0

পথেপ্রবাসে - দীপ্ত প্রতিম মল্লিক

Posted in

পথেপ্রবাসে

পেরুতে বেড়ুবেড়ু
দীপ্ত প্রতিম মল্লিক


প্রথম পর্ব – লিমা,প্যারাকাস, হুয়াকাচিনা, আরুকুপা 

৬ ও ৭ই এপ্রিল, ২০১৯- লিমা 

অনেক বছর আগের কথা। সালটা ১৯৭১। স্কুলে ক্লাস এইটে পড়ি, নকশাল আন্দোলন তখন তুঙ্গে আর তার সাথে পাল্লা দিয়ে চলেছে পুলিশি ধরপাকড়। স্কুল অর্ধেক দিন বন্ধ, পড়াশুনার বালাই সেরকম নেই – তখন আমার সময় কাটাবার প্রধান উপকরণ গল্পের বই। এমনিতেই গল্পের বই-এর পোকা ছিলাম – রোজ বিকালে প্রথমে যেতাম স্কুল লাইব্রেরি ও তারপর পাড়ার লাইব্রেরি। তখন সবে প্রেমেন্দ্র মিত্রের বই পড়তে শুরু করেছি- “ঘনাদা”, “কুহকের দেশে” গোগ্রাসে গিলেছি। সেদিন স্কুল লাইব্রেরি খোলার সাথে সাথেই গিয়েছি আর একখানা ঘনাদা তুলবো বলে – কিন্তু দেখি সহপাঠী সুনীল “বেড়াজালে ঘনাদা” বইটা নিয়ে হাসিমুখে বেরুচ্ছে। যাওয়ার আগে মুচকি হাসি হেসে আমায় বললো, -আজ একটাই ঘনাদা ছিলো, নিয়ে গেলাম। দেখ, অন্য কোনো লেখক পাস কিনা! সুনীলের বাড়ী স্কুলের পাশেই – কাজেই ও লাইব্রেরি খোলার সাথে সাথেই আসতো, ও ছিলো আর এক বই-এর পোকা। স্কুল লাইব্রেরি থেকে সবচেয়ে বেশী বই নেওয়ার পুরস্কার ও-ই পেতো প্রতি বছর।

যাই হোক, মনমরা হয়ে লাইব্রেরিতে ঢুকছি – এটাই একমাত্র ঘনাদা যেটা আমার পড়া হয় নি – কতো আশা করে এসেছিলাম আজ – এমন সময় কে যেন ডাকলো পিছন থেকে। দেখি নারায়ণ স্যার। আমাদের বাংলার শিক্ষক – স্যার লাইব্রেরির দায়িত্বে ছিলেন, বললেন -কি ব্যাপার? মন খারাপ নাকি?

-হ্যাঁ স্যার, “বেড়াজালে ঘনাদা” বইটা নেওয়ার জন্য এসেছিলাম, সুনীল নিয়ে বেরিয়ে গেলো।

-তাতে মন খারাপের কিছু নেই। প্রেমেন্দ্র মিত্রের একটা বই আজ-ই কেনা হয়েছে, অসাধারণ লেখা, এটা নিয়ে যা।

এই বলে স্যার হাতের প্যাকেট খুলে আনকোরা একটা নতুন বই বের করলেন, নাম দেখি “সূর্য কাঁদলে সোনা”।

স্যার বললেন – এতে ঘনাদার পূর্বপুরুষের পরিচয় পাবি। পাবি আজ
থেকে ছশো বছর আগের পেরুর ইনকা সাম্রাজ্যের বিবরণ, আর পাবি কিভাবে সে সোনার সাম্রাজ্য ছারখার করে দিলো সাগরপার থেকে আসা স্প্যানিশরা। পড়ে দেখ, অনেক কিছু জানতে পারবি।

বইটা সাগ্রহে নিলাম। পরের তিনটে দিন কিভাবে যে কাটলো! যেখানে যখন সুযোগ পাচ্ছি, পড়ছি। তখন লোডশেডিং সদ্য শুরু হয়েছে, কিন্তু হ্যারিকেনের টিমটিমে আলোয় পড়ে যাচ্ছি ইনকা সম্রাট আতাহুয়ালপা, হুইস্কারের কথা। পড়ছি পিজারো, ঘনরাম, কয়ার রোমাঞ্চকর অভিযান – কুজকো, কাজামালকা, পেরুর পার্বত্য অঞ্চলের কথা – অ্যান্ডিসের গুহা ও পার্বত্য পথ যেন মনের মধ্যে একটা দাগ কেটে দিচ্ছে। আর সেদিন থেকে আমি শপথ নিলাম – যেদিন প্রথম সুযোগ আসবে, পেরু দেখবো। আর মিলিয়ে নেবো আমার কল্পনাকে বাস্তবের সাথে।

তাই অনেকদিন থেকেই ভাবছি কিভাবে পেরু বেড়াবো। পেরু ঘোরার প্রধান দুখানি অন্তরায় – প্রথম হলো ভাষাগত সমস্যা । ওখানে ইংরাজী প্রায় অচল আর স্প্যানিশে আমি অজ্ঞ। আর দ্বিতীয়ত, এক জায়গা থেকে আর একটা যাবো কিভাবে? নিরাপত্তা যাতে বিঘ্নিত না হয়, তার রাস্তা কি? এইভাবে ভাবতে ভাবতে আর ওয়েবসাইটে চোখ রেখে কাটিয়ে দিলাম অনেকগুলো বছর। অবশেষে একদিন আমার ধৈর্য্যের ফসল মিললো। দেখলাম “পেরু হপ” বলে একটি কোম্পানি পেরুতে চালু হয়েছে, যারা পেরুর বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে বাস নিয়ে যায়। আমার যা যা দেখার, তা সবই এদের বাসের আওতায়। শুধু তাই নয়, এদের হচ্ছে ডোর টু ডোর সার্ভিস – মানে হোটেল থেকে তুলবে আবার হোটেলে পৌছে দেবে। বাসগুলি ট্যুরিস্ট বাস, আরামপ্রদ আর আমার খুশি মতো আমি যেখানে যতোদিন ইচ্ছা থাকতে পারি। অতএব হৈ হৈ করে সব কিছু প্ল্যান করা হলো – সব হোটেল বুকিং, বাসে কোথায় উঠবো স্থির করা ও সর্বোপরি লন্ডন লিমার টিকিট। ভাগ্যক্রমে এয়ার ফ্রান্সে ন্যায্য মূল্যের টিকিট পাওয়া গেলো।

অবশেষে ৬ই এপ্রিল ২০১৯, শনিবার, ভোর ভোর বেরিয়ে পড়লাম। এয়ার ফ্রান্সে প্রথমে প্যারিস ও তারপর বারো ঘন্টার উড়ানে লিমা। প্লেন জার্নিতে এটুকুই বলার আছে যে এত খাবার ও ড্রিংকস এর সম্ভার এরা সাজিয়ে দিয়েছিলো – বোঝাই গেলো না কোথা দিয়ে বারো ঘন্টা কাটলো।

অবশেষে লন্ডন রাত সাড়ে দশটা বা পেরুর লোক্যাল টাইম বিকাল চারটেয় পৌছে গেলাম লিমায়। অত্যন্ত বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যাবহার ইমিগ্রেশনে – ফটাফট ত্রিশ দিন থাকার অনুমতি পাওয়া গেলো। শুধু আমার নয়, ভারতীয় পাসপোর্ট হোল্ডার যাদের ইউ.কে. বা ইউ.এস.এ-তে থাকার পারমিট আছে, তাদেরও লাগবে না।

বেরুবার মুখে কাস্টমস – এক্স রে মেশিনে সমস্ত লাগেজ চেক করে বেরুনো। ড্রাগের বিরুদ্ধে ব্যাবস্থা আর কি!

বাইরে বেরিয়ে দেখি, এক সুদর্শন যুবক নামের বোর্ড নিয়ে অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। বাইরে বেরিয়ে লিমার মিষ্টি হাওয়াতে প্রাণ জুড়িয়ে গেলো। তাপমাত্রা ২২ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড আর সমুদ্রের মিঠা বাতাস।

আমরা উঠলাম লিমার অভিজাত অঞ্চল মিরাফ্লোয়েসের
“কোর্টইয়ার্ড ম্যারিয়ট” হোটেলে। পরদিন, অর্থাৎ ৭ই এপ্রিল বেরিয়ে পড়লাম লিমা দর্শনে। এখানে ট্যাক্সি নিয়ে প্রচুর অভিযোগ শুনেছি, তাই আমরা উবের ট্যাক্সি ব্যাবহার করলাম। উবেরের গাড়ি লিমাতে সর্বত্র পেয়েছি আর এখানে ট্যাক্সি জলের দর, অন্তত লন্ডনের তুলনায়। ৮-১০ সোল-তে অনেকদূর যাওয়া যায়। আর এক পাউন্ডে চার সোলের বেশীই পাওয়া যায়। অতএব ঘোরা যাক কদিন রাজার হালে।

প্রথমে এলাম সান ফ্রানসিসকো মনেস্ট্রি। স্প্যানিশ অভিযাত্রী ফ্রানসিসকো পিজারো যখন পেরুর দখল নেন, তখন প্রশাসনিক কাজকর্ম ও যোগাযোগের সুবিধার জন্য লিমা শহরের উৎপত্তি। তার কারণ লিমা সমুদ্রের পাশে, যেখানে ষোড়শ শতাব্দীতে ইনকা রাজধানী কুজকোয় যোগাযোগ ব্যাবস্থা ছিলো সময় সাপেক্ষ ও দুঃসাধ্য। এই চার্চের কাজ সমাপ্ত হয় ১৭৭৪ সালে। 


চার্চ দেখার পর গেলাম পিছন দিকে মিউজিয়াম ও গাইডেড টুরে। পনেরো সোলেস করে টিকিট কেটে ইংলিশ গাইডেড ট্রিপে সকাল সাড়ে নটায় ঢুকলাম। প্রথমে দেখলাম মোজাকের কাজ – ১৫৩৫ সালে ইনকা আমলের ধ্বংসস্তূপের ওপর প্রথম এই চার্চ বানানোর কাজ শুরু। পরে সপ্তদশ শতাব্দীতে একে ঢেলে সাজানো হয়। গাইড এরপর নিয়ে গেলেন কয়্যার রুমে, যেখানে ১৩৫ খানা কয়্যার আছে। শুনলাম যে সানফ্রানসিসকো নিজে ভায়োলিন বাজাতেন। তারপর একে একে চ্যাপটার রুম, প্রেয়ার রুম, ডাইনিং রুম দেখে এলাম ক্যাটাকোম্ব-এ। এখানে অজস্র মানুষের হাড়, মাথার খুলি। বিশেষ বিশেষ স্থানে তাদের জ্যামিতিক ভাবে সাজানো। অজস্র ছবি আছে, যার মধ্যে ১৬৯৬ সালে আঁকা “দ্য লাস্ট সাপার” ছবিটি উল্লেখযোগ্য। ভিতরে ছবি তোলা বারণ, তাই সবকিছু মনের মণিকোঠাতেই রেখে দিলাম।

ঘন্টখানেক এই ট্রিপ করে এবং তখনকার স্প্যানিশ কলার সাথে
সম্যক পরিচিতির পর বেরুলাম। পাঁচ মিনিট হাঁটতে না হাঁটতেই চোখে পড়লো বিরাট ক্যাথিড্রাল – সামনে এক বিস্তীর্ণ প্লাজা বা চত্তর – নাম “প্লাজা দ্য আরমাস” বা “প্লাজা মেওর”। আরমাস মানে অস্ত্র। হয়ত বা এককালে এখানে স্প্যানিশ সৈন্যরা কুচকাওয়াজ করতো। আমরা ইস্টারের আগে গিয়েছি, দেখি বিরাট প্যারেড করে যিশু ও মা মেরির বিরাট মূর্তি ঢুকলো ক্যাথিড্রালে । 

বিরাট ক্যাথিড্রাল – ১৫৩৫ সালে কাজ শুরু করে ধীরে ধীরে এর কলেবর বেড়েছে পরবর্তী একশো বছরে। দেখার মতো এর স্থাপত্য ।

লিমাতে আরো অনেক চার্চ আছে, তার মধ্যে আমরা এক এক করে গেলাম মনেস্ট্রি অফ নাসারেনাস( Monastery of Las Nazarenas), যেখানে আছে যিশুর এক বিরাট মিউর‍্যাল। 

তারপর “সেন্ট অগস্টিন” ও আরো দু একটি চার্চ দেখে বিকাল চারটে বাজলো। তাপমাত্রা দারুণ – দুপুরে একটু গরম গরম আর রাতে ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা। লিমাতে আর একটি দ্রষ্ট্রব্য ছিলো হুয়াকা পুকলানা, যেটি একমাত্র ইনকা ও প্রাক ইনকা যুগের নিদর্শন। এ ছাড়া আছে ম্যাজিক ওয়াটার সার্কিট। ঠিক হলো আপাতত ম্যাজিক ওয়াটার দেখা যাক। হুয়াকা পুকলানা পরে দেখবো। ম্যাজিক ওয়াটার সার্কিট আর কিছুই না, অনেক গুলি ফোয়ারার সমষ্টি। গিনেস বুক অনু্যায়ী এটা পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো কমপ্লেক্স – খান দশেক বিভিন্ন টাইপের ফোয়ারা আছে, যার মধ্যে সবচেয়ে বড়ো হচ্ছে রেনবো ফাউন্টেন আর হারমোনি ফাউন্টেন। এদের রাতের আলোয় দেখার ইচ্ছা অনেক দিনের। রাত্রে যখন আলো, লেসার শো চলে আর মিউজিকের তালে তালে এই ফাউন্টেনগুলি নাচতে থাকে – অপূর্ব এক মায়াবী পরিবেশ সৃষ্টি হয়। এত বড়ো ফাউন্টেন
কমপ্লেক্স, যার এরিয়া এতো বড়ো আর সুন্দর গাছপালা দিয়ে সাজানো, তার প্রবেশ মূল্য মাত্র চার সোল – ভাবা যায়? টানেল ফাউন্টেন বলে দুশো ফুট লম্বা একটা ফোয়ারা ছিলো টানেলের মতো – তার এ প্রান্ত দিয়ে ঢুকে ও প্রান্ত দিয়ে বেরুনো যায়, এতটুকুও না ভিজে, অন্যবদ্য! রাত আটটা পর্যন্ত ফাউন্টেনের লেজার শো-র কারসাজি ও উদ্দাম নৃত্য দেখে ফিরে এলাম হোটেলে – এবারও সহায় উবের।

0 comments: