0

প্রবন্ধ - সুরঞ্জন রায়

Posted in

প্রবন্ধ


পাসোলিনির সিনেমা যেন ‘গোধূলিসন্ধির নৃত্য’
সুরঞ্জন রায়


ব্রহ্মাণ্ডের প্রতিটি জ্যোতিষ্কই যেমন পরস্পরের সঙ্গে বাঁধা আছে এক উপবৃত্তাকার গাঁটছড়ায়, সে অন্তহীন যাপনের ছাপ মানুষের শিল্প-সাহিত্যকেও কখনও কখনও উতরোল করে তোলে। জানা বা অজানায় মোড়া সেই যাপনকে আমরা শিল্প-সাহিত্যে আস্বাদন করি এক স্বর্গীয় আনন্দে।

১৯২২ সালে উত্তর-পূর্ব ইতালির বোলোগনা শহরের কাছাকাছি ফ্রিউলি নামের এক গণ্ডগ্রামে জন্মেছিলেন পিয়ের পাওলো পাসোলিনি (১৯২২-১৯৭৫)। কিশোর বয়সেই শিক্ষাদীক্ষায় সমৃদ্ধ বোলোগনা-তে চলে আসেন লেখাপড়া করতে। পড়াশোনার পাশাপাশি চলতে থাকে কবিতা ও গল্প লেখার চর্চা। আংশিক সময়ের শিক্ষকতার কাজ করতে করতেই তিনি জড়িয়ে পড়লেন সমকামী এক কেচ্ছায়, খোয়ালেন চাকরিটি, কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ থেকেও বরখাস্ত হলেন— ঝামেলা গড়াল আদালত পর্যন্ত। ফলে ১৯৫১ সালে তিনি রোমের পথে পা বাড়ালেন, রোজগারের আশায় চিত্রনাট্য লেখায় মনোযোগী হয়ে উঠলেন। প্রথম উপন্যাস ‘চিলড্রেন অব লাইফ’ প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হলেন। এই উপন্যাসের সুবাদেই তিনি সমর্থ হলেন ইতালির সুপ্রতিষ্ঠিত পরিচালক মাউরো বোলগনিনির সান্নিধ্য লাভেও। ১৯৫৭ সালে পরিচালক ‘দ্য ইয়াং কাপল’ ছবিটির চিত্রনাট্য লেখার দায়িত্ব দিলেন পাসোলিনিকে। এই সময়েই পাসোলিনি তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘গ্রামশিস অ্যাশেজ’-এর জন্য জনপ্রিয় এক পুরস্কারে ভূষিত হলেন। এ বার ইতালির লব্ধপ্রতিষ্ঠ পরিচালক ফেদেরিকো ফেলিনির কাছ থেকে ডাক এল পাসোলিনির কাছে— ‘নাইটস অব ক্যাবিরিয়া’র চিত্রনাট্য লেখার কাজে মনোনিবেশ করলেন। অবসর সময়ে পাসোলিনি ঘুরে বেড়াতেন রোমের দারিদ্রলাঞ্ছিত বস্তি-জীবনের আনাচে-কানাচে। যার ছাপ স্পষ্ট আঁকা আছে তাঁর সৃষ্টিকর্মে। ১৯৫৯ সালে ‘চিলড্রেন অব লাইফ’ অবলম্বনে লিখলেন ‘আ নাইট অব অডাসিটি’র চিত্রনাট্য, পরিচালক সেই বোলগনিনি। ১৯৬০ সালে বোলগনিনির নির্দেশে মোরাভিয়ার ‘রোমান টেলস’ অবলম্বনে পাসোলিনি লিখলেন ‘আ ফুলিশ ডে’র চিত্রনাট্য। ছবিটি এক দিকে যেমন দর্শকদের সাধুবাদ পেল, অন্য দিকে তেমনই পেল বিদগ্ধজনের বাহবাও। ক্রমে পাসোলিনি হয়ে উঠলেন ইতালীয় সিনেমার এক গুরুত্বপূর্ণ মুখ। এই বছরেই ভিতালিয়ানো ব্র্যানকাতির উপন্যাসকে ভিত্তি করে গড়ে উঠল ‘আন্তোনিয়নি, দ্য গ্রেট লাভার’-এর চিত্রনাট্য। ব্র্যানকাতির উপন্যাসে ফ্যাসিবাদের মুখ স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল, কিন্তু পাসোলিনি তাঁর চিত্রনাট্যে সমসময়ের সমাজজীবনে এই ফ্যাসিবাদেরই ফল্গুধারা ব্যক্তিজীবনে কী ভাবে মর্মান্তিক পরিণতি ডেকে আনছে, তারই ট্র্যাজিক চেহারাটা আমাদের সামনে ফুটিয়ে তুলেছেন। বোলগনিনি ও পাসোলিনি একসঙ্গে কাজ করতে করতেই এক সময় অনুভব করলেন তাঁদের মানসজগতের ভিন্নতা, তাই দুজনেই দুজনের থেকে সরে আসাকেই শ্রেয় বলে অনুভব করলেন।

সর্বহারাদের বিপর্যয় পাসোলিনিকে বিচলিত করেছে বরাবর। মার্ক্সবাদকে তিনি আবেগ দিয়ে গ্রহণ করেননি, করেছিলেন মেধা দিয়ে। এই মেধার শিকড় চারিয়ে গিয়েছিল তাঁর সত্তার গভীরে। বামপন্থী মতাদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন পাসোলিনি। ১৯৭৫ সালে নৃশংস ভাবে খুন হয়ে যাওয়ার আগে পর্যন্ত টলেনি মার্ক্সবাদে তাঁর আস্থা। ১৯৬১ সালে নিজের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে এগিয়ে আসেন তিনি। অর্থনৈতিক দিক দিয়ে বিপন্ন রোমের নিচুতলার মানুষদের নিয়ে গড়ে তোলা তাঁর চলচ্চিত্র ‘আকাটোনে’ ও ‘মাম্মা রোমা’ থেকেই স্পষ্ট হয়ে উঠল তাঁর আলাদা পথে চলার ধরন। এর পরে দুটো শর্ট ফিল্ম বানানোর পর ১৯৬৪ সালে তিনি বানালেন তাঁর বিতর্কিত ছবি ‘গসপেল অ্যাকর্ডিং টু সেন্ট ম্যাথু’ (ইন দি আই অব আ কমিউনিস্ট)। বহু সমালোচকই ভুল ভাবে ছবিটিকে ক্যাথলিক-মার্ক্সিস্ট আখ্যায় ভূষিত করলেন। আসলে সাধারণ নিপীড়িত মানুষের কাছে যিশু যে সর্বরোগহর পয়গম্বর হিসেবেই বিবেচিত হয়েছিলেন, সেটাকেই তিনি ছবিতে তুলে ধরেছেন।

তরুণ বয়সে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ খারিজ হয়ে গেলেও থিসিস-অ্যান্টিথিসিস-সিন্থেসিস’এর স্বপ্নে বিভোর পাসোলিনির কবিতা-উপন্যাস-চিত্রনাট্যে যেমন তার ছায়া দেখা দিল প্রগাঢ় ভাবে, তেমনি তাঁর সিনেমাতেও ঘনিয়ে উঠল এর সুর। আমাদের ছাত্রাবস্থায় সাউথ ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটির ব্যবস্থাপনায় পাসোলিনির প্রথম দিকের ছবি ‘গসপেল অ্যাকর্ডিং টু সেন্ট ম্যাথু’ দেখানোর আয়োজন করা হয়। সরলা রায় মেমোরিয়াল হলে সে দিন তিলধারণের জায়গা ছিল না। উপস্থিত বহু বিশিষ্টজনের মধ্যে উত্তমকুমার ও সুপ্রিয়া দেবীও এসেছিলেন ছবি দেখতে। এ ছবির লোকেশন বাছা হয়েছিল ধূলিমলিন মরক্কোর গ্রামেগঞ্জে। নিষ্করুণ দারিদ্রের চেহারাটা ফুটে উঠেছিল সিনেমার পর্দায়। মির‌্যাক্‌লের ঘনঘটায় দর্শকদের কিন্তু ধৈর্যচ্যুতি ঘটছিল। বিশেষত যখন এক খঞ্জ মানুষ লাঠিতে ভর দিয়ে যিশুর করুণা লাভের আশায় পয়গম্বরের সন্নিকটে জায়গা করে বসে পড়ল, এবং‌ কিছু সময়ের মধ্যেই সেই করুণাঘন মানুষটির নির্দেশে লাঠি ছাড়াই সেই ব্যক্তি স্বাভাবিক ভাবে হাঁটতে হাঁটতেই নিজ কর্মবৃত্তে ফিরে গেল। বেশির ভাগ অপরিণতবুদ্ধি দর্শকও আসন ছেড়ে হল থেকে বেরিয়ে পড়ল। শুধু আমাদের মতো দু-চার জন দর্শক বাঙালির সম্মান বাঁচানোর দায়ে ছবিটা শেষ পর্যন্ত দেখতে বসে রইলাম। আজ জীবন-সায়াহ্নে পৌঁছে অনুভব করি, পরিচালক সেই লো-অ্যাঙ্গল শটগুলোর মধ্য দিয়ে যিশুর প্রবল ব্যক্তিত্বের যে ছবি এঁকেছিলেন, আজও তা ভুলতে পারিনি।

প্রাচীন গসপেলগুলোর মধ্যে উচ্চারিত হয়েছে ধনীর প্রতি তীব্র ঘৃণা। সেন্ট ম্যাথুর ভাষায়, যিশু বলেছেন, ‘আমি পৃথিবীতে এসেছি আগুন দিতে... তোমরা কি ভাবছ আমি পৃথিবীতে শান্তি বিলাতে এসেছি? আমি বলছি, না! আমি এসেছি বিরোধ সৃষ্টি করতে। এর পর থেকে এক ধনী পরিবারের পাঁচ ব্যক্তিও দ্বিধাবিভক্ত হবে— হয় তিনের বিরুদ্ধে দুই, নাহয় দুইয়ের বিরুদ্ধে তিন।’ (ম্যাথু, ২৪:২৬) লুক-এর সমাচারে একে সংক্ষিপ্ত করা হলেও তীব্রতা বেড়েছে: ‘ভেবো না আমি পৃথিবীতে প্রেম বিলাইতে আসিয়াছি। প্রেম বিলাইতে আসি নাই আমি, আসিয়াছি তরবারি দিতে।’ (লুক, ১২:৪৯) আর এই জন্যই পাসোলিনি তাঁর ছবির দৃশ্য গ্রহণের জন্য বেছে নিয়েছিলেন দারিদ্রলাঞ্ছিত মরক্কোকেই। আর শিল্পীর মনে হয়েছিল, যিশু সর্বহারাদের শামিল করতে চেয়েছিলেন লোভী কুচক্রী ধনীদের বিরুদ্ধে।

‘গসপেল অ্যাকর্ডিং টু সেন্ট ম্যাথু’-র পর ১৯৬৭ সালে তিনি তাঁর শুটিং ইউনিট নিয়ে আবার চলে এলেন মরক্কোয়। সোফোক্লিসের ‘অয়দিপাউস’ নাটকটি কেন্দ্রে থাকলেও পাসোলিনি তাঁর ছবি ‘অয়দিপাউস রেক্স’-এ কোনও কোনও জায়গায় নিজ আদর্শ অনুযায়ী রূপান্তর ঘটিয়েছেন। যেমন গ্রিসের রাজপ্রাসাদের জায়গায় এসেছে মরক্কোর ধূলিমলিন গ্রাম্য জনজাতির আবাসস্থল। আর অয়দিপাউসের বাবা পলিবাস এখানে রাজা নয়, এক সামান্য সৈনিক। ছবিতে অয়দিপাউস অ্যাপোলোর মন্দিরে এসে দৈববাণী শুনতে পায়নি,শুনেছে পথচলতি এক দরিদ্র গণকের কাছ থেকে। গ্রিক নাটকের ভাগ্যবিড়ম্বিত নায়ক পাসোলিনির সিনেমায় হয়ে উঠেছে ক্রোধতাড়িত, জীবনের বিশ্লেষণে অক্ষম এক দুর্বল মানুষ। আর সেই জন্যই সে মেনে নিয়েছে তার অন্ধত্ব। ছবির শেষে এই অন্ধ মানুষটি এক তরুণ সঙ্গীর কাঁধে ভর দিয়ে চলে এসেছে উত্তর ইতালির এক শিল্পাঞ্চলে। আর শেষ দৃশ্যে সে এসে পড়ে শ্যামশষ্পে ঘেরা তার জন্মস্থানেই— সম্পূর্ণ হয় তার জীবনবৃত্ত।

পাসোলিনির ‘অয়দিপাউস রেক্স’ ছবিটি দেখতে দেখতে মনে ভেসে আসে জীবনানন্দ দাশের ‘গোধূলিসন্ধির নৃত্য’ কবিতাটি।

দরদালানের ভিড়— পৃথিবীর শেষে
যেইখানে প’ড়ে আছে— শব্দহীন— ভাঙা
সেইখানে উঁচু উঁচু হরিতকী গাছের পিছনে
হেমন্তের বিকেলের সূর্য গোল— রাঙা—

চুপে চুপে ডুবে যায়— জ্যোৎস্নায়।
পিপুলের গাছে ব’সে পেঁচা শুধু একা
চেয়ে দ্যাখে; সোনার বলের মতো সূর্য আর
রূপার ডিবের মতো চাঁদের বিখ্যাত মুখ দেখা।

হরিতকী শাখাদের নীচে যেন হীরের স্ফুলিঙ্গ
আর স্ফটিকের মতো শাদা জলের উল্লাস;
নৃমুণ্ডের আবছায়া— নিস্তব্ধতা—
বাদামী পাতার ঘ্রাণ— মধুকূপী ঘাস।

কয়েকটি নারী যেন ঈশ্বরীর মতো:
পুরুষ তাদের: কৃতকর্ম নবীন;
খোঁপার ভিতরে চুলে: নরকের নবজাত মেঘ,
পায়ের ভঙ্গির নিচে হঙকঙের তৃণ।

সেখানে গোপন জল ম্লান হয়ে হীরে হয় ফের,
পাতাদের উৎসরণে কোনো শব্দ নাই;
তবু তারা টের পায় কামানের স্থবির গর্জনে
বিনষ্ট হতেছে সাংহাই।

সেইখানে যূথচারী কয়েকটি নারী
ঘনিষ্ঠ চাঁদের নিচে চোখ আর চুলের সংকেতে
মেধাবিনী; দেশ আর বিদেশের পুরুষেরা
যুদ্ধ আর বাণিজ্যের রক্তে আর উঠিবে না মেতে।

প্রগাঢ় চুম্বন ক্রমে টানিতেছে তাহাদের
তুলোর বালিশে মাথা রেখে আর মানবীয় ঘুমে
স্বাদ নেই; এই নিচু পৃথিবীর মাঠের তরঙ্গ দিয়ে
ওই চূর্ণ ভূখণ্ডের বাতাসে— বরুণে

ক্রূর পথ নিয়ে যায় হরিতকী বনে— জ্যোৎস্নায়।
যুদ্ধ আর বাণিজ্যের বেলোয়ারি রৌদ্রের দিন
শেষ হ’য়ে গেছে সব; বিনুনিতে নরকের নির্বচন মেঘ,
পায়ের ভঙ্গির নিচে বৃশ্চিক-কর্কট-তুলা-মীন।

‘পৃথিবীর শেষে’ পড়ে আছে শব্দহীন ভাঙা দরদালানের ভিড়, আর সেখানে হরিতকী গাছের পেছনে ডুবে যাচ্ছে রাঙা গোল সূর্য, চুপে চুপে জ্যোৎস্নার মধ্যে। প্রায় পিথাগোরাসের ঢঙে গড়ে তোলা এই ছবিটি মোটেই অস্পষ্ট বা ঝাপসা নয়। একদিন পাসোলিনি মাতৃতান্ত্রিক সমাজকে নিয়ে গড়ে ওঠা গ্রিক উপকথা থেকে নেওয়া ‘অয়দিপাউস’ নাটককে বিষয়বস্তু করেই গড়ে তুললেন তাঁর সিনেমা, তবে লোকেশন হিসেবে বেছে নিলেন মরুভূমির প্রান্ত-প্রত্যন্তকেই। তাই সিনেমাটি চলে আসে কবিতার আরও কাছাকাছি। কবিতায় হেমন্তের বিকেলের সূর্যাস্ত বলে দিচ্ছে, জ্যোৎস্না এখনও গাঢ় হয়নি। এই সরল ছবিটি যে কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়ে উঠবে সভ্যতার অবক্ষয়, ধ্বংস ও জীর্ণতার প্রতীক, তা আমাদের চোখ এড়িয়ে যায়— হয়তো একটু অস্বস্তি অনুভব করি কেবল। কবিতাটি ভালো করে পড়লে দেখতে পাই, এখানে সূর্য হয়ে উঠেছে মানবসভ্যতার প্রতীক, আর চাঁদ যেন ডেকে এনেছে সেই সভ্যতার অবক্ষয়কে। এখানে পেঁচা মহাকালের মতোই গ্রাসমান সভ্যতাকে অবলোকন করছে। কবিতাটির প্রেক্ষাপটে ফুটে উঠেছে এই সন্ধিকাল। ‘সুপক্ক যবের ঘ্রাণ অসহ্য বোধ’ হয়েছিল বলেই কি ছবিতে দেখি ঊষর মরুভূমিতে ক্যামেরা ট্রলি করে এগোতে থাকে— যেন আমাদের সতর্ক করতে থাকে বন্ধ্যাত্বের অভিশাপ বিষয়ে। অথচ এক দিন যুদ্ধ আর বাণিজ্যের বেলোয়ারি রৌদ্রে ঝলমল করে উঠেছিল মিশরের সাম্রাজ্যের দিন— যার একটা ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল ‘ক্লিয়োপাট্রা’ সিনেমায়— আজ কিন্তু ‘শেষ হয়ে গেছে সব’,থেমে গেছে তুরি-ভেরির নিনাদ। হিরের স্ফুলিঙ্গ আর স্ফটিকের মতো সাদা জলের উল্লাস, নৃমুণ্ডের আবছায়া জনহীন প্রান্তরে অন্ধকারকে আরও ঘনীভূত করে তোলে। এর পরেই স্টেজে নেমে আসে ঈশ্বরী নয়, ভাগ্য-প্রেরিত ঈশ্বরীর মতো কয়েকটি নারী (ইয়োকাস্তে কি?) হংকঙের মতো কোনও একটা উপনিবেশের মাটিতে শুরু হয়েছে তাদের যন্ত্রণার দিন গোনা। এই নারীদের সঙ্গী নবীন পুরুষেরা সফলতাকে আস্বাদন করতে পেরেছে (অয়দিপাউস)। কিন্তু তারা জানে না, সর্বনাশ চুপিচুপি তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। কেননা আমরা কবিতায় দেখতে পাচ্ছি, এই নারীদের খোঁপার ভিতরে চুলে নরকের নবজাত মেঘ। সর্বনাশের এই হাতছানি অয়দিপাউস তো এড়াতে পারেনি। তাই হয়তো কবিতার শেষে দেখি,প্রগাঢ় চুম্বন ক্রমেই তীব্র হয়ে উঠছে, তুলোর বালিশে মাথা রেখে আর মানবীয় ঘুমে স্বাদ নেই তাই ভাগ্যচক্র তাকে টানছে এক অবশ্যম্ভাবী নিয়তির দিকে। এই ইয়োকাস্তের বাহুলগ্ন হয়েই অয়দিপাউস বধির হয়ে রইল— শুনতে পেল না তার শহরের জনগণের যন্ত্রণার খবর।

এ প্রসঙ্গে মনে আসছে গোদারের কথা। প্রথম থেকেই পরিচালক গোদার তাঁর সিনেমার গল্পগুলোর ভিত্তি খুঁজে পাচ্ছিলেন চকিতে ছুঁয়ে যাওয়া কোনও গল্প বা নাটক থেকে। কখনও বা কারও মুখে শোনা গল্পই তাঁকে উত্তেজিত করে তুলছিল— যেন কোনও গল্পের বইয়ের পাতা ওল্টাতে তিনি পেয়ে যাচ্ছিলেন তাঁর পরবর্তী সিনেমার অবলম্বন। ‘আলফাভিল’ছবিটি দেখতে দেখতে আমাদের মনে পড়ে যায় ‘রক্তকরবী’র কথা। ধনবাদী সজ্জায় সজ্জিত এ এক চোখ-ধাঁধানো সাম্রাজ্য। ‘রক্তকরবী’র রাজার মতোই এখানকার শাসকও শোষণ করে অলক্ষ্য থেকেই। শোনা যায়, গোদার ‘রক্তকরবী’র আখ্যান শুনেছিলেন এক বন্ধুর কাছ থেকেই। কবি পাসোলিনি কি জীবনানন্দের কবিতাটি সম্পর্কে অবহিত ছিলেন? ক্লিন্টন সিলির অনুবাদ কি তাঁর নজরে এসেছিল? এ সব প্রশ্নের উত্তর আমাদের জানা নেই, তবে পাসোলিনির সিনেমার সঙ্গে জীবনানন্দের কবিতার আত্মীয়তা আর আশ্চর্য মিল আমাদের অনুভূতিকে গভীর ভাবে নাড়া দেয়... দেয় না কি?

0 comments: