0

প্রপঞ্চ - শিশির রায় ও পল্লববরন পাল

Posted in

প্রপঞ্চ





চোখের বাহিরে...



পল্লববরন পাল
ওই দৃষ্টির সামনে কি দাঁড়াতে পারে কেউ? চোখ রাখতে পারে ওই
চোখে?

শিশুদের চোখ এমনিতেই বড়-বড় লাগে। ছোট্ট মাথা, এট্টুসখানি নাক, গুল্লুমুল্লু ঠোঁট, রেশম-রেশম চুল। এ সৌন্দর্য নয়,একে বলে লাবণ্য। এই বিস্তারের মধ্যে চোখদুটোকে মনে হয় মস্ত একজোড়া আয়না। আর আয়না বলেই তার সামনে দাঁড়ানো যায় না বেশি সময়। নিজেকেই দেখা যায় যে! নিজেকে কি মানুষ অতক্ষণ সহ্য করতে পারে?

এই চোখের সামনে বরং ধরে রাখা যায় একটা জামবাটি। কাঁসার, বা পাথরেরও হতে পারে। ঠান্ডা। ওর ভেতরেই তো জমা হবে বিন্দু-বিন্দু জল। এই মুহূর্তে যে জল টলটল করছে ওই জোড়া-চোখের বাটিতে। একটু ঠেলাতেই কানা ছাপিয়ে গড়িয়ে পড়বে তোমার বাড়িয়ে ধরা জামবাটির মধ্যে। ঠান্ডা বাটির গর্ভে গড়িয়ে আসা গরম জল। তুমি আলতো তর্জনী দিয়ে ছুঁয়ে দেখো! জিভে ঠেকাও একটা মুক্তো! চরণামৃত তো কতই খেয়েছ তুমি, কিন্তু এমন নয়নামৃত?

আপাতত কিন্তু গড়িয়ে পড়ছে না সে-জল। পড়বে-পড়বে করছে, কিন্তু পড়েনি এখনও। চোখের সামনে জামবাটিও ধরা নেই কোনও (ও-সব তো কল্পনা), কিন্তু মুখের সামনে ছোট্ট একটা মাইক্রোফোন আছে। এটা সত্যি। মাথাটা কালো, ছোট্ট—পথেঘাটে হঠাৎ-সাক্ষাৎকারের পরিস্থিতি তৈরি হলে সাংবাদিকদের যেমন দরকার পড়ে, তেমন মাইক। সেটা যাদের সামনে ধরা, তাদের মুখগুলো পাল্টে পাল্টে যাচ্ছে। চোখগুলো কিন্তু একই রকম। টলটল করছে জল। কিংবা আবেগ। ছোট্ট মানুষগুলোর মনের ভেতরের কথাগুলো সব হাত-পা ছুঁড়ে উঠে আসছে চোখে।

মাইকে প্রশ্ন ছিল একটাই। ‘কিছু বলতে চাও, বাবাকে?’ কয়েকটা মোটে শব্দ। তার উত্তরে কী বলল ওই চোখের মালিকরা?‘কেমন আছ, বাবা? ভালো থাকো। খুব ভালোবাসি আমি তোমাকে।’ একজোড়া চোখ প্রশ্নের উত্তরে সপাট সহজ— ‘আমার বাবা মরে গেছে।’ ভালোবাসো বাবাকে? ‘হ্যাঁ।’ কী বলবে বলো, বাবাকে? ‘বলব, ভালোবাসি।’ আর এক জন—দেবদূতের মতো চেহারা, চোখ-মুখ-গাল সব যেন অন্য এক পৃথিবীতে টেনে ধরে রেখেছে কে— বললে, ‘আমি উপহার চাই বাবার কাছ থেকে। খেলনা গাড়ি, খেলনা বন্দুক।’ একজোড়া চোখ তো মাথাই তোলে না। মাটিতে মিশে যেতে চায় যেন।‘আমি চাই, বাবা এসে আমাকে নিয়ে যাক এখান থেকে। গ্রামে, আমাদের বাড়িতে।’ স্ফটিক-স্বচ্ছ দৃষ্টি ফেলে বলে আর এক জন: ‘তুমি এখানে থাকলে কী যে ভালো হত! আমরা একসঙ্গে খেলতাম, খেতাম!’ অন্য একজোড়া চোখ খুব চটপটে— ‘আমরা সবাই আবার একসঙ্গে থাকতে পারলে কী যে ভাল হত! তুমি ফিরে এলে, আমরা আবার বাড়ি যাব, মায়ের কাছে যাব, কেমন? দিদাকে দেখতে যাব— লেবাননে। সেখান থেকে জর্ডন, কেমন হবে?’ খুব মনখারাপিয়া দুটো চোখ বলে, ‘আমি তোমাকে, মা’কে খুব ভালোবাসি। খুউব মিস করি।’ কয়েকটা চোখ তো বলেই না কিছু। তবু, শুধু চেয়ে থেকেই কত কথা যে বলে!

এরা সবাই সিরিয়ার সন্তান। যুদ্ধের ছেলেমেয়ে— চিলড্রেন অব ওয়ার। বাবাকে, মা’কে চোখ মেলে ওরা বলছে বটে কথাগুলো, কিন্তু আমরা জানি, সারা পৃথিবী জানে— ওদের মা-বাবা কেউ বেঁচে নেই আর। কক্ষনও নিতে আসবে না ওদের। বাড়ি নিয়ে যাবে না। ওরা অনিকেত, ওদের বাড়ির নাম ক্যাম্প। শরণার্থী, উদ্বাস্তু— এই শব্দগুলোর মানে ওরা না জেনেও জানে। তবু ওদের চোখগুলো হাসে, ঝকঝক চকচক করে। বাবার কথা শুনলে ওদের ঠোঁটগুলো কমলালেবুর কোয়া হয়ে যায়, চোখগুলো বর্ষার জলে ভরা এক-একটা পুকুর। কেউ অভিমানী চোখের পাতা মেলে ধরে থাকে কেবল। কেউ চোখ সরিয়ে নেয়, অন্য দিকে তাকায়, অন্য কিছু খোঁজার ভান করে শুধু। এতই নিষ্পাপ চোখ, অভিনয় জানে না। ভান— জানে না। 

ওই চোখে কি চোখ রাখতে পারে কেউ? দাঁড়াতে পারে ওই দৃষ্টির সামনে?
শিশির রায়

0 comments: