0

গল্প - সৌমিত্র চক্রবর্তী

Posted in

গল্প


অযান্ত্রিক
সৌমিত্র চক্রবর্তী


ঘুম আসছে না। নির্জন পায়ে পায়ে পাশের ঘরে এল। আদুল গায়ে গভীর ঘুমোচ্ছে ছেলেটা। রাত বাতির আলোয় ফর্সা পিঠটা দেখতে ঝুঁকল নির্জন। নাঃ, দাগ টাগ কিছু নেই। ব্যথা আছে নিশ্চয়। খাটের পাশে হাঁটু মুড়ে বসে ছেলের পিঠে হাত বুলোতে লাগল। দুম করে মাথাটা এমন গরম হয়ে গেল সন্ধ্যাবেলায়! নির্জন মনে মনে নিজেকে দেখে হাসল। বুবু যখন ছোট্ট ছিল, মানে যে বয়সে বাচ্ছারা মা বাবার হাতে পিটুনি খায়, একদিনের জন্যও ছেলের গায়ে হাত তোলেনি সে। বরং মিতা হাত চালালে মাঝে দাঁড়িয়েছে। আর এখন, এই বছর তিনেক সে যে কতোবার মারল ছেলেটাকে! সব জেনে শুনেও বারবার! আদরের স্পর্শ পেয়ে শরীর গুটোচ্ছে বুবু। মিতাও উশখুশ করছে। সুগার ধরা পড়ার পর থেকে মাঝে মাঝে রাতে ওঠে ও। এখন দুজনের কেউ জেগে গেলে ভীষণ লজ্জার হয়ে যাবে। নির্জন তাড়াতাড়ি বারান্দায় সরে এল।



হলদে আলোয় পিছলে যাচ্ছে রাস্তা। অনেক ওপর থেকে ঘুমন্ত শহরটার দিকে তাকাল নির্জন। সারাদিনের ধকলের শেষে যে যার মতো আরাম খুঁজছে সুখ, বিষণ্ণতা, ক্ষোভ জড়িয়ে। শুধু তার মতো দুয়েকজন নিশাচরের মতো খুঁড়ছে নিজেকে। শব্দের শীৎকার তুলে একটা ইয়ামাহা ছুটে গেল বেলাগাম। আঠারো কুড়ির এক আরোহী। এ বে-লাগামী উল্লাস কি বয়সের, মাদকদ্রব্যের না কি ওই ছেলেটিরও বুবুর মতোADHD আছে? Attention Deficit Hyperactive Disorder! আনন্দ সিনেমার রাজেশ খান্না তার অসুখের নাম শুনে খুশীর ভান করেছিল, "লিম্ফোসারকোমা অফ দ্য ইন্টেস্টাইন! আহা কি বড় নাম! কি ঝংকার! অসুখ হলে এমনই হওয়া উচিত।" পাঁচ বছরের বুবুর বাবা হিসাবে অমন খুশী হতে পারেনি নির্জন। বরং দিশাহারা বোধ করেছিল। আগে কখনও নাম শোনেনি অসুখটার, কাজেই এর ধরন বা তীব্রতা নিয়েও আন্দাজ ছিল না। ছোট থেকে দুষ্টু ছিল বুবাই, ভীষণ চঞ্চল। এক মূহূর্ত চুপ থাকতনা পুঁচকেটা। ব্যাপারটা গায়ে মাখেনি মিতা বা সে। তাদের অজ্ঞতার ওপর প্রথম আলো ফেলল বিলু মামা, মায়ের খুড়তুতো ভাই, ডাক্তার, লন্ডন প্রবাসী।



"দেখুন, ওর জীবনটা কিন্তু বেশ কঠিন হতে চলেছে। শুধু তো ADHD নয়, পাশাপাশি এপিলেপ্সিও ধরা পড়ল। যদিও বিনাইন রোল্যান্ডিক এপিলেপ্সি সবচেয়ে কমন ফর্ম অফ এপিলেপ্সি, ইন ফ্যাক্ট ফরটি পার্সেন্ট চাইল্ড এপিলেপ্সিই BRE, এবং তা বড় হলে সেরেও যায় বেশীরভাগ ক্ষেত্রে, তবু এর সাইড এফেক্টগুলোকে কিন্তু ইউ হ্যাভ টু বেয়ার। আমাদের মেইন টার্গেট কিন্তু যাতে ওর এপিলেপ্টিক সিজারটা রেকার না করে। কারণ, পরপর দুবার দেখে নিশ্চয় বুঝেছেন ইমপ্যাক্টটা।" নির্জন মিতা মাথা নেড়েছিল। দেখেছে বৈকি সরস্বতী পূজার পরের দিন রাতে। মাঝখানে শুয়ে থাকা বুবু হঠাৎ প্রচণ্ড জোরে মাথা নাড়াতে শুরু করল, যেন ভর হয়েছে। মুখের কোণ দিয়ে ততক্ষণে উথলোচ্ছে গ্যাঁজলা। মিতা কোলে তুলে নিয়েছিল ছোট্ট শরীরটাকে। মাথাটা হেলে পড়ল দ্রুত, চোখ উল্টোনো। নির্জন হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। তার মনে হয়েছিল এক্ষুণি রক্তচাপ শূণ্যে নেমে জ্ঞান হারাবে সে। তারপর হঠাৎই ছেলেটা শান্ত হয়ে গেল। নিথর। খালি বুকটা উঠছে নামছে। গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল বুবু। পরেরদিন ডঃ সোম জানালেন একটা নয়, এক জোড়া খটমট রোগের রুগী তাদের ছোট্ট ছেলে। নির্জন অজান্তেই লম্বা শ্বাস টেনেছিল। তারপর জানতে চেয়েছিল সাইড এফেক্টগুলো। লম্বা ফর্দ- মনোযোগের অভাব হবে, মেমরি লস হবে মাঝে মাঝে, বলবার বা লেখবার উপযুক্ত শব্দ হাতড়াবে মাঝে মাঝেই, লার্ণিং ডিসেবিলিটি থাকতে পারে, অতিরিক্ত চঞ্চলতা, খারাপ কাজ বা কথার প্রবণতা... লিস্ট বেড়েই চলেছিল। আর সবশেষে ছিল অমোঘ নিদান, "ওর থেকে কোনও অ্যাকাডেমিক কেরিয়ার এক্সপেট করবেননা। ও যতটা এগোবে, জানবেন সেটাই অনেক।" ডাক্তারবাবুর কথাগুলো বুবুর ছোটবেলায় তীব্রভাবে ফলেনি তেমন। মোটামুটি একরকম চলতে চলতে ঝামেলাটা পাকালো ক্লাস সিক্সে, মানে হাই স্কুলে এসে।



এতোদিনের ছোট ছোট পরীক্ষার স্টাইল ছেড়ে এবার বড় সাইজের টেস্ট। সঙ্গে সায়েন্সের তিনভাগে ভেঙে যাওয়া। পিছিয়ে পড়া শুরু হল, সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অন্যমনস্কতা আর কোয়েশ্চেন ছেড়ে আসা। জানা জিনিস না লেখা, হোমওয়ার্ক ভুলে যাওয়া এক নতুন লড়াইয়ের সামনে দাঁড় করালো নির্জনকে। সব প্রতিবন্ধকতা ঠেলে ছেলেকে নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার লড়াই। নির্জনের মনে হত সে যেন একটা হাইওয়েতে চলেছে বুবুকে নিয়ে, যেখানে সবাই সাঁ সাঁ করে ছুটে চলেছে শুধু তাদের ছ্যাকরা গাড়িটা ছাড়া। মাঝে মাঝে জোরে ছোটে, না হলে সেই ক্যাঁচকোঁচ। অফিস সামলে দুবেলার যুদ্ধ লড়তে গিয়ে ক্লান্ত সৈনিক নির্জনের রাগ আর হাত আছড়ায় আজকাল ছেলেটার পিঠে মুখে। প্রথমবার খুব অবাক হয়ে গিয়েছিল বুবু, ভাবতেই পারেনি ওর বাবান ওকে মারতে পারে।



এরপর মাঝে মাঝেই। ধৈর্যের নাগাল হাতছাড়া হলেই হাত চালানো শুরু। পরে আক্ষেপ হত, খারাপ লাগত নিজের অসংযমে। মনকে বোঝানোও যেত বুবুর সীমাবদ্ধতা, কিন্তু পরিবেশ পরিস্থিতি উগরে দিত রাগ। সে রাগ কার উপর কে জানে, কিন্তু গন্তব্য একটাই- নির্জনের ছেলে, একমাত্র আদরের ছেলে। কিন্তু আজ... আজও নির্জন সামলাতে পারেনি নিজেকে যখন একটা প্রবলেম সাম আটবারেও শেষ হলনা বুবুর। তেড়ে উঠেছিল, বুবু ভয়ে গুটিয়ে নিয়েছিল দেহটা, ওর গুটিয়ে যাওয়াটা দেখে আরও খেপে গিয়েছিল নির্জন, মনে হয়েছিল একে তো কিছু পারেনা, তার উপর আবার শাস্তির হাত থেকে পালাচ্ছে। বেধড়ক হাত চালাতে শুরু করেছিল সে, চড়ে চটাচট শব্দ আরও হিংস্র করছিল তাকে, মনে হচ্ছিল এই রাগ আর শাস্তি কোনওটাই শেষ হওয়ার নয়। হঠাৎ সজোরে ডান হাতটা নেমে এসেছিল বুবুর পিঠে। ঠা-আ-স! নিজেই থেমে গিয়েছিল নির্জন সে আওয়াজে। বুবু কুঁকড়ে শুয়ে থাকল কিছুক্ষণ, তারপর ডুকরে কেঁদে উঠে দাঁড়াল। ছেলের চোখের দিকে তাকিয়ে হতভম্ব হয়ে গেল নির্জন। সে চোখে ব্যথা নেই, খালি টপটপ করে জলের সঙ্গে ঝরে পড়ছে ক্রোধ আর ঘেন্না। ঝটকা মেরে নিজের ঘরে ঢুকে গিয়েছিল বুবু, সজোরে দরজা ভেজিয়ে দিয়েছিল। চড়ের শব্দে আগেই ছুটে এসেছিল মিতা, ছেলের পেছন পেছন ঢুকেছিল ঘরে। আর এ ঘরে খারাপ হয়ে যাওয়া যন্ত্রের মতো থম মেরেছিল নির্জন তখনও ফণা তুলে থাকা রাগ আর অনুতাপের মুকুল হাতে। তার কানে সীসার মতো উগরে পড়ছিল ভেজানো দরজার ওপার থেকে আনকোরা কিছু শব্দ।



বাইকটা যাতায়াত করছে বারবার বিশ্রী শব্দ করে। যেন রাতটাকে বিরক্ত করতে চাইছে জেনেবুঝে। আসলে প্রতিটি জীবনের নিজস্ব কিছু দাবি থাকে, থাকে সীমাবদ্ধতা যা অন্যকোনও জীবনের অভিজ্ঞতম আয়নাতেও প্রতিফলিত হয়না। "সব সময়ে মস্তানি, সব সময়ে চোখ রাঙানি। কেন গায়ে হাত তুলবে লোকটা? ওই লোকটা বাবা না মস্তান?" মিতার সব প্রতিরোধের চেষ্টা পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছিল অগ্ন্যুৎপাতের সামনে, "আমি কোনও ভুল করিনি। আমার পড়তে ভালো লাগেনা। অংক করতে আমার বিরক্ত লাগে। আমি বুঝিনা, আমি কি করব? তাবলে মারবে কেন সব সময়ে? ওই লোকটা পারে সব কাজ করতে? আমার আতংক হয়ে গেছে এই লেখাপড়া। বাবা! বাবা! এর নাম বাবা! আমার ঘেন্না হয় ওই লোকটার কাছে পড়তে।" হিসহিসানি বেড়েই চলেছিল, সঙ্গে কান্না। বেশ কিছুক্ষণ পরে এ ঘরে এসেছিল মিতা, ও জানত আগ্নেয়গিরির লাভা গড়াতে গড়াতে এ ঘরেও এসে পৌঁছেছে। নির্জন হাত তুলে থামিয়েছিল বৌয়ের কিছু বলতে চাওয়াকে। শুধু ভেঙে পড়তে পড়তে জানতে চেয়েছিল, "ও কাকে ওই লোকটা বলছিল?আমাকে?"



গুমোট ছড়াচ্ছে রাতটা। নাকি সব ঠিকঠাকই আছে, হাওয়া দিচ্ছে এ শহরে? শুধু নির্জনের নিদ্রাহীনতাই বে-বাতাস? হয় তো, এমন হয়। মাঝে মাঝে হিসেবের গোড়ায় গলদ হয়ে গেলে অংকেরা ফাঁস হয়ে গলায় চেপে বসে। আচ্ছা, কি হয় যদি বুবু তেমন লেখাপড়া না শেখে? যদি মাধ্যমিক অবধি গিয়ে আর না জারি থাকে ওর নম্বরের দৌড়? সব ধ্বংস হয়ে যাবে? বুবু বাঁচবেনা? ও এতো মানবিক, এতো নরম মনের,এতো ভালোবাসায় ভরা, এই সব... এই স-অ-ব ঢাকা পড়ে যাবে কয়েকটা লাল দাগে? তারচেয়ে ওর সুস্থভাবে বেঁচে থাকাটা কি বেশী জরুরী নয়? সেটা নিশ্চিত করাই কি নির্জনের জীবনে প্রায়োরিটি লিস্টের উপরের দিকে পড়ে না? প্রায়োরিটি লিস্ট, ইয়েস, প্রায়োরিটি লিস্টটা ঢেলে ঝেড়ে-মুছে সাজানো দরকার। বাকি দুনিয়ার মতো আতসকাঁচ হাতে বসে না থেকে নতুন করে আরেকবার বুবুর বাবান হয়ে উঠতে হবে তাকে। রাতের গভীরতা ভোরের আগমণীতে দ্রবীভূত হতে চলেছে। বাবা বলতেন এ ব্রাক্ষ্ম মুহূর্ত, বড় পবিত্র সময়। এ সময়ে ভালো কাজ করতে হয়, ভালো ভাবতে হয়। ফরসা হয়ে আসতে থাকা শহরটার চোখে একবার চোখ রেখে "ওই লোকটা" থেকে বাবা হওয়ার জন্য নির্জন ভেতরে দ্রুত পা চালাল। একবার, হ্যাঁ, আরেকবার বুবুর পিঠের ওই জায়গাটায় হাত রাখা তার ভীষণ দরকার।

0 comments: