ধারাবাহিক - সোমঙ্কর লাহিড়ী
Posted in ধারাবাহিক
ধারাবাহিক
পায়ের শব্দ
সোমঙ্কর লাহিড়ী
১৮
ডিপার্টমেন্ট ইনভেস্টিগেশান টিম তৈরী করে প্রথম যেটা করল সেটা হল পরেশ সামন্তকে একটা ম্যারাথন জেরা। যেহেতু ফোর্সে থাকার অভিজ্ঞতা সামন্তর ছিল তাই সেও পুরোপুরি সাহায্য করে গেল। এক লোকের বিভিন্ন প্রশ্ন থেকে শুরু করে বিভিন্ন লোকের একই প্রশ্ন সবকিছুর উত্তর দিয়ে পরেশ সামন্ত নিজেকে প্রথম প্রমান করল টিমের কাছে।
প্রথম কেসটার ব্যাপারে সামন্তর বয়ান ভেরিফাই হয়ে গেল আর দ্বিতীয় কেসটা যেহেতু সাবজুডিস হয়েই আছে তাই আর বেশী খাটা খাটনি করতে হল না। ইনভেস্টিগেশান টিমের প্রধান সুব্রত সেনগুপ্ত জানিয়েই দিল যে তারা যে অ্যাকশান নেবে এই কেসে সেটা তারা সামন্তকে আগে জানাতে নাও পারে। কিন্তু সামন্ত যেন কোনকিছু ডিপার্টমেন্টের কাছে না লুকিয়ে রাখে। পরেশ সামন্ত বিরক্তি চেপে হেসে উত্তর দিল,
আমি এতক্ষণ ধরে মনে হয় তাই করছি মিঃ সেনগুপ্ত। তবে আমার একটা সাজেশান আছে যদি পারমিশান দেন,
হ্যাঁ হ্যাঁ বলুন, বলুন,
তিন জনের যে নাম আমরা পেয়েছি এখনো অবধি সব একই প্রফেশানের। আর তারা যেহেতু কেউই নিজে কাজটা করেনি ধরে নেওয়া যেতেই পারে যে তারা কোন একটা লোক বা দলকে দিয়েই কাজটা করাচ্ছে। এখন এই তিন জনকে যদি আমরা একসাথে তুলি তাহলে সেই দলের কাছে বা লোকের কাছে খবর হয়ে যাবে, আর একজন একজন করে তুললে বাকীরা সতর্ক হয়ে যাবে, বা উকিল ইত্যাদি নিয়ে বেল মুভ টুভ করে একটা অশান্তি তৈরী করতে পারে। তাই ব্যাপারটা যদি একটু মাথায় রাখেন।
তা আপনি কি সাজেস্ট করেন?
আমি তিন জনের নাম ঠিকানা জানি, কিন্তু তিনের কেউই আমায় চেনে না, আমি একটা প্রোজেক্টের লোভ দেখিয়ে যদি ওদের বারকরে আনতে পারি তারপরে আপনারা যদি ওদের তোলেন তবে ব্যাপারট ওদের বাকী গ্রুপের যারা আছে তাদের কাছে খুব স্বাভাবিক লাগতে পারে কারণ তারা ভাববে প্রোজেক্ট এর ব্যাপারে দেখতে বাইরে গেছে। কোন শোরগোল হবে না প্রাথমিক ভাবে। তারপরে ওদের পিছনের নাম জেনে গেলে তো আর কোন প্রবলেম হবে না তখন তাকে আমরা টার্গেট করতে পারি।
এই প্রথম সুব্রত সেনগুপ্তের ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠল। বলল,
গুড পয়েন্ট। গো অ্যাহেড। ব্যাকাপ লাগবে?
হ্যাঁ লাগবে আমি আমার অফিসের একটি মেয়েকে নিয়ে যাবো ব্যাপারটার ইনিশিয়াল লুকটা নর্মাল রাখতে, তার যদি কোন প্রবলেম হয়, তাই একটা ব্যাকাপ লাগবে। বাই দ্য ওয়ে সেই লোকটি যাকে নিজের জামাইয়ের পরিচয় দিয়ে আমার কাছে খুঁজে দিতে বলেছিল সে এখন মানিকতলা অঞ্চলে থাকে। ভালো নামটা কি সেটা মনে নেই, সবাই ভালুয়া বলেই চেনে, ওর কাছে একটা এলার্ট জানিয়ে দিতে হবে, আর জানিয়ে দিতে হবে ওর লাইফ রিস্ক আছে। লাইনের লোক এলার্ট হয়ে যাবে। আর যদি ধরতে পারে তবে যেন জানায়। ওকেও ইনফর্মার করে নিতে পারেন। প্রাণ বাঁচানর জন্যে লোকে সব কিছু করতে পারে।
দুঘণ্টা বাদে পরমেশ মুনিরকার অফিসের সামনে একটা ইনোভা থেকে একজন মধ্য পঞ্চাশের লোক ও তার সাথে একটা অর্ধেক বয়সের মেয়ে নেমে পরমেশ মুনিরকার সাথে দেখা করতে চাইল একটা প্রোজেক্টের ব্যাপারে। একঘণ্টার অপেক্ষা, তারপরে পরমেশের চেম্বারে প্রবেশ। তারপরে প্রায় পঞ্চাশ কোটি টাকার একটা প্রোজেক্ট ডেভলপমেন্টের অফার। আরো প্রায় একঘণ্টা সেটা নিয়ে আলোচনা, শেষে সন্তোষ আগরওয়ালের নামও যখন সেই মধ্যপঞ্চাশ উল্লেখ করল তখন পরমেশ আর থাকতে পারল না। বলল,
আপ ক্যা উনসে বাত কর চুকে হ্যাঁয়?
নেহী আগর আপ রাজী না হোঁ তব.....
কোলকাতায় সামান্য বাইরে একটা পঞ্চাশ কোটি টাকার প্রোজেক্ট কি রিটার্ন আনতে পারে সেটা ক্যালকুলেশান করতে মুনিরকার মতো লোকেদের ক্যালকুলেটার লাগে না। মাথাই কাফি।
ঠ্যারিয়ে, বলে নিজেই সন্তোষ আগরওয়ালকে ফোন করে অফিসে ডাকল। কাজটা এত দ্রুত হবে সামন্ত ভাবতে পারেনি। পঞ্চাশ কোটিতে প্রচুর শুন্য থাকে, মনে মনে ভাবল সামন্ত।
দুজনে রাজী হল প্রায় বিকেলের দিকে, সামন্ত তাদের জানাল পরদিন সকাল দশটায় সে আসবে। সাইট দেখাতে নিয়ে যাওয়ার জন্য।
মুনিরকার অফিস থেকে বেরিয়ে কিছু দূরে দিয়ে সামন্ত ফোনে জানিয়ে দিল যে কাল সকাল দশটায় দুজনকে তোলার ব্যবস্থা করার কথা বাইপাসের উপর থেকে আর মহেশতলার মেজবাবুকে দিয়ে যেন তিন নম্বর প্রোমোটারকে ইন্টারোগেট করতে হবে বলে তুলিয়ে নেয়।
সময় সেই সকাল দশটাই ঠিক হল।
সেনগুপ্ত চেয়ারের হাতলে তাল ঠুকতে ঠুকতে ভাবল, বাবা লোকটার বুদ্ধি আছে তো বেজায়। মানিকতলার বড়বাবুকে ফোন করে নিজের পরিচয় দিয়ে ভালুয়াকে নিয়ে কি কি করতে হবে সেটা জানিয়ে দিল সেনগুপ্ত সাহেব।
পরদিন সকাল দশটায় বেশ কয়েকটা ঘটনা ঘটে গেল আপাত দৃষ্টিতে তাদের মধ্যে কোন যোগসুত্র নেই।
সাংবাদিক বীরু সেই “টি ভ্যালী” রিসর্টের ওপেনিং নাইটের সব ভিডিও ফুটেজ যোগাড় করতে সক্ষম হয়েছিল, তার চ্যানেল সেটা ব্রেকীং নিউজ করতে রাজী হয়ে গেল।
বাইপাশের উপর একটা ইনোভাকে দুটো স্করপিও রাস্তা রোধ করে দাঁড়াল। তার ভেতরের দুজন যাত্রিকে নামিয়ে নিয়ে স্করপিওতে তোলার সময় একজনকে শুধু একটা প্রচন্ড জোরে চড় মারতে দেখা গেছিল। রাস্তার লোক সেটাকে গাড়ীতে গাড়ীতে যে অশান্তি হয় সেই রকম কিছু একটা ভেবে ছিল, তাই মনে রাখেনি। ইনোভাটা স্করপিও দুটোর পিছনে পিছনে চলতে লেগেছিল যেমন সদ্যবিবাহিত দেহাতি স্বামী স্ত্রী চলে ঠিক সেই ভাবে।
মহেশতলা থানার মেজবাবু গিয়ে তিন নম্বর প্রোমোটার বিনয় খেমকাকে জানাল যে তার স্ত্রীর সাথে যে লোকটাকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে তার সাথে টেররিস্ট লিঙ্ক আছে ইন্টারোগেশানের জন্য তাকে একবার থানায় যেতে হবে, কারণ লোকটা খেমকার ড্রাইভারও ছিল অনেকদিন।
বেশ কয়েকদিন সঞ্জয়কে দেখতে না পেয়ে আর তার কাছ থেকে কোন খবর না পেয়ে গণেশ একটু চিন্তায় পরে গেছিল তাই সঞ্জয়ের বাড়ির দরজায় তাকে দেখা গেল খুব ভদ্র মুখ চোখ করে কড়া নাড়াতে।
সঞ্জয় একটা এক কামরা ফ্ল্যাট বসে তার সরঞ্জাম গুলোকে ঠিক করছিল, মানে মাথার একটা স্ন্যাপ ব্যাক একটা টুপিকে নিয়ে কিছু একটা কারিকুরি করছিল। সাথে ছিল ঘন নীলরঙের এল.ই.ডি’র অনেক মাপের খুব পাতলা প্যানেল। এমন সময় সেই লোকটা এলো যে সঞ্জয়কে এই ফ্ল্যাটে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে।
অ্যান্ডি যে মিউজিক অ্যালবামটা করা শুরু করেছিল সেটার প্রোডাকশান হাউস থেকে প্রেস মীট করে জানাল যে সেটার লঞ্চিং ডেট আর ভেনু। আর তারসাথে জানাল তাদের নেক্সট ফিল্ম প্রোজেক্টে অ্যান্ডি লীড করতে চলেছে। ছবির নাম এখনো ডিসাইডেড হয়নি।
পরের এক ঘণ্টা বেশ ঝোড়ো বীরুদের প্রভুত প্রচিলত বাংলা খবরের চ্যানেলে ডিপি বাজোরিয়াকে দেখা গেল একটা গ্র্যান্ড পিয়ানোর উপরে একটি মহিলাকে শুইয়ে তার উপরে ‘প্রীটী ওম্যান” ছবিতে জুলিয়া রবার্টাস আর রিচার্ড গ্যর যে রকম মায়াবিধুর প্রেমের দৃশ্যকল্প সৃষ্টি করে ছিল প্রায় কাছাকাছি কিছু একটা করতে চলেছে। তবে রিচার্ড গ্যর আর জুলিয়া রবার্টসকে এর জন্য অনেক তালিম নিতে হয়েছিল ডিপি আর সেই মহিলার শট ছিল একে বারে ক্যান্ডিড। ফুটেজের বহু জায়গা ঝাপ্সা করে দেওয়ার পরেও কারো বুঝতে বাকী ছিল না ঘটনাটা কি ঘটছে সেখানে।
কিছুক্ষণ বাদে দেখা গেল সেই রিসর্টের অন্য ঘরে উদ্দাম নেশা করার দৃশ্য। আরো কিছুক্ষণ বাদে দেখা গেল সেই অ্যান্ডি ও মিসেস ডিপি বাজোরিয়ার কিছু মুহুর্ত যেটাকে ঘনিষ্ঠও বলা যায় আবার একজন অসুস্থা কে সাহায্য বললেও অবাক হবার কিছু থাকে না।
অশান্তির আরো বাকী ছিল, ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার স্থানীয় রিপোর্টাররা ডিপিকে তার অফিসে ধরবার চেষ্টা করল। তিনি ফোনের পর ফোন পেয়ে শেষে অতিষ্ঠ হয়ে বেলার দিকে প্রেস কনফারেন্স ডেকে বসলেন।
এক শেয়াল থেকে বহু শেয়ালের ডাকের মতো সব খবরের চ্যানেলে সেই ব্রাকীং নিউজ চলতে শুরু করল। মিডিয়া তারস্বরে প্রচার শুরু করে দিল বিকেলের প্রেস মিটিং এর। সারা দেশে যেন আর অন্য কিছু দেখার বা বলার মতো সেদিন তৈরীই হল না। চাটনি এমনিতেই ভালো খায় লোকে, এখানেও তার অন্যথা হতে পারে না।
পুলিশের ইন্টারোগেশান রুমে ঢুকলে নাকি অনেক আচ্ছা আচ্ছা মালের প্যান্ট হলুদ হয়ে যায়। কিন্তু কাঁচা টাকার জোরও তো কিছু কম নয়, তাই মুনিরকা, খেমকা, আর আগরওয়ালের কাঁচা টাকা বেশ খানেকক্ষন যুযতে চেষ্টা করেছিল প্রায় ঘণ্টা দুয়েক। তারপরে মৃদু পায়ে ঘরে ঢুকল একটা সাদা পোষাকের পুলিস, বেশী কিছু নয় হাতের ডান্ডাটা দিয়ে টেবিলের উপরে একটা সপাটে বাড়ি মারল। মুনিরকা হাতটা সরানর সময় পায়নি।
দুটো শব্দ ঘরটাকে বেশ কাঁপিয়ে দিল। একটা সেই ডান্ডার সাথে টেবিলের মোলাকাত আর দ্বিতীয়টা মুনিরকার হাউহাউ করে কেঁদে ফেলার শব্দ। আগরওয়াল নিজের সহ ব্যবসায়ীকে বাঁচানর জন্য খানেকটা হিউম্যান রাইটস কমিশনের ভয় দেখাতে চেষ্টা করেছিল। ফলটা যে এত মারাত্মক হবে বুঝতে পারেনি। দুটো লোক বগলের নীচে হাত দিয়ে ওকে দাঁড় করিয়ে দিল নিমেষে। আর একজন এসে প্যান্টটা প্রায় ছিঁড়ে হাঁটুর নিচে নামিয়ে দিল। পরের মুহুর্তে আগরওয়াল বুঝতে পারল টেবিলের উপরে তার শরীরের উপরের ভাগ। আর উন্মুক্ত পাছায় একটা প্রবল ডান্ডার ঘা। লাগার সাথেসাথে আগরওয়ালের অনেক চিন্তার সাথে আরো একটা চিন্তা মাথায় ঘুরে গেল। ছোটোবেলায় স্কুলে এইরকম মার পড়ত পিছনে, তবে প্যান্ট খুলে নিত না কেউ।
খেমকার দিকে ঘরের সবাই একসাথে তাকাল, খেমকা বুঝল এবারে তার পালা, কথা বলতে গিয়ে বুঝল গলা শুকিয়ে গেছে, আওয়াজ বেরচ্ছে না। হাতের ইশারায় জল চাইল, একজন একটা প্লাস্টিকের বোতল এগিয়ে দিল। পাশের লোকটা তাকে জিজ্ঞাসা করল,
মোহনদা পেচ্ছাপ ভরা বোতল দেননি তো? বলা যায় না আগেরবারে বেশ ভুগতে হয়েছিল আমাদের।
খেমকার হাত বোতলের দিকে এগিয়েও আবার পিছিয়ে এলো। সেই মোহনদা বলল,
এদের কথায় বিশ্বাস করিস না, এই দেখ আমি নিজে এই জল খাচ্ছি।
বলে বোতলের জল গলায় ঢালল। খেমকা আস্বস্ত হয়ে বোতলটা হিয়ে মাথাটা তুলে জল্টা খেতে শুরু করল, দু ঢোঁক খেয়েছে কি খায়নি সেই মোহনদা বোতলটায় একটা হালকা ধাক্কা দিল, জল চলে গেল মুখে নাকে, কাশি শুরু হয়েগেল খেমকার। সে প্রবল কাশি।
আর বিষম খেলে মানুষ সাধারণত তার পিঠে হালকা চাপড় দিয়ে তাকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে। এক্ষেত্রেও সেটা হল। তবে চড় কিল ঘুষি গুলোয় বড্ডো জোর ছিল। বিনয় খেমকার প্রাণ বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম হল। কাশি থামার পরে সে বুঝতে পারল তার পেচ্ছাপ বেরিয়ে গেছে।
লোকে জল খেতে গিয়ে বিষম খেয়ে পেচ্ছাপ ইত্যাদি করে ফেলে, দোষ নাকি হয় পুলিসের ইন্টারোগেশান রুমের।
একটু সব কিছু ঠিক হওয়ার পরে বিনয় খেমকা রণেভঙ্গ দিল। সে কাতর গলায় বলল,
বলছি বলছি স্যার, আমার ড্রাইভার ভজন আমাদের বাড়িতে ছোটবেলা থেকে আসত ওকে ড্রাইভারই শিখিয়ে নিজের কাজে লাগাই আমি। সেই শয়তান....
একজন অফিসার বলল,
মালটাকে পাশের ঘরে নিয়ে গিয়ে স্টেটমেন্ট নিন মোহনবাবু।
মোহনবাবু বিনয় খেমকাকে বলল,
চলুন আপনার গান শুনি একটু।
কাঁধে হাত রাখতেই খেমকা ঝটকা মেরে হাতটা সরিয়ে দিতে গেল।
মোহনবাবু হেসে কাঁধটায় একটা প্রবল চাপ দিয়ে বলল,
চল।
মুনিরকা আর আগরওয়াল দুজনে প্রায় একসাথে বলে উঠল,
আমরা তো জানিই না কেন আমাদের ধরে এনেছেন আপনারা। ধরে এনে থেকে মারছেন। কি দোষ করলাম সেটাও বললেন না।
সেই পুলিস অফিসার এবারে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে টেবিলের উল্টোদিকে বসে বললেন,
এবারে জানবেন যে কি করেছেন আপনারা।
0 comments: