0

সম্পাদকীয়

Posted in


সম্পাদকীয়



নীল তিমি থেকে বাথটব – গভীর সমুদ্র থেকে সোপওয়াটার – আমরা সেই জলেই আছি এবং মৃত্যু মিছিলের মধ্যে বেশ অদ্ভুতভাবে বেঁচে আছি! কিভাবে, কে জানে!  অবশ্য নিন্দুকের দল বলছে – এটাকে বেঁচে থাকা মোটেই বলেনা; চতুর্দিকের এই অমানুষ অধ্যুষিত সমাজে প্রতি মুহূর্তে আতঙ্কিত বুকে পড়ে থাকাকে কি বেঁচে থাকা বলে? রাজামশাই গাইছেন – হাল্লা চলেছে যুদ্ধে – আর আমরা কোরাসে সবাই তাঁর পোঁ ধরে ‘হাল্লা হাল্লা হাল্লা’ করেই চলেছি, করেই চলেছি... গুঁড়ি মেরে চেরা জিভে হিস হিস করতে করতে এগিয়ে আসছে আগুনে ঋতু...

এরই মধ্যে চুপি চুপি চলে গেলেন স্টিফেন হকিং – পৃথিবীর একমাত্র মানুষ, যিনি প্রতিবন্ধী ছিলেন না কোনওদিন। আস্ত একটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড যাঁর কর্মক্ষেত্র, গবেষণার খাতিরেই হয়ত হুইলচেয়ার গড়িয়ে গেছে অন্য কোনও সৌরজগতে – আলোর খোঁজে

অন্ধকার ভালো নয়। আমি অন্ধকারে এতকাল।।
শুধুই আলোর ইচ্ছা লালন করেছি।
শুধুই আলোর ইচ্ছা, আলোর অসীম ইচ্ছা নিয়ে
আমি এই অন্ধকারে জেগে আছি। এই
অব্যয় তরল অন্ধকারে।

[অন্ধকার নয় – নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী]

আমাদের জেগে থাকতেই হবে – শুভবোধ নিয়ে – আলোর অপেক্ষায় – আমরা জেগেই আছি

শুভেচ্ছা নিরন্তর

0 comments:

0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - অলকরঞ্জন বসুচোধুরী

Posted in

প্রচ্ছদ নিবন্ধ


ভাষা-সাহিত্য-স্বাধীনতাঃ প্রেক্ষিত বাংলা ও বাঙ্গালি
অলকরঞ্জন বসুচোধুরী


অন্তিম পর্ব


প্রতিষ্ঠানের আধিপত্য ও স্রষ্টার স্বাধীনতা 

একটি সভ্য ও সংস্কৃতি সম্পন্ন সমাজে সাহিত্য রচনা বা মতপ্রকাশের যে স্বাধীনতা একটি মৌলিক শর্ত, তার অনুশীলনের পক্ষে বা বিপক্ষে কোন্‌ শক্তিগুলো কাজ করে, সে কথা ভেবে দেখতে গেলে আমরা দেখতে পাবো নানাধরনের প্রতিষ্ঠানকে অবলম্বন করেই স্বাধীনতার এই মৌলিক প্রবৃত্তিটি যেমন অভিব্যক্তি লাভ করে, তেমনই আবার পুঞ্জীভূক্ত ক্ষমতা ও আধিপত্যের পীঠস্থানে পরিণত কিছু প্রতিষ্ঠান বা গোষ্ঠী সৃজনশীল মানুষের সেই স্বাধীনতাকে হরণ করার কিংবা ক্ষুন্ন ও খর্ব করার চেষ্টাও করে থাকে। এই প্রতিষ্ঠানগুলির হতে পারে বিশেষ কোনো মতবাদে বিশ্বাসী দল বা গোষ্ঠী হতে পারে নির্বাচিত বা স্বৈরতন্ত্রী কোনো সরকার, হতে পারে পত্র-পত্রিকা বা সাহিত্য গোষ্ঠী। বিশেষ কোনো মতবাদ বলতে প্রধানত দু-ধরণের মতবাদ এখানে বুঝতে হবে- রাজনৈতিক ও ধর্মীয়।

রাজনৈতিক মতবাদ কীভাবে সাহিত্যের স্বাধীনতার কণ্ঠরোধ করতে পারে বা একজন সাহিত্য স্রষ্টার রচনার উৎকর্ষের অবনমন ঘটাতে পারে তার উদাহরণ হিসেবে মুক্ত দুনিয়ার বুদ্ধিজীবীরা অনেক সময় কম্যুনিজমের দিকে আঙুল তুলে থাকেন। বিস্তারিত বির্তকে না গিয়ে তাঁদের যুক্তির নমুনা হিসেবে আমরা পশ্চিমবঙ্গের কিছু প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিকের বক্তব্য এখানে সংক্ষেপে উল্লেখ করতে পারি ১৯৬২ সালে ভারত চীন সীমান্ত সংঘর্ষের পর 'দেশ' পত্রিকার উদ্যোগে 'শিল্পীর স্বাধীনতা' শিরোনামে পশ্চিমবঙ্গের নামী সাহিত্যিকদের দিয়ে একটি প্রবন্ধমালা লেখানো হয়েছিল। আমরা জানি চীনের সামারিক অভিযানের ধাক্কায় সে সময় সহসা কিভাবে বাঙালি তথা ভারতীয়দের দেশপ্রেম জেগে উঠেছিল ও প্রত্যাশিতভাবেই শিবরাম চক্রবর্তী ও নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের মত মুষ্টিমেয় দু'একজন ছাড়া প্রায় সবাই কম্যুনিজমের বিরুদ্ধে তাঁদের নিঃসংশয় বিরুপতা প্রকাশ করেছিলেন। শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের অভিমত ছিল, 'কম্যুনিস্ট সমাজতন্ত্রে স্বতন্ত্র মানুষের বিশিষ্ট কোনও ভূমিকা নেই। তারা শুধু মানুষ। বৃহৎ একটি যন্ত্রের অঙ্গ বিশেষ।... [শিল্পীর স্বাধীনতা' দেশ। পৃঃ৯৯২]

সঞ্জয় ভট্টাচার্য ঐ প্রবন্ধমালায় বলেছিলেন, "সৃষ্টিশীল সাহিত্যিকদের মননে বাধানিষেধের পাহারায় রাখলে সৃষ্টি পঙ্গু হতে বাধ্য। কম্যুনিস্ট আদর্শ সৃষ্টিশীল মনক পঙ্গু করে। তাই মায়াকভস্কির আত্মহত্যা। ...কম্যুনিস্ট আদর্শ মানবতার ওপরে আঘাত দেয়। এ আঘাত আর যেই সহ্য করুক, সাহিত্যিক সহ্য করতে পারে না।" [শিল্পীর স্বাধীনতা' দেশ। পৃঃ৭৯৪] তাঁর আরও অভিযোগ ছিল যে, অকম্যুনিস্ট রাশিয়াতে যে উচ্চশ্রেণীর সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছিল, কম্যুনিস্ট জমানায় তা হয়নি। কম্যুনিজমে বিশ্বাসী হয়ে যে শক্তিমান লেখকের সাহিত্যিক উৎকর্ষের অধঃপতন হয়, এর দৃষ্টান্ত হিসেবে তিনি এরেনবুর্গ ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উল্লেখ করেছিলেন। [শিল্পীর স্বাধীনতা' দেশ। পৃঃ৭৯৩] আবার বুদ্ধদেব বসুর মত ছিল- 'কম্যুনিজমের ঘোষিত উদ্দেশ্য হলো স্বাধীনতার হত্যা ও এক নায়কতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা। [ঐ, ১০ ফাল্গুন, ১৩৬৯, পৃঃ৩১০) এই বিতর্ক চলার সময়েই স্বাধীন সাহিত্য সমাজ নামে এক সংস্থা প্রতিষ্ঠা করে কম্যুনিজম সম্পর্কে কয়েকজন লেখক ঘোষণা করেছিলেন, "এই ব্যক্তি বিনাশী ব্যবস্থাকে সকলের চেয়ে ভয় ও ঘৃণার চোখে দেখেন শিল্পী সাহিত্যিক ও জ্ঞানব্রতীরা না দেখে পারেন না। কারণ ব্যক্তি স্বাধীনতার প্রয়োজন সকলের চেয়ে বেশি তাঁদেরই। তাঁদের ব্যক্তিত্ব বিকাশের পূর্ণতা পূর্বনির্দিষ্ট পথে- প্রথা শাস্ত্র বা ঐতিহ্যের পথে সম্ভব নয়।" এই ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেছিলেন আবু সঈদ আইয়ুব, তারাশংকর বন্দোপাধ্যায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, বুদ্ধদেব বসু ও সুবোধ ঘোষ। [স্বাধীন সাহিত্য সমাজ, দেশ, ৫ মাঘ, ১৩৬৯, পৃঃ১০৭৯] বলাবাহুল্য রাজনৈতিক মতাদর্শ হিসেবে কম্যুনিজমের গুণাগুণ বিচার সম্পূর্ণ ভিন্ন বিতর্ক, আমরা শুধু সাহিত্যের স্বাধীনতার অনুশীলনে রাষ্ট্রনৈতিক মতবাদ কিভাবে বাধক ভূমিকা নিতে পারে তার একটিমাত্র উদাহরণ হিসেবে কম্যুনিজমের উল্লেখ করেছি, আমাদের দেশে এর চরম দৃষ্টান্ত না থাকলেও সোভিয়েত দেশের ক্ষেত্রে নোবেলজয়ী পাস্তের নাক বা সলঝেনিতসিনের কথা আমাদের জানা আছে।

ক্ষেত্র বিশেষে এই স্বাধীনতার বিরোধী প্রতিষ্ঠানের বা মতবাদের উদাহরণ হতে পারে কম্যুনিজমের স্থানে নাতসিবাদ, ফ্যাসিবাদ, এমন কি ধর্মীয় নানারকম মৌলবাদ।

আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশের ক্ষেত্রে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের সঙ্গে ঐ অভিব্যক্তির স্বাধীনতার গলা টিপে ধরার ক্ষেত্রে অনন্ত রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান বা মতবাদের সেই দাপুটে ভূমিকা আর নেই একথা স্বীকার করতেই হবে। সেকালের তুলনায় একালে বরঞ্চ এই অঞ্চলে দাপট বেড়েছে ধর্মীয় মৌলবাদের, সেটা আমরা ভাল করেই জানি। সেকালে বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের প্রবর্তন করে কাজি আবদুল ওদুদ প্রভূত প্রতিবন্ধকের সম্মুখীন হয়েছিলেন ধর্মধবজীদের কাচ্ছ থেকে আজ তাঁরই উত্তরসূরী তসলিমা নসরিনকে ধর্মীয় মৌলবাদীদের দাপটেই নিজের স্বদেশ স্বজন ছেড়ে ঘুরে বেড়াতে হয় দেশে বিদেশে, ভারতে এমন কি, পশ্চিমবঙ্গে এসেও তিনি তাদের আক্রমণ থেকে রেহাই পান না, হুমায়ুন আজাদের ওপরে নেবে আসে বাংলাদেশী ধর্মধবজী ছুরি, সেদেশে একের পর এক খুন হয়ে যান মুক্তমনা ব্লগ লেখক ও স্বাধীন চিন্তকেরা। 


প্রতিষ্ঠানশাসিত সাহিত্য বনাম স্বাধীন সাহিত্য 

কোনো প্রতিষ্ঠান, তা সে রাজনৈতিক বা ধর্মীয় বা সাহিত্যকেন্দ্রিক যে ধরণেরই হোক না কেন, যখন দীর্ঘস্থায়ী হয়, তখন সেটি হয়ে ওঠে ক্ষমতা, দাপট ও আধিপত্যদের কেন্দ্রস্বরূপ। মানুষের সামনে নিজের ক্ষমতা, মতবাদ ও অভিপ্রায়কে সুপ্রতিষ্ঠিত করার নেশায় ক্রমশ এইসব প্রতিষ্ঠান আরও শক্তি, আরও আধিপত্য সঞ্চয়ের উদগ্র বাসনায় প্রায়ই সাহিত্যের ও মানুষের অভিব্যক্তির স্বাধীনতার সীমানা লঙ্ঘন করতে চায়। এই প্রতিষ্ঠানগুলি নানা বিষয়ে নানা বিধান বা ফতোয়া জারি করেই ক্ষান্ত হয় না, তারা চায় স্বাধীন মানুষ তাদের কাজে, বক্তব্যে ও রচনায় এইসব শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনগুলির মতবাদ ও বিধিবিধানকেই প্রচার করবে, বা সেগুলির বিরোধিতা থেকে বিরত থাকবে। এই উদগ্র বাসনা চরিতার্থ করতে এই প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠানগুলি চেষ্টা করে অন্যান্য ক্ষুদ্রতর সংগঠন বা গণমাধ্যগুলিকে কুক্ষীগত করতে। একমাত্র ফ্যাসিবাদী রাস্ট্রব্যবস্থা ছাড়া অন্যান্য সমাজে এই প্রক্রিয়াটি সাধারণত সোজাসুজি পথের বদলে ঘুরিয়ে অন্যান্য নানা সাহিত্যিক প্রকরণ ব্যবহার করে সাহিত্যের লেখক ও পাঠকদের প্রভাবিত করে, করবার চেষ্টা করা হয়। আমাদের এই অভিজ্ঞতা আছে যে, সাহিত্য সংশ্লিষ্ট জগতে এমন কিছু লোকজন সর্বদাই থাকেন; যারা না বুঝে অথবা বুঝেসুঝেই নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য এই ফাঁদে ধরা পড়েন বা ধরা দেন। এদের পৃষ্ঠপোষণায় সাহিত্য হয়ে উঠতে পারে প্রতিষ্ঠানশাসিত। 

স্বাধীন সাহিত্য কীভাবে প্রতিষ্ঠানশাসিত হয়ে উঠতে পারে, তা বোঝার জন্য প্রতিষ্ঠানের প্রভাব ও প্রতিপত্তি অর্জনের ও বিস্তারের সহায়ক সাহিত্য সংশ্লিষ্ট উপকরণ বা প্রকরণগুলির উল্লেখ করা যেতে পারে। সাহিত্য সম্মেলন, সাহিত্য পত্রিকা, সাহিত্য পুরস্কার, বিশেষ উদ্দেশ্য ও কর্মসূচী নিয়ে গঠিত সংস্থা বা আন্দোলন, ভাষা ও সাহিত্যের সংস্কার কর্মসূচী ইত্যাদি হচ্ছে সাহিত্য সমাজে প্রচলিত সেইসব উপকরণ, যেগুলিকে ব্যবহার করে একটি প্রতিষ্ঠান সমাজে তার প্রভাব প্রতিপত্তি ও একাধিপত্য কায়েম করার চেষ্টা করে থাকে। এই প্রকরণ বা উপকরণগুলি বাঙলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে অতীতে ও বর্তমানে কিভাবে ব্যবহৃত হয়েছে ও সাহিত্যের স্বাধীনতার ওপর তার কিরকম প্রভাব পড়েছে, আমরা এবার সংক্ষেপে তার একটি হিসেব নেবো। বর্তমানে বাংলা সাহিত্য সৃষ্টির তিনটি মূল কেন্দ্র, অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও বাংলাদেশের মধ্যে শেষোক্ত দুটি কেন্দ্র সম্পর্কে আমাদের জানাশোনা ও ধ্যানধারণা নিতান্তই সীমাবদ্ধ বলে আমাদের এই আলোচনার নানা দৃষ্টান্ত ও ঘটনাবলীর উপস্থাপনা হবে প্রধানত পশ্চিমবঙ্গ বা আরও সুনির্দিষ্টভাবে কলকাতা কেন্দ্রিক সাহিত্যের নিরিখে। 

সাহিত্য পত্রিকা- অতীতে অর্থাৎ স্বাধীনতার পূর্ব পর্বে উনিশ শতককে বলা যায় বাংলা পত্রিকার স্বর্ণযুগ। বিখ্যাত সাহিত্য সেবীদের সম্পাদনায় যেমন নানা পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছে, তেমন আবার মূলত সাহিত্যিক না হয়ে শুধু সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনার সুত্রেই খ্যাত কীর্তি হয়েছেন রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় ও জলধর সেনের মতো সম্পাদকেরা। বঙ্গদর্শনের সময় থেকেই এই পত্রিকাগুলোকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠতো সাহিত্য সেবীদের নানা গোষ্ঠী বা আড্ডা। একটি গোষ্ঠী বা পত্রিকার বিরোধিতা করে আর একটি প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠী বা পত্রিকার উদ্ভভও বিরল ছিল না। এদের মধ্যে সুস্থ প্রতিযোগীতা, বির্তক, বিরোধিতা এমন কি পারস্পরিক আক্রমণ বা রেষারেষি থাকলেও সাধারণভাবে সাহিত্য সৃষ্টির স্বাধীনতায় কোনো হস্তক্ষেপ ছিল না। 'ভারতী' বনাম 'সাহিত্য', 'সবুজপত্র' বনাম 'নারায়ণ', কল্লোল-কালিকলম-প্রগতি বনাম 'শনিবারের চিঠি' - এরকম অনেক প্রতিযোগী পত্রিকা কেন্দ্রিক মঞ্চ ছিল, এর বাইরে ছিল সাধনা, হিতবাদী, বিচিত্রা, পরিচয় ইত্যাদি নানা বিশিষ্ট পত্রিকা সাহিত্য ছাড়াও রাজনীতি ও শিল্প সংস্কৃতির নানা প্রগতিশীল ধারার পৃষ্ঠপোষকতায় অগ্রগণ্য ছিল প্রবাসী পত্রিকা। এটির মধ্যেই প্রথম দেখা যায় একটি স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠানের বিশালতা স্বাধীনতা পরবর্তী যুগে সাহিত্য পত্রিকার ক্ষেত্রে অবশ্যই উল্লেখযোগ্যভাবে গণনীয় ওঠে আনন্দবাজার পত্রিকা গোষ্ঠীর 'দেশ' পত্রিকা। এ-সময় অতীত যুগের সাহিত্য পত্রিকাগুলির বেশিরভাগই বিলুপ্ত হবার বা তাদের বিক্রি কমে যাবার ফলে বিভিন্ন সংবাদপত্রভিত্তিক সাহিত্য পত্রিকাগুলোই প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। খবরকাগজ প্রধানত বাণিজ্যমূলক বলে এইসব গোষ্ঠীর সাহিত্য পত্রিকাগুলোর অর্থনৈতিক ভিত্তিও ছিল বিশুদ্ধ সাহিত্য পত্রিকাগুলোর তুলনায় মজবুত। তাই গত শতকের ষাট সত্তর দশক পর্যন্তও সাপ্তাহিক ও মাসিক বসুমতি ও যুগান্তর গোষ্ঠীর সাহিত্য পত্রিকা 'অমৃত', 'দেশ' পত্রিকার সমান্তরাল সাহিত্য মঞ্চ হিসেবে টিকেছিল। এ-ছাড়া শিশু সাহিত্য কেন্দ্রিক কয়েকটি পত্রিকাও ছিল, যার প্রচার ছিল বেশ ভালো। এ জাতীয় পত্রিকাগুলো ও যাকে লিটল ম্যাগাজিন বলা হয়; সেই উৎকন্ঠের বিচারে উচ্চমানের ও আয়ুর বিচারে ক্ষীণজীবী পত্রিকাগুলিকে আমরা এখানে ধরছি না। 

দেশ ও তার প্রতিযোগী 'অমৃত' পত্রিকার মাধ্যমে একটা সুস্থ প্রতিযোগিতার হাওয়া কলকাতাভিত্তিক বাংলা সাহিত্যের বাজারে কিছুদিন বজায় ছিল। সংবাদপত্রের সঙ্গে যুক্ত বলে এই পত্রিকাগুলির অনেক লেখকই ছিলেন ঐ সব সংবাদপত্রের কর্মচারী বা সাংবাদিক ও সে কারণে তারা একটি বিশেষ গোষ্ঠীর লেখক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যান। সম্ভবত ষাটের দশকের শেষের দিকে এই সুস্থ হাওয়াটি নষ্ট হয়ে যায় 'দেশ' তথা আনন্দবাজার গোষ্ঠীর একটি ফতোয়ার ফলে। এই গোষ্ঠীর শারদীয়া সংখ্যাগুলিতে [অর্থাৎ শারদ সংখ্যা আনন্দবাজার পত্রিকা ও দেশ] উপন্যাস লিখবেন, তারা অন্য গোষ্ঠীর শারদ সংখ্যায় উপন্যাস লিখতে পারবেন না। এই গোষ্ঠীতে অনেক গণনীয় উপন্যাস লেখক থাকলেও তাদের স্বাধীনতার বাধক এই ফরমান তাঁরা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন জীবিকার দায়ে, কারণ আর্থিক কৌলীন্যে আনন্দবাজারের সমকক্ষ তখন কেউ ছিল না। আজকেও সংবাদপত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত কিছু কাগজ থাকলেও সাহিত্য পত্রিকা হিসেবে তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো সাহিত্য পত্রিকা এদের নেই। আশি ও নব্বই দশকে 'প্রতিক্ষণ' পত্রিকাটির বিলুপ্তির পর পশ্চিমবাংলার বাণিজ্যিক সাহিত্য পত্রের জগতে কার্যত এক মেরু ব্যবস্থার প্রবর্তন হয়েছে। যা সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর বিশ্ব রাজনীতির অবস্থার সঙ্গে তূলনীয়। এই একাধিপত্য কায়েম করেও অবশ্য দেশ পত্রিকা শেষ রক্ষা করতে পারেনি, পত্রিকাটির বর্তমান উৎকর্ষের অবক্ষয় তার প্রমাণ- বিক্রি কমে যাবার ফলে এটিকে দ্বিসাপ্তাহিকে পরিণত করে এর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হয়েছে। কিন্তু এই গোষ্ঠীর আধিপত্য প্রতিষ্ঠার বিরাম অবশ্য হয়নি। 

সাহিত্য পুরস্কার - গত শতাব্দিতে শুধুমাত্র বাংলা সাহিত্যের জন্য প্রদেয় পুরস্কার হিসেবে প্রথম যুগে খ্যাত ছিল কলকাতা বিশ্ব বিদ্যালয়ের জগত্তারিণী পদকও একটি তেল প্রস্তুতকারক সংস্থার 'কুন্তলীন' পুরস্কার ইত্যাদি হাতে গোনা কয়েকটি সম্মাননা। তখন খ্যাতকীর্তি সাহিত্য স্রষ্ট্রা প্রচুর ছিলেন, যারা এইসব পুরস্কার পাননি, তাতে কিন্তু তাঁদের খ্যাতি বা সমাদরে কোনো ঘাটতি পড়েনি। অবস্থার পরিবর্তন হয়, স্বাধীনতার পর থেকে। পশ্চিমবঙ্গ-ত্রিপুরা-বাংলাদেশ- সর্বত্রই বর্তমানে প্রধান সাহিত্য পুরস্কারগুলোর উদ্যোক্তা স্বাভাবিকভাবেই জাতীয় বা প্রাদেশিক সরকার, কিংবা বাংলা আকাডেমির মতো কৌলীন্য বর্জন করেছে, সেই তালিকায় বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দেখতে পাই সাহিত্য পত্রিকা ছাড়াও নানা বাণিজ্য গোষ্ঠী ও ব্যাঙ্ক এগিয়ে রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে একদা এ ব্যাপারে সমান্তরাল স্থানে ছিল আনন্দবাজার ও যুগান্তর গোষ্ঠীর প্রবর্তিত সাহিত্য পুরস্কারগুলি। এছাড়াও বহু গোষ্ঠীর আয়োজিত নানা সম্মাননা ও পুরস্কার পশ্চিমবঙ্গে থাকলেও যুগান্তর গোষ্ঠীর বিলোপের পর আনন্দবাজার গোষ্ঠীর আনন্দ পুরস্কারের সম-গুরুত্বের ও কৌলীন্যের বেসরকারি পুরস্কার যে আর একটিও নেই। একথা অস্বীকার করার নয়। এই এক মেরু দুনিয়াতে একচেটিয়া প্রভুত্ব বিস্তার তাই এই সংস্থার কাছে আজ আরও সহজসাধ্য পুরস্কার, প্রচার ও গ্রন্থ প্রকাশন ব্যবস্থা-লেখক তৈরির সব কটি বাহ্য প্রকরণই আজ তাদের করায়ত্ত। 

সাহিত্য-সম্মেলন - বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে পুরানো সাহিত্য-সম্মেলন প্রবাসী বঙ্গ সাহিত্য-সম্মেলনের সূচনা হয়েছিল ১৯২২ সালে, সভাপতি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তারপর থেকে নানা গুণী ও সুধী সাহিত্য সেবীর অংশগ্রহণে কালক্রমে এটি হয়ে উঠেছিল বাংলা সাহিত্য আলোচনার একটি অগ্রগণ্য প্রতিষ্ঠান, স্বাধীনতার পরে যার নাম হয় নিখিলভারত বঙ্গসাহিত্য সম্মেলন। এরপরে বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে নানা সময়ে অবিভক্ত বাংলাদেশে বিভিন্ন সাহিত্য সংগঠন গড়ে উঠেছে। তিরিশের দশকে ঢাকায় গড়ে উঠেছিল কাজি আবদুল ওদুদের নেতৃত্বে মুসলিম সাহিত্য সমাজ - বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন ছিল তাঁর বিশেষ অম্বিষ্ট। মুসলিম সমাজে মুক্ত বুদ্ধি ও শাস্ত্রবিরোধিতার এই আন্দোলন অবশ্য বেশিদিন চলতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলিম হলে এই সংস্থার অধিবেশন বসত, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিরূপতায় তা তিন বছরের বেশি চলতে পারে নি- ধর্মান্ধ রক্ষণশীলদের বিরোধিতায় এক্ষেত্রে ক্ষুণ্ণ হয়েছিল সাহিত্যের স্বাধীনতা। 

বাংলাদেশের মার্কসবাদী ভাবধারায় বিশ্বাসী বুদ্ধিজীবীদের উদ্যোগে ১৯৩৬ সালে গঠিত হয়েছিল বঙ্গীয় প্রগতি লেখক সংঘ, ১৯৪২ সালে এটিই পরিবর্তিত হয় ফ্যাসিবিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘে। এগুলিতে অবশ্য বামপন্থী বা মার্কসীয় ভাবধারায় বিশ্বাসী নোন, এমন বুদ্ধিজীবীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল না, নানাভাবে রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদক সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার পর্যন্ত অনেকেই এই গোষ্ঠীতে যুক্ত হয়েছেন। এই সংগঠনগুলিতে মতভেদ ও গোষ্ঠীত্যাগের মতো ঘটনা থাকলেও কারও সৃষ্টির স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের মতো অবাঞ্ছিত ফ্যাসিবাদী ঘটনার তেমন কোনো নজির নেই। 

১৯৫৩ সাল থেকে 'নিখিলভারত বঙ্গসাহিত্য সম্মেলন' নামে পরিচিত বাংলা সাহিত্যের একমাত্র সর্বভারতীয় সংগঠনটির পরিচালনার উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের সূচনা হয় যখন এর সভাপতিত্বের আসনে সাহিত্যসেবী বা লেখকদের পরিবর্তে রাজনীতির নেতা ও সংবাদপত্র গোষ্ঠীর কর্ণধারদের বসানো শুরু হয়। মনে আছে, একসময় অমৃতবাজার যুগান্তর গোষ্ঠীর প্রভাবশালী ব্যক্তিরা এই সংস্থায় যুক্ত ছিলেন, সেসময় এই গোষ্ঠীর প্রধান সম্পাদক তুষারকান্তি ঘোষ এই সম্মেলনের সভাপতি পদে বেশ কয়েকবছর আসীন ছিলেন। সে সময়টায় আনন্দবাজার পত্রিকা এই গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক অধিবেশনগুলির কোনো সংবাদই তাদের কাগজে ছাপতো না। হতে পারে যুগান্তর গোষ্ঠী ছিল এদের প্রতিযোগী বা প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠান, কিন্তু একটি গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্য-সম্মেলনের সংবাদ প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে এভাবে পাঠকের কাছে নিষ্প্রদীপ করে দেওয়া আসলে এদের আধিপত্যবাদী নীতি ও অন্য একটি সংস্থাকে কুক্ষীগত করার ফ্যাসিবাদী প্রচেষ্টারই একটি নিদর্শন এবং এরকম পরিস্থিতিতে সাহিত্যের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ থাকতে পারে না বলাই বাহুল্য। আজ অবশ্য ঐ সর্বভারতীয় সম্মেলনটি টিকে থাকলেও সাহিত্য জগতে আগের মতো মর্যাদা ও গুরুত্ব যে তার নেই, তার প্রমাণ শুধু আনন্দবাজার নয়, প্রায় কোনো বাংলা কাগজেই এর কোনো খবর পাওয়া যায় না। কিন্তু তা অন্য প্রসঙ্গ। 

বাংলা বানান সংস্কার- সাহিত্যের বাহন বা উপকরণ হচ্ছে ভাষা, তাই সাহিত্যের সাধারণ স্বাস্থ্য স্বাচ্ছন্দ্য ও অগ্রগামিতাকে বহমান রাখার জন্য ভাষা সংস্কার বা বানান সংস্কার একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে এই প্রয়োজনের কথা প্রথম ভেবেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এই বানান সংস্কারের দায়িত্ব কারা অতীতে নিয়েছিলেন, তার একটি সংক্ষিপ্ত পরিক্রমা এখানে আমরা তুলে ধরছি, এর বৈশিষ্ট্যগুলো বোঝার জন্য। 

১৯২৫ - রবীন্দ্রনাথের উদ্যোগে বিশ্বভারতীর বানান সংস্কার দায়িত্বে সুনীতকুমার চট্টোপাধ্যায় ও হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। 

১৯৩৬- রবীন্দ্রনাথের অনুরোধে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রচেষ্টা - দায়িত্বে রাজশেখর বসু ও চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য। 

১৯৪৯- পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ পূর্ব বাংলায় বানান সংস্কারের সরকারি প্রচেষ্টা শুরু। 

১৯৬৩- ঢাকা বাংলা আকাদেমির বানান সংস্কার কমিটির দায়িত্বে সৈয়দ আলি আহসান 

১৯৬৭- ডঃ মুহম্মদ শহিদুল্লার নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বানান সরলায়ন কমিটি-এর বিরোধিতা করেন আবুল হাই, এনামুল হক, ডঃ মুনীর চৌধুরী প্রমুখ। 

১৯৮১-কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে বানান সংস্কার সম্পর্কে প্রায় ২০০ জন বিশেষজ্ঞের অভিমত সংগ্রহ করা হয়, কিন্তু কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। 

১৯৯১- আনন্দবাজার পত্রিকার ব্যবহারের জন্য নিজস্ব বানান বিধি 'কী লিখবো কেন লিখবো' বই আকারে প্রকাশিত, লেখক নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। 

১৯৯২- ঢাকা বাংলা আকাদেমির প্রমিত বাংলা নিয়মাবলী প্রকাশ। 

২০০৬- বাংলাদেশে 'প্রথম আলো' পত্রিকার নিজস্ব বানানরীতি প্রণয়ণ। 

এই পরিক্রমা থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে মোটামুটি ভাষা সংস্কারের একশো বইয়ের ইতিহাস আনন্দবাজার পত্রিকার এই ঢুকে পড়াটা ছিল ব্যতিক্রমী উচ্চাভিলাষী ও আলোড়ক। এ জাতীয় দায়িত্ব সাধারণত সর্বজনমান্য প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে উপযুক্ত বিদগ্ধ ব্যক্তিদের ত্তত্ববধানে ও বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে বা প্রকাশ্য বিতর্কের সুযোগ দিয়েই করা হয়ে থাকে ও বাংলা ভাষার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। আনন্দবাজার গোষ্ঠীই সর্বপ্রথম [ও পরে এদের দৃষ্টান্তে উৎসাহিত হয়ে ঢাকার 'প্রথম আলোর মতো দু'একটি পত্রিকা] নিজেদের উদ্যোগে কোনো জনমতের রায় বা বুদ্ধজীবীদের তোয়াক্কা না করে নিজের সংস্থায় কর্মরত এক সাংবাদিককে দিয়ে বানানবিধি প্রণয়ণ করাবার সাহস দেখায়। সাধারণভাবে নিজেদের পত্রিকায় ব্যবহারের জন্য বানানবিধি তৈরি করায় দোষের কিছু না থাকলেও সেটি বই আকারে ছাপিয়ে সাধারণ পাঠকের ওপর চাপিয়ে দেওয়া ও মতগুলির সপক্ষে কোনো যুক্তি বা বির্তকের প্রয়োজনকে উপেক্ষা করাটা এই গোষ্ঠীর আধিপত্যবাদী উচ্চাভিলাষেরই দৃষ্টান্ত। কবি বা সাংবাদিক/লেখক হিসেবে নীরেন চক্রবর্তী মহাশয় যতই কৃতী হন ভাষা সংস্কারে শেষ কথা বলার মতো পাণ্ডিত্য বা বৈদগ্ধ্য তাঁর কতটা ছিল, তা পূর্ববতী উদ্যোগগুলির সঙ্গে জড়িত দিকপাল মানুষগুলির নাম স্মরণ করলেই বুঝতে অসুবিধা হবে না। একটি সংবাদপত্র শুধু প্রাতিষ্ঠানিক সচ্ছলতার জোরে সাহিত্য জগতে মর্যাদা ও সমীহ আদায়ের জন্য এভাবে মরিয়া হয়ে ওঠার পরেও আমাদের পশ্চিমবঙ্গীয় বুদ্ধিজীবীরা এনিয়ে তেমন ভাবে সরব যে হতে পারেননি তা হাল আমলের সাহিত্যের ক্রমশ স্বাধীনতা খুইয়ে প্রতিষ্ঠান শাসিত হয়ে ওঠারই ইঙ্গিত দেয়। 

সাহিত্য-দুনিয়ায় প্রভাব ও প্রতিপত্তি বিস্তারের জন্য নানা উপকরণের ব্যবহার বা অপব্যবহারের যেসব দৃষ্টান্ত আমরা উল্লেখ করলাম, তা থেকে বোঝা যায়, বর্তমান সময়ে পশ্চিমবাংলায় সাহিত্যের স্বাধীনতা যে খুব সুরক্ষিত তেমনটা বলা যাচ্ছে না। এখানে এখন সরকারের সমান্তরালে ক্ষমতাশালী ও প্রভুত্বাকাংক্ষী একটিই মাত্র প্রতিষ্ঠান বিরাজ করছে, তার নাম হচ্ছে আনন্দবাজার পত্রিকা। সাহিত্যের গতি-প্রকৃতি নিয়ন্ত্রণ করার, এমন কি লেখকদের নিয়ন্তা হয়ে ওঠার সব ক'টি প্রকরণ, প্রকাশনী, পত্র-পত্রিকা, পুরস্কার, টিভিচ্যানেল-এর হস্তগত। অপর উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠান অবশ্যই পশ্চিমবঙ্গ সরকার। তবে সাহিত্য সম্পর্কে পরিস্কার ধ্যানধারণা বা পরিকল্পনা না থাকলে সাহিত্য সৃষ্টির স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপও তেমন পরিকল্পিতভাবে করা যায় না একথাও সত্যি। তবু পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে সরকার ও আনন্দবাজার গোষ্ঠী এই দুই প্রতিষ্ঠানের নানা নীতি যে স্বাধীন সাহিত্য সমাজের স্বাস্থ্যের পক্ষে খুব একটা শুভ হয়নি, তা সাম্প্রতিক অতীতের কয়েকটি ঘটনা থেকে বোঝা যায়। 

১৯৯১ সালে রবীন্দ্রনাথের গ্রন্থস্বত্বের মেয়াদ শেষ হবার সময় নিজের ব্যবসায়িক স্বার্থে বিশ্বভারতী যেভাবে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মাধ্যমে কেন্দ্রের সরকারকে প্রভাবিত করে আরও দশ বছর গ্রন্থস্বত্বের মেয়াদ বাড়িয়ে নিতে সফল হয়েছিল, তা আমাদের মনে আছে। এ ক্ষেত্রে বিশ্বভারতী নামক প্রতিষ্ঠান পশ্চিমবঙ্গ ও ভারত সরকার- এই দুই প্রতিষ্ঠানকে প্রভাবিত করে নিজের স্বার্থে সাহিত্য প্রকাশনার স্বাধীনতাকে খর্ব করতে পেরেছিল, যদিও এই সময় তা আমাদের মনে আছে। এ ক্ষেত্রে বিশ্বভারতী নামক প্রতিষ্ঠান পশ্চিমবাংলার তাবৎ বুদ্ধিজীবীসমাজ সহ আনন্দবাজার পত্রিকা এই প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে ছিল। 

এরকম আর একটি স্বাধীনতা হরণের ন্যক্কারজনক ঘটনা হচ্ছে বাংলাদেশের লেখিকা তসলিমা নসরিন ধর্মীয় মৌলবাদের দাপটে দেশ ছাড়তে বাধ্য হলেও দুই বাংলার বুদ্ধিজীবীরা কেউই এর প্রতিবাদে তেমনভাবে সোচ্চার হননি। তাঁকে দু-দুবার আনন্দ পুরস্কারে ভূষিত করে ও আনন্দবাজার গোষ্ঠী এই ফ্যাসিবাদী স্বাধীনতা হরণের বিরুদ্ধে কোনো আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করেনি। 

0 comments:

0

প্রবন্ধ - ধ্রুবজ্যোতি চক্রবর্ত্তী

Posted in


প্রবন্ধ


শ্রীমান কমলাকান্ত উবাচ 
ধ্রুবজ্যোতি চক্রবর্ত্তী 



আমাদের প্রবাসী বাঙালী ক্লাবে নতুন ম্যানেজিং কমিটি ঠিক করেছে এবার পুজোয় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অমর সৃষ্টি কমলাকান্তের ওপর নাটক মঞ্চস্থ করা হবে বঙ্কিমচন্দ্রের জন্মদিনে। নাটকটি শুধু “কমলাকান্তের জোবানবন্দী”র ওপর মঞ্চস্থ হবে না, পুরো কমলাকান্তের চরিত্রের ওপর আলোকপাত করা হবে। বুদ্ধিজিবী কমলাকান্ত, দার্শনিক কমলাকান্ত, লেখক কমলাকান্ত, খাদ্যবিলাসী কমলাকান্ত, অলস কমলাকান্ত ইত্যাদি কমলাকন্তের সকল দোষ-গুনেরই ৩৬০ ডিগ্রী পর্যালোচনা এই নাটকের মাধ্যমে আজকের দর্শকের কাছে তুলে ধরা হবে। 

আমাদের ক্লাবে প্রতিবছরই বারো মাসে আঠারো পার্বণ। প্রতিবছর রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ আর নেতাজী’র জন্মদিন পালন করা হয় এবার যুক্ত হলেন ঋষি বঙ্কিম। আসলে প্রবাসে রবীন্দ্র জন্মোৎসব পালনের পর একটা শূন্যতা’র সৃষ্টি হয় যেটার পরিপূরক হিসেবে এবার ঋষি বঙ্কিম জন্মোৎসব পালন। 

যাইহোক দ্বায়িত্বটা যখন নিতেই হলো তখন কোমর বেঁধে নেমে পড়লাম। বইয়ের তাক থেকে বঙ্কিম রচনাবলীর দ্বিতীয় খণ্ডটাকে ধুলো-টুলো ঝেড়ে নামানো হলো। রাতের খাবার তাড়াতাড়ি সেরে কমলাকান্তকে নিয়ে বসলাম। 

কমলাকান্ত আর আফিম একে অপরের পরিপূরক। তাই স্ত্রী’র শ্যেন দৃষ্টিকে বোকা বানিয়ে একটা নরম পাণীয়ের সঙ্গে দশরথের বড় পুত্রকে একটি পানপাত্রে নিমজ্জিত করে সেই মিশ্রণটাকেসঙ্গী করে আমার লেখার টেবিলের সামনে থাকাআমার অতি প্রিয় ঘুরন্ত চেয়ারটাতে বসলাম। 

গিন্নীকে বললাম আজ আমাকে একটু রাত জাগতে হবে। আমার এই দেশ উদ্ধার কর্মকাণ্ডের সাথে যথেষ্ট পরিচয় হবার ফলেগিন্নী আগের মতো আমায় এখন আর বিব্রত করেন না। 

একটু গভীর রাতে আমার লেখার টেবিলের পরিবেশটা বেশ মধুর। রাতে শব্দদূষণ কমে এলে টেবিল ল্যাম্পের আলো-আঁধারিতে আমার মনঃসংযোগটা ভাল হয়। কালি, থুড়ি, কম্পিউটার-কলম-আর মন এদের মধ্যে coordination-টা বেশ ভালো হয়। 

টেবিলে রাখা মিশ্রণটিতে একটি লম্বা চুমুক দিয়ে শ্রীভীষ্মদেব খোশনবীস কমলাকান্তের যে মুখবন্ধ লিখেছেন তাতে মনোনিবেশ করলাম। 

“কমলাকান্তকে লোকে পাগল বলিত। সে কখন যে কি বলিত, কি করিত, তাহার স্থিরতা ছিল না। লেখাপড়া না জানিত, এমত নহে…” 

কমলাকান্ত সম্পর্কে যতই পড়া এগোতে থাকল ততই যেন এই চিরত্রটিকে ভালবেসে ফেলতে লাগলাম। আনন্দের আতিশয্যে কখন যে গেলাসের পাণীয়টির প্রথম পর্যায়ের সমাপ্তি ঘটিয়ে দিত্বীয় পর্যায়ে চলে এসেছি সেটা নিজেই জানিনা। ইতিমধ্যে কমলাকান্তের দপ্তরটির ভেতরে ঢুকে পড়েছি। প্রতি মুহূর্তে তার লেখার সেই অনির্বচনীয় দার্শনিকতার স্বাদ আমার মুদ্ধ করে তুলতে লাগল। 

এর মধ্যে আলো আঁধারির রৌদ্রছায়ায় মনে হলো কেঊ যেন আমার চেয়ারের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। চোখ তুলে তাকাতেই দেখি অশীতিপর এক বৃদ্ধ খালি গায়ে একটি সাদা উড়নি জড়িয়ে আমার ঠিক ডান পাশে দন্ডায়মান। পড়নে হাঁটু পর্যন্ত সাদা খেটো ধুতি। উড়ুনিটির ফাঁক দিয়ে তাঁর কাঁধে ঝকঝকে সাদা উপবীতটি দেখা যাচ্ছে। এই আলো আঁধারিতেও তাঁর দুধে-আলতা গায়ের রঙের আভাস পাচ্ছি। ঋজু শরীরটির মধ্যপ্রদেশ ঈষৎ স্ফীত। 

২/- 

(২) 


মুহূর্তেই চিনতে পারলাম। বুঝতে পারলাম শ্রীকমলাকান্ত চক্রবর্ত্তী এখন আমার সামনে দণ্ডায়মান। 

কোনওরকম ভনিতা ছাড়াই, জলদগম্ভীর স্বরে তিনি আমাকে শুধোলেন, আমাসম্পর্কে চর্চা হইতেছে বুঝি?” 

অস্বীকার করবার উপায় নাই। একেবার বমাল সমেত ধরা পড়েছি। 

বলতেই হলো, আজ্ঞে হ্যাঁ। 

“আমার সম্পর্কে ওই খোশনবীস কতটুকুই বা জানে। সে ব্যাটা তো আমার দপ্তরটি চুরি করিয়া স্বনামে বঙ্গদর্শণ পত্রিকার সম্পাদকের নিকট বিক্রয় করিয়া দু-পয়সা কামাইয়া আমাকে বঞ্চিত করিয়াছে। 

“আজ্ঞে তাই নাকি?” 

“হ্যাঁ, আজিকার দিন হইলে প্লেগারিজম জগতে ইহা সর্ববৃহৎ স্ক্যাম বলিয়া বিবেচিত হইত। সোশ্যাল মিডিয়ায় ইহা ভাইরাল হইয়া যাইত।” 

আমি যৎপরনাস্তি অবাক হলাম। এই ঊনবিংশতি শতাব্দীর ব্রাহ্মণ সোশ্যাল মিডিয়ারও খবর রাখে!আমার কিংকর্তব্যবিমূঢ় ভাবটি কমলাকান্তের নজর এড়াল না। 

“কি ভাবিতেছ বৎস্য, আমি তোমাদের ফেসবুক, হোয়াটসয়্যাপ, টুইটার, স্ন্যাপচ্যাট ইত্যাদি সকল বিষয়েই আলোকপ্রাপ্ত হইয়াছি।

আমি আরও অবাক হয়ে মূর্খের মতো জিজ্ঞেস করে বসলাম, ”কি ভাবে?” প্রশ্নটা করেই বুঝতে পারলাম যে অসাধারণ বুদ্ধিধারী এই ব্রাহ্মণটিকে অর্বাচীনের ন্যায় এই প্রশ্নটি করা একেবারেই উচিৎ হয়নি। 

তবে কমলাকান্ত আমার মূর্খামিকে বিশেষ আমল না দিয়ে মহাভারত সিরিয়ালের শ্রীকৃষ্ণের সেই সবজান্তা বাঁকা হাসিটা হেসে বলল, স্বীকার করিতে আমার কুন্ঠা নাই যে এই বিষয়ে জ্ঞান লাভের জন্য আমি প্রসন্ন গোয়ালিনীর নিকট অতিমাত্রায় ঋণী।” 

গল্পের গন্ধে আমি ঝুলে পড়লাম বলা যায়। 

কমলাকান্ত আমার দিকে একটু কৃপা দৃষ্টি দিয়ে বলতে থাকে, “শুনো বৎস্য, একদা আফিমের আকাল পড়িয়াছিল। এক-আধ ভরি আফিমের জন্য চতুর্দিকে ত্রাহি-ত্রাহি রব। আমার রাতে ঘুম নাই, দিনে শরীরে বল পাই না, চারিদিকের জগৎ বিষময় ঠেকিতেছে। সরকারি আবগারি বিভাগের রক্তচক্ষুর জ্বালায় আমার এতদিনকার অতি আদরের তোয়াজের নেশাটির সমাধি আসন্ন লাগিতেছে। কেহ কহিল আফিমের বদলে সুরার নেশা ধর। ধরিলাম। কিন্তু শান্তি পাইলাম না। সসেমিরা অবস্থায় আবগারি বিভাগের এক ডেপুটির কাছে আধভরি আফিম ভিক্ষা করিতে গিয়া লাঠ্যাষৌধির সন্মুখীন হইয়াছিলাম।

আমি রাত্রির সেই আলো-আঁধারিতেও কমলাকান্তের চোখে এক বিন্দু অশ্রু কালের কপোলতলে শুভ্রসমুজ্জ্বল মক্তোর মতো চমকাচ্ছে দেখতে পেলাম। 

একটু দম নিয়ে কমলাকান্ত বলে চলে, আমার এই অর্ধমৃতপ্রায় অবস্থায় একদিন প্রসন্ন আসিয়া উপস্থিত। আমার জীবন্মৃত অবস্থা দেখিয়া সে প্রশ্ন করে ঠাকুর তোমার এ-দশা কেন। আমার নিকট হইতে সমস্ত অবগত হইয়া প্রসন্ন আমায় আশ্বাস দিয়া বলে যে ঠাকুর তুমি অতি সত্বর আফিম নামক এই স্থুল নিকৃষ্ট নেশা পরিত্যাগ কর। আমি তোমাকে একটি অতি উচ্চাঙ্গের নেশার সন্ধান দিতেছি। সমস্ত জগৎ আজি এই নেশার আস্বাদে আহ্লাদিত। তুমিই বা ঠাকুর ইহা হইতে বঞ্চিত হইবে কেন। এই বলিয়া সে আমাকে তোমাদিগের হোয়াটসয়্যাপ এবং ফেসবুক নামক দুইটি নেশার সন্ধান দেয়। আর তাহারপর আমি চক্ষু-কর্ণের বিবাদ ভঞ্জন করিয়া এই নেশাতে ডুবকি মারিতেই এই দেব প্রদত্ত নেশাটি আমায় যেন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়াইয়া ধরিয়া আমায় একান্ত আপন করিয়া লইল।” 



(৩) 



আমার বাকরহিত অবস্থা দেখিয়া কমলাকান্ত একটু মৃদু হাসিয়া আবার শুরু করে, এই নেশা সত্যই দেব প্রদত্ত। এই নেশার ক্ষয় নাই, লয় নাই, স্থান-কালের বিচার নাই। শ্মশানে-মশানে, বিদ্যালয়ে-মন্দিরে-মসজিদে-গীর্জায়-শয়ণ কক্ষে, আদালতে-কারাগারে, হাসপাতালে-মর্গে জগতের সকল সম্ভাব্য স্থলে, অন্তরীক্ষে ব্যোমযানে, রেলগাড়িতে, গো-শকটে সর্বস্থলে এই নেশার আস্বাদ লওয়া যায়। ইহার জন্য আবগারি বিভাগের রক্তচক্ষুর পরোয়া নাই।” 

নেশাগ্রস্তের ন্যায় কমলাকান্ত বলিয়া চলে,”এই নেশার প্রচণ্ডতা অতুলনীয়। ইহার ফলস্বরূপ আমি দিনমানে, রাত্রি জাগরণে সতত জঙ্গম। ইহার আখড়া সারা পৃথিবী ব্যাপী। এই নেশার www জালের জগতে আমি নিজেকে পূর্ণ নিমজ্জিত করিয়াছি। 

অহো… কি হেরিতেছি স্বপ্নসম এই জগতে!! ইধার কা মাল উধার করিবার নেশায় নেশাড়ুগণ রাত্রি জাগরণ করিয়া রক্তবর্ণ চক্ষু লইয়া সতত শ্যেণ দৃষ্টিতে সকল পোষ্টের দিকে চাহিয়া আছে যাহাতে তৎকাল সেইসকল পোষ্ট অপর কেহ অন্য নেশাড়ুকে পাচার করিবার পুর্বেই তিনি এই সৎকার্যটি তিনি সর্বাগ্রে করিতে পারেন। অপর কোন নেশাড়ু’র পূর্বে এই মাল পাচার না করিতে পারিলে সেই পোষ্টের কোনো মূল্য নাই, কোন like নাই। বরং অন্য নেশাড়ুগণ দুয়ো দিবে এবং ঊহা অতীব অপমানকর বলিয়া বিবেচিত হইবে। ইহাতে নেশা ছুটিয়া যাইবার প্রবল সম্ভাবনা বিদ্যমান থাকে।“ 

আমার হতচকিত অবস্থায় হাঁ-করা মুখে এক টুকরো কাঁচা সুপুরি ঢুকিয়ে দিয়ে কমলাকান্ত বলে চলে, হোয়াটসয়্যাপ আর ফেসবুক নামক নেশার ফাঁসে আজ সমস্ত জগৎ আটকা পড়িয়াছে। আজ আমি বুঝিতে পারিয়াছি এই উচ্চমার্গের নেশাটি চক্রব্যুহের ন্যায়। এই নেশার কবলে একবার পড়িলে ইহা হইতে কাহারও মুক্তি নাই। ইহা তোমাদিগের ঐ হকিং সাহেবের কৃষ্ণ গহ্বরের ন্যায়। অতএব দিবা-রাত্রি সকল কর্ম ত্যাগ করিয়া আজ সমস্ত জগতের মনুষ্য সকল তাহাদের মস্তক অবনত করিয়া দলমত, জাতি-ধর্ম, স্ত্রী-পুরুষ, খোকা-খুকুসহ সকল মনুষ্য সম্প্রদায় এই নেশার নিকট তাহার পদতলে আত্মসমর্পন করিয়াছে। সকল মনুষ্যকে একত্রিত করিয়া একই ছত্রের নিচে লইয়া আসিবার এই মহান কার্যটি স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ পারেন নাই, ভগবান যীশু পারেন নাই, মহম্মদ পারেন নাই এমন কি আলেকজান্ডার সাহেবও হাল ছাড়িয়া দিয়াছিলেন। এই কারনে আমি জুকেরবার্গ মহাশয়কে সর্বশক্তিমান মহাপুরুষ বলিয়া মান্য করিয়া থাকি। এই কারনে আমার গৃহদেবতার সিংহাসনের ওপরে ওনার একটি হাফ-বাষ্ট চিত্র বাঁধাইয়া রাখিয়া প্রতিদিন ধূপধুনো দিয়া অঞ্জলি প্রদান করিয়া থাকি। এই প্রসঙ্গে একটি কথা তোমাকে শুনাইতে চাই। মনে রেখ কোন ভিড়ের মধ্যে যদি কোনো মনুষ্যকে তুমি উচ্চশির অবস্থায় দেখিতে পাও তবে তাহাকে নেশা মুক্ত ভাবিবার কোনো কারন নাই। ইহার বদলে তুমি অতি অবশ্যই জানিবে যে সেই মনুষ্যটির পৃথিবী ব্যাপী www মাকড়সার জালে জড়াইবার জন্য যে সংযোগ ব্যবস্থার প্রয়োজন তাহাতে কিছু বিঘ্ন ঘটিয়াছে, হয় সে প্রয়োজনীয় রৌপ্য মুদ্রা জমা করে নাই অথবা তাহার যন্ত্রে কোন প্রকার যান্ত্রিক গোলোযোগ ঘটিয়াছে।“ 

আমিও এই সকল নেশার আস্বাদ নিয়ে থাকি। তবে এত গভীর ভাবে কখনও ভেবে দেখিনি। তবে হঠাৎ করে একটা কথা মনে পড়ল। ইস্কুলে আমাদের বাঙালী মহাপুরুষদের জীবনী পড়াবার দ্রুতপঠন ক্লাসটি আমাদের হেডমাষ্টার মহাশয় স্বয়ং পড়াতেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল যে এই মহাপুরুষদের জীবনী ছাত্রদের চরিত্র গঠনে সাহায্য করে আর এই কারণেই তিনি তাঁর সকল ব্যস্ততার মধ্যেও এই দ্রুত পঠনের ক্লাসটি তিনি নিজের দায়িত্বে রেখেছিলেন। 

এই ক্লাসে তিনি একবার রাজা রামমোহন রায়ের জীবনী পড়াতে-পড়াতে বলেছিলেন যে সমাজ সংস্কারক রাজা রামমোহন অত্যন্ত বিদগ্ধ এমন একজন মহাপুরুষ ছিলেন যে তিনি কোনদিনই কারো কাছে মাথা নত করেননি এমনকি প্রবল প্রতাপ সম্পন্ন ইংরেজ সরকার বাহাদুরের কাছেও নয়! 

আমাদের ক্লাসে পাগলা দাশুর ন্যায় একজন ছাত্র ছিল, তার নাম ছিল পল্টু। 


(৪) 



রাজা রামমোহন রায়ের এই প্রতিভার কথা শুনে পল্টুদাঁড়িয়ে উঠে প্রতিবাদ করেছিল। সে বলেছিল সে নাকি এমন একজনকে জানে যার কাছে রাজা রামমোহন রায়কেও তাঁর জিবীত অবস্থায় মাথা নত করতে হয়েছিল এবং একবার নয় অনেকবার। 

রাশভারী হেডমাষ্টার মহাশয়সহ সমস্ত ক্লাসের সবাই নিশ্চুপ।পরিস্থিতিটা যাকে বলে যাকে বলে একটা সূঁচ পড়লেও শব্দ শোনা যাবে গোছের। আমাদের কারুর মুখে কোনো কথা নেই। আমরা সবাই সভয়ে হেডমাষ্টার মহাশয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছি তাঁর প্রতিক্রিয়া দেখবার জন্য। বোঝা যাচ্ছে হেডমাষ্টার মহাশয় ভেতরে ভেতরে ভীষণ ভাবে উত্তজিত। কিন্তু নিজের সমস্ত উত্তেজনা সামলে তিনি পল্টুকে জিজ্ঞেস করেছিলেন,”আচ্ছা তুই যখন বলছিস তখন তোর কাছ থেকেই সেই মহাপুরুষটির নামটি আমরা সকলে শুনে নি যাঁর কাছে স্বয়ং রাজা রামমোহন রায়কেও মাথা নত করতে হয়েছিল!” 

এতটুকু না ঘাবড়ে মনে পড়ছে পল্টু সেদিন আমাদের রাসভারী হেডমাষ্টার মহাশয়কে বলেছিল,”মাষ্টারমশাই, আমি এমন একজনকে জানি যাঁর কাছে শুধু রাজা রামমোহনকেই নয় সমস্ত মহাপুরুষকেই যুগে যুগে মাথা নত করে আস্তে হয়েছে, হচ্ছে এবং হবেও।“ 

ধৈর্য আর ধরে রাখতে না পেরে হেডমাষ্টার মহাশয় পল্টুকে ধমকে বললেন,”আর হেঁয়ালি না করে সেই মহান ব্যক্তিটির কথা আমাদের তুই তাড়াতাড়ি বল।“ 

পল্টু বলেছিল। 

পল্টু তারপর আর কোনো হেঁয়ালি না করেই বলেছিল,”আজ্ঞে মাষ্টারমশাই, রাজা রামমোহন রায় যখন সেলুনে মাথার চুল কাটাতে যেতেন তখন তাঁকে অতি অবশ্যই নরসুন্দরের কাছে মাথা নোয়াতে হত।“ 

আমরা সবাই আবার কয়েক মূহুর্তের জন্য বোবা হয়ে গেছিলাম। সমস্ত ক্লাসে সে এক অসহ্যকর পরিস্থিতি। অবশেষে রাশভারী গম্ভীর হেডমাষ্টার মহাশয় হো হো করে হেসে উঠতেই সারা ক্লাস যেন প্রাণ ফিরে পেয়ে সেই হাসিতে যোগ দিল। 

ঘটনাটা মনে পড়তেই সেটা শোনাবার জন্য ঘাড় ঘোড়াতেই কমলাকান্তকে আর দেখতে পেলাম না। খোলা জানালাটার দিকে তাকাতেই দেখি পুব আকাশে রং ধরেছে। আমাদের সামনের কৃষ্ণচূড়া গাছটাতে একটা কোকিল থাকে। শুনতে পেলাম সে কুহুস্বরে সে নতুন দিনের আগমন ঘোষনা করছে। মনে পড়ে গেল কমলাকান্তের সেই বিখ্যাত উক্তি,”তুমি বসন্তের কোকিল, শীত, বর্ষার কেহ নও।“ 

তাহলে এতক্ষণ কমলাকান্ত আমাকে যা শুনিয়ে গেল তা কি সবটাই আমার পাণীয়ের কল্যাণে! কিন্তু কমলাকান্তের যুক্তিটা তো একেবারে ফেলনা নয়। 

ফেসবুক আর হোয়াটসয়্যাপ নেশার কল্যাণে সারা জগৎ সত্যি সত্যিই তো আজ ভগবান জুকেরবার্গের পদতলে মাথানত করে দণ্ডায়মান! 

0 comments:

0

প্রবন্ধ - সোমেন দে

Posted in


প্রবন্ধ


কলকাতার মেসবাড়ি এবং বাংলা সাহিত্য 
সোমেন দে 



কলকাতা শহরের বেশিরভাগটাই গড়ে উঠেছে অপরিকল্পিত ভাবে। এ শহরটাতো আসলে একটা করপোরেট হাউসের তৈরি শহর। বলা যেতে পারে দুনিয়ার সব চেয়ে বড় কর্পোরেটের হাউসের তৈরি। যার নাম ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। এ শহরে ব্যাবসা পত্তর ঠিক মতো জমে উঠবে কিনা সে বিষয়ে কোম্পানির কত্তাদের প্রথমদিকে বেশ সংশয় ছিল। জায়গাটা ছিল রীতিমত অস্বাস্থকর। কলেরা ম্যালেরিয়া প্লেগের উৎপাতে সাহেবরা ছিলেন নাজেহাল। তবে শেষ পর্যন্ত সব বাধা সরিয়ে কলকাতা হয়ে দাঁড়ালো মহানগর। এ শহরে মধ্যভাগে সাহেবপাড়ার বাইরে বাকি শহর নিয়ে ইংরেজদের বিশেষ মাথা ব্যাথা ছিলনা। তাই এ শহরে গ্রাম বা মফস্বল থেকে আসা নেটিভদের বসতি গড়ে উঠলো নেহাতই এলোমেলো ভাবে। শহর যখন বাড়তে থাকল তখন ক্রমশ অনেক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের অফিস খুলতে লাগল। খুলল নতুন লতুন স্কুল কলেজ দোকান পাট। সাহেবরা মধ্য কোলকাতাকে তাদের লন্ডনের মতো করে সাজাতে লাগলেন। ডালহৌসি অঞ্চলে গড়ে উঠলো অফিসপাড়া। ফিটন-ছ্যাকরা গাড়ির যায়গায় এলো ঘোড়ায় টানা ট্রাম। গ্যাসের বাতি সরিয়ে এলো বিদ্যুতের আলো। আর উত্তর কলকাতায় ক্রমশ বাঙ্গালিদের বসত বাড়ি গড়ে উঠতে লাগল। সে সব বাড়ির বেশির ভাগের তেমন ছিরি ছাঁদ নেই। এ শহরে শরীরের শিরা উপশিরার মতো ছড়িয়ে গেল কিনু গোয়ালার গলির নানা সংস্করণ। ছোট খাটো রাজারা, রাজার দেওয়ানরা, জমিদাররা, ইংরেজদের বদান্যতাপুষ্ঠ রাজকর্মচারীরা, যুদ্ধের বাজারে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হওয়া ব্যবসায়ীরা এরা সব উত্তর কলকাতায় এখানে ওখানে চক মেলান দালান বাড়ি গড়লেন, আর তার গা ঘেঁষে মধ্যবিত্ত কেরাণীরা গড়লেন এলোমেলো ভাবে ‘একটূকু বাসা’। তার অদুরেই গতর খাটা মজুররা গড়লেন বারো ঘর এক উঠোনের বস্তি। কাজেই এ শহরে কোনো বিশেষ অঞ্চলে অভিজাতদের মৌরসি পাট্টা নেই, আবার গরোবগুর্বোদের একচেটিয়া দখলদারীও নেই। সব আছে মিলেমিশে। তার মধ্যে এক একটা পাড়া গড়ে উঠল। পাড়ার ভিতরে বাড়িগুলোতে থাকত গাড়িবারান্দা, লাল সিমেন্টের মেজে এক ফালি রোয়াক, রট আয়রনের গ্রিল রেলিং, কড়িকাঠ, খড়খড়ি, বৈঠকখানাঘর। সব মিলে এই সব পাড়ায় একটা কোথাও নাগরিক বাঙ্গালিয়ানার জন্ম হলো । 

কলকাতা চিরকালই হা-ঘরেদের জন্যে হাট করে দ্বার খোলা রেখেছে। এ শহরের ভাবখানা - ‘নাহয় হবে, ঘেঁষাঘেঁষি, এমন কিছু নয় সে বেশি, নাহয় কিছু ভারী হবে আমার তরীখান-- তাই বলে কি ফিরবে তুমি আছে, আছে স্থান!’ 

এই উদার ছন্দের ফলে কলকাতার লেন-বাইলেনের বিন্যাস হয়ে গেল অনেকটা প্রাচীন বটগাছের শিকড়ের মতো। একটা বড় রাস্তা থেকে শুরু হয়ে যেখানে যেমন পেরেছে বাঁক নিয়েছে, সরু হয়েছে, চওড়া হয়েছে, তার পর আবার আর একটা বড় রাস্তার হাত ধরেছে। প্রসাধনের ভনিতা নেই। চাকচিক্যের বাহার নেই। 

শহরে ব্যাবসা পত্তর বাড়তেই চাকরির খোঁজে, কলেজ ইউনিভারসিটিতে পড়াশনা করতে গ্রাম থেকে মফস্বল থেকে, আসতে লাগল মধ্যবিত্ত নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষ, দলে দলে। আলাদা বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকার মতো রেস্ত নেই তাদের। প্রয়োজন হলো কম খরচে মাথা গোঁজায় জায়গার। গজিয়ে উঠল মেসবাড়ি নামের সস্তার আস্তানা। শুরু হলো বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা মানুষের একধরণের সম্পর্কহীন যৌথ জীবনযাপন, রক্তের আত্নীয়তাবিহীন একান্নবর্ত্তীতা। এই সব মেসবাড়িগুলো গড়ে উঠল হ্যারিসন রোড, কলেজ স্ট্রিট, মির্জাপুর, আমহার্স্ট স্ট্রিট, শিয়ালদা, মানিকতলা অঞ্চলে। মেসবাড়িগুলোর পরিকল্পনাহীন ভাবে গড়ে উঠলেও সেগুলোর মোটামুটি একটা ধরণ ছিল। দুই বা তিন তলা, বারো চোদ্দ কামরার বাড়ি। মেজে লাল সিমেন্টের, কড়িকাঠের সিলিং। খড়খড়ি লাগানো জানলা। বেশ মোটা কাঠের সদর দরজা দিয়ে ঢুকলে সামনে এক ফালি উঠোন। তার একদিকে মেসের ম্যানেজরের ঘর, অন্য কোনায় রান্নাঘর আর পাত পেড়ে খাবার জায়গা। তারই একদিকে কলতলা, সারাদিন বাড়িতে আলোর চেয়ের অন্ধকারের দখল বেশি থাকে। ম্যানেজার থাকলেও বোর্ডারদের আসল তত্বাবধানের দায়িত্বে থাকত একজন পরিচারক এবং একজন পরিচারিকা। 

বোর্ডাররা হতেন মূলত সদাগরী অফিসের কনিষ্ঠ কেরানী, খুচরো ব্যাবসায়ী, উকিল, মুহুরি, ফেরিওয়ালা, ইন্সুরেন্সের দালাল, ছাত্র, শিক্ষক, অধ্যাপক এবং চাকরীসন্ধানরত বেকার। এ ছাড়া আরও কিছু মানুষ থাকতেন, যারা কিছু বিশেষ স্বপ্ন বুকে নিয়ে মহানগরে এসেছেন, একদিন বিখ্যাত অভিনেতা, গায়ক, শিল্পী কবি বা লেখক হবেন। অনিশ্চিত জীবন। মেসবাড়ির সামান্য ভাড়াও মাঝে মাঝে বাকি পড়ে যায়। দিনের পর দিনে চেষ্টা চালিয়ে যেতে যেতে কেও অবশেষে খুঁজে পেতেন পায়ের তলার মাটি, কেওবা রণে ভঙ্গ দিয়ে তা ফিরে যেতেন আবার দেশবাড়িতে। 

বাঙ্গালির সৌভাগ্য আমাদের সাহিত্যের অনেক উজ্বল ব্যাক্তিত্যর প্রতিভার আঁতুড়ঘর এই মেসবাড়ি। সৌভাগ্য এই জন্যে এই মেসবাড়ির জীবন থেকে পাওয়া অভিজ্ঞতা হয়ত কোনোভাবে সম্বৃদ্ধ করেছে তাঁদের। 

শরৎচন্দ্রের ‘দেবদাস’ উপন্যাসের পটভুমি বিংশ শতাব্দীর প্রথমের দিকে। সাহিত্য হিসাবে ‘দেবদাস’ যে উচ্চমানের হয় নি সে কথা শরৎচন্দ্রের নিজেরই অভিমত ছিল। কিন্তু তা সত্বেও এ দেশে বাঙ্গলার বাইরে অন্য প্রদেশে ‘দেবদাস’ শরৎবাবুর সবচেয়ে পরিচিত উপন্যাস। সেটা অবশ্যই চলচ্চিত্রের কল্যানে। উপন্যাসে তালসোনাপুর গ্রামের জমিদারপুত্র যখন গ্রাম ছেড়ে কলকাতায় এলেন প্রথমে উঠেছিলেন মামার বাড়িতে। তার পরে মামাবাড়ি ছেড়ে একটি মেসবাড়িতে গিয়ে পড়লেন। সেই মেসবাড়িতে দেবদাসের পাশের ঘরেই থাকতেন চুনিলাল। যে কিনা ‘আজ নয় বৎসর হইতে বাস করিয়া আসিতেছেন। তাঁহার এই দীর্ঘ কলিকাতা বাস বি এ পাস করিবার জন্য অতিবাহিত হইয়াছে – ‘আজও তিনি সফলকাম হইতে পারেন নাই বলিয়া এখনো এইখানেই তাঁহাকে থাকিতে হইয়াছে’। অর্থাৎ ধরে নেওয়া যেতে পারে সেই সময় মেসবাড়ি কলকাতায় ভালো ভাবেই প্রচলিত হয়ে গেছে। 

এই চুনিলালের সঙ্গে দেখা হওয়াই দেবদাসের জীবনের টারনিং পয়েন্ট। এখান থেকেই হয় দেবদাসের জীবনের যত কিছু ‘স্থলন পতন ত্রুটি’র শুরু। কলকাতার মেসবাড়ির বোর্ডার থেকে ভারতবিখ্যাত হয়ে যাওয়া মাতাল আইকনটিকে চলচ্চিত্রে বিভিন্নভাবে ফুটিয়ে তোলবার চেষ্টা করেছেন – প্রমথেশ বড়ূয়া, দিলীপকুমার, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, প্রষেনজিৎ, শাহরুখ খান এবং আরো অনেকে। 

দেবদাসের স্রষ্টা শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নিজেও কিছুদিন কলকাতায় মেসবাড়িতে বসবাস করেছিলেন। সে বাড়িটির ঠিকানা ছিল ২৭ নং বাদুড় বাগান লেন। সুকিয়া স্ট্রিটের বাই লেন। এই বাড়িতেই বাস করেছিলেন প্রখ্যাত কবি এবং সাহিত্য সমালোচক মোহিতলাল মজুমদার। মোহিতলাল কাচড়াপাড়া থেকে কলকাতায় রিপন কলেজে ভর্তি হন। তাঁর কবিতায় প্রথম দিকে রবীন্দ্রনাথের প্রচুর প্রভাব থাকলেও পরে তিনি লেখার অভিমুখ পরিবর্তন করেন। তিনি কাজি নজরুলেরও আগে বাংলা কবিতায় উর্দু এবং ফার্সি শব্দ প্রয়োগ করেছিলেন। সেই সময় তাঁর কবিতায় দেহাশ্রয়ী প্রেমের আভাষ এনেছিলেন বলে আধুনিক কবিদের দ্বারা বন্দিত এবং রক্ষনশীলদের কাছে নিন্দিত হন। পরে অবশ্য মোহতলাল সাহিত্য সমালোচক হিসেবেই বেশি খ্যাতিলাভ করেন। এই মেসবাড়িতেই থাকতেন আরও এক কবি এবং সমালোচক সজনীকান্ত দাস। তিনি অবশ্য শনিবারের চিঠির সম্পাদক হিসাবেই বেশি বিখ্যাত। বর্ধমানের প্রত্যন্ত গ্রামের থেকে যান বেনারসে ইঙ্গিনিয়ারিং পড়তে। সে পড়া মাঝপথে ছেড়ে দিয়ে চলে আসেন কলকাতায়। সম্ভবত সাহিত্যের টানেই। শনিবারের চিঠিতে প্রথমের লেখক ও পরে সম্পাদক হন। মোহিতলাল তাঁর বেশির ভাগ লেখা দিতেন শনিবারের চিঠিতেই। হয়ত এই বাদুড় বাগানের মেসেই দুজনে মিলে বসে হতো তুমুল সাহিত্যচর্চা। এবং তার ফসল বাংলা সাহিত্যের সম্পদ হয়ে আছে। 

দেবদাসের পরে বাংলার বাইরে বাংলা সাহিত্যের সব চেয়ে পরিচিত চরিত্র সত্যান্বেষী ব্যোমকেশ। ব্যোমকেশের সব গল্পই অজিতের বয়ানে লেখা। কিন্তু এই অজিতের সঙ্গে ব্যোমকেশের দেখা হ্যারিসন রোডের এক মেসবাড়িতে। ব্যোমকেশ সিরিজের প্রথম গল্প সত্যান্বেষীতে একই মেসে থাকতে এসে অজিতের সঙ্গে ব্যোমকেশের পরিচয়। অজিতের সেই প্রথমদেখা ব্যোমকেশের একটি অতি সংক্ষিপ্ত বিবরণ ছিল - বয়স বোধকরি তেইশ-চব্বিশ হইবে, দেখিলে শিক্ষিত ভদ্রলোক বলিয়া মনে হয়। গায়ের রঙ ফরসা, বেশ সুশ্রী সুগঠিত চেহারা-মুখে চোখে বুদ্ধির একটা ছাপ আছে। 

এই চরিত্র সৃষ্টির সময় লেখকের নিশ্চয় পরবর্তী কালে ব্যোমকেশের কালজয়ী হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনার কথা সুদূর কল্পনাতে ছিল না। কিন্তু অনেক কটা যুগ পেরিয়ে ব্যোমকেশ বিখ্যাত হয়েছেন সিরিয়াল এবং সিনেমার কল্যানে। ঈদানীং তো ব্যোমকেশকে নিয়ে সিনেমা করার রীতিমত হুড়োহুড়ি পড়ে গেছে। বলা যেতে পারে এই ব্যোমকেশও মেসবাড়ির দান। 

পরে অবশ্য ব্যোমকেশ মেসবাড়ি ছেড়ে উঠে যান কেয়াতলা রোডে নিজের বাড়িতে। 

ব্যোমকেশের স্রষ্টা শরদিন্দু বন্দোপাধ্যায় নিজেও এক সময় থাকতেন ৬৬ নং হ্যারিসন রোডের প্রেসিডেন্সি বোর্ডিং হাউস নামের মেস বাড়িতে। এখান থেকেই পেয়েছেন ব্যোমকেশ সৃষ্টির প্রেরণা। 

এই বাড়িতেই একসময় থাকতেন জীবনানন্দ দাশ। ১৯২২ সালে যখন সিটি কলেজে ইংরেজী শিক্ষকের চাকরি পান তখন তিনি থাকতেন এই বোর্ডিং-এ। মেসবাড়ির ঘর তাঁর অনেক রচনার আঁতুড়ঘর। তাঁর রোজনামচায় এবং বেশ কিছু গল্প উপন্যাসে এই মেস-জীবনের উল্লেখ আছে। 

পরে অবশ্য তিনি যখন স্ত্রীকে কলকাতায় নিয়ে আসেন, তখন বাসা নেন রাসবিহারী মোড়ের কাছে ল্যান্সডাউন রোডের একটি গলিতে। 

বাংলা সাহিত্যের আর একটি অতি জনপ্রিয় চরিত্র প্রেমেন্দ্র মিত্রের অনবদ্য সৃষ্টি ঘনাদা। তিনিও থাকতেন মেসবাড়িতে। তাঁর পুরো নাম ঘনশ্যাম দাশ। ঘনাদার কথায় ইয়োরোপের লোকে চেনে ‘ডস’ বলে। মেসের সদস্যরা তাকে ডাকত ঘনাদা বলে। ঘনাদা জমিয়ে যে গল্প ফাঁদেন তা বাঙ্গালির ট্রেড মার্ক গুল মারা হলেও সে সব গল্পের ভিত্তিতে আছে কল্প-বিজ্ঞান, আছে ভুগোল, আছে ইতিহাস। এ সব গল্প শুধু বাগাড়ম্বর নয়। গল্পের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে আছে ঘনাদার পাণ্ডিত্য, প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব, আর উদ্ভাবনী শক্তির পরিচয়। বাংলা সাহিত্যে ঘনাদার আবির্ভাব ঘটে ১৯৪৫ সালে। দেবসাহিত্য কুটির থেকে প্রতি বছর একটি করে ছোটোদের জন্যে পুজাসংখ্যা বেরোতো। প্রতি বছর সে পত্রিকার একটি নতুন নাম দেওয়া হতো। সে বছর নাম ছিল আলপনা। গল্পের নাম ছিল মশা। 

প্রথম গল্পেই জানা গেছল ঘনাদা একটি মেসের চিলেকোঠায় থাকেন। ঘনাদা ধুমপায়ী, ভোজনবিলাসী, স্বভাবে কিঞ্চিৎ আয়েসী, চেহারা লম্বা, গায়ের রঙ কালো। এই মেসবাড়িতে থাকেন চার বাসিন্দা শিবু শিশির গৌর আর ঘনাদার গল্পের কথক সুধীর। 

প্রথম গল্পে এই মেসবাড়ির ঠিকানা না জানা যায়নি। তাঁর ষষ্ঠ গপ্ল ‘টুপি’তে জানা যায় সে মেসবাড়ির ঠিকানা ৭২ নং বনমালী লস্কর লেন। 

তবে মেসবাড়িকে যিনি সবচেয়ে মহিমান্বিত করেছেন তিনি হচ্ছেন শিবরাম চক্রবর্তী। বাংলাসাহিত্যের একজন প্রখ্যাত লেখক হওয়া সত্বেও তিনি তাঁর সারা জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন উত্তর কোলকাতার একটি মেসে। মুক্তারাম বাবু স্ট্রীটের সেই মেসবাড়িটি প্রায় তাঁরই মতো বিখ্যাত হয়ে গেছে। কারণ তাঁর অদ্ভুত জীবনযাপনের যে গল্প তিনি আমাদের শুনিয়েছেন তাতে এই মেসবাড়িটি একটি বিশেষ চরিত্র। 

তাঁর জীবন থেকে নেওয়া এসব গল্প এই সময়ে দাঁড়িয়ে পড়লে শিব্রাম চরিত্রটিকে একটি বাস্তব চরিত্র বলে মনে হয় না। সরস গল্প লিখে মানুষকে হাসানো এক ব্যাপার, কিন্তু নিজের জীবনযাপনের পরতে পরতে এমন নির্লিপ্ত নির্মল পরিহাসের অনুপান ভরে দেওয়া বড় কঠিন কাজ। একটা আতস কাঁচ দিয়ে তার উদ্ভট সব কান্ড কারখানা ভালো করে দেখার চেষ্টা করলে মনে হয় যেন তিনি এক শুধু রসিক মানুষ নন, কোথাও একটা বেশ তেজী বিদ্রোহী ছিলেন। হাস্যরসের আড়ালে বোধ হয় তাঁর ছিল স্বভাবে বাঙালি মধ্যবিত্ত জীবনযাপনের প্রচলিত ছকটিকে তামাশা করার এক অভিনব স্পর্ধা। সফলতাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে, উচ্চাশাকে মুখ ভেংচিয়ে, এক আশ্চর্য নিরাসক্ত ভাবে এই মেসবাড়ির ঘরের ‘মুক্ত আরামে’, ছারপোকা পোষিত ‘তক্তারামে’ শুয়ে শুয়ে, দিনের পর দিন শুক্তারাম খেয়ে তিনি নট-নড়ন-চড়ন হয়ে কাটিয়ে দিয়েছেন অনেকটা জীবন ১৩৪ নং মুক্তারাম বাবু স্ট্রিটের মেসবাড়ির দোতলার একটি ঘরে। যখন তাঁর বেশ নামডাক হয়েছে, তিনি এ বাড়ি ছেড়ে যেতেই পারতেন। কিন্তু তাঁর কথায় – এখান থেকে নড়বেন কি করে, কলকাতায় তাঁর কোনো যাবার জায়াগাই ছিল না, যেতে গেলে তো সেই যেখান থেকে উঠে এসেছেন সেখানেই গিয়ে জুটতে হতো – সেই সাবেক সাকিন ফুটপাত। 

কেমন ছিল এই মেসবাড়ির ঘরটি? 

একবার কয়েকজন বন্ধু এসেছেন তাঁর মেসবাড়ির ঘরে তার সঙ্গে দেখা করতে, ঘরে ঢোকার আগে তাঁরা বাইরে জুতো খুলে ঘরে ঢুকেছেন দেখে শিবরাম বললেন – ও তোমাদের দামী জুতোতে ময়লা লেগে যাবে এই ভয়ে বুঝি জূতো খুলে এলে? 

আর একবার এক সাংবাদিক এসেছেন তাঁর কাছে, ঘরে প্রচুর জঞ্জাল দেখে একটু ইতস্তত করছেন দেখে শিবরাম তাকে বললেন – পায়ে নোংরা লেগে থাকলে মুছে নিন না আমার বিছানায়! হতভম্ব সাংবাদিক প্রশ্ন করলেন বিছানায় মুছবো? নির্বিকার শিবরাম বললেন – বিছানায় মানে ওই চাদরের নিচে একটা কম্বল আছে না, ওটাতেই মুছে নিন, আমিও তাই করি, চাদরটা চাকনচিকন থাকলেই হলো, চাদরের নিচে আর কে দেখতে যাচ্ছে! 

সেই ঘরের দেওয়ালে পেনসিলে লেখা অজস্র টেলিফোন নম্বর আর ঠিকানা লেখা। তাই বাড়িওয়ালাকে কিছুতেই চুনকাম করতে দিতেন না। কয়েকদিন আগে একটি খবরের কাগজে দেখলাম সেই ঘরটির দেওয়ালে নাকি এখনও তাঁর লেখা কিছু টেলিফোন নম্বর রয়ে গেছে।

বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের নাম উঠলে বাঙালি পাঠক অবধারিত ভাবে ঘাটশিলা নামটি জুড়ে দেন। আর জুড়ে দেন ইছামতী-লবটুলিয়া-ঘেঁটু-আকন্দ-পুঁইমাচা-গাংশালিক-নিশ্চিন্দিপুর। আমাদের মনে হয় যেন শহর কলকাতার সঙ্গে তাঁর তেমন পরিচয় গড়ে ওঠেনি। শহর সন্মন্ধে তিনি উদাসীন। কিন্তু তা বোধহয় পুরোপুরি সত্যি নয়। তিনি যে জীবনের মধ্যে দিয়ে গেছেন সেখান থেকেই কিছু খুঁজে নিয়েছেব লেখার উপাদান। জীবনের উপান্তে তিনি যখন মাঝে মাঝে ঘাটশিলায় থাকতেন তখন তাঁর টানে টানে অনেক লেখকই মাঝে মাঝে সেখানে গিয়ে হাজির হতেন। ১৯৫০ সালে পুজোর সময় ঘাটশিলায় রাজবাড়িতে তাঁকে একটি সম্বর্ধনা দেওয়া হয়েছিল। সেই সভায় কলকাতা থেকে গিয়েছিলেন প্রমথ বিশী, প্রবোধ স্যান্যাল মশাই এবং আরো অনেকে। তাঁকে দেওয়া সম্বর্ধনার উত্তরে বলবার সময় বিভুতিবাবু বলেছিলেন তরুণ বয়সে কলকাতায় মেসে তিনি বেশ কিছুদিন কাটিয়েছিলেন। সেই মেসের বোর্ডাররা সবাই প্রায় চাকুরীজীবী ছিলেন। তাই সকাল দশটায় সবাই অফিসে চলে যেতেন। আর বিভুতিভূষণ এই সময়ে ফাঁকা মেসবাড়িতে বসে গোগ্রাসে গিলতেন বটতলার উপন্যাস। তিনি বলেছিলেন এই সময়কার স্মৃতি তাঁকে পরবর্তী জীবনে লেখার উপাদান জুগিয়েছে। মেসবাড়িটি সম্ভবত ছিল মির্জাপুর স্ট্রিটে। 

যেহেতু সাহিত্যে মেসবাড়ির প্রভাব পড়েছে, আর সিনেমা এককালে সাহিত্যের হাত ধরে চলত তাই বেশ কিছু সিনেমাতেও এসেছে মেসবাড়ি। 

এর মধ্যে যে সিনেমাটি সময়ের দলিল হয়ে মেসবাড়ির জীবনের অম্লমধুর প্রতিচ্ছবি তুলে ধরে রেখেছে আগামীকালের বাঙ্গালির জন্যে তার নাম ‘সাড়ে চুয়াত্তর’। তিন চার প্রজন্ম পেরিয়ে যে জুটির জন্যে আজও বাঙালি মোহাবিষ্ট সেই উত্তম-সুচিত্রা প্রথম বার জুটি বাঁধার ঘটনাটি ঘটানোর জন্যে এই সিনেমাটি ইতিহাস হয়ে আছে। তবে সেই সঙ্গে কলকাতার হারিয়ে যাওয়া সমস্ত মেসবাড়ির প্রতিনিধি ‘অন্নপুর্না বোর্ডিং হাউস’কে সেলুলয়েডে ধরে রাখার জন্যেও ছবিটির অসীম মূল্য আছে। এ ছাড়া সপ্তপদী থেকে বসন্তবিলাপ অনেক ছবিতেই এসেছে মেসবাড়ি। এসেছে হিন্দিতে বিমল রায়ের পরিচালনায় কিশোরকুমার অভিনীত নৌকরী ছবিতে। শক্তি সামন্তের অমর প্রেম ছবিতে। 

কলকাতার নাগরিক জীবন বদলে গেছে সময়ের দাবী মানতে মানতে। উত্তর কলকাতার অলিগলির চেহারা হয়ত বিশেষ পালটায়নি। পুরোনো কিছু মেসবাড়ি আজও টিকে থাকলেও থাকতে পারে। তবে সেখান থেকে লেখক শিল্পী উঠে আসবেন এমন সম্ভাবনা বিলীন হয়ে গেছে। শুধু লেখক বা কবি হবার জন্যে নিবেদিত প্রাণ সেই সব রোমান্টিক মানুষেরা এখন আর নেই। এখনকার সাহিত্যযশপ্রার্থীরা অনেক বাস্তববাদী। মেসবাড়ির ক্লিষ্ট জীবন থেকে গল্প কবিতার উপাদান খোঁজার মতো ভুল তারা করেন না। 

ছাত্রছাত্রীদের জন্যে, অন্যপ্রদেশ থেকে আসা চাকুরেদের জন্যে কলকাতায় এখন চালু হয়েছে একধরণের ‘পিজি’ ব্যাবস্থা। মেসবাড়ি শব্দটিতে মেসের সঙ্গে বাড়ি শব্দ জুড়ে দেওয়ার পিছনে একটা অঘোষিত কারণ ছিল। এই মেসবাড়ির ভাবনায় কোথাও একটা বাড়ির বিকল্প হয়ে ওঠার চেষ্টা ছিল। পিজিতে সে চেষ্টা নেই। ওখানে নেহাতই ঘর শেয়ার করা, আর কিছু শেয়ার করা নয়। তাই ওখান থেকে কোন গল্প তৈরি হয় না।

0 comments:

0

বইপোকার বইঘর - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in


বইপোকার বইঘর
অনিন্দিতা মণ্ডল




নাস্তিক পণ্ডিতের ভিটা 
লেখক – সন্মাত্রানন্দ 
প্রকাশক – ধানসিঁড়ি 
মূল্য – ৪৫০/-

বইয়ের প্রচ্ছদে এক সিল্যুয়েটে আঁকা একজন মানুষ। নীচে লেখা অতীশ দীপঙ্করের পৃথিবী। একজন অনুসন্ধিৎসু পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করতে এটুকুই যথেষ্ট। আমরা বাঙালিরা বিস্মৃতি ভালোবাসি বোধ হয়। আমাদের সহজেই ভুলিয়ে দেওয়া চলে বাঙালির উত্তরাধিকার একসময় সারা পৃথিবীতে শান্তিদীপ জ্বেলেছিল। যে কজন বাঙালিকে নিয়ে এখনও আমরা গর্ব বোধ করতে পারি তাদের মধ্যে একজন অতীশ। হয়ত তিনিই অগ্রগণ্য। বিবিসির সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালির তালিকায় তাঁর নাম জ্বলজ্বল করছে। হাজার বছর পরেও। স্বাভাবিক ভাবেই আমি বইটি হাতে নিয়ে ভেবেছিলাম এটি অতীশের জীবন কাহিনী। ৩৫৬ পৃষ্ঠায় বিস্তৃত তাঁর জীবন পড়বার আগ্রহ আমাকে এমনই ছুটিয়ে নিয়েছিল যে আমি নাওয়া খাওয়া ভুলে বইটিতে ডুবে গেলাম। মনে প্রশ্ন জাগতে পারে যে, মাত্র তো ৩৫৬ পৃষ্ঠা! তাই পড়ে ফেলতে এহেন পরিশ্রম ও সময় কেন লাগবে? হ্যাঁ, লাগবে। কারণ বইটি প্রথমত একটি গবেষণা গ্রন্থ। কি নেই সে গবেষণায়! হাজার বছর আগের বাংলা তথা পূর্ব ভারত, তিব্বত, এবং বৌদ্ধ ধর্মের দর্শন ও তন্ত্রযানের অনালোকিত প্রদেশে আলোকপাত। সেই সময়ের রাজনৈতিক সামাজিক ও ধর্মের দ্বন্দের নিপুণ চিত্র। কিন্তু লেখক তাঁর লব্ধ জ্ঞানের প্রমাণ দিতেই বইটি রচনা করেননি! এ বইতে তিনটি সময়সরণি পাশাপাশি চলেছে। কখনও কখনও তাদের দেখা হয়েছে যখন সমান্তরাল চলন ছেড়ে তারা একে অপরের যাত্রাপথে এসে পরেছে। আর সেই সব মুহূর্তে এমন আলো ছড়িয়েছে কাহিনীতে যা অতীন্দ্রিয় বলতেই ইচ্ছে করে। অতীশ ছাড়াও কাহিনীতে বাকি দুই সময় সরণির দুটি নায়ক আছেন। তাঁরাও কম চিত্তাকর্ষক নন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এটি অতীশেরই কাহিনী। সেই দীপঙ্করশ্রী জ্ঞানের কাহিনী, যিনি এখনও আমাদের আলো দেখাতে পারেন। বইটির বিষয়বস্তুর গভীরে নিয়ে যাওয়া আমার উদ্দেশ্য নয়। এ বই দ্রুতপঠনের জন্য নয়। এটি প্রণয়কাব্যও বটে। বজ্রডাকিনী স্বয়ংবিদা লেখকের কল্পনা। ইতিহাসের চরিত্র নন। কিন্তু সেই সময়ে এমন বিদুষী ও সিদ্ধা নারী ছিলেন বলেই আমরা জানি। তাই কাহিনীর মধ্যে তাঁর উপস্থিতি একটি অন্য মাত্রা এনেছে। সর্বোপরি, অতীশের তথাকথিত বীরাচার সাধনার বিপ্রতীপে বাৎসল্য আমাকে মুগ্ধ করেছে। বইটি অবশ্য সংগ্রহযোগ্য। এ বইয়ের আলোচনা বিদগ্ধ পাঠক আরও ভালো করবেন বলে আমি মনে করি। আপাতত আমি বাংলার সেই গৌরবময় যুগে নিঃশ্বাস নিয়ে চলেছি। কারণ, শেষ পর্যন্ত অতীশের অন্বেষার মূলে কাঠ নয় ধাতু নয় প্রস্তর নয়, মানুষের জীবন্ত মূর্তি। লেখক মনে করেন সেই অর্থে আমরা প্রত্যেকেই অতীশ। অতীশের উত্তরাধিকার বহন করি।

0 comments:

0

স্মৃতির সরণী - বিপুল দাস

Posted in


স্মৃতির সরণী


কথামালা
বিপুল দাস



পাহাড়তলিতে ‘অ্যান্টিবায়োটিক’ নামে একটা গল্প লিখেছিলাম। অনেকে এখনও গল্পটার কথা বলে। নিখিলের মতো খুঁতখুঁতে মানুষও বলেছিল – মন্দ হয়নি। ওই গল্পটিই আমার গল্পের জগতে যাত্রার সবুজ সংকেত। ওই গল্পটাই পেছনে লাথ মেরে আমাকে অপার দুঃখের জগতে ঠেলে দিয়েছে। পরে আমি বেশ কিছুদিন নাটক নিয়ে, এবং প্রায় কুড়ি বছর সেতার নিয়ে রগড়েছি। শেষে আবার গল্পের কাছে ফিরে এসে অসহায় আত্মসমর্পণ করেছি। মাঝের সময়টা লেখালেখি করেছি, কিন্তু অনিয়মিত ভাবে। টেনশন ছাড়া। ওভাবে লেখা হয় না। দু”টি অসমতল তলের ঘর্ষণ ছাড়া, সংশয় ছাড়া, নিজেকে সিংকটাপন্ন করে তুলতে না পারলে লেখা যায় না। এ সত্য আমাকে শিখিয়ে দিয়ে গেছেন শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁর কাছে আর সিরাজদার কাছে আমি জীবন ও শিল্প-বিষয়ক অনেক গূঢ় কথা জেনেছি।

আমার বাড়ি শিলিগুড়ি। উত্তরবাংলার এই মফস্‌সল শহরে আমার জন্ম। আমি বড় হয়েছি তিস্তা, তোর্সা, মহানন্দা। করতোয়ার ভিজে বাতাসে। নদীপারে কাশবনের দোলা আর উত্তরে তাকালেই দা গ্রেট হিমালয়ান রেঞ্জ। পাহাড় পরিষ্কার থাকলেই ভোরে দেখতে পাই কাঞ্চনজঙ্ঘার শুভ্র মুকুটে একরকম লাল, আবার বিকেল গড়ালে সেখানে কেমন দুখি লাল। আমার অস্তিত্ত্বের সঙ্গে জড়িয়ে আছে মইষাল বন্ধুর গান, চা-বাগানের কুলি-লাইনের গল্প, বৈকুণ্ঠপুর ফরেস্টের আর মহানন্দা স্যাংচুয়ারির গাঢ় সবুজ গন্ধ। উত্তরের দারুণ বর্ষা আর কনকনে শীত। শালশিমুলজারুলখয়েরের ছায়ায় আমার বড় হয়ে ওঠা। মানুষের চৈতন্যে অবিরত রেকর্ডিং হতে থাকে ছড়ানো-ছেটানো এই সব উপাদান। সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে শুষে নেওয়া এই সব উপকরণ যেন একটা আর্কাইভে জমা হতে থাকে। বস্তুত, প্রায় তখনই ঠিক হয়ে সে কী লিখবে, কাদের নিয়ে লিখবে। এই কারণেই আমার গল্পে বারে বারে তিস্তা নদী এসেছে, কাঠমাফিয়াদের কথা এসেছে, ভাওয়াইয়া ও রাজবংশীদের কথা এসেছে। বহুদিন আগে দেখা ডুয়ার্সের বাসে একজন ভুটিয়া রমণীর নাকে সোনার নথের ঝিকমিক মগ্ন-চৈতন্যে নিহিত থাকে। ধুপগুড়ির রোদ্দুর আর ওই নথের ঝিলিক নিয়ে একটা গল্প তৈরি হয় আমার মগজে। স্কুলে পড়ার সময় পিকনিক করতে গিয়ে সেভোকে করোনেশন ব্রিজের ওপর থেকে একমুঠো পাহাড়ি ঝাউপাতা ফেলে দিয়েছিলাম তিস্তার জলে। এই নদী বাংলাদেশে জলে গেছে। এখন বয়স যখন হেলে পড়েছে অড সাইডে, একটা গল্প তৈরি হতে চায়, যার নাম হতে পারে – মনোয়ারা বেগমের প্রতি শুভেচ্ছা।

ষাটের দশক চলছে। পাহাড়তলির শহর শিলিগুড়ি তখন নেহাতই এক অর্বাচীন শহর। বড়সড় একটা গঞ্জ থেকে ক্রমশ শহর হয়ে উঠছে। নাগরিক ব্যাধি তখনও তার শরীরে রোগজীবাণু ছড়িয়ে দেয়নি। শহড়জুড়ে নারকেলসুপারি, আমজাম, শিরীষ, দেবদারু গাছ ছড়িয়ে আছে। হাইরাইজ কাকে বলে, প্রোমোটার কাকে বলে, এগ-রোল কিংবা পার্লার কাকে বলে – শিলিগুড়ি জানে না। গ্রামীন সারল্য এবং লাবণ্য ছিল শিলিগুড়ির অন্তর এবং বহিরাবরণে। তখন উত্তরে তাকালেই কাঞ্চনজঙ্ঘা, তখন মহানন্দার জল ছিল সত্যি কাকচক্ষু। ওপর থেকে পরিষ্কার দেখা যেত টলটলে জলের নীচে নুড়িপাথরের গড়িয়ে চলা। পুবে জনপদ শেষ হতে না হতেই শুরু হয়ে যেত বৈকুণ্ঠপুর ফরেস্টের ঘনসবুজ। সেদিক থেকে শহরের দিকে উড়ে আসত টিয়াপাখির ঝাঁক। শহরে বেশির ভাগ বাড়ি ছিল তরাই অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য মেনে কাঠের খুঁটির ওপর মাটি থেকে অন্তত চারফুট উঁচুতে কাঠেরই ঘর। তখনও কাঠা অত আক্রা হয়নি এ শহরে। তখনও রাতে গাড়ির হেড-লাইট নিভিয়ে লোভের ট্রাক চকচকে করাত নিয়ে লুঠ করত না জঙ্গলের শালশিমুলসেগুনশিশুর দীর্ঘ বনস্পতি।

এই সব লাবণ্য, সবুজ ঘ্রাণ, পাহাড়ি নদীর ছন্দ, ছোট শহরের মানুষের আন্তরিক আত্মীয়তার উষ্ণতা ঘিরে রেখেছিল আমাদের। 

মহানগরের দুষ্ট ক্ষতগুলো তখনও শিলিগুড়িকে আক্রমণ করেনি। বাতাস তখনও অনেক পরিষ্কার। শহরে ধুলো কম, অক্সিজেন বেশি। মোমো আসেনি, মিষ্টির দোকানগুলো তখনও বাঙালি ব্যবসায়ীদের হাতে। পরিষ্কার-পরিছন্ন ছোট্ট শহর। ট্রেন চলে না, কিন্তু শহরের মহাধমনি হিলকার্ট রোডের ওপরে তখনও ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়েজের ন্যারোগেজ লাইন পড়ে আছে। পরে সেগুলো তুলে ফেলা হবে। নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন হব-হব করছে। পুরনো টাউন স্টেশনের যৌবন ঢলে পড়লেও তার চ্ছটা রয়েছে। তখনও উত্তরে তাকালে শহরের মানুষ দেখতে পায় কাঞ্চনজঙ্ঘায় রক্তরাগ। বিধান মার্কেট সবে শুরু, হংকং মার্কেট চালু হয়নি। অশ্রুকুমার সিকদারের নাম বিরল-উচ্চারিত। আমরা নবোত্থিত-শ্মশ্রু সদ্য-তরুণ কিছু যুবা বয়সের দোষে দু’ছত্তর কবিতা লিখে ফেলেছি। বুদ্ধদেব বসু, সুধীন দত্ত, জীবনানন্দের তিন ছত্তর পড়েও ফেলেছি। অশ্রু সিকদারের নাম অস্পষ্ট কানে আসছে। কে একজন বলল –অশ্রুবাবুর দাঁত দেখা যায় না। আমার বিশ্বাস হয়নি। কোনও মানুষ কখনই হাসেন না, তাই আবার হয় নাকি। পরে সাক্ষাৎ পরীক্ষায় প্রমাণিত হয় যে, উক্ত ধারণা হাইপোথেসিস মাত্র। আমরা ক’জন বন্ধু বেশ কয়েক বার দূর থেকে সৌম্য, শান্ত, একটু ওজনদার চাউনির ধবধবে ধুতিপাঞ্জাবিপরিহিত অধ্যাপককে দূর থেকে দেখে শিহরিত, মনে হয়েছিল একেই বলে অধ্যাপক। আর, বাংলা সাহিত্যের এ রকম একজন ওস্তাদ আমাদের শহরে থাকেন, এটা যেন বিশ্বাসই হচ্ছিল না। মাঝে মাঝেই বাবুপাড়ায় তাঁর বাড়ির সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় আমাদের মনে হতো কিছু একটা রেডিয়েশন বোধহয় আমাদেরও স্পর্শ করে গেল।

টাউন স্টেশনের ওভারব্রিজ থেকে রোজ একটা দু’টো তক্তা কমে যায়। আমরা রেল-ক্যান্টিনে আড্ডা মারতে মারতে পরিকল্পনা করি স্যারের বাড়িতে একদিন দেখা করতে যাব। আলোচনা এর বেশি আর এগোয় না। এদিকে টাউন স্টেশনে কুলি কমে যাচ্ছে, এন জে পি-তে বাড়ছে। শহরে পুরনো লোক কমে যাচ্ছে, আনকো লোক বাড়ছে। হঠাৎ একদিন দেখি প্ল্যাটফর্মে শীর্ষেন্দু মুখোপাধায়। আমরা পাকামি মেরে গিয়ে আলাপ করে জানতে চাইলাম তিনি গল্পটার নাম –‘টিকটিকিরা জল খায় না কেন’ রাখলেন কেন। কী যেন একটা সাদামাটা উত্তর দিয়েছিলেন, যেটা আমদের হতাশ করেছিল। আমরা আশা করেছিলাম উনি অস্তিত্ত্ব-অনস্তিত্ত্ব বিষয়ক কোনও ভারি তত্ত্বের কথা বলবেন। একদিন সাইকেল নিয়ে তিন বন্ধু সেবকে বেড়াতে যাওয়ার পথে দেখলাম পথের দু’পাশের গাছপালা সব সাফ। হু হু করে বাড়ছে জমির দাম। হং কং মার্কেটে নতুন ধরনের হাওয়াই চটি এসে গেল। আমি সাইন্সের ছেলে, কালদোষে কবিতা লিখি। একদিন সাহস করে বাংলার অধ্যাপক অশ্রু সিকদারকে ঘেমে নেয়ে তার ক্লাস-লেকচার শোনার পারমিশন চাইলাম। তখন ইউনিয়ন ছাত্রদের ফুসকুড়ি বা ঘামাচির ব্যাপারে খবর্দারি করত না। স্যার আমাকে অনুমতি দিলে আমি, মনে আছে, লাইব্রেরি নীচে এগারো নাম্বার রুমে তাঁর ক্লাস করেছিলাম। বাংলা অনার্সের স্টুডেন্টের সঙ্গে।

সেই ক্লাসই আমাকে নেশা ধরিয়ে দিয়েছিল। ক্রমে স্যারের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং প্রমাণিত হয় যে, অশ্রুকুমার সিকদারেরও দাঁত দেখা যায়। কিন্তু আমার একটু আপশোষ থেকে যায়, যে এই গুজব ছড়িয়েছিল, তাকে ব্যাপারটা দেখাতে না পারার জন্য।

উটকো লোকে শহর ভরে যাচ্ছিল। শহরে কাঠের খুঁটির ওপরে পুরনো স্টাইলের বাড়ি কমে যাচ্ছিল। চারতলা, পাঁচতলা বাড়ি দেখা যাচ্ছিল। শিলিগুড়ি কলেজ ক্রমশ আয়তনবান হয়ে উঠছে। কথা নেই বার্তা নেই, হঠাৎ তিলক ময়দান হয়ে গেল কাঞ্চনজঙ্ঘা ক্রীড়াঙ্গন। বাঙালিদের মিষ্টির দোকান কমছে, অবাঙালিদের মিষ্টির দোকান বাড়ছে। অশ্রুকুমার সিকদার শিলিগুড়ি কলেজ ছেড়ে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে গেলেন। আমি তখনও গল্প লিখতে শুরু করিনি। কবিতা লিখছি। অনেকগুলো একসঙ্গে স্যারকে দেখিয়ে আনছি। স্যার অবশ্য সরাসরি বলছেন না – কিস্‌সু হয়নি, মুখে উৎসাহ দিচ্ছেন এবং নিজের সংগ্রহ থেকে কবিতার বই দিচ্ছেন পড়ার জন্য। পরে অবশ্য জানতে পেরেছিলাম তিনি নাকি আমার কবিতার প্রশংসা করেছেন। বন্ধুদের সেদিন ক্যান্টিনে চায়ের সঙ্গে ভেজিটেবল্‌ চপ খাইয়েছিলাম। সাইকেল চালিয়ে যখন স্টেশন ফিডার রোড ধরে বাড়ি ফিরছি, মনে হ’ল কানের পাশে সুড়সুড়ি লাগছে। হাত দিয়ে দেখলাম ঘাড়ের রোঁয়াগুলো।

মাঝে মাঝে এক আধটা লিটল্‌ ম্যাগাজিন হাতে আসে। আমরা ক’জন গোগ্রাসে গিলি। কলকাতায় গেলে ম্যাগাজিন আর কবিতার বই কিনে আনি। শহর খুব দ্রুত বদলে যাচ্ছিল। যতটা ভৌগোলিক এবং জনসংখ্যা ও তাদের বিচিত্র বৈশিষ্ট্যে, ততটা সাংস্কৃতিক ভাবে নয়। একটি, দু’টি ম্যাগাজিন বেরোয় বটে, কিন্তু এত বেশি মফস্‌সলি গন্ধমাখা, আধুনিকতা থেকে অনেক দূরে সেই পত্রিকা আমাদের বিরক্ত করত। ইতিমধ্যে পড়ে ফেলেছি বুদ্ধদেব বসু, অমিয় চক্রবর্তী, বিষ্ণু দে, সুধীন দত্ত। আমাদের বন্ধু নিখিল বসু বলল বিনয় মজুমদার না পড়লে আধুনিক কবিতা বোঝা যাবে না। নিখিল আমাদের সর্দার। সে সত্তর দশকের প্রথমেই কলকাতায় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠের ডাক পেতে শুরু করেছিল। আমাদের আধুনিক করে তোলার কঠিন সংকল্প করেছিল। ‘ফিরে এসো চাকা’ জোগাড় করলাম। প্রকাশক মীনাক্ষী দত্ত, মূল্য তিনটাকা। কালো রং-এর প্রচ্ছদে কবির মুখাবয়ব। বইটা হাতে নিয়ে কেমন যেন গা শিরশির করে উঠল। “ রোমাঞ্চ কি র’য়ে গেছে; গ্রামে অন্ধকারে ঘুম ভেঙে/ দেহের উপর দিয়ে শীতল সাপের চলা বুঝে/ যে-রোমাঞ্চ নেমে এলো, রুদ্ধশ্বাস স্বেদে ভিজে ভিজে।/ সর্পিণী, বোঝোনি তুমি, দেহ কিনা, কার দেহ, প্রাণ”। আমি, গীতাংশু আর নিখিল তর্কে মেতে উঠি কাব্যের অন্তর্গত চিরকালীন সৌন্দর্য ও মৃত্যুর তুলনামূলক আলোচনায়। শেষে ঠিক হয় অশ্রুদা ছাড়া এ শহরে আর দ্বিতীয় কেউ নেই, যাঁর কাছে যাওয়া যেতে পারে। এর আগে একবার এ রকম হয়েছিল একটি পংক্তি পড়ে – একটি কথার দ্বিধা থরো থরো চূড়ে/ ভর করে আছে সাতটি অমরাবতী। শব্দ ও বাক্যের অন্তর্গত ব্যঞ্জনা, ভারসাম্য, ছন্দের চতুরালি, একটি গূঢ় কথার উড়াল বুঝতে পেরে বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে যাই। এত গোপন ভার বহন করে কবিতা।

এর মাঝে একদিন অশ্রুদা আমাকে উপহার দিলেন শঙ্খ ঘোষের ‘নিহিত পাতালছায়া’। পড়ে আমি ভোঁ হয়ে গেলাম। কী আলতো অথচ অমোঘ উচ্চারণ। এতকাল যা পড়ে এসেছি, মায় জীবনানন্দ, এ একদম আলাদা। “ ... অসীম ছড়ায় শূন্যে শঠ/ প্রতি মুহূর্তের কণ্ঠ ছিঁড়ে নেয় অন্ধকারে পর্বতকন্দরে মহাকাল/ কারণবিহীন এক মহাপরিণাম ভেসে চলে যায় গভীর সাগরে”। আরও চাই, শঙ্খ ঘোষের আরও বই চাই। যা পেরেছি, জোগাড় করেছি। রাত জেগে কবিতা পড়ি। ডাইরির পৃষ্ঠায় আপনমনে লিখি – তোমার নিজের হাতে ভিক্ষা নিতে এত ভালো লাগে। প্রিয় কবির লাইন। ‘নিজের’ ও ‘ভিক্ষা’ শব্দদুটির নিচে পেন দিয়ে দাগ দিলাম। এক ধরণের ভয় করে উঠল হঠাৎ। আচমকাই আমি বুঝতে পারে শব্দ তার নিজের তৈরি বেড়া ভেঙে কীভাবে সামান্য ভরটুকু শক্তিতে রূপান্তরিত করে নিচ্ছে। মনে হয় আকাশে সহস্র সূর্য ঝল্‌সে উঠল বুঝি। ব্যাঙের ছাতার মত মেঘ। কীভাবে যে একটা দুটো শব্দ তীব্র তড়িৎগ্রস্ত কালো মেঘের মত আকাশে ফেটে পড়ে, কবি ছাড়া আর কেউ বুঝি তার নাগাল পায় না। উৎসারিত মারণরশ্মি ধেয়ে আসে চৈতন্যের দিকে। বিপন্ন বিস্ময়ে কবি দেখতে পায় ব্যক্তিগত আবরণ কেমন করে গলে যায়, খসে পড়ে লৌকিক চামড়া। দগদগে পোড়া ঘা-এর যন্ত্রণায় মানুষ মনে করে হেমলক, একগাছা দড়ি অথবা ধাবমান ট্রামের সামনে আছে ম্যাজিক-মলম।আমাদের শহর বদলে যাচ্ছিল। গাছ কমছিল, হোটেল বাড়ছিল। একটু বেশি রাতে হিলকার্ট রোডের আলো-আঁধারিতে দাঁড়িয়ে থাকে উগ্র সাজে রোগা রোগা মেয়েরা। মহানন্দার জল আরও কালো হয়ে যাচ্ছে। গাড়িধোয়া তেলমবিল, শহরের সব আবিলতা, চা-বাগান গড়িয়ে-আসা বিষ নিয়ে আমাদের শহরের নদী ক্রমে মরে যাচ্ছিল। আমাদের শহরের সব গাছ, তরাই-ডুয়ার্সের গন্ধ, আমাদের নদী – সব চুরি হয়ে যাচ্ছিল। আর আমাদের ভাবনাচিন্তার বদল ঘটে যাচ্ছিল আধুনিক কবিতার দিগ্বলয়ের পরিধি বরাবর। যখনই কোনও সংশয় আসে, মমতাজ আলির রেল-ক্যান্টিনে বসে আমাদের তুমুল তর্ক শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত সেই অশ্রুদার বাড়িতে যাওয়া সাব্যস্ত হয়। ততদিনে আমরা জেনে গেছি অধ্যাপক অশ্রুকুমার সিকদারের আপাতগম্ভীর আবরণের আড়ালে দিব্যি একজন স্বাভাবিক ভালোমানুষ রয়েছেন। এই বিশাল পণ্ডিত মানুষটির সামনে আমাদের আর তখন কোনও সংকোচ ছিল না।

0 comments:

0

প্রাচীন কথা - ঋতুপর্ণা চক্রবর্তী

Posted in


প্রাচীন কথা


মিথ-কথন
ঋতুপর্ণা চক্রবর্তী



গ্রীক পুরাণের বিভিন্ন গল্পে নানা জনপ্রিয় এবং তুলনামূলক কম জনপ্রিয় কিছু চরিত্র বারবার উঠে এসেছে। এই গল্পগুলি জানার জন্য এই চরিত্রগুলির সম্পর্কে একটু ধারণা থাকা দরকারী। আগামী কিছু পর্বে আমরা গ্রীক পুরাণ নিয়ে কথা বলব। এখানে মূলতঃ পুরাণের বিভিন্ন চরিত্রের পরিচয় এবং তাঁদের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে একটু আলোচনা করা হল।

অন্যান্য অপ্রধান দেবদেবীরা 

এই পর্বে কিছু দেবদেবীকে নিয়ে আলোচনা করা হলো যারা অলিম্পাসের প্রধান বারোর মতো শক্তিশালী না হলেও বিভিন্ন মিথে বহুল চর্চিত। এঁরা সকলেই যে অলিম্পাসে থাকেন তা নয়, এঁরা অন্যান্য অনেক জায়গাতেই থাকেন। কেউ কেউ আবার জিউস এবং হেরার সন্তান হয়েও অলিম্পাসের প্রধান বারোর মতো বিখ্যাত নন। সেইরকমই কিছু দেবদেবীকে নিয়ে এবারের পর্বটি। 

ইরিস (Eris) - ইনি জিউস এবং হেরার কন্যা, এরিসের বোন এবং খুব প্রিয় বন্ধু। ইনি ঝগড়াঝাঁটি, রাগারাগি, কথাকাটাকাটি, মতের অমিল ইত্যাদির দেবী। এরিস যদি যুদ্ধের দেবতা হন, ইনি তাহলে সেই যুদ্ধের কারণ। কারণ যুদ্ধের কারণ হিসাবে যে মতের অমিল হয়, সেই মতের অমিল এঁর জন্যেই হয়ে থাকে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, এজিনার (Aegina) রাজা ইয়াকাসের (Aeacus) সুপুত্র মহাবীর পেলেউস (Peleus) আর সমুদ্রের পরী থেটিসের (Thetis) বিবাহ অনুষ্ঠানে (এই থেটিস এবং পেলেউস হলেন মহাবীর আকিলিসের মাতা ও পিতা) সকল দেবদেবীকে নিমন্ত্রণ জানানো হলেও এঁকে জানানো হয়নি। ইরিস নিজেই সেই অনুষ্ঠানে হাজির হন বিনা নিমন্ত্রণেই। তাঁকে ঢোকার অনুমতি দেওয়া হয়নি বলে তিনি এক সোনার আপেল ছুঁড়ে ফেলে বলেন, সবথেকে সুন্দরী এই আপেল পাবে। তিনজন দেবী সেই আপেল নিয়ে মতান্তর শুরু করেন, এথেনা, অ্যাফ্রোদিতি এবং হেরা। এই মতান্তর থেকেই বিখ্যাত ট্রয়ের যুদ্ধের কার্যকারণ শুরু হয়। 

হেবে (Hebe) - হেবে বা হেবি জিউস এবং হেরার কন্যা ছিলেন, কিন্তু সেরকম বিশেষ কোনো দেবী ছিলেন না। এক মতে তিনি যৌবনের দেবী। তিনি অলিম্পাস দেবতাদের আমব্রোসিয়া (Ambrosia) নামক খাদ্য এবং নেকটর (Nectar) নামক স্বর্গীয় পানীয় পরিবেশন করেন। এছাড়াও তিনি অ্যাফ্রোদিতির সহচরী ছিলেন। বিখ্যাত গ্রীক হিরো হারকিউলিস এঁকে স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করেন, এবং সেইজন্যেই সম্ভবত এঁর মা হেরা এবং হারকিউলিসের আবার সুসম্পর্ক স্থাপিত হয়। 

নাইকি বা নাইক (Nike) - এখন একটি বিশেষ স্পোর্টসু হিসাবে পরিচিতি পেলেও আদতে ইনি গ্রীসের জয়ের দেবী। সাধারণ খেলাধুলা বা যুদ্ধ যাই হোক না কেন নাইকি যে দলে থাকবেন সেই দলই জিতবে। এঁর মা হলেন আন্ডারওয়ার্ল্ডের নদী স্টিকস (Styx)। কথিত আছে, স্টিকস যখন টাইট্যানোম্যাকির সময়ে জিউসের দলে যোগ দেন, তখন তিনি তাঁর চার পুত্রকন্যাকেও নিয়ে আসেন। তাঁরা চারজনেও জিউসের হয়েই যুদ্ধ করেন। তাঁরা হলেন, নাইকি অর্থাৎ জয়, যেলোস অর্থাৎ প্রতিযোগিতা (Zelus) , ক্র্যাটোস (Cratus) অর্থাৎ শক্তি আর বায়া (Bia) অর্থাৎ বলপ্রয়োগ। নাইকি জিউসের সারথি এবং চারজন ভাইবোন একত্রে হলেন জিউসের প্রধান রক্ষী। 

আইরিস (Iris) - আইরিস হলেন রামধনুর দেবী এবং দেবতাদের সংবাদপ্রেরক। তিনি মূলতঃ হেরার সাহায্যকারিনী এবং ব্যক্তিগত সংবাদপ্রেরিকা। তাঁর পিতা থোমাস (Thaumas) একজন সমুদ্রদেবতা ছিলেন, এবং মা একজন মেঘপরী। সেইজন্যেই সকল রামধনুকে মেঘ থেকে সমুদ্র অবধি বিস্তারিত হতে দেখা যায়। এঁকে নিয়ে আলাদা করে কোনো মিথোলজির গল্প নেই। তবে অনেক গল্পেই এঁকে বিভিন্ন সংবাদ বহনকারী হিসাবে দেখা যায়। এঁর সাথে পশ্চিমের বায়ুর দেবতা যেফাইরাসের (Zephyrus) বিবাহ হয়েছে। 

ফেমে (Pheme) - কথাটা চেনা চেনা লাগছে না? এই দেবীর থেকেই আমরা পেয়েছি সেই বিখ্যাত শব্দ ফেম বা খ্যাতি, যার নেশায় চিরকালই অনেক মানুষ মেতে উঠেছেন। ইনি স্বাভাবিক ভাবেই খ্যাতির দেবী। আর তার সাথে যে দুটো জিনিস খুব সহজেলভ্য সেই গুজব (Gossip) এবং উচ্চাশার দেবীও ইনি। ইনি গায়া (মতান্তরে আশা) -র সন্তান। ইনি নাকি সমস্ত ঘটনাকে ততক্ষণ অবধি পরচর্চা পরনিন্দা করতে থাকেন, যতক্ষণ না সেই ঘটনাটা সবাই শুনে ফেলে আলোচনা শুরু করছেন। বর্তমানে থাকলে কোনো না কোনো সংবাদমাধ্যমে এঁর চাকরি পাকা ছিল। ইনি কিন্তু অলিম্পাসে থাকেন না, পৃথিবী এঁর বাসভুমি। 

এসক্লেপিয়াস (Asclepius) - ইনি অ্যাপোলোর একজন সন্তান এবং হিরো বা অর্ধদেব অর্ধমানুষ হলেও পরে প্রোমোশন পেয়ে ইনি হলেন চিকিৎসার দেবতা। ওদের ধন্বন্তরি বলা যায়। এঁর সাপ জড়ানো দন্ডটি এখনকার ডাক্তারদের চিহ্ন। এঁকে যারা সাহায্য করে, তাদের থেরাপিউটি (Therapeutae) বলা হয়। এঁর অনেকগুলি সন্তান আছে, যেমন হাইজিয়া, আইয়াসো, অ্যাসেসো, এগলিয়া এবং প্যানাকিয়া। হাইজিয়া (Hygieia) হলেন পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার দেবী। আইয়াসো (Iaso) হলেন স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের দেবী। অ্যাসেসো (Aceso) নিরাময় পদ্ধতির দেবী। এগলিয়া (Aglæa) সুস্বাস্থ্যের দেবী। প্যানাকিয়া (Panacea) হলেন ওষুধের দেবী।

তবে গ্রীসে যখন সবকিছুরই দেবতা আছে তখন এদেরও বিপ্রতীপ অপদেবতাও বর্তমান থাকবেন। তাঁরা হলেন নোসোই(Nosoi), অর্থাৎ অসুখের অপদেবীরা। এঁরা সংখ্যায় অনেক ছিলেন। 


প্যানের মতো গুরুত্বপুর্ণ দেবতার কথা এখানে বলতেই হয়। প্যান (Pan) হলেন পশুপালক, রাখাল এবং শিকারীদের দেবতা। খোলা মাঠ, বনজঙ্গল, পার্বত্য উপত্যকা হলো এঁর চারণক্ষেত্র। এঁর অনুপস্থিতিতে রাখাল আর শিকারীদের মধ্যে কি সৃষ্টি হতো বলুন তো? ঠিকই ধরেছেন! প্যানিক শব্দটি এখান থেকেই এসেছে। আর্কেডিয়া প্রদেশে বিরাট মাঠ ছিল, সেখানেই প্যান ঘুরে বেড়াতেন। আর্কেডিয়া (Arkadia) শব্দটি থেকেই একর কথাটি এসেছে। প্যান জঙ্গুলে পরী বা নিম্ফদের খুব পছন্দ করতেন এবং তাঁদের ধরার জন্য তাড়া করে বেড়াতেন। এরকম একজন নিম্ফ পিটিস (Pitis) কে তিনি খুব প্রণয় নিবেদন করেছিলেন, কিন্তু সে অস্বীকার করায় তাকে শাস্তিস্বরূপ পাইনগাছে পরিণত করেন। আরেকজন নিম্ফ, তার নাম সাইরিঙ্গস (Syrinx) সেও তাঁকে প্রত্যাখ্যান করায় রিড (Reed) বা নলখাগড়া জাতীয় গাছে পরিণত করেছিলেন। সেই রিড থেকে অবশ্য তিনি এক বাঁশি তৈরি করেন, সেই বাঁশিকে প্যানপাইপ (Panpipe) বলা হয়। মন খারাপ হলে তিনি একা একা সেই বাঁশি বাজিয়ে বেড়ান। আরেকজন নিম্ফ, তাঁর নাম ইকো (Echo)। সেও তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেছিল তাই তিনি শুধুমাত্র তার আওয়াজ ছাড়া বাকি সবকিছু মিলিয়ে যেতে আদেশ দেন। সেই থেকে ইকো বা প্রতিধ্বনি শুধুমাত্র আওয়াজ হয়েই রয়ে গেছে। 
এইসব বিবরণ পড়লে প্যানকে বেশ খারাপ বলে মনে হয়, কিন্তু প্যান আদতে খারাপ নন, তাঁর প্রণয় নিবেদনের ধারাটাই অমনতর । অন্যান্য দেবতাদের থেকে প্যানকে বেশ অন্যরকম দেখতে। তাঁর মাথায় শিং আছে, তাঁর পা ছাগলের মতো এবং একটি লেজও আছে। শুধু তাই নয় তাঁর নাকও জীবজন্তুদের মতো চ্যাপ্টা এবং কান কৌণিক। তাঁকে অনেক সময়ই ডায়নিউসের সাথে দেখা যায়। প্যান হারমিস এবং পেনেলোপির সন্তান। 

ইয়স (Eos) - ইয়স হলেন ভোরের দেবী। প্রাচীন সুর্য্যদেবতা হেলিওস এবং চন্দ্রদেবী সেলেন হলেন এঁর ভাইবোন। ইনি প্রাচীন দেবী হলেও পরবর্তী যুগেও চলে এসেছেন। ইয়সের নাকি গোলাপফুলের মতো সুন্দর আঙুল আছে। তিনি এক সময়ে যুদ্ধদেবতা এরিসের প্রেমে পড়েছিলেন এবং তাঁর অঙ্কশায়িনী হন। সেইজন্য এরিসের প্রেমিকা অ্যাফ্রোদিতি তাঁকে অভিশাপ দিয়েছিলেন যে তিনি সর্বদা সুদর্শন যুবকদের প্রেমে পড়বেন, কিন্তু কোনো সম্পর্কেই টিকে থাকতে পারবেন না। তাঁর প্রেমিকপ্রবরদের মধ্যে অনেকেই আছেন, ওরিওন (Orion) নামে এক সুদর্শন দৈত্য ছিলেন, তিনি তাঁর পিতা পোসেইডনের আশির্বাদে জলের উপরে চলার ক্ষমতা পান। ইয়স তাঁকে দেখেই প্রেমে পড়েন, কিন্তু অভিশাপের ফলে এই সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। আরেকজন ছিলেন ফেথন (Phaethon)। এক মতে তিনি তারাদের একজন ছোটখাট দেবতা। আরেক মতে তিনি সূর্যদেবতা হেলিওসের পুত্র। একদিন হেলিওসের কাছে বায়না ধরে তিনি সূর্যের রথ চালানোর অনুমতি যোগাড় করেন। তিনি এই গুরুদায়িত্ব পালন করতে পারেননি খুব একটা সেইজন্যই এক এক সময়ে তিনি মাটির খুব কাছাকাছি নেমে এসেছিলেন। এমনকি আফ্রিকায় তিনি নাকি মাটির এত কাছে এসে পড়েছিলেন যে সূর্যের তাপে সব পুড়ে গিয়ে সাহারা মরুভুমির সৃষ্টি হয়, সেই মরুভুমি এখনো বর্তমান। এইসব দেখে ধরিত্রীমাতা গায়া জিউসকে নালিশ করেন। জিউস এক বজ্রের আঘাতে ফেথনকে মৃত্যুদণ্ড দেন। এই ফেথনও ইয়সের প্রেমিক ছিলেন কিছু সময়ের জন্য। এরপর টিথোনোস (Tithonus) নামে একজন ট্রোজান রাজপুত্রকে ইয়সের পছন্দ হয়। তাঁর সাথেই সারা জীবন কাটাবেন বলে মনস্থির করেন। কিন্তু ইয়স অনন্ত যৌবনের অধিকারী হলেও টিথোনোস তা নন। তাই দেবরাজ জিউসের কাছে তিনি টিথোনোসের অমরত্বের জন্য দরবার করেন। কিন্তু দেবী ভুলে গেছিলেন অমরত্ব আর অনন্ত যৌবন এক জিনিস নয়। ফলে টিথোনোস অমরত্ব পেলেও অনন্ত যৌবন পাননি। অতিবৃদ্ধ হওয়ার পর তিনি একটি ফড়িংএ রূপান্তরিত হন। 

ইয়সের সন্তানরাই হলেন বিভিন্ন বায়ুর দেবতা। চারজন গ্রীক বায়ুদেবতার হদিশ পাওয়া যায়। এঁদের একত্রে অ্যানেমোই (Anemoi) বলে। এঁরা হলেন বোরিয়াস (Boreas), উত্তুরে বাতাস ও শীতের দেবতা; নোটাস (Notus), দক্ষিণের বাতাসের দেবতা; যেফাইরাস (Zephyrus) পশ্চিমা বায়ুর দেবতা আর ইউরস (Euros), পূর্বের হাওয়া দেবতা, যাকে অপয়া মনে করা হতো।

হারমোনি (Harmonia) - অ্যাফ্রোদিতি অর্থাৎ প্রেমের দেবী এবং যুদ্ধের দেবতা এরিসের সন্তান হলেন হারমোনি। ইনি হলেন আগে বর্ণিত ইরিসের বিপ্রতীপরূপ। ইনি সব ঝগড়া ভুলে আবার মিলেমিশে এক হওয়ার দেবী। ইরিসের ঠিক উল্টোটি। থিবস নগরীর প্রতিষ্ঠাতা এবং রাজা ক্যাডমাসের (Kadmos) সাথে তাঁর বিবাহ হয়। এই বিবাহে তিনি একটি নেকলেস উপহার পান। কে যে এই নেকলেস উপহার দিয়েছিলেন সেটা নিয়ে প্রচুর মতান্তর আছেন, কেউ বলেন জিউস, কেউ ইউরোপা ( Europa, ক্রীটের রানী) কেউ বলেছেন হেপাস্টাস এবং কেউ বলেন এফ্রোদিতি, কেউ হেরা। বহুল প্রচলিত মতটি হল, হারমোনি যেহেতু এরিস এবং অ্যাফ্রোদিতির প্রেমের প্রমাণ, সেইজন্য হেপাস্টাস তাঁর স্ত্রী এর উপর রাগ করেই এই নেকলেসটি উপহার দিয়েছিলেন। দুইখানি সাপ যেন একে অপরের লেজ খেয়ে ফেলছে এইরকমই দেখতে ছিল এই নেকলেসটি। এই নেকলেসটি ছিল অপয়া। যে এই নেকলেসটি ধারণ করেছেন তিনিই নানারকম দুর্ভোগে পড়েছেন। হারমোনির (আরেক নাম অবশ্য হারমায়নি, চেনা লাগছে?) আর ক্যাডমাস দুজনেই সাপ বা ড্রাগনে পরিণত হন পরে, তখন নেকলেসটি তাঁদের কন্যার হাতে এসে পড়ে। এরপরে বিভিন্ন হাত ঘুরে এই নেকলেস এসে পড়ে আকারনান (Acarnan) এঁর হাতে, তিনিও এর দুর্ভোগ কিছু ভোগার পর নেকলেসটি ডেলফির এথেনার মন্দিরে দান করে নিশ্চিন্ত হন। কিন্তু তারপরেই এথেনার মন্দিরে ডাকাতি হয়। ফ্যালাস (Phayllus) নামে এক স্বৈরাচারী মন্দির থেকে নেকলেসটি নিয়ে তাঁর প্রেমাস্পদাকে দেন। সেই প্রেমাস্পদা কয়েকদিন এই নেকলেসটি পরে ছিলেন। অবশেষে তাঁর কনিষ্ঠ সন্তানটি পাগল হয়ে যায় এবং বাড়িতে আগুনে লাগিয়ে দেয়, সেই আগুনে ওই নারী এবং তাঁর পরিবারের সকলেই নেকলেস এবং অন্যান্য সম্পত্তিশুদ্ধ পুড়ে ছাই হয়ে যান। 

এম্ফেট্রিট (Amphitrite) - জিউসের ভ্রাতা সমুদ্রের দেবতা পোসেইডনের স্ত্রী হলেন এম্ফেট্রিট। তিনিও সমুদ্রের দেবী। তিনি পঞ্চাশজন নার্নিয়াড বা সমুদ্রপরীদের সবথেকে বড় বোন এবং মাছ, ডলফিন এবং সীলমাছদের জননী। কথিত আছে পোসেইডন যখন তাঁকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন, তিনি ভেবেছিলেন এই গুরুদায়িত্ব তাঁর পক্ষে পালন করা কঠিন হতে পারে, তাই তিনি পালিয়ে গিয়ে পৃথিবীর শেষপ্রান্তে এটলাসের কাছে গিয়ে লুকিয়ে ছিলেন। ডলফিনদের দেবতা ডেলফিন গিয়ে তাঁকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে রাজী করে ফেরত নিয়ে আসেন। গ্রীক সাহিত্যে এবং আঁকায় একে অল্পবয়সী নারী হিসাবে দেখানো হয়েছে। কখনো কখনো তিনি হাতে মাছ ধরে আছেন। হিপ্পোকম্পোই বা সমুদ্রঘোড়া যাদের লেজ মাছের মতো তাঁদের টানা রথে চেপে তিনি পোসেইডনের সাথে ভ্রমণ করেন। 
ট্রাইটন (Triton) - পোসেইডন এবং এম্ফেট্রিট অর্থাৎ সমুদ্রের দেবতা এবং দেবীর সন্তান হলেন ট্রাইটন। একজন মারম্যানের মতো দেখতে তাঁকে, অর্থাৎ তাঁর উর্ধাঙ্গ মানুষের মতো হলেও অর্ধাঙ্গ মাছের মতো। আমরা যাকে মৎস্যকন্যা বলি তারই পুরুষরূপ আর কি। তাঁর কাঁধের উপর সমুদ্রঝিনুক থাকে অনেক। পোসেইডনের মতো তাঁরও একটা ত্রিশূল আছে। আর আছে এক বিরাট শঙ্খ। সেই শঙ্খ দিয়ে তিনি সমুদ্রের উত্তাল ঢেউগুলিকে শান্ত করেন, বা দরকারে শান্ত সমুদ্রে উত্তাল ঢেউয়ের সৃষ্টি করেন। এছাড়াও শঙ্খটিকে তিনি যখন অত্যন্ত জোরে বাজান তখন নাকি দৈত্যরাও আওয়াজে ভয় পেয়ে পালিয়ে যায়। 

অলিম্পাসের প্রধান বারো ছাড়াও এই দেবদেবীরাও প্রচুর গল্পে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে রয়েছেন। 



মিথকথনের প্রথম পর্ব এখানেই শেষ হলো।

0 comments: