0

গল্প - মধুবন্তী রুদ্র

Posted in

গল্প


জাগরণ
মধুবন্তী রুদ্র



শহরের উত্তর প্রান্তে এই দিকটায় উন্নয়নের হাওয়া সেভাবে লাগেনি। সরু সরু ধুলো ওড়া রাস্তার দু'পাশে, গায়ে গায়ে লাগানো সারি সারি দু'তলা বাড়ি। ছোট্ট ছোট্ট জানলা বসানো,কেবলমাত্র একদিক খোলা এই বাক্স-মার্কা বাসস্থান গুলোকে দেখলেই বোঝা যায়, এদের কোনওটার বয়স কয়েকশো বছরের কম নয়। বেশকিছু বাড়ির সামনে ঘোড়া বাঁধা রয়েছে। রাস্তায় ছাগলছানা খেলে বেড়াচ্ছে। তাদের সঙ্গে দিব্যি মিলেমিশে খেলে চলেছে ছোট ছোট মানবশিশু। এই জায়গাটার ওপর দিয়ে কোথাও গেলেই, ইতিহাসের ছাত্রী শ্রুতিলেখার মনে হয়, সময় যেন থমকে থেমে আছে এখানে। এই অঞ্চলেরই গলিঘুঁজির মধ্যে কোনও এক ভাঙাচোরা মহল্লায় আফ্রিনের বাড়ি ছিল।

ভারতবর্ষের ম্যাপের ঠিক পেটের কাছটাতে এই শহরের অবস্থান। বছর তিরিশ আগে, একুশ বছরেরর সদ্য বিবাহিতা শ্রুতিলেখা যখন প্রথমবার এই শহরে পা রাখেন, পাহাড়-জঙ্গলে ঘেরা শান্ত জায়গাটা এক লহমায় তাঁর মন জিতে নিয়েছিল। কয়েকশো বছর ধরে মুসলমান শাসকদের অধীনে থাকা শহরটা জুড়ে অজস্র প্রাচীন মসজিদ আর হাভেলি। মন্দিরগুলো বরং অপেক্ষাকৃতভাবে বয়সে অনেকটাই নবীন। বহু প্রজন্ম ধরে পাশাপাশি বাস করা শহরের সাদাসিদধা লোকগুলো একে অপরকে প্রতিবেশীই ভেবে এসেছে -- হিন্দু বা মুসলমান নয়। আর ঠিক এই ব্যাপারটাই শ্রুতিলেখাকে সবথেকে বেশি মুগ্ধ করেছিল।

তবে ইদানিং হাওয়া যেন কেমন অন্য খাতে বইছে। কারা যেন দুই সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে একটা অলঙ্ঘনীয় কাঁচের দেয়াল তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছে। মেয়েদের নিরাপত্তা তলানীতে গিয়ে ঠেকেছে। গত দু বছরে পাঁচ পাঁচটা ধর্ষণের ঘটনা ঘটে গেছে শহরের বুকে -- তারমধ্যে দুটো কেসে ভিক্টিমের বয়স দশের নীচে, একটা গণধর্ষণের কেস আর পাঁচটার মধ্যে চারটে কেসে ধর্ষিতাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। ওই পাঁচজনের মধ্যে তিনজন হিন্দু, দুজন মুসলমান আর একজন আদিবাসী। দলিত মেয়েটা চিৎকার করে প্রাণে বাঁচে। সারা শহর প্রত্যেকবার চমকে চমকে উঠেছে ঘটনার নৃশংসতায় -- ন‍্যশানাল টিভি চ্যানেলগুলো মুচমুচে খবরের সন্ধান পেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। কিন্তু কাজের কাজ কিচ্ছু হয়নি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক প্রভাবের ফলে এত দেরিতে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে যে, অপরাধীর পক্ষে আইনের জাল কেটে বেরিয়ে যাওয়াটা সহজ হয়ে গেছে।



ঝাঁসি থেকে খুব একটা দূরে নয় এই শহরটা। হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে এখানকার তেজি আর স্বাবলম্বী মেয়েরা রাণী লক্ষ্মীবাঈএর উত্তরাধিকার সম্বন্ধে খুবই সচেতন। গত কয়েকবছরের ঘটনা যে ভেতরে ভেতরে ধর্ম নির্বিশেষে তাদের এক গভীর, অবিচ্ছেদ্য বাঁধনে বেঁধে ফেলছে, এ খবর শহরের পুরুষরা রাখেনা।

আজকাল প্রচণ্ড রাগ হয় শ্রুতিলেখার। কিন্তু কিছু করতে না পারার ফ্রাসট্রেশনে মনটা খারাপ হয়ে যায়। অনেকদিনের পরিচিতির সুবাদে উনি জানেন, পরভীন, নাসরিন, জুবেদাদের মনেরও এই একই অবস্থা। দিনকয়েক আগে নাসরিনের সাথে দেখা হয়ে গেল একটা মলে। এই বদল নিয়েই আলোচনা হচ্ছিল দু'জনের মধ্যে। ওঁদের স্বামীদের অসহায়তাটা ওঁরা বুঝতে পারেন। এই টায়ার ফোর শহরে, সার্ভিস সেক্টরের সেরকম বাড়বাড়ন্ত নেই। ব‍্যবসাই এখানে মানুষের মূল জীবিকা। ব্যবসাদার হয়ে রাজনীতির লোকেদের কেই বা ঘাঁটাতে চায়? ফলে কনফিউজড লোকগুলো নিজেদের মধ্যেই সম্ভব অসম্ভব আলোচনা করে, ভয় পায়, ভুলে যায় এবং আবার নতুন কিছু নিয়ে স্পেকুলেশন শুরু করে।

এইভাবেই অশান্তির মধ্যে কাটছিল দিনগুলো।

মানুষ মুখে কিছু না বললেও মনে মনে ফুঁসছিলই -- আফ্রিনকাণ্ড সেই ছাইচাপা আগুনকে খুঁচিয়ে জাগিয়ে তুলল।

ফর্সা, ডাগর চোখের আফ্রিনের বয়স ছিল ঠিক আট বছর তিনমাস, যখন তিনমাস আগে হঠাৎ একদিন ও হারিয়ে যায়। শহরের উত্তর সীমানার এক প্রত্যন্ত মুসলমান মহল্লায় কয়েকটা পরিবার থাকে, যারা আদতে যাযাবর প্রজাতির। শখানেক বছরের বেশি হবেনা ওরা এখানে এসে বসত গেড়েছে। শোনা যায় এদের গায়ে নাকি কুর্দিশ রক্ত বইছে, তাই এদের চেহারা আর জীবনযাত্রা স্থানীয় ধর্মান্তরিত মুসলমানদের থেকে কিছুটা আলাদা। সবথেকে বড় পার্থক্য হল, এদের পরিবারের মেয়েরাও ছেলেদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে হাটে বাজারে কাজ করে। আফ্রিন এরকমই একটি পরিবারের মেয়ে। সকাল সকাল জোয়ান পুরুষ মহিলার দল একসাথে কাজে চলে যাওয়ার পর, পাড়ার বাচ্চাগুলো একা একাই থাকে। কেউ কেউ সকালের দিকটা মাদ্রাসায় যায়। আফ্রিনের সমবয়সীরা সাধারণত পাড়ার মধ্যে খেলে বেড়ায়। কাজে না বেরনো ফুফু, খালারা ওদের চোখে চোখে রাখে, ঠিক সময়ে বকে ঝকে বাড়িও পাঠিয়ে দেয়। আফ্রিনের মা-বাপের কখনও মনে হয়নি, পাড়ার চৌহদ্দির মধ্যে ওদের মেয়ের কোন ক্ষতি হতে পারে।

কিন্তু আফ্রিন একদিন হারিয়ে গেল। ওর বাড়ির লোক সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে আর মেয়েকে দেখতে পেলনা। খোঁজ খোঁজ। একটা একটা করে কেটে গেল নটা দিন। দশ দিনের দিন সকালবেলা নুসরাতবানুর আতঙ্কিত চিল চিৎকারে সারা মহল্লার লোক ঘুম ভেঙ্গে ছুটে এসে দেখল আফরিনের ক্ষতবিক্ষত দেহটা পড়ে রয়েছে চৌমাথার ঠিক মাঝখানটায়। জামা-কাপড় রক্তমাখা আর মাথাটা বীভৎসভাবে থ্যাঁতলানো।



এই নারকীয় ঘটনার কথাটা শহরের অপর প্রান্তে, শ্রুতিলেখার কানে গিয়ে যখন পৌঁছলো, মাঝখানে কেটে গেছে একটা মাস। ধামাচাপা দেবার হাজার চেষ্টা করা সত্ত্বেও ততদিনে সারা শহরে মুখে মুখে রটে গেছে ঠিক কী ঘটেছিল মেয়েটার সাথে। পাহাড়ের উপর হাজার বছরের পুরনো শিব মন্দির। সেই মন্দিরে দু’তলা উঁচু শিবলিঙ্গ। সেই দেবস্থানে মেয়েটাকে এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে আটকে রেখে তার ওপর চলে নারকীয় অত্যাচার। আট বছরের শিশুকে ধর্ষণ করা হয় আট দিন ধরে, দফায় দফায়। ধর্ষকদের মধ্যে কে ছিলনা?স্থানীয় এসপি থেকে শুরু করে ষাটোর্ধ্ব মন্দিরসেবক। এমন কথাও শোনা যাচ্ছে নাকি বাইরে থেকেও লোকজনকে ডেকে আনা হয়েছিল আমোদে অংশগ্রহণ করার জন্য।

ওঃ, ভগবান! নিষ্পাপ বাচ্চাটার মৃত্যু-যন্ত্রনার কথা ভাবতে ভাবতে স্বভাবকোমল শ্রুতিলেখা বারবার শিউরে উঠেছেন। রাতে ঘুমের মধ্যে কানে বেজে উঠেছে কচি মেয়েটার গোঙানি, যন্ত্রণাকাতর চিৎকার আর মায়ের কাছে যাওয়ার আকুতি। ধড়মড় করে জেগে উঠে বসেছেন। একটা নিষ্পাপ বাচ্চার এই নিষ্ঠুর পরিণতি হবে আর কেউ কিচ্ছু করবেনা? দোষীরা শাস্তি পাবেনা? ভেতরে ভেতরে রক্তাক্ত হতে থাকেন শ্রুতিলেখা।



কদিন যাবৎ খুব ডিস্টার্বিং কতগুলো তথ্য কানে আসছে -- আফ্রিনের গোষ্ঠীর কয়েকশো লোক নাকি ভয়ে টু্ঁ শব্দটি পর্যন্ত করছে না। এমনকি কিছু কিছু পরিবার নাকি অলরেডি ওখান থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে অন্য জায়গায় চলে যাবার চেষ্টা করছে, কেননা ওদের শাসানো হয়েছে, এই নিয়ে হইচই বাঁধালে ওদের পরিবারের বাচ্চাদেরও এই একই হাল করা হবে। ঘুম চলে গেছে শ্রুতিলেখার। কিছু একটা করতে হবে। করতেই হবে।

নাঃ একটা শেষ চেষ্টা করা যাক। কলকাতায় ওঁর ছোট বোনকে ফোন লাগান শ্রুতিলেখা -- ভগ্নিপতি নামী কাগজের মস্ত বড় জার্নালিস্ট।

আর তারপরেই আফ্রিন 'খবর' হয়ে গেল। সোশ্যাল মিডিয়ার ট্রেন্ডিং টপিকস-এ সবার ওপরে উঠে এল আফ্রিন শিরানের নাম।



কিন্তু তাতে ফলটা কি হলো? অপরাধীদের কোমরে দড়ি পড়ল না কোর্টে তোলা হল? কোনওটাই নয়। কয়েকটা স্কাউন্ড্রেলকে চিহ্নিত করা গেলেও চার্জশিট দেওয়া গেল না। সবকটি রত্নই শাসকদলের ছত্রছায়ায় বিশেষভাবে সুরক্ষিত।

একটাই লাভ হল -- পুরো কাণ্ডটাই যে একটা রাজনৈতিক চক্রান্তের অংশ, সেটা প্রমানিত হয়ে গেল। শহরের ওই প্রান্ত থেকে এই দিন দরিদ্র পরিবারগুলোকে হঠানোর চেষ্টা নতুন সরকার অনেকদিন ধরেই চালিয়ে যাচ্ছে -- এই নৃশংসতাটা প্রেশার ট্যাকটিক্স-এরই যে একটা অংশ, সেটা জেনে সাধারণ, শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ স্তম্ভিত হয়ে গেল, ক্রুদ্ধ হয়ে উঠল। কিন্তু সাধারণ মানুষের ইমোশন দিয়ে তো আর রাজনৈতিক মদতপুষ্ট দুষ্কৃতীদের জ্বালিয়ে দেওয়া যায়না, তাই আফ্রিনের হত্যাকারীরা বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগল।

শ্রুতিলেখা, সরিতা, সোনিয়াদের মতো পারভিন, নাসরিনরাও মনে মনে ফুঁসছে আর ভেতরে ভেতরে ছটফট করছে। বুকটা রাগে জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে। কিন্তু ওরা জানে না ওরা কি করবে। কি করলে এই জ্বালা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে।

কিন্তু সেদিন সব ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল, যখন শ্রুতিলেখা নাসরিনের কাছে শুনলেন, পুরো ঘটনাটাকে একটা ধর্মীয় রঙ দিয়ে দাঙ্গা বাঁধানোর চেষ্টা চালান হচ্ছে। এ এলাকার প্রধান মসজিদের ইমামের জিগরি দোস্ত হলেন নাসরিনের ভাসুর। ভদ্রলোকের কাছে অনেক ভেতরের খবর থাকে।

শিবমন্দিরের পুরোহিত এবং অন্যতম অভিযুক্ত তাঁর সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে নাকি আজকে এক বিরাট সভা করতে চলেছেন মন্দিরের পাশেই। তা, তেনার দাবিটা কি? না, এই ঘটনায় ওঁর মন্দিরের নাম জড়িয়ে যে কুৎসা রটানো হয়েছে, তার প্রতিকার চাই। বোঝো কাণ্ড! চোরের মায়ের বড় গলা আর কাকে বলে! ধর্মের ধুয়ো তুলে আসল ঘটনাটাকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা আর কি... নাসরিন নিজের মনে বলে চলেন, কিন্তু খেয়ালও করেননা, সামনে বসে থাকা শ্রুতিলেখার চোখমুখ কেমন যেন বদলে যাচ্ছে।

-- নাআআআআআ!

বন্ধুর চিৎকারে সম্বিত ফেরে মধ্যবয়সী মুসলমানীর। সামনে এ কোন শ্রুতিলেখা? সভয়ে তাকিয়ে দেখেন। বহু বছরের পুরনো বান্ধবীটিকে নাসরিন যেন চিনতে পারেন না। শ্রুতিলেখার চোখ দিয়ে আগুন ঠিকরে বেরোচ্ছে। মাথার চুল খামচে ধরে মাথাটা বারবার ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে বলে চলেছেন না, না, না, না, আমি আর সহ্য করতে পারছিনা। আমি কিছুতেই আর সহ্য করতে পারছি না। একটা নিষ্পাপ শিশু কেন একটা সুপরিকল্পিত, নৃশংস, নোংরা ষড়যন্ত্রের বলি হবে? কেন কেন কেন? আতঙ্কিত নাসরিনের গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোয় না।

শ্রুতিলেখা যেন উন্মাদিনী। নাসরিনকে দুই হাতে ধরে তিনি ঝাঁকাতে থাকেন -- কেন, কেন, কেন?

নাসরিন চুপ। নাসরিনের কাছে এই কেনর উত্তর নেই। কিন্তু কি যেন একটা রেডিয়েট করছে শ্রুতিলেখার শরীর থেকে। সেই উত্তাপ ক্রমশ দ্বিতীয় রমনীটির মধ্যেও সংবাহিত হতে থাকে। তিনি বান্ধবীকে জড়িয়ে ধরেন -- না বহেন। আর আমরা সহ্য করবনা। এবার আঘাত হানার সময় হয়েছে।

-- তবে চল, আমরা বেরিয়ে পড়ি... মধ্যবয়সিনী বাঙালিনী শক্ত করে পাঠানীর হাত জড়িয়ে ধরেন -- চল, এখনি যুদ্ধে বেরতে হবে। তুমি আর আমি সৈন্য সাজাই।



নাসরিন একছুটে বন্ধুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েন। শ্রুতিলেখা কোমরে আঁচল গুঁজে ফোনটা হাতে তুলে নেন। শ্রুতিলেখার কাছ থেকে সোনিয়া, তাঁর কাছ থেকে সরিতা, সেখান থেকে নেহা, নেহার থেকে শালিনী -- যুদ্ধের বার্তা রেডিও ওয়েভের মাধ্যমে সারা শহরের বিভিন্ন বয়সী নারীর কাছে পৌঁছে যায়।

ঐ একই সময়ে, নাসরিনের আর্মিও জন্ম নিচ্ছে। পাশের বাড়ির অল্পবয়সী বউ সালমা গায়ে বোরখাটা চাপিয়ে সবে বেরোবে, ওর ডবলবয়সী শোহর এসে ওর কনুই মুচড়ে ধরে ঘরে টেনে নিয়ে যেতে চেষ্ট করে। ওর অশীতিপর শাশুড়ি এসে সপাটে ছেলের গালে এক থাপ্পড় কষান। বৃদ্ধার শিরা ওঠা হাতের চপেটাঘাতে, জোয়ান লোকটা গাল ধরে বসে পড়ে। শাশুড়ি বউমার হাতে তুলে দেন দুদিন আগে শান দিয়ে আনা মাংসকাটা ছুরিটা। বিস্মিত, হতচকিত স্বামীর দিকে দৃকপাত না করে, উনিশ বছরের সালমা বিবি হাতে ছুরি উঁচিয়ে লাফ দিয়ে রাস্তায় নামে। জিনাত আর শবনম দুদিক থেকে এসে ওর দু হাত ধরে।

মেয়েকে এসে শ্রুতিলেখা বলেন -- চল, যুদ্ধে যেতে হবে। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের হেজিটেশন, মেয়ে শরণ্যা বলে -- চলো। অফিসের ব্যাগ খুলে ফোল্ডিং সুইস নাইফ আর পেপার স্প্রেটা হাতে নিয়ে নেয়।

কোমরে আঁচল গোজা, হাতে নেপালে বেড়াতে গিয়ে কিনে আনা কুকরি। শ্রুতিলেখা স্বামীর সামনে গিয়ে বলেন -- যুদ্ধে যাচ্ছি। হয় জিতে ফিরব নয় মরবো। ধর্মভীরু অধ্যাপক স্বামী ঠাকুরঘরে প্রতিষ্ঠিত দুর্গা মায়ের সিঁদুরের তিলক স্ত্রী কন্যার কপালে এঁকে দিয়ে বলেন -- বিজয়িনী ভব। অতঃপর শ্রুতিলেখা কন্যাসহ রাস্তায় নামেন।



ততক্ষণে রাস্তায় নানা বয়সী, নানা ধর্ম, নানা জাতির নারীর ঢল। সবার হাতে অস্ত্র, সবাই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত। সবার গন্তব্য একটাই -- শহরের শেষ প্রান্তের শিব মন্দির। মিছিল যত এগোতে থাকে, পুরো শহরের আঁকাবাঁকা গলিগুলি থেকে পিলপিল করে শয়েশয়ে নারী এসে সেই মিছিলে যোগ দিয়ে তার বহর বাড়িয়ে তোলে। সে এক অবিশ্বাস্য, অবর্ণনীয় দৃশ্য। অচিরেই আইনেররক্ষকদের টনক নড়ে। মন্দিরের দিকে যেতে জাতীয় সড়কের ওপর প্রথমেই পড়ে লালগড় থানা। বড়বাবুটি লাঠি উঁচিয়ে মিছিল ছত্রভঙ্গ করার জন্য ধেয়ে আসেন। এইভাবে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মিছিল করা যায় নাকি? দেশে কি আইন কানুন নেই? মিছিলের পুরোভাগে দাঁড়ানো শ্রুতিলেখা ঠাণ্ডা চোখে ওঁর দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকেন। সে চোখে কী যে ছিল! দোর্দণ্ডপ্রতাপ অফিসারটি কয়েকপা পিছিয়ে যান, মিছিল নিজের গতিতে সামনে এগিয়ে যায়।

লাঠি চালনা, টিয়ারগ্যাস না সোজাসুজি গুলিবর্ষণ -- কোনটার প্রয়োগ সঠিক হবে, পুলিশের বড়কর্তা এবং মন্ত্রীরা দফায় দফায় মিটিং করেও যখন সেটা ডিসাইড করে উঠতে পারেন না, পুলিশ কমিশনার তখন হোম আর ডিফেন্স মিনিস্টারের সাথে ভিডিও কনফারেন্সিং করার জন্য প্রস্তুত হন। ততক্ষণে মিছিল মন্দির থেকে আর মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দূরে।



ঠিক সেই সময়ে শিব মন্দির প্রাঙ্গনে মহাসমাবেশ। মন্দিরের চাতালে জাতীয় পতাকা শোভিত বিরাট বড় মঞ্চসজ্জা দেখে মনে হয় যেন সরকারী কোন অনুষ্ঠান। শেষশীতের চড়া রোদ অগ্রাহ্য করে জনসমাগম দেখার মত। ব্যবসায়ী,ডাক্তার,উকিল, সরকারি কর্মচারী, ধর্মীয় নেতাদের নিয়ে যাকে বলে তারকাখচিত সমাবেশ। মঞ্চ আলো করে বসে সাতজন মানুষ, আফ্রিন কাণ্ডে অভিযোগের তীর সরাসরি যাদের দিকে অথচ আইনগ্রাহ্য প্রমানের অভাবে যাদের টিকিটিও কেউ ছুঁতে পারছেনা। এদের সবার দাবি তারা নিরপরাধ। মন্দিরে নাকি কোনো রকম অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। আট বছরের বাচ্চা মেয়েটা নাকি তার প্রেমিকের সঙ্গে পালিয়ে গিয়েছিল তাই প্রেমিক তাকে খুন করেছে। মাইক্রোফোনে ভেসে আসছে গরম গরম উস্কানিমূলক ভাষণ। ধর্ষণ? তাতে কি? সে তো হয়েই থাকে। প্রতি ৩০ মিনিটে একটা করে রেপ হয় ইন্ডিয়ায়। কিন্তু এই যে তাদের পবিত্র দেবালয়ের বিরুদ্ধে রটনাটা হল, তার প্রতিকারটা তো আগে হওয়া দরকার। অতএব দাঁতের বদলে দাঁত। মন্দিরের বদলে মসজিদ।

দর্শকদের মধ্যে বেশ কিছুক্ষণ ধরে উসখুসানি চলছিল। অনেকেরই কানে ফোন। ভিড়টা যেন ক্রমশ পাতলা হয়ে আসছিল। এসবের কোনও কিছুই যে মঞ্চে উপবিষ্ট সাত মহারথীর নজরে এল না, তার কারণ হল তাদের অতিরিক্ত ক্ষমতার দর্প, আত্মবিশ্বাস এবং তজ্জনিত অতি ঔদ্ধত্য। ফলে মাইকের সামনে তারা এক এক করে লম্বা চওড়া লেকচার দিয়ে চলল। তাদের প্রত্যেকের ফোন কতবার বেজে উঠল। সতীর্থদের হুঙ্কারে আর চ্যালা চামুণ্ডাদের করতালির বহরে সে শব্দ তাদের কানেই ঢুকলনা। ধ্বংসের নেশায় বুঁদ হয়ে লোকগুলো হিংসার বীজ বুনতে বুনতে বসে বসে নিজেদের ধমনীর মধ্যে আ‍্যড্রিনালিনের দাপদাপি উপভোগ করতে লাগল। যদি কোনও একজনও ফোনটা অন্তত একবারের জন্যও চেক করত,তবে ঘটনাপ্রবাহ হয়তোবা অন্য খাতে বইত।



অবশেষে দিল্লি থেকে অর্ডার এল, মিছিলকারিনীদের ওপর কোন রকম ফিজিকাল ভায়োলেন্সের প্রয়োগ ছাড়াই মিছিল ছত্রভঙ্গ করে দিতে হবে। ফোনটা রেখে পুলিশ কর্তাটি কপালের ঘাম মোছেন। দিল্লির আর কি? হুকুম দিয়েই খালাস। এমন মিছিল ভূভারতে কেউ কখনও দেখেছে? মনে মনে তিনি ইন্টেলিজেন্স টিমের মুণ্ডুপাত করেন। বহুদিনের পরিকল্পনা ছাড়া তো এতবড় একটা মিছিল নামানো সম্ভব নয় -- ব্যাটারা বসে বসে কি ঘোড়ার ঘাস কাটছিল? কেউ ঘুণাক্ষরেও কিছু টের পেল না? মার খেতে খেতে এভাবেও যে ঘুরে দাঁড়ানো যায়, তা পোড় খাওয়া আইনরক্ষকটি তাঁর তিরিশ বছরের কেরিয়ারে কখনও দেখেননি, ফলে তিনি জানতে পারলেন না যে তাঁর ইন্টেলিজেন্স টিমের সত্যিই কোনও দোষ নেই। এ আন্দোলন শতকরা একশোভাগ স্পন্টেনিয়াস।

ছোট শহরের এমার্জেন্সি হ্যান্ডলিং-এ অপটু ছোট্ট পুলিশ ফোর্স যতক্ষণে টিয়ার গ্যাস চার্জ করার অর্ডার নিয়ে মিছিল অভিমুখে রওনা দেয়, ততক্ষণে যুযুধান নারীর দল মন্দিরপ্রাঙ্গন ছুঁয়ে ফেলেছে।


১০

স্যামুয়েল ক্রেগ একজন পেশাদার ফটোগ্রাফার। জাতে ব্রিটিশ, এই ফোটো জার্নালিস্টটি সারা দুনিয়া ঘুরে ঘুরে ছবি তুলে বেড়ায়। ভারতবর্ষে এসেছেন ন্যাশানাল জিওগ্রাফিকের হয়ে প্রাচীন মন্দিরের ওপর একটা ফোটো ফিচার করার জন্য। এই শান্ত ছিমছাম শিবমন্দিরটা স্যামের খুব মনে ধরে। আজ সকাল সকাল এসে পাশের টিলাটায় উঠেছিল, কতগুলো লঙ শট নেওয়ার জন্য। সকাল থেকে দেখছে কি এক অনুষ্ঠান চলছে। স্যাম শুটিং চালিয়ে যায়। হঠাৎ তার নিকন ডি 800 E-র টেলি লেন্স এক অদ্ভুত দৃশ্য ক্যাপচার করে -- মন্দিরের দক্ষিণ প্রান্তে কিসের যেন একটা মুভমেন্ট! অনেক ঢেউ যেন আস্তে আস্তে ওঠাপড়া করছে। স্যাম লেন্সটাকে আরও ভালভাবে ফোকাস করে বুঝতে পারে, এক জনসমুদ্র সুনামির মত মন্দিরের দিকে এগিয়ে আসছে। চড়াই উতরাই ভাঙতে ভাঙতে আসার ফলে মনে হচ্ছে যেন ঢেউএর ওঠাপড়া। স্যাম অবাক হয়ে দেখল, মন্দিরের কাছাকাছি এসে মানুষের লম্বা লাইনটা দুভাগে ভাগ হয়ে গিয়ে মন্দিরকে দুদিক থেকে বেড় দিয়ে ঘিরে ফেলল। স্যাম তার সাংবাদিক-সুলভ ইনস্টিংক্ট থেকে বুঝতে পারে, বিরাট কিছু একটা ঘটতে চলেছে। সে জ্যানেটকে ফোন লাগায়। জ্যানেট বিবিসির একজন সিনিয়র কনটেন্ট প্রোডিউসার।


১১

কোথা থেকে একটা বিশাল রঙিন ঢেউ এসে মন্দির প্রাঙ্গনে আছড়ে পড়ল। ভণ্ড পুরোহিত কেশরিলাল ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখল তারা একটা চক্রবূহ্যের মধ্যে বন্দি। এরা কারা? শাড়ি, বোরখা, সালোয়ার, স্কার্ট। ছুরি, কাটারি, কাস্তে, হাতুড়ি। সবার চোখ জ্বলছে... যেমন করে রাতের বেলায় শ্বাপদের চোখ জ্বলজ্বল করে। গা থেকে আগুনের হলকা বেরিয়ে যেন ওদের গা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিচ্ছে। গলা শুকিয়ে কাঠ। পঁয়ষট্টি বছরের কেশরিলাল প্রথম বুক চেপে নীচে বসে পড়লেন। অভিযুক্ত কনস্টেবল ভজনলাল সবাইকে ঠেলে ফেলে পালাবার একটা বৃথা চেষ্টা করে ছুরি কাঁচির গুঁতো খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ল। বাকিদের অবস্থা তথৈবচ। এলাকার প্রবল প্রতিপত্তিশালী রিয়েল এস্টেট টাইকুন হরিভাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছোটবাইরে করে ফেলল। কেশরিলালের জ্ঞাতিভাই রওনকলাল শুধু কাঁপা কাঁপা গলায় পুলিশ পুলিশ করে একবার চেঁচাবার চেষ্টা করেছিল।

তার গলা পুলিশের কানে পৌঁছাল কিনা বোঝা গেলনা। যদিও সাইরেন বাজিয়ে, লাইন করে ততক্ষণে পুলিশের গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে পাহাড়ের নীচটায়। সামনের গাড়িটা বহু এনকাউন্টার-অভিজ্ঞ পুলিশ কমিশনার এস কে চৌহান নিজেই চালিয়ে এসেছেন। লাফ দিয়ে নিজের জিপসি থেকে নামেন তিনি। চারপাশটা ভালভাবে ছকে নিয়ে চার্জের হুকুম দেওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে সামনে কি যেন দেখে কয়েক সেকেন্ডের জন্য থমকে যান প্রবীণ আই পি এস অফিসারটি। কি দেখছেন তিনি? আগুনের হল্কা নাকি? চড়া রোদে চোখটা যেন কেমন ধাঁধিয়ে গেল। সামনে এ কে? চেনার মত তবু অচেনা? লাল শাড়ির আঁচল পতপত উড়ছে হাওয়ায়। তার সাথে খোলা চুলও। কপালে সিঁদুর লেপ্টে আছে। দুঁদে পুলিশ কর্তার গলা দিয়ে এক আতংকের চিৎকার বেরিয়ে আসে। তাঁর একমাত্র ছেলের বউ। সবে এক বছর হলো বিয়ে হয়েছে। কন্যাহীন দম্পতির জীবনে অল্পবয়সী মেয়েটি যেন এক ঝলক খুশির বাতাস বয়ে এনেছে। -- বেটি তুইও এদের মধ্যে আছিস? কেন কেন? উত্তরে মেয়েটি শুধু চেয়ে থাকে। সে দৃষ্টিতে কি ছিল কে জানে? পোড় খাওয়া আইনের রক্ষক মাথা নিচু করে নিজের গাড়িতে উঠে বসেন। সহকারীকে বলেন -- মনে রেখো, পুলিশ ঠিক সময়ে স্পটে পৌঁছাতে সক্ষম হয়নি। তাঁর লম্বা চাকরি জীবনে এতবড় হার আর কখনও হয়নি। কিন্তু পুলিশ কমিশনার চৌহান অবাক হয়ে আবিষ্কার করলেন, মনটা আজ কয়েকযুগ পরে কেমন যেন হালকা লাগছে।


১২

প্রথমে পিচকিরির মত লঙ্কা গুঁড়োর স্প্রে ছুটে এসে চোখে নাকে মুখে যেন আগুন জ্বালিয়ে দিল। ধারালো অস্ত্রের খোঁচায় পরনের বস্ত্র ছিঁড়েখুঁড়ে সর্বাঙ্গ মুহূর্তে নিরাভরণ। যে পুরুষাঙ্গকে এরা দুর্বলের ওপর প্রয়োগ করার জন্য সৃষ্ট একটা torture tool ছাড়া কিছুই মনে করেনি কখনো, দেহের সেই বিশেষ অঙ্গটি লুকানোর জন্য এখন তাদের কতই না আকুলতা! গায়ে বিছুটি পাতার জ্বালা, মুখে মা মা বহেন বহেন রব। সে ডাকে আর চিঁড়ে ভিজবে না। আজ এই মন্দিরে জমা হওয়া হাজার হাজার মহিলার একটাই পরিচয় -- তারা আফ্রিনের মা। এসেছে তাদের সন্তানের নারকীয় হত্যার প্রতিশোধ নিতে। আঘাতে আঘাতে জেরবার নরপশু গুলো একসময় জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ে। চারদিকে তখন হর হর মহাদেও ধ্বনি। সবাই এই যুযুধান নারীদের মধ্যে দেবতাকে প্রত্যক্ষ করেছে যে। অবশেষে দেবতা জেগে উঠেছেন অসুর নিধনের নিমিত্ত।

স্যামের ক্যামেরা ফিড তখন আন্তর্জালের মাধ্যমে জ্যানেটের ল্যাপটপে। বিবিসির প্রাইম টাইম বুলেটিনে তখন ব্রেকিং নিউজ child rapists crushed to death in India. এক চ্যানেল থেকে আরেক চ্যানেল আর সেখান থেকে আস্তে আস্তে সারা দুনিয়ার ড্রইংরুমে পৌঁছে যায় সেই ভিডিও রেকর্ডিং। Three Billboards এর মিলড্রেডের লড়াই, পাকিস্তানের জৈনাবের পরিবারের লড়াই, অপহৃতা ইয়াজিদি কন্যাদের মায়েদের লড়াই, গল্প, বাস্তব, জাতি, ধর্ম কোথায় যেন মিলে মিশে এক হয়ে যায়। আজ প্রকৃত অর্থেই আফ্রিন যেন এক বিশ্বকন্যা। দিল্লি, লাহোর, লন্ডন, প্যারিস, টোকিও, নিউইয়র্কে মায়েরা একইসঙ্গে হাসিকান্নায় ভাসে। আজ নারী দিবস।

স্যামের ক্যামেরার লেন্স ফলো করে এক রণক্লান্ত বিধ্বস্ত মাঝবয়সী রমনীকে। পড়ন্ত সূর্যের আলো মেখে হেঁটে চলেছেন তিনি। আজ অনেকদিন পর তিনি রাতে একটু ঘুমাবেন।

0 comments: