0

গল্প - স্নেহাশিস ভট্টাচার্য

Posted in


গল্প

সমৃদ্ধির মা’রা
স্নেহাশিস ভট্টাচার্য


ছাদের আলসের কাছটায় আলগা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল পাখি। রাতের রান্না সেরে মাঝে মাঝে ছাদে আসতে খুব ভাল লাগে ওর। সদ্য পূর্ণিমা গেছে বোধ হয়। চাঁদটা কেমন আলগোছে ঝুলে রয়েছে সামনের ফ্ল্যাট বাড়ির ওপর। নাইটির ওপর হাউস কোট চাপিয়ে কপালের ওপর পড়তে চাওয়া চুল সরিয়ে একটা আলগা খোঁপা করে নেয় পাখি। রাজারহাটের ২৪ তলা এই ফ্ল্যাটবাড়ির ১৯ তলার বাসিন্দা ও। নিজের ফ্ল্যাটের বারান্দাই ওর সবচেয়ে প্রিয় জায়গা। তবু মাঝে মাঝে অনেক উঁচুতে উঠে একলা হবার শখ জাগে। ফ্ল্যাটের বেশীর ভাগই খালি। হাউস কোটের পকেট থেকে গোল্ড ফ্লেকের প্যাকেটটা বের করে দেখলো প্রায় পুরোটাই ভর্তি। আজ বিশেষ সময় হয়নি ধূমপানের। ডাক্তারের নিষেধে সংখ্যায় কমালেও ছেড়ে দিতে পারেনি পুরোপুরি। একটানে অনেকটা ধোঁয়া ফুসফুসে চালান করে নিজেকে কেমন রিল্যাক্সড লাগলো। আজ চাকরিতেও রেজিগনেশন জমা দিয়ে এসেছে। ট্যান্ডন অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল ওর দিকে। কোনও প্রশ্ন করার সুযোগই দেয় নি ওকে আজ পাখি। নিজের খুব অল্প বেড়ে ওঠা পেটের ওপর হাত বুলিয়ে সিগারেটটা ফেলেই দিল। নাঃ, আর খাবে না। সমৃদ্ধির কথা ভেবে ছেড়েই দেবে।

উত্তর কলকাতার উমেশ ব্যানার্জি স্ট্রীট, সরু গলি, টানা রিক্সার টুং টাং শব্দ, মেঝে থেকে ওঠা বড় জানলা। বাইরে তাকালে এক ফালি রাস্তা আর উলটো দিকের বাড়ি। একটু এগিয়ে চাপা কলে বালতির লাইন। নিঝুম কাক ডাকা দুপরে ফেরিওয়ালার হাঁক, মায়ের আচার তৈরি , বড়ি দেওয়া। পাখি এক মেয়ে বাবা মার। আটপৌরে সংসার। বাবা বেসরকারি সংস্থার অ্যাকাউন্টান্ট। ঠাকুমা রোগ শয্যায় বহু বছর। মা-ই সব করে। বাবা অফিস আর বাড়ি করে নিত্যদিন পরিশ্রান্ত। রবিবার দিনটা বাবার আর পাখির। পাখি ওই বিরাট জানলায় বসে প্রাণপণ চেষ্টা করে আকাশ দেখার। কিন্ত কখনো কখনো একফালি রোদ্দুর ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ে না। দুপুরে বাবার গা ঘেঁষে শুয়ে বিভিন্ন গল্প আর মায়ের ওই একদিন পান সাজা। ওর ভাগেও জোটে। ঠাকুমাও পাশ ফিরে শোয় ওই দিন। বাবা গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। মাকে কখনো কিছু বলতে দেখেনি পাখি। শুধু মুখ বুঁজে কাজ করে যাওয়া ছাড়া। পাখি আর পাখির পৃথিবীর চারপাশ রোজ একই স্বাদের খাবার বেড়ে দেয় পাতে। ঠাকুমা তার দীর্ঘ অবসাদ মিটিয়ে একদিন ঘর খালি করে চলে গেল। পাখির খুব অদ্ভুত লেগেছিল সবচেয়ে কষ্ট মাকে পেতে দেখে। দিন রাত এক করে অমানুষিক পরিশ্রম করতো মা। ঠাকুমার চান, খাওয়া, পটি হিসু পরিস্কার। এমনকি জ্বর হলে রাত জাগা। বহু বছর প্যারালাইসিস। তবু গঞ্জনা পাওনা ছিল মার। বাবাকে কিছু বোঝানো যায়নি। একমাত্র নাতনির সাথেও বিশেষ সখ্যতা গড়ে ওঠেনি ঠাকুমার। তবু পাখিও মনে মনে খালি জায়গাটা অনুভব করে। পাখির পড়াশোনা চলতে থাকে। সেও আপন খেয়াল বেড়ে উঠতে থাকে। উচ্চমাধ্যামিকের পর কলেজ। পাখি উত্তর কলকাতার গলি থেকে ডানা মেলতে শুরু করলো।

হাতের মোবাইলটা বেজে উঠলো। স্ক্রিনে আকাঙ্ক্ষার নম্বর। বল... কি রে নিচে আসবি না? আবার এখন ছাদে গেছিস? ...যাচ্ছি। উনিশ তলায় নেমে এল পাখি। ওয়ান রুম ফ্ল্যাট,প্রমান সাইজের একটা ঘর, সামনে বেশ সুন্দর একটা ডাইনিং কাম কিচেন। একটা ঘরের লাগোয়া ব্যালকনি। ছিমছাম আসবাব, টিভি, রেফ্রিজারেটর, মাইক্রোওয়েভ, টুকিটাকি জিনিস আর একটা সাউন্ড সিস্টেম। ব্যালকনিতে কিছু শখের গাছ লাগিয়েছে ও। ডাইনিং-এ টিভির পাশে একটা ফুলদানি। রোজ ফুল বদলানো আকাঙ্ক্ষার স্বভাব। পাখিরও খুব ভাল লাগে। আজও পাখি নেমে এসে দেখে ফুল বদলাচ্ছে আকাঙ্ক্ষা। একটু নিচু হয়ে। টি শার্টটা সামান্য উঁচু হয়ে আছে, লো ওয়েস্ট জিন্সের ওপর দিয়ে প্যান্টির সামান্য অংশ দৃশ্যমান। শরীরটা শিরশির করে ওঠে পাখির। আকাঙ্ক্ষা ওর দিকে না ফিরেই বলে ওঠে... আবার সিগারেট! পাখি কথা না বাড়িয়ে পকেট থেকে প্যাকেটটা বের করে ডাস্টবিনে ফেলে দিলো। আকাঙ্ক্ষা ওকে জড়িয়ে ধরে একটা চুমু খেয়ে বললো... লক্ষ্মী মেয়ে। কিচেনের দিকে যেতে যেতে পাখি বললো... আজ জবটা ছেড়ে দিলাম। একটা সিডি হাতে নিয়ে চালাবে বলে এগোচ্ছিল আকাঙ্ক্ষা, একটু থামলো, তারপর বলে উঠলো... সমৃদ্ধির জন্য? পাখির ছোট্ট উত্তর... হুঁ। ওর কানে গেল কি না বোঝা গেল না, মিউজিক সিস্টেমে গান বেজে উঠলো ইয়ে মোহ মোহ কে ধাগে।

কলেজ জীবন শুরু হয়ে গেল পাখির। কলকাতার অলিগলি, বইমেলা, সাউথ সিটি, আইনক্স, তবে অর্থ বাধ সাধে মাঝে মাঝেই। তাই রফা করতে হয়। মা আজও একই রকম, কথা বলে খুব কম। বাবাও তার ডিউটি করে চলেছে একইভাবে। পাখির সাথে সময় কাটানো এখন আর হয় না। বাবা বাড়ি ফিরে মার সাথেও বিশেষ গল্প করে না। টিভি দেখা আর গল্পের বই, দুইই বাবার অবসর কাটানোর সঙ্গী। মাকে পাখি সিরিয়ালও দেখতে দেখতে দেখেনি কোনোদিন। মার কাজ যেন ফুরোতেই চাইতো না। পাখি ইকনমিক্স নিয়ে পড়ছে। বাবার আয়ের কথা ভেবেই টিউটর একজনই। পাখি নিজেও টুকটাক পড়ায়। হাত খরচটা উঠে আসে। সেদিন কলেজের পিকনিক ছিল। ওরা অনেকে মিলে জোকার দিকে একটা রিসর্ট বুক করেছে। সকাল বেলায় বাসে করেই পৌঁছনো ওখানে। দারুণ হৈ হৈ। অ্যাপ্লায়েড ফিজিক্সের আকাঙ্ক্ষার সাথে পাখির বেশ ভাল আলাপ। ওরা দুজন কথা বলতে বলতে ভিতরের সুইমিং পুলের কাছে গিয়ে বসল। বাকিদের হৈ হুল্লোড় চলছে। চিকেন পকোড়া ভাজা হচ্ছে, বাকার্ডি আর ম্যাকডুয়েল অপেক্ষায়। আকাঙ্ক্ষা একটা সিগারেট ধরিয়ে পাখির দিকে বাড়িয়ে দিল। পাখি খায় না। ...আরে একদিন খেয়ে উড়িয়ে দাও।

কাঁপা হাতে সিগারেট নিয়ে সুখটান, হালকা কাশি হলেও নিকোটিনের সাথে ভালবাসার সেই শুরু। আকাঙ্ক্ষার সাথে কথা বলতে বেশ লাগে। প্রাণবন্ত। মেয়েটা ঠিক মেয়েলি নয়। স্পষ্টবাদী, হৈ চৈ করে কাটাতে চায়। স্মোক করে, ড্রিংক করে, অবশ্য প্রায় সবাই এইভাবে অভ্যস্ত। পাখির বেড়ে ওঠা ওকে আটকায়। ওর একফালি আকাশ দেখা সময়টা মাঝে মাঝে ওর রাশ টেনে ধরে। ক্রমশ আকাঙ্ক্ষা ওর জীবনে এক বিরাট জায়গা নিতে থাকে। সেদিন কলেজ থেকে বাড়ি ফিরবে, আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমেছে। পাখি বাইরের এক বন্ধ দোকানের শেডের নিচে আশ্রয় নিয়েছে। দেরি হবে বলে বাড়িতে মাকে ফোন করার জন্য মোবাইল বের করতে যাবে, ঠিক সেই সময়ে একটা ট্যাক্সি নিয়ে এসে দাঁড়ালো আকাঙ্ক্ষা। ...চল চল উঠে পড়। ...আরে তুই তো যাবি অন্য জায়গায়। ...আরে ওঠ তো! আমি আজ একটু হেদুয়ার দিকে যাবো। তোকে ছেড়ে দেবো। আকাঙ্ক্ষা আজ একটা সাদা স্লিভলেস টপ আর ডেনিম জিন্স পরে। পাখি দৌড়ে এসে দরজা খুলে ঢুকল। ট্যাক্সি চলতে শুরু করলো। ...তোকে কি সুন্দর দেখাচ্ছে রে, মনে হচ্ছে একটা চুমু খাই। পাখি একবার ওর দিকে তাকিয়ে কিছু বললো না। বাইরে বেশ জোরে বৃষ্টি নেমেছে। এক মনে বাইরের রাস্তা দেখছিল ও। আকাঙ্ক্ষা বললো... কি রে, কিছু বলবি না? পাখি একবার ওর দিকে তাকিয়ে বলল... চুমু খাওয়া নিয়ে? হাহা করে হেসে উঠল আকাঙ্ক্ষা। তারপর ওকে অবাক করে দিয়ে ওর গালে একটা চুমু এঁকে দিল। হতভম্ব পাখি কিছু বলার আগেই আকাঙ্ক্ষা ওর ভেজা ঠোঁটে নিজের ঠোঁট ডুবিয়ে দিলা। পাখির ভাল লাগছিল, এক নারী তার ভালবাসা এঁকে দিচ্ছে আর এক নারীর ঠোঁট ছুঁয়ে মনের মধ্যে... 

নিম্নচাপের বৃষ্টি
ভালবাসা উচ্চচাপ শোনায়
ওয়াইপারে ক্লান্তি জমে
উইন্ডস্ক্রীন বাষ্প জমায়...

একটা ঘোরের মধ্যে বাড়ি ফিরল পাখি। মার সাথে ওর খুব বিশেষ মনের কথা হয় না। বাবাই সব। তবু আজ রাত্রে মার কাছ ঘেঁষে শুতে ইচ্ছে করল। রাতে কিছুতেই ঘুম আসছে না ওর। জানলার কাছে বসে আকাশ দেখার চেষ্টা করতে গিয়ে দেখল, একফালি মেঘ কেটে যাওয়া জ্যোৎস্না ওদের গলিতে এসে এক্কা দোক্কা খেলছে।

আকাঙ্ক্ষা শার্টটা খুলতে খুলতে বললো... এবার কি বাড়িতে বসে মাতৃত্বের স্বাদ নেওয়া? আর কি জব করবি না? পাখি ওর দিকে তাকিয়ে কোন কথা বলে না। আকাঙ্ক্ষার গায়ে এখন একটা সুতো অবধি নেই, পাখি এক দৃষ্টে চেয়ে আছে ওর দিকে। ও চানঘরে যাবে।

দুটো দিন কলেজ গেল না পাখি। মা একবারও জিজ্ঞেস করেনি কেন। রোজের কাজ নিয়েই ব্যস্ত মা । মাঝে মাঝে মনে হয় জোর করে মাকে জিজ্ঞেস করে, তুমি কেন এরকম? বাবা সেদিন বাড়ি ফিরলো একটু যেন বেশী ক্লান্তি নিয়ে। পাখিকে পাশে বসিয়ে জানতে চাইল... তোর ফাইনাল কবে শেষ রে মা? পাখি জানালো নেক্সট ইয়ার। ...এবার তো তোর বিয়ে-থার একটা ব্যবস্থা করতে হয়। কি বলো আল্পনা? মা চা আর চিঁড়ের পোলাও বানিয়ে নিয়ে আসছিল। উত্তর এলো... পড়াটা শেষ করুক, কম্পিউটারও তো জানে, যদি নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায়। এই অবধি বলে আবার রান্নাঘরে চলে গেল। অবাক পাখি, বাবা চুপ করে বসে আছে। শুধু একবার বললো... আর তিনটে বছর পর আমারও চাকরি শেষ। ঠিক আছে মা, তুই আগে ভাল করে পরীক্ষা দে। তার পরদিনও পাখি কলেজ গেল না। মোবাইলে আকাঙ্ক্ষার তিনটে মিস কল দেখেও ফোন ধরেনি বা কল ব্যাক করেনি পাখি। বিকেল বেলা হঠাৎই স্কুটি নিয়ে হাজির আকাঙ্ক্ষা। পাখির বাড়িতে এসেই ওর কাছে এসে দাঁড়িয়ে বললো... কি রে, কলেজ আসছিস না কেন? আমার জন্য? পাখি প্রমাদ গুনলো। ...কাকিমা,একটু চা খাবো। বলে নিজেই বসে পড়লো। মা একবার ওকে দেখে খানিক বাদে লুচি আর বাটি চচ্চড়ি নিয়ে হাজির হলো। এদেশী বাড়িতে ফ্রিজে মিষ্টি থাকবেই। আকাঙ্ক্ষা নিয়েই খেতে বসলো।

পরম তৃপ্তি নিয়ে বললো… দারুণ! আরো দুটো হবে?

মাকে আজ অনেক দিন পরে হাসতে দেখলো পাখি। আরো চারটে গরম গরম লুচি আকাঙ্ক্ষার পাতে এল। ...জানো কাকিমা, খুব ক্ষিদে পেয়েছিল। মা কোনো উত্তর দিলো না। পাখি অবাক হয়ে দুজনকে দেখছে। ...চল, চল! আজ কলেজ চল। আজ এই প্রথম মা বললো... যা না। পাখির খাওয়া হয়েই গেছিল। বেরিয়ে পড়ল। স্কুটিতে উঠে আকাঙ্ক্ষা বললো ...চল, আজ একটা মুভি দেখি। পাখি না বললো না। বাকিটা একদম একটি মেয়েলি গল্পের মত। পাখির আকাঙ্ক্ষা আর আকাঙ্ক্ষার পাখি। ওরা সব নিয়মের বাধা টপকে একে অপরকে নিয়ে চলতে থাকলো। রেজাল্ট বেরোলো, আকাঙ্ক্ষা টপ করেছে। পাখিরও ভালোই রেজাল্ট হয়েছে। আকাঙ্ক্ষা আর ওর স্ট্রীম আলাদা। আকাঙ্ক্ষা প্রত্যাশা মতোই আই এস আই ক্র্যাক করেছে। চেন্নাইয়ে ইন্টারভিউ দিতে যাবে। পাখি নানান দিক ভেবে একটা আই টি কোম্পানিতে জয়েন করেছে। ঘরে বাবা নিশ্চিন্ত হলেও বিয়ে নিয়ে মাঝে মাঝেই তাড়া দিচ্ছে। মা একই ভাবে চুপ থাকে। সেদিন আকাঙ্ক্ষাকে ফ্লাইটে তুলে দিয়ে সোজা বাড়ি চলে এসেছে পাখি। অসময়ে ওকে ফিরতে দেখে মা যেন একটু হকচকিয়ে গেল আজ। পাখি একটু অবাকই হলো। মা তো, তারপর আর কিছু না ভেবে গা এলিয়ে দিল খাটে। হঠাৎই টেবিলের নিচে একটা রঙিন পুরোনো কাগজ পড়ে থাকতে দেখে কি মনে হতে ওটা নিয়ে খুলে ফেললো। অনেক পুরোন কাগজ। কিন্ত বেশ যত্নে রাখা। মাকে লেখা একটা চিঠি। এক নিঃশ্বাসে লেখাটা পড়ে ফেললো ও। তলায় নাম লেখা তোর বকুল। স্তব্ধ হয়ে বসে রইল ও। মা ঘরে ঢুকে ওকে দেখে কোনো কথা না বলে চিঠিটা ওর হাত থেকে নিয়ে নিজের কাছে রেখে দিতে দিতে বললো... আকাঙ্ক্ষার বাড়িতে জানে? 

পাখি আকাঙ্ক্ষার জন্য কফি বানিয়ে নিয়ে এলো। একটা হট প্যান্ট আর হাত কাটা টি শার্ট পরে ওর হাত থেকে কফি নিয়ে আরাম করে চুমুক দিয়ে ওকে পাশে বসালো। ...ডার্লিং, আজ তোকে দারুন সেক্সি লাগছে। মাতৃত্ব তো তোকে একদম... পাখি ওর কাঁধে মাথা দিয়ে ওর শরীরের গন্ধ নিল। ...আজ মাকে বলেছি জানিস। পাখির চুলে হাত বোলাতে বোলাতে আকাঙ্ক্ষা বললো... ভাল করেছিস। কি বললো? ...কিছুই না, শুনলো শুধু। আকাঙ্ক্ষা কফি খেয়ে বললো ...কিন্ত তুই ডিনার সেরে ফেল। আমি রাতে খাবো। আবার কাজ নিয়ে বসতে হবে। পাখি ওকে জড়িয়ে ধরে ওর ঠোঁটে ঠোঁট বসিয়ে দিল। 

আকাঙ্ক্ষার বাবা নাম করা ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট। অলিপুরে ওদের বিরাট বাড়ি। মার সাথে বনিবনা না হওয়ায় মা চলে যায়। মামার বাড়ি বালিগঞ্জ প্লেসে। মা আর বিয়ে করেনি,পারিবারিক ব্যবসা সামলে আর এন জি ও নিয়ে জীবন চালায়। মোটা অঙ্কের খোরপোষ তো এককালীন ছিলই। বাবা অনেক দিন পরে আবার বিয়ে করে। দ্বিতীয় পক্ষের এক ছেলে। বাবা আকাঙ্ক্ষার সব খরচই দেয়। আকাঙ্ক্ষা মার কাছেই থাকে। পরিবার নিয়ে ওর কোনো তাপ উত্তাপ নেই। সমকামিতা এক অতি স্বাভাবিক ব্যাপার। ও পাখির সাথেই বাকি জীবন কাটাবে। পাখির ভয় হয়, বাবাকে কিভাবে বলবে। সেইদিন রাত্রে বাবা আর একবার বিয়ের কথা তোলে। পাখি বলবে বলবে করেও বলতে পারে না। মা আঁচলে হাত মুছতে মুছতে এসে দাঁড়ায়। ...ও আর আকাঙ্ক্ষা সংসার পাততে চায়। বাবা স্তব্ধ হয়ে তাকায় ওর দিকে। মা আরো বলে ...আর সেটাই আমি চাই। পাখি বিস্মিত, হতবাক। যদিও সেদিনের বকুলের চিঠি অনেক কিছু বুঝিয়ে দিয়েছিল ওর সমকামি সত্ত্বাকে। বাবা শুধু বললো ...বেশ, তবে আমি এই ঘটনা সামাজিক ভাবে করতে পারবো না। মা বলে উঠলো ...সমাজে কে আছে বলতে পারো? সমাজ, লোক, এইসব না ভেবে মেয়েটা যাতে ভাল থাকে সেটা ভাবো। বাবা শুধু বললো ...ওরা ওদের জীবন বেছে নিক তবে। আমি বেঁচে থাকতে এই বাড়িতে ঠাঁই হবে না। মার গলার স্বর এক তীব্র ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়লো ...এই কথাটা চল্লিশ বছর আগেই বলতে পারতে। বাবা একবার তাকিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে রাস্তায় চলে গেল।

আকাঙ্ক্ষা ওকে নিয়ে সোফায় বসিয়ে দিয়েছে। বলল ...রোজ রোজ রান্না করিস না, অর্ডার করিস বাইরে। আমারও ফিরতে দেরি হয়। ডঃ চন্দ্রানী কি বলছেন? ...বলছেন এভরিথিং ইজ ফাইন। ...যাক। পাখিকে জোর করে আগে খাইয়ে শুইয়ে দিল ও। ঘরের হালকা নীল আলোয় শুয়ে ঘুম আসছে না পাখির।

সেদিন বাবা একটু রাত করে বাড়ি ঢুকলো। কারুরই আর খাওয়া জুটলো না। মায়ের জীবনে ভালবাসা ছিল তার বকুল। মা আর বকুল একে অপরের ছিল। কিন্ত অত বছর আগে কেউ শোনেনি এই কথা, কেউ বোঝেনি। অঘোরের সাথে তড়িঘড়ি বিয়ে দেওয়া হয়। কালের নিয়মে পাখিও আসে ওদের জীবনে। বাকিটা শুধুই চলে আসা। পাখি কাউকেই কিছু বলে উঠতে পারেনি। আকাঙ্ক্ষার কাউকে কিছু জবাব দেবার ছিল না। ব্যাঙ্গালোরে জব পায় ও। পাখি কলকাতা ছাড়তে পারে না। দূর থেকেই ওরা বাসা বাঁধে। পাখি ওকে চিঠি লেখে...

নিঃশব্দে তোকে ভালোবাসতে চাই
এই নিঃশব্দতায় আমি কোন প্রত্যাখ্যান খুঁজে পাই না।
আমি একাকিত্বে তোকে ভালবাসতে চাই
এই একাকিত্বে কেউ না জিতলেও আমি জিতি।

আমি দূর থেকেও তোকে আদর করতে চাই
এই দূরত্ব আমার যন্ত্রণার ঢাল হয়ে থাকে।

আমি বাতাসের বুকে তোর উদ্দেশ্যে চুমু খাই
এই বাতাস আমার ঠোঁটের থেকেও নরম বলে।

আমি তোকে স্বপ্নে জড়িয়ে ধরি
আমার স্বপ্নে তুই অশেষ।

একদিন ট্রান্সফার পায় আকাঙ্ক্ষা। রাজারহাটে ফ্ল্যাট কেনে। মন আর শরীরের ভালবাসায় ওদের ফ্ল্যাট ভরে ওঠে। কিন্ত পাখির মেয়েলি মন মাতৃত্ব চায়। আকাঙ্ক্ষাও আপত্তি করে নি। ফার্টিলিটি বিশেষজ্ঞ ডঃ চন্দ্রানীর তত্ত্বাবধানে মা হবার পথে আজ পাখি। কখন যেন চোখ লেগে যায় ওর। সকাল বেলা ঘুম ভাঙে সিকিউরিটির ফোনে, কেউ একজন আসতে চায়। অনুমতি পাবার পর ডোর বেল বাজতেই দরজা খুলে অবাক ওরা। মা একটা ব্যাগ নিয়ে হাজির। ওর দিকে তাকিয়ে বলে ...ভিতরে চল। আকাঙ্ক্ষাকে জড়িয়ে একটা চুমু খায় আল্পনা। পাখি অস্ফুস্ট স্বরে জিজ্ঞেস করে ...বাবা? মা মৃদু হেসে বলে ...বকুলের ঠিকানা জোগাড় করেছে। পাখি আর আকাঙ্ক্ষা হাহা করে হেসে উঠলো। সমৃদ্ধি আসতে চলেছে।

0 comments: