0

গল্প - অভিরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়

Posted in

গল্প


নিশিকান্তর রুটিন
অভিরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়


ঘন্টা বাজল স্কুলে। ঠিক সাড়ে দশটা এখন। ঘড়িটা মিলিয়ে নিলেন নিশিকান্ত বাবু। তিনটে পাঁচ। কে জানে, থেমে গেছিল হয়ত দুপুরবেলায়। বা হয়ত রাতদুপুরে। আসলে মিলিয়ে নিলেন বলাটা ভুল। নিশিকান্ত বিহ্বল বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকলেন দেয়ালঘড়িটার দিকে।

সেদিন রোববার। ঘুমঘুম দুপুর। নিঝুম পাড়া। আর হাওয়ায় সোঁদা গন্ধ। আকাশটাকে ছাই রঙে এঁকেছে যেন কেউ। ঘরের ভেতর অদ্ভুত আঁধার আলোর বোঝাপড়ার মতন নিশিকান্তর জীবন। একটা বেড়াল ড্রইংরুম পেরিয়ে নিঃশব্দে কার্ণিশ থেকে পাঁচিলে নামল। আচমকা বৃষ্টি এলো মুষলধারে। নিশিকান্ত ভাবছিলেন অনেকদিন কুমোরটুলি যাওয়া হয়নি তাঁর বন্ধু রমাপদর কাছে।

বৃষ্টিটা কমছে না কিছুতেই। ভিজছে ইজিচেয়ার বারান্দা পাতাবাহার। নিশিকান্তর মন চৌকাঠ পেরিয়ে রেলিঙে ঠেস দিয়ে দাঁড়ালো। ল্যাম্পপোস্টের তারে ভেজা কাকটার মতই ছন্নছাড়া একজন তাঁর বাড়ির উল্টোদিকের শেডটার নীচে দাঁড়িয়ে। তবু দমকা হাওয়া তাকে বৃষ্টি ছিটিয়ে দিচ্ছে। নিশিকান্ত লোকটাকে ঘরে ডাকলেন। ফ্লাক্সে রাখা চা দুটো কাপে ঢেলে একটা এগিয়ে দিলেন তার দিকে। বেশ আড্ডার মেজাজে চায়ে চুমুক দিয়ে জানতে চাইলেন কি আছে তার ঝোলায়। নিশিকান্তর প্রশ্নটায় শুধু কৌতূহল ছিল না, একটা বিশেষ দাবীও ছিল। সংসার পেতে বসল লোকটা। আর এভাবেই ঠিকানা বদল হয়ে গেল দেয়ালঘড়িটার। তিনশো টাকার বিনিময়ে। প্রায় ছিনিয়ে নিলেন তিনি ঘড়িটা। নিশিকান্ত অবশ্য বলেন টেলিপ্যাথি। মানে, সেদিন বৃষ্টিতে তাঁর বারান্দায় আসা, উল্টোদিকের ফুটপাতে লোকটার বৃষ্টি থামার অপেক্ষা, নিশিকান্তর সাথে বসে চা খেতে খেতে বারবার ঝোলাটাকে আঁকড়ে ধরা, এই পুরো ঘটনা পরম্পরাটাই নাকি আগে থেকে চিত্রনাট্যের মতো লেখা ছিল।

যাইহোক, মোদ্দাকথা, সেগুনকাঠের তৈরী ঘড়িটার মালিক এখন নিশিকান্ত। এই এক নেশা মানুষটার। এতদিন ছিল একটা টাইপরাইটার। সকাল বিকেল রাত। একসাথে খাওয়া ঘুম অবসর। চোখ খুললেই সে। চোখ বন্ধ করলেও। ক’দিন ধরে কত না-বলা কথাই বললেন স্ত্রীকে। চিঠির লাইনে প্যারাগ্রাফে কাটাকুটিহীন। ভাঁজপড়া চামড়া জড়ানো আঙুল যতবার মিশে গেল টাইপরাইটারের সোহাগে, ততই যেন বাড়তে লাগল বুকের লাবডুবটা। ধমনী শিরায় রক্তস্রোত অনুভব ক’রে নিশিকান্তর মনে হ’লো এভাবেই কি মৃত্যু জানান দেয়, আসার আগে?

এখন দোসর হয়েছে ঘড়ি। ভালোবাসা না কমলেও আদরে টান পড়েছে বৈকি। টাইপরাইটারের প্রতিবাদ নেই। এমনকি কয়েকটা অক্ষরও নেই। নিশিকান্তর অবশ্য কোনো দেয়াল নেই। তিনি ঘড়ির কাছে টাইপরাইটারের গল্প করেন আর টাইপরাইটারের কাছে ঘড়ির। কাজের মাসী গজগজ করে – ‘বুড়ো বুড়ো হ’লে কি হবে, ব্যাটাছেলে তো! দু’নৌকায় পা দিয়ে চলার স্বভাবটা এখনো যায়নি।’ সময়মতো পাম্প না চালালে কলে জল থাকে না নিশিকান্তর। যাহ্‌, আজও পাম্প চালালেন না তিনি। কলঘরের সামনে এলেন কিন্তু কিছুতেই মনে পড়ল না কেন এলেন। পাকা টসটসে জামের বেগুনী রঙ মেখে আছে চাতালটা। কাঠবিড়ালী, ডোরা পিঁপড়ে, শালিক এতোদিনে জেনে গেছে এ জায়গাটা নিরাপদ। কোনো মানুষ তেড়ে আসবে না খাবারে ভাগ বসাতে। নিশিকান্ত খানিক তাকিয়ে থাকলেন অপলক। নিথর। উস্কোখুস্কো চুল, কুঁচকে যাওয়া চোখের কোল, জ্যামিতির ভাঁজে মোড়া ফতুয়া।

জামবাটিটায় এখন আর নুন লঙ্কা দিয়ে জাম মাখা হয় না। সন্ধ্যেবেলায় শুকনো মুড়ি খান নিশিকান্ত । এমন অনেক কিছুই আর হয় না, যা হ’তো পরমা বেঁচে থাকাকালীন। ঝড়বৃষ্টি হ’লে জানলা বন্ধ করা হয় না। কাজের মাসীকে রোজ মনে ক’রে জলখাবার দেওয়া হয় না। শব্দজব্দের খালি ঘরগুলো ভর্তি করা হয় না। অজানা কোনো গ্রামে পরিযায়ী পাখিরা ঘর বেঁধেছে শুনেও দেখতে যাওয়া হয় না এখন। দত্ত কেবিনে মাংসের চপ, দাস কেবিনের কবিরাজী, অনাদি দা’র স্পেশাল কাটলেট, লোটে মাছ... কিছুই আর হয় না।

ঘরে এসে নিশিকান্তর চোখ চলে গেল বিছানায় রাখা খবরের কাগজটার উপর। প্রথম পাতার হেডলাইন – জল সমস্যার সমাধান ঘটাতে এবার মেয়র বাড়ি বাড়ি। নিশিকান্তরও মনে পড়ে গেল, পাম্পটা চালানো হয়নি। যাক্‌ গে, এসব নিয়ে মাথাব্যাথা করার সময় নেই তাঁর। খামোকা করতে যাবেনই বা কেন! প্রাচীন পিয়ানো, লুপ্তপ্রায় মডেলের কালো ফোন, টাইপরাইটার বা ঘড়ি – এদের জীবনে তেষ্টাও নেই, স্নানও নেই। আছে শুধু মুহূর্তরা। গোলাপি নেলপালিশ পড়া একটা ভাঙা নখের আঁচড় মনে আছে পিয়ানোটার। মনে আছে অন্ধকার ঘর, জানলা গলে আসা রাস্তার আলোটার সাথে বন্ধুতা।

নিশিকান্ত ভোঁকাট্টা ঘুড়ির মতন লাট খেতে খেতে শহরের নানা প্রান্তে চলে যান। উদ্দেশ্যহীন। একা একা। গন্তব্যের তোয়াক্কা না করেই। প্রগতি শব্দটা শহরে লুকিয়ে থাকা কোনও জঙ্গির ছদ্মনাম বলে মনে হয়। বা হয়ত পরমাণু বোমা। নিশিকান্তর ভয় হয়, একদিন ম্যানিকুইন হয়ে যাবে শহরটা। প্রাণহীণ সৌন্দর্যের মেলা বসবে শুকনো শীতের রোদে। থাকবে না ট্রাম, রাস্তার ধারের চায়ের দোকান, সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা হলুদ ট্যাক্সির স্নানের সকাল, মুছে যাবে দেহাতি রিকশাওয়ালার ফুটপাথ বাড়ি, হজমিওয়ালা, ফুচকার গাড়ি, বইপাড়া। হয়ত কোনও বিস্ফোরণে মিশে যাবে শতবর্ষের ঠিকানা, লেটারবক্স আর রাস্তার নাম। একদিন হয়ত আসবে যেদিন মাছরাঙার ফসিল পাওয়া যাবে খবরের কাগজে। মানুষের নাম চড়াই হলে জানা যাবে এটা আসলে একটা পাখির নাম, যারা এক্কা দোক্কা খেলতে জানত। একদিন হয়ত আর পানকৌড়ির ডানা শুকিয়ে দেবার জন্য মেঘের আড়াল থেকে আলো দেবার দায় থাকবে না সূর্যের। তবু নিশিকান্ত আকাশের চুম্বকে আটকে থাকা বাড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকেন আনমনে। আসলে তাঁর মন হাঁটাচলা করে ওইসব কংক্রিটের ছাদের মেঝেতে। ভাবেন, মরে যাবার আগে অন্তত একবারও যদি ওই ছাদে দাঁড়িয়ে পূর্ণিমার জোয়ারে ডুবে যেতে পারতেন!

আজকাল অনেক সময় মানুষের মুখ খুব চেনা বলে মনে হয়। গলির ভেতর দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া বারান্দা, জানলায় লেগে থাকা মানুষ, কিছু কিছু গন্ধ বসন্তের সন্ধ্যেবেলার হাওয়া লাগিয়ে যায়। এরকম চেনা লাগার উদাহরণ আরো অনেক। সত্যিই যখন কোনো পরিচিত মুখ জানতে চায় – “আরে আপনি? এদিকে?” নিশিকান্ত যাকে যেমন ইচ্ছে বানিয়ে কোনো পছন্দসই জবাব দিয়ে দেন। শহরের নানা টুকরো মুহূর্ত নিয়ে স্মৃতিচারণ করেন।

পাড়ার ব্রোকাররা নিশিকান্তকে তাঁর বড় দোতলা বাড়ির নীচটা ভাড়া দেবার জন্য জোরাজুরি করে। "মেসোমশাই, বলছিলাম শরীর ভালো আছে তো?" নিশিকান্তর কানে প্রশ্নটা আসতেই তিনি চারপাশ তাকিয়ে বলেন - "আমাকে বললে?" প্রশ্নকর্তা নতুন উদ্যমে আবার বলে - "হ্যাঁ মেসোমশাই, কয়েকদিন থেকেই দেখছি, কেমন শুকিয়ে যাচ্ছেন, বাড়ি থেকে খুব একটা বেরোন টেরোন না।" নিশিকান্ত উত্তর না দিয়ে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকেন। সেই সুযোগে ছেলেটি আবার বিজ্ঞের মতো বলে - "বয়েস হলে মানুষ বিলকুল একা হয়ে যায়। তাই না? আপনি যে কি ক'রে এত্তবড় বাড়িটায় একা থাকেন! চা খাবেন মেসোমশাই? আসুন না চায়ের দোকানটায় বসি। আপনাকে আমি হেবি ইয়ে করি, জানেন তো। আপনাকে চা খাওয়ালে আমার জীবনটা ধন্য যাবে মাইরি।" নিশিকান্ত চায়ের দোকানে বসে প্রথম তীরটা ছোঁড়েন - "আচ্ছা, সখেরবাজারে যে পুলিশ কুকুরটা খুনীকে ধরিয়ে দিলো কাল, তার নাম জানো?" ছেলেটা মশা মারতে গিয়ে ফস্কায়। কি উত্তর দেবে কুলকিনারা পায় না। চায়ে চুমুক দিয়ে নিশিকান্ত দ্বিতীয় তীরটা বার করেন। "আজ সকালে সোনারপুরে যে লোকটা ট্রেনে কচ্ছপ নিয়ে ধরা পড়েছে, তার ব্যাগে ক'টা কচ্ছপ ছিল বলতে পারবে?" ছেলেটা ধৈর্য হারিয়ে ফেলে এবার। "কি হবে বলুন তো এতসব জেনে? পেট ভরবে?" নিশিকান্ত চায়ের দাম দিয়ে উঠে যেতে যেতে বলে যান - "সেইজন্যই বলছি আমি আমার বাড়িতে কিভাবে থাকি নাই বা জানলে, তাই না?" এরকম ঘটনা আরও ঘটেছে। কেউ বিশেষ সুবিধে করতে পারেনি।

অবশেষে ব্রোকার হারু। ছিল রোলের দোকান। শত্রুতা করে একদিন কেউ আগুন লাগিয়ে দিল। তারপর থেকে জীবিকার প্রয়োজনে সে জমি বাড়ির দালাল। ভগবান চেহারাটা বানিয়েছে খারাপ লোকেদের মতো, কিন্তু মনটা ভালো। নিশিকান্তরও একটা দুর্বলতা আছে। যখন রোলের দোকান ছিল, সেই সময়ই হারু মেয়ের জন্মদিন করেছিল অনাথ বাচ্চাদের হোমে। মনে মনে হারুকে সম্মান করেন নিশিকান্ত। হারুর মধ্যে একটা পরোপকারী মানুষ আছে। তার সাদা কথা, "আমি কিছু করি না। সব তারা মা করিয়ে নেয়। খারাপটাও করায়, ভালোটাও।" যদিও হারুর সঙ্গে একটা ব্যাপারে খুব অমিল নিশিকান্তর। তিনি ‘সবই তাঁর ইচ্ছে’ টাইপ কথায় বিন্দুমাত্র আগ্রহী নন, বিশ্বাস তো অনেক বড় ব্যাপার। সারাজীবন তিনি নিজের ইচ্ছেতেই সব করেছেন। আগাপাশতলা স্বাধীনচেতা। তাই তিনি হারুকে বলেন - "তুই ভালোটাও করিস নিজের মর্জিতে, খারাপটাও করিস মনের সায় থাকে বলেই। একদম অন্যের ঘাড়ে বন্দুক রাখবি না।"

একদিন হারু একটি মেয়েকে নিয়ে এলো নিশিকান্তর কাছে। সুন্দরী, চেহারায় একটা লালিত্য আছে। চশমার আড়ালে চোখদুটো গভীর। বুদ্ধিদীপ্ত। আবদার, নীচতলাটা ভাড়া দিতে হবে। "মানে!" কথাটা হারুর উদ্দেশ্যে বললেও মেয়েটির কপালে ভাঁজ পড়ল। একমুহূর্তের জন্য তার চাহনিটা অসহায় মনে হল নিশিকান্তর। "বাবা! এরকম করছেন কেন? দিন না! আমি আগে কখনও বলেছি?" নিশিকান্ত না বলতে পারেন না। মেয়েটির সমস্যার কথা শুনে তাঁর পরোপকারী মনটা বেরিয়ে আসে।

এর দিন দশেক পর চুরি হয়ে যায় নিশিকান্তর সাধের জিনিসগুলো। থানা পুলিশ করে কোনো লাভ হয় না। পুলিশের লোকেরা বলে, পুরনো অ্যান্টিক জিনিসগুলো ফেরত পেয়েই বা কি হবে? যতসব পাগলামো!

মনটা ভালো নেই নিশিকান্তর। বাড়িতে চুরি হবার পর থেকে সেই মেয়েটিরও আর পাত্তা নেই। এরপরই একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটে যায় নিশিকান্তর জীবনে। রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে দূরে একটি লোককে অসুস্থ হয়ে নিথর হয়ে যেতে দেখে। নিশিকান্ত থানা পুলিশ হাসপাতাল করার কথা ভেবেও দমে যান। মোটা মানিব্যাগটা বেরিয়ে আছে। এই অবস্থায় লোকটাকে ফেলে চলে যাওয়াটা ঠিক হবে না, তিনি জানেন। হঠাৎ মোবাইল বাজে লোকটার। নিশিকান্ত ইতস্তত করে ফোনটা রিসিভ করেন। অন্যপ্রান্তে একটি মহিলা কন্ঠস্বর অবিরাম কথা বলে চলে।

এক নতুন দিগন্ত খুলে যায় নিশিকান্তর সামনে। অন্যপ্রান্তের মহিলা নিশিকান্তর চোখের সামনে নিথর হয়ে যাওয়া লোকটির স্ত্রী। আজ ওদের মেয়ের জন্মদিন। লোকটিকে তাড়াতাড়ি বাড়ি আসতে বলেন মহিলা। সঙ্গে অভিযোগ করেন, পুরনো বাতিল জিনিসের ভিড়ে বাড়িতে লোক বসানোর জায়গা নেই। নিশিকান্তর মনে হয় তাঁর জিনিসগুলো তিনি খুঁজে পেয়ে গেছেন।

নিশিকান্ত যখন সেই বাড়িটা খুঁজে বার করেন, তখন বাড়িতে জন্মদিনের উৎসব। নিশিকান্ত জানান, পুরনো জিনিস সংগ্রহ করা তার নেশা। তিনি এসেছেন এখানে কিছু অ্যান্টিক জিনিসের খোঁজ পেয়ে।

0 comments: