গল্প - সৌম্য ব্যানার্জী
Posted in গল্প
গল্প
বিবর্তন
সৌম্য ব্যানার্জী
প্রাসাদশীর্ষে দাঁড়িয়ে অশান্ত সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে ছিলেন মহাপ্রশাসক মাহাদেনকার্ষপ। অস্তগামী সূর্যের লোহিতাভা সমুদ্রের সঙ্গে একাকার হয়ে রক্তাক্ত করে তুলছিলো জলকে...
মাহাদেনকার্ষপের মুখ চিন্তাক্লিষ্ট। পাশে দাঁড়িয়ে প্রধান সচিব বারুন্দরেখ। তাঁরও কপালে ভ্রুকূটি। সমুদ্রের জল বাড়ছে। কথাটা এক বছর আগে প্রশাসন পরিষদে প্রথম বলেছিলেন অর্ণবাচার্য আন্তরীশ। তাঁর সংস্থার পর্যবেক্ষণে ধরা পড়েছিলো, উত্তরদিক থেকে জল ঢুকছে সমুদ্রে। হিমশীতল জল। মৎস্যজীবীদের সাক্ষ্যেও সে দাবির সত্যতা প্রতিপন্ন হয়েছিলো। সামুদ্রিক প্রাণীরা বিপুল সংখ্যায় প্রাণ হারাচ্ছে প্রতিদিন। হুহু করে কমে যাচ্ছে জলের তাপমাত্রা।
প্রশাসন পরিষদে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে এই বিষয়ে। বৈজ্ঞানিকদের সঙ্গে প্রহরের পর প্রহর কাটিয়েছেন প্রশাসকরা। প্রাথমিক পর্যায়ের বিশ্লেষণে বোঝা গেছে, মহাসাগরের সুদূর উত্তরে যে চিরতুষারাচ্ছ্বাদিত দেশ, কোনও কারণে সেখানকার তুষার গলতে আরম্ভ করেছে। সেই তুষার-গলা জল এসে মিশছে সমুদ্রে। তাই জল বাড়ছে। যত দিন যাবে, এই বাড়ার গতি আরও বৃদ্ধি পাবে।
দ্বিতীয় পর্যায়ে শুরু হয়েছে এর প্রতিকার বিষয়ে আলোচনা। সেই সব আলোচনায় প্রযুক্তিবিদদের সঙ্গে সঙ্গে যোগদান করেছেন কবি-শিল্পীরাও। মাহাদেনকার্ষপের ব্যক্তিগত অমন্ত্রণে এসেছেন শিল্পমন্দিরের অধ্যক্ষা বিন্দমীণা। দ্বীপবাসীরা সবাই জানে মাহাদেনকার্ষপ ও বিন্দমীণার ঘনিষ্ঠতার কথা। প্রজ্ঞানিকেতনে সহপাঠী ছিলেন দু’জন। প্রশাসনিক বিষয়ে মাঝে মাঝেই বিন্দমীণার পরামর্শ গ্রহণ করেন মাহাদেনকার্ষপ।
দ্বীপরাষ্ট্রের সব চিন্তাবিদ সম্মিলিত হয়ে উপলব্ধি করেছেন, স্থানান্তরন ছাড়া আর কোনও উপায় নেই... অর্থাৎ অন্য ভূখণ্ডের উদ্দেশ্যে সমুদ্রযাত্রা। দ্বীপরাষ্ট্রের সমগ্র জনসংখ্যাকে নিয়ে একসঙ্গে এক জায়গায় যাওয়া যাবে না। তাতে সেখানকার প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হবে। তাই পৃথক ভাগে গিয়ে উপনিবেশ স্থাপন করতে হবে বিভিন্ন ভূখণ্ডে।
পূর্ব উপকূলে যাবে দু্’টি নৌবহর। একদল উত্তরে, আরেক দল দক্ষিণে। দক্ষিণ উপকূল পরিক্রমণ করে আরও সুদূর পূবে যাবে আরেক বাহিনী জলযান। পশ্চিমদিকে যাত্রা করবে বাকি দু’টি দল। এই পাঁচ ভাগে সমুদ্রযাত্রার জন্য প্রয়োজন হবে পাঁচ সহস্র বৃহৎ ও শক্তিশালী জলযানের। আন্তরীশ ও যানপ্রযুক্তিবিদ মার্হবিনকের তত্ত্বাবধানে আরম্ভ হয়ে গেছে জলযান নির্মাণকার্য। বৈজ্ঞানিকরা বলেছেন, দ্বীপরাষ্ট্র সম্পূর্ণ জলমগ্ন হওয়ার অনেক আগেই নির্মাণকার্য নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হবে।
দ্বীপবাসীদের সব কথা জানানো হয়েছে। তাদের ইচ্ছা ও সংস্থানের উপর ভিত্তি করে নির্দিষ্ট হয়েছে কে কোথায় যাবে। সবাই সেই অনুযায়ী প্রস্তুতি নিচ্ছে। বয়োঃবৃদ্ধের দল উৎকন্ঠিত। অল্পবয়স্করা উত্তেজিত। পাঁচ সহস্র বছরের উপনিবেশ ছেড়ে আবার বেরিয়ে পড়ার সময় এসেছে...
শুধু বিন্দমীণার চোখে একটু অনিশ্চয়তা ছিলো। স্থানান্তরন যে অবশ্যম্ভাবী, তাই নিয়ে শিল্পীশ্রেষ্ঠারও দ্বিমত নেই। কিন্তু জলযান নির্মাণসংক্রান্ত আলোচনাগুলিতে বিন্দমীণা একটু যেন অন্যমনস্ক ছিলেন। মাহাদেনকার্ষপ একান্তে জিজ্ঞেসও করেছিলেন তাঁকে। শিল্পীশ্রেষ্ঠা শুধু বলেছেন --আরেকটু চিন্তা করতে দাও। ধ্যানমন্দিরে যাওয়া প্রয়োজন।
তারপর থেকে আলোচনাসভাগুলিতে আর আসেননি বিন্দমীণা। মাহাদেনকার্ষপও ভেবেছেন ধ্যানমন্দিরে যাওয়ার কথা। ব্যবস্থাপনার ব্যস্ততায় হয়ে ওঠেনি। গতকাল নির্মাণকার্য পরিদর্শন করে এসে কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়েছেন। আজ প্রাসাদশীর্ষে দাঁড়িয়ে অপরাহ্নবেলার সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে স্মরণে এসেছে...
--শিল্পীশ্রেষ্ঠার সংবাদ কি?
--তিনি আজকাল অধিকাংশ সময় ধ্যানমন্দিরে অতিবাহিত করছেন। বলেছেন বারুন্দরেখ। প্রজ্ঞানিকেতনে ইনিও সহপাঠী ছিলেন এঁদের।
..........
মোমবাতির সারি জ্বলছে দীর্ঘ অলিন্দের দু’ধারে। অলিন্দপথে একা হাঁটছেন মাহাদেনকার্ষপ।
পাঁচ হাজার বছরের পুরনো ধ্যানমন্দির। আদতে কি উপাদান ব্যবহৃত হয়েছিলো এই বিশাল মৎস্যাকৃতি স্থাপত্যটি নির্মাণের জন্য, এখন আর বোঝা যায় না। সারা গায়ে সূক্ষাতিসূক্ষ কারুকার্য নিয়ে দ্বীপরাষ্ট্রের কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে আছে। মৎস্যের মুখবিবর এর প্রবেশদ্বার। প্রবেশদ্বারের সামনে দাঁড়ালে দেখা যায়, উপরে মাছের কপাল জুড়ে স্ফটিক জাতীয় কোনও বস্তুর একটি অচ্ছাভ আবরণ। ঢুকে দু’পাশে দু’ধাপ সিঁড়ি উঠে গেছে উপরে, আর সমুখে দীর্ঘ অলিন্দ চলে গেছে মাছের উদর অভিমুখে।
অলিন্দ পার হয়ে মাহাদেনকার্ষপ উপস্থিত হলেন এক সুপরিসর গর্ভগৃহে। কক্ষের অপরপ্রান্তে বিস্তৃত বেদীর উপর পাশাপাশি দাঁড়িয়ে পাঁচটি বিশালকায় মূর্তি। ভাস্কর্যের উপাদান বোঝা যায় না। ধাতু ও প্রস্তরের মধ্যবর্তী কোনও বস্তু। তিনজন পুরুষ ও দু’জন নারী।
বেদী থেকে কিছু দূরে ভূমির উপর উপবিষ্টা বিন্দমীণা। গভীর ধ্যানমগ্না। এই নারীকে বিগত বহু বছর যাবত দেখছেন মাহাদেনকার্ষপ। তবু আজও পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারেননি। রহস্যময়ী এই নারী যেন কোনও সুদূর লোকের বাসিন্দা...
প্রজ্ঞানিকেতনের দুই শ্রেষ্ঠ ছাত্রছাত্রী ছিলেন মাহাদেনকার্ষপ ও বিন্দমীণা। বস্তুত, বিন্দমীণা অধিক মেধাবিনী ছিলেন। কিন্তু শিক্ষান্তে প্রশাসন সচিবের পদ স্বভাবজ নম্রতার সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করে তিনি গ্রহণ করেন শিল্পমন্দিরের সহাধ্যক্ষার পদ।
তারপর বহু বছর অতিবাহিত হয়েছে। বিন্দমীণা এখন শিল্পমন্দিরের মহাধ্যক্ষা, এবং সেদিনের সহকারী প্রশাসন সচিব মাহাদেনকার্ষপ আজ মহাপ্রশাসক। দু’জনের বন্ধুত্ব আজও অটুট আছে। দু’জনের কেউই পরিবারবৃদ্ধির চেষ্টা করেননি। একাগ্রভাবে নিজেদের কর্তব্য সম্পাদন করে গেছেন।
বিন্দমীণার ধ্যানভঙ্গ হলো। চোখ খুলে দেখলেন, মহাপ্রশাসক তাঁর পাশে দণ্ডায়মান। উঠে দাঁড়িয়ে স্নিগ্ধ হেসে জিজ্ঞেস করলেন --এত চিন্তাক্লিষ্ট কেন, কার্ষপ? ব্যবস্থাপনা তো সুষ্ঠুভাবেই চলছে বলে জানি।
--হ্যাঁ, ব্যবস্থায় ত্রুটি নেই। আশা করা যায় স্থানান্তরন নিরাপদেই হবে।
--তাহলে তুমি এত চিন্তান্বিত কেন?
মাহাদেনকার্ষপের মুখে একটি বিষণ্ণ হাসির উদ্ভাস হলো। --আমি কেন চিন্তিত, সে কথা কি তুমি জানো না, মীণা?
বিন্দমীণাও হাসলেন। --জানি। তাই তো ভাবছি। মনঃসংযোগ করার জন্য প্রতিদিন আসছি এখানে।
খানিকক্ষণ নীরবতার পর মাহাদেনকার্ষপ যেন আত্মগতভাবে বলতে আরম্ভ করলেন... --একদিন সময় আসবে, জানতাম। ছড়িয়ে পড়তে হবে এই গ্রহের দিকে দিগন্তে। প্রতিষ্ঠাতাদের ভবিষ্যদ্বাণী সেইরকমই ছিলো। কিন্তু এত অপ্রস্তুতভাবে চলে যেতে হবে, ভাবিনি কখনও। আবার নতুন করে শুরু করার পর আমরা আর কতদিন ধরে রাখতে পারবো আমাদের বিজ্ঞান-প্রযুক্তি-দর্শন-শিল্পের সুমহান ঐতিহ্য? আদৌ পারবো কি?
--পারবো না। ধীরে ধীরে মাথা নাড়লেন বিন্দমীণা। --কিন্তু কি আসে যায়, যদি না-ই পারি তো?
অবাক হয়ে তাঁর দিকে তাকালেন মাহাদেনকার্ষপ। --কিছু আসে যায় না? এতদিনের অর্জিত এই বিপুল জ্ঞানভাণ্ডার নষ্ট হয়ে গেলে আসে যায় না কিছু?
--না। আবার মাথা নাড়লেন বিন্দমীণা। --প্রতিষ্ঠাতারা পূর্বভূমি থেকে যে অতুল প্রজ্ঞা নিয়ে এসেছিলেন, তার কতটুকু আমরা ধরে রাখতে পেরেছি, কার্ষপ? এই যানের পরিচালনকৌশল অবধি আমরা সম্পূর্ণ বিস্মৃত। বিগত চার হাজার বছর ধরে আমরা একে শুধুমাত্র ধ্যানমন্দির রূপে ব্যবহার করছি। আমরা বিস্মৃত সেই অত্যাশ্চর্য বস্তুবিদ্যা, যার সাহায্যে নির্মিত হয়েছিলো এই যান, প্রতিষ্ঠাতাদের মূর্তিগুলি এবং আরও অনেক কিছু।
একটু থামলেন বিন্দমীণা। তারপর বললেন, --কেন আমরা সে সব বিদ্যা ভুলে গেছি জানো? কারণ সেগুলির আর প্রয়োজন হবে না কোনওদিন। আমাদের পূর্বভূমি বহুকাল ধ্বংসপ্রাপ্ত। এই যান আর কোনওদিন প্রত্যাবর্তন করবে না সেখানে। প্রয়োজন হবে না বস্তুসংশ্লেষেরও। কারণ, প্রযুক্তিবিদ্যাকে এগিযে নিয়ে যাওয়ার জন্য যে উপাদানরাজির প্রয়োজন, এই আশ্চর্য গ্রহে সেই সব উপাদানের প্রাচুর্য। এ আলোচনা আমরা আগেও করেছি। এই গ্রহের সভ্যতাকে তার নিজস্ব গতিপথ ধরে অগ্রসর হতে হবে। আমাদের বিজ্ঞান, দর্শন এদের সভ্যতাকে অতি দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যাবে, সে কথা সত্য। কিন্তু তাতে এদের অবস্থা হবে শৈশব থেকে সোজা পূ্র্ণযৌবনে উপনীত হওয়ার মতন। সে যে সুস্থ অগ্রগতি নয়, তা নিয়ে তো আমাদের কোনওদিন কোনও দ্বন্দ্ব ছিলো না!
--না, ছিলো না। সেই কারণেই বিগত পাঁচ সহস্র বছর আমরা নিজেদের বিজ্ঞানকে সীমাবদ্ধ রেখেছি এই দ্বীপরাষ্ট্রের মধ্যে। কিন্তু বিজ্ঞান-প্রযুক্তির কথা যদি ছেড়েও দিই, এত হাজার বছর ধরে অর্জিত আমাদের এই সৌহার্দ্য-সম্প্রীতির চেতনা, সেও যে নষ্ট হয়ে যাবে! মাহাদেনকার্ষপের কন্ঠে আর্তি... --সভ্যতার প্রাক্কালে পূর্বভূমির রক্তাক্ত ইতিহাস কি তুমি ভুলে গেছো?
--আমি কিছুই ভুলিনি। মাথা নাড়লেন বিন্দমীণা। --এই গ্রহের সভ্যতাকেও সেই সংঘাতের সাক্ষ্য বহন করতে হবে। আমাদের উত্তরপ্রজন্মেরা, যারা তাদের শোণিতস্রোতে এই সৌহার্দ্য-সম্প্রীতির চেতনা বহন করবে, তারা হয়তো চেষ্টা করবে হিংসা-দ্বেষ রোধ করার। তারপর একদিন, হয়তো কয়েক সহস্র বছর পরে, তাদের সে প্রচেষ্টা সফল হবে। এই গ্রহের মানবজাতি হিংসাপ্রবৃত্তি জয় করে অগ্রসর হবে আলোকপ্রাপ্তির পথে।
বিন্দমীণা থামলেন। হাসলেন। বড় রহস্যময় হাসি। তারপর গভীর স্বরে বললেন, --জানো কার্ষপ, আমাদের পূর্বভূমিতে এই গ্রহের মতন এত প্রাণবৈচিত্র ছিলো না। সে গ্রহ আকারে ক্ষুদ্রতর ছিলো। মাধ্যাকর্ষণের টান কম হবার কারণে সেখানকার প্রাণীরা বৃহদাকৃতি ছিলো। যেমন ছিলেন প্রতিষ্ঠাতারা। বিন্দমীণার দৃষ্টি বেদীর উপর মূর্তিগুলির দিকে নির্দেশ করলো। --এই সিক্ত, শ্যামল, বিশাল গ্রহ আমাদের পূর্বভূমির মতন নয়। এ গ্রহ প্রাণপ্রাচুর্যে পূর্ণ। সরল, নিষ্পাপ, আনন্দময় প্রাণ।
মাহাদেনকার্ষপ একাগ্রচক্ষে তাকিয়ে আছেন। বোঝার চেষ্টা করছেন...
--চিন্তাবিদদের এখানে ডাকো, কার্ষপ। দ্বীপরাষ্ট্রের সব শিল্পী, সাহিত্যিক, দার্শনিক, বিজ্ঞানীকে ডাকো। জানি, তোমরা সবাই ব্যস্ত। তবু এ সমাবেশ প্রয়োজনীয়, অত্যন্ত প্রয়েজনীয়।
..........
জল বাড়ছে হু হু করে। সগর্জনে সমুদ্র প্রবেশ করছে দ্বীপে। এক মাস আগে পাঁচ হাজার জলযান নিরাপদে পাড়ি দিয়েছে। যাননি শুধু মাহাদেনকার্ষপ, বিন্দমীণা, আন্তরীশদের সঙ্গে দ্বীপরাষ্ট্রের দু’শোজন চিন্তাবিদ... কবি, শিল্পী, দার্শনিক, বিজ্ঞানী। এঁরা স্বেচ্ছায় থেকে গেছেন। ধ্যানমন্দিরের সমাবেশে আহুত সহস্রাধিক চিন্তাবিদকে বিন্দমীণা বলেছিলেন তাঁর সিদ্ধান্তের কথা। তাঁদের মধ্যে এই ক’জন সে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। প্রাণনাশের ঝুঁকি থেকেছে তাতে। কিন্তু সাফল্যের সম্ভাবনায় বিশ্বাস করেছেন এঁরা... উদ্বেল হয়েছেন সে সাফল্যের পরবর্তীকালীন অনাবিল আনন্দের কথা ভেবে।
তাঁরা সবাই এখন ধ্যানমন্দিরের বিশাল গর্ভগৃহে সমাবিষ্ট। প্রায়ান্ধকার গর্ভগৃহের ভূমির উপর উপবিষ্ট প্রত্যেকটি দেহের মেরুদণ্ড ঋজু। প্রত্যেকটি শরীর সম্পূর্ণ আবরণমুক্ত। প্রত্যেকে গভীর ধ্যানমগ্ন।
এই ধ্যান আরম্ভ হয়েছে তিন দিন পূর্বে, দ্বীপে জল ঢুকতে আরম্ভ করেছে যেদিন থেকে। সকলে একযোগে প্রবেশ করেছেন ধ্যানমন্দিরে। উন্মুক্ত করে দিয়েছেন প্রতিটি দ্বার, বাতায়ন। তারপর সমবেত হয়েছেন গর্ভগৃহে। এই মহাকাশযান একদিন বহুদূরস্থিত এক ধ্বংসোন্মুখ গ্রহ থেকে এঁদের পূর্বজদের নিয়ে এসেছিলো এ গ্রহে, এই দ্বীপে...
গর্ভগৃহের অন্ধকারে কোনওকিছুই স্পষ্টত দৃশ্যমান নয়। তবু যেন মনে হয়, উপবিষ্ট শরীরগুলির মধ্যে কিসের এক স্পন্দন চলছে! কি যেন একটা পরিবর্তন ঘটছে তাদের...
বাইরে সর্বগ্রাসী জল ঢুকে আসছে প্রচণ্ড বেগে। খড়কুটোর মতন ভেসে যাচ্ছে দ্বীপরাষ্ট্রের পরিত্যক্ত বাড়িঘর, হর্ম্যপ্রাসাদ। কৃষ্ণকায় তরল দানব ছুটে আসছে দ্বীপের কেন্দ্রাবস্থিত ধ্যানমন্দিরের দিকে...
গর্ভগৃহের অন্ধকারে কিসের যেন আলোড়ন শুরু হয়েছে... শরীরগুলি অতি দ্রুত স্পন্দিত হচ্ছে... কাঁপছে থর থর করে... যেন কোন অসহ্য বেদনার বিস্ফোরক সুখানুভূতিতে... তাদের আকৃতি পরিবর্তিত হচ্ছে ধীরে ধীরে...
মধ্যরাতের অন্ধকারে তরল দৈত্য ধেয়ে এলো ধ্যানমন্দিরকে গ্রাস করতে। প্রতি দ্বার, প্রতি বাতায়ন, প্রত্যেক রন্ধ্রপথে লবনজল প্রবেশ করলো গ্রহান্তরের মহাকাশযানের অভ্যন্তরে। ধেয়ে চললো গর্ভগৃহের দিকে...
সেখানে উপবিষ্ট শরীরগুলিকে এখন আর চেনা যায় না... দু’পা সংযুক্ত হয়ে অন্তভাগে বিস্তৃত হয়ে গেছে দু’পাশে... হাতগুলি সংকুচিত হয়ে গেছে... পৃষ্ঠদেশে দেখা দিয়েছে পক্ষাকৃতি একেকটি প্রত্যঙ্গ... মাথাগুলি দীর্ঘায়িত হয়ে নাক চঞ্চুর আকার ধারন করেছে... সমগ্র শরীর হয়ে উঠেছে বর্তুল, প্রলম্বিত...
প্রচণ্ড গর্জনে গর্ভগৃহে প্রবেশ করলো জল! ভেঙে পড়লো চারপাশের প্রাচীর, প্রতিষ্ঠাতাদের মূর্তিগুলি! মুহূর্তের মধ্যে সম্পূ্র্ণ জলমগ্ন হলো ধ্যানমন্দির... আর ঠিক সেই মুহূর্তে সব ক’টি ধ্যানমগ্ন শরীর জেগে উঠলো একসঙ্গে! তারা এখন সম্পূর্ণ পরিবর্তিত... মৎস্যাকৃতি প্রাণী! সাবলীল সন্তরণে তারা নির্গত হলো বাতায়ন পথে। মিশে গেলো মহাসমুদ্রে...
অতলান্তিক দ্বীপরাষ্ট্র যে মুহূর্তে সম্পূর্ণ নিমজ্জিত হলো অতলান্ত মহাসাগরের জলে, সেই মুহূর্তে ঘটে গেলো এক অত্যাশ্চর্য বিবর্তন... জন্ম নিলো এই গ্রহের আশ্চর্যতম স্তন্যপায়ী প্রাণী... ডলফিন!
অপূর্ব!! অনবদ্য!! চমৎকার!!
ReplyDeleteঅকুন্ঠ ধন্যবাদ...
ReplyDelete