প্রবন্ধ - রঞ্জন রায়
Posted in প্রবন্ধ
প্রবন্ধ
আমি বাঁচতে চাই
রঞ্জন রায়
ক'দিন আগের একটি খবর আমায় ভাবিয়ে তুলছে। আমি বিভ্রান্ত, আমি রেগে যাচ্ছি। গায়ে পড়ে বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে তর্ক করছি, সেটা ক্রমশ চেঁচামেচি ও ঝগড়ায় গড়াচ্ছে। সবাই আমার ব্লাড প্রেসার মাপতে চাইছে।
খবরটি এ’রকম…
মহামান্য সুপ্রীম কোর্ট কিছুদিন আগে নিজেদের দেওয়া মৃত্যুদণ্ডের রায় খারিজ করে মুক্তি দিয়েছেন ছ’জন খুনের আসামীকে। শুধু তাই নয়, মহারাষ্ট্র সরকারকে নির্দেশ দিয়েছেন তাদের প্রত্যেককে পাঁচলক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দিতে। ভাবা যায়!
ঘটনাটি হলঃ-
আজ থেকে ১৬ বছর আগে মহারাষ্ট্রের নাসিকের কাছে একটি জনপদে ত্রম্ব্যক সাতোতের পরিবারের চারজন নৃশংসভাবে খুন হয়। পুলিশ অচিরেই খুনিদের ধরে ফেলে। তারা হল বদর নামের একটি ভবঘুরে জনজাতির ছয়জন সদস্য। অম্বাদাস শিন্দে, বাপু শিন্দে, রাজ্য শিন্দে, রাজু শিন্দে ও আরও দু’জন।
পাবলিক প্রসিকিউটর কেস সাজিয়েছিলেন খুব যত্ন করে। খুনি, খুনের হাতিয়ার, খুনের মোটিভ সব দিনের আলোর মত স্পষ্ট। এই ভবঘুরে গরীবগুর্বো লোকগুলো নিরক্ষর, অসংস্কৃত। গাঁইতি কোদাল ওদের পোশাকের অঙ্গ। কেননা ওরা এখানে সেখানে ঘুরে দিনমজুরি করে -- পাথর ভাঙা, নর্দমা সাফ, ক্ষেতের আগাছা ওপড়ানো—এই সবই।
ঘটনার দিন রাত্তিরে ওরা বাড়িটির কাছে মদ খেয়ে লুটপাটের উদ্দেশ্যে ত্রম্ব্যক পরিবারের বাড়িতে ঢোকে। সেখানে মহিলাশুদ্ধু সবাইকে কোদাল পেটা করে হাজার তিনেক টাকা কেড়ে নেয়, ওদের রান্না করা খাবার খেয়ে ফেলে। এই নয়, একটু পরে ওরা আবার ফিরে আসে। সবাইকে মারে মেরে ফেলার জন্যে, যাতে কেউ সাক্ষী না থাকে। তার আগে দুই মহিলাকে বাইরে টেনে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে। ছ’জনের মধ্যে চারজন মারা যায়। দু’জন আহত মহিলা মরণাপন্ন অবস্থা থেকে বেঁচে ওঠে। তারা পুলিশের শনাক্তকরণ প্যারেডে গিয়ে অভিযুক্তদের স্পষ্ট শনাক্ত করে।
ব্যস, কেস এয়ারটাইট। নিম্ন আদালত থেকে হাইকোর্ট, সুপ্রীম কোর্ট, সবাই সহমত যে এই নৃশংস ঘটনাটি ‘রেয়ারেস্ট অফ দ্য রেয়ার’ শ্রেণীতে পড়ে। আর কোনও ‘মিটিগেটিং ফ্যাক্টর’ও দেখা যাচ্ছে না যে! এবার বিচারকদের সমাজের কাছে সঠিক এবং সময়োপযোগী বার্তা পাঠাতে হবে। তাই সবাইকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হল । এই রায় বহাল রইল নিম্ন থেকে উচ্চ এবং সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত। শুধু তাই নয়, হাইকোর্ট তিনজনের শাস্তি কম করে যাবজ্জীবন করে দিয়েছিলেন। আপিল শুনে মহামান্য সুপ্রীম কোর্ট তাদের শাস্তিও বাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড করে দিলেন। অভিযুক্তরা অবশ্য গোড়া থেকেই নির্দোষ বলে দাবি করছে। তা, কোন অপরাধী কবে নিজের দোষ স্বীকার করে?
এই গোটা প্রক্রিয়ায় লেগে গেল ১৬ বছর। এরা ক্লান্ত হয়ে অপেক্ষা করছে কবে ফাঁসি হবে, আমরা ভাবি – আর কত দেরি? আপদ-বালাই চুকেবুকে যাক।
এর মধ্যে একজনের ছেলে মারা গেছে; আরেকজনের বৌ গিয়ে অন্যের ঘরে উঠেছে। বাচ্চাগুলোর স্কুলে যাওয়া হল না, এখন ওরা যুবক এবং বাপের মতই অশিক্ষিত জনমজুর। এদের মাটির ঘরগুলো ভেঙে গিয়ে এখন সাপখোপের আড্ডা। এদের বৌ-বাচ্চা ঘুমোয় খোলা আকাশের নিচে, চটের বস্তা বিছিয়ে।
তা এর জন্যে আপনি-আমি কী করতে পারি? আমরা কি ওদের লুটপাট করতে, খুন করতে, রেপ করতে বলেছিলাম?
আর ষোল বছর ধরে আইন চলেছে আইনের পথে। নিম্ন থেকে উচ্চ, শেষে সর্বোচ্চ—সমস্ত আদালতের আইন জানা অভিজ্ঞ জ্ঞানীগুণী মহামান্য বিচারকের দল দেখে-শুনে-ভেবে-বুঝে এদের শেষমেষ সবচেয়ে কড়া শাস্তিটি দিয়েছেন। আমরা বরং কাজী ও কোটালকে ধন্যবাদ দেব যে ওঁরা যেভাবে নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্বপালন করেছেন, তাতে আমার মত সাধারণ এবং ফেকলু পাবলিকের দল নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারে।
লেকিন স্যার, ইয়াহাঁ কহানি মেঁ টুইস্ট হ্যায়।
সাত ফেব্রুয়ারি ২০১৯ তারিখে সূর্য বোধহয় পশ্চিমে উদিত হইয়াছিল। সেদিন শীর্ষ আদালত নিজেদের আগের রায় পালটে দিয়ে ফাঁসির অপেক্ষায় ১৬ বছর ধরে দিন গুণতে থাকা ছ’জনকে শুধু নির্দোষই ঘোষণা করেননি, ক্ষতিপূরণ এবং মিথ্যে মামলায় ছ’জনকে প্রায় ঝুলিয়ে দেওয়ার অপরাধী পুলিশ অফিসারদের বিরুদ্ধে স্টেপ নিতে বলেছেন।
আসামীপক্ষের উকিল গোড়া থেকেই বলে আসছিল যে দিস হ্যাজ বীন আ বচড ইনভেস্টিগেশন। পুলিশ এবং প্রসিকিউশন প্রত্যক্ষদর্শী মা এবং মেয়ের একটি মূল্যবান সাক্ষ্যকে গুরুত্ব দেয়নি। ওই ধর্ষিত এবং প্রাণঘাতী হামলায় আহত দুই মহিলা প্রথমেই থানায় গিয়ে দাগি অপরাধীদের ফাইল দেখে নিজের থেকেই চারজনকে চিহ্নিত করেছিলেন। পুলিশ তাদের গ্রেফতারও করেনি এবং বয়ানও নেয়নি । কেন? কাদের আড়াল করতে এই খেলা?
আইডেন্টিফিকেশন প্যারেডে তাহলে কি ওরা পুলিশের ‘আগে থেকে শিখিয়ে দেওয়া’ লোকেদের থেকে আঙুল তুলেছিল?
আশ্চর্য, পুলিশ না হয় তাদের কোনও গোপন অ্যাজেন্ডায় এভাবে ফলস কেস সাজিয়েছিল, কিন্তু তিন স্তরের মহামান্য আদালত? তাঁরা কী করলেন?
সবারই মনে পড়বে, কলকাতার চোদ্দ বছরের কিশোরীর রেপ ও হত্যায় অভিযুক্ত ধনঞ্জয় চ্যাটার্জির ফাঁসি। পেশায় লিফটম্যান ধনঞ্জয়ও নিজেকে নির্দোষ বলেছিল। ইদানীং কলকাতার ইণ্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিট্যুটের দুই গবেষক অধ্যাপক ওই মামলার চুলচেরা বিচার করে দেখিয়েছেন যে তথ্য ও বিশ্লেষণের আলোয় মামলাটি ধোপে টেকে না।
মনে পড়ছে, কীভাবে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ঊর্দূ ভাষার অধ্যাপক গিলানী পার্লিয়ামেন্ট হামলা কেসে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছিলেন, পরে দর্শনের অধ্যাপক নির্মলাংশু মুখার্জি ও আরও অনেকের প্রয়াসে দিল্লি উচ্চ আদালত তাঁকে বেকসুর ঘোষণা করে মুক্ত করে দেয়।
আমি ভাবি, শাস্তি কম-বেশি হওয়া বোঝা গেল, টেকনিক্যাল কারণে (ধরুন, ফর দ্য ল্যাক অফ সাফিশিয়েন্ট এভিডেন্স) মুক্তি পাওয়া বুঝলাম, কিন্তু আজ যাকে মৃত্যুদণ্ড দিচ্ছি, কাল তাকে ‘সম্পূর্ণ নির্দোষ’! তবেই বুঝুন সহায়সম্বলহীন গরীব মানুষকে মিথ্যে কেস খাইয়ে জেলে পাঠানো, ঝুলিয়ে দেওয়া কত সহজ! দেখুন না, আরুষি তলওয়ার হত্যা মামলায় বাবা-মা (ডাক্তার দম্পতি) কেমন ভাবে লড়ে যাচ্ছেন ভুল জাজমেন্টের বিরুদ্ধে। কিন্তু ওঁরা যদি গরীব হতেন!
বলছি এই জন্যে যে বিভিন্ন কমিশন বা রিসার্চ ছাড়াও প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি আব্দুল কালামের উপলব্ধি হয়েছিল যে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত নাগরিকদের নব্বই শতাংশের বেশি মানুষ হয় গরীব, নয় অন্ত্যজ বা অল্পসংখ্যক সম্প্রদায়ের।
তাবলে কি দেশে আইন কানুন তুলে দিতে হবে? স্পেয়ার দ্য রড, স্পয়েল দ্য চাইল্ড—নীতিটি কি ভুল?
আচ্ছা, আজ তো স্কুলে কর্পোরাল পানিশমেন্ট বন্ধ হয়েছে, শাস্তিযোগ্য অপরাধের মধ্যে গণ্য হয়েছে,-- তাহলে যাবজ্জীবন কারাবাস রেখে প্রাণদন্ড তুলে দিলে কেমন হয়?
এক, আধুনিক রাষ্ট্র কী করে ‘খুন কা বদলা খুন’ নীতি মানতে পারে?
এতে কি অপরাধ কমে? ভারতে কমেছে? আমেরিকায়? আর ‘আই ফর অ্যান আই’ তো বর্বর সমাজের আইন। আর যেসব উন্নত দেশগুলো প্রাণদণ্ড তুলে দিয়েছে (তারাই মেজরিটি) তাদের দেশে কি অপরাধের বাড়-বাড়ন্ত?
দুই, রাষ্ট্র যখন কারও প্রাণ দিতে পারে না, তো নিতে আসে কোন আক্কেলে?
ওই, এবং আরও অনেক ভুল কেস, ভুল শাস্তির বলিদের কী করে জাস্টিস দেওয়া যাবে? কারও প্রথম জীবনের অমূল্য ১৬ বছর ফিরিয়ে দেয়া যায়? যার ঘর ভেঙে গেছে? আর যে নির্দোষ মরে গেছে? তার বৌ-বাচ্চাকে কী বলে সান্ত্বনা দেবেন?
এবার ভাবুন, ওই দণ্ডিতদের কেউ যদি আপনার আমার কেউ হত ? বালাই ষাট, এখনও হয় নি, কিন্তু যদি ভবিষ্যতে হয়?
ভালো লেখা।
ReplyDelete