলা ছেলেছোকরারা, তার সঙ্গেও ঘটছিল একই জিনিস। মেয়েটি চায় না, ছেলেটি চায়। ওর না— এ হ্যাঁ করেই ছাড়বে। মেয়ের মন ওঠে না, ছেলের প্রত্যাখ্যান সয় না। সমাধানের সুতোয় বাঁধা পড়তে চায় না যে সমস্যা, তার নিষ্পত্তি কোথায়, কিসে? মগ-ভর্তি অ্যাসিডে। মেয়েটার মুখের উপর ছুড়ে দিয়ে ফেরার হয়েছিল ছেলেটা।
আক্ষরিক অর্থেই মুখ পুড়েছে যার, সে মুখ দেখায় কী করে? মামলা-মকদ্দমা, আইন, থানা-পুলিশ— সব কিছু সামলানোর পরেও তো এক-একটা দিনের, একটা জীবনের অনেকটা সময় বাকি থেকে যায়। সেই সময় একাকী সময়। সেই একাকী সময়ে পোড়ারমুখী মেয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ায় কী করে? নিজের খসে-পড়া, গলে-যাওয়া, ঝুলে-থাকা চামড়া নিজের চোখে দেখে তার কী মনে হয় নিজেকে? মনে কি হয়, এ জিনিস আমাকে নিজের চোখে দেখতে হচ্ছে কেন? আমার চোখদুটো অ্যাসিড থেকে বেঁচে গেল কেন? নাকি আয়নায় আর মুখ দেখে না সে? কাচের আয়নাকে যদি বা সরিয়ে ফেলা যায় জীবন থেকে, সহ-মানুষের চোখের আয়না?
না, দগ্ধ মুখ সে সরিয়ে নেয়নি সমাজ থেকে। বরং ওইটিকেই করে তুলেছে এক আন্দোলনের অভিজ্ঞান। নিজের কথা, নিজের লড়াই নিয়ে বলতে ছুটে ছুটে যায় সে— গ্রাম থেকে শহরে, ঘরোয়া আড্ডা থেকে সুগম্ভীর আলোচনাসভায়। তার মুখ দেখে শিউরে ওঠে দর্শক, সে কিন্তু চোখে চোখ রেখে কথা বলে ঠিক। তার হতশ্রী মুখ তাকে মানুষ চিনতে শিখিয়েছে। তাদের বাড়িতে আসা বন্ধ করা মানুষ, যোগাযোগ ছিন্ন করা মানুষ। আবার— ‘আয়, কাছে এসে বোস’ বলে ডেকে নেওয়া মানুষ, মাঝে মাঝে প্রাণে স্নেহের পরশ দেওয়া মানুষ।
মসৃণ কিংবা বিক্ষত, চামড়ায় যায়-আসে অনেক কিছুই। নিজের বাঁ হাতের বুড়ো আঙুলের দিকে তাকিয়ে আমি সেই মেয়েটির কথা ভাবি।
শিশির রায়