প্রবন্ধ - ধ্রূবজ্যোতি চক্রবর্তী
Posted in প্রবন্ধ
প্রবন্ধ
গীতারহস্যামৃতম
ধ্রূবজ্যোতি চক্রবর্তী
(১৯)
গীতা মহাগ্রন্থের বহু উচ্চমার্গের দার্শণিক তত্ত্বের যে অতি সহজ সরল ব্যাখ্যা ঠাকুরের কাছ থেকে আমরা পেয়েছি তার দিকে একটু আলোকপাত করা যাক।
গীতা মহাগ্রন্থে যে উপদেশটি সবচেয়ে বেশী খিটকেল সাংখ্যযোগের সেই ৪৭নং শ্লোকটি একবার পড়ে নেওয়া যাকঃ
“কর্ম্যণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন।
মা কর্মফলেহেতুভূর্মা তে সঙ্গওহস্ত্বকর্মণি।।
(কর্মেই তোমার অধিকার, ফলে নয়; কর্মফলার্থী হয়ো না; নৈষ্কর্মেও তোমার আসক্তি না হোক)
ম্যাঙ্গোম্যান পটলবাবুদের কাছে ব্যাপারটা বেশ গোলমেলে। কাজ করে যেতে বলা হচ্ছে আবার কাজের শেষে যে উদ্দেশ্যে কাজটা করছি সেটার দিকে নজর দিতে মানা করা হচ্ছে। আবার একই সঙ্গে কাজ না করে নিস্কর্মা হয়ে বসে থাকতেও মানা করে হয়েছে।
এটা যেন সেই “হ-য-ব-র-ল”-এর চন্দ্রবিন্দুর “চ”, বেড়ালের “তালিবশ্য” আর রুমালের “মা”!!
এবার দেখা যাক পরমহংসদেব এই বিষয়ে কি বলেছেন।
ঠাকুর বলেছেন, “সংসারে থাকবে বড়লোকের দাসীর মতো। দাসী যেমন মনিবের ছেলেমেয়েদের মানুষ করে, নিজের ছেলেপিলের মতো যত্ন করে – বলে “আমার রাম মাছের ঝোল না হলে ভাত খেতে পারে না”, কিন্তু তার মনটি পড়ে আছে দেশের বাড়িতে নিজের ছেলেমেয়ের উপর।”
অসাধারণ সহজপাচ্য ব্যাখ্যা।
কর্তব্য কর্ম করতেই হবে। তবে মন যদি পরমাত্মায় নিবেদিত থাকে তবে কর্তব্য কর্মের ফল নিয়ে বিব্রত হবার প্রয়োজন নেই।
বলা বাহুল্য, ঠাকুর এখানে দাসীর নিজের ছেলেকে “পরমাত্মা” আর মণিবের ছেলেকে “কর্তব্য কর্ম”-এর রূপক হিসেবে ব্যবহার করেছেন সাধারণ মানুষের উপলব্ধির জন্য।
এই প্রসঙ্গে Management Guru-দের কথাও স্মরণ করা যেতে পারে। তাঁরা বলেন, “Concentrate on your work process and give your best. Result would follow automatically.”
শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেবের আর একটি Signature উপদেশ হল “যত মত তত পথ।” এই আপাত ছোট্ট কথাটির মধ্যে বিশ্ব ভাতৃত্বের চিরকালীন শান্তির বাণী লুকিয়ে আছে। আজকের এই বিশ্বব্যাপী অশান্ত সময়ে এই বাণীটিই সমগ্র বিশ্বের একমাত্র শান্তির বাণী হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। নোবেল কমিটি যদি Posthumously নোবেল পুরস্কার দেবার নিয়ম কানুনটি চালু করতেন তবে আমার মতে প্রথম নোবেল শান্তি পুরস্কারটি ঠাকুরের জন্যই বরাদ্দ হতো।
এবার দেখা যাক এই প্রসঙ্গে মহাগ্রন্থ গীতায় কি লেখা আছে।
গীতা মহাগ্রন্থের চতুর্থ অধ্যায় জ্ঞানযোগের ১১নং শ্লোকটি বলছেঃ
“যে যথা মাং প্রপদ্যন্তে তাংস্তথৈব ভাজাম্যহম।
মম বর্ত্মানুবর্তন্তে মনুষ্যাঃ পার্থ সর্বশঃ।।”
(যারা যে ভাবে আমার শরণাপন্ন হয়, আমি তাদের সেই ভাবেই ভজনা (তুষ্ট – Courtesy রাজশেখর বসু ) করি। হে পার্থ, মনুষ্যগণ সর্বপ্রকারে আমার পথ অনুসরণ করে।)
আবার জ্ঞানবিজ্ঞান যোগের ২১নং শ্লোকে কৃষ্ণের মুখে আমরা একই কথা শুনতে পাইঃ
“যো যো যাং যাং তনুং ভক্তঃ শ্রদ্ধয়াচির্তুমিচ্ছতি।
তস্য তস্যাচলাং শ্রদ্ধাং তামেব বিদধাম্যহম্।।”
(যে যে ভক্ত যে যে মূর্তি শ্রদ্ধার সহিত অর্চনা করতে ইচ্ছা করে,
আমি সেই সেই ভক্তের সেইপ্রকারই (আরাধ্য মূর্তির অনু্যায়ী) অচলা শ্রদ্ধা বিধান করি)
(২০)
এইখানে যদি শ্রীকৃষ্ণকে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে Supreme Power হিসেবে কল্পনা করা যায় তবে সেই শক্তির উৎস স্থলের লক্ষে পৌঁছবার উপায় শরণাগত ভক্তবৃন্দের বহুবিধ হলেও শ্রীকৃষ্ণরূপী Supreme Power তাঁদের তুষ্ট করেন। অতএব পথ বিভিন্ন হলেও লক্ষ একই।
এই পরিপ্রেক্ষিতে যদি ধ্যানযোগ অধ্যায়ের ৮নং শ্লোকটি নিয়ে আলোচনা করা যায় তবে একটু ডিটেলে যেতে হবে। কেননা ঠাকুরের আর একটি অসাধারন উপদেশ “টাকা মাটি মাটি টাকা“ মহাগ্রন্থ গীতার নিম্নলিখিত শ্লোকটিকে অত্যন্ত সহজ ভাবে ব্যাখ্যা করেছেঃ
“জ্ঞানবিজ্ঞানতৃপ্তাত্মা কূটস্থো বিজিতেন্দ্রিয়ঃ।
যুক্ত ইতচ্যুতে যোগী সমলোষ্টাশ্মকাঞ্চনঃ।।”
এই শ্লোকটির যথার্ততা উপলব্ধি করার জন্য তিনটি ব্যাখা নিচে দেওয়া হলো।
যদিও তিনটি ব্যাখ্যারই মূল বক্তব্য একই বলে আমার মনে হয় তবু ভাষার তারতম্যে যাতে উপলব্ধি এদিক ওদিক না হয়ে যায় তাই পাঠকবৃন্দের আপন আপন জ্ঞান ভাণ্ডারের কাছে এই তিনটি ব্যাখ্যাকেই হাজির করে দিলাম।
স্বামী অপূর্বানন্দ, রামকৃষ্ণ মঠ, ভুবনেশ্বর,“যার মন শাস্ত্রোপদেশলব্ধ জ্ঞান ও অপোরক্ষনুভুতির দ্বারা পরিতৃপ্ত, যিনি রূপরসাদি বিষয়ের সংস্পর্শে এসে নির্বিকারচিত্ত এবং মাটি, পাথর ও সোনায় সমদর্শী, তাঁকে যোগসিদ্ধ বলা হয়।”
Swami Vireswarananda, Ramkrishna Math, Madras, “The Yogi whose self is satisfied through knowledge and realization, who is steady and has the senses under control, and to whom a clod of earth, a stone and gold are of equal value, is said to be steadfast.”
রাজশেখর বসু, “জ্ঞানবিজ্ঞানতৃপ্তাত্মা, কূটস্থ (স্থানু, অপ্রকম্প ((শংকর)), নির্বিকার), বিজিতেন্দ্রিয় লোষ্টপ্রস্তরকাঞ্চনে সমদর্শী যোগী (কর্মযোগী) যুক্ত – এইরূপ উক্ত হন।”
এই তিনটি ব্যাখ্যাতেই কিন্তু ঠাকুরের “টাকা মাটি মাটি টাকা” উপদেশটি উচ্চারিত হয়েছে।
ঠাকুরের মুখে আমরা বারংবার “শুদ্ধা ভক্তি”-র কথা শুনেছি। ওনার মতে একমাত্র শুদ্ধা ভক্তির পথেই পরমাত্মার উপলব্ধি হয়। একই কথা যা মহাগ্রন্থ গীতার বিশ্বরূপদর্শন যোগে ৫৪নং শ্লোকে “অনন্যা ভক্তি” রূপে উচ্চারিত হয়েছে।
“ভক্ত্যা ত্বনন্যয়া শক্য অহমেবংবিধোহর্জুন।
জ্ঞাতুং দ্রষ্টূঞ্চ তক্তেন প্রবেষ্টূঞ্চ পরন্তপ।।”
[হে পরন্তপ অর্জুন, কেবলমাত্র অনন্যা ভক্তির দ্বারাই আমি এই প্রকারে তত্ত্বত (যথার্থত) জ্ঞানের এবং দৃষ্টির এবং প্রবেশের সাধ্য (হই)]
ঠাকুর বারংবার ঐশ্বরিক প্রসাদ লাভের জন্য শরণাগত হতে বলেছেন। ঠাকুরের জ্ঞান, বিজ্ঞান, তপস্যা, পূজাপাঠ, যাগযজ্ঞ, সন্যাসধর্ম ইত্যাদি সবকিছু ছেড়ে শরণাগত হবার যা উপদেশ দিয়েছেন শ্রীকৃষ্ণও অর্জুনকে মোক্ষযোগের ৬৬নং শ্লোকে সেই কথাই বলেছেনঃ
“সর্বধর্মান পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ।
অহং তাং সর্বপাপেভ্যো মোক্ষয়িষ্যামি মা শুচঃ।।”
(সর্বধর্ম পরিত্যাগ করে একমাত্র আমাকে শরণ করে চল;
আমি তোমাকে সর্বপাপ হতে মুক্ত করব)
(২১)
তবে এতদূর পর্যন্ত যে সকল পাঠক / পাঠিকা আমার এই প্রবন্ধটির সঙ্গে আছেন, ছেড়ে চলে যান নি, জানি না তাঁরা আমার সাথে একমত হবেন কিনা যে সহজ সরল অনবদ্য ভাষায় রূপকের মাধ্যমে ঠাকুর শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব মহাগ্রন্থ গীতার অতি উচ্চ দার্শনিক উপদেশগূলোর যে ব্যখ্যা সাধারন মানুষদের জন্য রেখে গেছেন আজও তা অদ্বিতীয়।
এ বিষয়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা নিশ্চয় আরও বিশদে আলোচনা করে আরও অনেক মূল্যবান তথ্য এবং নতুন দিশার সন্ধান দিতে পারবেন। তবে একজন সাধারন গীতা মহাগ্রন্থ পাঠক হিসেবে পরমহংসদেবের উপদেশগুলো নাড়াচারা করতে গিয়ে এক অদ্ভুত অনুভুতির উপলব্ধি এই রচনাটার জন্ম দেয়।
সবশেষে আর কয়েকটি বিষয় স্পর্শ না করলে রচনাটি অসমাপ্ত থেকে যেতে পারে ভেবে সুধী পাঠক / পাঠিকাবৃন্দের কাছে আর একটু সময় চেয়ে নিচ্ছি।
ঠাকুরের যে উপদেশটি আমার মনে হয় সবচেয়ে দামি সেটা হচ্ছে সংসার ত্যাগী সন্ন্যাসী আর সংসারী জীবের তুলনামূলক আলোচনা।
শ্রীরামকৃষ্ণ সংসারী ভক্তদের গৃহী সন্ন্যাসী বলেছেন। তাঁর মতে সংসারত্যাগী সন্ন্যাসীদের তো ভগবানের আরাধনাই একমাত্র উদ্দেশ্য। সংসারের সমস্ত দায় দায়িত্ব প্রলোভন থেকে তাঁরা দূরে সরে গিয়েছেন ভগবানকে ডাকবেন বলেই তো। সেখানে গৃহী ভক্তরা তাঁদের সংসারের সমস্ত দায়িত্ব কর্তব্য পালন করে মাথায় দশমণ পাথরের বোঝা সরিয়ে তবে ভগবানের নামগান করার জন্য সময় বের নেন । তাই গৃহী সন্ন্যাসীদের কৃতিত্ব সংসার ত্যাগী সন্ন্যাসীদের থেকে অনেক বেশী প্রশংশাযোগ্য।
মহাগ্রন্থ গীতা কিন্তু ঠিক এই কথাই বলেছে। সন্ন্যাসযোগ ৬নং শ্লোকের মূল অর্থ স্বামী অপূর্বানন্দের মতে সম্পূর্ণ চিত্তশুদ্ধি না হওয়া পর্যন্ত নিস্কামকর্মযোগ অনুষ্ঠান করাই শ্রেয়। আর রাজশেখর বসুর মতে কর্মত্যাগ করে কেবল সন্ন্যাস দ্বারা সিদ্ধিলাভ কঠিন, কিন্তু নির্লিপ্ত হয়ে কর্ম করলে সহজে সিদ্ধিলাভ হয়। দুই অনুবাদকেরই মূল বক্তব্য এক। তাই মহাগ্রন্থ গীতার মত অনুযায়ীও গৃহী সন্ন্যাসী সংসার ত্যাগী সন্ন্যাসী অপেক্ষা শ্রেষ্ঠতর রূপে বিবেচিত হয়েছে।
রাজর্ষি জনকই হচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণ এবং শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণের মতে আদর্শ পুরুষ যিনি একই সঙ্গে সফল ভাবে ঈশ্বরে মন রেখে রাজধর্ম কর্তব্য পালন করে গেছেন।
আগেই উল্লেখ করেছি মহাগ্রন্থ গীতায় “যোগ” শব্দটি বহুমাত্রিক। সাংখ্যযোগ অধ্যায়ের ৫০নং শ্লোকটির মতে কর্মে কৌশলই যোগ আবার ধ্যানযোগ অধ্যায়ের ২নং শ্লোকের মুখরাতে দেখতে পাচ্ছি শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলছেন, “হে পাণ্ডব, যাকে সন্ন্যাস বলা যায় তাকে যোগ বলে জানবে…।”
যোগ শব্দের যদি অভিধানিক অর্থ ধরা যায় তবে বলা যেতে পারে “যুক্ত” হওয়া। সেই অর্থে মহাগ্রন্থ গীতার যে অষ্টাদশ অধ্যায় আছে সেই সম্পর্কে একটা মোটামুটি ধারনা করা যেতে পারে যেমন কর্মযোগ, ধ্যানযোগ, ভক্তিযোগ, মোক্ষযোগ ইত্যাদি।
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ সহজ সরল ভাবে কোনরকম উচ্চস্তরের দার্শণিক আলোচনায় না গিয়ে সমস্ত যোগের উর্ধে “মনোযোগ”-কে স্থান দিয়েছেন যা এক কথায় simply awesome.
আমাদের সমস্ত ক্রিয়া কর্ম কার্য একাগ্রচিত্ত ব্যতীত যে অচল সেটা ঠাকুর রামকৃষ্ণ যাকে বলে Bull’s eye হিসেবে চিহ্নিত করে দিয়েছেন মনোযোগ রূপে। সত্যি অসাধারণ।
(২২)
গীতা মহাগ্রন্থে শান্ত সহিষ্ণু অহিংস হবার যেমন উপদেশ আছে তেমনই দূর্বলের মতো অত্যাচার সইতেও নিষেধ আছে। এই প্রসঙ্গে রামকৃষ্ণদেবের সেই বিখ্যাত গল্পটি স্মরণ করা যেতে পারে যা লোকশিক্ষার রূপক হিসেবে এক কথায় একম এবং অদ্বিতীয়ম।
স্মৃতি যদি বিশ্বাসঘাতকতা না করে তবে গল্পটার সারাংশটা মোটামুটি ভাবে স্মরণ করা যাকঃ
একবার এক সাধু তীর্থ ভ্রমণকালে এক ভয়ঙ্কর বিষধর সাপকে উপদেশ দিয়ে গিয়েছিলেন যে সে যেন মানুষকে কামড়ানো থেকে বিরত থাকে কেননা তার ভয়ে নিকটবর্তী সমস্ত গ্রামবাসী অত্যন্ত ভীত সন্ত্রস্ত।
বহু দেশ পরিভ্রমণ করে ফিরতি পথে সাধু সাপটির মৃতপ্রায় অবস্থা দেখে করুণাবশতঃ তার বর্তমান অবস্থার কারন জানতে চাইলেন। ক্রন্দনরত সাপটি সাধুবাবাকে জানায় যে যেদিন থেকে সে তার কামড়ানো স্বভাব ত্যাগ করেছে সেইদিন থেকে তাকে আর কেউ ভয় পায় না। ছেলেরা মাঠে খেলতে এসে সবাই মিলে তাকে লাঠি ঢিল মেরে মেরে মৃতপ্রায় করে ছেড়েছে।
সব শুনে সাধু সাপটিকে বললেন, “ওরে বোকা, তোকে তো আমি শুধু কামড়াতে মানা করেছি; ফোঁস করতে তো বারণ করিনি।”
আবার বলছি লোকশিক্ষা উপযোগী এই গল্পটি এক কথায় অসাধারণ।
সুধী পাঠক / পাঠিকাদের জানাই যে এতবড় একটা ভারি বিষয়ে মতামত জ্ঞাপন করার জন্য উপযুক্ত জ্ঞান না থাকা সত্বেও এতপাতা লিখে ফেলার পর মনে হচ্ছে এবার দাঁড়ি টানবার সময় এসেছে।
মহাগ্রন্থ গীতার পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণ এবং পরমপুরুষ শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ এই দুই হেভি ওয়েট ব্যক্তিত্বেদের নিয়ে নিজের আলোচনা নিজের কানেই কেমন বেসুরো লাগছে। আমার মতো সুরে অসুর আর তালে বেতাল মানুষের কাছে বাঁশী আর বাঁশের বিশেষ পার্থক্য থাকে না। প্রায় হাজার আষ্টেক শব্দ লেখার পর মনে হচ্ছে পাঠকদের ধৈর্যের বাঁধ এবার ভেঙে পড়তে পারে।
শেষ অঙ্কে এসে যদি নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করি যে, “মহাগ্রন্থ গীতায় যে শিক্ষা আছে তার উদ্দেশ্য কি? চোখের পলক না ফেলেই উত্তর হবে, কেন? মোক্ষ লাভ!”
এই মোক্ষলাভ সম্পর্কে আমার সঠিক পরিষ্কার কোন ধারনা নেই। মোক্ষের কোন তারতম্য আছে কিনা সে ব্যাপারেও আমার কোন সম্যক ধারনা নেই।
তবে সাদামাটা বাংলায় এটুকু বুঝি যে অর্জুনকে যুদ্ধে রাজী করাবার উদ্দেশ্যেই শ্রীকৃষ্ণের মুখ নিঃসৃত শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার জন্ম এবং সেই সুত্রেই আমাদের এক অতি উচ্চমার্গীয় দার্শণিক উপদেশমূলক আলোচনার প্রাপ্তি।
রাজশেখর বসুর মতে, “গীতাকে যোগশাস্ত্র বলা হয়। এই যোগের অর্থ – আত্মোন্নতির জন্য সর্বতোভাবে সাধনা, Spiritual, Moral and Physical culture. বঙ্কিমচন্দ্র একেই “অনুশীলন” নাম দিয়েছেন। যিনি এই সাধনা করেন তাঁর সামাজিক বৃত্তি যাই হ’ক – গীতাকার তাঁকে যোগী বলেন।”
এই প্রসঙ্গে যদিও আমার মতো পটলবাবু ম্যাঙ্গোম্যানের মতামত মুল্যহীন তবুও সাহসিকতার সঙ্গে আমি আমার একান্ত নিজস্ব ব্যক্তিগত মতামতটা জানিয়ে রাখি।
(২৩)
আমার মতে মহাগ্রন্থ গীতা যে দার্শণিকতার ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে সেই “ত্যাগ” সম্পর্কীয় বহু শ্লোকভিত্তিক আলোচনা আমরা এই মহাগ্রন্থে দেখতে পেলেও এই প্রসঙ্গে শ্রেষ্ঠ শ্লোকটি কিন্তু উপনিষদ-এ বিবৃত আছেঃ
“ক্তেন ক্ততেন ভুঞ্জীথা মা গৃধ”
(ত্যাগের দ্বারা ভোগ করিবে, কখনো লোভ করিবে না)
এতক্ষন ধরে এতসব ভারি ভারি দার্শণিক কথার ফুলঝুরি দেখা গেল, কৃষ্ণ ঠাকুর আর রামকৃষ্ণ ঠাকুরের কথা আলোচনা হলো আর বাঙালীর প্রাণের ঠাকুর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা হবে না সেটা তো হতে পারে না।
আগেই বলেছি রবি ঠাকুর সৃষ্ঠ “রাজর্ষি” উপন্যাসের নায়ক মহারাজ গোবিন্দমাণিক্য ঠিক এমনই একটি চরিত্র যিনি উপনিষদের উপরিউক্ত বাণীটিকে জীবনের পাথেয় করে নিয়েছিলেন।
রাজর্ষি উপন্যাসটির গোবিন্দমাণিক্য চরিত্রটি মহাগ্রন্থ গীতার পুরুষোত্তমযোগে বর্ণিত চরিত্রের ন্যায় এক আদর্শবান আসক্তিহীন নিষ্কাম কর্মে নিয়োজিত একটি ইর্ষান্বিত চরিত্র।
এইখানে একটা কথা সকলের মনে হতে পারে যে উপন্যাসের এই গোবিন্দমাণিক্য চরিত্রটি কি বাস্তবে সোনার পাথরবাটি যা কেবল ফিকশনাল ক্যারেক্টার হিসেবেই পাওয়া যাবে?
এই প্রশ্নের উত্তরে বলতে হয় যে মোটেই তা নয়।
ভারতবর্ষ তথা পৃথিবীর নানান কোণে জীবনযাত্রার বিভিন্ন মঞ্চে এখনও গোবিন্দমাণিক্যরা প্রচারের আলোর বাইরে থেকে নিষ্কাম ভাবে ব্যক্তিগত স্বার্থবিহীন বহুজন হিতায়চ নিজের নিজের কর্মযোগে লিপ্ত আছেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে জানি আমাদের হায়দ্রাবাদে শহরেও এরকম গোবিন্দমাণিক্যের সংখ্যা মোটেই কম নয়।
তবে আমজনতা পটলবাবুদের কাছে নিস্কাম কর্মবীর গোবিন্দমাণিক্যদের আদর্শ জীবন দর্শণ অনুসরণ করার ছাড়াও পরমহংসদেব প্রদর্শিত পথে সমস্ত যুক্তিতক্কের উর্ধে উঠে শরণাগত হয়ে পরমাত্মায় নিজেকে সমর্পণ করার রাস্তাও খোলা আছে –
“শরণাগত কিঙ্কর হীন মনে।
গুরুদেব দয়া কর দীন জনে।।”
-----------------“কৃষ্ণ বলো সঙ্গে চলো”--------------------
Bibliography :
১। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা – অনুবাদক রাজশেখর বসু –এম সি সরকার এন্ড সন্স
২। শ্রীমদ্ভাগবদ্গীতা – স্বামী অপূর্বানন্দ কর্তৃক অনূদিত ও সম্পাদিত
রামকৃষ্ণ মঠ – ভুবনেশ্বর।
৩। Srimad Bhagavad Gita Original and Translation - Swami Vireswarananda,
Ramkrishna Math, Madras
৪। OM THE BHAGAVADGITA or THE SONG DIVINE –Gita Press, Gorakhpur
৫। পরমপুরুষ শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ – অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত (চার খন্ড একত্রে) – মিত্র ও ঘোষ
৬। শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত – শ্রীম কথিত (অখন্ড), উদ্বোধন কার্যালয়
৭। Swamy Vivekananda A Biography– Swamy Nikhilananda, Advaita Ashrama
৮। শ্রীরামকৃষ্ণ বাণী ও শাস্ত্রপ্রমাণ – সংকলক কুমারকৃষ্ণ নন্দী, উদ্বোধন কার্যালয়
0 comments: