গল্প - সৌম্য ব্যানার্জী
Posted in গল্প
গল্প
মন্থনামৃতম
সৌম্য ব্যানার্জী
বছর পাঁচেক আগে এক বন্ধু ইষৎ মত্তাবস্থায় বলেছিলো, ‘‘যেদিন বিয়ার আর পেট্রলের দাম সমান হয়ে যাবে, সেদিন হয় বিয়ার খাওয়া, নয়তো গাড়ি চালানো... কোনও একটা ছেড়ে দেবো।’’ সেই দিনটা যে এত তাড়াতাড়ি এসে পড়বে, সেটা সেই আসরের কেউই যে ভাবেনি, সে কথা আমি হলফ করে বলতে পারি। সেটাই বলছিলাম অমৃতদাকে সেদিন অফিস যাওয়ার পথে। পেট্রলের দাম আশি ছুঁই-ছুঁই হওয়ার পর থেকে মাঝে মাঝে আমরা একসঙ্গে যাই আজকাল। ওর কলেজ আমার অফিসের পথেই পড়ে। অ্যাপ ট্যাক্সি নিই। ওকে নামিয়ে দিয়ে যাই।
কথাটা শুনে অমৃতদা ওর পেটেন্টেড চাপা হাসিটা দিয়ে বললো, ‘‘পেট্রোলিয়ম নিয়ে মারদাঙ্গাটা কিছু নতুন নয় হে। হাজার হাজার বছর ধরে হয়ে আসছে।’’
আমি যথারীতি থ! হাজার হাজার বছর ধরে পেট্রোলিয়ম নিয়ে মারদাঙ্গা??
‘‘এসিটা একটু বন্ধ করুন তো ভাই।’’ ড্রাইভারকে নির্দেশ দিয়ে অমৃতদা জানলার কাচ নামিয়ে সিগারেট ধরালো। আমাকে দিলো না। জানে, আমি আজকাল কম খাওয়ার চেষ্টা করছি। খানিকক্ষণ আয়েস করে সিগারেট টানলো। তারপর বললো, ‘‘ব্যাবিলনে দেওয়াল বানানোর জন্য অ্যাস্ফল্ট ব্যবহার হতো, জানো? প্রাচীন পারস্যের ধনীদের বাড়িতে পেট্রোলিয়মের বাতি জ্বলতো। বাগদাদের রাজপথ টার দিয়ে বাঁধানো হতো। জানো সেসব?’’
বলা বাহুল্য, জানি না। কিন্তু জানতে চাই অবশ্যই। তাই তাকিয়ে রইলাম প্রোফেসর সাহেবের দিকে, প্রত্যাশী বেড়ালের মতন। কিন্তু তার দেখি হেলদোল নেই। জানলার বাইরে তাকিয়ে ফুসফুস করে সিগারেট টেনেই চলেছে। তাই বাধ্য হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘‘পেট্রোলিয়ম বস্তুটা কত পুরনো?’’
অমৃতদা ওর টিপিকাল কায়দায় একটা ভুরু তুলে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে চাইলো আমার দিকে। তড়িঘড়ি ভুল শুধরে আবার প্রশ্ন করলাম... ‘‘আই মীন, কতদিন হলো মানুষ ব্যবহার করছে পেট্রোলিয়ম?’’
উত্তরে কয়েক সেকেন্ড বাদে পেলাম একটা আপাত-অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন... ‘‘সুমেরীয় সভ্যতা কত পুরনো বলে মনে হয়?’’
আমি ভ্যাবাচাকা খেয়ে হাঁ!। আমতা আমতা করে বললাম, ‘‘সুমেরীয়... মানে... ইরাকের কথা বলছো?’’
‘‘নয় তো কি ইটানগরের কথা বলছি?’’
গুম মেরে গেলাম। নাহয় একটু কম জানি, তাই বলে...
কয়েক সেকেন্ড পর অমৃতদা মুচকি হেসে সিগারেটের প্যাকেট আর লাইটার বাড়িয়ে দিলো। আমিও বিনা বাক্যব্যয়ে একটা নিয়ে ফস করে ধরিয়ে ফেললাম। রাগ হলে কার না সিগারেট খেতে ইচ্ছে করে?
‘‘ফার্টাইল ক্রেসেন্ট কাকে বলে জানো?’’
সিগারেটের ধোঁয়া গলায় আটকে প্রথমটা একটু কাশি এলেও পরক্ষণেই মনে হলো, কথাটা শোনা। একটু ভাবতেই মনে পড়লো... ‘‘মিডল ঈস্টের একটা অঞ্চল, রাইট?’’
‘‘হুঁ। সভ্যতার আঁতুড়ঘর।’’ অমৃতদা শেষ টানটা দিয়ে সিগারেটটা ক্যারামের কায়দায় বাইরে ফেলে দিয়ে বলতে আরম্ভ করলো... ‘‘আজকের ইরাক, ইজরায়েল, প্যালেস্তাইন,সিরিয়া, লেবানন, ইজিপ্ট, জরডান, টার্কি এবং ইরানকে নিয়ে একটা অর্ধচন্দ্রাকার ভূমি। উত্তরপশ্চিমে ভূমধ্য সাগর, দক্ষিণপশ্চিমে নীলনদ আর লোহিত সাগর, দক্ষিণে সিরিয়ার মরুভূমি এবং দক্ষিণপূর্বে পারস্য উপসাগর, যেখানে টাইগ্রিস আর ইউফ্রেটিস নদ টার্কির আনাতোলিয়া অঞ্চল থেকে এসে মিশছে। অতি উর্বর ভূখণ্ড। এই অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষই আজ থেকে আনুমানিক দশ হাজার বছর আগে পৃথিবীতে প্রথম কৃষিকর্ম শেখে। সূত্রপাত করে সুমেরীয় সভ্যতার।’’
অমৃতদা থামলো। এই ভঙ্গীটা আমার অতি পরিচিত। লেকচার মোড। প্রোফেসর অমৃত অধিকারীর লেকচারের স্টাইলটা একটু স্পেশাল। একতরফা নয়। রেসপন্স চায়। তাই বললাম, ‘‘এরাই প্রথম লিখতেও শিখেছিলো না?’’
‘‘লিখতে শিখেছিলো, চাকার ব্যবহার শিখেছিলো, আরও অনেক কিছু শিখেছিলো। এবং সেই সঙ্গে করে ফেলেছিলো একটা সাংঘাতিক কাণ্ড।’’
নড়েচড়ে বসলাম। ‘‘কিরকম?’’
অমৃতদা মুচকি হাসলো। ‘‘ধৈর্যং রহুঃ, বৎস। এসব গুহ্য কথা এরকম হুড়মুড়িয়ে জানা যায় না।’’
যাকে বলে টোটাল অ্যান্টিক্লাইম্যাক্স! ‘‘গুহ্য কথা?’’
‘‘ইয়েস। অতি গুহ্য কথা। ইতিহাসে পাবে না।’’
‘‘তো তার জন্য কি করতে হবে?’’
‘‘বিশেষ কিছু না... খানিকটা অপেক্ষা, একটু গুগল আর পারলে কিছুটা চিন্তাভাবনা।’’
‘‘কি বিষয়ে?’’
‘‘বিষয়ের অভাব কি? ফার্টাইল ক্রেসেন্ট, সুমেরীয় সভ্যতা, পেট্রোলিয়মের ইতিহাস, ভারতীয় পুরাণ... কত বিষয় আছে গুগল করার জন্য।’’
‘‘ভারতীয় পুরাণ? তার সঙ্গে পেট্রোলিয়মের কি সম্পর্ক?’’
‘‘আছে হে, আছে। দৃষ্টি উন্মীলিত হলেই দেখতে পাবে। এই বাঁদিক করে একটু দাঁড় করান তো।’’
বলা বাহুল্য, শেষ কথাগুলো ড্রাইভারকে বলা। ওর কলেজ এসে গেছে। গাড়ি দাঁড়ালো। অমৃতদা নেমে আমায় একটা মুচকি হাসি দিয়ে কলেজের দিকে হাঁটা দিলো, আর আমিও যাকে বলে ‘কম্প্লীটলি ব্যাফ্লড’ অবস্থায় পেট্রোলিয়মের সঙ্গে ভারতীয় পুরাণের সম্পর্কের বিষয়ে ভাবতে ভাবতে অফিস গিয়ে পৌঁছলাম। তারপর সারাদিনের ব্যস্ততায় ব্যাপারটা মাথা থেকে বেরিয়ে গেছিলো। কিন্তু লাঞ্চ ব্রেকে পেট্রলের দাম নিয়ে দুই কোলীগের সঙ্গে আলোচনার সময় আবার মনে পড়ে গেলো। দুপুরটা মোটামুটি অন্যমনস্ক হয়েই কাটলো । কাজের ফাঁকে ইন্টারনেট ঘেঁটে দেখলাম, বাস্তবিকই ব্যাবিলনের দেওয়াল আর মিনার বানানোর জন্য আদ্যিকাল থেকেই অ্যাস্ফল্ট ব্যবহার হতো। প্রাচীন পারস্যের ধনীদের বাড়িতে পেট্রোলিয়মের আলোও জ্বলতো। বাগদাদের রাজপথও টার দিয়ে বাঁধানো হতো। এসব যদি সত্যি হয়, তাহলে মানতেই হবে যে মধ্যপ্রাচ্যের মানুষ প্রাগৈতিহাসিক সময় থেকে পেট্রোলিয়মের ব্যবহার জানতো। কিন্তু তার সঙ্গে ভারতীয় পুরাণের যোগটা কোথায়, সেটা আমার মোটা মাথায় আসলো না।
বিকেলের একটা ঢপের মীটিং ক্যান্সেল করে তড়িঘড়ি বাড়ি ফিরলাম, এবং ফিরেই কোনওরকমে ফ্রেশ হয়ে জামাকাপড় পাল্টে গিয়ে হাজির হলাম অমৃতদার ওখানে। ও আমার অনেক আগেই বাড়ি ফিরে আসে। সোফায় বসে চা খাচ্ছিলো। আমায় দেখে মুচকি হাসলো। ভাবটা এমন, যেন জানতো আমি আসবোই। আমিও নাচার, এবং নাছোড়ও। যতক্ষণ না প্রাচীন মধ্যপ্রাচ্যে পেট্রোলিয়ম ব্যবহারের ইতিহাসের সঙ্গে ভারতীয় পুরাণের যোগাযোগটা বুঝতে পারছি, ততক্ষণ আমার শান্তি নেই... এবং সেটা অমৃতদা খুব ভালো করে জানে।
‘‘কি? কিছু পাওয়া গেলো?’’ আমি ওর উল্টো দিকের সোফায় বসার পর ভুরু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো।
‘‘ব্যাবিলন-বাগদাদের কথা তো পাওয়া গেলো। সেখানকার মানুষ যে প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে পেট্রোলিয়ম ব্যবহার করতো, তাও বোঝা গেলো। কিন্তু তার সঙ্গে ভারতীয় পুরাণের সম্পর্কটা কোথায়, তার তো কোনও হদিশ পাওয়া গেলো না।’’
‘‘প্রসঙ্গটা কি দিয়ে আরম্ভ হয়েছিলো?’’
‘‘অ্যাঁ?’’
‘‘বলছি, আজ সকালে এই প্রসঙ্গটা কি দিয়ে আরম্ভ হয়েছিলো?’’
‘‘পেট... মানে, পেট্রলের দাম দিয়ে।’’
‘‘তারপর?’’
‘‘তারপর... তুমি বললে, হাজার হাজার বছর ধরে পেট্রোলিয়ম নিয়ে মারামারির কথা।’’
‘‘হুঁ।’’
‘‘কি হুঁ?’’
‘‘যোগাযোগটা সেইখানেই।’’
‘‘মানে? ভারতীয় পুরাণের সঙ্গে পেট্রোলিয়মের যোগাযোগ মারামারি নিয়ে?’’
‘‘খানিকটা সেইরকমই।’’
আমি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। অমৃতদার হেঁয়ালিমার্কা গৌরচন্দ্রিকা বোঝার মতন ক্ষমতা আমার নেই। কোনওদিন হবেও না। তাই এসব ক্ষেত্রে পুরোটাই ওর মূড এবং মর্জির উপর নির্ভর করা ছাড়া আমার গত্যন্তর নেই। তবে এইটা এতদিনে বুঝেছি যে যত বেশি হেঁয়ালি, বিষয়টা তত বেশি চমকপ্রদ। তাই যথাসম্ভব গোবেচারা মুখ করে তাকিয়ে রইলাম প্রোফেসর সাহেবের দিকে।
কিন্তু নিয়তি কে ন বাধ্যতে! ঠিক তখনই সুমিত্রাবৌদির প্রবেশ, চা আর আর ওর ট্রেডমার্ক হোমমেড মাংসের সিঙাড়া নিয়ে। অমৃতদার গল্প অতি উপাদেয় নিঃসন্দেহে, কিন্তু সুমিত্রাবৌদির মাংসের সিঙাড়ার সঙ্গে তার তুলনা হয় না। তাই বেচারা ভাবটা বেশিক্ষণ ধরে রাখা গেলো না। মাংসের সিঙাড়া ঠাণ্ডা হতে দেওয়া মহাপাপ, এবং সেটা অমৃতদারও বিশ্বাস।
দুজনে দুটো করে সিঙাড়া পেঁদিয়ে প্রায় একসঙ্গেই চায়ের কাপ তুললাম। অমৃত অধিকারী-স্পেশাল সুগন্ধী মিক্সড লিকার চা। এক চুমুকেই মন ভালো হয়ে যায়। সেটা দিয়ে বললাম,‘‘এইবার ব্যাপারটা বলো, গুরু। আর ভণিতা কোরো না, প্লীজ।’’ ওরকম সিঙাড়া আর এরকম চা খাওয়ার পর কারও মূড খারাপ হতেই পারে না। হলে সে নিতান্তই অমানুষ, আর আমাদের প্রোফেসর সাহেব যতই কাঠখোট্টা হোক না কেন, অমানুষ নয়।
‘‘হুঁ।’’ চায়ের কাপটা টেবিলের উপর নামিয়ে রাখলো অমৃতদা। ‘‘জিওগ্রাফিটা মনে আছে?’’
জিওগ্রাফি? মুহূর্তের ভ্যাবাচাকার পর মনে পড়লো, সকালে ফার্টাইল ক্রেসেন্টের কথা হচ্ছিলো।
‘‘হ্যাঁ... ইরান, ইরাক, ইজরায়েল, প্যালেস্তাইন, সিরিয়া-টিরিয়া নিয়ে একটা কাস্তে শেপ-এর ভূখণ্ড। তাই তো?’’
‘‘হুঁ। উপরে বাঁদিকে মেডিটেরেনিয়ান। নীচে ডান দিকে পারস্য উপসাগর, যাকে তোমরা পার্শিয়ান গাল্ফ বলো। সেখানে টাইগ্রিস আর ইউফ্রেটিস এসে জল ঢালছে।’’
‘‘হ্যাঁ। সভ্যতার আঁতুড়ঘর। তাই তো?’’
‘‘ইয়েস।’’
‘‘কি হয়েছিলো সেখানে?’’
অমৃতদা চায়ে একটা আয়েস করে চুমুক দিলো। তারপর কাপ রেখে সিগারেট ধরালো। আমার চলবে না। নিজেরই সেট করা দিনে দুটোর লিমিটে আজ অলরেডি পৌঁছে গেছি।
‘‘ভাবো, কল্পনার রাশ আলগা দাও...’’ অমৃতদা বলতে আরম্ভ করলো। আমি নড়েচড়ে বসলাম। বৌদিও দেখলাম ফ্রিজ থেকে খাবার বার করতে করতে কান খাড়া করে রেখেছে,অর্থাৎ এ গল্পটা ওরও শোনা নয়... ‘‘আজ থেকে কমপক্ষেও সাড়ে তিন-চার হাজার বছর আগের কথা। পারস্য উপসাগরের কূলে বসবাসকারী একটা শ্বেতাঙ্গ জাতি। এদেরই পূর্বজরা এই গ্রহে প্রথম কৃষিকাজ আরম্ভ করে। লিখতে শেখে। কিন্তু সে সব আরও অনেক আগের ঘটনা। ততদিনে এরা সভ্যতার পথে আরও বহুদূর এগিয়ে গেছে। বড় বড় পাল-তোলা কাঠের জাহাজ বানিয়ে সমুদ্রযাত্রা আরম্ভ করেছে। সাগরপারের অন্যান্য সব সভ্যতার সঙ্গে বাণিজ্যও শুরু হয়েছে। নিজেদের এরা বাকি সব প্রতিবেশী জাতির থেকে আলাদা করে চিহ্নিতও করে ফেলেছে... পাণি নামে।’’
একটু বিরতি। পাণি নামটা ভীষণ চেনা চেনা... কিছুতেই মনে পড়লো না।
‘‘চিনতে পারলে না তো?’’ প্রোফেসর সাহেবের টিপিকাল বাঁকা হাসি। ‘‘স্বাভাবিক। ইংরেজ ঐতিহাসিকদের কল্যাণে তোমরা আজ এদের চেনো ফিনিশিয়ান বলে। প্রাচীন পৃথিবী এদের পাণি নামেই চিনতো।’’
ঠিক! মনে পড়লো, শরদিন্দুবাবুর লেখায় নামটা পড়েছিলাম...
‘‘তারপর?’’ অপ্রত্যাশিত প্রশ্নটা এলো সুমিত্রাবৌদির কাছ থেকে।
অমৃতদা একবার তাকালো বৌদির দিকে। চায়ে শেষ চুমুকটা দিলো। তারপর আবার বলতে আরম্ভ করলো... ‘‘নিয়মিত সমুদ্রযাত্রার ফলে সমুদ্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলো তাদের। তারপর হঠাৎ একদিন কোনও এক ঘটনা বা দুর্ঘটনার মাধ্যমে তারা আবিষ্কার করলো, কৃষ্ণবর্ণ তেলের যে মতন পদার্থটিকে মাঝে মাঝেই জলের উপর ভেসে থাকতে দেখা যায়, সেটি অত্যন্ত দাহ্য... এবং জ্বালানি হিসেবে তুলনাহীন।’’
‘‘পেট্রোলিয়ম!’’ আমার মুখ দিয়ে আপনা থেকেই বেরিয়ে এলো। সুমিত্রাবৌদিও ততক্ষণে খাবার-টাবার রেখে এসে সোফায় বসে পড়েছে।
‘‘হুঁ।’’ মাথা নাড়লো অমৃতদা। ‘‘পেট্রোলিয়ম আবিষ্কৃত হলো। বাট দ্যাট ওয়াজ ওনলি হাফ দ্য জব। জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করতে হলে প্রভূত পরিমাণে পেট্রোলিয়ম সমুদ্র থেকে তুলে আনতে হবে। সেই প্রাচীন যুগে কোনওরকম কম্বাসশন ইঞ্জিন প্রযুক্তি ছাড়া সমুদ্র থেকে খনিজ পেট্রোলিয়ম তুলতে যে বিপুল জনবলের প্রয়োজন ছিলো, সেরকম ম্যানপাওয়ার পাণিদের ছিলো না।’’
অমৃতদা থামলো। সিগারেটে শেষ টানটা দিয়ে অ্যাশট্রেতে ঘষে নেভালো। আমার মুখ দিয়ে আপনিই বেরলো, ‘‘তাহলে?’’
‘‘ওই তাহলেটাই আসল। ওইখানেই ভারতীয় পুরাণ।’’
অমৃতদার মুখ দেখে মনে হলো আমাদের উৎকন্ঠাটা বেশ উপভোগ করছে। এসব ক্ষেত্রে আমার ধৈর্য ধরার অভ্যাস থাকলেও বৌদি কিন্তু ব্যস্ত মানুষ। রাতের খাবার-টাবার গরম করতে হবে। টিভিতে কোনও আকর্ষণ থাকাও বিচিত্র নয়। তা ছাড়া, এই একটাই মানুষ যে প্রোফেসর সাহেবের মেজাজ-মর্জির ধার কোনওদিন ধারে না। তাই বৌদি যখন প্রায় মুখ-ঝামটা দিয়ে বলে উঠলো ‘‘বলো না তাড়াতাড়ি! আমার এখন হাঁ করে বসে থাকলে চলবে?’’ তখন অমৃতদা খালি একবার গলা খাঁকরে বলতে আরম্ভ করলো...
‘‘পাণিরা উপলব্ধি করলো এই নতুন জ্বালানি তেলের বিপুল সম্ভাবনার কথা... এবং এও বুঝলো যে, তাদের একার দমে বস্তুটা সমুদ্র থেকে আহরণ করা যাবে না। আরও অনেক লোক লাগবে। তাই তারা ফন্দি আঁটলো। অতি কুটিল ফন্দি।’’
‘‘কিরকম?’’ এমন গল্পে এইটুকু রেসপন্স না দেওয়াটা কথকের অপমান... বিশেষত কথক যেখানে নিজেই গল্পকার।
অমৃতদা আবার ফস করে একটা সিগারেট ধরালো। বৌদির ভুরু কুঁচকে উঠলেও কিছু বললো না। জানে, এখন ব্যাগড়া দিলে পাগলা প্রোফেসর বেঁকে বসতে পারে। তাই অমৃতদা আয়েস করে সিগারেটে টান দিয়ে আবার শুরু করলো... ‘‘এদের উত্তর-পূর্ব সীমান্তের প্রতিবেশী ছিলো আসিরীয়রা। নরমে গরমে সম্পর্ক। মাঝেমধ্যে ছোটখাটো যুদ্ধবিগ্রহ হলেও সেই সময়ে মোটামুটি শান্তি বজায় ছিলো। তা ছাড়া, আসিরীয়রা যন্ত্রপাতি বানাতে দক্ষ। তাদের স্থাপত্য আর কারিগরিবিদ্যা এদের চাইতে উন্নত। তাই, তাদের টেকনোলজিকাল সাপোর্ট পেলে কাজটা অনেক সহজও হয়ে যায়। কিন্তু তাতে একটাই সমস্যা।’’
‘‘কি সমস্যা?’’ কয়েক সেকেন্ড নীরবতার পর বৌদির প্রশ্ন।
‘‘শত্রুর শক্তিবৃদ্ধির চিরকালীন সমস্যা। এই শক্তিশালী জ্বালানি যেমন পাণিদের অর্থনৈতিক আর সামরিক শক্তি বাড়াবে, তেমনি আসিরীয়দেরও বাড়াবে। এমনিতে আসিরীয়রা শান্তিপ্রিয়, ফূর্তিবাজ জাত। পাণিদের মতন মারকুটে, কুচুটে নয়। সহজ সরল লোক। কিন্তু এই মহাস্ত্র হাতে পেলে তাদের প্রতিভাবান ইঞ্জিনিয়াররা কি কাণ্ড করে ফেলবে, কে জানে! তাই, বস্তুটা আহরণ করার জন্য তাদের সাহায্য ব্যবহার করা হলেও, কোনওমতেই তাদের এর ভাগ দেওয়া চলবে না।’’
ততক্ষণে আমার মাথায় একটা বাল্ব জ্বলে উঠেছে! এ তো... কিন্তু না! প্রোফেসর সাহেবকে গল্প শেষ করতে দিতে হবে। রসভঙ্গ করা চলবে না। তাই শুধু বললাম, ‘‘তারপর?’’
‘‘তারপর ফন্দি... এবং তার এগ্জিকিউশন। নতুন জ্বালানির লোভ দেখিয়ে সোজা-সরল আসিরীয়দের কাজে লাগানো... পসিব্লি ফর দ্য ফার্স্ট ট্রু ইন্টারন্যাশনাল কোল্যাবোরেশন অফ দ্য ওয়ার্ল্ড... এবং বিশ্বের প্রথম মেরিন পেট্রোলিয়ম মাইনিং।’’
‘‘তারপর?’’ সুমিত্রাবৌদির গলায় অবিমিশ্র কৌতূহল।
অমৃতদা মুচকি হেসে আমার দিকে তাকালো, আর আমার মুখ থেকে আপনিই বেরিয়ে এলো... ‘‘সমুদ্রমন্থন!’’
বৌদি চমকে তাকালো আমার দিকে। ‘‘সমুদ্রমন্...!’’ তারপর আবার ঘুরে তাকালো অমৃতদার দিকে। ‘‘মানে?’’
‘‘মানে ভারতীয় পুরাণ। এরকম আরও কত যে প্রাচীন ঘটনার স্মৃতি লুকিয়ে রেখেছে অ্যাপ্যারেন্টলি অ্যাবসার্ড গল্পগুলোর পিছনে, কে তার হিসেব রাখে?’’
‘‘সে তো বুঝলাম।’’ বৌদির আকুল প্রশ্ন... ‘‘কিন্তু ওইসব মন্দার পর্বত, বাসুকি নাগ, কূর্ম অবতার, নীলকন্ঠ, মোহিনী... ওগুলো তাহলে কি?’’
অমৃতদা মুচকি হাসলো। ‘‘ওগুলো হলো গিল্ট ঢাকার উপকরণ। এমন একটা মোক্ষম ধোঁকাবাজি ঢাকা দেওয়া কি চাট্টিখানি কথা? ঢাকা পড়েওনি। আজকালকার বাচ্চারা আর কেউ সমুদ্রমন্থনের গল্প পড়ে কি না জানি না, কিন্তু আমাদের সময় যারা পড়তো, তারা সবাই প্রথমবার প্রশ্নটা করতোই... কেন দেবতারা এরকমভাবে ঠকালো অসুরদের? ভ্যালিড প্রশ্ন। ওই সব অ্যাস্টনিশিং গল্পগাছার উদ্দেশ্যই প্রশ্নটাকে যুগ যুগ ধরে ডিস্ট্র্যাক্ট করা। তবে ওই মোহিনীর গল্পটার মধ্যে খানিকটা সারবত্তা থাকলেও থাকতে পারে।’’
‘‘কিরকম?’’ ইন্টেরেস্টিং ব্যাপার মনে হচ্ছে!
অমৃতদা সিগারেট নেভালো। ‘‘যেমন বললাম, আসিরীয়রা চিরকাল হ্যাপি-গো-লাকি, ফূর্তিবাজ জাত। প্যাঁচঘোঁচ বোঝে না। তাই পেট্রোলিয়ম তোলার সাকসেস সেলিব্রেশনের পার্টিতে অপর্যাপ্ত মদ-মাংস-মেয়েমানুষে ডুবে থাকা লোকগুলো টেরও পেলো না যে পাণিরা আসলি মাল তাদের নাগালের বাইরে সরিয়ে ফেলছে। জনাকয়েক হয়তো ফক্কিকারিটা ধরে ফেলেছিলো... কিন্তু তাদের ওই, ঘ্যাঁচাং!’’ হাত দিয়ে গলা কাটার ভঙ্গি করলো অমৃতদা।
‘‘তারাই কি রাহু আর কেতু?’’ খানিকক্ষণ নিস্তাব্ধতার পর বৌদির প্রশ্ন।
‘‘কিতনি নাদান হ্যায় রে তু!’’ বলে বৌদির চিবুকটা একটু নেড়ে দিয়েই সুড়ুৎ করে ঘরে ঢুকে পড়লো ইতিহাসের দুঁদে অধ্যাপক, আমার চলতা-ফিরতা পুরাণপিডিয়া প্রোফেসর অমৃত অধিকারী।
সৌম্য'র মন্থনামৃতম পড়তে পড়তে প্রেমেন মিত্তিরের ঘনাদা মনে পড়ে যাচ্ছিল। লেখার স্টাইল পাঠককে আটকে রাখবে শেষ না হওয়া অবধি।
ReplyDeleteরমাপ্রসন্ন ভট্টাচার্য