0

ধারাবাহিক - সুবল দত্ত

Posted in

ধারাবাহিক


প্রতিস্রোত
সুবল দত্ত


৩ 
জেরেকা 
শস্যক্ষেত্রে প্রথম রোপন নিয়ে যে ঝামেলা হলো তা পেরো সামাল দিলো ঠিকই কিন্তু জোহার কথায় এই স্বর্গরাজ্যে মানে সত্যিকারের ইউটোপিয়ায় আগে কখনোই এইকাণ্ড হয়নি। মনেহয় এই প্রথম এখানে একটু বিষানুর অনুপ্রবেশ হলো। এই বিষ কোনো সঞ্জীবনী ঔষধি দিয়ে শেষ হবার নয়। এই বিষ আকাশে বাতাসে মাটিতে প্রত্যক্ষ নয়। ভয় হয় কখনো না কখনো বিশাল আকার ধারন করতে পারে। যদিও জেরেকা পেরোর সাথে বসে দু পক্ষের মানুষকে বুঝিয়ে সুজিয়ে ক্ষেতে পাঠিয়ে বীজ ফেলার অনুষ্ঠান বীনা রক্তক্ষয়ে সম্পন্ন করেছে কিন্তু মনে মনে একটা অশান্তি এখনো তাড়া করছে। টিকতে দিচ্ছেনা। তবে পেরোকে দেখে জেরেকার মনোবল অনেক দৃঢ় হয়েছে। ভিন্ন ভিন্ন উপজাতিদের ভিতর সাম্যতা রাখার ক্ষমতা তো পেরোর আগে থেকেই ছিল,কিন্তু তখন পদ্ধতি ছিল ভিন্ন। সে তখন ছিল উগ্র ও হিংস্র। তার স্বভাব ছিল বন্য। ছোটো ছোটো প্রাণী জ্যান্ত কাঁচা খেয়ে ফেলতো। স্নান করতো না,নোংরা থাকতো। নেকড়ের মতো স্বভাব ছিল আর কি জানি কেন অন্ধকারে ওর চোখ শ্বাপদের মতো জ্বলতো। মানুষ খুন করতে একটুও হাত কাঁপতো না। একজনের সামনেই সে জুজু হয়ে থাকতো,তিনি হলেন গোরাচাঁদ। আর এখন? সেই পেরোকে চেনাই যায়না।শান্ত সৌম এক ঋষিকুমারের মত স্বভাব। কি সুন্দর দেখতে হয়েছে। আগে ওএতই উগ্র ছিলো যে ওর সাথে কথা বলতে ভয় পেতো। মিটিং ছাড়া ওর কাছে খুব একটা কেউ আসতো না। আর এখন ওকে দেখলেই লোকে দৌড়ে কাছে চলে আসে। হেসে হেসে কথা বলে। ওইতো ! পেরো আর কয়েকজন বয়স্ক মানুষ ঝিলের ধারে বসে আছে। কিছু পরামর্শে মগ্ন।ঈশ্বর ওকে এমনিই রাখুন চিরকাল। জেরেকার বুকটা ভরে ওঠে। 

ঝিলে প্রচুর পদ্ম ফুটে রয়েছে,তবু গাঢ় কালচে নীল রঙের গভীর জলে সাদা তরঙ্গ উছলে উঠছে। কয়েকজন বোদ্ধা মানুষের সাথে পেরো সবুজ মসৃণ লম্বা লম্বা ঘাসে যেন ডুবে আছে। দিগন্তে একটু লাল রঙ ধরেছে। পরিবেশ মনোরম তবু জেরেকার মন অশান্ত। কেন সে কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছেনা। কি মনে হতে জেরেকা এগিয়ে গেল ওদের কাছে। ওর সসম্ভ্রমে ওকে বসতে অনুরোধ করল।সবাই চুপ। সবার এই মৌনতা জেরেকার একটুও ভালো লাগছে না। পেরোকে বলল,-কি হলো চুপচাপ যে? কিছু হয়েছে কি? 

–যে বাচ্চা ছেলেটার বলি না হতে দেবার জন্য সারাদিন ধরে এতো মেহনত,তাকে বাঁচানো গেল না। 

-বাঁচানো গেল না মানে? ওকে তো শুধু বেঁধে রাখা হয়েছিল। ওর কড়ে আঙুল পর্যন্ত কাটতে দেওয়া হয়নি। তবে? কিসে ও মারা গেল? 

–ওকে নিরাপদে কুটিরে রেখে আসা হয়েছিল। খুব বেশি মধু খাইয়ে দেবার জন্য অজ্ঞান হয়ে যাবার মতো ঘুমিয়েছিল। তখন কে বা কারা তাকে গলা কেটে হত্যা করে এসেছে। 

-সর্বনাশ! ওর সাথে তো কারো দুশমনি থাকার কথা নয়? ও তো দশবছরের বাচ্চা! আর আমাদের জঙ্গলের কানুন অনুযায়ী কোনো উপজাতি অন্য উপজাতিকে গুপ্তভাবে হত্যা করেনা। সামনাসামনি লড়াই হয়। এরকম কাজ তো শহুরে মানুষের। তবে কার এমন দুর্মতি হোলো? 

পেরো মুখ নিচু করেই ছিল। এবার সোজা হয়ে বসে কথা বলল,-এটাই তো সমস্যা। আমরা সবার সাথে এক এক করে জিজ্ঞাসাবাদ করেও সুরাহা পাইনি এখনো। এখন আলোচনা করে দেখলাম,কেউ এই পরিবেশ ইচ্ছাকৃত ভাবে নষ্ট করছে।এবং পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী। এখানে যারা এসেছে তাদের মধ্যে কেউ বা কয়েকজন অসত্‍ উদ্দেশ্য নিয়ে ঢুকে পড়েছে এখানে। খুঁজে বার করে খতম করে দেওয়া খুব তাড়াতাড়ি দরকার। কিংবা এই শান্তির পরিবেশ থেকে বাইরে নিয়ে গিয়ে চরম শাস্তি। কিন্তু এনারা বলছেন এখানে প্রাণে মেরে দেওয়ার কোনো বিধান নেই। 

-তাহলে কি উপায়? 

-তাকে খুঁজে বের করে এক ধরনের ঔষধি আছে সেটা দিয়ে উপচার করা যেতে পারে। কিন্তু এই ওষুধ আগে কখনো কারো উপরে প্রয়োগ করা হয়নি। এটির প্রয়োগে মানুষটির মানসিকতা এমন হয়ে যায়,কারোর সাথে কথা বলাতো দূরের কথা কারোর কাছে আসতে পর্যন্ত চায় না সে। তাকে দূরে জঙ্গলের মাঝে স্মৃতিভ্রংশ হয়ে একা একা কাল কাটাতে হবে। কিন্তু... 

-কিন্তু কি পেরো? 

-এনারা বলছেন সেই ওষুধটি একধরনের সুন্দর হালকা গোলাপী রঙের ফুল। এর অতি সুন্দর মাদক মিষ্টি গন্ধ। এর গন্ধ কারো নাকে গেলেই সে দু চারদিন ধরে চুপচাপ মৌন থাকে। বেঁটে খাওয়ালে তো যা হয় সেটা তো বললাম। কিন্তু এইফুলে এত মধু যে, একধরনের মৌমাছি দিন রাত সব সময় উড়ে বেড়ায় আর বসে থাকে। যে ফুলে হাত দেয়, ওই মৌমাছির কামড় খেলে তার হাত পা অসাড় হয়ে চিরদিনের মত পঙ্গু হয়ে যায়। সেই ফুল আহরণ করা খুব মুশকিল। এই কথা বলে পেরো কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে হঠাত্‍ উঠে দাঁড়াল। 

-জোহা এখন একটা বিপদের সামনা করছে মনেহয়। কে ওই অনুপ্রবেশকারী? এখানে আসার প্রবেশপথ খুঁজে পেয়েছে? ওরসাথে এখানকার হত্যাকারীর কি কোনো যোগ আছে? আমরা যা চাইছি তার পদে পদে বাধা। ঈশ্বর কি কখনো মুখ তুলে চাইবেন না? এই নিষ্পাপ অসহায় বনবাসীদের উপর? 

জেরেকা উঠে দাঁড়িয়ে পেরোর হাত ধরলো। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,-আমাদের বনদেবতা সিংবোঙ্গা আমাদের নিশ্চয় রক্ষা করবেন। মাথা ঠাণ্ডা করে একটা কথা শোন পেরো। আমাদের এখান থেকে বাইরের জগতে বেরোবার পথ কারোর জানা নেই আর নাতো আমাদের স্মৃতিতে বাইরের জগতের কিছু মনে আছে। তার কারণ পরে জোহার কাছথেকে জেনেছি, এখানে আসার সময় সবাইকে একধরনের স্মৃতিভ্রংসের ওষুধ খাওয়ানো হয়েছে। আর আমাদের এই চারিত্রিক পরিবর্তনের জন্যেও তো আমরা এখনো জড়িবুটি খাচ্ছি। কিন্তু আমার মনেহয় কেউ বা কয়েকজন সেই অনুপ্রবেশের সময় থেকেই কোনো ওষুধ খায়নি। এবং সে ইচ্ছেকরে চালাকি করে খায়নি এই কাজ করতে। তাকে খুঁজে বার কর। প্রতিজনের সাথে আবার অন্যভাবে কথা বল। 

পেরো খুব মন দিয়ে কথাটা শুনল। বাকি সবাই মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানালো। 

0 comments: