0

সম্পাদকীয়

Posted in


সম্পাদকীয়


বর্ষা আসি আসি করেও আসছে না। গরমে প্রাণ ওষ্ঠাগত। ভূগর্ভস্থ জল দিন দিন আরও গভীরে সেঁধোচ্ছে। আর ক’বছর পর কি হাল হবে, ভাবতেও ভয় করে। আর এসবের প্রেক্ষাপটে দেশ জুড়ে এই আর্থ‌রাজনৈতিক ক্যারিকেচার! সত্যি, আমাদের সহনশীলতা তুলনাহীন!

এরই মধ্যে ঘামতে ঘামতে গালে হাত দিয়ে ভাবি, এ কিসের ফলশ্রুতি? কল্যাণমূলক অর্থনীতি, যাকে বলে কিনা welfare economics -তারই backfire বা বিপর্যয় নয়তো! সাম্যবাদ চিরকাল যে আর্থসামাজিকভাবে পিছিয়ে থাকা সাধারণ মানুষের উত্থানের কথা বলে এসেছে, আজ ভারতবর্ষের রাজনীতিতে তো তাদেরই রমরমা। যেটা সাম্যবাদ কখনও বলেনি, বা ভাবেওনি হয়তো, সেটা হলো এই যে, যাদের কিছুই নেই, তাদের কিন্তু শিক্ষা বস্তুটাও নেই। অথচ সাম্যবাদের বিশিষ্ট ভারতীয় প্রবক্তা তথা সেই সব উজ্জ্বল নক্ষত্ররা কিন্তু প্রায় বেশীরভাগই শিক্ষিত, সংস্কৃত, আলোকপ্রাপ্ত পরিবার থেকে এসেছেন। সাম্যবাদের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম... ন্যূনতম রুচিবোধ, ভদ্রতাবোধটুকুও আজ ভারতীয় রাজনীতি থেকে বিলুপ্তপ্রায়, এবং সেই রাজনীতির শীর্ষে যাঁরা এখন বিরাজমান, তাঁদের কথা এখানে বলে বিড়ম্বনা বাড়ানোরও কোনও অর্থ হয়না।

মোদ্দা কথা হলো, সাম্যবাদের স্বপ্ন সার্থক করে যে subaltern মানুষগুলোর ভারতীয় রাজনীতিতে উত্থান ঘটলো গত কয়েক দশক ধরে, আজকের এই অদ্ভুত পরিস্থিতি অধিকাংশেই তার ফলশ্রুতি। শ্রেণীশত্রু Elitist বুর্জোয়ারা তাই এখন শুধু মুচকি মুচকি হাসছেন।

যাক... এসব জাহাজের খোঁজখবর আমাদের মতন আদার ব্যাপারীদের কাজে আসে না। আমরা বরং আমাদের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির আপাতসুন্দর  নরম বালিশে মুখ গুঁজে যতটা সম্ভব সময় কাটিয়ে দিই... এবং সংখ্যায় বাড়তে বাড়তে ও এই গ্রহের যৎপরিমাণ অবশিষ্ট রসটুকু শুষে নিতে নিতে কোনও এক মহান, অতি‘মানবিক’ ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি, যেন তাড়াতাড়ি বৃষ্টি এসে এই অসহ্য গরমের হাত থেকে রেহাই দেয়।

ভালো থাকবেন। শুভেচ্ছা নিরন্তর...

0 comments:

1

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - শমিত বিশ্বাস

Posted in

প্রচ্ছদ নিবন্ধ


জাগো সমর্থক, জাগো!
শমিত বিশ্বাস


ফুটবলই হোক আর রাজনীতিই হোক, সমর্থকদেরই হয়েছে ঘোরতর মুস্কিল। অল্পবয়সে যখন কলকাতার ফুটবল লীগ নিয়ে খুব মাতামাতি করতাম, তখন প্রতিবছর লীগ শুরুর ঠিক আগে অসীম আগ্রহে চোখ রাখতাম কোন খেলোয়াড় কোন দলে নাম লেখাচ্ছে, সেদিকে। কাগজে ফলাও করে ছাপতো কোন নামজাদা খেলুড়েকে কোন বড় ক্লাব বিশাল টাকা দিয়ে কিনে নিল, ইত্যাদি। আমাদের, অর্থাৎ সমর্থকদের পছন্দের কোনো ক্লাব, যেমন মোহনবাগান বা ইস্টবেঙ্গল, কোনো বড় প্লেয়ারকে কিনতে পারলে উল্লসিত হতাম; আবার কেউ ছেড়ে গেলে আতঙ্কিতও হতাম। অবশ্য সব বড় ক্লাবেরই কিছু না কিছু দুর্ধর্ষ খেলোয়াড় ছিলেন, যাঁরা কোনোদিন দলবদল করতেন না; বছরের পর বছর একই ক্লাবে খেলে যেতেন। সমর্থকদের চোখে এঁরা ছিলেন নমস্য। এঁদের কথা বাদ দিলে, বাকিরা প্রায় সকলেই দল পাল্টাপাল্টি করতেন প্রধানত টাকার অঙ্কের কারণে। তা, এরকমটা হওয়াই তো স্বাভাবিক। তখনও ছিল, আজও একইরকম আছে। এ নিয়ে প্লেয়ারদের বিরুদ্ধে কখনও কোনো অভিযোগ কেউ করেনি, আর করার কথাও নয়। কিন্তু মজার ব্যাপার এই যে, সমর্থকদের ক্ষেত্রে এই নিয়ম খাটে না। তারা কখনোই এ ক্লাব, ও ক্লাব মানে আজ মোহনবাগান, কাল ইস্টবেঙ্গল, এমনটা করতে পারেন না; করলে সেটা গর্হিত অপরাধ বলেই গন্য হবে। এই অগণতান্ত্রিক বৈষম্যের কারন কি, তার সদুত্তর আমি পাইনি। বন্ধু বান্ধবদের জিজ্ঞেস করলেই তারা ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকায় আর বলে -- 'ওরে আহাম্মক, মোহনবাগান মানে ঘটি, ইস্টবেঙ্গল মানে বাঙাল, আর মহামেডান স্পোর্টিং মানে হলো মুসলিম। এরা এদিক ওদিক করবেটা কি করে ?" কিন্তু এ উত্তর আমাকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। তাহলে খেলোয়াড়রা কেন এসবের ধার ধারে না ? কোনো ঘটি খেলোয়াড় যদি ইস্টবেঙ্গলে খেলে, তাহলে কেউ কি তাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করায়? আবার, কোনো মুসলিম প্লেয়ার যদি মোহনবাগানে নাম লেখায়, তাতে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায়? ওসব বাজে কথা। আসলে, এ সমর্থকদের প্রতি এক সুপরিকল্পিত অবিচার।

এবার আসা যাক বাঙ্গালীর আর এক প্রিয় বিষয় - 'দি গ্রেট রাজনীতির' কথায়। রাজনৈতিক নেতারা কিন্তু এই সেদিন পর্যন্তও ফুটবলারদের থেকে ছিলেন আলাদা। যে যার নিজের নিজের ভালোবাসার দলে 'পীরিতি কাঁঠালের আঠার' মতই সেঁটে থাকতেন। গান্ধীবাদী নেতা গান্ধীটুপি পরে সারাজীবন থেকে থেকে অনশন করতেন আর ধর্না দিতেন। বামপন্থী বছরের পর বছর "লড়াই লড়াই লড়াই চাই, লড়াই করে বাঁচতে চাই" বলে চিৎকার করেই চলতেন, আমৃত্যু। কিন্তু অধুনা দিনকাল বদলেছে। চারিদিকে পরিবর্তনের ঘোড়েল হাওয়া। রাজনীতির হোমরা-চোমরারাও যে এর ব্যতিক্রম নন, সেটা টের পেলাম এইভাবে। টিভিতে রোজ সন্ধেবেলা বেশ আয়েশ করে চ্যানেলে চ্যানেলে বিভিন্ন পার্টির নেতাদের তর্জাগান শুনি। বেশ লাগে। এদল ওদলকে মুখ ভ্যাংচায়, তো ওদল এদলের দিকে ঘুঁসি পাকায়। এই নেতা কলা দেখায় তো ঐ নেতা বক দেখায়। সঞ্চালক মশাই দু দলকেই তাতিয়ে দিয়ে মজা পান। সিটি দিতে না পারলেও হাসেন মিটি মিটি। তা কিছুদিন ধরে এই রঙ্গরস দেখতে দেখতে বেশ চেনা হয়ে আসছিল মুখগুলো, মানে কে কোন দলের ওস্তাদ। ওমা, হঠাৎ আবিষ্কার করলুম যে চেনা মুখগুলোর কয়েকটিকে আর দেখতে পাচ্ছি না! শুনলাম, তাঁরা নাকি দল পাল্টেছেন। অর্থাৎ, কদিন আগেও যাদের দেখলেই 'এই মারেন তো সেই মারেন' করতেন, এখন তাদের সঙ্গেই নাকি হলায় গলায় ভাব! তাই, কি করে আর তাদের সঙ্গেই তর্জা লড়েন? মানে মোদ্দাকথা হল, পার্টির কর্তাদের গায়েও ফুটবলারদের হাওয়া লেগেছে। কোনো ঢাক ঢাক গুড় গুড় নেই। সকালে এক পার্টি তো বিকেলে আর এক। পেশাদার ফুটবলার যদি হয়, তবে পেশাদার পলিটিশিয়ানই বা হবেনা কেন ? 'সার্ভিস' পেতে গেলে, ফ্যালো কড়ি মাখো তেল। এদের মধ্যে কেউ কেউ আবার আরো বেশি দূরদর্শী। নিজে এক পার্টিতে থেকে, বৌ কিংবা ছেলেমেয়েকে ভিড়িয়ে দেন অন্য পার্টিতে। তাতে ভারসাম্যও বজায় থাকে, আর দরকার মত দলবদলটাও মসৃন হয়। আমি বলি কি, ব্যাপারটার একটু সরলীকরণ দরকার। প্রতি বছর মরশুমের শুরুতেই একেবারে সই-সাবুদ করে, ফুটবলারদের মত দলবদলের পালাটা চুকিয়ে দিলেই হয়। তাতে ফরোয়ার্ড, ডিফেন্স দুটোই অন্তত এক বছরের জন্য আর নতুন করে গড়াপেটা করতে হয়না।

তা সে যাকগে, মরুকগে, আমাদের আলোচনার মূল বিষয় হোল সমর্থকদের সমস্যা নিয়ে। তারা কিন্তূ দুঃখের বিষয়, ইচ্ছে করলেই রাতারাতি, এক পার্টি-অফিস থেকে, আর এক পার্টি-অফিসে গিয়ে বসে পড়তে পারেন না। বরং নীলবর্ণ শৃগাল চিহ্নিত হয়ে, মার খেয়ে চামড়া গুটিয়ে যাবার ভয় আছে। তাহলেই দেখুন, কি ফুটবল, কি রাজনীতি, সমর্থকদের সঙ্কটটা একই। কেন রে বাপু? সমর্থকদের কি একটু চেঞ্জের দরকার নেই? সকালবেলা মেঘ করলে কি রাত্রি বেলা চাঁদ উঠতে নেই? না না, এভাবে দিনের পর দিন চলতে পারে না। এখনি ঠিক সময় এসেছে এই বঞ্চনার বিরুদ্ধে সমস্বরে গর্জে ওঠার। কর্তারা যদি মুহূর্মুহু দল পাল্টাতে পারেন, তাহলে সমর্থকরাই বা কেন ইচ্ছেমত রঙ বদলাতে পারবেন না ? তাই বলি, এখনো সময় আছে, দুনিয়ার সমর্থক কূল এক হোন। আর চলুন নেচে নেচে গাই -----

বদল বদল বদল চাই। বদল নিয়ে বাঁচতে চাই। রঙবদল আর ভোলবদল। বল হরি হরিবোল।

1 comments:

1

প্রবন্ধ - চিত্তরঞ্জন হীরা

Posted in

প্রবন্ধ


মুখের ভাষা মনের ভাষা
চিত্তরঞ্জন হীরা

#

কথা যখন শুরু হয়, ভাষাই তার প্রধান বাহন হয়ে ওঠে। যা আমাদের নিজেদেরও প্রকাশ মাধ্যম। একটা চালু প্রবাদ ছিল–'আপনার ভাষাই আপনার পরিচয়'। এখন অবশ্য তেমন শুনতে পাই না কারও মুখে। কিন্তু আমরা বড্ড বেশি টালমাটাল হই মুখের কথার সঙ্গে লেখার ভাষা নিয়ে। তার চল-অচল, মিল-অমিলের বোধগম্যতা নিয়ে। যুক্তির পালে যখনই একটু আবেগের ঢেউ এসে লাগে, প্রথম দোলাটা ওঠে ভাষা থেকে। একটা অভিব‍্যক্তি, তার প্রকাশ। নানারকম হতে পারে। কোনও অর্থই রইলো না, কিন্তু আমরা বুঝে ফেললাম। কোনও অর্থ হয়তো ছিলই না, কিন্তু একটা সংযোগ তো কোথাও না কোথাও ঘটে গেল। এটা কেন কবিতার ক্ষেত্রে হবে না!

আড্ডায় তো কতকিছুই হয়, কথার বাঁকে বাঁকে কত আড়ালফেরতা! সব কথা বলা হল না, অথচ অসম্পূর্ণ কথার এগলি সেগলি ঘুরে রাজনীতি, সিনেমা, নাটক, মায় রাতগভীরের নীল আলোর শীৎকার, মায়ারহস্য, গা- ছমছম পর্যন্ত। কিন্তু আমরা বলি কি, যৌনতারও একটা বিশেষ ভাষা আছে, তেমন কবিতার। এসব নিয়েই সময়। তার যে থেমে থাকা নেই। সে চলেছে সবকিছুকে নিরাসক্ত করে। তারও কত দুঃখ থাকে। একা বইছে। একাকীত্বেই তার চারণভূমি। আমরা তাকে বুঝতেই পারি না। বলি বটে সময়ের সঙ্গে আছি, কিন্তু সে চলেছে আগে আগে, আমরা একটু পিছিয়েই রইলাম। বুঝতে পারি না। আসলে যারা দুঃখ বুঝল না, তারা আনন্দ বুঝবে কেমন করে! এমনই কবিতা...।

#

পাড়ের নৌকোটি খোলা হল, সে পাড়ি দেবে, হাওয়ায় দুলছে, কালের হাওয়া। আমরা কয়েকজন চড়ে বসলাম টুক করে। এবার নিয়তি টানছে। কবিতার নিয়তি। ভেসে চলেছি, ভেসে চলেছি, আর ভেসে চলেছি,গূঢ়ভাষার অন্তর্গত বিশ্ব নিয়ে। কথার আড়ালে কথা, কথার পিঠে কথা, রহস্যরঙ নিয়ে। অন্তর্লীন ডুবে থাকা রূপ, রস, গন্ধ নিয়ে- 'মাথাভর্তি মনখারাপ; তার ভিতর তুমি গঙ্গাফড়িঙের কুটিরশিল্প লিখে রেখেছো / মাথাভর্তি মনখারাপ; তার ভিতর তুমি পায়রার মৌরিফুল ঢেলে দিয়েছো / মাথাভর্তি মনখারাপ; তার ভিতর তুমি শালিকের শৃঙ্গার বুনে দিয়েছো' ( জহর সেন মজুমদার )।

এই তো আমরা বয়ে চলেছি কূল ছাড়িয়ে, আর ওদিকে হিজলতলার রামধনু ছুঁয়ে প্রজাপতি উড়ছে, ছাইচাপা একটা শামুক গা শীতল করে উঁকি মারছে, রক্তমাখা যৌনটিয়া গড়িয়ে নামছে মহাবিস্ময় হয়ে, অস্ত যাচ্ছে অপরাহ্ন।

- তাহলে কি সন্ধ‍্যামালতির বনে আবার উৎসব হবে! আবার কি একটা ভোরের জন্মদিন এল!

#

কে বলতে পারে, এই সেই শব্দগুচ্ছ, যাদের দেওয়ালে কোনও অর্থচিহ্ন নেই, তাই আমাদের মনের কোণে একটুও বাজল না! কে বলতে পারে এর কোনও আলোচিহ্ন নেই, তাই কয়েক আলোকবর্ষ অন্ধকার থেকে উঠে আসা শুধুই শব্দের মায়া, কথাহীন কথকের অব‍্যর্থ প্রতারণা !

তবে তাই-ই হোক। আমরা না হয় কয়েকজনই শুধু বুঝলাম, পূর্বনির্ধারিত সংকেত ছাড়া এদের নিষ্কৃতি কখনোই সম্ভব নয়।

এ হল সেই পারাপারের খেলা, বিশ্ব নিয়ে, ভাষা নিয়ে, বোধ নিয়ে। কল্পনার দেশ বাস্তবতায় মিশে একাকার। নানাদিকের নির্দেশনা নিয়েই তার অনাবিষ্কৃত মুখগুলো মাথা তুলতে চায়। শুধু কি মুখ, একটু একটু করে শরীর খুলবে, তাঁতবসন।

- বসন তো খুলছো কিন্তু দাঁড়ালে কোথায়!

ইশারার বাঁকে এসে হাতের তালুতে রাখা সেই লুকানো বীজগুলো শূন্যে ছুঁড়ে দেওয়া। তারা জলে ভেসে, হাওয়ায় টাল খেয়ে যে যেখানে পড়বে, সেখানেই তার সম্ভাবনা‌। তার বাস্তব। অঙ্কুর তো এল, এবার গাছটা বাড়াও, বাড়িয়ে তোলো। সার দাও, জল দাও। দেখবে একদিন ঠিক ফুলে-ফলে ভরে উঠলো নতুন সভ‍্যতা। একে হয়তো অনেকটা প্রলাপই বলা যায়। কিন্তু কবিতা তো ঐ প্রলাপমাত্র!

###

শব্দ, বোধ, দৃশ্য এবং ব‍্যক্তিক অভিজ্ঞতা- এই নিয়ে যা রচিত হল, তা একটি পাঠবস্তু, কবিতাও হতে পারে বা অন্য কিছু। পাঠক এবং ঐ রচিত পাঠবস্তুর মধ্যে যদি স্বাভাবিক সংযোগ নিয়ে আমরা ভাবতে বসি, তাহলে দুটো অভিমুখের কথা স্মরণ করতে হবে। একটি চেতনাপ্রসারিত, অন্যটি অভ‍্যাসে ঘেরা স্বাদবোধতাড়িত। যা স্বাভাবিক অভ‍্যাসে অচেতন থেকেই ঐতিহ্যে বয়ে আসে, কিন্তু অনবচ্ছিন্ন।

চেতনার নিজস্ব ক্রিয়া ক্রমাগত চোখে চোখে দেখাকে প্রসারিত করে। ভেতরে ভেতরে তার আগের ধারণার সঙ্গে মিলিয়ে দেখারও একটা প্রবণতা জন্ম নিতে পারে। আর দ্বিতীয়টি হল, একটি ফ্রেম মনের মধ্যে রয়েছে, তাতে ফেলে পূর্বধারণা মত বুঝে নিতে চেষ্টা করা। না মিললে নস্যাৎ করা। কিন্তু এই অবস্থা থেকে যখনই মনের মধ্যে কিছু প্রশ্ন জাগতে শুরু করবে, তখনই চেতনাও জাগ্রত হতে থাকবে। অর্থাৎ, অচেতন যদি অবচেতনেও একটু সজাগ হয়ে ওঠে, তবেই ধারণা বিবর্তিত হতে পারে। প্রতিটি বিষয় বা ঘটনার অন্তর্নিহিতে একটা তাৎপর্য থাকে, সে ক্রিয়াশীল হয় এবং প্রতিক্রিয়া ঘটায়। তবে একই ভাষা অঞ্চলভেদে ভিন্ন ভিন্ন ধ্বনির ইঙ্গিত বহন করতে পারে। একই ভাষা শুধু শব্দের হেরফেরে, শব্দসাজের হেরফেরে তার দ‍্যোতনাই একেবারে বদলে দিতে পারে।

তাহলে এবার প্রশ্ন হল, সংযোগ মানে মানুষের মনের একরৈখিক কোনও মেলবন্ধন তাহলে নয়?

সে কথাও পরের, আগে আমাদের মীমাংসায় আসা প্রয়োজন, যাঁরা বলেছিলেন কবিতার ভাষা হোক মানুষের মুখের ভাষার মত, তাঁরা আসলে কবিতাকে কেমন হওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন? আজও কি তার সঠিক মীমাংসা হয়েছে? বোধহয় হয় নি। সংযোগ অর্থে ঠিক অর্থ নয়, ঠিক বুঝে ওঠাও নয়, অনেকগুলো উপাদান পাশাপাশি রেখে তার কোনও একটির মাধ্যমে লেখকের উপাদানকে বা বক্তার বলা বিষয়কে ধরতে চেষ্টা করা। বা কোনও একটি আভাসের মধ্যে নিজেকে অনেকটা জড়িয়ে নেওয়া। শেষ পর্যন্ত ধ্বনির বহুরৈখিক চিহ্নময়তা বা বহুমাত্রিক অনুভবতা একটি পাঠবস্তুকে এক এক পাঠকের কাছে এক একরকম সংযোগ বা উপলব্ধি দিতে পারে। লেখক বাধ্য করাচ্ছেন কীনা বলা যাবে না, কে কেমনভাবে বিষয়কে ধারণ করবেন, তা তাঁর বেড়ে ওঠা মানসিক গঠনের উপরই নির্ভর করে। হয়তো আমরা কেউ পড়ছি -

'চিমনির মুখে শোনা সাইরেন-শঙ্খ
গান গায় হাতুড়ি ও কাস্তে –
তিল তিল মরণেও জীবন অসংখ্য
জীবনকে চায় ভালোবাসতে।'
(সুভাষ মুখোপাধ্যায়)

এর মধ্যেও বহু পাঠকের নাবোঝার এলিমেন্ট রয়েছে। অর্থাৎ সহজ সংযোগ হল, এমনটা দাবি করা যায় নি। ইতিহাসে এটাই সত্য। কিন্তু কবিতার জয় এখানেই যে, ধরা দিয়েও সে পুরোপুরি ধরা দেয় না, তার স্বভাব সৌন্দর্য নিয়ে একটু আড়াল রাখে। কথাটা হল এই, কবিতায় সহজ সংযোগের চেয়ে আড়াল সৌন্দর্যই প্রধান উপাদান। আমরা যাকে কমিউনিকেশন বলছি, তা একটি বিশেষ অনুভূতির ব‍্যঞ্জনা। তা ঐ অভ‍্যাস, আভাস আর সমর্পণের বাইরে আর কিছু নয়। কবিতার ভেতর থেকে কবিতার আবেদন মিলিয়ে গেলে তা আর কবিতা থাকে না। নিছক কথামাত্র, নিছক শব্দসমষ্টি। শব্দকে যে আড়াল মাধুর্য দিয়ে গড়ে তোলা হচ্ছে, তাকে বাজাতে হবে অন্তরাত্মায়। এটাই ব‍্যঞ্জনার মূখ্য ভূমিকা।

যাঁরা এখনও এসব কথায় গোল বাঁধিয়ে বসেন, তাঁদের জন্যে কবি সুভাষেরই কবিতাকারী ভাবনার সাহায্য নিতে পারি আমরা। তিনিই বলেছিলেন–

"লেখার ভাষা অবিকল মুখের ভাষা হতে পারে না। মুখের ভাষার স্থান কাল পাত্রের গণ্ডিটা থাকে ছোট, লিখতে গেলে এমন একটা গড়নপিটনের দরকার যাতে লেখকের হাত ছেড়ে দিয়ে সে লেখা যখন-তখন যেখানে-সেখানে যার তার কাছে যেতে পারে। মুখের ভাষার কাছে থাকতে চাই নিকট দূরত্বে।"

(কবিতা পরিচয়/বৈশাখ-আষাঢ় ১৩৭৭)

মানুষ যতক্ষণ না নাবলা কথার ফাঁক থেকে রহস্যটুকু উদ্ধার করতে পারছেন, ততক্ষণ এই মাধুর্যকে উপভোগ করতে পারবেন না। ধ্বনি যেখানে ভাষার উৎস, সেই ধ্বনিসমষ্টি আমাদের মনে কতগুলো চিহ্ন তৈরি করে, যা মনের ভাষা, তাকে বোঝাতে যে শব্দগুলো ব‍্যবহার করা হয় তা মুখের ভাষা, এই দুইয়ের মধ্যে এমন অনেক কিছুই ঘটে থাকে, তাকে অর্থ করে বুঝিয়ে দেওয়া যায় না। সৃষ্টির বাঁক আসে বহুপ্রসারিত আলোর রেখা থেকে। কবিতার নিকট-দূরের আলো-আঁধারটুকু নিয়েই তো পাড়ি দেওয়া একটা জীবন। বিশ্ব-চরাচর নানা রহস্য নিয়ে নিত্য খেলছে, আর আমাদের পাগল করে তুলছে। আলো-আঁধারের আভাস দিচ্ছে।

#

বহুপ্রসারিত সেই আলোর রেখা থেকে হয়তো হঠাৎ উঁকি দিয়ে উঠলো–

'মুগা সুতো
কথা ভাঙছে
মনে প্রাণে
আর
ছড়িয়ে দিচ্ছে
বাথানে বাথানে'
(রুহুল আমিন হক মণ্ডল)

এই যা উদ্ধার করা গেল তারপরই বলতে হয়, এ থেকে গ্রহীতা যা নিলেন তার সঙ্গে বক্তা বা কবির মনোভাষা এবং বাকভঙ্গীর নৈকট্য খুবই সামান্য। কিছুটা কাছে এসে কিছুটা দূর থেকেই এর উত্তাপ ও আলো নেওয়া। এই জন্যেই আমরা বলতে চেয়েছি, একটু আভাসের মধ্যে অনেকটা সমর্পণ। এমন একটা অবস্থানের উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে ভাষাসম্পর্ক।

###

শব্দেরও শারীরিক ভাষা হয়। শব্দশরীর কথা বলে। কবিই শুধু শুনতে পান তার কথা। যে কবি শুনতে পান না, তাঁর শব্দরা আদতে নিষ্প্রাণ, জড়। এই কারণে অনেক কবিতা পাঠের পরই মনের কোণ থেকে ঝরে যেতে থাকে, অর্থাৎ তার বাঁধন আলগা রয়েছে।

আসলে এসব কথা তো প্রমাণ করা যায় না, ঐ আপন মনে প্রলাপের মত বকে যাওয়া। এই যে কবিতার ভাষার সঙ্গে শব্দের শরীরীভাষার যে সম্পর্কের কথা আমরা বলতে চেয়েছি, তাকেও কি সবাই অনুভব করতে পারেন? একমাত্র কবিই। কবির সত্তার আলোড়ন ঐ শরীরীভাষার জাগরণ থেকে তাঁর কবিতায় প্রবেশ করে। শব্দের যৌন-আধার থেকে নিষ্ক্রান্ত আলোকণা, তাপবীর্য কবিকে পাগল করে, অস্থির করে। কবি তখন আর ঐ শব্দঘোর থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন না। লেখাটি শেষ হলে তবেই যেন তাঁরও মুক্তি।

একজন কবি নতুন সৃষ্টির জন্যে অনলস ভাঙচুরের খেলায় মেতে থাকবেন। অবিরাম ভাঙনের টানই তাঁকে আহ্লাদিত করবে। এভাবেই শব্দবিশ্বের প্রসার ঘটে, বিস্তার ঘটে। কবিতাও গতানুগতিকতা ছেড়ে মহোত্তর জীবনবোধ নিয়ে প্রসারিত হয় নতুন ভুবন, নতুন শব্দচরাচরের দিকে। এ হল ইন্দ্রিয়চেতনার প্রত‍্যক্ষ জ্ঞান, সঙ্গে মিশবে পরোক্ষলব্ধ বিশেষ অভিজ্ঞতা। শব্দ শুধু কুড়িয়ে পাওয়া অক্ষরের নুড়ি নয়, তাকে একটু একটু করে বানিয়েও তুলতে হয়, তবেই না এই আমাদের শব্দের গোলাঘর আরও ভরভরন্ত হবে, আরও সমৃদ্ধ হবে !

#

ভাষা এমনই একটা অস্ত্র, জীবন-অভিঘাতে তাকে শাণ দিতে দিতে ধারালো করে তোলা। বাইরে থেকে বল প্রয়োগ না করলে যেমন বস্তুর স্থানান্তর ঘটে না, তেমনি ধারাবদলের স্পৃহা না থাকলে ভাষাও স্থবির হয়ে পড়ে। এই যে চলতে ফিরতে লক্ষ্য করি মানুষের মুখের ভাষা কত পাল্টে গেল, কত নতুন নতুন শব্দ হাসছে খেলছে গড়াচ্ছে, সেখান থেকে কবিতায়ও নতুন নতুন শব্দের আগম ঘটে। সাজিয়ে তোলাটাই কবির কাজ–

'বুকের ভেতর এক চোরা মেঘ এসে
মাঝে মাঝে জল দিয়ে যায় চাতকে।
দুচোখে সাতভরি গান
শুকিয়ে যাওয়া ফুলটি তখন
আলাদীন আলাদীন।'
(আশিস গোস্বামী)

কবিতার ভাষা নিয়ে সারা পৃথিবীতে সব সময় এরকম এক একটা আলোড়ন চলে। মানে স্বাভাবিক চলনের বাইরে একটা বিরুদ্ধস্রোত বইয়ে দেওয়া। পালাবদলের ঢেউটা ওঠে এখান থেকেই। শুরুতে কেউ কেউ মনে করেন 'মেধার অসুস্থ পাগলামি', আবার কেউ কেউ বিশ্বাস করেন–

"সব রদবদলের তলে তলে একটা যোগসূত্র কাজ করে। এক-দিকের নতুনের সঙ্গে আরেকদিকের নতুনের যোগ থাকে। কবিতা আর সবকিছু আলাদা নয়। মানুষ জীবনের ভাষা আয়োজনে, কবি ভাষাবদলের,ভাষাখোঁজের, ভাষাতল্লাশির যোগানদার হয়ে উঠতে পারলেই তার সার্থকতা।"– (সমীর রায়চৌধুরী)

#

আবার যদি বলা হয়, চিরন্তনের যাত্রা তাহলে কোনদিকে ? তাহলেও সেই একই কথা এসে পড়ে- 'ব‍্যক্তি' আমির 'সর্বময়' আমির দিকে ছুটে যাওয়া, ধাবিত হওয়া। কিন্তু একজন ব‍্যক্তির দ্বান্দ্বিকতা আর একজন স্রষ্টার দ্বান্দ্বিকতা এক নয়। একজন ব‍্যক্তি বা সাধারণ মানুষ যখন নিজেকে চিনতে বুঝতে সত্তার উলোঝু্লোয় পাগল পাগল হতে থাকেন, তখন তার মধ্যেও সৃষ্টিজনিত অবস্থার প্রকাশ ঘটতে পারে। এটা হল সৃষ্টিসত্তার উন্মোচনের দিক। কিন্তু সাধারণত একজন ব‍্যক্তির দ্বান্দ্বিকতা বলতে যা বোঝা যায় তা হল সে নিজেকেই ঠিক বুঝতে পারছে না, নিজের ভেতরের আলোড়নগুলো প্রকাশ করতে পারছে না। এটা একধরনের ব‍্যক্তিবোধের সংকট। স্রষ্টার দ্বান্দ্বিকতা তাঁর সৃষ্টির উচাটন নিয়ে। ভাবনার বন্দিদশা থেকে বিষয় বা অনুভূতিকে মুক্ত করার জন্যে অস্থির হয়ে ওঠা। ভেতরে ভেতরে নৈঃশব্দ্যের আলোড়ন। শব্দহীন সেই জ‍্যোৎস্নাকে যিনি দেখে ফেললেন, তাঁর আর বন্দী থাকার কোনও উপায় নেই। সমস্ত অর্থের বন্ধন থেকে স্বাধীনসত্তায় উন্মোচিত হওয়ার জন্যে শুরু হয় আক্ষরিক প্রচেষ্টা। শব্দ ছুটে চলেছে পরিব্রাজকের হাত ধরে। কবি তিনিই, যিনি সেই ব্রহ্মাণ্ডচেতনার উৎসঙ্গী হয়েছেন, যেখান থেকে তিনি দেখতে পান–

'নিমপাতা জমে উঠছে চাঁদের উপর
পিঠের ঝুড়িতে মেঘ
নিঝুম তুলসীর কোণে বিকেলের ছায়া
ভাঙা আদরের মত কেউ কেউ ফিরে আসে অন্যেরা
চিনেবাদামের ঠোঙা ফুলিয়ে ফাটায়'
(দোলনচাঁপা চক্রবর্তী)

এত এত ছবি, দৃশ্য থেকে কল্প, থেকে চিত্রছায়া, আমরা যে জুড়তে দেখলাম তাতে কি আমাদের কোনও মানসিক পীড়া ঘটলো, নাকি চোখ বুজলে আমরাও অনুভব করতে পারছি, আহা! এমন করে তো আগে কখনও দেখিনি!? এই-ই হল অসম্ভবের বাস্তবতা। আগে কখনও ঘটেনি, কিন্তু আগামীতে ঘটবে।

#

এভাবেই বলা যায় চেতনারও একটা নিজস্ব বাস্তবতা রয়েছে, ভাষা রয়েছে, তাকে ধরতে হবে সংবেদনা দিয়ে। মনের দরজা খুলে সামনে এসে দাঁড়াও, দেখো কে এসেছে অতিথি হয়ে, তাকে বসতে দাও মননে। আসন দাও। পাশে বসো। বাতাসমুখো করে কান পাতো, দেখো, শোনো। এদুটোই আসল। ইন্দ্রিয় জাগ্রত হলে তবেই সে ধরা দেবে। তোমার ভেতরে বেজে উঠবে আরেক সুর। তখন তুমিও গাইছ বা তাকিয়ে দেখছ–

'এক অবাকজংশনে উড়ে যাচ্ছে ওড়না
ডাকি
মনেহয় রাস্তাগুলো বড় হয়ে যাবে
জোনাকি বড় হয়ে চলে যাবে'…
(স্বপন রায়)

আমরা তো চাইছি রাস্তাটা বড় হোক, প্রসারিত হোক, বিন্দু আলো এক আকাশ সূর্য হয়ে উঠুক‌। তবে শব্দ যদি ভিড়ের যাত্রী হয়, তাহলে আলো এবং পথ ভিড়েই হারাবে। অর্থাৎ, কোলাহল থেকে উত্থিত ধ্বনির মধ্যে সৃষ্টির উৎস সন্ধান করা বৃথা। সেখানে চেতনার অভিনিবেশ কম। খুব নিঃশব্দে নীরবে ভাষাকাঠামোর মধ্যে এক একটা জন্মমুহূর্ত তৈরি হয়। আবার এক একটা মুহূর্ত বারবার জীবনের স্বাভাবিক গ্রাহ‍্যতা নিয়েই নতুন আদল পেতে চায়, প্রত‍্যাশায় অধীর হয়।

#

জীবনানন্দ মনে বসিয়েছিলেন, 'বৈজ্ঞানিক প্রবর্তনার পথেই মানুষের হৃদয়ের পরিবর্তনের সম্ভাব্যতা'। তো হৃদয়ের পরিবর্তন হোক বা না হোক, যুগে যুগে মুখের ভাষার পরিবর্তন ঘটেই চলেছে। আর মুখ যখন বদলাচ্ছে, মনের মধ্যেও নিশ্চয়ই নতুন নতুন কথার, ভাষার, বুদবুদ উঠছে !

আবেগ যদি যুক্তিকে গ্রাস না করে ফেলে, যদি উন্মীলনের পথে বাধা হয়ে না দাঁড়ায়, তাহলে শব্দের গর্ভ জাগবেই। প্রবল কামনায় জেগে আছে চরাচরে পরিব্রাজকের ব্রহ্মবীজ। ওরা যে মিলতে চায় সঙ্গ-আসঙ্গ-নিঃসঙ্গতায়। ওখানেই–

'এবং'- শব্দটি ঝুলে আছে দুঃখের উপর

সে বলছে:

নামাও আমারে নামাও বন্ধু !
এরপর ফাঁস এঁটে গেলে
মৃত্যু হবে অব‍্যয়ের, নির্ভাবনা-ভাবনা, নিদ্রা-অনিদ্রার।'
(নারায়ণ মুখোপাধ্যায়)

এই নৈঃশব্দ্যের ভাষা যিনি বুঝবেন, যিনি নিশ্চেতনা থেকে চেতনাকে উদ্ধার করতে পারবেন, তিনিই হয়তো দেখতে পাবেন– ধূ ধূ বালির চরায় এক সন্ন্যাসী ঝিনুক। দেখছে, ধীরপা, ধীরসমুদ্রের দিকে। তার পা থেকে লালা ঝরছে, রক্তলালা। লালটুকু শুষে নিয়েছে সমস্ত বালুকণা। বালু থেকে বালি– লক্ষ লক্ষ কণার মধ্যে যে অভ্রবীজ, তাকেই ঘরে তুলছে ঝিনুকপা, শক্ত খোলের মত সংসার– আর সেই ঘরে জমতে জমতে ঘর, জমতে জমতে মুক্তোদ‍্যুতি। আকাড়া মুক্তোরা ঘুমিয়ে আছে নৈঃশব্দ্যের পাহারায়।

এই বুঝি ভ্রমণকাতর সন্ন্যাসীর পরমতাসন্ধান ! সন্ন্যাসীমোড়কে যতটুকু বাইরের সীমাবোধ টানা, তা অতি তুচ্ছ। ভেতরে যে অসীম খেলছে অভ্র নিয়ে, অভ্রবীজ নিয়ে! লক্ষাতীত লক্ষ বালির মধ্যে সেই অভ্রতাপ…!

1 comments:

1

প্রবন্ধ - রঞ্জন রায়

Posted in

প্রবন্ধ


আমি বাঁচতে চাই
রঞ্জন রায়


ক'দিন আগের একটি খবর আমায় ভাবিয়ে তুলছে। আমি বিভ্রান্ত, আমি রেগে যাচ্ছি। গায়ে পড়ে বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে তর্ক করছি, সেটা ক্রমশ চেঁচামেচি ও ঝগড়ায় গড়াচ্ছে। সবাই আমার ব্লাড প্রেসার মাপতে চাইছে।

খবরটি এ’রকম…

মহামান্য সুপ্রীম কোর্ট কিছুদিন আগে নিজেদের দেওয়া মৃত্যুদণ্ডের রায় খারিজ করে মুক্তি দিয়েছেন ছ’জন খুনের আসামীকে। শুধু তাই নয়, মহারাষ্ট্র সরকারকে নির্দেশ দিয়েছেন তাদের প্রত্যেককে পাঁচলক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দিতে। ভাবা যায়!

ঘটনাটি হলঃ-

আজ থেকে ১৬ বছর আগে মহারাষ্ট্রের নাসিকের কাছে একটি জনপদে ত্রম্ব্যক সাতোতের পরিবারের চারজন নৃশংসভাবে খুন হয়। পুলিশ অচিরেই খুনিদের ধরে ফেলে। তারা হল বদর নামের একটি ভবঘুরে জনজাতির ছয়জন সদস্য। অম্বাদাস শিন্দে, বাপু শিন্দে, রাজ্য শিন্দে, রাজু শিন্দে ও আরও দু’জন।

পাবলিক প্রসিকিউটর কেস সাজিয়েছিলেন খুব যত্ন করে। খুনি, খুনের হাতিয়ার, খুনের মোটিভ সব দিনের আলোর মত স্পষ্ট। এই ভবঘুরে গরীবগুর্বো লোকগুলো নিরক্ষর, অসংস্কৃত। গাঁইতি কোদাল ওদের পোশাকের অঙ্গ। কেননা ওরা এখানে সেখানে ঘুরে দিনমজুরি করে -- পাথর ভাঙা, নর্দমা সাফ, ক্ষেতের আগাছা ওপড়ানো—এই সবই।

ঘটনার দিন রাত্তিরে ওরা বাড়িটির কাছে মদ খেয়ে লুটপাটের উদ্দেশ্যে ত্রম্ব্যক পরিবারের বাড়িতে ঢোকে। সেখানে মহিলাশুদ্ধু সবাইকে কোদাল পেটা করে হাজার তিনেক টাকা কেড়ে নেয়, ওদের রান্না করা খাবার খেয়ে ফেলে। এই নয়, একটু পরে ওরা আবার ফিরে আসে। সবাইকে মারে মেরে ফেলার জন্যে, যাতে কেউ সাক্ষী না থাকে। তার আগে দুই মহিলাকে বাইরে টেনে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে। ছ’জনের মধ্যে চারজন মারা যায়। দু’জন আহত মহিলা মরণাপন্ন অবস্থা থেকে বেঁচে ওঠে। তারা পুলিশের শনাক্তকরণ প্যারেডে গিয়ে অভিযুক্তদের স্পষ্ট শনাক্ত করে।

ব্যস, কেস এয়ারটাইট। নিম্ন আদালত থেকে হাইকোর্ট, সুপ্রীম কোর্ট, সবাই সহমত যে এই নৃশংস ঘটনাটি ‘রেয়ারেস্ট অফ দ্য রেয়ার’ শ্রেণীতে পড়ে। আর কোনও ‘মিটিগেটিং ফ্যাক্টর’ও দেখা যাচ্ছে না যে! এবার বিচারকদের সমাজের কাছে সঠিক এবং সময়োপযোগী বার্তা পাঠাতে হবে। তাই সবাইকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হল । এই রায় বহাল রইল নিম্ন থেকে উচ্চ এবং সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত। শুধু তাই নয়, হাইকোর্ট তিনজনের শাস্তি কম করে যাবজ্জীবন করে দিয়েছিলেন। আপিল শুনে মহামান্য সুপ্রীম কোর্ট তাদের শাস্তিও বাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড করে দিলেন। অভিযুক্তরা অবশ্য গোড়া থেকেই নির্দোষ বলে দাবি করছে। তা, কোন অপরাধী কবে নিজের দোষ স্বীকার করে?

এই গোটা প্রক্রিয়ায় লেগে গেল ১৬ বছর। এরা ক্লান্ত হয়ে অপেক্ষা করছে কবে ফাঁসি হবে, আমরা ভাবি – আর কত দেরি? আপদ-বালাই চুকেবুকে যাক।

এর মধ্যে একজনের ছেলে মারা গেছে; আরেকজনের বৌ গিয়ে অন্যের ঘরে উঠেছে। বাচ্চাগুলোর স্কুলে যাওয়া হল না, এখন ওরা যুবক এবং বাপের মতই অশিক্ষিত জনমজুর। এদের মাটির ঘরগুলো ভেঙে গিয়ে এখন সাপখোপের আড্ডা। এদের বৌ-বাচ্চা ঘুমোয় খোলা আকাশের নিচে, চটের বস্তা বিছিয়ে।

তা এর জন্যে আপনি-আমি কী করতে পারি? আমরা কি ওদের লুটপাট করতে, খুন করতে, রেপ করতে বলেছিলাম?

আর ষোল বছর ধরে আইন চলেছে আইনের পথে। নিম্ন থেকে উচ্চ, শেষে সর্বোচ্চ—সমস্ত আদালতের আইন জানা অভিজ্ঞ জ্ঞানীগুণী মহামান্য বিচারকের দল দেখে-শুনে-ভেবে-বুঝে এদের শেষমেষ সবচেয়ে কড়া শাস্তিটি দিয়েছেন। আমরা বরং কাজী ও কোটালকে ধন্যবাদ দেব যে ওঁরা যেভাবে নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্বপালন করেছেন, তাতে আমার মত সাধারণ এবং ফেকলু পাবলিকের দল নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারে।

লেকিন স্যার, ইয়াহাঁ কহানি মেঁ টুইস্ট হ্যায়।

সাত ফেব্রুয়ারি ২০১৯ তারিখে সূর্য বোধহয় পশ্চিমে উদিত হইয়াছিল। সেদিন শীর্ষ আদালত নিজেদের আগের রায় পালটে দিয়ে ফাঁসির অপেক্ষায় ১৬ বছর ধরে দিন গুণতে থাকা ছ’জনকে শুধু নির্দোষই ঘোষণা করেননি, ক্ষতিপূরণ এবং মিথ্যে মামলায় ছ’জনকে প্রায় ঝুলিয়ে দেওয়ার অপরাধী পুলিশ অফিসারদের বিরুদ্ধে স্টেপ নিতে বলেছেন।

আসামীপক্ষের উকিল গোড়া থেকেই বলে আসছিল যে দিস হ্যাজ বীন আ বচড ইনভেস্টিগেশন। পুলিশ এবং প্রসিকিউশন প্রত্যক্ষদর্শী মা এবং মেয়ের একটি মূল্যবান সাক্ষ্যকে গুরুত্ব দেয়নি। ওই ধর্ষিত এবং প্রাণঘাতী হামলায় আহত দুই মহিলা প্রথমেই থানায় গিয়ে দাগি অপরাধীদের ফাইল দেখে নিজের থেকেই চারজনকে চিহ্নিত করেছিলেন। পুলিশ তাদের গ্রেফতারও করেনি এবং বয়ানও নেয়নি । কেন? কাদের আড়াল করতে এই খেলা?

আইডেন্টিফিকেশন প্যারেডে তাহলে কি ওরা পুলিশের ‘আগে থেকে শিখিয়ে দেওয়া’ লোকেদের থেকে আঙুল তুলেছিল?

আশ্চর্য, পুলিশ না হয় তাদের কোনও গোপন অ্যাজেন্ডায় এভাবে ফলস কেস সাজিয়েছিল, কিন্তু তিন স্তরের মহামান্য আদালত? তাঁরা কী করলেন?

সবারই মনে পড়বে, কলকাতার চোদ্দ বছরের কিশোরীর রেপ ও হত্যায় অভিযুক্ত ধনঞ্জয় চ্যাটার্জির ফাঁসি। পেশায় লিফটম্যান ধনঞ্জয়ও নিজেকে নির্দোষ বলেছিল। ইদানীং কলকাতার ইণ্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিট্যুটের দুই গবেষক অধ্যাপক ওই মামলার চুলচেরা বিচার করে দেখিয়েছেন যে তথ্য ও বিশ্লেষণের আলোয় মামলাটি ধোপে টেকে না।

মনে পড়ছে, কীভাবে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ঊর্দূ ভাষার অধ্যাপক গিলানী পার্লিয়ামেন্ট হামলা কেসে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছিলেন, পরে দর্শনের অধ্যাপক নির্মলাংশু মুখার্জি ও আরও অনেকের প্রয়াসে দিল্লি উচ্চ আদালত তাঁকে বেকসুর ঘোষণা করে মুক্ত করে দেয়।

আমি ভাবি, শাস্তি কম-বেশি হওয়া বোঝা গেল, টেকনিক্যাল কারণে (ধরুন, ফর দ্য ল্যাক অফ সাফিশিয়েন্ট এভিডেন্স) মুক্তি পাওয়া বুঝলাম, কিন্তু আজ যাকে মৃত্যুদণ্ড দিচ্ছি, কাল তাকে ‘সম্পূর্ণ নির্দোষ’! তবেই বুঝুন সহায়সম্বলহীন গরীব মানুষকে মিথ্যে কেস খাইয়ে জেলে পাঠানো, ঝুলিয়ে দেওয়া কত সহজ! দেখুন না, আরুষি তলওয়ার হত্যা মামলায় বাবা-মা (ডাক্তার দম্পতি) কেমন ভাবে লড়ে যাচ্ছেন ভুল জাজমেন্টের বিরুদ্ধে। কিন্তু ওঁরা যদি গরীব হতেন!

বলছি এই জন্যে যে বিভিন্ন কমিশন বা রিসার্চ ছাড়াও প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি আব্দুল কালামের উপলব্ধি হয়েছিল যে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত নাগরিকদের নব্বই শতাংশের বেশি মানুষ হয় গরীব, নয় অন্ত্যজ বা অল্পসংখ্যক সম্প্রদায়ের।

তাবলে কি দেশে আইন কানুন তুলে দিতে হবে? স্পেয়ার দ্য রড, স্পয়েল দ্য চাইল্ড—নীতিটি কি ভুল?

আচ্ছা, আজ তো স্কুলে কর্পোরাল পানিশমেন্ট বন্ধ হয়েছে, শাস্তিযোগ্য অপরাধের মধ্যে গণ্য হয়েছে,-- তাহলে যাবজ্জীবন কারাবাস রেখে প্রাণদন্ড তুলে দিলে কেমন হয়?

এক, আধুনিক রাষ্ট্র কী করে ‘খুন কা বদলা খুন’ নীতি মানতে পারে?

এতে কি অপরাধ কমে? ভারতে কমেছে? আমেরিকায়? আর ‘আই ফর অ্যান আই’ তো বর্বর সমাজের আইন। আর যেসব উন্নত দেশগুলো প্রাণদণ্ড তুলে দিয়েছে (তারাই মেজরিটি) তাদের দেশে কি অপরাধের বাড়-বাড়ন্ত?

দুই, রাষ্ট্র যখন কারও প্রাণ দিতে পারে না, তো নিতে আসে কোন আক্কেলে?

ওই, এবং আরও অনেক ভুল কেস, ভুল শাস্তির বলিদের কী করে জাস্টিস দেওয়া যাবে? কারও প্রথম জীবনের অমূল্য ১৬ বছর ফিরিয়ে দেয়া যায়? যার ঘর ভেঙে গেছে? আর যে নির্দোষ মরে গেছে? তার বৌ-বাচ্চাকে কী বলে সান্ত্বনা দেবেন?

এবার ভাবুন, ওই দণ্ডিতদের কেউ যদি আপনার আমার কেউ হত ? বালাই ষাট, এখনও হয় নি, কিন্তু যদি ভবিষ্যতে হয়?

1 comments:

1

প্রবন্ধ - মনোজিৎকুমার দাস

Posted in

প্রবন্ধ


বৈদিক যুগের নারী ঋষিরা
মনোজিৎকুমার দাস


পৃথিবীর প্রাচীনতম ধর্মগুলোর মধ্যে হিন্দুধর্ম অন্যতম। হিন্দুধর্মের বৈদিক যুগের (প্রায় খৃষ্টপূবার্ব্দ ১১০০- ৫০০) জ্ঞানবান পুরুষ সাধকদেরকে বলা হত ঋষি। অন্যদিকে, জ্ঞানঋদ্ধা নারী সাধিকাদের বলা হত ঋষিকা (নারী ঋষি)। বৈদিকযুগের নারী ঋষিদের বৈদিক দর্শন, ভাবনাচিন্তা,জ্ঞানগরিমা, প্রজ্ঞার পরিচয় উপস্থাপনের আগে বেদ সম্পর্কে আলোচনা করা একান্ত প্রয়োজন বলে মনে করি।

বেদ প্রাচীন ভারতের হিন্দুধর্মালম্বীদের একাধিক ধর্মগ্রন্থের একটি সমষ্টি। বেদের অর্থ জ্ঞান। বৈদিক সংস্কৃত ভাষায় রচিত বেদ সংস্কৃত সাহিত্যের প্রাচীনতম হিন্দু ধর্মগ্রন্থ। বেদকে “অপৌরুষেয়” (মানুষের দ্বারা রচিত নয়) বলা হয়। বেদ প্রত্যক্ষভাবে ঈশ্বর কর্তৃক প্রকাশিত হয়েছে। তাই বেদের অপর নাম “শ্রুতি”(যা শোনা হয়েছে)। বেদ বা শ্রুতি চারটি প্রধান সংকলন সংহিতা নামে এক সময় লিপিবদ্ধ হয়। বেদের নির্দেশিত বিধিবিধানের দ্বারা প্রাচীন ভারতে বৈদিক যুগ পরিচালিত হত।

বেদ চার ভাগে বিভক্ত ঋক, সাম, যজু ও অথর্ব। ঋগ্বেদ ১০টি মণ্ডলে বিভক্ত, যা ১০২৮টি বৈদিক সংস্কৃত সূক্তের সমন্বয়। ঋগ্বেদ মোট ১০,৫৫২টি ঋক বা মন্ত্র বা স্তুতি রয়েছে। ঋক বা স্তুতির সংকলন হল ঋগ্বেদ সংহিতা। ঋগ্বেদ ঈশ্বর, দেবতা ও প্রকৃতির স্তুতি করা হয়েছে। বেদের চারটি অংশ মন্ত্র বা সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক ও উপনিষদ। মন্ত্রাংশ প্রধানত পদ্যে রচিত, কেবল যজুঃসংহিতার কিছ অংশ গদ্যে রচিত। এটাই বেদের প্রধান অংশ। এতে আছে দেবস্তুতি, প্রার্থনা ইত্যাদি। ঋক মন্ত্রের দ্বারা যজ্ঞে দেবতাদের আহ্বান করা হয়, যজুর্মন্ত্রের দ্বারা তাঁদের উদ্দেশে আহুতি প্রদান করা হয় এবং সামমন্ত্রের দ্বারা তাঁদের স্তুতি করা হয়। ঋগ্বেদে প্রায় ৩০ জন নারী ঋষি বা ঋষিকা’র নাম পাওয়া যায়।(১)

বৈদিকযুগে নারী ঋষিদের কালপর্বের কথা বলতে গিয়ে উপনিষদ সম্পর্কে আলোচনা করা একান্তই প্রাসঙ্গিক। উপনিষদের অপর নাম বেদান্ত। উপনিষদগুলোতে সত্য ব্রহ্মের প্রকৃতি এবং মানুষের মোক্ষ বা আধ্যাত্মিক মুক্তিলাভের উপায় বর্ণিত হয়েছে। উপনিষদগুলো মূলত বেদের ব্রাহ্মণ ও আরণ্যক অংশের শেষ ভাগে পাওয়া যায়। "ব্রহ্ম" ও "আত্মা" শব্দ দুটি উপনিষদে উল্লিখিত হয়েছে। ব্রহ্ম হলেন বিশ্বের সত্ত্বা আর আত্মা হলেন ব্যক্তিগত সত্ত্বা। ব্রহ্ম শব্দটি "ব্র" শব্দ থেকে এসেছে, যার অর্থ "বৃহত্তম"। ব্রহ্ম হলেন "স্থান, কাল ও কার্য-কারণের অতীত এক অখণ্ড সত্ত্বা। তিনি অব্যয়, অনন্ত. চিরমুক্ত, শ্বাশত, অতীন্দ্রিয়।" আত্মা বলতে বোঝায়, জীবের অন্তর্নিহিত অমর সত্ত্বাটিকে। উপনিষদের মন্ত্রদ্রষ্টাদের মতে, আত্মা ও ব্রহ্ম এক এবং অভিন্ন। এটিই উপনিষদের সর্বশ্রেষ্ঠ মতবাদ। বৃহদারণ্যক ও ছান্দোগ্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপনিষদ, এই দুটি উপনিষদ দর্শনের দুটি প্রধান শাখার প্রতিনিধিত্ব করে। বৃহদারণ্যকে "নিষ্প্রপঞ্চ" বা জগতের অতীত বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। ছান্দোগ্যতে "সপ্রপঞ্চ" বা জাগতিক বিষয়গুলি আলোচিত হয়েছে। এদুটির মধ্যে বৃহদারণ্যক প্রাচীনতর। তবে কিছু কিছু অংশ ছান্দোগ্যের পরেও রচিত হয়। উপনিষদের রচয়িতা হিসাবে একাধিক ব্যক্তির নাম পাওয়া যায়। প্রাচীন উপনিষদগুলোতে যাজ্ঞবল্ক্য ও উদ্দালক আরুণির কথা পাওয়া যায়। অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ লেখকরা হলেন শ্বেতকেতু, শাণ্ডিল্য, ঐতরেয়, পিপ্পলাদ ও সনৎকুমার। মহিলাদের মধ্যে উপনিষদে কয়েকজন মহিলা ঋষির নাম আছে। তাঁদের মধ্যে গার্গী এবং যাজ্ঞবল্ক্যের পত্নী মৈত্রেয়ীর নাম বিশেষভাবে উল্লেযোগ্য।

ব্রাহ্মণ মূলত বেদমন্ত্রের ব্যাখ্যা। এটি গদ্যে রচিত এবং প্রধানত কর্মাশ্রয়ী। আরণ্যক কর্ম-জ্ঞান উভয়াশ্রয়ী এবং উপনিষদ বা বেদান্ত সম্পূর্ণরূপে জ্ঞানাশ্রয়ী। বেদের বিষয়বস্তু সাধারণভাবে দুই ভাগে বিভক্ত কর্মকাণ্ড ও জ্ঞানকাণ্ড। কর্মকাণ্ডে আছে বিভিন্ন দেবদেবী ও যাগযজ্ঞের বর্ণনা এবং জ্ঞানকাণ্ডে আছে ব্রহ্মের কথা। কোন দেবতার যজ্ঞ কখন কিভাবে করণীয়, কোন দেবতার কাছে কি কাম্য, কোন যজ্ঞের কি ফল, ইত্যাদি কর্মকাণ্ডের আলোচ্য বিষয়। আর ব্রহ্মের স্বরূপ কি, জগতের সৃষ্টি কিভাবে হয়েছে, ব্রহ্মের সঙ্গে জীবের সম্পর্ক কি, এসব আলোচিত হয়েছে জ্ঞানকাণ্ডে। জ্ঞানকাণ্ড বেদের সারাংশ। এখানে বলা হয়েছে যে, ব্রহ্ম বা ঈশ্বর এক, তিনি সর্বত্র বিরাজমান, তাঁরই বিভিন্ন শক্তির প্রকাশ বিভিন্ন দেবতা। জ্ঞানকাণ্ডের এই তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করেই পরবর্তীকালে ভারতীয় দর্শনচিন্তার চরম রূপ উপনিষদের বিকাশ ঘটেছে।

এসব ছাড়া বেদে অনেক সামাজিক বিধিবিধান, রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা, শিল্প, কৃষি, চিকিৎসা ইত্যাদির কথাও আছে। এমনকি সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের কথাও আছে। বেদের এই সামাজিক বিধান অনুযায়ী সনাতন হিন্দু সমাজ ও হিন্দুধর্ম রূপ লাভ করেছে। হিন্দুদের বিবাহ, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া, ইত্যাদি ক্ষেত্রে এখনও বৈদিক রীতিনীতি যথাসম্ভব অনুসরণ করা হয়।

ঋগ্বেদ থেকে তৎকালীন নারীশিক্ষা তথা সমাজের একটি পরিপূর্ণ চিত্র পাওয়া যায়। অথর্ববেদ থেকে পাওয়া যায় তৎকালীন চিকিৎসাবিদ্যার একটি বিন্তারিত বিবরণ। এসব কারণে বেদকে শুধু ধর্মগ্রন্থ হিসেবেই নয়, প্রাচীন ভারতের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ, সাহিত্য ও ইতিহাসের একটি দলিল হিসেবেও গণ্য করা হয়।

বৈদিকযুগের মহিলাদের বুদ্ধিবৃত্তি এবং আধ্যাত্মিক সাফল্য বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। প্রথমেই বৈদিকযুগের প্রথম দিকের নারীদের বিদ্যালাভ ও ধর্মাচরণের যে ইতিবৃত্ত জানা যায় সে সম্বন্ধে আভাস দেওয়া যেতে পারে। নারীদের মধ্যে দুই শ্রেণির বিদ্যার্থিনী ছিলেন। এক শ্রেণি ব্রহ্মবাদিনী, আর এক শ্রেণি সন্ন্যাসিনী।

নারীদের যে পুরুষদের সাহায্যকারী ও সম্পূরক হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছে, তা বৈদিক যুগের স্তোত্রাদির মধ্যে প্রকাশ পায়। বৈদিক যুগের যে সব নারী ঋষিদের প্রজ্ঞা, জ্ঞান, বুদ্ধি, বিবেক ও আধ্যাত্মিকতার দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়, তাদের মধ্যে নাম করতে হয় লোপামুদ্রা, মৈত্রেয়ী, গার্গী,ঘোষা, অদিতি, ব্রহ্মজায়া, পৌলমী, অপালা, বাক, অপত্ত, কত্রু, বিশ্বম্ভরা, জুহ, রোমাশা, মেধা, নিষৎ, সবিতা, শিক্তা, ভগস্ত্রীনি, যরিতা, শ্রদ্ধা,উর্বশী, স্বর্লগা, ইন্দ্রানী, দেবায়নী, কক্ষিবতী, দক্ষিণা, ইত্যাদি। এদের মধ্যে কয়েকজন নারী বৈদিক ঋষি ঈশ্বরের স্তুতিস্তোত্র রচনা করে তাঁদের প্রজ্ঞার প্রমাণ রাখেন। তাদের মধ্যে ঘোষা, লোপমূদ্রা, মৈত্রেয়ী, গার্গী, প্রমুখ বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্যা।(২)

নারী ঋষিদের রচিত স্তোত্রগুলোকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে। প্রথম ভাগে স্তোত্রগুচ্ছের নারী ঋষিদের মধ্যে বিশ্বম্ভরা ও অপালা নারী ঋষির কথা বলতে হয়। বিশ্বম্ভরা তাঁর স্তোত্রগুলো অগ্নি দেবতাকে উৎসর্গ করেন। অন্যদিকে অপালা তাঁর স্তোত্রগুলোকে ইন্দিরাকে উৎসর্গ করেন। দ্বিতীয় গুচ্ছের স্তুতি ও স্তোত্র বিশেষ করে লোপামুদ্রা, শশীয়সি ও অন্যান্য নারী ঋষির রচনা। লোপামুদ্রার স্তোত্রে ছয়টা সূক্ত রাত্রি দেবীকে উৎসর্গীকৃত। নারী ঋষি বিশ্বম্ভরার একটি লেখায় উল্লেখ আছে কিছু কিছু বৈদিক স্ত্রোত্র অত্রি কন্যা অপালা, কাক্ষিবানের কন্যা ঘোষা এবং ইন্দ্র ঋষির পত্নী ইন্দিরার নামে উৎসর্গীকৃত। এ থেকে উপলব্ধি করা যায় বৈদিক যুগের ঊষালগ্নে নারীরা বেদ অধ্যায়ন ও বেদের বিধিবিধান পালনে নিবেদিতা ছিলেন। বৈদিকযুগে যে সমস্ত নারী সারাজীবন কুমারীত্ব গ্রহণ করে বেদ অধ্যায়ন, বেদচর্চা এবং বৈদিক ধর্ম পালনে ব্রতী থাকতেন, তাঁদের ব্রহ্মবাদিনী বলা হত। পাণিনি আচার্য্য ও আচার্য্যানী এবং উপাধ্যায় ও উপাধায়িনী সম্বন্ধে ব্যাখ্যা দান করেন। আচার্য্যের পত্নী আচার্য্যানী এবং উপাধ্যয়ের পত্নী শিক্ষার্থীদের বেদের পাঠদান করতেন। তাঁর মতে কাথি, কলাপী, বাহভিচি ইত্যাদি নামে বেশ কয়েকজন জ্ঞানবতী নারী পণ্ডিত ছিলেন।।

ঋগ্বেদে অগস্ত্য ঋষির সঙ্গে তাঁর পত্নী লোপামুদ্রার দীর্ঘ আলাপআলেচনার কথা লিপিবব্ধ আছে। তা থেকে উপলব্ধি করা যায়, লোপামুদ্রা অত্যন্ত বুদ্ধিমতী ও জ্ঞানঋদ্ধা ছিলেন। তিনি এক সময় স্বামীর কাছ থেকে অনেক অনেক জ্ঞানের অধিকারিনী হন। কথিত আছে, লোপামুদ্র ঋষি অগস্ত্যর বরে রাজা বিদর্ভের এক কন্যা হিসাবে জন্মগ্রহণ করেন। রাজদম্পতি তাঁদের কন্যাকে বিলাসব্যাসনের মধ্যে রেখে লেখাপড়ায় সুশিক্ষিত গড়ে তোলেন। তারপর এক সময় লোপামুদ্রা বিয়ের বয়সী হলে ঋষি অগস্ত্য কৌমার্য ব্রত ভঙ্গের জন্য দারিদ্র সত্ত্বেও লোপামুদ্রাকে বিবাহ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। লোপা ঋষি অগস্ত্যকে বিবাহ করতে রাজি হন। বিবাহের পর তিনি অগস্ত্যের আশ্রমে গমন করেন। দীর্ঘদিন যাবত আনুগত্যের সঙ্গে স্বামী সেবা করার পর লোপা স্বামীর কঠোর তপস্যার সঙ্গী হয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েন। ড. রমেশচন্দ্র মুখোপাধায়েরর মতে, লোপামুদ্রার স্তোত্রে বলা হয়েছে, পুরুষের নারীর সান্নিধ্য লাভ প্রয়োজন। এমনকি অতীতের ঋষিরা দেবতাদের তপস্যা করা সত্ত্বেও জায়াদের প্রতি অনীহা দেখাননি। কিন্তু লোপামুদ্রার স্বামী ঋষি অগস্ত্য তাঁর পত্নীর প্রতি যৌন নিস্পৃহতা প্রদর্শন করায় লোপামুদ্রা এ বিষয়ে দুটো সংস্কৃত ভাষার কবিতাগুচ্ছে তাঁর মনের হতাশা ব্যক্ত করেন যার ইংরেজি ভাষান্তর: Lopamudra: For many autumns have I been laboring, evening an morning, through the aging dawns. / Old Age diminishes the beauty of bodies. Bullish men should now come to their wives.

Lopamudra: For even those ancients who served truth and at one with the gods spoke truths, /even they got out of harness for they did not reach the end. Wives should now unite with their bullish (husbands) (৩)

অবন্তী সান্যালের লেখা ‘হাজার বছরের প্রেমের কবিতা’ গ্রন্থের সুশীলকুমার দে অনূদিত লোপামুদ্রার লেখা স্বামীর মনোযোগ ও ভালবাসা না পাওয়ায় তাঁর আবেগ, অনুভূতি ও আক্ষেপ প্রকাশ করেন তারই বহিঃপ্রকাশ বলে মনে হয় নিচের দুটো স্তবককে।

আক্ষেপ
দিবস রজনী শ্রান্ত আমারে দীর্ঘ বরষ র্জীর্ণ করে,
প্রতি ঊষা হয়ে কায়ার কান্তি,
---- আসুক পুরুষ নারীর তরে।

দেব -- সম্ভাষী সত্যপালক পূর্ব ঋষিরা, তাদের ঘরে
ছিল জায়া, তবু ছিল তপস্যা
--- যাক নারী আজ পুরুষ তরে।(৪)

এক সময় ঋষি অগস্ত্য তাঁর স্ত্রীর প্রতি দায়দায়িত্বের কথা উপলব্ধি করে গার্হস্থ্য ও তপস্যী জীবন সমান ভাবে পালন করতে থাকেন। ফলে তাঁর মধ্যে আধ্যাত্মিক ও শারিরীক ক্ষমতার প্রকাশ ঘটে। তাঁদের একটি পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করে। তার নাম রাখা হয় দ্রিধাস্যু, তিনি পরে একজন বিখ্যাত কবি হন।

ঋগ্বেদে লোপামুদ্রার ১৭৯ সংখ্যক স্তোত্রের সন্ধান পাওয়া যায়। রাত্রি দেবীকে নিবেদিত লোপামুদ্রার রচিত ছয়টি ছন্দোবদ্ধ স্ত্রোত্রেরও সন্ধান পাওয়া যায়। ঋগ্বেদে অগস্ত্য এবং লোপামুদ্রা মন্ত্রদ্রষ্টা হিসাবে বিবেচিত হন। লোপমুদ্রা ঋগ্বেদ, যর্জুবেদ ও অন্যান্য গ্রন্থে ‘মন্ত্রদ্রিকা’ নামে পরিচিত।(৫) অন্যদিকে, বৈদিক জ্ঞানের প্রত্যাদেশপ্রাপ্ত এক ডজন মহিলার মধ্যে ছিলেন বিশ্বম্ভরা, শাশ্বতী, গার্গী, মৈত্রেয়ী, অপালা, ঘোষা,অদিতি প্রমুখ। তাঁরা ব্রহ্মাবাদিনী, বক্তা ও বেদের প্রত্যাদেশপ্রাপ্তা বলে জানা যায়।

মৈত্রেয়ী বৈদিক যুগের একজন ভারতীয় নারী হিন্দু দার্শনিক। তিনি ঋষি যাজ্ঞবল্ক্যের (খৃষ্টপূর্বাব্দ ৮ম থেকে ৭ম শতক) পত্নী ঋগ্বেদে প্রায় এক হাজর স্তোস্ত্র স্তুতি আছে তার মধ্যে মৈত্রেয়ী সম্পাদিত ১০ টি স্তোত্র রয়েছে। মৈত্রেয়ী একজন নারী ভবিষৎ দ্রষ্ট্রা ও দার্শনিক। ঋগ্বেদে উল্লিখিত আত্মা সম্পর্কে মৈত্রেয়ী বৃহদারণ্যক উপনিষদে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছেন। ভালবাসা একজনের আত্মা থেকেই আসে। তিনি তাঁর স্বামী ঋষি যাজ্ঞবল্ক্যের আধ্যাত্মিক চিন্তাভাবনা এবং সাধনার একান্ত সহযোগিনী ছিলেন। মৈত্রেয়ী ও যাজ্ঞবল্ক্যের কথোপকথনে আধ্যাত্ম বিষয়ে উঠে এসেছে, যা বৃহদারণ্যক উপনিষদে বিশেষ ভাবে লিপিবদ্ধ হয়েছে।(৬)

মৈত্রেয়ী ও কাত্যায়নী ছিলেন যাজ্ঞবল্ক্যের দুই পত্নী। মৈত্রেয়ী ছিলেন হিন্দু ধর্মশাস্ত্র সম্পর্কীয় কাব্য ও ছন্দোবদ্ধ কাব্য গুণের অধিকারিনী। তিনি ছিলেন ব্রহ্মবাদিনী। অন্যদিকে কাত্যায়নী ছিলেন সাধারণ মহিলা। একদিন যাজ্ঞবল্ক্য তাঁর পার্থিব সম্পত্তি ও সম্পদ দুই পত্নীর মধ্যে ভাগ করে দেবার সিদ্ধান্ত নিলেন তপস্যায় নিয়ত মগ্ন হবার উদ্দেশে। তিনি তাঁর পত্নীদ্বয়কে তাঁর ইচ্ছার কথা ব্যক্ত করলেন।(৭)

বুদ্ধিদীপ্তা মৈত্রেয়ী তাঁর স্বামীকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘পৃথিবীর সমস্ত সম্পদ কি অবিনশ্বর?’ ঋষি যাজ্ঞবল্ক্য প্রত্যুত্তরে বললেন, ‘সম্পদ শুধুমাত্র একজন ভোগ করতে পারে, তাছাড়া কিছুই করতে পারে না। সম্পদ অমরত্ব দান করতে পারে না।’ মৈয়েত্রীঁর তাঁর স্বামী ঋষি যাজ্ঞবল্ক্যের কাছে অর্থ, প্রাচুর্য্য, ধনসম্পত্তি, কিছুই না চেয়ে শুধু বললেন ‘যেনাহম্ অমৃতস্যাম, কিমহম্ তেন কুর্যাম?’ অর্থাৎ ‘যা আমাকে অমৃত দান করতে পারে না, তা লাভ করে আমি কি করবো?’ যাজ্ঞবল্ক্য তাঁর কথা শুনে খুশি হলেন। মৈত্রেয়ী ও যাজ্ঞবল্ক্যের কথোপকথনের কিয়দংশ এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। মৈত্রেয়ী তাঁর স্বামী ঋষি যাজ্ঞবল্ক্যকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘মহাশয়, পুরো পৃথিবী সম্পদেই পরিপূর্ণ। আমি কি তা থেকে অমরত্ম লাভ করতে পরব?’ ‘না।’ যাজ্ঞবল্ক্য বললেন। ‘এমনকি ধনীর জীবনও অমরত্ম লাভ করতে পারে না। ধন সম্পদের মধ্যে অমরত্ম লাভের কোন আশা নেই।’ মৈত্রেয়ী বললেন, ‘তাহলে ধনসম্পদ দিয়ে আমি কী করব, যা আমাকে অমরত্ম দান করবে না, মহাশয় আমাকে বলুন তাহলে আমার কী প্রয়োজন?’ যাজ্ঞবল্ক্য প্রত্যুত্তরে মৈত্রেয়ীকে বললেন, ‘অহ! প্রিয়া, তুমি কী বলছ! বসো, আমি তোমাকে সব খুলে বলছি।’

মৈত্রেয়ী যাজ্ঞবল্ককে ব্যাখ্যা করে বলার জন্য অনুরোধ করলেন। মৈত্রেয়ী ও যাজ্ঞবল্ক্য এর সংলাপের উপসংহারে ভালবাসার আলোচনায় ভালবাসার নির্যাস ব্যক্ত হল, যাতে ভালবাসা আত্মা এবং পরমাত্মার সঙ্গে সম্পৃক্ত। ‘দেখ, স্বামীকে ভালবাসলেই একজন প্রিয় স্বামী পাওয়া যায় না, স্বামীর আত্মার প্রতি ভালবাসা থেকেই একজন প্রিয় স্বামী লাভ করা যায়। পত্নীকে ভালবাসলেই একজন প্রিয়া পত্নী পাওয়া যায় না, পত্নীরর আত্মার প্রতি ভালবাসা থেকেই একজন প্রিয়া পত্নী লাভ করা যায়। একজনের প্রয়োজন হয় দর্শন, শ্রবণ, ধ্যানের সাহায্যে আত্মাকে উপলব্ধি করা। এ বিষয়ে গভীর ভাবে চিন্তাভাবনা করছো?’

মৈত্রেয়ী: ‘একজন দর্শন, শ্রবণ, ধ্যানের সাহায্যে আত্মাকে উপলব্ধি করতে পারে। তার কাছেই একমাত্র সারা পৃখিবী জ্ঞান অর্জন করা যায়।’ (৮)

যাজ্ঞবল্ক্য পূর্বাশ্রম ত্যাগ করার পর মৈত্রেয়ীও সন্ন্যাসজীবন গ্রহণ করেন। তিনি লোকজনকে আধ্যত্মিক জ্ঞানদানে ব্রতী হন। ‘মৈত্রেয়ী উপনিষদ’উদ্গাতা হিসাবে তিনি প্রশংসিতও হন। মৈত্রেয়ী বৈদিক ভারতে নারীদের শিক্ষালাভের সুযোগ এবং নারীদের দার্শনিক জ্ঞান লাভ সম্বন্ধেও অভিমত ব্যক্ত করেন। একজন বুদ্ধিদীপ্তা নারী হিসাবে তাঁর সম্মানার্থে ভারতে তাঁর নামে অনেক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়,নারী ঋষি মৈত্রেয়ীর নামে নতুন দিল্লিতে একটি কলেজ স্থাপিত হয়েছে। তামিলনাড়ুতে গড়ে উঠেছে মৈত্রেয়ী বৈদিক গ্রাম।(৯)

বৈদিক যুগের অন্যতমা নারী ঋষি গার্গী (জন্ম খৃষ্টপূর্বাব্দ ৭০০)। তিনি ঋষি বাচাক্নুর কন্যা। তাঁর পুরো নাম গার্গী বাচাক্নাবি। তিনি প্রাচীন ভারতের একজন দার্শনিক। বৈদিক সাহিত্যে তিনি প্রকৃতবাদী দার্র্শনিক সম্মানীয়া ও ব্রহ্মবাদিনী হিসাবে পরিচিতা। বৃহদারণ্যক উপনিষদে দেখা যায়, বিদেহের রাজা জনক আয়োজিত ‘ব্রহ্মজ্ঞান’ নামে দার্শনিক বিতর্কে গার্গী ছিলেন অন্যতমা অংশগ্রহণকারিনী। এই বিতর্কে যোগদান করে তিনি যুক্তি প্রদর্শন করেন। প্রখ্যাত প্রখ্যাত পণ্ডিতরা নীরব থাকলেও গার্গী যাজ্ঞবল্ক্যকে নানা প্রশ্নে জর্জরিত করেন। তিনি যাজ্ঞবল্ক্যকে আত্মা সম্পর্কে প্রশ্ন করেন, ‘একটা স্তর, উপরে আকাশ নিচে জমিন। স্তরটা জমিন ও আকাশের মাঝে অবস্থিত, যা নির্দেশ করে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের প্রতীক হিসাবে, সেই স্তর কোথায় অবস্থিত?’

প্রত্যুত্তরে যাজ্ঞবল্ক্য বললেন, ‘শূন্যে’। গার্গী তাঁর উত্তরে সন্তুষ্ট হলেন না। তিনি তাঁকে আরো আরো প্রশ্ন করলে একসময় যাজ্ঞবল্ক্য রেগে গিয়ে বলে উঠেন, ‘হে গার্গী, আর বেশি প্রশ্ন করো না, তাহলে তোমার মাথা খসে পড়ে যাবে!’ যাজ্ঞ্যবল্ক্যের কথায় গার্গী পরবর্তীতে স্বীকার করেন,ব্রহ্মবিদ্যায় যাজ্ঞবল্ক্যকে কেউ পরাজিত করতে পারবে না।(১০)

নারী ঋষি ঘোষার কথা বলতে গিয়ে বলতে হয় তিনি ছিলেন ঋঝি দীর্ঘতামসের প্রপৌত্রী আর কাক্ষিবানের কন্যা। তারা দু’জনেই অশ্বিনীকুমারদ্বয়ের উদ্দেশ্যে স্তুতি জ্ঞাপন করে গান ও স্তোত্র রচনা করেন। ঘোষা দুটো স্তোত্রসম্মিলিত দশটা পুস্তকে স্তুতি স্তোত্র রচনা করেন। প্রত্যেকটি স্তোত্রে ১৪টি করে সূক্ত তিনি রচনা করেন। অশ্বিনীকুমারদ্বয়ের উদ্দেশ্যে স্তুতি জ্ঞাপন করে গান ও স্তোত্র রচনা করেন। দ্বিতীয়টিতে তিনি তাঁর ব্যক্তিগত আবেগ, অনুভূতি আর আশার কথা এবং তাঁর বিবাহিত জীবনের আকাঙ্খার কথাও তুলে ধরেছেন।(১১)

বৈদিক যুগে আরো অনেক বুদ্ধিমতি ও আধ্যাত্মিক শক্তির অধিকারিনী নারীর সন্ধান পাওয়া যায়। তাঁদের মধ্যে অনসূয়া এমন একজন সত্যবতী নারী, যিনি তাঁর ভক্তিশ্রদ্ধার বলে একজন ঋষির অভিশাপে মৃতপ্রায় কৌশিকা ব্রহ্মাণকে পুনর্জীবিত করতে সক্ষম হন। তিনি একজন খ্যাতিমান ঋষিকে তাঁর আধ্যত্মিক শক্তির সাহায্যে পুনর্জীবিত করেছিলেন। অনসূয়া ঋষি অত্রীর পত্নী ছিলেন। অনসূয়ার মাতা ছিলেন স্বয়ম্ভুবা, আর পিতা কর্দম মুনি। অনসূয়ার খ্যাতি বৈদিক যুগের একজন ভক্তিমতী সাধিকা হিসাবে। বৈদিক যুগের প্রাথমিক অবস্থায় মেয়েদের শিক্ষালাভের বিষয়ে বিধিনিষেধ ছিল না। ছাত্রজীবন ব্রহ্মচর্য নামে অবহিত হতো। সেই যুগে অনেক মন্ত্রদ্রষ্টা নারী ঋষির সন্ধান পাওয়া যায়, যাঁদের কথা আগেও বলা হয়েছে। জুহ, শাশ্বতী, মেধা, নিষৎ, অদিতি, সবিতা, শিক্তা প্রমুখ মন্ত্রদ্রষ্টা নারী ঋষি।

এসব নারী ঋষির নাম উল্লেখের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়, তৎকালীন বৈদিক ভারতের নারী শিক্ষার ব্যবস্থা ও বিদ্যানিকেতন ছিল। সে সময় মেয়েরা ব্রহ্মচর্যাবস্থা শেষ না হওয়া পর্যন্ত বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হত না।(১২) বিবাহকালে মেয়েরা তাদের পছন্দমত স্বামী নির্বাচন করার স্বাধীনতা ভোগ করত। এই স্বাধীনতা কেবল যে রাজকন্যাগণই ভোগ করতে পারতো তা নয়, সমাজের যে কোন শ্রেণির শিক্ষিত নারীমাত্রই এই সুবিধা ভোগ করতো। ঋগ্বেদের প্রথম মণ্ডলে বলা হয়েছে, ‘হে বলবান ইন্দ্র! যেমন আকাঙ্খাবতী পত্মী আকাঙ্খাবান পতিকে প্রাপ্ত হয়, তেমনি মেধাবীগণের স্তুতি তোমাকে স্পর্শ করে।’ (১৩) এবং ‘যে স্ত্রীলোক ভদ্র, যার শরীর সুগঠন, সে অনেক লোকের মধ্য হতে নিজের মনের মত প্রিয় পাত্র কে পতীত্বে বরণ করে।’ (১৪)

ধর্মীয় কার্যাবলীতে পুরুষের পাশাপাশি নারীর অংশগ্রহণ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। নারী ও পুরুষ একসঙ্গে যজ্ঞকার্য সম্পাদন করত, এ বিষয়ে ঋগ্বেদে প্রমাণ রয়েছে, ‘হব্যপ্রদায়ী যজমান, হব্যপ্রদায়ী অধ্বর্যু প্রভৃতির সাথে ইন্দ্রকে স্বপ্রদত্ত হব্য দ্বারা অর্চনা করেন, ইন্দ্র তৃষিত মৃগের ন্যায় দ্রুতবেগে যজ্ঞস্থলে উপস্থিত হবেন। হে উগ্র ইন্দ্র! মর্তহোতা, স্ত্রোত্রাভিলাসী দেবতাগণকে স্তব করে স্ত্রী-পুরুষে যজ্ঞ নিষ্পন্ন করেছেন।’ (১৫)

নারী সেযুগে পুরুষের সঙ্গে সমানভাবে বেদচর্চা করতেন। অপালা, ঘোষা, বিশ্বম্ভরা, লোপামুদ্রা, বিশাখা, প্রভৃতি নারীরা বৈদিকযুগের আদি পর্বে বৈদিক শাস্ত্রে বিদূষী হিসাবে খ্যাতিলাভ করেছিলেন। বিবাহের ক্ষেত্রে নারীর স্বামী নির্বাচনের এবং মতামত প্রকাশের অধিকার ছিল। শস্ত্র বিদ্যাতেও নারীরা পারদর্শিতা লাভ করতেন, যুদ্ধেও যোগদান করতেন। উদাহরণস্বরূপ, বৈদিক কালের এক যুদ্ধে একজন খ্যাতনাম্নী নারী সেনাপ্রধান ছিলেন মুদ্গলনি। নারীরা জীবনের সর্বক্ষেত্রে তাঁদের স্বামীর সঙ্গিনী হতেন। ভারতীয় নারী শুধুমাত্র আর্থিক নয়, বরং পারমার্ধিক প্রগতির দিকেই অগ্রসর হতে চেয়েছেন বৈদিক যুগ থেকে। ঋদ্বেদে নারী পুরুষের সমান অধিকারের কথা ব্যক্ত হয়েছে: ‘পত্নী ও স্বামী এক এর সমান সমান অর্ধাংশ সব কাজ, ধর্ম ও নিরপেক্ষতার ক্ষেত্রে।’ (১৬) ফলে বৈদিক যুগের ঋষির পত্নীরা সহ প্রজ্ঞাবতী, তাপসী, ব্রহ্মবাদিনী নারীরা ঋষিকা হওয়ার অধিকারিণী হন। @


তথ্যসূত্র:
(১) বেদ: Wikipedia, the free encyclopedia
(২) The equals of Men by Nandita Krishnan
(৩) In the translation of the Sanskrit text of the Rigveda by Ralph T.H.Griddith(1896),
(৪) ঋগ্বেদ: লোপামুদ্রা।। আক্ষেপ: অনুবাদ: সুশীলকুমার দে: হাজার বছরের প্রেমের কবিতা--- অবন্তী সান্যাল, পৃষ্ঠা---৪১, প্রকাশক: বিশ্ববাণী, কলকাতা--৯)
(৫) Wikipedia, the free encyclopedia
(৬)বৃহদারণ্যক উপনিষদ 
(৭) The equals of Men by Nandita Krishnan 
(৮) মৈত্রেয়ী ও যাজ্ঞবল্ক্যের সংলাপ: বৃহদারণ্যক উপনিষদ ২.৪.২-৪ (৯) Wikipedia, the free encyclopedia 
(১০) The equals of Men by Nandita Krishnan 
(১১) The equals of Men by Nandita Krishnan 
(১২) অথর্ববেদ ১১/৫) 
(১৩)ঋগ্বেদ, ১/৬২/১১ 
(১৪)ঋগ্বেদ, ১০/২৭/১২) 
(১৫)ঋগ্বেদ, ১/১৭৩/২) 
(১৬) ঋদ্বেদ ৫.৬১.৮

1 comments:

0

প্রবন্ধ - ধ্রূবজ্যোতি চক্রবর্তী

Posted in

প্রবন্ধ


গীতারহস্যামৃতম  

ধ্রূবজ্যোতি চক্রবর্তী


(১৯) 

গীতা মহাগ্রন্থের বহু উচ্চমার্গের দার্শণিক তত্ত্বের যে অতি সহজ সরল ব্যাখ্যা ঠাকুরের কাছ থেকে আমরা পেয়েছি তার দিকে একটু আলোকপাত করা যাক। 

গীতা মহাগ্রন্থে যে উপদেশটি সবচেয়ে বেশী খিটকেল সাংখ্যযোগের সেই ৪৭নং শ্লোকটি একবার পড়ে নেওয়া যাকঃ 

“কর্ম্যণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন। 
মা কর্মফলেহেতুভূর্মা তে সঙ্গওহস্ত্বকর্মণি।। 

(কর্মেই তোমার অধিকার, ফলে নয়; কর্মফলার্থী হয়ো না; নৈষ্কর্মেও তোমার আসক্তি না হোক) 

ম্যাঙ্গোম্যান পটলবাবুদের কাছে ব্যাপারটা বেশ গোলমেলে। কাজ করে যেতে বলা হচ্ছে আবার কাজের শেষে যে উদ্দেশ্যে কাজটা করছি সেটার দিকে নজর দিতে মানা করা হচ্ছে। আবার একই সঙ্গে কাজ না করে নিস্কর্মা হয়ে বসে থাকতেও মানা করে হয়েছে। 

এটা যেন সেই “হ-য-ব-র-ল”-এর চন্দ্রবিন্দুর “চ”, বেড়ালের “তালিবশ্য” আর রুমালের “মা”!! 

এবার দেখা যাক পরমহংসদেব এই বিষয়ে কি বলেছেন। 

ঠাকুর বলেছেন, “সংসারে থাকবে বড়লোকের দাসীর মতো। দাসী যেমন মনিবের ছেলেমেয়েদের মানুষ করে, নিজের ছেলেপিলের মতো যত্ন করে – বলে “আমার রাম মাছের ঝোল না হলে ভাত খেতে পারে না”, কিন্তু তার মনটি পড়ে আছে দেশের বাড়িতে নিজের ছেলেমেয়ের উপর। 

অসাধারণ সহজপাচ্য ব্যাখ্যা। 

কর্তব্য কর্ম করতেই হবে। তবে মন যদি পরমাত্মায় নিবেদিত থাকে তবে কর্তব্য কর্মের ফল নিয়ে বিব্রত হবার প্রয়োজন নেই। 

বলা বাহুল্য, ঠাকুর এখানে দাসীর নিজের ছেলেকে “পরমাত্মা” আর মণিবের ছেলেকে “কর্তব্য কর্ম”-এর রূপক হিসেবে ব্যবহার করেছেন সাধারণ মানুষের উপলব্ধির জন্য। 

এই প্রসঙ্গে Management Guru-দের কথাও স্মরণ করা যেতে পারে। তাঁরা বলেন, Concentrate on your work process and give your best. Result would follow automatically.” 

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেবের আর একটি Signature উপদেশ হল “যত মত তত পথ। এই আপাত ছোট্ট কথাটির মধ্যে বিশ্ব ভাতৃত্বের চিরকালীন শান্তির বাণী লুকিয়ে আছে। আজকের এই বিশ্বব্যাপী অশান্ত সময়ে এই বাণীটিই সমগ্র বিশ্বের একমাত্র শান্তির বাণী হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। নোবেল কমিটি যদি Posthumously নোবেল পুরস্কার দেবার নিয়ম কানুনটি চালু করতেন তবে আমার মতে প্রথম নোবেল শান্তি পুরস্কারটি ঠাকুরের জন্যই বরাদ্দ হতো। 

এবার দেখা যাক এই প্রসঙ্গে মহাগ্রন্থ গীতায় কি লেখা আছে। 

গীতা মহাগ্রন্থের চতুর্থ অধ্যায় জ্ঞানযোগের ১১নং শ্লোকটি বলছেঃ 

“যে যথা মাং প্রপদ্যন্তে তাংস্তথৈব ভাজাম্যহম। 
মম বর্ত্মানুবর্তন্তে মনুষ্যাঃ পার্থ সর্বশঃ।।

(যারা যে ভাবে আমার শরণাপন্ন হয়, আমি তাদের সেই ভাবেই ভজনা (তুষ্ট – Courtesy রাজশেখর বসু ) করি। হে পার্থ, মনুষ্যগণ সর্বপ্রকারে আমার পথ অনুসরণ করে।) 

আবার জ্ঞানবিজ্ঞান যোগের ২১নং শ্লোকে কৃষ্ণের মুখে আমরা একই কথা শুনতে পাইঃ 

“যো যো যাং যাং তনুং ভক্তঃ শ্রদ্ধয়াচির্তুমিচ্ছতি। 
তস্য তস্যাচলাং শ্রদ্ধাং তামেব বিদধাম্যহম্।। 

(যে যে ভক্ত যে যে মূর্তি শ্রদ্ধার সহিত অর্চনা করতে ইচ্ছা করে, 

আমি সেই সেই ভক্তের সেইপ্রকারই (আরাধ্য মূর্তির অনু্যায়ী) অচলা শ্রদ্ধা বিধান করি) 

(২০) 

এইখানে যদি শ্রীকৃষ্ণকে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে Supreme Power হিসেবে কল্পনা করা যায় তবে সেই শক্তির উৎস স্থলের লক্ষে পৌঁছবার উপায় শরণাগত ভক্তবৃন্দের বহুবিধ হলেও শ্রীকৃষ্ণরূপী Supreme Power তাঁদের তুষ্ট করেন। অতএব পথ বিভিন্ন হলেও লক্ষ একই। 

এই পরিপ্রেক্ষিতে যদি ধ্যানযোগ অধ্যায়ের ৮নং শ্লোকটি নিয়ে আলোচনা করা যায় তবে একটু ডিটেলে যেতে হবে। কেননা ঠাকুরের আর একটি অসাধারন উপদেশ “টাকা মাটি মাটি টাকা“ মহাগ্রন্থ গীতার নিম্নলিখিত শ্লোকটিকে অত্যন্ত সহজ ভাবে ব্যাখ্যা করেছেঃ 

“জ্ঞানবিজ্ঞানতৃপ্তাত্মা কূটস্থো বিজিতেন্দ্রিয়ঃ। 
যুক্ত ইতচ্যুতে যোগী সমলোষ্টাশ্মকাঞ্চনঃ।।

এই শ্লোকটির যথার্ততা উপলব্ধি করার জন্য তিনটি ব্যাখা নিচে দেওয়া হলো। 

যদিও তিনটি ব্যাখ্যারই মূল বক্তব্য একই বলে আমার মনে হয় তবু ভাষার তারতম্যে যাতে উপলব্ধি এদিক ওদিক না হয়ে যায় তাই পাঠকবৃন্দের আপন আপন জ্ঞান ভাণ্ডারের কাছে এই তিনটি ব্যাখ্যাকেই হাজির করে দিলাম। 

স্বামী অপূর্বানন্দ, রামকৃষ্ণ মঠ, ভুবনেশ্বর,“যার মন শাস্ত্রোপদেশলব্ধ জ্ঞান ও অপোরক্ষনুভুতির দ্বারা পরিতৃপ্ত, যিনি রূপরসাদি বিষয়ের সংস্পর্শে এসে নির্বিকারচিত্ত এবং মাটি, পাথর ও সোনায় সমদর্শী, তাঁকে যোগসিদ্ধ বলা হয়।

Swami Vireswarananda, Ramkrishna Math, Madras, The Yogi whose self is satisfied through knowledge and realization, who is steady and has the senses under control, and to whom a clod of earth, a stone and gold are of equal value, is said to be steadfast.” 

রাজশেখর বসু, জ্ঞানবিজ্ঞানতৃপ্তাত্মা, কূটস্থ (স্থানু, অপ্রকম্প ((শংকর)), নির্বিকার), বিজিতেন্দ্রিয় লোষ্টপ্রস্তরকাঞ্চনে সমদর্শী যোগী (কর্মযোগী) যুক্ত – এইরূপ উক্ত হন। 

এই তিনটি ব্যাখ্যাতেই কিন্তু ঠাকুরের “টাকা মাটি মাটি টাকা” উপদেশটি উচ্চারিত হয়েছে। 

ঠাকুরের মুখে আমরা বারংবার “শুদ্ধা ভক্তি”-র কথা শুনেছি। ওনার মতে একমাত্র শুদ্ধা ভক্তির পথেই পরমাত্মার উপলব্ধি হয়। একই কথা যা মহাগ্রন্থ গীতার বিশ্বরূপদর্শন যোগে ৫৪নং শ্লোকে “অনন্যা ভক্তি” রূপে উচ্চারিত হয়েছে। 

“ভক্ত্যা ত্বনন্যয়া শক্য অহমেবংবিধোহর্জুন। 
জ্ঞাতুং দ্রষ্টূঞ্চ তক্তেন প্রবেষ্টূঞ্চ পরন্তপ।।

[হে পরন্তপ অর্জুন, কেবলমাত্র অনন্যা ভক্তির দ্বারাই আমি এই প্রকারে তত্ত্বত (যথার্থত) জ্ঞানের এবং দৃষ্টির এবং প্রবেশের সাধ্য (হই)] 

ঠাকুর বারংবার ঐশ্বরিক প্রসাদ লাভের জন্য শরণাগত হতে বলেছেন। ঠাকুরের জ্ঞান, বিজ্ঞান, তপস্যা, পূজাপাঠ, যাগযজ্ঞ, সন্যাসধর্ম ইত্যাদি সবকিছু ছেড়ে শরণাগত হবার যা উপদেশ দিয়েছেন শ্রীকৃষ্ণও অর্জুনকে মোক্ষযোগের ৬৬নং শ্লোকে সেই কথাই বলেছেনঃ 

“সর্বধর্মান পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ। 
অহং তাং সর্বপাপেভ্যো মোক্ষয়িষ্যামি মা শুচঃ।।

(সর্বধর্ম পরিত্যাগ করে একমাত্র আমাকে শরণ করে চল; 
আমি তোমাকে সর্বপাপ হতে মুক্ত করব) 

(২১) 

তবে এতদূর পর্যন্ত যে সকল পাঠক / পাঠিকা আমার এই প্রবন্ধটির সঙ্গে আছেন, ছেড়ে চলে যান নি, জানি না তাঁরা আমার সাথে একমত হবেন কিনা যে সহজ সরল অনবদ্য ভাষায় রূপকের মাধ্যমে ঠাকুর শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব মহাগ্রন্থ গীতার অতি উচ্চ দার্শনিক উপদেশগূলোর যে ব্যখ্যা সাধারন মানুষদের জন্য রেখে গেছেন আজও তা অদ্বিতীয়। 

এ বিষয়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা নিশ্চয় আরও বিশদে আলোচনা করে আরও অনেক মূল্যবান তথ্য এবং নতুন দিশার সন্ধান দিতে পারবেন। তবে একজন সাধারন গীতা মহাগ্রন্থ পাঠক হিসেবে পরমহংসদেবের উপদেশগুলো নাড়াচারা করতে গিয়ে এক অদ্ভুত অনুভুতির উপলব্ধি এই রচনাটার জন্ম দেয়। 

সবশেষে আর কয়েকটি বিষয় স্পর্শ না করলে রচনাটি অসমাপ্ত থেকে যেতে পারে ভেবে সুধী পাঠক / পাঠিকাবৃন্দের কাছে আর একটু সময় চেয়ে নিচ্ছি। 

ঠাকুরের যে উপদেশটি আমার মনে হয় সবচেয়ে দামি সেটা হচ্ছে সংসার ত্যাগী সন্ন্যাসী আর সংসারী জীবের তুলনামূলক আলোচনা। 

শ্রীরামকৃষ্ণ সংসারী ভক্তদের গৃহী সন্ন্যাসী বলেছেন। তাঁর মতে সংসারত্যাগী সন্ন্যাসীদের তো ভগবানের আরাধনাই একমাত্র উদ্দেশ্য। সংসারের সমস্ত দায় দায়িত্ব প্রলোভন থেকে তাঁরা দূরে সরে গিয়েছেন ভগবানকে ডাকবেন বলেই তো। সেখানে গৃহী ভক্তরা তাঁদের সংসারের সমস্ত দায়িত্ব কর্তব্য পালন করে মাথায় দশমণ পাথরের বোঝা সরিয়ে তবে ভগবানের নামগান করার জন্য সময় বের নেন । তাই গৃহী সন্ন্যাসীদের কৃতিত্ব সংসার ত্যাগী সন্ন্যাসীদের থেকে অনেক বেশী প্রশংশাযোগ্য। 

মহাগ্রন্থ গীতা কিন্তু ঠিক এই কথাই বলেছে। সন্ন্যাসযোগ ৬নং শ্লোকের মূল অর্থ স্বামী অপূর্বানন্দের মতে সম্পূর্ণ চিত্তশুদ্ধি না হওয়া পর্যন্ত নিস্কামকর্মযোগ অনুষ্ঠান করাই শ্রেয়। আর রাজশেখর বসুর মতে কর্মত্যাগ করে কেবল সন্ন্যাস দ্বারা সিদ্ধিলাভ কঠিন, কিন্তু নির্লিপ্ত হয়ে কর্ম করলে সহজে সিদ্ধিলাভ হয়। দুই অনুবাদকেরই মূল বক্তব্য এক। তাই মহাগ্রন্থ গীতার মত অনুযায়ীও গৃহী সন্ন্যাসী সংসার ত্যাগী সন্ন্যাসী অপেক্ষা শ্রেষ্ঠতর রূপে বিবেচিত হয়েছে। 

রাজর্ষি জনকই হচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণ এবং শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণের মতে আদর্শ পুরুষ যিনি একই সঙ্গে সফল ভাবে ঈশ্বরে মন রেখে রাজধর্ম কর্তব্য পালন করে গেছেন। 

আগেই উল্লেখ করেছি মহাগ্রন্থ গীতায় “যোগ” শব্দটি বহুমাত্রিক। সাংখ্যযোগ অধ্যায়ের ৫০নং শ্লোকটির মতে কর্মে কৌশলই যোগ আবার ধ্যানযোগ অধ্যায়ের ২নং শ্লোকের মুখরাতে দেখতে পাচ্ছি শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলছেন, হে পাণ্ডব, যাকে সন্ন্যাস বলা যায় তাকে যোগ বলে জানবে…।” 

যোগ শব্দের যদি অভিধানিক অর্থ ধরা যায় তবে বলা যেতে পারে “যুক্ত” হওয়া। সেই অর্থে মহাগ্রন্থ গীতার যে অষ্টাদশ অধ্যায় আছে সেই সম্পর্কে একটা মোটামুটি ধারনা করা যেতে পারে যেমন কর্মযোগ, ধ্যানযোগ, ভক্তিযোগ, মোক্ষযোগ ইত্যাদি। 

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ সহজ সরল ভাবে কোনরকম উচ্চস্তরের দার্শণিক আলোচনায় না গিয়ে সমস্ত যোগের উর্ধে “মনোযোগ”-কে স্থান দিয়েছেন যা এক কথায় simply awesome. 

আমাদের সমস্ত ক্রিয়া কর্ম কার্য একাগ্রচিত্ত ব্যতীত যে অচল সেটা ঠাকুর রামকৃষ্ণ যাকে বলে Bull’s eye হিসেবে চিহ্নিত করে দিয়েছেন মনোযোগ রূপে। সত্যি অসাধারণ। 

(২২) 

গীতা মহাগ্রন্থে শান্ত সহিষ্ণু অহিংস হবার যেমন উপদেশ আছে তেমনই দূর্বলের মতো অত্যাচার সইতেও নিষেধ আছে। এই প্রসঙ্গে রামকৃষ্ণদেবের সেই বিখ্যাত গল্পটি স্মরণ করা যেতে পারে যা লোকশিক্ষার রূপক হিসেবে এক কথায় একম এবং অদ্বিতীয়ম। 

স্মৃতি যদি বিশ্বাসঘাতকতা না করে তবে গল্পটার সারাংশটা মোটামুটি ভাবে স্মরণ করা যাকঃ 

একবার এক সাধু তীর্থ ভ্রমণকালে এক ভয়ঙ্কর বিষধর সাপকে উপদেশ দিয়ে গিয়েছিলেন যে সে যেন মানুষকে কামড়ানো থেকে বিরত থাকে কেননা তার ভয়ে নিকটবর্তী সমস্ত গ্রামবাসী অত্যন্ত ভীত সন্ত্রস্ত। 

বহু দেশ পরিভ্রমণ করে ফিরতি পথে সাধু সাপটির মৃতপ্রায় অবস্থা দেখে করুণাবশতঃ তার বর্তমান অবস্থার কারন জানতে চাইলেন। ক্রন্দনরত সাপটি সাধুবাবাকে জানায় যে যেদিন থেকে সে তার কামড়ানো স্বভাব ত্যাগ করেছে সেইদিন থেকে তাকে আর কেউ ভয় পায় না। ছেলেরা মাঠে খেলতে এসে সবাই মিলে তাকে লাঠি ঢিল মেরে মেরে মৃতপ্রায় করে ছেড়েছে। 

সব শুনে সাধু সাপটিকে বললেন, ওরে বোকা, তোকে তো আমি শুধু কামড়াতে মানা করেছি; ফোঁস করতে তো বারণ করিনি।” 

আবার বলছি লোকশিক্ষা উপযোগী এই গল্পটি এক কথায় অসাধারণ। 

সুধী পাঠক / পাঠিকাদের জানাই যে এতবড় একটা ভারি বিষয়ে মতামত জ্ঞাপন করার জন্য উপযুক্ত জ্ঞান না থাকা সত্বেও এতপাতা লিখে ফেলার পর মনে হচ্ছে এবার দাঁড়ি টানবার সময় এসেছে। 

মহাগ্রন্থ গীতার পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণ এবং পরমপুরুষ শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ এই দুই হেভি ওয়েট ব্যক্তিত্বেদের নিয়ে নিজের আলোচনা নিজের কানেই কেমন বেসুরো লাগছে। আমার মতো সুরে অসুর আর তালে বেতাল মানুষের কাছে বাঁশী আর বাঁশের বিশেষ পার্থক্য থাকে না। প্রায় হাজার আষ্টেক শব্দ লেখার পর মনে হচ্ছে পাঠকদের ধৈর্যের বাঁধ এবার ভেঙে পড়তে পারে। 

শেষ অঙ্কে এসে যদি নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করি যে, মহাগ্রন্থ গীতায় যে শিক্ষা আছে তার উদ্দেশ্য কি? চোখের পলক না ফেলেই উত্তর হবে, কেন? মোক্ষ লাভ!” 

এই মোক্ষলাভ সম্পর্কে আমার সঠিক পরিষ্কার কোন ধারনা নেই। মোক্ষের কোন তারতম্য আছে কিনা সে ব্যাপারেও আমার কোন সম্যক ধারনা নেই। 

তবে সাদামাটা বাংলায় এটুকু বুঝি যে অর্জুনকে যুদ্ধে রাজী করাবার উদ্দেশ্যেই শ্রীকৃষ্ণের মুখ নিঃসৃত শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার জন্ম এবং সেই সুত্রেই আমাদের এক অতি উচ্চমার্গীয় দার্শণিক উপদেশমূলক আলোচনার প্রাপ্তি। 

রাজশেখর বসুর মতে, গীতাকে যোগশাস্ত্র বলা হয়। এই যোগের অর্থ – আত্মোন্নতির জন্য সর্বতোভাবে সাধনা, Spiritual, Moral and Physical culture. বঙ্কিমচন্দ্র একেই “অনুশীলন” নাম দিয়েছেন। যিনি এই সাধনা করেন তাঁর সামাজিক বৃত্তি যাই হ’ক – গীতাকার তাঁকে যোগী বলেন।”  

এই প্রসঙ্গে যদিও আমার মতো পটলবাবু ম্যাঙ্গোম্যানের মতামত মুল্যহীন তবুও সাহসিকতার সঙ্গে আমি আমার একান্ত নিজস্ব ব্যক্তিগত মতামতটা জানিয়ে রাখি। 

(২৩) 

আমার মতে মহাগ্রন্থ গীতা যে দার্শণিকতার ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে সেই “ত্যাগ” সম্পর্কীয় বহু শ্লোকভিত্তিক আলোচনা আমরা এই মহাগ্রন্থে দেখতে পেলেও এই প্রসঙ্গে শ্রেষ্ঠ শ্লোকটি কিন্তু উপনিষদ-এ বিবৃত আছেঃ 

“ক্তেন ক্ততেন ভুঞ্জীথা মা গৃধ” 
(ত্যাগের দ্বারা ভোগ করিবে, কখনো লোভ করিবে না) 

এতক্ষন ধরে এতসব ভারি ভারি দার্শণিক কথার ফুলঝুরি দেখা গেল, কৃষ্ণ ঠাকুর আর রামকৃষ্ণ ঠাকুরের কথা আলোচনা হলো আর বাঙালীর প্রাণের ঠাকুর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা হবে না সেটা তো হতে পারে না। 

আগেই বলেছি রবি ঠাকুর সৃষ্ঠ “রাজর্ষি” উপন্যাসের নায়ক মহারাজ গোবিন্দমাণিক্য ঠিক এমনই একটি চরিত্র যিনি উপনিষদের উপরিউক্ত বাণীটিকে জীবনের পাথেয় করে নিয়েছিলেন। 

রাজর্ষি উপন্যাসটির গোবিন্দমাণিক্য চরিত্রটি মহাগ্রন্থ গীতার পুরুষোত্তমযোগে বর্ণিত চরিত্রের ন্যায় এক আদর্শবান আসক্তিহীন নিষ্কাম কর্মে নিয়োজিত একটি ইর্ষান্বিত চরিত্র। 

এইখানে একটা কথা সকলের মনে হতে পারে যে উপন্যাসের এই গোবিন্দমাণিক্য চরিত্রটি কি বাস্তবে সোনার পাথরবাটি যা কেবল ফিকশনাল ক্যারেক্টার হিসেবেই পাওয়া যাবে? 

এই প্রশ্নের উত্তরে বলতে হয় যে মোটেই তা নয়। 

ভারতবর্ষ তথা পৃথিবীর নানান কোণে জীবনযাত্রার বিভিন্ন মঞ্চে এখনও গোবিন্দমাণিক্যরা প্রচারের আলোর বাইরে থেকে নিষ্কাম ভাবে ব্যক্তিগত স্বার্থবিহীন বহুজন হিতায়চ নিজের নিজের কর্মযোগে লিপ্ত আছেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে জানি আমাদের হায়দ্রাবাদে শহরেও এরকম গোবিন্দমাণিক্যের সংখ্যা মোটেই কম নয়। 

তবে আমজনতা পটলবাবুদের কাছে নিস্কাম কর্মবীর গোবিন্দমাণিক্যদের আদর্শ জীবন দর্শণ অনুসরণ করার ছাড়াও পরমহংসদেব প্রদর্শিত পথে সমস্ত যুক্তিতক্কের উর্ধে উঠে শরণাগত হয়ে পরমাত্মায় নিজেকে সমর্পণ করার রাস্তাও খোলা আছে – 

“শরণাগত কিঙ্কর হীন মনে। 
গুরুদেব দয়া কর দীন জনে।।

-----------------“কৃষ্ণ বলো সঙ্গে চলো”-------------------- 

Bibliography : 

১। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা – অনুবাদক রাজশেখর বসু –এম সি সরকার এন্ড সন্স 
২। শ্রীমদ্ভাগবদ্গীতা – স্বামী অপূর্বানন্দ কর্তৃক অনূদিত ও সম্পাদিত 
রামকৃষ্ণ মঠ – ভুবনেশ্বর। 
৩। Srimad Bhagavad Gita Original and Translation - Swami Vireswarananda, 
Ramkrishna Math, Madras 
৪। OM THE BHAGAVADGITA or THE SONG DIVINE –Gita Press, Gorakhpur 
৫। পরমপুরুষ শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ – অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত (চার খন্ড একত্রে) – মিত্র ও ঘোষ 
৬। শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত – শ্রীম কথিত (অখন্ড), উদ্বোধন কার্যালয় 
৭। Swamy Vivekananda A Biography– Swamy Nikhilananda, Advaita Ashrama 
৮। শ্রীরামকৃষ্ণ বাণী ও শাস্ত্রপ্রমাণ – সংকলক কুমারকৃষ্ণ নন্দী, উদ্বোধন কার্যালয় 

0 comments: