0

প্রবন্ধ - তীর্থার্থ চট্টোপাধ্যায়

Posted in

প্রবন্ধ


প্রকৃতি ও আমরা
তীর্থার্থ চট্টোপাধ্যায়


প্রকৃতি চলে নিজের খেয়ালে। সৃষ্টির আদিকাল থেকে প্রকৃতির খেয়াল মেনে নিয়েই তৈরী হয়েছে জীববৈচিত্র – বিভিন্ন উদ্ভিদ, হরেকরকম প্রাণী। বিবর্তনের কালচক্রে পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাব ঘটার পরে এক বিশেষ অধ্যায়ের সূচনা হল। বুদ্ধিবৃত্তিতে শ্রেষ্ঠ মানুষ (যদিও এ বিষয়ে বিতর্কের যে একেবারেই অবকাশ নেই, তা নয়!) প্রকৃতির খামখেয়ালিপনাকে সহজে মেনে নিতে অস্বীকার করল। বৃষ্টি পড়লেই যে ভিজতে হবে, তা মেনে নিল না; বাসস্থানের জন্য জোর গলায় সওয়াল করল। শীত এলেই যে ঠাণ্ডায় কাঁপতে হবে, বিনা তর্কে তা মেনে না নিয়ে পোশাক তৈরী করল। শুরু হল আমাদের তথাকথিত সভ্যতার ইতিহাস, যেখানে প্রকৃতির লড়াই-এর বিজয়গাথা মানুষ সগর্বে রচনা করল। কিন্তু, দুর্ভাগ্যবশত সাফল্যের অহংকারের আড়াল দিয়ে চুপিসারে ঢুকে পড়ল লোভ! খামখেয়ালি প্রকৃতিকে গোহারা হারিয়ে মানুষ তাকে এতটাই চটিয়ে তুলল যে বেশ কিছু ক্ষেত্রে প্রকৃতি মুখ ফিরিয়ে নিল মানুষের থেকে – প্রকৃতিতে মানুষের অস্তিত্ব সঙ্কটময় হয়ে উঠল। তাই দেখে ভবিষ্যতের মানুষ আক্ষেপ করতে বাধ্য হল, তার সাথে ইতিহাসের মানুষদের দোষ দিতেও ছাড়ল না। এখানে একটা উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটা সহজবোধ্য করে তোলা প্রয়োজন।

আমরা জানি, আদিম মানুষ খাদ্য সংগ্রহের জন্য শিকার আর বনের ফলমূল সংগ্রহের ওপর নির্ভরশীল ছিল। ক্রমশ তারা শিকারের ঝুঁকি আর সারা বছর ধরে ফলমূলের সহজলভ্যতার অভাব – এই দুই বিষয়েই বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ল। অভিজ্ঞতা খরচ করে মানুষ শিখল যে ফল খেয়ে তার বীজ মাটিতে পুঁতে দিলে যে গাছ জন্মায়, তাতে ওই একই রকম ফল ধরে। তাই এবার সে গাছ থেকে ফল পেড়ে খেয়ে তার বীজ ফেলে দিল না – সাথে করে নিয়ে এসে পুঁতে দিল নিজের বাসস্থানের আশেপাশে। সংগ্রাহক মানুষ ধীরে ধীরে উৎপাদক মানুষে পরিণত হল। সময়ের সাথে সাথে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে মানুষ এও শিখল যে একই গাছের একশো ফল থেকে সংগ্রহ করা একশো বীজ থেকে যে নতুন একশো গাছ জন্মায়, তাদের সকলের ফলের স্বাদ হুবহু একরকম নয় – সামান্য তারতম্য রয়েছে। মানুষ বেছে বেছে সেই গাছের ফলই সংগ্রহ করতে শুরু করল, যার বীজ থেকে ভালো স্বাদের ফলের গাছ জন্মায়। উৎপাদক মানুষ পরিণত হল নির্বাচক মানুষে। তার নির্বাচন তার প্রয়োজন অনুযায়ী হল – প্রকৃতি নির্বাচনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতে শুরু করল। হয়তো কোনো জায়গার মাটির চরিত্র অনুযায়ী টক আমের গাছ ভালো জন্মায় – প্রাকৃতিক নির্বাচন তাই সেখানে টক আমের বীজকেই প্রাধান্য দিত। কিন্তু মানুষের প্রয়োজন তো মিষ্টি আম! অতএব টক আমের বীজ অঙ্কুরিত হবার সুযোগ পেল না – নির্বাচক মানুষের আনা মিষ্টি আমের বীজ প্রকৃতিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সেখানে প্রাধান্য পেল। জংলী উদ্ভিদ ও প্রাণীসম্পদকে এভাবে আমরা পোষ মানাতে শুরু করলাম। জংলী মানুষ চাষবাস শুরু করল। মানুষের চাহিদা মেটাতে পারে এমন সব গাছ, শস্য, ফল, ফুলকে মানুষ পোষ মানিয়ে গৃহপালিত করে তুলতে লাগল – আর অধিকাংশ উদ্ভিদ ও প্রাণীসম্পদ অবশ্যম্ভাবী বিলুপ্তির পথে পা বাড়াল। ইতিহাসের মানুষ জেনে বা না জেনে তার তোয়াক্কাই করল না! তথাকথিত অসভ্য, অবাধ্য এই উদ্ভিদ ও প্রাণীসম্পদের মধ্যে কিন্তু এমন কিছু গুণ ছিল, যা ভবিষ্যতের মানুষের বিশেষ কাজে লাগতে পারত। যেমন, মোটা চালের ধানগাছ শৌখিন ও ভোজনরসিক মানুষের কাছে প্রাধান্য না পেলেও তার খরা সহ্য করার ক্ষমতা কিন্তু মানুষের কাছে উপযোগী। কিন্তু ইতিহাসের মানুষ হয়তো ভবিষ্যতের এই পরিবর্তিত জলবায়ু সম্পর্কে উদাসীন ছিল। তাই মোটা চালের ধানের প্রজাতির সাথে সাথে তার এই খরা সহ্য করার গুণটিকেও আমরা বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচাতে পারলাম না। মানুষের নিজস্ব চাহিদা পূরণের লোভের কাছে লাঞ্ছিত হয়ে অভিমানী প্রকৃতি নিঃশব্দে তার বৈচিত্রের পসরা গুটিয়ে নিল। আজ বহুদিন পরে আমাদের বোধোদয় হয়েছে। সৌভাগ্যের বিষয় এই যে দেরীতে হলেও আমরা জীববৈচিত্র সংরক্ষণে বিশেষ মনোযোগ দিয়েছি। তবে দুর্ভাগ্যের বিষয় হল, মানুষের কাছে লাঞ্ছিত প্রকৃতি সবসময়ই যে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে, তেমনটা নয়। বেশ কিছু ক্ষেত্রে সে নিঃশব্দে প্রতিবাদ করেছে। পরবর্তীকালে সেই নৈঃশব্দের অনুনাদে মানুষের অস্তিত্ব কেঁপে উঠেছে। এমনই একটা উদাহরণ এখানে তুলে ধরা যাক।

আগাছা বলতে আমরা অবাঞ্ছিত গাছ বুঝি। ফসলের ক্ষেতে এই আগাছা মূল ফসলের জন্য প্রাপ্য সূর্যালোক ও মাটির উর্বরতায় ভাগ বসায়। স্বভাবতঃই, সঠিক সময়ে আগাছা নিয়ন্ত্রণকরতে না পারলে ফসলের উৎপাদন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রকৃতির খেয়ালে এই আগাছাদের আবার ‘কই মাছে’র প্রাণ’ – প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও টিঁকে থাকার প্রশ্নে আমাদের পোষ মানানো সভ্য ফসলের তুলনায় আগাছা বেশ কয়েক মাইল এগিয়ে! তাই আগাছা নিয়ন্ত্রণ শুধু জটিলই নয়, বেশ শ্রমসাপেক্ষ ও ব্যয়সাপেক্ষ। হাত দিয়ে বেছে উপড়ে সমূলে বিনাশ করাই এর সবচেয়ে ভালো দাওয়াই। তবে দক্ষ কৃষিশ্রমিকের অভাব এবং দর, এই দুই কারণেই আগাছা নিয়ন্ত্রণ চাষির বিশেষ মাথাব্যথার কারণ হয়ে ওঠে। উর্বর মানবমস্তিস্ক অবশ্য কিছুদিনের মধ্যেই এর একটা সহজ উপায় বের করে ফেললো। এমন কিছু রাসায়নিক আবিষ্কৃত হল যা আগাছা মেরে ফেলতে সক্ষম। সঠিক সময়ে সঠিক মাত্রায় এইসব রাসায়নিক আগাছানাশী ছড়িয়ে দিলে তারা নির্বিচারে সমস্ত আগাছা মেরে ফেলতে ওস্তাদ। তবে সমস্যা অন্য জায়গায়। ঠিক যে নীতিতে ভর করে আগাছানাশী রাসায়নিক আগাছা মেরে ফেলে, সেই একই নীতিতে সে আমাদের পোষ-মানানো ফসলকেও মেরে ফেলতে পারে। অতএব উপায়? খোদার ওপর খোদকারী করে, জীবপ্রযুক্তিবিদ্যার নিখুঁত প্রয়োগের মাধ্যমে আমরা এমন কিছু ফসল বানালাম যাদের ওপরে এই আগাছানাশী রাসায়নিকের কোনো প্রভাব পড়ে না। আবার মানুষের কাছে প্রকৃতি পরাজিত হল। তবে প্রকৃতি এবার চুপ করে বসে থাকলো না। আগেই বলেছি যে পরিবর্তিত প্রতিকূল পরিস্থিতিতে টিঁকে থাকার ক্ষমতায় আগাছার জুড়ি মেলা ভার। প্রকৃতির খেয়ালে আগাছার মধ্যেও স্বতঃস্ফূর্ত জিনগত পরিবর্তন হামেশাই ঘটে। এমন কিছু পরিবর্তনও ঘটে, যার ফলে একটি বিশিষ্ট রাসায়নিক আগাছানাশীর কবল থেকে ওই পরিবর্তিত আগাছাটি রেহাই পেতে পারে। যতদিন রাসায়নিক আগাছানাশী আমরা ব্যবহার করিনি, ততদিন সেইসব জিন-পরিবর্তিত আগাছারা চুপিসারে আর পাঁচটা আগাছার মধ্যে মিশে ছিল। আর পাঁচটা সাধারণ আগাছার বীজের মতই তাদের বীজও অঙ্কুরিত হবার সুযোগ পাচ্ছিল। মোদ্দাকথা, আগাছার সংসারে এইসব পরিবর্তিত আগাছারা বিশেষ কেউকেটা হয়ে উঠতে পারেনি। কিন্তু যে মুহূর্তে আমরা রাসায়নিক আগাছানাশী ব্যবহার করলাম, সাধারণ আগাছারা নির্মূল হয়ে গেল - টিঁকে রইল শুধু পরিবর্তিত আগাছা। প্রাকৃতিক নির্বাচনে যে ছিল সাধারন, আগাছানাশীর মাধ্যমে আরোপ করা আমাদের কৃত্রিম নির্বাচন তাকে ‘অসাধারণ’ করে তুলল। শুধুমাত্র সেইসব ‘কেউকেটা’ আগাছারাই বেঁচে থাকার, ফুল ফোটানোর এবং বীজপ্রস্তুত করার সুযোগ পেল। ফলে পরের বারে পরিস্থিতি হয়ে উঠল ভয়ানক! দোর্দণ্ডপ্রতাপ যে আগাছার বংশ জন্মাল, রাসায়নিক আগাছানাশী তাকে মোটেই মারতে পারল না। ছিল আগাছা – হয়ে গেল রক্তবীজের বংশ! ইদানীং সমস্যা আরো গম্ভীর আকার ধারণ করেছে, কারণ বেশ কিছু আগাছা একাধিক রাসায়নিক আগাছানাশীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলছে। ফসলের ক্ষেত যদি এইসব অপ্রতিরোধ্য আগাছায়ই ভরে ওঠে তাহলে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম ‘দুধে-ভাতে’ থাকতে পারবে তো?

আজ সচেতনতা গড়ে তোলার সময় এসেছে। প্রকৃতিকে আমাদের প্রতিপক্ষ না ভেবে পরিপূরক বলে ভাবতে পারি না কি? পৃথিবী যে শুধু মানুষের জন্য নয় – এই সহজ সত্যটাকে অস্বীকার করলে মানুষেরই অস্তিত্ব যে সঙ্কটময় হয়ে ওঠে, প্রকৃতি তা বারে বারে আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছে। লোভের বাটখারা নামিয়ে দিয়ে, আসুন, আমরা প্রকৃতি ও ব্রহ্মাণ্ডের দাঁড়িপাল্লায় এক চিরন্তন সুস্থির সাম্য প্রতিষ্ঠায় ব্রতী হই।

0 comments: