0

প্রবন্ধ - চিত্তরঞ্জন হীরা

Posted in

প্রবন্ধ


নাকথার ভাষা : কিছু প্রেম, কিছু স্বাধীনতা
চিত্তরঞ্জন হীরা



দিনে দিনে দেখছি শরিকি ঝামেলাটা লেগেই থাকছে আবেগ এবং যুক্তির মধ্যে। কে কতটা অংশ নেবে, কার সীমা কোন্ পর্যন্ত – এ নিয়ে ঝগড়া-বিবাদ, চলতেই থাকে। একটা দেশ স্বাধীন হতে পারে, একটা বয়স (নির্দিষ্ট কাল পেরিয়ে যাওয়ার পর) স্বাধীন হতে পারে, কিন্তু একটা ভাষা পারে না? এমন প্রশ্ন কারও কারও মনে জাগতেই পারে। আর যদি নাও জাগে, আজ মনে হলো আমরা এটা নিয়েই কিছু কথা বলবো। নাকথার ভাষায় যতটুকু সাধ, কিছু প্রেম, কিছু স্বাধীনতা।

মাতৃভাষাকে ভালোবাসার জন্যে প্রথমত চাই একটা জাতীয়তাবোধ, তারপর ঔপনিবেশিক দাদাগিরি এড়িয়ে নিজের মত তার চলাবলাকে প্রসারিত করা। এখানে থাকবে না অন্য কোনও ভাষার অনুশাসন। থাকবে না কোনও বাধ্যতা। এমনটা একটা রাষ্ট্রই এনে দিতে পারে। কিন্তু এটা দিয়ে ঠিক ভাষার স্বাধীনতা বোঝানো যাবে না। পাশাপাশি, ভাষার ঔপনিবেশিকতা নিয়ে লম্বা চওড়া গল্পটাও না হয় বাদ রেখে আমরা একটু সোজাসাপটায় যাই।

ভাষার স্বাধীনতা হলো নিজেকে প্রকাশ করার জন্যে কিছুটা উদার হয়ে ওঠা, কিছুটা আপন সত্তায় স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠা। যদিও আমরা শুদ্ধ বাংলা বলতে শব্দ ব‍্যবহারের ছুঁৎমার্গতা বর্জন করেছি বহু আগেই। চেয়ার, টেবিল, কাপ, প্লেট, পেন-পেনসিল দিয়ে কেউ আর হয়তো কোনও ব‍্যাক‍রণে তাকে বাঁধতে চাইছে না। কারণ এই শব্দগুলো অভিধানে বাংলা না পরভাষা, আমরা খুঁজতে যাই না আর। এমনই বাঁধাহীন একটা ভাষা এখন চলেছে নতুন পথের সন্ধানে‌। আরও আরও দুঃসাহস নিয়ে যতটা পেরোলে ঠিক পথিক বলা যায়!

আরেকটু এগোলেই সূর্যাস্তের পাড় ধরে যেখানে গোধূলিরঙ সন্ধ্যা আসবে। আরবসাগরের জল নীল থেকে আরও নীল, নীলাব্জ। সহকলায় আশ্চর্য আসমানিয়া। রাত্রি এসে ধুয়ে দেবে সমস্ত দিনের ক্লেদ। আমরা আমাদের পতাকার রঙে রোদের বেড়ে ওঠা দেখতে দেখতে বলবো, এই তো ভূভারত সুধাময়, নতুন সকাল। ভোর এসে রেশমিডানা মেলে বলবে,হারমোনিতে হিম লেগেছে। কাফেটরিয়ায় ধোঁয়া উড়ছে, বলো সম্ভাবনা। উড়ছে কুয়াশাফের মেঘান্তরার পাখি। পাখি পাখি মেঘের আকাশ, বলো সম্ভাবনা। খুব ভোর ভোর হয়তো কবিও লিখে ফেলবেন এভাবেই দুকলম–

'আমার অন্তরের চিৎকার, ব‍্যাকুলতা
আর অসম্ভব অপেক্ষাগুলো কুড়িয়ে এনে
এই উঠোন, সিঁড়ি, জানালা…'
(তারককুমার পোদ্দার)

আর একটু এগোলেই নির্বিকল্প সরণির বাঁকে আমাদের দেখা হলে দুজনেই বলে উঠবো, স্বাধীনতা। জড়িয়ে ধরবো একে অন্যকে।

#

তো দাঁড়ালো এই, কবি একটু স্বেচ্ছাচারী হলেই ভাষার স্বাধীনতা আসে। একটা পুরোনো পথের উপর নতুনের প্রলেপ পড়ে। এক্ষেত্রে আবেগকে একটু নড়েচড়ে বসতেই হয়। শুধু আবেগ দিয়ে কোনও নতুন পথ গড়ে তোলা সম্ভব নয়। আবেগ হলো বিশ্বাসের, আর যুক্তি থাকবে একান্তপন বিশ্লেষের জায়গায়। এই দুয়ের মাঝখানে তার মনবাড়িটা সব দেখছে। থেকে থেকে মননের দিকে একটা ঝুলন্ত সিঁড়ি রেখে ইন্দ্রিয়াতীত বোধে জুড়ছে অভিজ্ঞতা। প্রশ্ন তখন সত্তার আহার হয়ে ঝুলন্ত সিঁড়ির মুখে বনভোজনে মেতে আমাদের দেখাতে চাইছে প্রস্থানবিন্দুটি কোথায়! অর্থাৎ কোথা থেকে আমাদের শুরু হয়েছিল, আর আমরা যেতে চাই কোথায়!

তর্কটা বহুদিনের। কিন্তু আমরা আর পেছন ফিরে তাকাতে চাইছি না। প্রয়োজনে আরও একটু ভেঙে বাড়িটাকে না হয় নতুন করে গড়বো, একেবারে ভিত থেকে তুলবো। আমাদের একটা নতুন বাড়ি চাই, স্বাধীন সত্তার বাড়ি। কবি থাকবেন প্রবহমান শব্দের নিত্যসঙ্গী হয়ে। শব্দকে ভাঙবেন, খুঁড়বেন, মাটি তুলে তুলে সেই খননগুহার পাড়ে রাখবেন কিছুটা প্রত্নরূপ করে। তারপর সেই নতুন বাড়িটির ভিতে দাঁড়িয়ে হয়তো দেখে ফেলবেন– 

'এই ঘর মৃত্যুর চোয়াল।
দরজার খুব কাছে ঝোপঝাড় হয়ে আছে
অজস্র বাক্যের ক্ষুরধার।
নির্জনতা যেন এক স‍্যানেটোরিয়াম।'
(শ‍্যামশ্রী রায় কর্মকার)

এই হলো একটা বাড়ি তৈরির ভিত, ভাষার স্বাধীনতা, ভাষা ব্যবহারের স্বাধীনতা। অবিশ্রাম উল্লাস থেকে পাওয়া নয়, একনিষ্ঠ নীরবতা। যাঁর ভেতরে এই ধ্বনিগুলো বাজছে, তিনিই নিয়ত বাস্তবকে অন্যরূপে দেখার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। যেমন ঘরকে কী ভাবে মৃত্যুর চোয়াল হিসাবে দেখা যায়, বা ঝোপঝাড়গুলো কীভাবে অজস্র বাক্যের ক্ষুরধার হয়ে উঠতে পারে– এই দেখা এবং পাওয়াটাই একজন কবিকে স্বাধীন করে তোলে। যেমন সামান্য হয়েও অসামান্য –

'দুঃখ- রেশমগুটির নীচে শুয়ে থাকা ব‍্যাঙের আর্তস্বর
সুখ- কোনো এক সম্রাটের শুঁড়হীন হাতি'
(রেজাউদ্দিন স্টালিন)

এখানেই অনুভূতির বৈচিত্র্য। যা একটি শব্দকে নানা ব‍্যঞ্জনায় ফুটিয়ে তুলতে সাহায্য করে। কিন্তু ভেতরের অভিঘাত ছাড়া এই বোধ বা অনুভুতির জন্ম হতে পারে না।

অভিঘাত হলো অতৃপ্তিজাত। একজন কবি তখনই অস্থির হবেন, যখন তিনি যা দেখতে চাইছেন তার স্বরূপটি ফুটিয়ে তুলতে পারছেন না। তিনি জানেন বাইরের দেখাটাই সব দেখা নয়। বাইরের দেখার মধ্যে যে ঘটমান বর্তমান, তার একটা পুরাঘটিত অতীত রয়েছে, একটা সম্ভাবনার আগত কাল রয়েছে। এভাবে একটি স‍্যানেটোরিয়াম থেকে ব‍্যাঙের আর্তনাদ ধরে সেই শুঁড়হীন হাতিটির কাছেই আমাদের তো পৌঁছাতে হবে। এইসব নাকথাগুলো ভাষা পেয়ে যায় এমনি এমনি, তখনই স্বাধীনতা …।

#

আমরা অপরিচয়ের অন্ধকার হাতড়ে আরেক আলোর গভীরে প্রবিষ্ট হতে চলেছি। অতলের প্রকোষ্ঠ ভেঙে বের করে আনতে চলেছি আরও একটি নতুন রূপ, নতুন প্রাণ, যাকে দেখলে মনে হবে, ঠিকই তো, এর কোনও বিকল্প হয় না, অথচ অদৃষ্টপূর্ব। আগে তো ভাবিনি। এভাবেই দুপুর খোলা নৈঃশব্দ্যের একখানা সাদাপাতা আমাদের দেখিয়ে দিতে পারে–

'লোকটার ব্লাডগ্রুপ জেড প্লাস
দরজা না খুলেই বলে দিল
ভিতরে আনমনা আছে
তার লীলায়িত বেগম বাহার।'
(কমল চক্রবর্তী)

এ হলো ভাষা দিয়ে ভাবনার মূর্তিকে বিমূর্ত রেখে একটা অবয়বে গড়ে তোলার স্বাধীনতা। যাতে রয়েছে অনির্বচনীয় স্ফূর্তির টান। মায়া তার নির্মোহকে দেখছে। খোলস ছাড়াতে ছাড়াতে ভিতরে ঢুকছে, অতলে ঢুকছে, খননের পথ দীর্ঘ করছে। তার লীলা বোঝা ভার। কিন্তু বোঝাটা যখন সহজ হয়ে উঠবে, তখনই সে বেগম বাহার – আহা!

ঘটনা এভাবেই ঘটে। তলে তলে আরও অনেক কিছু ঘটে যায়। স্বাধীন সত্তার প্রকাশ শুরু হয়, যে শব্দের আধারে থাকে, কিছুটা শক্ত খোলসে। প্রকাশের পথটা কবির কাছে একবার উন্মুক্ত হয়ে গেলেই তাঁর আর মুক্তি নেই। অতল জলের ডাক, স্রোত ভেঙে, ঘুম ভেঙে, এবার তাঁকে ধরা দিতে চায়।

#

আসলে কোনও শব্দই স্বপ্ন থেকে আসে না। কবি নিরন্তর শব্দের গর্ভ নিয়ে খেলছেন। পথ চলতে চলতে, চারপাশের আলোড়ন থেকে, ঘটনার অভিব‍্যক্তি থেকে তাঁর ভেতরে অনর্গল খেলা চলতেই থাকে। কিছু ফেলছেন, কিছু রাখছেন, কিছু ভাঙছেন, তারপর গড়তে বসা। সাদাপাতায় বা আজকের যান্ত্রিক পর্দায় যে রূপটি প্রথম ফুটলো, তার আগে ভেতরে ভেতরে অনেক অনেক মূর্তির গঠন-বিগঠন হয়ে গেছে। এরপরও রয়েছে ছিঁড়ে ফেলা, মুছে ফেলা, আরও কত খেলা। এই খেলাই তাঁর নিয়তি। এতসবের পরও তিনি তৃপ্ত হতে পারেন না। যে কবি তাঁর কাঙ্খিত অবয়বটি পেয়ে গেছেন ভেবে আনন্দে বিভোর হয়ে পড়েন, তা হয়তো মুহূর্তের আনন্দ। আবার ফিরে পড়তে বসলেই মনে হবে, কিছুই হলো না‌। এই মনে হওয়াটা তাঁকে আরও একটি নতুনের জন্যে অতৃপ্ত করলো। যা নির্মোহ, তাই-ই সত্য–

'ঘরে ঘরে কাশ ফোলানো আকাশ। চারদিক
জড়িয়ে একটা গোটা, একটা সমস্ত উঠছে ভোর
জাগার আগে। টেবিলের সমতলে তোমার
বিশ্ব ভাসানো পেনসিলে শব্দ উঠছে কবিতার।'
(প্রণব পাল)

বীজ যখন গর্ভে পড়ে, সে বর্তমান স্থিতি ছেড়ে, নস্যাৎ করে নিষেকে নামে। গর্ভ পূর্ণ হয়ে যা প্রকাশিত হলো, পাঠক যে প্রসূত শিশুটির মুখ দেখতে পেলেন, তা ঐ বীজগর্ভের আলো,কিন্তু আপাত ধ্বনির সন্তান। বহুধ্বনির সমষ্টি নিয়ে কবি যাকে শব্দের মোড়ক দিলেন, তা আসলে ধ্বনি থেকে শব্দে, শব্দের সঙ্গে শব্দ মিলিয়ে এক একটি বাক্য বা পংক্তির ধারণা। এই ধারণা ও প্রক্রিয়ার সঙ্গে পাঠক সম্পৃক্ত হলে তবে তাঁরও মধ্যে নানারকম ক্রিয়া-বিক্রিয়া ঘটবে। এবার পাঠক নিজের মত করে একটি কবিতার বয়ান অথবা শব্দাধার তৈরি করে নিতে পারবেন।

এই পর্যন্ত এসে হয়তো পাঠক বললেন, বুঝেছি। কিন্তু কী বুঝলেন! কবিতা তো যতটা বোঝার নয়, অনুভবের, তারচেয়ে বেশি হলো বাজার, বেজে ওঠার। কবি পরোক্ষে পাঠকের ভেতরে ঢুকবার দরজাটা শুধু একটু ফাঁক করে রাখেন। বাকি কাজটা তখন ঐ পাঠকের। পাঠক ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে যতটা বাজবেন, তাঁর ভেতরেও একটা ভাষাদেশ গড়ে ওঠার সম্ভাবনা তৈরি হবে। তাঁর কথার ভোল বদলে যাবে নতুন শব্দে, শব্দসম্ভারে। নিজেকে পেতে থাকবেন আপন সত্তায়, উন্মোচনের মাধ্যমে।

#

মানুষ মূলত নিজের মত করে বাঁচে। এখানে আমরা আত্মশক্তির কথা বলতে চাইছি। বেড়ে ওঠা, বড় হওয়ার পর হয়ে ওঠা। হয়ে ওঠার জন্যেই বেরিয়ে পড়া। পথ যে ডাকছে। জল,আলো, বাতাস ডাকছে, আকাশ ডাকছে। কখনও ডুব, কখনও সাঁতার। ভাষায় ভেসে। ভেসে ডুবে কবি দেখছেন তাঁর সারা গায়ে এত এত মৃতশব্দের শ‍্যাওলা জমে আছে! শ‍্যাওলা মুছতে জল, জল মুছতে জলজঞ্জাল। সব কি সাফ হয়ে এলো! কে যেন ডাক দিলো ‌– সুন্দর এখানে একা নয়। আলোর বুদবুদ গায়ে মেখে একটি হরিণী তাকিয়ে আছে জলভরন্ত চাঁদের কিনারে। কানায় জ‍্যোৎস্না লেগে আছে। বেলা কি পড়ে এলো! আমরা দিন এবং রাত্রির মাঝে পড়ে হাবুডুবু, তখনই দেখি –

'ক্ষতচিহ্ন থেকে উঠে আসা জিজ্ঞাসাশহর, তার পাপড়িগুলো
তৃতীয় বন্ধনী থেকে হারিয়ে যাচ্ছে দূরে'
(শান্তিময় মুখোপাধ্যায়)

হারাতে হারাতে আমারই আত্মার খোঁজ দেয়। আমার গভীরতম আত্মায় যে 'আমি', তাকে জাগিয়ে তোলার কথা বলে। বন্ধনী খুলে দিয়ে দূরকে দেখায়‌। অনির্দিষ্ট যাত্রার কথা বলে। কারণ, তারও কিছু প্রত‍্যাশা থেকে যায়, কিছু কিছু প্রণোদনা।

মন বলছে, জীবন নানা তালবাদ‍্যের সমাহারে গড়া। তার যে কী ছন্দ, কী লয়, আমরা বুঝে উঠতে পারিনা‌। শুধু জীবন কাটাই। কিন্তু ভাষা বোঝে সময়ের ক্লান্তিকে। বোঝে বিকারগ্রস্ততা। প্রাণের উৎসে আরেক প্রাণ, আরেক বীজের জীবন, সেখানেই কবিতা।

একজন তরুণতম কবি আত্মপ্রকাশের নিছক তাড়না নিয়ে হয়তো কোনও এক আশ্চর্য সকাল বা নিঃশব্দ রাতে লিখে ফেললেন একটি কবিতা। তাঁর যে কী আনন্দ! ক্রমশ তাঁকে পেয়েও বসে আত্ম-আবিষ্কারের খেলায়, তখনই হয়তো একটু একটু করে টের পান না হয়ে ওঠার বেদনা। এই অনুভবই তাঁকে আলাদা হওয়ার রাস্তা দেখাবে। শুরু হবে অন্তর্ব‍্যাপী বেদনার স্ফূরণ। তাঁকে টেনে নিয়ে যাবে আত্মহননের দিকে। প্রতিটি ঘটনার স্পন্দন, প্রতি মুহূর্তের গ্লানি, ব‍্যর্থতা, কিছুই যাবে না ফেলা। শিরায় শিরায় গোপন সংঘাতের তাড়না। তিনি ছুটে চলেছেন অনিশ্চয়ের দিকে। যা কিছু অনির্নেয়, যা অনিশ্চয়, সেখানেই এক নতুনের সম্ভাবনা।

কোনও বস্তু বা বিষয়ের নির্দিষ্ট কোনও অর্থ নেই, সে প্রকাশিত হয় এক একটি চিহ্নের মধ্যে প্রতীকি ব‍্যঞ্জনায়। অর্থাৎ বহু প্রতিশব্দের মধ্যেই তার অবস্থান। যে যত বেশি প্রতিশব্দের সন্ধান দিতে পারে ততই তার ব‍্যাপ্তি, তার প্রসারতা।

#

অসংযোগ, অসন্তোষ নিয়ে মুহূর্তের 'আমি' চিরন্তনের খোঁজে যখন নেমেছে, তার আর পিছুটান কীসে, কীসের মায়া! গৃহে আছো পাঁকাল মাছের মত, গৃহী হয়েও সন্ন্যাসীর মত,বলোতো সংসারের কোন্ কাজে তোমার মন আছে! জীবনে দুঃখ ছাড়া আর কোনও সঞ্চয়ও তোমার নেই। কারও নিঃসঙ্গতার উট হয়ে মরুভূমি পার করে দিতে পার না। শুধু নিজেকেই, নিজেকে নিয়েই শববাহকের সঙ্গে পাড়ি দিচ্ছ। তারপর দেখতে দেখতে–

'গোটানো ছাতার কাছে শেষ আর্জি পেশের সময়
আমার ভেতরের দোলনাটা যে ভাঙ্গতে দোলে
তাকে তোমরা সংশয় বা স্ববিরোধ বলতেই পারো'
(উমাপদ ক‍র)


কিন্তু ঐ যে শেষ বলে কিছু নেই, আর আলাদা হতে হলে নিঃসঙ্গ হতে হয়। শববাহকের সঙ্গে তুমি যে চলেছো, সেটা হলো মৃতশব্দের শব নিয়ে। তাহলে তোমার সংযোগ কোথায়! তুমি দুঃখকে বুকে টেনে নাও, ভাষাকে জড়াও। দাহ করো, দহনে পোড়ো। পুড়ে পুড়ে খাক হয়ে এবার দেখো একটা নতুন শব্দশিশু উঁকি দিচ্ছে তোমার জন্যে। তাকে তোলো, লালন করতে হবে যে।

#

তো বিষয় রয়েছে অবিষয়ের মধ্যেই, কথারা মেলছে নাকথার ডানা। বাকিটা ভাসা ভাসা কথার কথা মাত্র। ভাষাই জানান দেয় কবিতার অস্তিত্বকে। আর ভাষার স্বতন্ত্রতায় কবির অস্তিত্ব। এই দুই সত্তার মধ্যে মিলে মিশে প্রবাহিত কাল, সময়, সমাজ, মায় সভ‍্যতা। আমাদের খুঁজে নিতে হবে কবি কি সভ‍্যতার পিঠে চড়ে সময়ে পাড়ি দিচ্ছেন, না কালান্তরে গড়ে তুলতে চাইছেন নিজেই এক সভ‍্যতা!

এ প্রসঙ্গে দুটি ধারার হাত ধরে আমরা কিছুটা পথ এগোতে পারি। একই সময়ে দাঁড়িয়ে দুজন কবি জীবনকে দুভাবে দেখছেন, তাঁদের ভাষাও আলাদা হয়ে সেভাবে কবিতায় অবস্থান করছে। একজন হয়তো অপসৃয়মান এক অলীক মায়ায় গড়ে ফেললেন আত্মপ্রতিমাখানি, আমরা মুগ্ধ হলাম। আবার আরেকজন সব বাঁধন কেটে প্রবাহিত মূর্তিমিথ ভেঙে সংগ্রহ করলেন রহস্যের কিছু অভূতপূর্ব ব‍্যঞ্জনা। আমরা মুগ্ধ হলাম না, কিছুটা দ্বিধাগ্রস্থ হলাম, অস্থিরও হলাম, কারণ স্বাভাবিক পাঠ-অভ‍্যাসে সে আঘাত করছে। কিন্তু কবিতা রয়েছে এ দুয়ের মধ্যেই। মুগ্ধতা এবং অস্থিরতা, দুই-ই শিল্পের বিশেষ লক্ষণ, বিশেষ প্রবণতা। ভাঙতে ভাঙতে গড়ে তোলা যেমন শিল্পীর ধর্ম, তেমনি নতুনের সন্ধানে নেমে চেতনার প্রসার ঘটানোও তাঁর দায়বদ্ধতা।

আমরা দুটি উদাহরণ পাশাপাশি রেখে দেখি। যেমন–

'যে মুহূর্তে হেমলক জিভে ছোঁয়ালেন
সেই সময় থেকেই তাঁর অমরত্বের যাত্রা শুরু।'
(শুভঙ্কর দাশ)

এই ঘটনার অভিঘাত থেকে যে সত্যটুকু নির্গত হয়, তা সত্যই। এ হলো প্রথম বিস্ময়, যেখানে রয়েছে মুগ্ধতা। কিন্তু কোনও ভাবনার বাঁক এখানে তৈরি হলো না।

আবার আর একজন কবি একই সময়ে দাঁড়িয়ে লিখছেন–

'বৃষ্টিব‍্যাগ থেকে ভোকাট্টা নামে।
অনেকটা বেড়াল নিয়ে
চুপি চুপি
বিকেলের গোলাপির গায়ে ঝিলিক হয়ে বাজে।'
(কৌশিক চক্রবর্তী)

এখানে আর আমরা অতীত বা বর্তমানের কোনও ঘটনা থেকে উত্থিত সত্যের অভিঘাত পেলাম না। স্বাভাবিকভাবেই আমাদের কারও কারও কাছে এটা অর্থহীন, নাহলে দুরূহ মনে হতে পারে। আসলে সরল সংযোগের অভাবে মনে একটা অস্থিরতাই সৃষ্টি করলো। কিন্তু যিনি এই রহস্যঘরের চাবিটি কোথায় তা জনেন, তাঁর কাছে নানারকম দৃশ্যের দোলা সৃষ্টি হতে বাধ্য। যেমন বৃষ্টিব‍্যাগ বলতে কী কী বুঝে নেওয়া যেতে পারে! ধরা যাক আমরা মেঘ বুঝলাম। আর ভোকাট্টার সঙ্গে ঘুড়ির একটা যোগ যেমন রয়েছে, আবার হারিয়ে যাওয়া বা মিলিয়ে যাওয়াও ধরা যেতে পারে। মেঘ দেখলে কারও কারও মন উদাস হয়, মেঘের সঙ্গী হয়ে হারিয়ে যেতে যেতে কাটা ঘুড়ির মত ভোকাট্টা হয়ে পড়তে ইচ্ছে করে। একটা বিকেল, একদিকে গোধূলির রঙ আর বিজলি ঝিলিক তাকে আরও উদাসী করলো। ঘর ছাড়া করলো। বেড়ালও এখানে মেঘের সঙ্গে যায়, যেমন কেউ কেউ বুনো মোষের সঙ্গে মেঘের তুলনা দেখেছেন। এভাবে খুঁজে পেতে বের করা যায় আরও আরও অনেক অসম্ভবের সম্ভবতা। আসলে আজ যা সহজগ্রাহ‍্য নয়, কালের নিয়মে ভবিষ‍্যৎ তার জন্যে আসন পেতে বসে আছে। এক্ষেত্রে মাইকেল, জীবনানন্দ প্রমুখরা খুবই প্রাসঙ্গিক উদাহরণ। এখানে দৃশ্যের অবতারণা হয়েছে বা যে দৃশ্যকল্প তৈরি করলো তা অবশ্যই নৈসর্গিক এবং বহুমাত্রিক। দৃশ্যতই আমাদের অনেকগুলো বাঁকে এনে ফেললো। আমরা আগে বেজে ওঠার কথা বলেছিলাম, এখানে দেখার তাড়না, ভিন্ন চোখে দেখা, অস্থির হতে হতেও যাকে নস‍্যাৎ করতে পারলাম না। এখানেই এর মজাটা। শুধু আমাদের নিজেদের মত করে এর মধ্যে জড়িয়ে পড়তে হবে।

#

এটাই নতুন বিস্ময়। নতুনের সম্ভাবনায় এভাবে কল্পনাকে বাস্তব করে তোলা। কবি কল্পনায় দেখেছেন বলে প্রথমে কবির বাস্তব, পাঠক যদি রিলেট করতে পারেন তাহলে সম্ভাবনা উজ্জ্বল। অর্থাৎ পাঠকের বাস্তব। এই পর্যন্ত পৌঁছাতে শুধু সময়ের অপেক্ষা। চাঁদের কাস্তেটা শাণ দিতে দিতে যিনি এগোলেন তাঁর কাছে বাস্তবের আর কোনও বিকল্প ছিল না। কল্পনার সঙ্গে ভাষার বাস্তবিক কোনও সংঘাত হতে পারে না, তা শুধু ধারণার অস্পষ্টতা মাত্র। আমরা একটু এগিয়েই বলছি, স্বাধীনতা।

কথা প্রতিনিয়ত বিষয়হীন হয়ে উঠছে। এটা প্রমাণ করে বাইরের অস্থিরতা বা কেওস্। এই বিশৃঙ্খলা কবিকেও আলোড়িত করে। তিনি খুঁজবেন এর মধ্যে সৃষ্টির বীজগুলো কোথায়! এছাড়াও বলার কথা হলো, আমরা যাকে আপাত বিশৃঙ্খল দেখছি, আসলে তা হলো শব্দের অবিভাজিত কণার মধ্যে যে তরঙ্গ, তার উল্লাস, তার অবাধ্য ছোটাছুটি। যা এই বাস্তবের সমস্ত বিচ্ছিন্নতাকে প্রকট করতে চায়, ভেঙে পড়ার অপেক্ষা নিয়ে। আমাদের শব্দবিশ্ব ধ্বনি সম্পর্কে ধারণাকে এভাবে স্পষ্ট করতে চায় কণাতরঙ্গের অস্থিরতা দিয়ে। অস্থির ভাষাকে স্বাধীনসত্তায় ব্যবহারের মাধ্যমে। একটি গঠন ভেঙে কখনও বিগঠনের দিকে হেঁটে যাওয়া, কখনও পুনর্নির্মাণের দিকে।

#

–তাহলে ভেবে দেখা যাক, কবিতা আসলে কি!

আমরা কেউ জানি না। শুধু জানি শব্দ‌। আদি ও অন্তহীন। তাহলে কি শাশ্বত বলবো! হয়তো বা কিছুটা। বাকি যা পড়ে থাকে তা কালের হাতে। তাকে রাখবে না ফেলে দেবে, সময়ই বলবে। আমরা দেখেছি, হয়তো আরও দেখবো, অনেক মহৎ কবিতাই কালের ধুলোর নিচে চাপা পড়ে যায়। অনেক মহৎ কবি শুধু তাঁর সৃষ্টির উল্লাসেই মেতে থাকেন সারাটা জীবন। প্রচারের আলো তাঁকে ছুয়েও দেখলো না। প্রচারসর্বস্ব বিশ্বে অতি নগণ্যও হয়ে উঠতে পারে অনন্য। এই কারণে ইতিহাস সর্বদা আংশিক সত্য, আর কবিতা অংশত শাশ্বত।

তবে সময় তো বদলায়। পরিবেশ বদলায়, সঙ্গে ভাষাও বদলায়। প্রতিটি বদলের সঙ্গে জাগতিক বিস্ফোরণের সংযোগ ঘটতে পারে, আবার নাও ঘটতে পারে। একজন কবির মধ্যেও এভাবে অংশত যুগের হাওয়া, জাতির সংবেদনা মিলে মিশে সংশ্লেষিত হতে হতে সমকালীন এবং সমগ্র জীবনের অভিজ্ঞতা জারিত হয়। তারপর একটা নতুন ভাষাদেশ গড়ে তোলার দিকে যাত্রা করে। কবি যখন তাকে তাঁর সত্তা দিয়ে জাগিয়ে তুলতে সক্ষম হবেন, তখনই উজ্জীবন। উপনিষদ বলছে – অপাবৃণু, অপাবৃণু। অর্থাৎ, নিজেকে উন্মোচন করও,উন্মোচন করও, ঢাকনা খোলো বন্ধু...।

0 comments: