0

জংলা ডায়েরি - শিবাংশু দে

Posted in

জংলা ডায়েরি
শিবাংশু দে

"... খুঁটিয়ে দেখেছি বন, বনাঞ্চল, গাছের শিখরে
যদি সে আনন্দ কিছু করে
গভীর রাত্রের খেলা যদি তাকে পায়
আমোদ বিন্যস্ত থাকে লতায় পাতায়
যদি তাকে টানে
ঐ প্রান্ত থেকে ভুল চাঁদ অন্যখানে-
তাকে পাওয়া!
কেন বা সন্ধান দেবে এলোমেলো হাওয়া?
-ইন্দ্র, ইন্দ্র, ইন্দ্রনাথ? প্রতিধ্বনি ফেরে
বিপুল অসহ্য শব্দে ভাঙে নির্জনতা।....."
(পাথর গড়িয়ে পড়ে, গাছ পড়ে বোধে- শক্তি চট্টোপাধ্যায়)

জঙ্গল কেন টানে, মানুষকে। সবাইকে তো টানেনা। শীতের রুখু জঙ্গল। পাতা ঝরে পড়ে আছে। বনস্পতিদের ডালপালা একা একা হাত বাড়িয়ে হিম হাওয়ার কাছে কিছু প্রার্থনা করে ক্লান্ত। ধুলো ওড়ে, রেঞ্জারের জিপগাড়ি কোথা থেকে কোনদিকে ছুটে যায়, তারাই জানে। কোনও ফুল নেই, তাই কোনও গন্ধও নেই। শুধু পাতা জ্বলার ধোঁয়ার গন্ধ। কারা যেন আগুন জ্বেলেছিলো, জঙ্গলে।

বর্ষাশেষের জঙ্গল ভরা যুবতী। ভেজা মাটি, সোঁদা গন্ধ, তেজি সবুজ আর ঝলসানো রোদ। বিপদে ফেলে। চরিত্র হারানোর ডাক দেয়। মানুষের মধ্যেও তো একই রকম শরীরের টান। মাটি থেকে আকাশ জুড়ে রাখিপূর্ণিমার চাঁদ। কার কাছে যাওয়া,কার থেকে পিছুটান। সব কিছু নয়, শরীরেও জোয়ার জাগায়। কাছাকাছি যদি একটা নদী থাকে তবে তো কথাই নেই।

"যাওয়াই বেশি, ফিরে আসার পথ
চেনাজানা, খুবই সহজ, কম
এখন তাই, যেদিকে চাই, ফেরারই মরসুম
না যেতে চান যদি মহম্মদ
সব সময়ে পাহাড় কাছে আসে?
নিথর পাহাড়, গৈরিকে সন্ন্যাসে
বলে, এ কি নিছক ভ্রমণ? দাঁড়াও কিংবা ফেরো
যেদিকে যাও, আমিই ভবিষ্যত।
(ভ্রমণ - শঙ্খ ঘোষ)

অনুগুল থেকে দক্ষিণের পথে ছোটে জীপগাড়ি। সেখানে ভাদ্রের জঙ্গল শরীর বিছিয়ে বহু দূর। বানতলা, শঙ্খপুর পেরোলেই টিকরপাড়া রেঞ্জের জঙ্গলমহাল। টানা গেটে ফরেস্ট গার্ড। পেরোলেই বাঁদিকে মোরমের রাস্তা চলে যায় লবঙ্গি বনের সবুজ। মাঝেমধ্যে ছোট্টো গ্রামসব। যতো এগোনো, জঙ্গল ঘন হয়ে আসে। পথ থেকে পাকদন্ডি হয়ে যায়। ঘোরানো একটি পথ উঠে যায় লবঙ্গির বনবাংলোর দিকে। সামনে তাকালেই নীচে দিয়ে রাস্তা ঘুরে চলে গেছে টাইগার রিজার্ভের পথ। আর চোখের সামনে সোজা রয়েছে পাহাড়ের পর পাহাড়। সবুজের পর সবুজ। ফুল, পাতা, নুয়ে পড়া ডাল হাতীর শুঁড়ের টানে। কাঁঠাল গাছের পাশে সতর্কবাণী, "থামো, এখানে হাতী কাঁঠাল খাইতে আসে। সাবোধান।"

থেমে গেলে আপনি আর জঙ্গলের হলেন কোথায়? নামোরাস্তায় এবড়োখেবড়ো পাথর, ঝরাপাতা আর ভাঙা ডালপালা। জীপ আছে ফরেস্টবাবুর। একপাশে কারা অনেক ডালপালা কেটে সাজিয়ে রেখেছে। অর্জুনগাছ পড়ে গেছে, শেষরাতের ঝড়। তারই সহস্রবাহুর ছিন্ন শোক। এখানে দাঁড়ানোর নয়। বনবাংলো চোখের আড়ালে চলে যায়। বনস্পতিরা আরো ঘনিষ্ঠ আশ্লেষে ঘিরে ধরে ট্রেসপাসার কয়েকজন মানুষকে।

-সার, ইধর কাল রাত হাথী আয়া থা।

-অভি নহি হ্যাঁয় না...

-লগতা নহি, থোড়া অওর যানে সে পতা চলেগা...

সবাই মৌন। শুধু চোখ ছুটে চলে। মাঝে মধ্যে বনসৃজন করেছে মানুষ, যেখানে যেখানে দাবানলে উজাড় হয়ে গিয়েছিলো বন। প্রথম জলধারাটি রাস্তার এপারওপার। জীপগাড়ি পেরিয়ে যায়। দুদিকে উছলে যায় জল। কী উজ্জ্বল, উচ্ছ্বসিত কুমারী স্রোতের হাসি। আলো কমে আসিতেছে। চারধারে আকাশছোঁয়া বনস্পতি। যতটুকু আকাশ, সেখানে বেড়াতে আসা মেঘের শ্যামল খুনসুটি।

-সার, গাড়ি অওর নহি যায়েগি...

নেমে আসি। কিন্তু পায়ে তো ভারি জুতো, এই ভেজা সোহাগি ঘাসের বন্ধহীন লেপতোশক। নাহ, খালি পা হওয়া যাবেনা। জলে ভেসে যাচ্ছে জোঁকের উপনিবেশ। তারপর একটু গভীর টানা জলের স্রোত। বাঁশের আড় ধরে পেরিয়ে যাওয়া। ওপারে লগ গেট। টাইগার রিজার্ভ, অন্দর জানা মনা হ্যায়।

-ক্যা বাত হ্যাঁয় ভাই? য়ঁহি রুকনা হ্যায় ক্যা?

-নহি সর, হম হ্যাঁয় ন.... পানি তালাও তক তো যায়েঙ্গে হি....

কিন্তু সেখানে তো পাকদন্ডিও ফুরিয়ে গেছে। শুধু সবুজ আর সবুজ। হাঁটু তক লম্বা ঘাসবন। ভারি ভারি গাছের বল্কলঘেরা জানা-অজানা স্যাপ্রোফাইট। সেগুনবৃক্ষের গোড়ার দিকে মস্ত পাতাগুলোর উপর টুপটাপ জলের ফোঁটা। গামারের ঘনপাতায় আকাশ ঢাকা গেছে। আগে আগে ফরেস্ট চৌকিদার লাঠি ঠুকতে ঠুকতে... এখানে গোখরো সাপ পায়ে পায়ে ঘোরে। কয়েকদিন আগে সে একটা শঙ্খচূড়ও দেখেছে এখানে। ওয়াচ'টাওয়ার এসে যায়। পাশেই মস্ত এক দীঘি। ঘাসবনে কয়েকটা হরিণ, দূরে। সবাইকে ঠোঁটে আঙুল দেখায়। একটু শব্দ হলেই পালিয়ে যাবে। সব গাছগুলোর উপরতলায় মানুষের পূর্বপুরুষদের লাচালাচি। হঠাৎ সব থেমে যায়। সব্বাই চুপ। হরিণগুলো ছুটতে শুরু করে। চৌকিদার বলে, সর লগতা হ্যাঁয় আসপাস মেঁ শের হ্যায়...

-কও কি হে, এতো সহজে ব্যাঘ্রদর্শন? হবেনা...

এই দীঘিটাতেই সল্টলিক করা আছে। আর জলে টইটুম্বুর। তিনচার মাইলের মধ্যে সবচেয়ে বড়ো দীঘি। সব জানোয়ারেরা আসে। চৌকিদার টাওয়ারের ল্যাচটা এঁটে দেয়। এদিক ওদ্কি দেখি। ক্যামেরার শাটার ছাড়া আর কোনও আওয়াজ নেই। আধঘন্টা এভাবেই। হঠাৎ দেখি বাঁদরেরা আবার লাফালাফি শুরু করেছে।

-সর, শের আগে সে নিকল গয়া... থোড়ি দের বাদ হমলোগ উতরেঙ্গে...

এইতো বিখ্যাত লবঙ্গির জঙ্গল। কলকাতার লোকে চোখে হারায়।

-ক্যা জি, কলকত্তা সে লোগ আতে হ্যাঁয় ইধর?

-আতে তো হ্যাঁয় সর, মগর ইতনা অন্দর নহি লাতে উনলোগোঁকো...

-তো হম লোগোঁ কো কিঁউ লেকে আয়ে ভাই, গয়েরকানুনি কাম করতে হো জি...

-নহি সর, ডি এফ ও সাব বোলে হ্যাঁয়...

(ক্রমশ)

0 comments: