বইপোকার বইঘর - অনিন্দিতা মণ্ডল
Posted in বইপোকার বইঘর
বইপোকার বইঘর
অনিন্দিতা মণ্ডল
শশাঙ্ক
লেখক – রাজীব মজুমদার
প্রকাশনা – আজকাল
মুল্য- ১৫০/-
ইতিহাসাশ্রিত গল্প একসময় তত বেশি লেখা হতোনা। মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ, যাঁরা বেশ বিদ্যেবুদ্ধি ধরতেন, তাঁরাই এ জাতীয় রচনায় হাত দিতেন। বাংলা সাহিত্যে ইতিহাসনির্ভর লেখা তাই বলে কম নয়। বলতে চেয়েছি, অন্য লেখার চেয়ে অনেক কম। এটি একটি তুলনামূলক উক্তি। ইদানীংকালে ইতিহাস আমাদের প্রিয় চর্চা হয়ে উঠেছে। যে আমরা নিজেদের পঠনপাঠনে ইতিহাসকে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে রেখেছিলাম, সেই আমরাই জীবনের প্রিয় নেশা হিসেবে ইতিহাস চর্চায় মন দিয়েছি। কেন? কারণ ইতিহাস আমাদের ফিরিয়ে দিয়েছে মূল্যবান অতীত। যে অতীত নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারি। ইতিহাস আমাদের জানিয়েছে, কেন আমরা কোনও বিশেষ বিশেষ ঘটনা থেকে শিখে নেব জীবনের পাঠ। সত্যি বলতে,পড়ে পাশ করতে হবে, এই উদ্বেগ যদি না থাকত, তবে আমাদের ইতিহাসের জ্ঞান আরও বিস্তৃত আরও গভীর হতে পারত। ভালোবাসার বয়স বেশি হতো। শিক্ষানীতিবিদেরা এটি ভেবে দেখতে পারেন। তবে একটি কথা। কোন ঘটনাকে কোন আলোয় দেখব, সেটি যাঁরা স্থির করেন, তাঁদের কাছ থেকে নিরপেক্ষতা অবশ্যই আশা করব আমরা। না হলে পুরনো দিনের রাজপুষ্ট ইতিহাস রচয়িতাদের মতো একপেশে মিথ্যে ইতিহাস পড়তে হবে। পণ্ডিতেরা সহজেই ধরে ফেলবেন ও ইতিহাসে কতটা দুধ আর কতটা জল। সেটি বড় লজ্জার হবে আমাদের উত্তরপ্রজন্মের জন্য।
এ তো গেল এখনকার কথা। আমি বলি প্রাচীন ইতিহাসের পাতা উল্টে, যেখানে অন্ধকার কিংবা ছেঁড়া পাতা জলে গিয়েছে,সেই সব শূন্যস্থান পূরণের প্রয়াসও তো অব্যাহত রাখতে হবে! আর কতকাল আমরা মিথ্যে ইতিহাস পড়ব? ধান ভানতে শিবের গীত নয় ঠিক। কারণ, আলোচ্য বইটিতে লেখক রাজীব মজুমদার যত্নে ভালোবাসায় উদ্দীপ্ত হয়ে তুলে এনেছেন বাঙালির প্রিয়, বাঙালির গর্বের এক প্রাচীন পুরুষকে। আহা! শশাঙ্ক! স্বাধীন বাংলার স্থপতি! এর আগে গৌড় রাজ্যের তেমন কোনও উল্লেখ আমরা প্রাচীন ইতিহাসে বা সাহিত্যে পাইনা। পাইনা কোনও সার্বভৌম নৃপতির নাম। শশাঙ্ক আমাদের প্রথম নায়ক। এই বইটিতে আমরা সেই সময়ে ঘটে চলা গৌড় মালব কান্যকুব্জ ও উত্তরাপথস্বামী হর্ষবর্ধনের জটিল দ্বন্দের কাহিনী পাই। একই সঙ্গে জানতে পারি, রাজার নীতি কত উদার কত ক্ষমাশীল ছিল। যুদ্ধক্ষেত্রের শত্রুতা যে কখনও ব্যক্তিগত শত্রুতায় পর্যবসিত হতোনা, তার প্রমাণ পাই। এই সময়ে এই বইটি তাই অতি উপযোগী এক পাঠ। আমরা যে রাজনীতিকে সর্বনিম্ন এক শিক্ষায় নিয়ে যেতে বসেছি!
ভারী সুন্দর বই! রাজীব বহু যত্নে অন্ধকার সময়ে আলো ফেলেছেন। তাঁর কল্পনা কখনও ইতিহাসের কণ্ঠরোধ করেনি। খুবই দক্ষ হাতে সেটি সামলেছেন তিনি। অথচ শশাঙ্ককে নিয়ে যে সঙ্গত আবেগ তাঁর মধ্যে কাজ করেছে তাই দিয়ে তিনি হর্ষকে নীচু করেননি। এই তো সঠিক নীতি! ভীমা লেখকের সৃষ্টি। অপূর্ব চিত্রণ! শ্রমণ পরিমলও তাঁর সৃষ্টি। সুন্দর কিন্তু সামান্য স্থান জুড়েছেন পরিমল। লেখকের কাছে একটিই অনুরোধ, ভবিষ্যতে পরবর্তী সংকলনে তিনি যদি শ্রমণকে আরেকটু বিশদ করেন! করুণায় স্নাত হতে কে না চায়? মুদ্রণ সম্পর্কে একটি খারাপ কথা বলতেই হচ্ছে। এমন নামী প্রকাশনার বইতে বানানসহ প্রুফে নানা ভুলভ্রান্তি নজরে এলো। এমনকি, শব্দের পুনরাবৃত্তিদোষও আছে। আশা করি পরবর্তী মুদ্রণে প্রকাশক সেদিকে নজর দেবেন। পরিশেষে বলি, বাঙালির গর্বের এই বিশেষ অধ্যায়টি জানতে পাঠক বইটি পড়ুন। বিষয়বস্তু এর চেয়ে বিশদ করবনা।
0 comments: