0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in

ধারাবাহিক


সোয়ানার রহস্যময় মানুষ 
নন্দিনী সেনগুপ্ত 

৮ 

পাহাড়ের উপরে উচ্চতার কারণে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ে, অনেকে খাপ খাওয়াতে পারেনা হঠাৎ বদলে যাওয়া আবহাওয়ায়। ব্যাপারটা সবার জন্য একরকম নয়, তবে আবার এটাও সত্যি যে অনেকেই খুব উদ্দীপ্ত বোধ করে, ভালো বোধ করে পাহাড়ের মাথায় উঠে। ফ্রান্সেস্কোরও তেমনটাই হচ্ছিল। তার মনে হচ্ছিল যে তার শিরায় শিরায় রক্তস্রোতে যেন দোলা লেগেছে। তার চারপাশে ছড়িয়েছিটিয়ে পড়ে থাকা পাথরের স্তুপের মধ্য থেকে ফুলের গাছ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। একটু অন্য জাতের জেনটিয়ান ফুল, নীল পাপড়ি, একদম আগুনে নীলচে রং, মনে হচ্ছে যেন জ্বলে ওঠা আগুনের শিখা; কেউ যেন পরম মমতায় পাপড়িগুলোর গায়ে রঙের তুলির ছোঁয়া বুলিয়ে দিয়েছে। ফ্রান্সেস্কো প্রথমে ভেবেছিলো ফুল ছিঁড়ে নেবে, তারপর কী ভেবে আর তুললে না সে ফুল। ঝোলাটা পাশের পাথরে রেখে সে লক্ষ্য করছিলো লকলকে শিখার মত উদ্ধত ফুলের ভঙ্গিমা। পাথরের স্তুপের জঞ্জালের ফাঁকে ফাঁকে সর্বত্র সবুজ গাছ, লতাপাতা গজিয়ে উঠেছে। ঝোলাটা তুলে নিয়ে ফ্রান্সেস্কো আরও এগিয়ে যেতে লাগলো। দূর থেকে ভেসে আসছে ছাগলভেড়ার দলের ঘণ্টার আওয়াজ। এখানে কে মেষপালন করে? এই এত উঁচু পাহাড়ের মাথায়? পশুর দলটা কার? সেই হতদরিদ্র লুসিনো স্কারাবোটার কি? এই জায়গাটা যেন বাকি দুনিয়া থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন। এক অদ্ভুত প্রাগৈতিহাসিক সময় যেন এখানে থমকে থেমে আছে। 

ফ্রান্সেস্কো তার সঙ্গীকে আগেই ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছিল, কারণ ফেরবার পথটুকু সে নিজে একা চলতে চায়। পাহাড়ের এই অদ্ভুত সৌন্দর্যের মধ্যে যেন অন্য কোনো মানুষের উপস্থিতি তার সহ্য হচ্ছিলো না। তাছাড়া এখানে লুসিনোর সঙ্গে তার কাজ আছে, সেসময় অন্য কেউ উপস্থিত না থাকাই বাঞ্ছনীয়। সে চলতে চলতে দূর থেকেই লক্ষ্য করেছিল যে দূরে পাথরের স্তুপের মত দেখতে বাড়িটার দেয়ালের উপর দিয়ে উঁকিঝুঁকি মারছে শিশুর মাথা। জটপড়া, তেলবিহীন, চিরুনি না-পড়া রুক্ষ চুলওয়ালা ছোট ছোট মাথা দেখতে পাচ্ছিল সে ঐ বাড়ির কালচে দরজার কাছে পৌঁছে। দরজাটা হাট করে খোলা। সহজেই সে ঢুকে পড়ল বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে। বাড়ির উঠোন ছাগলভেড়ার নাদির গন্ধে ভারি হয়ে আছে। মাঝেমাঝে সে গন্ধ ছাপিয়ে কাঠকয়লার গন্ধ আসছে। ফ্রান্সেস্কো দরজায় দাঁড়ানোমাত্র বাচ্চাগুলো একছুটে বাড়ির ভেতরদিকে কোথাও চলে গেলো। ফ্রান্সেস্কো ঢুকতে গিয়ে দেখলো যে সামনের ঘরখানা বেজায় অন্ধকার। ফ্রান্সেস্কোর ডাকাডাকি শুনেও কেউ এলো না, বরং একটা মাদী ছাগল এসে মিহি গলায় ডাকতে শুরু করলো এবং একদুবার শুঁকে নিলো তাকে। 



ধীরে ধীরে ঘরের ভেতরের অন্ধকার তার চোখসওয়া হয়ে গেলো। সে দেখলো যে ঘর, ঘর না বলে অবশ্য সেটা গুহা বলাই সমীচীন, সেটা আসলে একটা আস্তাবল। গোবরের পুরু স্তর জমে আছে ঘরটায়। ডানদিকে পাথরের দেওয়ালের গা দিয়ে গুহা থেকে বেরিয়ে যাবার একটা পথ। সেখানে দেখা যাচ্ছে আগুন জ্বালাবার একটা পরিত্যক্ত ফায়ারপ্লেস। ছাই গাদা হয়ে পড়ে আছে, কাঠকয়লার স্তূপ পড়ে আছে পাথরের মেঝের উপর। ঝুলে ডাকা একটা শিকল থেকে কালিঝুলিমাখা একটা তামার পাত্র ঝুলতে দেখা যাচ্ছে। প্রস্তরযুগের এই ফায়ারপ্লেসের পাশে দেখা যাচ্ছে একটা কাঠের বেঞ্চ, পাথরের উপরে সমান দুটো পিলারের গায়ে আটকানো। বেঞ্চটা চওড়া, পুরু; না জানি মেষপালকদের কত প্রজন্ম, কত বাচ্চাকাচ্চা ওর উপরে বসে বসে ওটা আপনা থেকেই একটা চকচকে পালিশ নিয়ে নিয়েছে। ওটা আর দেখতে কাঠের মত নয় এখন, মনে হচ্ছে হলদে মার্বেল বা সোপস্টোনের তৈরি বেঞ্চ; তবে অনেক আঁকিবুঁকি আর আঁচড়ের দাগ আছে বেঞ্চটায়। চৌকো এই ঘর, কিংবা গুহায়, ন্যাড়া পাথরের দেয়ালগুলো বহুযুগের তেল আর ঝুলকালি লেগে কালো হয়ে আছে, কারণ দরজা ছাড়া সেভাবে ধোঁয়া বেরিয়ে যাবার কোনো চিমনি, কিম্বা ঐজাতীয় কোনো নিকাশি এখানে নেই। 



ফ্রান্সেস্কোর হঠাৎ মনে হল ঘরের অন্ধকার কোণ থেকে একজোড়া চোখের অদ্ভুত জ্বলজ্বলে দৃষ্টি তাকে লক্ষ্য করছে। কোণের দিকে ঘুরে তাকিয়ে মনে হল কে যেন দুদ্দাড় করে বাইরে বেরিয়ে গেলো। আর ঠিক তার পরেই লুসিনো স্কারাবোটা এসে ঘরে ঢুকলো। এমনভাবে সে এসে ঢুকল যেন যে প্রখর রোদ্দুরের সামনে এক নিঃসঙ্গ নিশ্চুপ ছায়া। ঘরটা যেন আরও অন্ধকার হয়ে উঠল। সে হাঁপাচ্ছিল; পাহাড়ি পথে অনেকটা দৌড়ে আসার জন্য তার দ্রুত শ্বাসের ওঠাপড়া, নাকি তরুণ যাজকের আগমনের কারণে তার উত্তেজনা, সেটা বোঝা যাচ্ছিলনা। তবে এখানে ফ্রান্সেস্কোর আগমন যে এক অভূতপূর্ব ঘটনা, তাতে সন্দেহ নেই। কারণ, এরকম ঘটনা আগে কখনো, কোনোদিন ঘটেনি। কোনো যাজক অতীতে এদিকের ধার ঘেঁষেনি। লুসিনো কী করবে ভেবে পাচ্ছিলো না। সংক্ষিপ্ত অভ্যর্থনার পরে সে ফ্রান্সেস্কোকে একরকম জোর করেই বসিয়ে দিল সেই কাঠের বেঞ্চে। বসানোর আগে তার বলিষ্ঠ, রুক্ষ হাতে বেঞ্চের উপর থেকে একঝটকায় পরিষ্কার করে দিলো ঢিল, পাথরের টুকরো, ছেঁড়া ফুলের পাপড়ি, শুকনো গাছের ডাল; হয়তো ওইসব নিয়ে বাচ্চাগুলো একটু আগেই ঐ বেঞ্চে বসে খেলা করছিল। লুসিনো তড়িঘড়ি ফায়ারপ্লেসের আগুনটা জ্বালাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। সে যেন এক ঘোরের মধ্যে কাজ করছিল। একগাদা কাঠ গুঁজে দিল আগুনে। প্রাণপণে ফুঁ দিতে শুরু করলো। এমন ধোঁয়া হল যে বসে থাকাই দায়। লুসিনো এমন ভাব করছিল যে ফ্রান্সেস্কোকে একটু খুশি করবার উপরেই যেন তার নিজের জীবনমরণ নির্ভর করছে। দৌড়ে গিয়ে নিয়ে এলো বিরাট একপাত্র দুধ। উপরে তাজা ঘন এবং পুরু সরের আস্তরণ থাকলেও পাত্রটার নোংরা চেহারা দেখে ফ্রান্সেস্কোর দুধ খাওয়ার ইচ্ছে উবে গেলো। সে দুধ স্পর্শ পর্যন্ত করলনা। এমনকি লুসিনোর নিয়ে আসা তাজা চীজ আর রুটিও একফোঁটা দাঁতে কাটলোনা সে। তাঁর মাথায় ছিল যে পাপীর অন্নগ্রহণ করা একেবারেই অনুচিত। স্বভাবগত সংস্কারের জন্যই ক্ষুধার্ত এবং তৃষ্ণার্ত হওয়া সত্ত্বেও লুসিনোর দেওয়া খাবার খেতে পারলো না সে। যাই হোক, এইসব নানা ব্যস্ততা এবং আতিথেয়তা দেখিয়ে অবশেষে যখন লুসিনো একটু ক্ষান্ত হল, তখন ধীরেসুস্থে ফ্রান্সেস্কো কথা বলতে শুরু করলো। 

- ‘লুসিনো, আপনি আমাদের চার্চের কৃপাদৃষ্টি থেকে বঞ্চিত হবেন না এবং আপনার বাচ্চারাও ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের কাছে আর একঘরে হয়ে থাকবেনা, যদি প্রমাণিত হয় যে আপনার সম্বন্ধে যেসব কুৎসিত কথা চারপাশে শোনা যাচ্ছে সেগুলো সব রটনামাত্র এবং সেগুলি সত্য নয়। সত্য হলেও আপনি প্রভু যীশুর কৃপা থেকে বঞ্চিত হবেন না। সেক্ষেত্রে আপনাকে প্রভুর কাছে অনুতপ্ত হৃদয়ে নিজের অপরাধ স্বীকার করতে হবে। অনুশোচনা এবং সন্তপ্ত হৃদয়ের স্বীকারোক্তির চেয়ে বড় কিছু হতে পারেনা। প্রভু যীশু আপনার সব পাপ, সব অপরাধ ক্ষমা করতে সর্বদা প্রস্তুত। তাহলে, সবার আগে প্রভুর কাছে আপনি মন খুলে নিজের সব কথা স্বীকার করবার জন্য প্রস্তুত হন, স্কারাবোটা! একমাত্র তাহলেই আপনি এই অভিশপ্ত জীবন থেকে মুক্তি পাবেন। যে বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছেন, যে অপবাদ সহ্য করে চলেছেন, সবকিছু থেকে পরম করুণাময় ঈশ্বর আপনাকে মুক্ত করবেন। প্রস্তুত হন, লুসিনো!’ 

যাজকের কথা শুনে লুসিনো চুপ করে রইলো। শুধু গলা দিয়ে কেমন অদ্ভুত একটা পাখির ডাকের মত কিচমিচ হাল্কা আওয়াজ বেরোল একবার। ফ্রান্সেস্কো ভাবছিল যে একইসঙ্গে তাঁর এটাও বলা উচিত কিনা যে প্রভু যীশুর কাছে আত্মসমর্পণ না করার ফল তাকে কতখানি ভুগতে হবে! সে ভাবছিল যে একগুঁয়েমি এবং কথা না শোনার ফল কতটা মারাত্মক হতে পারে, সেটা নিয়ে কিছু সতর্কবাণী বলবে কিনা! সে তো সবই বলেছে, বলেছে যে প্রভু যীশু সব অপরাধ ক্ষমা করতে প্রস্তুত, শুধু হৃদয়ে সমর্পণ আর অনুতাপ থাকতে হবে। এর অধিক আর কিই বা বলতে এবং করতে পারা সম্ভব তাঁর পক্ষে? 

ফ্রান্সেস্কো নীরব হয়ে রইলো অনেকক্ষণ। কোনো উত্তর না পেয়ে, অবশেষে কাঁধ ঝাঁকিয়ে যখন সে ভাবলো যে এবার উঠে পড়া যাক, তখনি লুসিনোর গলা দিয়ে নানারকম আওয়াজ বেরোতে শুরু করলো। তাঁর পিপের মত চেহারার ভেতর থেকে জড়ানোপেঁচানো নানারকমের শব্দ উঠে আসছিল। উঠে আসছিল, নাকি লোকটা উগরে দিচ্ছিল, কে বলবে সে কথা? মনে হচ্ছিল একঝাঁক পাখি ফাঁদে পড়ে নানারকম আওয়াজ করে চলেছে। তরুণ যাজকের মাথায় কোনো কথাই ঢুকছিলো না। তবুও অদম্য অধ্যবসায়ের সঙ্গে সে ঐ জড়ানোপেঁচানো দুর্বোধ্য ভাষার শব্দের জঙ্গলের মধ্য থেকে একটা একটা করে শব্দের জট ছাড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছিল। 




(চলবে) 

গেরহার্ট হাউপ্টমান রচিত ‘ড্যের কেৎজার ফন সোয়ানা’ অবলম্বনে লেখা 





0 comments: