0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in



ধারাবাহিক


সোয়ানার রহস্যময় মানুষ 
নন্দিনী সেনগুপ্ত 

৭ 

কিছুক্ষণ পরে শেষ হয়ে গেলো পায়ে চলা সরু পথটা। এবার খাড়াই পাহাড়ে চড়তে হবে। আরও প্রায় তিন ঘণ্টা সময় লাগবে জেনারোসোর চুড়ায় পৌঁছাতে। 

শীগগির পেরোতে হবে সাভাগ্লিয়া নদী। নদীটা নেমে এসেছে উচ্ছল জলপ্রপাতের ধারায়। খুব গভীর গিরিখাত তৈরি হয়েছে এখানে। প্রায় একশ মিটার কি তারও বেশি গভীর। এই গিরিখাত পেরিয়ে যাবার জন্য একটা সেতুর উপর দিয়ে যেতে হবে। সেতুটা অনেক পুরনো। অবস্থা ভালো নয় সেটার। যত এগিয়ে চলেছে ফ্রান্সেস্কো, তত শুনতে পাচ্ছে নদীটার জলোচ্ছ্বাসের আওয়াজ। যত এগোচ্ছে, তত সেটা একটা গর্জনের মত শোনাচ্ছে। হঠাৎ জলের আওয়াজ ছাপিয়ে শুনতে পেলো ছাগল- ভেড়ার দলের ডাকাডাকির আওয়াজ। আর কিছুক্ষণের মধ্যে সেই দলের মেষপালককেও দেখতে পেলো। সোয়ানার লোকজন গির্জায় উপাসনা করবার জন্য যেরকম ইউনিফর্ম পরে যায়, লোকটা সেরকম একটা জামা পরে আছে। লোকটার বিশাল চেহারা-- হাতে ভর দিয়ে নদীর তীরে বুকে হেঁটে হামাগুড়ি দিয়ে গিয়ে নদী থেকে জল খাচ্ছে!! মানে জন্তু- জানোয়ারেরা যে ভঙ্গিতে জল খায়, সেরকম আর কী! লোকটার পেছনে একটা মা- ছাগল চড়ে বেড়াচ্ছে বাচ্চাদের নিয়ে। খাড়া খাড়া কান নিয়ে পিছনে দাঁড়িয়ে আছে একটা কুকুর, প্রভুর জল খাওয়া শেষ হলে সেও জল খাবে বোধহয়! 

ফ্রান্সেস্কো ভাবছিল নিজের কথা... ভাবছিল যে... ‘আহা, আমিও যদি রাখাল কিম্বা মেষপালক হতাম, এইখানে এই প্রকৃতির বুকে... এইভাবে...’ -- তার ভাবনার সুতো ছিঁড়ে গেলো একটা তীক্ষ্ণ শিস দেওয়ার শব্দে। লোকটা জল থেকে উঠে এসে মুখের কাছে দুটো আঙুল পাকিয়ে এনে একটা শিস দিলো, আর সেই আওয়াজে এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছাগল ভেড়াগুলো দুড়দাড় করে ছুটে আসতে লাগলো লোকটার দিকে। ফ্রান্সেস্কো খাড়াই ধাপে অতিকষ্টে পাথর আঁকড়ে নিজেকে সামলেছিল, কারণ হঠাৎ জোরালো শিষের শব্দে সে এতটাই চমকে গিয়েছিল যে আরেকটু হলেই উল্টে পড়ত। নিজেকে সামলে নিয়ে ভাবতে লাগলো ফ্রান্সেস্কো যে অদ্ভুত এই পাহাড়ের রাস্তা! একটু অসতর্ক হলেই বিপদ। প্রতি পদে যেন শয়তানের হাতছানি! 

অদম্য আগ্রহ আর দ্বিগুণ জেদে এগিয়ে যেতে থাকলো ফ্রান্সেস্কো। যদিও দলছুট ভেড়াদের সঙ্গে হয়তো শয়তান স্বয়ং তার অনেক আগেই চলে গিয়েছেন এই রাস্তায়, ভাবলো সে। ফ্রান্সেস্কোর সঙ্গী তার দু পা আগে আগেই যাচ্ছিল। তবে রাস্তায় ফ্রান্সেস্কো কথা কওয়া বিশেষ পছন্দ করেনা বলে তাদের মধ্যে সেরকম কোনো কথাবার্তা চলছিলোনা। দুজনেই চুপচাপ এগিয়ে যাচ্ছিল। আরও প্রায় ঘণ্টাখানেক পাহাড়ি পথে যেতে যেতে হঠাৎ তারা দেখতে পেলো তাদের সামনে প্রায় পঞ্চাশ পা দূরেই দাঁড়িয়ে আছে আল্পসের সান্টা ক্রোসের সেই উপাসনালয়। 

তার প্রথমে বিশ্বাস হচ্ছিল না যে পাথরের টুকরো দিয়ে যাহোক করে বানানো এইরকম একটা ঘর আসলে উপাসনালয়। একনজরে দেখলে মনে হবে একটা ধ্বংসস্তুপ। যদিও উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ তাকে কিছুটা বলে রেখেছিল এই উপাসনালয়ের দুরবস্থার কথা, তবুও, আরেকটু যত্নের ছাপ সে আশা করেছিল। এই ঘরটার এখন যা দশা— মানুষও নয়, ছাগল-ভেড়ার ছাউনি হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে খুব খারাপ আবহাওয়ায়। খাড়াই ঢালের একপাশে এই ঘরটার সামনে টুকরোটাকরা নুড়িপাথরের একগাদা জঞ্জালের ঢিবি হয়ে আছে। ঘরটাতে ঢোকাও মুশকিল! বিস্ময় এবং বিরক্তির প্রাথমিক ধাক্কাটা কেটে গেলে ফ্রান্সেস্কো এই অদ্ভুত জায়গাটার সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতাবার চেষ্টা করতে লাগলো। 

কিছুক্ষণ পরে ধ্বংসস্তুপটা আর ততটা কুৎসিত বলে মনে হচ্ছিল না ফ্রান্সেস্কোর চোখে। মনে হচ্ছিল যে এটা এরকম একটা জায়গা, যেটা মানুষের দ্বারা ততটা সাজানোগোছানো সুন্দর নয়, কিন্তু এর একটা নিজস্ব চরিত্র আছে। চারপাশের সবুজ বন্য প্রকৃতির মাঝে ধসে পড়া পাথুরে দেয়ালের এই ঘরটাকে নির্জনতা আর একটা রহস্য ঘিরে রয়েছে। ঘরটার চৌকাঠের ঢালের কাছে কয়েকটা হলদে ঘাসফুল মাথাচাড়া দিয়েছে পাথুরে জমির ফাঁকফোকর থেকে। ফুলগুলো যেন ফ্রান্সেস্কোর মতই কৌতূহল প্রকাশ করে ঘরের ভিতরে উঁকিঝুঁকি মেরে দেখবার চেষ্টা করছে। ওরাও যেন জানতে চায় যে এই পাহাড়ের ঢালে পরিত্যক্ত ঘরটার ভেতরে ঠিক কী আছে! 

ফুলগুলো দেখে ফ্রান্সেস্কো বিস্মিত হয়ে গেলো। মনে হল ফুলগুলো যেন প্রতিবাদ করছে। পাহাড়ের ঝর্ণা থেকে চুইয়ে আসা জল জমে আছে ঘরটার চৌকাঠের সামনে একটু নিচু জায়গায়। একচিলতে আকাশ প্রতিফলিত হয়েছে সেই জলে। ফুলের গুচ্ছগুলো ঝুঁকে পড়েছে, সেই আকাশের নীলের মাঝে যেন তারা নিজেদের প্রতিবিম্ব দেখছে ঐ জমা জলে। সভ্য মানুষের সকালে ঘুম থেকে ওঠা, গাড়ি ধরা, পেটের ভাতের জন্য দৈনন্দিন লড়াই – এই সব কিছু, সবকিছুর বিপ্রতীপে অকারণ, অহেতুক ফুটে ওঠা ঐ ফুলগুলো যেন অদ্ভুত মূর্তিমান বিদ্রোহ। তরুণ যাজক এই বিস্ময়কর দৃশ্যটা যেন আর নিজের মধ্যে ধরে রাখতে পারছিলনা। সে রোদ্দুরে তেতে ওঠা একটা পাথরের উপরে বসে পাশে নামিয়ে রাখলো তাঁর কাঁধের ঝোলাটা। তাঁর কৈশোর কেটেছে বেশির ভাগ বদ্ধ ঘরে। গির্জায় উপাসনা করে, ক্লাসঘরে পড়াশুনা করে কেটেছে তাঁর সময়। প্রকৃতিকে এভাবে, এতখানি কাছ থেকে সে আগে কক্ষনো দেখেনি। এরকমভাবে পাহাড়েও চড়েনি সে আগে কোনোদিন। আল্পসএর অলীক সৌন্দর্য হয়তো এভাবে তাঁর দেখার সুযোগ হতই না, যদি না উপরমহল থেকে এই কাজটা করবার নির্দেশ আসতো তাঁর উপরে। নেহাত কেজো কারণে এখানে এসে সে যেন প্রকৃতির এক অন্যরকম সত্যের মুখোমুখি হচ্ছে; এই সত্য, এই সৌন্দর্যের খবর সে তাঁর পুথিগত বিদ্যের মধ্যে কোনোদিন পায়নি। এরকম মুহূর্তে এসে তাই স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর হৃদয় উদ্বেল হয়ে উঠলো। 

প্রথমবার, জীবনে প্রথমবার তরুণ যাজক ফ্রান্সেস্কো অনুভব করলো যে তাকে ঘিরে প্রকৃতির, পৃথিবীর রহস্যময় প্রাণশক্তির স্রোত বয়ে চলেছে। সে নিজের অস্তিত্ব ভুলে গেলো, ভুলে গেলো যে সে একজন যাজক। ভুলে যেতে থাকলো যে সে কোন বিশেষ কাজের জন্য এখানে এসেছে। প্রকৃতির সৌন্দর্য যেন তাকে এক তীব্র ভাবনায় ভাসিয়ে নিতে লাগলো। ঈশ্বরীয় অনুভূতির সঙ্গে জড়িত যেসব ধর্মীয় আচার-আচরণের কথা সে এদ্দিন পড়েছে, এদ্দিন শিখেছে- সবকিছুই বিস্মৃত হল সে প্রকৃতির কোলে দাঁড়িয়ে। সে ভুলে গেলো ক্রুশ স্পর্শ করতে, ভুলে গেলো অভ্যস্ত ভঙ্গিতে নিজের বুকে ক্রুশচিহ্ন আঁকতে। সে একদৃষ্টিতে দেখতে লাগলো তাঁর পায়ের কাছে, পাহাড়ের পাদদেশে বিশাল, বিস্তৃত লুগানো হ্রদ শুয়ে আছে। মাছ ধরা নৌকাগুলো ভেসে বেড়াচ্ছে সেই হ্রদে। লুগানো হ্রদের পাশে উপত্যকা যেন একটা আয়নার হাতলের মত দেখাচ্ছে। ইতালিয়ান আল্পসের সেন্ট আগাথা দাঁড়িয়ে আছে তাঁর মহান উপাসনালয়ের তীর্থক্ষেত্র নিয়ে। সান জর্জিওর শৃঙ্গ মাথা তুলে আছে সান সাল্ভাতোর পাহাড়ে। ফ্রান্সেস্কো আল্পসের একটা পাহাড়ে অনেক দূর থেকে এসব দেখতে পাচ্ছে। আর তাঁর ঠিক পেছনে অনেক দূরে বরফঢাকা অনেক শৃঙ্গ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে উচ্চতর আল্পস। রূপালি আলো ঠিকরে পড়ছে মন্টে রোজা পর্বতমালার সাতখানা ধারালো শৃঙ্গের শরীর থেকে, রেশম নীল আকাশের নরম আলো এসে পাহাড়কে ছুঁয়ে আছে সুগভীর আশ্লেষে। 

(চলবে) 
গেরহার্ট হাউপ্টমান রচিত ‘ড্যের কেৎজার ফন সোয়ানা’ অবলম্বনে লেখা 

0 comments: