গল্প - অভিরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়
Posted in গল্প
গল্প
গাছওয়ালা
অভিরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়
কবেকার এক পরিত্যক্ত কারখানা। তার সীমানা পেরোলেই একটা কবরস্থান। সেখানে পশ্চিম পাঁচিলের ইঁট সরিয়ে ঢুকে পড়েছে একটা ঘোড়ানিম গাছ। সূর্যাস্তের সঙ্গে তার অদ্ভুত এক সোহাগের সাক্ষী সমাধিস্থ মানুষগুলি। তারপর টানা দু’কিলোমিটার এলাকা জুড়ে শুধু গাছ আর গাছ। পোশাকী নাম খেয়াঘাটের জঙ্গল। যদিও ত্রিসীমানায় নদী নেই। অঞ্চলের লোকেরা বলে, একসময় এখান থেকে নৌকা বানানোর কাঠ নিয়ে যাওয়া হতো। তাই নাকি নাম হয়েছিল খেয়াকাঠের জঙ্গল। সেই খেয়াকাঠই মানুষের মনে ও মুখে কি করে যেন হয়ে গেছে খেয়াঘাট। শাল সেগুন আম জাম কাঁঠাল ছাতিম ইউক্যালিপটাস হাসনুহানা নাগচাঁপা রাধাচূড়া বট অশ্বত্থ ছাড়াও রয়েছে দুষ্প্রাপ্য বহু গাছ। আর চেনা অচেনা নানারঙের পাখির মেলা।
বুধন ভূত দেখেনি কখনও। শুধু শুনেইছে বরাবর। তারা নাকি মানুষের মতো দেখতে। ভুল করেও কথা বললে বা নিদেনপক্ষে তাদের চোখের দিকে তাকালেই নাকি বিপদ। এই ঘন জঙ্গলই নাকি তাদের বাসা। হাওয়ায় দুলে ওঠা সবুজের ভেতর সকালের আলোর আসা যাওয়ার অস্থিরতা দেখে বুধন। প্রত্যেকবার মনে হয় সোনারপুর বা বনগাঁ লোকালের ভিড়ে ঠাসা কামরায় সোনাদা’র সারাক্ষণ হাসিদিকে খুঁজে বেড়ানোটা। মেয়েদের চুলের ক্লিপ, সেফটিফিন, টিপের পাতা বিক্রির আঁকে বাঁকে। বুধন তখন কিছুদিন দিশাহারা হয়ে এই ট্রেনে ওই ট্রেনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যেদিকে দুচোখ যায়। জঙ্গলের ভেতর তখন সদ্য পাওয়া গেছে শম্ভু বাগের শুকনো পাতা দিয়ে ঢাকা শক্ত টানটান হয়ে যাওয়া নিথর দেহটা। মুখের গ্যাঁজলায় লাল পিঁপড়ে। ভনভন করছে মাছি।
বুধন আজও বিশ্বাস করে সাপের বাপের ক্ষমতা নেই তার বাঘমামাকে ছোবল মারার। সাপের সামনে এলে লোকটার সারা গায়ে চোখ গজিয়ে যায়। বাঘমামাই ছিল বুধনের ঈশ্বর। সত্যিকারের বাঘের বাচ্চা। এমনিতে ভূত ভগবান কিছুই মানে না সে। আর হবে নাই বা কেন? সত্যিকারের নিজের বলতে এই একটা লোকই ছিল তার পৃথিবীতে। মানুষের কত সমস্যা কত অসুখ শেকড় বাকড় দিয়ে সারিয়ে দিতে দেখেছে এই লোকটাকেই। দিনের পর দিন। মাসের পর মাস। জঙ্গলে শেকড় বাকড়, ডালপালা খুঁজে বেড়াত লোকটা। কি একটা যেন ভর করত তার উপর গাছেদের কাছে গেলে। লোকটার জামা বিছানা বালিশে জংলি গাছগাছালি আর মাটির গন্ধ পেতো বুধন। হাসপাতালের ওয়ার্ড বয় পিন্টুর গায়ে যেমন ওষুধ, ফিনাইলের গন্ধ পায় ওর বৌ, ঠিক সেরকম।
বৌ অন্য একটা লোকের সাথে পালিয়ে যাবার পর শম্ভু বাগেরও বোধহয় আর কেউ ছিল না পৃথিবীতে। খেয়াঘাটের জঙ্গলের ভেতর একটা পলাশ গাছের সে নীচে কুড়িয়ে পেয়েছিল কয়েকমাসের শিশু বুধনকে। তার বাবা ডাক শোনার ইচ্ছে ছিল কিনা বুধন জানে না। শুধু মনে আছে শম্ভুই তাকে বাঘমামা ডাকতে শিখিয়েছিল। সে মারা যাবার পর বুধন জানল লুকিয়ে লুকিয়ে সাপের বিষের সওদা করত তার বাঘমামা।যাদের হয়ে কাজ করত, তারাই নাকি ওকে সাপের ছোবল খাইয়ে মেরেছে।
সবাই ভেবেছিল বুধন খুব একা হয়ে যাবে। খেতেও পাবে না দু’মুঠো। চুরি ছিনতাই করবে। সাহস বাড়লে মানুষও মারবে হয়ত। আর কেউ না হোক, খেয়াঘাটের জঙ্গলই শিখিয়ে দেবে খুন করে কিভাবে লাশ গুম করে দিতে হয়। কত দাগী আসামী করে খাচ্ছে তার দৌলতে। নিদেনপক্ষে ভূতের ভয় দেখিয়ে নিঝুম রাস্তায় একা পথিক বা টায়ার পাংচার হওয়া গাড়ি। কিন্তু বুধন মানুষের ভিড়ে মিশে দেখেছে গাছ অনেক ভালো। হয়ত তারাও আকাশ ছুঁতে চায় মানুষের মতো, কিন্তু হিংসে করে পাশের গাছটার ক্ষতি করে না। তাদের চাওয়াগুলো বড্ড সীমিত। যারা ছিঁড়ে যায়, ঝরে যায়, তাদের নিয়ে গাছের অভিশাপ বা আক্ষেপ কোনওটাই নেই।
বুধন ক্রমশ নিজেকে নতুন করে চেনে। অনেক কিছুই মেনে নেওয়া ও মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা তার নেই। বোঝে, সে আদ্যপান্ত নিখাদ একটা মানুষ। মনখারাপে, অভিমানে সেও কিছু একটা হাতড়ে আঁকড়ে বাঁচতে চায়। পেরেকে ঝোলা বাঘমামার জামার গন্ধ, প্ল্যাটফর্মের ভিড়ে বরের হাত ধরে হাসিদির সিঁদুর মাখা মাথাটার হারিয়ে যাওয়া, নেশা করে সোনাদার হাউহাউ করে কান্নার শব্দ... কিছুই যেন তাকে ছেড়ে যেতে চায় না। বারুইপুরে একটা জায়গায় আয়ার কাজ করত হাসিদি। বিয়ে হয়েছিল তিলজলায়।
কেঁদেছিল বুধনও। বাঘমামার বেলায় নয়। টানা দুদিন নিখোঁজ থাকা সোনাদার খবরটা পাওয়ার পরে। যে হাতটায় কল্কা করে হাসি লেখা ছিল, সেই হাতটা কাটা। এমনভাবে থেঁতলে দিয়েছে মুখটা যে চোখ নাক ঠোঁট কিছু বোঝার উপায় নেই। একটা সুতোও লেগে নেই গায়ে। ওই কাটা হাতটা দেখেই চিনেছিল বুধন। এবারও সেই খেয়াঘাটের জঙ্গল। মেঘ জমেছে আকাশ কালো করে। দূরে কোথাও বৃষ্টির সোঁদা গন্ধ। পুলিশের জিপ সোনাদাকে নিয়ে চলে যাবার পরই শুরু হয়েছিল কালবৈশাখী। যেন বাঘমামার সাথে দেখা হয়ে গেছে সোনাদার। হয়তো এতদিন পর বুধনের খবর দেবার একটা লোক পেয়েছে বাঘমামা। বা রেগেও যেতে পারে, বলা যায় না! সোনাদা কোন আক্কেলে বুধনকে একা ফেলে চলে এসেছে! বুধনের বুকের মধ্যেও ভীষণ একটা ঝড়। মরে গিয়ে ওর দুটো কাছের মানুষ যেন গাছ হয়ে গেছে। বলতে চাইছে কিছু। বুধন শুনতে পাচ্ছে না। তবে যে ও গাছেদের সঙ্গে কথা বলতে পারে! গাছের মনের উথালপাথাল বুঝতে পারে! সবই কি ওর মনগড়া? নাকি মিথ্যে বলেছিল বাঘমামা? সে যে বলেছিল ওর কোনও পদবি নেই! ও গাছওয়ালা। ওকে গাছ চিনতে হবে। তার মাটি রোদ জল ছায়া সব বুঝতে হবে। যেমন বুঝতে পারে নিজেকে। প্রয়োজনে সারাটা দিন একটা গাছ আঁকড়েই পড়ে থাকতে হবে। পাখি যেমন ডিমে তা দেয়। বাঘমামা বলেছিল, নিজের হাতে করে তৈরি করা প্রত্যেকটা গাছকেই নিজের সন্তান মনে করতে। আর বাগানগুলো আঁতুড় ঘরের মতোই পবিত্র। সব ঋণ শোধ করা যায়, গাছের ভালোবাসার নয়।
সেদিন সারারাত মুষলধারে বৃষ্টি। অবিরাম বাজ পড়ার শব্দে কেঁপে উঠছে চারপাশ। ঘুম নেই বুধনের চোখে। টালি থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে জল। মাঝেমাঝেই ডানা ঝাপটাচ্ছে বাড়ি ফিরতে না পারা পাখি। রাস্তায় কাঁচ ভাঙার শব্দ। দরজা ধাক্কাচ্ছে দমকা হাওয়া। কাঁপছে ছিটকিনিটা। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বুধন বুঝতে পারল মাঝে কেটে গেছে অনেকটা সময়। সিঁদুরের দাগ লাগা একটা রুমাল আঁকড়ে বসে আছে বুধন। শেষবার এসে ফেলে গেছিল সোনাদা। হাসিদিকে বলতে চাইছিল সোনাদা মানুষটা আর কোনওদিনও ভিড় ট্রেনের ভেতর ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলবে না। প্ল্যাটফর্মের সিঁড়িতে এসে দাঁড়াবে না মুখোমুখি।
ছিটকিনিটা কাঁপতে কাঁপতে খুলে গেল নিজেই। দমকা হাওয়া আর বৃষ্টির ছাঁটে বুধনের ঘরটা যেন মাছধরা নৌকার মতো কাঁপছে। বুধন গাছওয়ালা লেখা সাইনবোর্ডটা এদিকে ওদিকে ঠোক্কর খেতে খেতে উড়ে যাচ্ছে খেয়াঘাটের জঙ্গলের দিকে। চুপচুপে ভিজে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে হাসিদি। খালি পা কাঁচ ফুটে ক্ষতবিক্ষত। ভেতরে ডাকল বুধন। বিয়ের আগে হলুদ ডালিয়ার মতো লাগত হাসিদিকে এখন যেন বাসি গোলাপের পাপড়ি। শালুক ফুলের মতো আঙুলে আলতা নয়, রক্ত। সাইনবোর্ডটার পিছু ধাওয়া করার জন্য ছুটে বেরোতে বেরোতে বুধন বলে গেল সে না ফেরা অবধি কাউকে যেন দরজা না খোলে হাসি। বুধন ছুটছে। গাছগাছালি, উইয়ের ঢিবি, শুকনো পাতা, সাপের খোলস, শিমূল তুলো, পাখির বাসা আর গাছেদের বাড়ির জানলা দরজার পাশ দিয়ে। কখন পেরিয়ে গেছে সব বুঝতেই পারেনি। সদ্য ফোটা ভোরের আলোয় দেখল একটা নদী। কচুরিপানা জমেছে বেশ কয়েকটা অসম্পূর্ণ নৌকায়। তার পাশেই বিশাল একটা নার্সারি। কতরকমের টব, নানারকম গাছের চারা, গোবর সার, খোল। একটা জায়গায় শুধুই ফুল। আকাশের সামিয়ানা খুলে বেরিয়ে আসছে সকালের আলো। একটা একতলা ঘর। কাঁচের বোতলে রাখা সাপ। গাছের শেকড়। লাল সুতো, সাদা সুতো। ঘরের বাইরে বিশাল সাইনবোর্ডে লেখা বুধন গাছওয়ালা। বুধনের একবার মনে হলো হাসিদি হয়ত তার জন্যে অপেক্ষা করবে। ওর গিয়ে নিয়ে আসা উচিত। নিশ্চয়ই কোনও বিপদ হয়েছে। নাহলে মাঝরাতে ওইভাবে তার বাড়িতে কি করে আসবে! আর চিনে এলোই বা কি করে! ঠিক তখনই একটা গাছের মাথায় প্রচণ্ড একটা বাজ পড়ার শব্দ। অনেকগুলো চামচিকে উড়ে গেল।
ঘুম ভেঙে গেল বুধনের। বুকের ভেতর ঢিপ ঢিপ শব্দটা সারা ঘরময় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে যেন। দড়িতে ঝোলানো বাঘমামার বোতাম ছেঁড়া জামাটা ওর মুখের উপর এসে পড়েছে। সেটায় গাছগাছালির গন্ধ নেই আর। শুধুই মানুষের গন্ধ।
0 comments: