0

গল্প - সনাতন সিংহ

Posted in


গল্প


খেলতে খেলতে
সনাতন সিংহ


রমেশ গালিতে ফীল্ডিং করছিল। ১৪ ওভারের শেষ বল বাউন্ডারির বাইরে উড়ে যাচ্ছে দেখে মাথা চুলকাতে চুলকাতে মোনার দিকে এগিয়ে এল। কিপিং করছিল মোনা। তার কাছে এসে বিরক্তিকর ভাবে বলল --সবে মাত্র ১৪ ওভার। কি ক্যালাচ্ছে রে। এই মালটা প্রত্যেককে ক্যেলিয়ে কালিপদ করে দিচ্ছে।

--ঠিক বলেছো। আগের ওভারে বাসুকে মেরে রাঙা সুতো বের করে দিল। মনে হচ্ছে এ ম্যাচ হারতে হবে!

--কিন্তু খাবার আগের এই ম্যাচ না জিততে পারলে খেতে পারবো না রে।



সহদেবের শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে ফ্রেন্ডলি ম্যাচ। জায়গাটা একবারে অজপাড়াগাঁ নয়। নদী পার হয়ে এসেছে ওরা। এখানে দুপুরে খাওয়া দাওয়া... সবই ওর শ্বশুর বাড়ির আয়োজন। তার আগে এই ম্যাচ। হোক না ফ্রেন্ডলি। কিন্তু হেরে গিয়ে খেতে কেমন লাগবে যে! সম্মানটা এখানে কেমন যেন হারজিতের উপর নির্ভর করে আছে।

সকালে এসেছে ওরা। দেখেছে, পুকুর থেকে বড় বড় বাটা মাছ ধরছে। ক্ষেতের লম্বা লম্বা নধর বীন। তরতাজা চেহারা। আহা দেখলে, কার না লোভ হয়! দেশি জ্যান্ত মুরগিগুলোকে ওদের সামনে ধরে ধরে কাটছে। আসার সময় চোখে পড়েছে বোঁটা সমেত বেগুন, হাফ ফালি করে হলুদ মাখাচ্ছে। ভাবতেই মোনা আর রমেশের জিভে লালা গড়িয়ে এল। মোনা ঢোক গিলেই শোনালো --রমেশদা, রমেশদা, জি-জিততেই হবে।

তখন রমেশের মনে নুন-হলুদ মাখা বাটা মাছ উঁকি মারছে। গলাটা কেমন হতাশাপূর্ণ শোনাল --দেখ, কি হয়! আজ ভাত জুটবে কিনা দেখ!

এটা বোঝা গেল, যদি তারা হেরে যায়, সেটা মেনে নিতে তার নিতান্তই কষ্ট হবে।



২০ ওভারে ১৭৯/৫।

রমেশদের ব্যাটিং শুরু। ৪ ওভারে ২৩/৩।

রমেশ ভাইস ক্যাপ্টেন আর সঞ্জয় ক্যাপ্টেন। দুজনের কপালে ভাঁজ পড়ে গেল। মোনাকে বলল --তোকে আগেই বলেছিলাম ওপেন কর। শুনলি না। নে শালা, এবার। সবার পেটে লাথি মারলি তো!

--বলি কি, এবার বাসুকে পাঠা। ওকে একটু ধরে খেলতে বল। আমি একটু পরে নামবো।

দশরথ দৌড়ে এল। সঞ্জয়ের হাত থেকে ব্যাট কেড়ে নিল।

--আমি নামবো। আমার ভাইয়ের শ্বশুর বাড়িতে খেলতে এসেছিস। আমাকে দে। আমি নামবো। নয়তো বৌমার কাছে ছোটো হয়ে যাবো। আজ দেখিয়ে দেব খেলা কাকে বলে।

বলেই মাথার উপর বন বন করে ব্যাট ঘোরাচ্ছে। শূন্যে লাফাচ্ছে।



চার-পাঁচজন তাকে ধরতে গেল। ধরার আগেই সে মাঠের ভিতর দিল দৌড়। তারাও তার পিছু নিল। রমেশও তার পিছু পিছু দৌড়াচ্ছে আর চেঁচাচ্ছে --তোর পায়ে ধরি। হেরে গেলে খেতে পারবো না রে। তুই আমার থেকে দশ টাকা নে। পায়ে ধরি বাপ। আমাদের পৌরষত্ব তোর হাতে। ব্যাটটা দে।

সঞ্জয় রেগে গিয়ে দশরথকে বলছে --কোনো দিন দশটা রান করেছিস? গেঁড়ে কোথাকার। আবার মাঠে নেমেছিস! ব্যাট দে রে ব্যাটা। দে বলছি।

কোনো কথাই সে কানে নিচ্ছে না। দৌড়াচ্ছে আর বলছে --এই জন্য তোদের সঙ্গে কোনোদিন খেলতে যাই না। মানুষকে সন্মান দিতে জানিস না। প্রত্যেক খেলায় আমাকে বসিয়ে রাখিস। আজ আমার সম্মানের প্রশ্ন। আমাকে নামতেই হবে।

সামনে থেকে জগদীশ এসে জাপ্টে ধরল তাকে। সে দলের সবথেকে ছোটো। ধরেই দশরথকে বলছে --ওরে পুত্র শোকাতুর রাজা, এটা তোর রাজত্ব নয়। দয়া করে ব্যাট হাতে আত্মসমর্পণ কর। হেরে গেলে আমাদেরও মান সম্মান যাবে? আর দেখ, আমরা যদি হারি, এতে তোর, তোর ভায়ের, তোর ভায়ের বউয়ের, তোর ভাইয়ের শ্বশুরের অপমান হবে না?

সবাই হো হো করে হেসে উঠল।

দশরথের মুখটা লজ্জায় রাঙা হয়ে গেল।

বি.কম করছে দশরথ। থার্ড ইয়ার। মাথায় একটু গোবর আছে বটে। কিন্তু তার উদ্যোগে এই ক্রিকেট খেলার সূচনা। পাড়ার অন্য ছেলেদের সঙ্গে নিয়ে সেইই বাবুদের পাড়ের বাবলা গাছ কেটে, কানাইদাকে দিয়ে গাবদা ব্যাট বানিয়ে ছিল। সঙ্গে হেঁড়ে হেঁড়ে উইকেট। সে রাতের কথা সবার মনে আছে...

১৯৯৬ সালের ভারত শ্রীলঙ্কার সেমিফাইনালের পরের দিন। ভারতের হার সবাইকে ভেতরে ভেতরে তাতিয়ে দিয়েছিল। আশেপাশের গ্রামগুলো কেমন ক্রিকেট ক্রিকেট করে মেতে উঠেছিল। বলতে গেলে এক প্রকারের ক্রিকেট জ্বর হয়েছিল, গ্রামে, গঞ্জে, অলিতে গলিতে। হ্যাঁ, ঠিকই ভাবছেন সেই সময়কার কথা।



ঠিক হারের পরের দিন। দশরথ কয়েকজনকে নিয়ে হাজির হয় বাবুদের পাড়ে। কাঁধে করাত। হাতে নাইলনের দড়ি। পাড়ে গাছ আর গাছ। রাতের অন্ধকারে পোঁচ পড়ল বাবলার ডালে।

বেশ দীর্ঘ ঝপাস শব্দ ধেয়ে এল পাড়ের দিক থেকে।

হেঁদা আর কানাই গান বন্ধ করে দিয়ে হুড়মুড়িয়ে উঠে দাঁড়াল। কানাইয়ের হাতে আড় বাঁশি। হেঁদার হারমোনিয়াম একটু পোঁঅঅঅঅঅঅঅঅ করে থেমে গেল। সুফল, মোনা দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ।

এদিন সকাল থেকেই কারেন্ট নেই। কেরোসিনের ল্যাম্প নিয়ে তারা বসেছিল। সেই আলোয় তাদের মুখ দুটো কেমন উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে।

--শালা, পাড়ে কেউ কিছু করছে মনে হয়! গেলেই ধরা যাবে।

কথা শেষ করে কানাই হেঁদার হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে চাইল।

হেঁদাও যেন মনে মনে তৈরি হচ্ছিল। --এত জোরে কি পড়ল বলতো? বড় কিছু একটা পড়ার শব্দ না? মনে হয় গাছ পড়ার শব্দ, বুঝলি! চল তো!

কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ তখনও আকাশে উঁকি মারেনি। আবছা অন্ধকার ঘিরে ধরেছে পাড়ার গাছপালা-ঘরকে। কারো কারো চোখে নিদ্রাদেবী উপবেশন করেছে তারই অজান্তে। ঝিঁঝির দল বাতাস কাঁপাচ্ছে নিজেদের ছন্দে। স্নানের ঘাটের জল স্তব্ধ হয়ে আছে। পাড়ার হেঁদা আর কানাই স্নানের ঘাটের শান বাঁধানো মেঝেতে মাদুর পেতে রোজকার মত গানের আসর বসিয়ে ছিল। হেঁদার হারমোনিয়াম ও উচ্চস্বরকে অনুসরণ করছিল কানাইয়ের আড় বাঁশি। এমন পরিস্থিতিতে সব কেমন গুলিয়ে গেল।

শ্রোতা বলতে এয়ারফোর্সের সুফল আর কলেজ পড়ুয়া মোনা। তাদের এ পাড়ায় প্রায় সকল বিশ্বাস ও ভরসা করে। তাই তাদের দায়িত্ব দিয়ে গেছে কিছু হলে সামাল দিতে। দুজনেই বলে উঠল...

--দূর, কিছুই নয়।

--কিছু নয় বললে হল? কত জোরে আওয়াজ হল শুনতে পাসনি?

সুফল মোনাকে চিমটি কেটে আমতা আমতা করছে --ও, ও, ও বোধহয় নারকেল পাতা পড়েছে।

চিমটির বেদনা-তরঙ্গ মোনার শরীরে মিলিয়ে যাওয়ার আগেই সায় দিয়ে বলল --হ্যাঁ, হ্যাঁ, ইয়ে মানে নারকেল পাতাই...

--চুপ কর! ক্যালা পেয়েছিস আমাদের? তোদের কথায় কেমন একটা সন্দেহ লাগছে।

--এই তোরা কিছু জানিস মনে হচ্ছে, না?

হেঁদা আর সুফল তাদের থেকে বয়সে অনেক বড়। সুফল পেশায় কাঠ মিস্ত্রী। বাঁশি বাজানো নিতান্তই তার শখের।

--আমাকে নারকেল পাতা শেখাচ্ছিস? মোনা বল, না তো তোর বাপকে ডেকে আনবো!

সুফল কানাইদার হাতে চেপে ধরে বলে --ব্যা-ব্যা-ব্যা-ব্যাট বানাবো। বাবলা গাছ কাটছে। প্লীজ একটু বানিয়ে দিও।

আগের দিনের বিনোদ কাম্বলির কান্নায় কানাই একটু কষ্ট পেয়েছিল। ক্রিকেট সেও ভালোবাসে। কি একটা ভেবে সে কিন্তু কিন্তু করে বলল --ব্যাট... আমি... বানাতে... মাপ জানি না রে!

--সে আমি বলে দেব। তুমি রাজি হয়ে যাও।

রাজিও হয়ে ছিল। বানিয়েও দিয়েছিল।



তাদের ক্রিকেটের পাদভূমি সেই দিনই দশরথের হাতে সূচনা হয়। তার সেই ঐতিহাসিক ভূমিকাই যেন তাকে দলে আলাদা একটা স্থান দিয়েছিল। তারপর অনেক দিন গড়িয়েছে। কত নতুন ব্যাট এল গেল।কোনোদিন একটা ভালো রানও সে করেনি। কিন্তু লেগে থাকার একটা অদম্য চেষ্টা বরাবরই আছে। কিন্তু দলে তার জায়গা কম।

তার হাত থেকে ব্যাট নিয়ে বাসুকে নামিয়ে দিল।

এখন সে হতাশ হয়ে মাঠের বাইরে বসে গজগজ করছে।

--দেখ না, বাসু কেমন আউট হয়। আমাকে বাদ দিয়ে ওকে নামানো! অক্ষয়দার মন্ত্র পড়া পাতা আমার পকেটে আছে। কাউকে দেব না। হারবি, সব হারবি!

সত্যি সত্যি বাসু নামতে না নামতে তিন বলের মাথায় আউট হয়ে ফিরে আসছে।

স্কোর ২৫/8 । আর থাকতে পারল না রমেশ। ঠেলে নামিয়ে দিল মোনাকে।

--যা ভাই। ম্যাচটা জেতাস। হেরে গেলে আমি এই দিক দিয়ে বাড়ি চলে যাব। হেরো মুখে খেতে পারবো না। মুখটা রাখিস।

বাসু বাউন্ডারির কাছে আসার আগেই দশরথ যেন খুব খুশি হয়ে উঠল। তার অভিলাষ পূরণ হওয়ায় টগবগ করে উঠল সে --কেমন? আউট হয়ে গেলি তো? ভগবান বলে কেউ আছে। ঠিক হয়েছে। ফল পেলি তো?

একে বাসু খেলতেই পারলো না। তার উপর দশরথের এমন জ্বালা ধরানো কথা তাকে উত্তেজিত করে তুলল। দশরথের দিকে তাকিয়ে বাসু বলল --মার খাবি?

--ও ইয়েস।

সঙ্গে সঙ্গে বাসু রাগে ব্যাট ছুঁড়ে দিয়ে লাফিয়ে পড়ল দশরথের উপর।

--শালা বিভীষণ, শ্বশুরবাড়ি থেকে তোর আজ খাটিয়া নিয়ে যাব। ক্রিকেটের দিব্যি কেউ তোকে আজ বাঁচাতে পারবে না!

একটা ধুন্ধুমার বেধে গেল। সবাই মিলে কোনোক্রমে ছাড়িয়ে দিল দুজনকে।



ম্যাচ তখন ওদের দিকে ভারী। পাড়ার লোক বেশ জড়ো হয়েছে। মিঠে রোদে তাদের উল্লাস মাঝে মাঝে বাতাস কাঁপাচ্ছে। খেলার মাঠের এপারে ওপারে কোথাও কোথাও ধানের খেত, সবজির খেত। একটা জমির পরে ফুলকপির বাগান। কপিগুলো সার দিয়ে সেই মিঠে রোদ গায়ে মাখছে। মাঠের দক্ষিণ দিকে টমেটোর খেত। পাকা-কাঁচায় তারা সরু সরু গাছ গুলোয় ঝুলে রয়েছে। একপাশে একটা বেশ বড় পুকুর।লোকও বেশ জমেছে।

বল থেকে থেকে সেই সব জায়গায় গিয়ে পড়ছে।

হঠাৎ রাস্তা থেকে এক ঠাকুমাকে নেমে আসতে দেখা যাচ্ছে।

হাতে লাঠি। সেটা শূন্যে উঁচিয়ে হনহন করে চেঁচাতে চেঁচাতে ধানের খেতের আলে বসে পড়ল।

--দেখি তোরা কেমন খেলিস? মার এইদিকে একবার। পারলে মেরে দেখা। এমন করে কেউ খেলে? তোদের খেলা আজ শিখিয়ে দেব।

কাছে যারা ছিল তারা ভাবছে, বুড়ির বোধ হয় এদের খেলা পছন্দ হয়নি। তাই এমন বলছে।

এদিকে মোনাদের রানের গতি ধীর ধীরে এগিয়ে চলেছে। আরো একটা উইকেট পড়ে গেছে। চালিয়ে না খেললে হার নিশ্চিত। মোনা ব্যাট চালাল সজোরে।

এক্সট্রা কভারের উপর দিয়ে বল গিয়ে পড়ল সেই ধানের খেতে। সেখানে বীজ রোপন হয়েছে, তা প্রায় দিন পঁচিশ। ধানের গোচ সবে মাত্র একটু শক্ত হয়েছে। রোজকার খেলায় ছেলেদের পায়ের চাপে তাদের কেউ কেউ মৃত্যু বরণ করেছে অকালে। সেই বল ধরতে গিয়ে কে একজন লাফিয়ে পড়ল সেই খেতে। পা পিছলে আছাড় খেল ঝপাস করে। জল-কাদা ছিটকে পড়ল বুড়ির গায়ে।

তাকে দেখেই বুড়ি গেল রেগে। মাঠে ঢুকে চেঁচাতে লাগল --এমন বালের খেলা বন্ধ কর! বাল খেলছে! কে ফেলল রে এটা? মেরে তার ঠ্যাং গুঁড়িয়ে দেব।

এবার যে খেতে আছাড় খেয়ে পড়ে আছে তার দিকে ফিরে বলছে --আটকুঁড়ির বেটা! চোখের মাথা খেয়েছিস? কচি কচি গাছগুলো মেরে ফেললি রে! মর, ওখানে মর। পড়ে মরে থাক!

সবাই চমকে গেল। কোথাও কোনো শব্দ নেই। শুধুমাত্র বুড়ির চেঁচানি মাঠে ছড়িয়ে পড়ছে। খেলোয়াড়রা দাঁড়িয়ে রইল চুপ করে। বুড়ি লাঠি শূন্যপানে উঁচিয়ে রইল কিছুক্ষণ। চারিদিকে চুপচাপ। কোনো সাড়া নেই। কেমন যেন লজ্জা ঘিরে ধরল বুড়িকে। লাঠি নামিয়ে ধীরে ধীরে মাঠের বাইরে বেরিয়ে যেতেই সবাই চেঁচিয়ে উঠল --বুড়ি, বুড়ি, বুড়ি, বুড়ি...



ক্রিজে তখন গৌতম আর মোনা। এক রান নিয়ে মোনাকে স্ট্রাইক দিল। বাসু গেল খেপে। কমেন্ট্রি করছে --লাঠি উঁচিয়ে বুড়ি গেল মাঠের বাইরে। কেল্টু সাপের মত ফোঁস ফোঁস করতে করতে এঁকেবেঁকে আসছে বল নিয়ে। লাফিয়ে ছুড়ল বল। ফুল লেন্থ। মোনা সামনের পায়ে ভর করে সজোরে ব্যাট চালাল। দারুণ টাইমিং। বল উড়ে চলেছে মিড অনের উপর দিয়ে……দেখা যাক ছয় হয় কিনা? আবার আবার বুড়ির ধান খেতে।

--ছয়য়য়য়য়…!

কে একটা দৌড়ে নামল সেই ধানের খেতে। বল তুলতে।

বুড়ি লাঠি নিয়ে তাকে করল তাড়া। মাঠে এখন বুড়ি আর ওই ছেলেটা দৌড়াচ্ছে। বুড়ি চেঁচাচ্ছে আর ছেলেটার পিছনে মাঠে ঘুরছে --বালের খেলা বন্ধ কর বলছি! বন্ধ কর!

সঙ্গে সঙ্গে দর্শকরা তাল মিলিয়ে একসঙ্গে সবাই হাততালি দিচ্ছে। আর চেঁচাচ্ছে --বুড়ি, বুড়ি, বুড়ি…

কে একটা মাঠের ভেতরে দৌড়ে এল। এসে বুড়িকে কোলে করে তুলে নিয়ে গেল বাউন্ডারির বাইরে। তখন অট্টহাসিতে জনতা ফেটে পড়েছে। আর বাতাসে ভাসছে --বুড়ি, বুড়ি, বুড়ি…



খেলা আবার শুরু। তবে, একেই না বলে ফ্রেন্ডলি ম্যাচ!

বাসুর ধারাভাষ্য আবার শুরু হল --বুড়িকে তুলে নিয়ে যাওয়া হল প্যাভিলিয়নে। খেলা জমে উঠেছে। লম্বু আসছে বল করতে। লম্বা রান আপ। স্ট্রাইকে মোনা। ব্যাট এখন হাওয়ায় তুলে রেখেছে। গুড লেন্থ বল। স্টেপ আউট করে মোনা এগিয়ে গেল। স্ট্রেট ড্রাইভ। আম্পায়ারের মাথার উপর দিয়ে বল পড়ল বাউন্ডারির ভেতরে। একটা বাউন্সে বল মাঠের বাইরে। চার।

সঞ্জয় চেঁচিয়ে উৎসাহ দিচ্ছে --পেঁদা মোনা, পেঁদা মোনা, পেঁদিয়ে বৃন্দাবন পাঠা। শালার খাল খিঁচে দে। ওই মালটা আমাকে খুব কেলিয়ে ছিল।

আবার ছয়। স্কোর এগিয়ে যাচ্ছে তরতর করে। আবার ছয়। মোনাকে রোখা যাচ্ছে না। আবার ছয়।

সঞ্জয় আর থাকতে পারল না। রমেশদার অনুমতি না নিয়ে বলেই ফেলল --রমেশদার শালীর সঙ্গে তোর ইয়ে করে দেব। মা কালীর দিব্যি! ফাটা, আরো ফাটা!

এই কথা শুনে রমেশ তো থ। কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল সঞ্জয়ের দিকে।



ক্যাম্বিস বলেই খেলা হচ্ছে। বল জলে পড়ছে থেকে থেকে। যত মার খাচ্ছে তার গায়ের আঠা লাগানো কাপড় খুলে খুলে রাবার বেরিয়ে আসছে।

রমেশ আর থাকতে পারল না --মার মোনা, মার! মেরে শালার ঘোল ডিম ভেঙে দে। মার!

আর মাত্র এক ওভারে সাত রান বাকি। গৌতম স্ট্রাইকে। প্রথম বল। হাঁটু মুড়ে ব্যাট চালালো। সরাসরি বল কাঁধে এসে লাগল। ফিল্ডাররা চেঁচিয়ে উঠল --হাউজ্জ্যাট!

কি বুঝে আম্পায়ার আঙুল তুলে ধরল শূন্যে।

গৌতম রাগে ব্যাট ফেলে তেড়ে এল আম্পায়ারের দিকে। ওদের পাড়ার ছেলে আম্পায়ার। দু'দলের ক্যাপ্টেন দৌড়ে গেল মাঠের ভিতরে। মোনা গৌতমকে আটকাতে পারছে না। একটা গণ্ডগোল বেঁধে গেল।

সঞ্জয় বলল --এভাবে আউট দিলে আমরা খেলবো না। চল চল। বাড়ি চল। শালা ঘুষখোর আম্পায়ার। ওদের হয়ে খেলাচ্ছে। কচি দেশি মুরগির লোভে শালা আউট দিল।

ওদের দলের ক্যাপ্টেনও কেমন একটা লজ্জায় পড়ে গেল। আম্পায়ার ও সঞ্জয়কে ডেকে কি বুঝিয়ে আবার খেলা শুরু হল।

গৌতম এক রান নিয়ে স্ট্রাইক দিল মোনাকে। তিন বলে পাঁচ রান।

ফিল্ডার সব একত্রে জড়ো হল, কি একটা আলোচনা করেই যে যার জায়গায় ফিরল।

বল নিয়ে দৌড়ে আসছে সেই লম্বুটা।

শর্ট পিচ বল মোনার কাঁধের প্রায় কাছ বরাবর। ব্যাট চালাল বাঁ পায়ের উপর ভর দিয়ে। বল ভেসে যাচ্ছে লং লেগে বাউন্ডারির দিকে। একজন ফিল্ডার দৌড়ে এসে ডাইভ দিল। বল ধরে ঝাঁপিয়ে পড়ল দশরথের কোলে।

দশরথের হাঁটু ধরে আ আ করে কাতরাচ্ছে --একে আমাকে খেলতে দেয়নি। তার উপর ও শালা এসে আমার হাঁটু ভেঙে দিল রে!!!

আম্পায়ার দুই হাত তুলে ছয় দেখাবে কি? গৌতম ছুটে গিয়ে মোনাকে জড়িয়ে ধরল। রমেশ, সঞ্জয়, জগদীশরা মোনাকে কাঁধে তুলে নিয়ে নাচতে লাগল।

উত্তেজনার রেশ কমে যেতেই মোনাকে রমেশ বলল --হ্যাঁ রে, বাটা মাছগুলো ভাজা করল নাকি?

তারপর দুজনে হাসিতে ফেটে পড়ল।



এখানে শেষ করতে পারলে হয়তো ভালো হত। কিন্তু এই খেলার বল আর ব্যাট আর একবার পড়ল তাদের যাওয়ার পথে।

সে ইতিহাস না শোনালে, তাদের বেদনাতুর ক্রিকেট জীবনকে অসম্মান করা হবে।

তবে চলুন সেই বাড়ি ফেরতা টিমের সঙ্গে।



খাওয়া দাওয়া শেষ করে বেরিয়ে পড়েছে সবাই। বিকেল গড়িয়ে গেছে। নদী পার হয়ে ওপার থেকে বাসে করে ফিরবে। বাসু ও দশরথের এখানকার গণ্ডগোলের জের এই মাঠ ছেড়ে গড়িয়ে গেল নদীর পাড়ে।খেয়া ঘাটে।

পড়ন্ত শীতের বিকেল। নদীতে ভাটা পড়ে গেছে। দু একটা নৌকা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে রক্তিম নদীর জলে। ওপাড়টা হালকা সাদা কুয়াশার চাদর গায়ে পরছে সবে। ওপাড়টা খুব বেশি দুরেও নয়। চোখে পড়ছে আলোকস্তম্ভ গুলো নিথর হয়ে অপেক্ষা করছে রাতের জন্য।

সূর্যের ডুবন্ত লম্বা শরীর ম্লান হয়ে পড়েছে নদীর জলে। নিস্তরঙ্গ জলরাশি। শান্ত হয়ে পড়ে আছে দু'কূলের মাঝখানে। জল দেখে মনে হয় হেঁটে পার হয়ে যাওয়া যায়।

বালির বেলাভূমি চকচক করছে। ওরা জুতো হাতে নিয়ে এগিয়ে গেল জলের দিকে।



অন্যদের সঙ্গে ওদের আটজনকে নিয়ে গেল নৌকা। মাঝির গলায় ভেসে আসছে --দে দে পাল তুলে, মাঝি হেলা করিস না.......

মূল ঘাট থেকে বালি মাড়িয়ে অনেক নিচে নেমে এসেছে যাত্রীরা।

একটু দূরেই জল। মাঝি যাওয়ার সময় বলে গেল --কেউ আর কোনো দিকে এগোবেন না।

কিছুক্ষণ পরে নৌকা তখন ওকূল ছেড়ে এদিকে আসছে।

দশরথ ভেতরে ভেতরে গুমড়াচ্ছিল কে জানতো? হঠাৎ কোনো কিছু নেই, বাসুকে ঠেলে দিয়ে বলল --খুব তো খেলি। পেট তো নয়! তেলে ডোঙা। ঠুসে ঠুসে ঢোকালি তো। এবার জলে ভেসে যা।

সুর করে আবার গাইছে --দে দে, বাসু পাল তুলে দে, হেলা করিস না। তেলে ডোঙা ভেসে হবে মক্কা-মদিনা।

তেলে ডোঙা শুনলেই বাসুর মটকা গরম হয়ে যায়। দশরথের ব্যঙ্গ সহ্য করতে পারল না --তোর বাপের খেয়েছি? তোর বাপকে বল তেলে ডোঙা।

--এই তুই বাপ তুললি কেন রে?

হাতাহাতি বেঁধে গেল। ব্যাট উঁচিয়ে মারতে গেল বাসু। দশরথ বাসুর ব্যাটটা কেড়ে নিয়ে ছুঁড়ে দিল দূরে। দূরে বালির উপর আছড়ে পড়ল সেটা। হ্যাঁ, ঠিকই পড়ছেন। আবার ব্যাট পড়ল, বল নয়। সেই ফাঁকে বাসু দশরথের জামা দিল ছিঁড়ে।



সবাই থামিয়ে দিল দুজনকে। বাসু রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে ব্যাট তুলে আনতে গেল।

মাঝি প্রায় মাঝ পথে। চেঁচাতে লাগল --আর যাবেন না, বাবু। আর যাবেন না!

বালি মাড়িয়ে মাড়িয়ে বাসু গেল ব্যাটের কাছে। হাত দিয়ে তুলে নিয়ে পা টানতেই আটকে গেল বালির টানে। পা দুটো জোরে নাড়ানাড়ি করতে আরো গেল ঢুকে। দূর থেকে জগদীশ বলছে –কই, উঠে এসো।

--দেখ না, দুটো পা কে যেন ভেতরে টেনে ধরে নিয়ে যাচ্ছে রে। পা বের করতে পারছি না।

হাত দুটো ব্যাটের উপর ভর দিয়ে চেপে উঠতে চাইল। ব্যাট আর নড়ল না। সেটাও গেল আটকে। ব্যাট ছেড়ে দিয়ে বালির উপর হাত দিয়ে চাপ দিল। হাত দুটোও কে যেন টেনে ধরল।

দেখতে দেখতে কুঁকড়ে যাচ্ছে শরীরটা। মৃত্যু ভয়ে শরীর তার আড়ষ্ট হয়ে আসছে ক্রমশ। মায়ের কথা মনে পড়ছে এখন। আসার সময় কত বারণ করেছিল। নতুন ব্যাট কিনেছে। আবেগে টগবগ করে ফুটছিল সে। পাড়ার ছেলেদের ডাক তাই সে ফেলতে পারেনি। সকাল সকাল মার হাতে একটা বিস্কুট খেয়ে বেরিয়ে এসেছিল। সেই ছবিটা এখন চোখের সামনে ভেসে উঠছে। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না।জগদীশকে বলছে --মার বারণ শুনলে এমনটা হত না রে। মাকে বলিস, মা যেন ভালো থেকে।

কাঁদছে হু হু করে। গলা থেকে আর স্বর বেরিয়ে আসছে না।

কে কি করবে কেউ কিছু ভেবে পাচ্ছে না। জগদীশ কিছু আনার জন্য পাড়ের দিকে দৌড়াল। অন্যরা থেবড়ে বসে পড়ল সেই বালির উপর।



তাদের সঙ্গে দাঁড়ানো এক অপরিচিত মহিলা, এ দৃশ্য দেখে নিজের ছেলেকে জ্যাপ্টে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে হাউ হাউ করে। বাকিরা ভয়ে আঁতকে উঠল। তারা দেখছে, তাদের চোখের সামনে বাসু একটু একটু করে জীবন্ত তলিয়ে যাচ্ছে।

মাঝি তখন এদিকে ফিরছে কিন্তু তাও অনেক দূর। সাবধান করছে --কেউ ওনার কাছে যাবেন না। ওনাকে কেউ ধরবেন না।

অপরাধীর মত ছটফট করছে দশরথ। ভাবছে, তার জন্য এই ঘটনা ঘটছে। উদভ্রান্ত হয়ে গেল সে। বাসুর কোঁকড়ানো শরীরটার দিকে দৌড়ে যাচ্ছে। কোনোক্রমে তাকে আটকে রাখল সবাই।

কাঁদতে কাঁদতে বাসুর শরীরটা এখন বালির তলায় মিলিয়ে যাচ্ছে।



ফিরে এসেছে জগদীশ। হাঁপাচ্ছে। কিছু না পেয়ে হতাশায়, কষ্টে কেমন নুইয়ে পড়েছে। দেখছে কেউ কাঁদছে, কেউ ফোঁপাচ্ছে।

মাঝি মাথায় হাত দিয়ে নৌকায় বসে আছে।

বাসুকে আর দেখা যাচ্ছে না। ব্যাটও চোখে পড়ছে না। বালির আস্তরণ সমান হয়ে গেছে। যেন ওখানে কিছুই ঘটেনি। এখন দেখলেও কারো মনে হবে না যে, বাসু একটু আগে ব্যাট নিয়ে তলিয়ে গেছে ওখানে!



সূর্য ডুবে গেছে অনেক আগেই। নদীর জল কালো হয়ে এসেছে। নৌকা গুলো কোথায় যেন হারিয়ে গেছে নিমেষে। তাদের টিমটিমে আলো জ্বলছে অস্পষ্টতায়। ঠাণ্ডা বাতাস বইছে শির শির করে। কুয়াশা ঘিরে ধরেছে সবাইকে। একটা মৃত্যু ভয় সেখানে জাঁকিয়ে বসেছে ভয়ঙ্কর রূপে। লোম খাড়া হয়ে উঠছে। কাঁটা দিয়ে উঠল সবার শরীরে।





জগদীশরা পা বাড়াল পাড়ের দিকে। সকলের পা ভারি হয়ে আর উঠছে না। জোর করে কে যেন টেনে টেনে ধরছে।

আতঙ্কে দৌড় দিল সবাই।

তাদের পায়ের শব্দে বালির চরে একটা চাপা কান্না গুমরে গুমরে বাতাসে মিলিয়ে গেল।

0 comments: