0

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in

ধারাবাহিক


আহিরণ নদী সব জানে
রঞ্জন রায়

৭)

ছুরিকলাঁ হলো মুখ্যতঃ তাঁতিদের গ্রাম, কিন্তু জাতপাতের ভিত্তিতে আলাদা আলাদা পাড়া গড়ে উঠেছে। যেমন কোষ্টাপাড়া (তাঁতিপাড়া), রাউতপাড়া (গয়লা), লুহারপাড়া (কামার), কুমহারপাড়া (কুমোর), বড়োইপাড়া (ছুতোর)। এরপর ছোটখাট সম্প্রদায়গুলোর বস্তি হলো মুহল্লা। যেমন পাঠান (মুসলমান) মুহল্লা, ছিপিয়া (যারা চুলের ফিতে আলতা এসব বিক্রি করে), সতনামী মুহল্লা ও সহিস (চামড়ার ঢোল তবলা মাদল বানায়) মুহল্লা। 

তবে মূলবস্তি শেষ হয় রাজওয়াড়া মানে রাজবাড়িতে গিয়ে। মেটে রঙের বিশাল প্রাচীর দিয়ে ঘেরা রাজবাড়ি। প্রধান দ্বারের উপর রয়েছে এদের কোট অফ আর্মস, খোদাই করা। আজ চোখ কুঁচকে দেখলে অতিকষ্টে একটি ছোটখাট সিংহ ও ১৮৩৭ সাল চোখে পড়বে। ভেতরে যুবরাজ, মঝলা, সঝলা ও ছোটে কুমারদের আলাদা আলাদা মহল। এককোণে একটি জীর্ণ জীপগাড়ি ও ভ্যান বুড়ো কর্মচারির মত নম্র ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে। এরা প্রত্যেকেই বেশ কালোকোলো এবং নিজেদের ক্ষত্রিয় বললেও চেহারায় স্থানীয় আদিবাসীদের ছাপ স্পষ্ট। রাজবাড়ির মূল অংশের বাইরে আর একটি ছোটখাট বাড়ি। সেটা বড়ে বাবুসাব ও ছোটে বাবুসাবের ডেরা। এরা হলেন রাজার প্রাক্তন মন্ত্রী বা নায়েবের দুই ছেলে। আজ দুই জনেই কিছু করেন না, তবে পৈতৃক সূত্রে যা চাষের জমি ও আহিরণের দুই তীরে জঙ্গলের মধ্যে পড়ত জমি পেয়েছেন ,সেগুলোর ফসল ও জমির টুকরো বেচে বেচে এদের দিন চলে।

এর পরেই পাকদন্ডী পথে নেমে গিয়েছে আহিরণের পাড় অবধি। তারপর নদীর ওপারে ঝরা-সিরকি জোড়া গ্রাম। এর জমিদারি অথবা মালগুজারি দুই বাবুসায়েবের নামে। 

গাঁয়ের আরএকপ্রান্তে নদীর ধার ঘেঁষে আছে বিঁঝওয়ার -মঝওয়ার মুহল্লা(ব্যাকওয়ার্ড ট্রাইব)। তারপরে গাঁড়ামুহল্লা। এরা অন্ত্যজ। এরা নগাড়া বাজায়, নাচে। অথচ এদের এই গাঁড়াবাজা না হলে সবর্ণ হিন্দুর বিয়ে, ছট্টী(নবজাতকের ছয়ষেটেরা) ও দাহসংস্কার পুরো হয় না।

এরপরে ক্ষেতখার (মানে চাষের ও পড়ত জমি) পেরিয়ে নদীর আরেক পাশে রয়েছে কিছু নীচু নীচু মাটির ঘর, মাথা নীচু করে ঢুকতে হয়। এদের বলা হয় সুকবাসী। এরা যাযাবর অন্ত্যজ গরীব মানুষ। এদের মূল গাঁয়ের লোক সন্দেহের চোখে দেখে। এদের নাকি হাতটান খুব, আর মেয়েরা জড়িবুটি বিক্কিরি করে। এরা সবাই খুব খাটতে পারে। ধানকাটার সময় অথবা পঞ্চায়েতের টেন্ডারে ও ওয়ার্ক অর্ডারে রাস্তা বানানো, পুকুর কাটা এসবের জন্যে এদের ডাক পড়ে। এরা মাথা নীচু করে আসে। আটঘন্টার জায়গায় দশঘন্টা খাটে। যা বনিভূতি বা মজুরি দেওয়া হয় মুখবুজে কৃতজ্ঞ চোখে মেনে নেয়। মিনিমাম ওয়েজ অ্যাক্ট ও ডেইলি ওয়েজ পেমেন্ট অ্যাক্টের নাম এরা শোনে নি। তবু মালিকদের শিকায়ত ফুরোয় না। 

এদের গায়ে বুনো গন্ধ; এক একেকজন প্রায় দু’জনের মত ভাত খায় যে! তবে এরা ক্ষেতে পায়খানা করলে মাটি নাকি উর্বরা হয়।

ওরা শীতকালে ধানকাটার পর ভিনগাঁয়ে সপরিবারে চলে যায়; মাঠে তাঁবু খাটিয়ে থাকে। খালি মাঠে চরতে আসা পাখিদের ফাঁদ পেতে ধরে বিক্রি করে। তবে এরা যে বেঁচে আছে এটাই গাঁয়ের লোকজনের চোখে পড়ে না।

ছুরিগাঁয়ের জীবন বয়ে চলেছে আহিরণ নদীর মত –সেই একই খাতে। আদ্যিকাল থেকে যেমন চলে আসছে।

কবে থেকে? তা রামনিবাস জানে না। খালি এটুকু বলতে পারে যে ওর ঠাকুমা বিয়ে হয়ে এসেছিল এই গাঁয়ে। ঠাকুর্দাকে ও দেখেনি। ঠাকুমা বলত যে ওরা আসলে সিঙ্ঘানিয়া। পদবি আগরওয়াল, রাজস্থানের মারওয়ার থেকে এসেছে। সেখানের কোন গ্রামে ওদের ঠাকুমার বাবার পেশা ছিল মীনার কাজ; নাম হয়েছিল। দশ গাঁয়ের লোকে চিনত। 

তারপর কিছু একটা ঘটে; কোন এক ঘটনা, যার ফলে ওর ঠাকুর্দা ঠাকুমাকে নিয়ে পালিয়ে আসে। মারওয়ার থেকে দিল্লি, সেখান থেকে ভোপাল। তারপর বছর খানেকের মাথায় ওই দম্পতিকে দক্ষিণ পূর্ব মধ্যপ্রদেশের ছত্তিশগড় এলাকার আহিরণ নদীর তীরে ছুরি গাঁয়ে নিয়ে আসে মনসুখনারায়ণ জোশী। জোশী হলেন মাড়োয়ারি সমাজের পূজারি ব্রাহ্মণ। ঠাকুর্দা ঠাকুমার বিয়ে দিয়েছিলেন আর ওদের প্রাণ বাঁচাতে গোপনে অন্য লোকের হাতে টাকাপয়সা দিয়ে ওদের ভোপালে পৌঁছে দেন। কিন্তু সেখানে দুশমন খবর পেয়ে যায়। রামনিবাসের বাবা বনওয়ারি তখন ওর ঠাকুমার পেটে। নিরুপায় হয়ে ওরা আবার জোশীজির কাছেই হাতজোড় করে। 

শেষে উনি বললেন তাহলে ছুরিকলাঁ গাঁয়ে চল, আহিরণ নদীর ধারে। রাজপরিবার সিধে সাদা। গ্রাম পঞ্চায়েত আমার কথায় মানা করবে না। আমি রেভিনিউ রেকর্ড দেখে তোদের আবাদী জমিন থেকে তোদের পাঁচ ডেসিমেল জমিন ঘরতোলার জন্যে পাইয়ে দেব। আগে ঘর তুলে নিবি, ইঁটের দেওয়াল ,চূণসুরকির গাঁথনি আর খাপরার ছাদ। তারপর ছ’মাস বাদে পাটোয়ারিকে দিইয়ে আমিই রেভিনিউ অফিসে তোদের বিরুদ্ধে বেজাকব্জা ও সরকারি আবাদী জমিনে বিনা পারমিশন ঘর তোলার নালিশ করে কেস খাওয়াব। দেওয়ানি মামলা। তহসিলদারের কোর্টে বিচার হবে। কোন উকিল লাগাবি না। হাতজোড় করে বলবি হজুর মাঈবাপ! ভুল হয়ে গেছে, মাপ করে দিন। মাথার উপরের ছাদ কেড়ে নেবেন না। ব্যস, সামান্য জরিমানা হবে; জমা করে দিবি।

কেল্লা ফতে। দুমাস পরে তহসিল অফিস থেকে পাকা রেভেনিউ বুক ও রেজিস্ট্রির কাগজপত্তর এসে যাবে। সামান্য খাজনা ধার্য হবে, বাৎসরিক। তোরা ওই জমিনের মালিক হবি। সব একনম্বরের কাগজপত্তর। বুঝলি, যদি আগে থেকে অ্যাপ্লিকেশন দিয়ে নকশা পাস করিয়ে ঘর তুলতে যেতি, তো ‘অনাপত্তি প্রমাণ পত্র, ডাইভার্সন সার্টিফিকেট এসব পেতে ছ’মাস লাগত। ততদিন থাকবি কোথায়!

এইদুনিয়ায় আইন মেনে কাজ করলে সময় বেশি লাগে, গাঁটের কড়ি খসে বেশি। আইন না মেনে কাজ করে আইনের কাছে শরণাগত হও, কমপয়সায় তাড়াতাড়ি কাজ। এটাই ভগবানের বিধান।

ঠাকুর্দা শুধিয়েছিলেন—মহারাজ, শেষ প্রসঙ্গটি বুঝিনি। আমি মুখ্যু মানুষ, যদি একটু খুলাসা করে বলেন।

শোন তবে। বৈকুন্ঠে বিষ্ণুভগবান দুপুরে খেয়েদেয়ে লক্ষ্মীদেবীর সঙ্গে একটু ভাতঘুম দিচ্ছিলেন। এমন সময় অষ্টাবক্র মুনি এসে হাজির। জরুরি কাজ। বিষ্ণু যেন একখুনি হাজির হন। দ্বারী জয়-বিজয় দুই ভাই কিছুতেই ঢুকতে দেবে না। অমন ভিখমাঙ্গা বৈরাগিঠাকুর ঢের ঢের দেখা আছে। অসময়ে ভগবানের ঘুম ভাঙানো যাবে না। কাঁচাখেকো মুনি অগ্নিশর্মা! শাপ দিলেন ওদের বৈকুন্ঠের চাকরি উনি খেয়ে নেবেন। ওদের মানুষের পৃথিবীতে যেতে হবে।

বিষ্ণু ঘুম ভাঙলে উঠে এসে নিজের দারোয়ানদের জন্যে অনেক কাকুতিমিনতি করলেন। কিন্তু হাকিম নড়ে তো হুকুম নড়ে না। মুনিঋষির অপমান। কান ধরে ক্ষমা চেয়েও রেহাই নেই। জয়-বিজয় মালিককে বললে হজৌর, যা করেছি আপনার হুকুমে। এখন আপনি যদি না দেখেন!

তখন অপ্রস্তুত বিষ্ণু আমতা আমতা করে বললেন যে তোরা বেছে নে; যদি ধরতীতে গিয়ে আমার শত্রু রূপে থাকিস, তো তিন জন্মে খালাস। নতুন ট্রান্সফার অর্ডার নিয়ে বৈকুন্ঠে ফেরত, পুরনো ডিউটিতে জয়েন করবি। আর যদি ভক্ত হয়ে জন্ম নিতে চাস তবে ফিরে আসতে সাত জন্ম লাগবে। এখন তোরা যা চাইবি।

ওরা বলল, --মালিক, আমরা চাই শত্রুরূপে জন্ম নিয়ে আপনার হাতে মরে তিনবারে সাজা কেটে মুক্ত হয়ে ফিরে আসব।

উনি বললেন তথাস্তু!

তাই ওরা দু’ভাই সত্যযুগে হিরণ্যাক্ষ- হিরণ্যকশিপু,ত্রেতাযুগে রাবণ-কুম্ভকর্ণ এবং দ্বাপরে শিশুপাল-দন্তাবক্র হয়ে জন্মাল। তারপর বিষ্ণূভগবানেরই তিন অবতাররূপ নরসিং ভগবান, রাম ভগবান ও কৃষ্ণভগবানের হাতে বধ হয়ে মুক্তি পেল। তাই বলছি এসব শাস্ত্রমতে ঈশ্বরের বিধান। 

এভাবেই ছুরি গাঁয়ে সাতঘর মারওয়ারি পরিবার গত আশি বছরে ঠাঁই পেল। এরা সবাই ধানচাল কেনা বেচা আর মুদি দোকান চালায়। ছুরিকলাঁ এখন বর্ধিষ্ণু গ্রাম, জনসংখ্যা দশহাজার ছাড়িয়েছে। আর তাদের উকিল, অভিভাবক, রক্ষাকর্তা হলে জোশী মহারাজ। সবাই দেখা হলে বলে প্যার লাগুঁ। পায়ে পড়ি গো মহারাজ। 

তবে রামনিবাসের ঠাকুমা নাতিকে বলত ওই বিটলে বামুন থেকে শতহস্ত দূরে থাকবি।

কেন ঠাকুমা, উনিই তো তোমাদের এই গাঁয়ে এনে বসিয়েছেন। কত দয়ার শরীর! পরোপকারী।

চুপ কর! তুই সেদিনের ছোঁড়া,কতটুকু দেখেছিস? আমার সোনার মাকড়ি আর রূপোর নাকছাবি ওকে দিতে হয়েছিল। এছাড়া ওর চলে সূদের কারবার। মাসে তিনটাকা হারে।

সন্ধ্যে ঘনিয়ে আসে আহিরণের পারে, ঘাসের উপর বসে অন্যমনস্ক ব্যাংক ম্যানেজার রূপেশ বর্মা একটা শিস ছিঁড়ে চিবুচ্ছিল। রামনিবাসকে বলল এবার উঠলে হয় না ?

-বিলকুল সাহাব। এক আখরি সিজার পিলাইয়ে।

রূপেশ পকেট থেকে পানামা সিগ্রেটের প্যাকেট থেকে দুটো বের করে একটা রামনিবাসকে দিয়ে একটা নিজে ধরায়। রামনিবাস একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে খোসামুদে সুরে বলে—আপকে সংগ দিনভর ঘুম রহা হুঁ। তো সিজার পী রহা হুঁ, নহি তো বিড়ি!

রূপেশ গত ছ’মাসে বহুবার দেখেছে যে ছুরির কয়েকজন সিগ্রেটকে সিজার বলে কেমন গর্বিত ভাবে তাকায়। আর জুটে গেছে রামনিবাস। সকাল আটটা বাজলেই এসে বেল টিপবে। ভেতরে এসে দরজা বন্ধ করে মন দিয়ে খবরের কাগজ পড়বে। ঠুল্লু এসে চা ও জলখাবার দিয়ে যাবে। নিঃসংকোচে সেগুলো সাঁটিয়ে ও সেদিনের চারপাশে কী কী ঘটছে এবং কী কী ঘটবে তার ফিরিস্তি ম্যানেজারকে শোনাবে। রূপেশ সেসব আদ্দেক কান দিয়ে শুনতে শুনতে আগের দিনের বকেয়া কাজ, যেমন ভাউচার চেকিং বা লেজার চেকিং করতে থাকবে। এরপর ও উঠবে স্নান করে ব্যাংক খোলার জন্যে। রামনিবাসও বাড়ি যাবে।

কিন্তু দুপুর গড়িয়ে বিকেল হবার আগেই ও আবার ব্যাংকে হাজির। একটা চেয়ার টেনে নিয়ে এককোণে বসে বসে সকালে পড়া খবরের কাগজ ওল্টাতে ওল্টাতে ও সবাইকে মন দিয়ে দেখে, সবার কথা কান পেতে শোনে। শেষে ব্যাংক বন্ধ হবার সময় ও ম্যানেজারকে ওর সামারি ইন্টেলিজেন্স রিপোর্ট দেয়। ধীরে ধীরে ও রূপেশের কাছে অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। রূপেশের অধিকাংশ ‘দোউরা’ বা ফিল্ড ভিজিট/সার্ভের সময় সঙ্গে রামনিবাস। ওর দুটো গুণ—ভাল মোটরসাইকেল চালায়, বিশেষ করে পুকুরের পাড় এবং ক্ষেতের আল দিয়ে চালাতে হলে। তখন রূপেশ ওর পেছনে বসে,কখনও কখনও চোখ বুজে ফেলে। আর প্রায় প্রত্যেক গ্রামে রামনিবাসের কোন না কোন কুটুম রয়েছে। ফলে চায়-নাস্তা ও ভেতরের খবর সহজেই পাওয়া যায়।

ভাবে সফল ভাবে রাজত্ব চালাতে কিংবা ব্যবসাবাণিজ্য করতে হলে গুপ্তচর খুব জরুরি। কৌটিল্য বলে গেছেন। এছাড়া এখানে ও কাউকে চেনে না, আবার হেড অফিস থেকে নির্দেশ এসেছে। দশটা গাঁয়ের প্রোফাইল তৈরি করতে। যাতে সেখানকার জমি, লোকজন, চাষ ও ব্যাংকের ডিপোজিট ও লোন বিজনেসের সম্ভাবনার স্পষ্ট উল্লেখ থাকবে। আগামী মাসে যে কোন দিন হেড অফিসের অফিসার এসে ইন্সপেকশন করবেন। তখন যেন এই ডায়েরিটা কমপ্লিট থাকে; নইলে—

ফলে ও রামনিবাসকে আরও বেশি করে আঁকড়ে ধরে। মনে মনে সংকল্প নেয়। অন্ততঃ একজন ক্লার্ক পোস্ট হলেই ও আর রামনিবাসকে নিয়ে ফিল্ড ভিজিটে যাবে না। আর রামনিবাস তো কোন কমিশন বা সার্ভিস চার্জ চাইছে না। ও শুধু ওদের আড্ডায় ব্যাংক সাহাব যে ওকে ছাড়া চলতে পারেন না,ও যে সে লোক নয়-এটা বলে ঘ্যাম নেয়। সে যাকগে!

আজকে ওরা ফিরছে ঝোরা –সিরকি গ্রাম থেকে। এখন শীত আসি- ভাই আসি-ভাই করছে। তবু সারাদিনের হ্যাপা আর গাঁয়ের মধ্যে ঘরে ঘরে গিয়ে দরজায় টোকা দেওয়া। কেউ খুললে আলাপ পরিচয় করে তাকে খানিকটা ‘ইমোশনাল অত্যাচার’ করে সেভিংস ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলানো—এসবের একটা ক্লান্তি আছে বইকি!

পাঁচ টাকা দিয়ে খাতা খোলা। তবু অধিকাংশ লোক বলে ওদের কাছে এখন টাকা নেই। আস্তে আস্তে ও বুঝতে পারে এই সব নদীপারের গাঁয়ে নগদের কারবার কম। কাজেই ওদের কাছে পাঁচটাকা নগদ না থাকা অস্বাভাবিক নয়। কয়েকবার ও নিজের পকেট থেকে পাঁচটাকা বের করে দিয়েছে। বলেছে যেদিন ব্যাংকে আসবে সেদিন মনে করে আমাকে ফেরত দিও।

রামনিবাস হাঁ-হাঁ করে উঠেছে। সাহেব, এমন ভুলটি করবেন না। নিজের পকেট থেকে টাকা না খসলে মানুষ ওর ব্যাংক অ্যাকাউন্টকে নিজের মনে করে না, সরকারি কারবার ভাবে। সরকার কা মাল,দরিয়া মেঁ ডাল। আর এভাবে দান-খয়রাত করতে থাকলে আপনার মাসের মাইনের পুরো টাকাটা ওদের পেটে যাবে। আমাকে কথা বলতে দিন। ফির আপ মেরা জাদু দেখনা।

রামনিবাস সত্যিই ম্যাজিক দেখাল। যেই কেউ বলে টাকা নেই ও হো-হো করে হেসে ওঠে। বলে সে কী! এতবড়ো গৌটিয়া, দশগাঁয়ে নামডাক। তার ঘরে পাঁচটা টাকা নেই,লোকে শুনলে বলবে কী! আর এই কথা যদি অমুক গ্রামে তোর সমধি-সমধিনের (বেয়াই-বেয়ানের) কানে পৌঁছে যায় তাহলে ওরা কী ভাববে? হাভাতে পরিবারে বিয়ে দিয়েছি? শোন, চালের বাতায় হাতড়ে দেখ, ঠিক পেয়ে যাবি। নয় তো তোর গিন্নিকে শুধিয়ে দেখ। আর নইলে পাশের বাড়ি থেকে ধার নে। আরে আমরা খালি হাতে ফিরে যাব? ব্যাংক ম্যানেজারকে ফিরিয়ে দিবি? এ তো মালক্ষ্মী কে বিদেয় করা! দেখিস নি, শেঠেদের গদ্দিতে তিজৌরির (সিন্দুকের) পাশের দেয়ালে বড়ো বড়ো করে লেখা থাকে ‘কুবের মহারাজকে ভান্ডার সদা ভরা পুরা রহে!’ আর তুই স্বয়ং কুবের মহারাজকে তোর দ্বার থেকে শূন্য হাতে বিদেয় করবি? ধর্মে সইবে? ভেবে দ্যাখ।

এর পরে আর কাউকেই খুব বেশি ভাবতে হয় না।

একদিনে জমাখাতা খোলা অভিযানের সাকসেস রেট খুব খারাপ নয়। কৃতজ্ঞ রূপেশ শীতের সন্ধ্যেয় ঘনিয়ে আসা বিষণ্ণ অন্ধকারে মোটর সাইকেল স্টার্ট করতে করতে রামনিবাসকে শুধোয় কালকে ও জোশী মহারাজের গদ্দিতে নিয়ে পরিচয় করিয়ে দিতে পারবে কি না।

0 comments: