গল্প - সরিৎ চট্টোপাধ্যায়
Posted in গল্প
গল্প
এক্স বি জিরো ওয়ান
সরিৎ চট্টোপাধ্যায়
১১ জুন, ২০১৮। লন্ডন থেকে রওনা হওয়া ইউরোস্টার ট্রেনটার এক চেয়ার-কার কোচের ভেতরে...
তুতুল অনেক্ষণ পাশের সিটে বসা লোকটার পাশে রাখা মোবাইলটার দিকে তাকিয়েছিল। লোকটা মন দিয়ে খবরের কাগজ পড়ছে।
হঠাৎ মোবাইলটা ওর চোখের এক ইশারায় শূন্যপথে উড়ে সোজা তুতুলের হাতে চলে এল।
বছর চারেকের তুতুলকে বেশ ডলপুতুলের মতো দেখতে। মাথায় একমাথা কোকড়ানো কালো চুল, নীল চোখ। অবিকল ওর মায়ের মতো। এতক্ষণ তাতিয়ানার পাশে চুপটি করে বসে ছিল। পার্থ মোবাইলটার এই অকস্মাত উড়ান দেখে চমকে তুতুলের দিকে চোখ পাকিয়ে মাথা নাড়ল। তারপর মোবাইলটা ওর হাত থেকে কেড়ে নিয়ে পাশের সিটের লোকটাকে ফেরত দিল।
: স্যরি, ইওর মোবাইল। আই সাপোজ ইট মাস্ট হ্যাভ সামহাউ ফলেন ডাউন।
: হাউ অন আর্থ...! থ্যাংকস্ স্যর।
তুতুল ওর ঝকঝকে দাঁত বার করে হাসছিল। ও খুব খুশি এই বেড়াতে আসায়। তাতিয়ানা বড়ো বড়ো চোখ করে ওর কানে কানে বলল, মানা করেছি না তুতুল, কারো সামনে ও'টা করতে!
হঠাৎ দু'জন পুলিসকে ওদের দিকেই আসতে দেখে ভয়ে তাতিয়ানাকে জড়িয়ে ধরে তুতুল আধো আধো গলায় বলে উঠল, মাম্মা! পুলিস!
: শুশ্ ডিয়ার। ডোন্ট বি আফ্রেড, মাম্মা ইজ হিয়ার।
পার্থ নিজের শরীর দিয়ে ওদের আড়াল করার চেষ্টা করছিল। কিন্তু পুলিসদুটো ওদিকেই এগিয়ে এলো।
: ইওর নেম?
: অনুপম রয়। ফ্রম ইন্ডিয়া।
: ট্যুরিস্ট? পেপার্স প্লীজ।
তিনজনের পাসপোর্ট বার করে এগিয়ে দিল পার্থ। পুলিসটা সেগুলো তার সঙ্গীকে চালান করে দিয়ে আবার জিজ্ঞেস করল, শি ডজন্ট লুক লাইক অ্যান ইন্ডিয়ান।
: ইয়েস, দ ব্লু আইজ। আই ফেল ফর হার বিকজ অফ দেম। বাট, শি ইজ অ্যাজ মাচ অ্যান ইন্ডিয়ান অ্যাজ মি।
: অ্যান্ড দ্য লিটল ওয়ান? ইওর ডটার? শি হ্যাজ হার আইজ।
: ইয়া। জাস্ট টার্নড ফোর ইয়েস্টরডে।
: গেটিং ডাউন অ্যাট ব্রুসেলস্। আই সি।
: ইয়েস। আ ডে দেয়ার অ্যান্ড উই মুভ অন টু প্যারি।
: দ্য পেপারস আর ওকে। এঞ্জয় ইওর জার্নি স্যর।
পুলিস দু'জন চলে গেল। বড়ো করে একটা নিঃশ্বাস ফেলল তাতিয়ানা।
: তার মানে এখনো খবরটা ছড়ায়নি।
: বোধহয় না।
: আর কতক্ষণ লাগবে চানেল ক্রস করতে?
: আর আধঘণ্টা।
: সেন্টারে এতক্ষণে নিশ্চয়ই সবাই জেনে গেছে।
: হ্যাঁ। কিন্তু ওরা হয়ত এত তাড়াতাড়ি পুলিসকে জানাবে না।
: না, পুলিস না। ইন্টার্নাল সিকিউরিটি, এম আই ফাইভ।
সবাই শুধু সেন্টার বলেই ডাকে ওই বিশাল জায়গাটাকে। সমুদ্রের মাঝে এক নামহীন দ্বীপে লোকচক্ষুর অন্তরালে অত্যাধুনিক এই প্রযুক্তিশালা। আজ সকাল থেকেই সেখানে চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়েছে। এক্স বি জিরো ওয়ান গায়েব।
সেপ্টেম্বর, ২০১৩
চৌকোণ স্বচ্ছ কাচের বাক্সটার মধ্যে কৃত্রিম পরিবেশ, আলো, আর্দ্রতা। তারই মধ্যে এক তরল মাধ্যমে ভেসে বেড়াচ্ছে ছোট্ট এক প্রাণ। এখনো একটা মাত্র কোষ দিয়ে গঠিত তার শরীর। অথচ তার মধ্যে ঘুমিয়ে আছে জ্ঞানের ভান্ডার।
বাক্সটা যেন কেউ অকারণেই নাড়াচ্ছে। মাঝেমাঝে সেই তরলের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে রকমারি বিভিন্ন রশ্মি অথবা বিদ্যূৎ তরঙ্গ।
বিপর্যস্ত কোষটা হঠাৎ দুভাগে ভাগ হতে লাগল। তারপর, দুই থেকে চার, আট, ষোল, বত্রিশ। এখনো খালি চোখে দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু প্রযুক্তির মন না থাক চোখ তো আছে! নিখুঁতভাবে সেই ব্লাস্টোসিস্টকে রোপণ করা হলো তাতিয়ানার জরায়ুতে। মূর্ত হলো এক প্রাণের প্রতিমা।
ন'মাস পর জন্ম নিল এক্স বি জিরো ওয়ান।
দেড়ঘণ্টা পর ...
ব্রুসেলস্ স্টেশনে নেমে তাতিয়ানা জিজ্ঞেস করল, এবারে?
: এয়ারপোর্ট।
: ওরা কিন্তু থাকবে ওখানে।
: জানি।
: তাহলে? ইন্ডিয়ার প্লেন ধরবে কী করে?
: ধরব না।
: মানে?
: নেক্স্ট স্টপ, ডাবলিন।
১৯৯২
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার পর কলকাতার লেকটাউনে ইউক্রেনের অ্যাপোস্টিল অফিসে '৯২ সালের শেষে তাতিয়ানার বাবা যখন তাঁর দুবছরের মেয়েকে নিয়ে আসেন তখন রান্নার মাসি আরতিদির বড়ো মুস্কিল হয়ে যায়। 'য়া কচু ভোদি' মানে যে 'জল খাব' কী করে বুঝবে সে? সেও বাংলায় সমান তালে চালিয়ে যেত। ফলে প্লে স্কুলে ভর্তি হওয়ার সময় তার শিষ্যা পরিষ্কার বাংলায় বলল, আমার নাম তাতিয়ানা। আরতি তিতংকা'র কাছে আমি রোজ ভাত খেয়ে নিই। তারপর দশবছর বয়েসে তাতিয়ানা আবার ফিরে যায় ইউক্রেনে তার পরিবারের সাথে।
২০১৩
২০১৩-এর ঝামেলার আগেই তাতিয়ানা লন্ডনে কলেজে পড়তে চলে আসে। কিন্তু ইউরোময়দান-এর সময় ক্রিমিয়ায় রাশিয়ান গুপ্ত সৈন্যের একটা বোমার আঘাতে প্রাণ হারান তাতিয়ানার মা-বাবা। তাতিয়ানার কলেজের ফিজ দেওয়ার মতোও ক্ষমতা ছিল না। ইউক্রেন তখন জ্বলছে। সেই সময় এক ফারমাসিউটিকাল কম্পানি একটা মেডিকাল এক্সপেরিমেন্টের জন্য তাতিয়ানাকে প্রায় এক লক্ষ ইউরো অফার করে। বদলে তার ডিম্বানু নিয়ে তারা জেনেটিক রিসার্চ করবে।
লন্ডনেরই এক হাসপাতালে পরপর তিনমাস যায় তাতিয়ানা। তারপর একদিন তাকে জানানো হয় যে তার ডিম্বানু এখন ভ্রূণকোষে রূপান্তরিত হয়েছে। এবং কয়েক সপ্তাহের জন্য সেটাকে কোনো জরায়ুতে রোপণ করা হবে। তাতিয়ানা যদি রাজি থাকে তবে সেই তাদের প্রথম পছন্দ। স্বাভাবিকভাবেই এর পারিশ্রমিক আলাদা হবে। রাজি হয়ে যায় তাতিয়ানা।
এরপরই তাকে নিয়ে আসা হয় সেই নির্জন দ্বীপের সেন্টারে। অবিলম্বেই ও বুঝতে পারে যে খুব বড়ো ভুল করে ফেলেছে ও। দ্বীপটা আসলে ওর জন্য এক বন্দীশালা। ওরা চায় যে ও বাচ্চাটাকে জন্ম দিক। এবং সেই সদ্যোজাত শিশু হবে তাদের পরবর্তী পরীক্ষার বিষয়। তার ওপর কোনো অধিকারই থাকবে না তাতিয়ানার।
২০০৯
সাহা ইনস্টিট্যুট থেকে স্ট্রাকচারাল জিনোমিকস্ পাস করে স্নাতোকোত্তর পড়াশুনো করতে পার্থ চলে এসেছিল ইউকে-তে। সেখানে তার গবেষণার বিষয় ছিল স্টেম সেল-এর ওপর রঞ্জন রশ্মি আর বৈদ্যুতিক প্রবাহের প্রভাব। মাস্টার্স ডিগ্রী পাওয়ার পর ও সুযোগ পেল ব্রিটিশ সরকারের এই রহস্য ঘেরা প্রোজেক্টে। খুব শীঘ্রই পার্থ বুঝতে পারল যে এরা দেশের আইনকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে এই কাজ করছে। কিন্তু ততক্ষণে ওর বৈজ্ঞানিক সত্ত্বা এতটাই জড়িয়ে পড়েছিল এই প্রোজেক্টের সাথে যে প্রতিবাদ করার বা ছেড়ে যাওয়ার কথা মাথাতেও আসেনি ওর।
২০১৩
তাতিয়ানা তখন বেঁকে বসেছিল। কিছুতেই সে মেনে নিচ্ছিল না। ওকে বোঝাবার দায়িত্ব দেয়া হয় পার্থকে। ফোর ডি আল্ট্রাসাউন্ড মেশিনের পর্দায় বাচ্চাটার হাত পা আঙুল হৃৎপিন্ড এক এক করে দেখিয়েছিল ওকে পার্থ। তাতিয়ানা কাঁদছিল। কোনমতে শুধু বলেছিল, ওর কোনো ডিফেক্ট নেই তো?
: না তাতিয়ানা। আমরা সব পরীক্ষা করেছি, ও সম্পূর্ণ সুস্থ।
: যদি কিছু হয়ে যায়? ও কিন্তু আমার সন্তান! আমার টাকা পয়সা চাই না। আমি ওকে নিয়ে চলে যেতে চাই।
: বলছি তো, কিছুদিন ওকে আমরা অবজার্ভ করব। তারপর তোমরা মুক্ত। আমি কথা দিচ্ছি।
১০ জুন, ২০১৪
জন্ম নিল এক্স বি জিরো ওয়ান। সব দিক থেকেই সুস্থ, স্বাভাবিক। একেবারে তাতিয়ানার প্রতিচ্ছবি। অনেকরকম পরীক্ষার পরও অস্বভাবিক কিছু না পাওয়া যাওয়ায় যখন ওর তিনবছর বয়েস পূর্ণ হলো তখন নির্ণয় নেওয়া হলো যে ওদের শীঘ্রই ছেড়ে দেওয়া হবে।
জানুয়ারি, ২০১৮
ধীরে ধীরে সবরকম নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হচ্ছিল তাতিয়ানা আর তুতুলের ওপর থেকে। দু'বার লন্ডনে বেড়াতেও গেছে ওরা। অবশ্য পার্থ আর দু'জন সিকিউরিটির লোক সঙ্গে ছিল।
সেদিন একটা মেলায় ঘুরছিল ওরা তিনজন। হঠাৎ লাল তুলো দেখে জিদ করতে লাগল তুতুল, মাম্মা, আমি ক্যান্ডি খাব! তাতিয়ানার মত ছিল না। কী জানি কি কেমিকাল মেশায় এরা! হঠাৎ একটা ক্যান্ডির স্টিক উড়ে এল ওদের দিকে। যে লোকটা বিক্রী করছিল সে হাঁহাঁ করে উঠল। পার্থ তাড়াতাড়ি দাম মিটিয়ে ওখান থেকে ওদের সরিয়ে নিয়ে গেল। তুতুল তখন মনের আনন্দে লাল তুলো খাচ্ছে।
তারপর থেকেই গোপনে ওরা তুতুলের এই ক্ষমতা নিয়ে আলোচনা করত। সিসিটিভি বা লোকচক্ষুর আড়ালে ওরা তুতলকে উৎসাহ দিত ওরকম কিছু করে দেখাতে। আর প্রতিদিন সেই ক্ষমতা বাড়ছিল তুতুলের। এখন বড়সড় টেবিলও সরিয়ে ফেলে ও শুধু ওর মনের শক্তি দিয়ে।
তাতিয়ানা কিন্তু বেশ ভয় পেত। অনেকবার পার্থকে জিজ্ঞেস করত বিশদে ওর এই অদ্ভুত ক্ষমতার ব্যাপারে।
: কী করে এটা সম্ভব পার্থ?
: জানি না। এই ক্ষমতাকে বলা হয় টেলিকাইনেসিস। এ ক'দিনে অনেক পড়াশুনো করলাম এ নিয়ে কিন্তু এর কোনো বৈজ্ঞানিক কারণ বার করতে পারিনি। তুতুল ওর মানসিক ক্ষমতা দিয়ে এখন প্রায় চল্লিশ কিলোর জিনিসকে পাঁচ ফুট দূর থেকেও নাড়িয়ে দিতে পারে। আর ওর এই ক্ষমতাটা ক্রমশ বাড়ছে।
: কী করে এমনটা হলো?
: তুমি একটা ব্যাপার এখনো জানো না তাতিয়ানা। জানো না যে তুতুলের সৃষ্টি কী করে হয়েছে।
: কী করে? আমি তো ভেবেছিলাম যেভাবে টেস্ট-টিউব বেবি হয় সেভাবেই ...
: না। তুতুল তোমার ক্লোন। ও সম্পূর্ণ তোমারই প্রতিচ্ছবি। বিজ্ঞানের চোখে তোমার আর ওর জেনেটিক মেটেরিয়াল অভিন্ন।
: কিন্তু, তাহলে ওর মধ্যে কী করে এই ...
: আমরা তোমার একটা ডিম্বানুকে ফার্টিলাইজ করেছিলাম একটা শুক্রানু দিয়ে। তারপর সেটার জেনেটিক মেটেরিয়াল বার করে নিয়ে তোমারই অন্য এক সাধারণ কোষের জেনেটিক মেটেরিয়াল ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম।
: তারপর?
: এবার মুস্কিল কাজ ছিল সেই ভ্রূণকোষটাকে বিভক্ত করা। আর সে জন্য আমরা বিদ্যুৎ আর রঞ্জন রশ্মির সহায়তা নিই। আমার মনে হয় সেই কারণেই কোনো পরিবর্তন হয়েছিল। কিন্তু সেটা জেনেটিক মিউটেশান নয়, আমাদের বর্তমান জ্ঞানের পরিধির বাইরের কোনো কিছু।
: ওর কিছু হবে না তো?
: মনে হয় না। কিন্তু এরা যদি জেনে যায় তাহলে তোমাদের আর কিছুতেই ছাড়বে না।
: যদি পুলিসের কাছে যাই আমরা?
: এরা তো পুলিসের অনেক ওপরে। খোদ এম আই ফাইভ এদের হাতে। কোথায় গায়েব করে দেবে জানতেও পারবে না। এখন যে করে হোক তুতুলকে শেখাতে হবে যাতে অন্য কারো সামনে ওর এই ক্ষমতার ব্যবহার না করে।
পার্থর খুব কাছে চলে আসে তাতিয়ানা। ওর বুকে নিজের মাথাটা ঠেকিয়ে বলে, কী হবে পার্থ? আমার ভীষণ ভয় করছে। পার্থ কাছে টেনে নেয় ওকে। বলে, পালাতে হবে তাতিয়ানা। আমাদের পালাতে হবে।
মে, ২০১৮
দু'সপ্তাহের ছুটি নিয়ে কলকাতায় এসেছে পার্থ। উল্টোডাঙার এক ঘিঞ্জি গলির ভেতর একটা ছোট্ট বাড়ির দোতলায় সাড়ে সাত লক্ষ টাকায় রফা হলো। পাওয়া গেল তিনটে জাল ভারতীয় পাসপোর্ট। দ্বিতীয় কাজ ছিল মোটর বোট চালাতে শেখা। এক ছুটির দিনে গঙ্গার বুকে সেটাও কিছুটা শেখা হলো।
১০ জুন, ২০১৮
আজ তুতুলের জন্মদিন। বিশাল কেক কাটা হবে। প্রোজেক্ট ডিরেক্টর উইলিয়াম সাহেব তার পুরো দলবল নিয়ে উপস্থিত রয়েছেন। ঘরের এক কোণে তাতিয়ানা ওনাকে প্রশ্ন করছিল।
: কবে আমাদের যেতে দেবেন স্যর?
: খুব শীঘ্রই, তাতিয়ানা।
: গত একবছরেরও বেশি এই একই কথা শুনছি আমি। আর আমি পারছি না! ওর চারবছর বয়েস হয়ে গেল। ওর একটা স্বাভাবিক জীবন বাঁচার অধিকার আছে।
: কাম ডাউন তাতিয়ানা। বোঝার চেষ্টা করো কত টাকা, কত লোকের মেহনত এই প্রোজেক্টের সাথে জড়িয়ে আছে। শুধু আমার কথায় কী আর গোটা প্রজেক্টটা ওয়াইন্ড আপ করা সম্ভব? এটা সরকারের ডিফেন্স প্রোজেক্ট, অনেক ওপর মহলে এই ডিসিশান নিতে হবে।
: কিন্তু আপনি রেকমেন্ড করলে তবেই তো ওরা রাজি হবে! আপনি তো দেখছেন ও সম্পূর্ণ স্বাভাবিক!
ওর কণ্ঠস্বরটা ক্রমশ কর্কশ শোনাচ্ছিল তাতিয়ানার নিজের কানেও। উইলিয়াম সাহেবের ভুরুজোড়াও ক্রমশ কুঁচকে যাচ্ছিল। তিনি এবার কিঞ্চিৎ বিরক্তির সঙ্গেই বলে উঠলেন, স্টপ দিস ননসেন্স তাতিয়ানা! ইউ অ্যান্ড ইওর ডটার আর গভর্নমেন্ট প্রপার্টি, ডু ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড! কোনোদিনও তোমাদের সম্পূর্ণ স্বাভাবিক জীবন কাটাতে দেওয়া হবে না। ইউ উইল অলওয়েজ বি আন্ডার দ্য স্ক্যানার!
পরক্ষণেই জন্মদিনের প্রকাণ্ড কেকটা উড়ে এসে সপাটে লাগল উইলিয়াম সাহেবের মুখে। ঘরের মধ্যে তখন পিন পড়লেও শোনা যাবে এমন নিঃশব্দতা। তারই মধ্যে তুতুল শুধু আগুন চোখে তাকিয়ে আছে সাহেবের দিকে।
ওয়াট দ হেল হ্যাপেন্ড! কোনরকমে মুখ থেকে কেক মুছতে মুছতে চিৎকার করে উঠলেন উইলিয়াম সাহেব। তারপর তুতুলের দিকে এগিয়ে গিয়ে জলদগম্ভীর স্বরে বলে উঠলেন, ডিড ইউ জাস্ট ডু দ্যাট, ইয়ং লেডি? অ্যানসার মি!
তুতুল সাহেবের কেকমাখা মুখের দিকে তাকিয়ে খিলখিল করে হেসে উঠল। তারপর হাসি থামিয়ে পরিষ্কার উচ্চারণে বলল, ডোন্ট ইউ ডেয়ার শাউট অ্যাট মাই মাম্মা আগেইন!
কিন্তু ততক্ষণে সাহেবের টনক নড়েছে। তিনি উত্তেজিত গলায় সবাইকে বললেন, ওয়াও! শি হ্যাজ দ্য পাওয়ার অফ টেলিকাইনেসিস। কাম অন চাইল্ড, ডু সামথিং! কাম অন! মুভ দ্যাট চেয়ার ওভার দেয়ার! নো?অলরাইট, মুভ দ্যাট কার্টেন!
কিন্তু তুতুল ততক্ষণে বুঝে গেছে যে সে ভুল করেছে। সে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর ছুটে গিয়ে তাতিয়ানাকে জড়িয়ে ধরল।
উইলিয়াম সাহেব ওদের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে শেষে বললেন, অলরাইট। ইটস্ কোয়াইট লেট টুডে। উই উইল স্টার্ট টুমরো। এইট এএম, শার্প!
পার্থ বুঝেছিল আর অপেক্ষা করা চলবে না। সে রাতেই পালিয়েছিল ওরা। ভোর রাতে পৌঁছে গেছিল লন্ডন স্টেশনে।
১১ জুন, বর্তমান
ডাবলিন এয়ারপোর্টে এটিহাদ এয়ারলাইনের তিনজনের দিল্লির টিকিট কিনে ওরা অপেক্ষা করছিল। প্লেন ছাড়তে এখনো প্রায় চল্লিশ মিনিট বাকি। হঠাৎ দু'জন ষণ্ডামার্কা লোক ওদের সামনে এসে দাঁড়াল। একজনের মাথা কামানো। অন্যজনের ডানহাতটা স্যুটের ভেতর কিছু একটা ধরে রয়েছে। টাকলামাকান এগিয়ে এল।
: মিস্টার রয়?
: ইয়েস?
: কুড ইউ থ্রি প্লীজ কাম উইথ আস?
: হু আর ইউ?
: এম আই ফাইভ, স্যর। লোকটা তার পরিচয়পত্র বার করে দেখাল।
: দিস ইজ আয়ারল্যান্ড, নট লন্ডন। ইউ ডোন্ট হ্যাভ এনি জুরিসডিকশন হিয়ার।
: নোপ। বাট দিস হ্যাজ - বলে স্যুটের ভেতর থেকে সাইলেনসারযুক্ত পিস্তল ধরা হাতটা কিছুটা বার করে দেখাল অন্যজন।
: ডোন্ট মেক আ সীন, প্লীজ। কাম উইথ আস।
একটা ঘরের মধ্যে ওরা নিয়ে গেল ওদের তিনজনকে। দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ করে দিয়ে প্রথমজন বলল, একঘণ্টা পর একটা স্পেশাল ফ্লাইট রওনা হবে তোমাদের নিয়ে। ততক্ষণ শান্ত হয়ে চুপ করে বসে থাক, কেমন?
তাতিয়ানা হঠাৎ বলে উঠল, আর আমরা যদি চিৎকার করি? ভিড় জড়ো করি?
: আই উইল শ্যুট ইউ ডিয়ার, অ্যান্ড হিম, বোথ। উই জাস্ট ওয়ান্ট হার।
লোকটার মুখের কথা শেষ হওয়ার আগেই মাথার ওপরের পর্দার ভারি রডটা দড়াম করে ভেঙে পড়ল। পরমুহূর্তেই ভারি আবলুশ কাঠের একটা টেবিল উড়ে এসে পড়ল সেই টাকলামাকানের ঘাড়ে। দু'জনেই আর্ত চিৎকার করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। পিস্তলটা দূরে ছিটকে পড়েছিল। পার্থ সেটা তুলে নিয়ে ওদের দিকে তাক করে তাতিয়ানাকে বলল, আমি ওদের দেখছি, তোমরা যাও!
আর বাক্যব্যয় না করে তাতিয়ানা তুতুলকে কোলে তুলে বেরিয়ে গেল। লোকদুটো তখনো গোঙাচ্ছে। পার্থ পর্দা থেকে দড়িটা খুলতে শুরু করল।
আবু ধাবি এয়ারপোর্টে দেড়ঘণ্টার স্টপ ছিল। পাইলট, ক্রু সব পাল্টে গেল। তুতুল তাতিয়ানাকে জিজ্ঞেস করল, ওয়ের আর উই গোয়িং নাও, মাম্মা?
: হোম ডিয়ার। উই আর গোইং হোম! তুতুলকে জড়িয়ে ধরে ভেজা চোখে জবাব দিল তাতিয়ানা।
আর পার্থ শুনতে পেল নতুন স্টিওয়ার্ডেসকে আগের স্টিওয়ার্ড সাবধান করে দিচ্ছে, বি কেয়ারফুল অফ দ্যাট লিটল গার্ল ইন সিক্সটিন এ। শি নোজ ম্যাজিক!
সবে তো শুরু হল সরিৎদা! ওর পরের অ্যাডভেঞ্চারও চাই যে।
ReplyDelete