প্রবন্ধ - চিত্তরঞ্জন হীরা
Posted in প্রবন্ধ
প্রবন্ধ
মুখের ভাষা মনের ভাষা
চিত্তরঞ্জন হীরা
#
কথা যখন শুরু হয়, ভাষাই তার প্রধান বাহন হয়ে ওঠে। যা আমাদের নিজেদেরও প্রকাশ মাধ্যম। একটা চালু প্রবাদ ছিল–'আপনার ভাষাই আপনার পরিচয়'। এখন অবশ্য তেমন শুনতে পাই না কারও মুখে। কিন্তু আমরা বড্ড বেশি টালমাটাল হই মুখের কথার সঙ্গে লেখার ভাষা নিয়ে। তার চল-অচল, মিল-অমিলের বোধগম্যতা নিয়ে। যুক্তির পালে যখনই একটু আবেগের ঢেউ এসে লাগে, প্রথম দোলাটা ওঠে ভাষা থেকে। একটা অভিব্যক্তি, তার প্রকাশ। নানারকম হতে পারে। কোনও অর্থই রইলো না, কিন্তু আমরা বুঝে ফেললাম। কোনও অর্থ হয়তো ছিলই না, কিন্তু একটা সংযোগ তো কোথাও না কোথাও ঘটে গেল। এটা কেন কবিতার ক্ষেত্রে হবে না!
আড্ডায় তো কতকিছুই হয়, কথার বাঁকে বাঁকে কত আড়ালফেরতা! সব কথা বলা হল না, অথচ অসম্পূর্ণ কথার এগলি সেগলি ঘুরে রাজনীতি, সিনেমা, নাটক, মায় রাতগভীরের নীল আলোর শীৎকার, মায়ারহস্য, গা- ছমছম পর্যন্ত। কিন্তু আমরা বলি কি, যৌনতারও একটা বিশেষ ভাষা আছে, তেমন কবিতার। এসব নিয়েই সময়। তার যে থেমে থাকা নেই। সে চলেছে সবকিছুকে নিরাসক্ত করে। তারও কত দুঃখ থাকে। একা বইছে। একাকীত্বেই তার চারণভূমি। আমরা তাকে বুঝতেই পারি না। বলি বটে সময়ের সঙ্গে আছি, কিন্তু সে চলেছে আগে আগে, আমরা একটু পিছিয়েই রইলাম। বুঝতে পারি না। আসলে যারা দুঃখ বুঝল না, তারা আনন্দ বুঝবে কেমন করে! এমনই কবিতা...।
#
পাড়ের নৌকোটি খোলা হল, সে পাড়ি দেবে, হাওয়ায় দুলছে, কালের হাওয়া। আমরা কয়েকজন চড়ে বসলাম টুক করে। এবার নিয়তি টানছে। কবিতার নিয়তি। ভেসে চলেছি, ভেসে চলেছি, আর ভেসে চলেছি,গূঢ়ভাষার অন্তর্গত বিশ্ব নিয়ে। কথার আড়ালে কথা, কথার পিঠে কথা, রহস্যরঙ নিয়ে। অন্তর্লীন ডুবে থাকা রূপ, রস, গন্ধ নিয়ে- 'মাথাভর্তি মনখারাপ; তার ভিতর তুমি গঙ্গাফড়িঙের কুটিরশিল্প লিখে রেখেছো / মাথাভর্তি মনখারাপ; তার ভিতর তুমি পায়রার মৌরিফুল ঢেলে দিয়েছো / মাথাভর্তি মনখারাপ; তার ভিতর তুমি শালিকের শৃঙ্গার বুনে দিয়েছো' ( জহর সেন মজুমদার )।
এই তো আমরা বয়ে চলেছি কূল ছাড়িয়ে, আর ওদিকে হিজলতলার রামধনু ছুঁয়ে প্রজাপতি উড়ছে, ছাইচাপা একটা শামুক গা শীতল করে উঁকি মারছে, রক্তমাখা যৌনটিয়া গড়িয়ে নামছে মহাবিস্ময় হয়ে, অস্ত যাচ্ছে অপরাহ্ন।
- তাহলে কি সন্ধ্যামালতির বনে আবার উৎসব হবে! আবার কি একটা ভোরের জন্মদিন এল!
#
কে বলতে পারে, এই সেই শব্দগুচ্ছ, যাদের দেওয়ালে কোনও অর্থচিহ্ন নেই, তাই আমাদের মনের কোণে একটুও বাজল না! কে বলতে পারে এর কোনও আলোচিহ্ন নেই, তাই কয়েক আলোকবর্ষ অন্ধকার থেকে উঠে আসা শুধুই শব্দের মায়া, কথাহীন কথকের অব্যর্থ প্রতারণা !
তবে তাই-ই হোক। আমরা না হয় কয়েকজনই শুধু বুঝলাম, পূর্বনির্ধারিত সংকেত ছাড়া এদের নিষ্কৃতি কখনোই সম্ভব নয়।
এ হল সেই পারাপারের খেলা, বিশ্ব নিয়ে, ভাষা নিয়ে, বোধ নিয়ে। কল্পনার দেশ বাস্তবতায় মিশে একাকার। নানাদিকের নির্দেশনা নিয়েই তার অনাবিষ্কৃত মুখগুলো মাথা তুলতে চায়। শুধু কি মুখ, একটু একটু করে শরীর খুলবে, তাঁতবসন।
- বসন তো খুলছো কিন্তু দাঁড়ালে কোথায়!
ইশারার বাঁকে এসে হাতের তালুতে রাখা সেই লুকানো বীজগুলো শূন্যে ছুঁড়ে দেওয়া। তারা জলে ভেসে, হাওয়ায় টাল খেয়ে যে যেখানে পড়বে, সেখানেই তার সম্ভাবনা। তার বাস্তব। অঙ্কুর তো এল, এবার গাছটা বাড়াও, বাড়িয়ে তোলো। সার দাও, জল দাও। দেখবে একদিন ঠিক ফুলে-ফলে ভরে উঠলো নতুন সভ্যতা। একে হয়তো অনেকটা প্রলাপই বলা যায়। কিন্তু কবিতা তো ঐ প্রলাপমাত্র!
###
শব্দ, বোধ, দৃশ্য এবং ব্যক্তিক অভিজ্ঞতা- এই নিয়ে যা রচিত হল, তা একটি পাঠবস্তু, কবিতাও হতে পারে বা অন্য কিছু। পাঠক এবং ঐ রচিত পাঠবস্তুর মধ্যে যদি স্বাভাবিক সংযোগ নিয়ে আমরা ভাবতে বসি, তাহলে দুটো অভিমুখের কথা স্মরণ করতে হবে। একটি চেতনাপ্রসারিত, অন্যটি অভ্যাসে ঘেরা স্বাদবোধতাড়িত। যা স্বাভাবিক অভ্যাসে অচেতন থেকেই ঐতিহ্যে বয়ে আসে, কিন্তু অনবচ্ছিন্ন।
চেতনার নিজস্ব ক্রিয়া ক্রমাগত চোখে চোখে দেখাকে প্রসারিত করে। ভেতরে ভেতরে তার আগের ধারণার সঙ্গে মিলিয়ে দেখারও একটা প্রবণতা জন্ম নিতে পারে। আর দ্বিতীয়টি হল, একটি ফ্রেম মনের মধ্যে রয়েছে, তাতে ফেলে পূর্বধারণা মত বুঝে নিতে চেষ্টা করা। না মিললে নস্যাৎ করা। কিন্তু এই অবস্থা থেকে যখনই মনের মধ্যে কিছু প্রশ্ন জাগতে শুরু করবে, তখনই চেতনাও জাগ্রত হতে থাকবে। অর্থাৎ, অচেতন যদি অবচেতনেও একটু সজাগ হয়ে ওঠে, তবেই ধারণা বিবর্তিত হতে পারে। প্রতিটি বিষয় বা ঘটনার অন্তর্নিহিতে একটা তাৎপর্য থাকে, সে ক্রিয়াশীল হয় এবং প্রতিক্রিয়া ঘটায়। তবে একই ভাষা অঞ্চলভেদে ভিন্ন ভিন্ন ধ্বনির ইঙ্গিত বহন করতে পারে। একই ভাষা শুধু শব্দের হেরফেরে, শব্দসাজের হেরফেরে তার দ্যোতনাই একেবারে বদলে দিতে পারে।
তাহলে এবার প্রশ্ন হল, সংযোগ মানে মানুষের মনের একরৈখিক কোনও মেলবন্ধন তাহলে নয়?
সে কথাও পরের, আগে আমাদের মীমাংসায় আসা প্রয়োজন, যাঁরা বলেছিলেন কবিতার ভাষা হোক মানুষের মুখের ভাষার মত, তাঁরা আসলে কবিতাকে কেমন হওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন? আজও কি তার সঠিক মীমাংসা হয়েছে? বোধহয় হয় নি। সংযোগ অর্থে ঠিক অর্থ নয়, ঠিক বুঝে ওঠাও নয়, অনেকগুলো উপাদান পাশাপাশি রেখে তার কোনও একটির মাধ্যমে লেখকের উপাদানকে বা বক্তার বলা বিষয়কে ধরতে চেষ্টা করা। বা কোনও একটি আভাসের মধ্যে নিজেকে অনেকটা জড়িয়ে নেওয়া। শেষ পর্যন্ত ধ্বনির বহুরৈখিক চিহ্নময়তা বা বহুমাত্রিক অনুভবতা একটি পাঠবস্তুকে এক এক পাঠকের কাছে এক একরকম সংযোগ বা উপলব্ধি দিতে পারে। লেখক বাধ্য করাচ্ছেন কীনা বলা যাবে না, কে কেমনভাবে বিষয়কে ধারণ করবেন, তা তাঁর বেড়ে ওঠা মানসিক গঠনের উপরই নির্ভর করে। হয়তো আমরা কেউ পড়ছি -
'চিমনির মুখে শোনা সাইরেন-শঙ্খ
গান গায় হাতুড়ি ও কাস্তে –
তিল তিল মরণেও জীবন অসংখ্য
জীবনকে চায় ভালোবাসতে।'
(সুভাষ মুখোপাধ্যায়)
এর মধ্যেও বহু পাঠকের নাবোঝার এলিমেন্ট রয়েছে। অর্থাৎ সহজ সংযোগ হল, এমনটা দাবি করা যায় নি। ইতিহাসে এটাই সত্য। কিন্তু কবিতার জয় এখানেই যে, ধরা দিয়েও সে পুরোপুরি ধরা দেয় না, তার স্বভাব সৌন্দর্য নিয়ে একটু আড়াল রাখে। কথাটা হল এই, কবিতায় সহজ সংযোগের চেয়ে আড়াল সৌন্দর্যই প্রধান উপাদান। আমরা যাকে কমিউনিকেশন বলছি, তা একটি বিশেষ অনুভূতির ব্যঞ্জনা। তা ঐ অভ্যাস, আভাস আর সমর্পণের বাইরে আর কিছু নয়। কবিতার ভেতর থেকে কবিতার আবেদন মিলিয়ে গেলে তা আর কবিতা থাকে না। নিছক কথামাত্র, নিছক শব্দসমষ্টি। শব্দকে যে আড়াল মাধুর্য দিয়ে গড়ে তোলা হচ্ছে, তাকে বাজাতে হবে অন্তরাত্মায়। এটাই ব্যঞ্জনার মূখ্য ভূমিকা।
যাঁরা এখনও এসব কথায় গোল বাঁধিয়ে বসেন, তাঁদের জন্যে কবি সুভাষেরই কবিতাকারী ভাবনার সাহায্য নিতে পারি আমরা। তিনিই বলেছিলেন–
"লেখার ভাষা অবিকল মুখের ভাষা হতে পারে না। মুখের ভাষার স্থান কাল পাত্রের গণ্ডিটা থাকে ছোট, লিখতে গেলে এমন একটা গড়নপিটনের দরকার যাতে লেখকের হাত ছেড়ে দিয়ে সে লেখা যখন-তখন যেখানে-সেখানে যার তার কাছে যেতে পারে। মুখের ভাষার কাছে থাকতে চাই নিকট দূরত্বে।"
(কবিতা পরিচয়/বৈশাখ-আষাঢ় ১৩৭৭)
মানুষ যতক্ষণ না নাবলা কথার ফাঁক থেকে রহস্যটুকু উদ্ধার করতে পারছেন, ততক্ষণ এই মাধুর্যকে উপভোগ করতে পারবেন না। ধ্বনি যেখানে ভাষার উৎস, সেই ধ্বনিসমষ্টি আমাদের মনে কতগুলো চিহ্ন তৈরি করে, যা মনের ভাষা, তাকে বোঝাতে যে শব্দগুলো ব্যবহার করা হয় তা মুখের ভাষা, এই দুইয়ের মধ্যে এমন অনেক কিছুই ঘটে থাকে, তাকে অর্থ করে বুঝিয়ে দেওয়া যায় না। সৃষ্টির বাঁক আসে বহুপ্রসারিত আলোর রেখা থেকে। কবিতার নিকট-দূরের আলো-আঁধারটুকু নিয়েই তো পাড়ি দেওয়া একটা জীবন। বিশ্ব-চরাচর নানা রহস্য নিয়ে নিত্য খেলছে, আর আমাদের পাগল করে তুলছে। আলো-আঁধারের আভাস দিচ্ছে।
#
বহুপ্রসারিত সেই আলোর রেখা থেকে হয়তো হঠাৎ উঁকি দিয়ে উঠলো–
'মুগা সুতো
কথা ভাঙছে
মনে প্রাণে
আর
ছড়িয়ে দিচ্ছে
বাথানে বাথানে'
(রুহুল আমিন হক মণ্ডল)
এই যা উদ্ধার করা গেল তারপরই বলতে হয়, এ থেকে গ্রহীতা যা নিলেন তার সঙ্গে বক্তা বা কবির মনোভাষা এবং বাকভঙ্গীর নৈকট্য খুবই সামান্য। কিছুটা কাছে এসে কিছুটা দূর থেকেই এর উত্তাপ ও আলো নেওয়া। এই জন্যেই আমরা বলতে চেয়েছি, একটু আভাসের মধ্যে অনেকটা সমর্পণ। এমন একটা অবস্থানের উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে ভাষাসম্পর্ক।
###
শব্দেরও শারীরিক ভাষা হয়। শব্দশরীর কথা বলে। কবিই শুধু শুনতে পান তার কথা। যে কবি শুনতে পান না, তাঁর শব্দরা আদতে নিষ্প্রাণ, জড়। এই কারণে অনেক কবিতা পাঠের পরই মনের কোণ থেকে ঝরে যেতে থাকে, অর্থাৎ তার বাঁধন আলগা রয়েছে।
আসলে এসব কথা তো প্রমাণ করা যায় না, ঐ আপন মনে প্রলাপের মত বকে যাওয়া। এই যে কবিতার ভাষার সঙ্গে শব্দের শরীরীভাষার যে সম্পর্কের কথা আমরা বলতে চেয়েছি, তাকেও কি সবাই অনুভব করতে পারেন? একমাত্র কবিই। কবির সত্তার আলোড়ন ঐ শরীরীভাষার জাগরণ থেকে তাঁর কবিতায় প্রবেশ করে। শব্দের যৌন-আধার থেকে নিষ্ক্রান্ত আলোকণা, তাপবীর্য কবিকে পাগল করে, অস্থির করে। কবি তখন আর ঐ শব্দঘোর থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন না। লেখাটি শেষ হলে তবেই যেন তাঁরও মুক্তি।
একজন কবি নতুন সৃষ্টির জন্যে অনলস ভাঙচুরের খেলায় মেতে থাকবেন। অবিরাম ভাঙনের টানই তাঁকে আহ্লাদিত করবে। এভাবেই শব্দবিশ্বের প্রসার ঘটে, বিস্তার ঘটে। কবিতাও গতানুগতিকতা ছেড়ে মহোত্তর জীবনবোধ নিয়ে প্রসারিত হয় নতুন ভুবন, নতুন শব্দচরাচরের দিকে। এ হল ইন্দ্রিয়চেতনার প্রত্যক্ষ জ্ঞান, সঙ্গে মিশবে পরোক্ষলব্ধ বিশেষ অভিজ্ঞতা। শব্দ শুধু কুড়িয়ে পাওয়া অক্ষরের নুড়ি নয়, তাকে একটু একটু করে বানিয়েও তুলতে হয়, তবেই না এই আমাদের শব্দের গোলাঘর আরও ভরভরন্ত হবে, আরও সমৃদ্ধ হবে !
#
ভাষা এমনই একটা অস্ত্র, জীবন-অভিঘাতে তাকে শাণ দিতে দিতে ধারালো করে তোলা। বাইরে থেকে বল প্রয়োগ না করলে যেমন বস্তুর স্থানান্তর ঘটে না, তেমনি ধারাবদলের স্পৃহা না থাকলে ভাষাও স্থবির হয়ে পড়ে। এই যে চলতে ফিরতে লক্ষ্য করি মানুষের মুখের ভাষা কত পাল্টে গেল, কত নতুন নতুন শব্দ হাসছে খেলছে গড়াচ্ছে, সেখান থেকে কবিতায়ও নতুন নতুন শব্দের আগম ঘটে। সাজিয়ে তোলাটাই কবির কাজ–
'বুকের ভেতর এক চোরা মেঘ এসে
মাঝে মাঝে জল দিয়ে যায় চাতকে।
দুচোখে সাতভরি গান
শুকিয়ে যাওয়া ফুলটি তখন
আলাদীন আলাদীন।'
(আশিস গোস্বামী)
কবিতার ভাষা নিয়ে সারা পৃথিবীতে সব সময় এরকম এক একটা আলোড়ন চলে। মানে স্বাভাবিক চলনের বাইরে একটা বিরুদ্ধস্রোত বইয়ে দেওয়া। পালাবদলের ঢেউটা ওঠে এখান থেকেই। শুরুতে কেউ কেউ মনে করেন 'মেধার অসুস্থ পাগলামি', আবার কেউ কেউ বিশ্বাস করেন–
"সব রদবদলের তলে তলে একটা যোগসূত্র কাজ করে। এক-দিকের নতুনের সঙ্গে আরেকদিকের নতুনের যোগ থাকে। কবিতা আর সবকিছু আলাদা নয়। মানুষ জীবনের ভাষা আয়োজনে, কবি ভাষাবদলের,ভাষাখোঁজের, ভাষাতল্লাশির যোগানদার হয়ে উঠতে পারলেই তার সার্থকতা।"– (সমীর রায়চৌধুরী)
#
আবার যদি বলা হয়, চিরন্তনের যাত্রা তাহলে কোনদিকে ? তাহলেও সেই একই কথা এসে পড়ে- 'ব্যক্তি' আমির 'সর্বময়' আমির দিকে ছুটে যাওয়া, ধাবিত হওয়া। কিন্তু একজন ব্যক্তির দ্বান্দ্বিকতা আর একজন স্রষ্টার দ্বান্দ্বিকতা এক নয়। একজন ব্যক্তি বা সাধারণ মানুষ যখন নিজেকে চিনতে বুঝতে সত্তার উলোঝু্লোয় পাগল পাগল হতে থাকেন, তখন তার মধ্যেও সৃষ্টিজনিত অবস্থার প্রকাশ ঘটতে পারে। এটা হল সৃষ্টিসত্তার উন্মোচনের দিক। কিন্তু সাধারণত একজন ব্যক্তির দ্বান্দ্বিকতা বলতে যা বোঝা যায় তা হল সে নিজেকেই ঠিক বুঝতে পারছে না, নিজের ভেতরের আলোড়নগুলো প্রকাশ করতে পারছে না। এটা একধরনের ব্যক্তিবোধের সংকট। স্রষ্টার দ্বান্দ্বিকতা তাঁর সৃষ্টির উচাটন নিয়ে। ভাবনার বন্দিদশা থেকে বিষয় বা অনুভূতিকে মুক্ত করার জন্যে অস্থির হয়ে ওঠা। ভেতরে ভেতরে নৈঃশব্দ্যের আলোড়ন। শব্দহীন সেই জ্যোৎস্নাকে যিনি দেখে ফেললেন, তাঁর আর বন্দী থাকার কোনও উপায় নেই। সমস্ত অর্থের বন্ধন থেকে স্বাধীনসত্তায় উন্মোচিত হওয়ার জন্যে শুরু হয় আক্ষরিক প্রচেষ্টা। শব্দ ছুটে চলেছে পরিব্রাজকের হাত ধরে। কবি তিনিই, যিনি সেই ব্রহ্মাণ্ডচেতনার উৎসঙ্গী হয়েছেন, যেখান থেকে তিনি দেখতে পান–
'নিমপাতা জমে উঠছে চাঁদের উপর
পিঠের ঝুড়িতে মেঘ
নিঝুম তুলসীর কোণে বিকেলের ছায়া
ভাঙা আদরের মত কেউ কেউ ফিরে আসে অন্যেরা
চিনেবাদামের ঠোঙা ফুলিয়ে ফাটায়'
(দোলনচাঁপা চক্রবর্তী)
এত এত ছবি, দৃশ্য থেকে কল্প, থেকে চিত্রছায়া, আমরা যে জুড়তে দেখলাম তাতে কি আমাদের কোনও মানসিক পীড়া ঘটলো, নাকি চোখ বুজলে আমরাও অনুভব করতে পারছি, আহা! এমন করে তো আগে কখনও দেখিনি!? এই-ই হল অসম্ভবের বাস্তবতা। আগে কখনও ঘটেনি, কিন্তু আগামীতে ঘটবে।
#
এভাবেই বলা যায় চেতনারও একটা নিজস্ব বাস্তবতা রয়েছে, ভাষা রয়েছে, তাকে ধরতে হবে সংবেদনা দিয়ে। মনের দরজা খুলে সামনে এসে দাঁড়াও, দেখো কে এসেছে অতিথি হয়ে, তাকে বসতে দাও মননে। আসন দাও। পাশে বসো। বাতাসমুখো করে কান পাতো, দেখো, শোনো। এদুটোই আসল। ইন্দ্রিয় জাগ্রত হলে তবেই সে ধরা দেবে। তোমার ভেতরে বেজে উঠবে আরেক সুর। তখন তুমিও গাইছ বা তাকিয়ে দেখছ–
'এক অবাকজংশনে উড়ে যাচ্ছে ওড়না
ডাকি
মনেহয় রাস্তাগুলো বড় হয়ে যাবে
জোনাকি বড় হয়ে চলে যাবে'…
(স্বপন রায়)
আমরা তো চাইছি রাস্তাটা বড় হোক, প্রসারিত হোক, বিন্দু আলো এক আকাশ সূর্য হয়ে উঠুক। তবে শব্দ যদি ভিড়ের যাত্রী হয়, তাহলে আলো এবং পথ ভিড়েই হারাবে। অর্থাৎ, কোলাহল থেকে উত্থিত ধ্বনির মধ্যে সৃষ্টির উৎস সন্ধান করা বৃথা। সেখানে চেতনার অভিনিবেশ কম। খুব নিঃশব্দে নীরবে ভাষাকাঠামোর মধ্যে এক একটা জন্মমুহূর্ত তৈরি হয়। আবার এক একটা মুহূর্ত বারবার জীবনের স্বাভাবিক গ্রাহ্যতা নিয়েই নতুন আদল পেতে চায়, প্রত্যাশায় অধীর হয়।
#
জীবনানন্দ মনে বসিয়েছিলেন, 'বৈজ্ঞানিক প্রবর্তনার পথেই মানুষের হৃদয়ের পরিবর্তনের সম্ভাব্যতা'। তো হৃদয়ের পরিবর্তন হোক বা না হোক, যুগে যুগে মুখের ভাষার পরিবর্তন ঘটেই চলেছে। আর মুখ যখন বদলাচ্ছে, মনের মধ্যেও নিশ্চয়ই নতুন নতুন কথার, ভাষার, বুদবুদ উঠছে !
আবেগ যদি যুক্তিকে গ্রাস না করে ফেলে, যদি উন্মীলনের পথে বাধা হয়ে না দাঁড়ায়, তাহলে শব্দের গর্ভ জাগবেই। প্রবল কামনায় জেগে আছে চরাচরে পরিব্রাজকের ব্রহ্মবীজ। ওরা যে মিলতে চায় সঙ্গ-আসঙ্গ-নিঃসঙ্গতায়। ওখানেই–
'এবং'- শব্দটি ঝুলে আছে দুঃখের উপর
সে বলছে:
নামাও আমারে নামাও বন্ধু !
এরপর ফাঁস এঁটে গেলে
মৃত্যু হবে অব্যয়ের, নির্ভাবনা-ভাবনা, নিদ্রা-অনিদ্রার।'
(নারায়ণ মুখোপাধ্যায়)
এই নৈঃশব্দ্যের ভাষা যিনি বুঝবেন, যিনি নিশ্চেতনা থেকে চেতনাকে উদ্ধার করতে পারবেন, তিনিই হয়তো দেখতে পাবেন– ধূ ধূ বালির চরায় এক সন্ন্যাসী ঝিনুক। দেখছে, ধীরপা, ধীরসমুদ্রের দিকে। তার পা থেকে লালা ঝরছে, রক্তলালা। লালটুকু শুষে নিয়েছে সমস্ত বালুকণা। বালু থেকে বালি– লক্ষ লক্ষ কণার মধ্যে যে অভ্রবীজ, তাকেই ঘরে তুলছে ঝিনুকপা, শক্ত খোলের মত সংসার– আর সেই ঘরে জমতে জমতে ঘর, জমতে জমতে মুক্তোদ্যুতি। আকাড়া মুক্তোরা ঘুমিয়ে আছে নৈঃশব্দ্যের পাহারায়।
এই বুঝি ভ্রমণকাতর সন্ন্যাসীর পরমতাসন্ধান ! সন্ন্যাসীমোড়কে যতটুকু বাইরের সীমাবোধ টানা, তা অতি তুচ্ছ। ভেতরে যে অসীম খেলছে অভ্র নিয়ে, অভ্রবীজ নিয়ে! লক্ষাতীত লক্ষ বালির মধ্যে সেই অভ্রতাপ…!
ভালো লাগল।
ReplyDelete