ধারাবাহিক - সুজিত নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়
Posted in ধারাবাহিক
ধারাবাহিক
সুজিত নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়
Diary Entry - 23
9 October, 1942, Friday
প্রিয় কিটী,
আজ একটা খারাপ খবর পেলাম। পাওয়ার পর থেকেই মনটা অন্ধকার আর ভারাক্রান্তিতে গুমোট হওয়া গেল। যতটুকু আনন্দ আর প্রফুল্লতা ছিল, সেটুকুও খরবটার বিষণ্ণতা যেন শুষে নিয়ে চলে গেল। আমাদের জন্যে রেখে গেল, শুধুই হতাশা আর বিশীর্ণতা। কিছুদিন ধরেই শুনছিলাম, ডজন ডজন ইহুদি উদ্বাস্তুকে জোর করে উদ্বাস্তু শিবিরে ঠেলে পাঠানো হচ্ছে। ঠিক যেমন করে খোঁয়াড়ে রাস্তার কুকুর ছাগল বিড়ালকে ঠেলে পাঠানো হয়। আজ শুনলাম, তাদের মধ্যে আমাদের বহু ঘনিষ্ঠ, পরিচিত, এমন কি আমার অনেক বন্ধুও আছে, যাদের সঙ্গে আমি একদিন খেলাধুলা করেছি। তাদেরকে নিয়ে যাওয়ার সময় যে ব্যবহার তাদের সঙ্গে গেষ্টাপো বাহিনী করছে, তার মধ্যে কোন শিষ্টতার বালাই আছে বলে মনে হয় না। অবশ্য আশাও করা যায় না। প্রায় পশুর মতো ব্যবহার তাদের সঙ্গে করা হচ্ছে। পশুর মতোই বা’ বলব কেন? গবাদি পশু বা রাস্তার বেওয়ারিশ পশুকে যেমনভাবে ট্রেন ওয়াগানের মধ্যে ঠেসেঠুসে ভরে নিয়ে যাওয়া হয়, সেই রকমভাবেই ওদেরকে ওয়াগানের মধ্যে ভরে ঠেসেঠুসে পশুর মতো করে ভরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে । বিশেষভাবে নজর রাখা হচ্ছে, যাতে ওয়াগানের মধ্যে কোনও আলগা জায়গা বা ফাঁকা জায়গা লোকাভাবে পড়ে না থাকে। ওয়াগানগুলোর চারদিক না’কি ঢাকা, বাইরের আলো যেন না ঢুকতে পারে তার যথাযথ ববস্থা করেই তবে এই সব বে-ফালতু ইহুদিগুলোকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। রেলপথে ওয়েসস্টারবুর্ককের (Westerbork) দ্রেঁতে (Drente) উদ্বাস্তু শিবিরে নিয়ে গিয়ে, না’কি তাদের “যত্ন” করে রাখা হচ্ছে। ইহুদি উদ্বাস্তুদের কাছে এই মুহূর্তে ওয়েস্টারবুর্ককের দ্রেঁতে উদ্বাস্তু শিবির একটি দুঃস্বপ্নের বাসস্থান। ভাবতে পার, প্রায় একশ জন পিছু একটা বড় জোর দুটো স্নানের জায়গা, আর মাত্র কয়েকটা বাথরুম। প্রয়োজনের তুলনায় অথবা, বলা ভাল, ভদ্রভাবে বাঁচার পক্ষে, যা নিতান্তই কম বললেও বেশী বলা হবে। এ’ভাবেও যে থাকা যায়, সেটা বোধহয় ভাবা যায় না, কিংবা যারা ওখানে ভাগ্যের দোষে গিয়ে পৌছিয়েছে, তারা কোনওদিন ভাবতে পারেনি। স্বপ্নের চেয়েও নির্মম কোনও নরক যে থাকতে পারে, এটা ওরা বুঝলো বোধহয় ওখানে পৌঁছে। তার আগে নয়। কিন্তু ওরা আছে, কারণ ওদের ও’ভাবেই রাখা হয়েছে। ওদের কাছে থাকার কেন, কিছু বলারও, কোন বিকল্প নেই। এ’রকম একটা জায়গায় পৃথক জায়গা আশা করাই গর্হিত কাজ বলে বিবেচিত হবে। এমন কি’ কেউ যদি ভাবার চেষ্টাও করে, তা’হলে তার জন্যে শাস্তিও জুটতে পারে। তাই ওরা স্বাভাবিকভাবে না’হলেও, বাস্তব অবস্থায় দাঁড়িয়ে মেনে নিয়েছে, কারুর জন্যে পৃথক কোন থাকার জায়গার প্রয়োজন নেই বলেই কর্তৃপক্ষ সেই ব্যবস্থা দরকার বোধ করেনি। ছেলে মেয়ে, যুবক যুবতী, স্ত্রী পুরুষ, সবাই একসাথে একটা বড় ক্যাম্প বা ডরমেটরীর মতো জায়গায় ছোট ছোট চৌকীতে শোওয়া বসা সব কিছু করছে। কেউ কখনও শুনেছ, সভ্যতার এই ভয়ংকর মানবের দানবীয় কীর্তির কথা? এক সাথে পুরুষ স্ত্রী, যুবক যুবতী থাকার কি অবশ্যম্ভাবী ফলাফল জান? ওখানে যারা কিছুকাল একসাথে আছে বা থাকতে বাধ্য হয়েছে, তাদের মধ্যে অনেক মহিলা, অনেক যুবতী ইতিমধ্যেই মাতৃত্বের জন্যে দিন গুনতে শুরু করেছে। এদের অনেকেই জানে না, তাদের ভবিষ্যৎ সন্তানের পিতার হদিশ। তারা মনেও করে না, এটা জানার বিশেষ কোনও দরকার আছে। কারণ সন্তান হয়ত জন্ম নেবে জৈব ক্ষুধার সাময়িক তৃপ্তি হিসাবে। জন্মের পরে সে’ও ক্ষুধার্ত হয়ে উঠবে, বেঁচে থাকার শেষ শক্তিটাকে টিকিয়ে রাখার জন্যেই সে শুধু ব্যস্ত হয়ে উঠবে।
জান, ইচ্ছা করলেও এখানকার বন্দী ইহুদিরা শিকল ছিঁড়ে পালাতে পারবে না, তাদের আমৃত্যু উদ্বাস্তু হয়েই থাকতে হবে। তাদের মধ্যে কেউ যদি কোনভাবে পালিয়েও যায়, তা’হলে সভ্য নগর তাকে আবার চিহ্নিত করে ফেলবে ‘পালিয়ে আসা’ উদ্বাস্তু হিসাবে। এমনিতে তাদের যাওয়ার সব সম্ভাব্য পথ বন্ধ, কোন পাহারায় নয়, কাঁটাতারের বেড়ায়। তারও বাইরে মাননীয় কর্তৃপক্ষ তাদের ওপর পরীক্ষামূলকভাবে উদ্বাস্তুর বিভিন্ন চিহ্ন এঁকে দিয়েছে। যেমন, নারী পুরুষ নির্বিশেষে সকলের মাথার চুল কেটে স্থায়ীভাবে নেড়া করে দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে আবার কেউ কেউ আছেন, যাদের দেখলেই ইহুদি হিসাবে চিনে ফেলা যায়। তাই কোনওভাবেই তাদের কার্যত শিবির ছেড়ে পালানোর কোন সম্ভাবনা নেই। সবথেকে বড় কথা, তাদের শীর্ণতা, তাদের হতাশাগ্রস্থ মুখ-চোখ এ’সবই বলে দেবে, তারা ইহুদি, তারা মানুষ নয়, মানুষের মাঝে তারা উদ্বাস্তু। আর তাই তারা শিবির ছেড়ে পালিয়ে এসেছে।
একদিন আমরা ইহুদিরা জার্মান থেকে নাৎসি সেনার তাড়া খেয়ে, সভ্য হল্যান্ডে উদ্বাস্তু হয়ে চলে আসতে বাধ্য হয়েছিলাম । আমরা চেয়েছিলাম ন্যুনতম অধিকার নিয়ে উদ্বাস্তু হয়ে বেঁচে থাকতে । আজ আমরা আমাদের সেইদিনের কাজের বা প্রত্যাশার ফল হাতেনাতে পাচ্ছি । এর চেয়ে ভাল ছিল সভ্যতার তাড়া খেয়ে তারা যদি কোন সুদূর অসভ্য বর্বর জায়গায় তাদের মতো করে থাকার মানসিকতা নিয়ে চলে যেত বা পালিয়ে যেত, তা’হলে অন্ততঃ বর্বরতার “সভ্যতাকে” নিয়ে তারা বাঁচার নিশ্চয়তা জোগাড় করে ফেলতে পারত । তাদের যদি কর্তৃপক্ষ ঘৃণা করেও সে’রকম একটা জায়গায় পাঠিয়ে দিত, তা’হলে তারা “অসভ্যতা নগ্ন আলোকে সভ্যতার বিড়ম্বনাকে দেখতে পেত ।“ এখন তারা যেখানে আছে, সেখানে কি সত্যিই অসভ্যতা আর বর্বরতার সঙ্গে দাম্ভিক ক্ষমতাবানের সভ্যতার কোন পার্থক্য কিছু আছে ? তা’ছাড়া বর্তমানের সভ্যতার উদ্বাস্তু শিবিরের সঙ্গে সেই কল্পিত বর্বরতার পার্থক্যের দুরত্বের কি আর ফল তাদের জীবনে দেখা যেত ? আমাদের এখনও ওখানে নিয়ে যাওয়া হয় নি, অথবা যাওয়ার ভাগ্য (??) হয় নি । বিভিন্ন জায়গা বা সূত্র থেকে পাওয়া খবরা-খবর থেকে, আমাদের মনে হয়, ওখানে যাদের নিয়ে যাওয়ার কথা বলা হচ্ছে, তাদের মধ্যে অনেককেই ইতিমধ্যে খুন করা হয়েছে । আর যাদের এখনও খুন করা হয় নি, তারা বোধহয় আর সভ্য অবস্থায় অবস্থান করছে না । জীবন তাদের এক জান্তব্য জীবন দিয়েছে । তাদের ভিতরের একটা মানুষ ছিল, সেটা ইতিমধ্যেই মারা গেছে, আমরা শুধু দেখতে পাচ্ছি না । যারা দৈহিকভাবে মারা গেছে, তাদের খবর ইংল্যান্ডের বেতারে ঘোষনা করছে, যাদেরকে অসুস্থতার নাম করে “ইচ্ছা মৃত্যুর” অধিকার দিয়ে গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে মৃত্যুর শেষ পরোয়ানায় সাক্ষর করে দেওয়া হয়েছে । তাদের কথা বেতার কর্তৃপক্ষ হয়তঃ জানে, কিন্তু পৃথিবীর কোন জীবিত মানুষই তাদের আসল অবস্থানের কথা জানে না ।
সম্ভবতঃ এইভাবেই মৃত্যুকে দ্রুত করা সম্ভব । নিজেকে ভীষণ বিধস্ত লাগছে । মিয়েপ ( ডাইরির ৯ নম্বর এন্ট্রিতে মিয়েপ গীসের পরিচয় উল্লেখ করা হয়েছে --- অনুবাদক ) যখন আমায় এই সমস্ত গল্পগুলো বলছিল, তখন, বিশ্বাস কর, আমি আমার চোখের জল ধরে রাখতে পারি নি । ইহুদিদের এই অমানবিক কষ্ট, ইহুদি হিসাবে আমি বুঝতে না পারলে, আর কে পারবে? ভাবছিলাম ঈশ্বর কি ওদের মানুষ করে পাঠায় নি, শুধুই ইহুদি করে পাঠিয়েছিল । আর তাই তাদের নিজের “অ-সাক্ষরিত ইচ্ছা মৃত্যু পরোয়ানায়” তাদের জীবনের ত্রাতা হিসাবে অন্য কেউ সাক্ষর করে দিল । আর তারা তাতেই মৃত্যু বরণ করল । ওদের তুলনায় আমি ত’ প্রাসাদে আছি । মানবিকতার বিরুদ্ধে এই ভয়ঙ্কর ঘটনাগুলো মিয়েপকেও সমানভাবে আঘাত যে করেছে, সেটা ওর কণ্ঠস্বর থেকেই বোঝা যাচ্ছিল । মিয়েপের কাছেই শুনেছিলাম আরও একটা ভয়ঙ্কর ঘটনার কথা । মাত্র কয়েকদিন আগে, মিয়েপ দেখে তার দরজার ঝনকাঠে এক ইহুদি বৃদ্ধা ম্লান ভয়ার্ত মুখে বসে আছে । বসে থাকার কারণ জিজ্ঞাসা করাতে ত্র্যস্ত ভয়ার্ত স্বরে সেই ইহুদি বৃদ্ধা মিয়েপকে একটু নিচু স্বরে জানায়, জার্মানির গেস্টাপো বাহিনী তাকে ওখানে বসতে কিছুক্ষণ আগে বলে গেছে ।ওকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে তারা কাছেপিঠে কোথাও থেকে একটা গাড়ী ধরে আনতে গেছে । তাকে এইখানে অপেক্ষা করতে বলে গেছে । ভয়ার্ত বৃদ্ধা বলেছিল, ওদের হাতে বড় বড় বন্দুক আছে । ওদের কাছে না’কি সে শুনেছে, ঔই বন্দুক দিয়ে ওরা ওপরের ইংলন্ডের এরোপ্লেনগুলোকে গুলি করে আগুন লাগিয়ে দিতে পারে । এ’গুলো দিয়ে ত’ কাছের মানুষ মারা অতীব সহজ । তীব্র সন্ধানী বাতিস্তম্ভের ওপর থেকে উজ্জ্বল আলোর রশ্মি দিয়ে ওরা ইংলন্ডের এরোপ্লেনগুলোর অনুসন্ধান করে । তারপর নীচ থেকে গুলি চালিয়ে সে গুলোকে তারা আগুন ধরিয়ে দেয় । বৃদ্ধা না’কি নিজের চোখে এ’সব দেখেছে ( আমার মনে হয় শুনেছে ) । এরপরও সে যদি পালায়, সে নিশ্চিতভাবে জানে ওদের হাত থেকে সে আর বাঁচবে না (কিন্তু বাঁচাটা আমাদের বিশেষ দরকার। অন্ততঃ যুদ্ধের শেষ দেখা দরকার)।
মিয়েপ বৃদ্ধার কাছে সব কথা শুনেছিল, তার অসহায় চেহারাও দেখেছিল। কিন্তু তবুও মিয়েপ সাহস করে তাকে ডেকে নিজের ঘরে নিয়ে যেতে পারেনি, বা সাহস পায়নি । কারণ সে নিশ্চিতভাবে জানত, যদি সে এই কাজটা করে, তবে তাকে আরও বড় বিপদের মুখোমুখি হতে হবে, এমন কি হয়তঃ বন্দুকধারীরা ফিরে এসে, বৃদ্ধার বদলে তার শরীরের তন্ত্রুগুলো ছিঁড়ে, তাকেই টেনে নিয়ে চলে যাবে। শুধু এইটুকু হলেও কথা ছিল। মিয়েপ অনুমান করেছিল, এর জন্যে তার পড়শিদেরও বিপদে পড়তে হতে পারে। মিয়েপ তার কাঁপা স্বরে, অপরাধবোধ নিয়ে বলল, “শুধু আমি কেন, পড়শীদের কারুরই সাহস ছিল না ঔই বৃদ্ধাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে ঘরে বসাতে ।“ তারা জানে জার্মান বাহিনী বা তার গেষ্টাপো বাহিনীর আর যাই হোক, হাতের বন্দুক দিয়ে মানুষ তাদের হাত কাঁপে না । আর সিএ মানুষটা যদি কোনভাবে ইহুদি হয়, তা’হলে ত’ বিন্দুমাত্র অপেক্ষা না করে গুলি মারবে, তারপর ভাববে, ইহুদি মারতে গিয়ে গুলিটাই নষ্ট হলো। মিয়েপের কাছেই শুনেছিলাম, এটাই না’কি তাদের বাহিনীতে নিযুক্ত হওয়ার অন্যতম যোগ্যতা ও পূর্বশর্ত ।
ইলি (বেপ ভোস্কুজী) মহিলা হিসাবে বেশ শান্ত আর চুপচাপ। কিন্তু যখন কোন বিষয়ে কোন মন্তব্য করেন, তখন তার মন্তব্যের পশ্চাতে থাকে তাঁর ধীর আত্মপ্রত্যয়। অতি সম্প্রতি তিনি খবর পেয়েছেন, তাঁর প্রেমিককে প্রায় বাধ্যতামূলকভাবে জার্মান যেতে হবে । জার্মান, ইংল্যান্ড আর ফ্রান্সের আকাশে যেভাবে অহরহ যুদ্ধ বিমানগুলো উড়ছে , তাতে যে’কোন সময়ে উড়তে উড়তে একটা বোমা ফেলে দিতে পারে। সেই যুদ্ধ-বোমা কার বাড়ির কোথায় পড়বে, সে ব্যাপারে কেউ কিছুই বলতে পারে না। কারণ এই মূহূর্তে কোন যুদ্ধ বিমান বা কোন যুদ্ধ-বোমা কোন রকম নিয়ম মেনে, সময় মেনে বা স্থান নির্বাচন করে ওড়েও না বা বোমাও ফেলে না। সবটাই যুদ্ধবাজদের মর্জিমত, বা খেয়াল মতো ঘটে চলেছে। সবাই এখন পাগলের মতো যুদ্ধে মেতেছে, এ’যেন এক মারণযজ্ঞের খেলা। এখানে মৃত্যুই একমাত্র লক্ষ্য, একমাত্র পরিণতি। মানুষ এখন আর মানুষ নেই, সে যুদ্ধের অস্ত্র হয়ে উঠেছে, আর যুদ্ধ হল এক অনাস্বাদিত জয়ের যন্ত্র । এ’জয় কি জয় কেউ জানে না, শুধু জানে “জয় চাই, যে কোন মানুষের মৃত্যুর বিনিময়ে, যে কোন সভ্যতার ধ্বংসের পরিবর্তে।“ পৃথিবী এখন জয়ের নেশায় উন্মত্ত। হয়ত এমনও একদিন হলো, কোন বাড়ির ওপর বা শত্রুর আবাসস্থলের ওপর বোমা ফেলতে গিয়ে, একটু লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে সেটা গিয়ে পড়ল, কোন প্রেমিক-প্রেমিকার মাথায়। মানুষের সাথে মানুষের প্রেমটাই তখন ভেঙ্গে চূড়মাড় হয়ে যাবে। ইদানীং একটা মজার কথা বা জোকস খুব চালু হয়েছে। “রোজগার করে এক মিলিয়ন উপার্জন করার চেয়ে এক মিলিয়ন টণের বোমা পাওয়া অনেক সহজ।“ তবে কি জান। এই ধরণের জোকসের মধ্যে বিশুদ্ধ হ্যতঃ নয়, ব্যাঙ্গাত্তক হাসি থাকতে পারে। কিন্তু জীবনের যে কোন গন্ধ নেই এ’ব্যবাপারে তুমি নিশ্চিত থাকতে পার। ইলি যেমন ভাবছিল, তার প্রেমিকা ড্রিককে একা জার্মানীতে যেতে হচ্ছে না। তার মতো আরও আনেক যুবককে প্রায় রোজই বাধ্যামূলকভাবে ট্রেনের কামড়া বোঝাই করে জার্মানীতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। উদ্দেশ্য যুদ্ধ ক্ষেত্রে জার্মান সৈন্যবাহিনীতে পদাতিক সেনার সংখ্যা বৃদ্ধি করা। মজাটা হলো, যাত্রী বোঝাই ট্রেনটা যখনই কোন ছোটখাট ষ্টেশনে এসে কোন কারণে দাঁড়াচ্ছে, এবং কিছুক্ষণ কিছু রসদ জোগাড় বা আর কিছুর জন্যে দাঁড়িয়ে থাকছে, তখনই ভিতরের দেশপ্রেমী যুবকবৃন্দ্র এদিক ওদিক তাকিয়ে সুযোগের সন্ধান করছে; একটু সুযোগ পেলেই, চারদিকে তাকিয়ে দেখে নিচ্ছে কোন জার্মান সৈনিক আছে কি’না ! কাউকে আশেপাশে দেখতে না পেলেই , যে যেদিকে পারছে দৌড় লাগাচ্ছে। ভুলেও পিছনের দিকে তাকাচ্ছে না। সত্যিই জার্মান দেশপ্রেম আর আর্য জাতিবোধের কি অসাধারণ টান। এই দুটোকে ছেড়ে কোনভাবে পালিয়ে যেতে পারলেই যেন তারা বেঁচে যাবে। যাওয়ার পথে কেউ কেউ আবার জার্মান সৈন্যদের হাতে ধরাও পড়ে যাচ্ছে। আবার কেউ কেউ আর্য উদ্ভবের টান এড়িয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হচ্ছে।
তোমার চিন্তা নেই, আর কোন বিশেষ খারাপ খবর তোমায় দেব না। তাবে এমন কিছু খবর আছে যা শুনলে তুমি নির্ঘাত আঁতকে উঠবে। কিংবা ভয়ে কুঁকড়ে যাবে। আচ্ছা, তুমি “জামিনদার” কথাটা শুনেছো, বা এ’ব্যাপারে কিছু কি জান? ধর, তোমাকে জার্মান সৈন্য বন্দী করতে এল। কিন্তু তুমি আগেভাগে খবরে পেয়ে অথবা, কিছু না জেনেই অন্য কোথায় চলে গেছ বা পালিয়ে গিয়ে লুকিয়ে বসে আছ। এবার তোমায় ধরতে এসে তোমায় না পেয়ে জার্মান সৈন্য চলে যাবে ভাবছ! তা;তারা করবে না। তোমাকে না পেলে, তোমার বাড়ীর কাউকে (তোমার অত্মীয়-স্বজন হলে খুব ভাল), বিনা কৈফিয়ত বা ওয়ারেন্টে ধরে নিয়ে চলে যাবে। খালি হাতে যাবে না। শর্ত দিয়ে যাবে, তোমায় হাজির করলে, তোমার জামিনদারকে ছেড়ে দেবে। আর তা সত্ত্বেও তুমি যদি ধরা না দাও, তবে তোমার জামিনদারের উপর দৈহিক অত্যাচার করবে, যতক্ষণ না সে, তুমি কোথাও আছে, সেটা না বলে দেয়। অন্যদিকে তোমার কানে যখন যাবে, যে তোমার আত্মীয়কে অত্যাচার করছে, তখন তুমিও হয়তঃ বাধ্য হয়ে আত্মসমর্পণ করবে। আসলে যে সমস্ত লোক লুকিয়ে-চুরিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে অন্তর্ঘাতমূলক কাজ করে অথচ ধরা দেয় না, তাদের শায়েস্তা করার জন্যেই এই জামিন প্রথা চালু করা হয়েছে। উদ্দেশ্য, তোমায় না পেলে, তোমার পরিবর্তে তোমার আত্মীয়কে ধরে নিয়ে গিয়ে, তার উপর অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়ে, তোমার অন্তর্ঘাতের প্রতিশোধ নেওয়া। এ’রকম একটা ভয়ঙ্কর প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসামূলক ব্যবস্থার কথা ভাবতে পার?
এইভাবেই, সমাজের সুপরিচিত অথচ আপাতঃ নিরপেক্ষ নাগরিকদের ‘জামিন’ হিসাবে বন্দী করা হচ্ছে। পরে গেস্টাপো বাহিনী সরকারী প্রশাসনের বিরুদ্ধে অন্তর্ঘাতকের হদিস যখন পাচ্ছে, তখন গেস্টাপো বাহিনী, জামিনদার হিসাবে নিয়ে আসা ঐ’সব নিরাপরাধ লোকগুলোকে ছেড়ে দেওয়ার পরিবর্তে, দেওয়ালের সামনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে মেরে ফেলছে। প্রত্যেক দিন খবরের কাগজে এ’রকম বেশ কিছু সুপরিচিত নিরপেক্ষ নাগরিকের মৃত্যু সংবাদ ছাপা হচ্ছে। উদেশ্য সরকারের স্বৈর মুখ দেখানো, যাতে সাধারণ লোক সরকারী অনুশাসনের প্রতি ভয় পেয়ে যায় । খবরের কাগজে এই সব সুপরিচিতের মৃত্যুর নাম দেওয়া হছে ঃ “সংবিধানিক বা আকস্মিক দুর্ঘটনা জনিত মৃত্যু”।
সত্যিই জার্মান কত সুন্দর সুসভ্য জাতি, এরা নিজেদের বলে আদি আর্য বা এরিয়ান। ভাবতে অবাক লাগে, একদিন আমি ওদেরই ছিলাম, শুধু ছিলামই না ওদের সঙ্গেই ছিলাম। আমি নিজেকে জার্মানি বলে গর্ব করতাম। না, এখন আর সেটা নেই। একেবারে চলে গেছে। আমি আর জার্মানিই নই। হিটলার আমার জাতীয়তাবাদটাকেই পরিবর্তন করে দিয়েছে। এখন আর আমি জার্মান নই আমি ইহুদি। আর সারা পৃথিবীতে আমরা ইহুদিরাই হলাম জার্মানের তথা হিটলারের সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ, সবচেয়ে বড় শত্রু।
ইতি,
অ্যানি।
অনুবাদকের সংযোজন ঃ
১? ওয়েস্টারবুর্কঃ- ওয়েস্টারবুর্ক আসলে ছিল একটি সৈনিকদের বিশ্রামাগার। নেদারল্যান্ডের উত্তরপূর্বে অবস্থিত ওয়েস্টারবুর্ককে ১৯৩৯ সালে ডাচ সরকার একটি সৈন্য ঘাঁটি হিসাবে তৈরী করে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল, জার্মানের নাৎসি সরকারের অত্যাচারে ভীত হয়ে যারা উদ্বাস্তু হিসাবে নেদারল্যান্ডে ঢোকার চেষ্টা করবে, তাদের সাময়িকভাবে ওয়েস্টারবুর্ককে রেখে, অন্যত্র, সুবিধা অনুসারে স্থানান্তরিত কারা হবে। এই সব জার্মান উদ্বাস্তুরা বেআইনি ভাবে নেদারল্যান্ডে প্রবেশ করার চেষ্টা করেছিল। কার্যত এরা জার্মান নাৎসি বাহিনীর ভয়ে নেদারল্যান্ডে পালিয়ে এসেছিল।
কিন্তু ১৯৪০ সালের মে’ মাসে জার্মান নেদারল্যান্ড আক্রমণ করে এবং অতি দ্রুত তা’ দখল করে নিয়ে, সেখানেও অতি দ্রুত ইহুদি বিদ্বেষী নীতি (Antisemitic Policy) লাগু করে। ১৯৪১ সালে অধিগ্রহনকারী জার্মান প্রশাসন ঠিক করে যে, ইহুদি চূড়ান্ত নির্বাসনের আগে পর্যন্ত তাদেরকে ওয়েস্টারবুর্ককে রাখা হবে। নতুন আইন মোতাবেক ১৯৪১ সালের ১৪ই জুলাই প্রথম নেদারল্যান্ডের উদ্বাস্তু ইহুদিদের ওয়েস্টারবুর্ককে স্থানান্তরিত করা হয়। এবং তার পরদিনই অর্থাৎ সম্ভবতঃ ১৪ অথবা ১৫ জুলাই ১৯৪২ সালে প্রথম নেদারল্যান্ডের ইহুদিদের নির্বাসিত করা শুরু হয়। ওয়েস্টারবুর্ক থেকে ইহুদি উদ্বাস্তুদের আউশউইতজ বিরক্যেন্যুই শিবিরে নিয়ে যাওয়া হতো। কাদেরকে আউশউইতজ শিবিরে নিয়ে যাওয়া হবে, তা’ প্রায় প্রতিদিনই ঠিক করা হতো। তারপর প্রতি সোমবারে ২০ টি ওয়াগন বিশিষ্ট (এই ওয়াগানগুলিতে সাধারণ সময়ে গবাদি পশু নিয়ে যাওয়া হতো) ট্রেন ইঞ্জিনে আউশউইতজ উদ্বাস্তু শিবিরে নিয়ে গিয়ে রাখা হত। প্রতিটি ওয়াগানে প্রায় কমপক্ষে ৫০ থেকে ৮০ জন ইহুদিকে তোলা হত, কারণ পঞ্চান্ন বা পঁচাশী জনকে তোলার জায়গা কোনভাবেই করা যেত না। এইভাবে জুলাই ১৯৪২ থেকে সেপ্টেম্বর ১৯৪৪ এর মধ্যে প্রায় ১০০০০০ ইহুদি ওয়েস্টারবুর্ক থেকে আউশউইতজ শিবির বা বারজেন-বেলসেন শিবিরে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল। ১৯৪৫ সালে যখন মিত্র শক্তি নেদারল্যান্ডকে জার্মানদের হাত থেকে মুক্ত করে তখন ওয়েস্টারবুর্ক শিবিরে মাত্র ৮৭৬ জন বেঁচে ছিল, তার মধ্যে ৫৬৯ জন ছিল নেদারল্যান্ডের নাগরিক ।
২/ দেরেন্থঃ- নেদারল্যান্ডের একটি ছোট প্রদেশের নাম ছিল দেরেন্থ। নেদারল্যান্ডের উত্তরপূর্ব সীমারেখায় এই প্রদেশটির অবস্থান। দেরেন্থের পূর্ব দিকে জার্মানের লোয়ার স্যাক্সনিতে অঞ্চলটির অবস্থান ছিল।
হ্যারমাইন সান্ত্রুশ্চিজ
হ্যারমাইন স্যান্ত্রুশ্চিজ ( Hermine Santruschitz :- জন্ম ১৫ই ফেব্রুয়ারী ১৯০৯ – মৃত্যু ১১ই জানুয়ারী ২০১০ ) অ্যানির ডাইরিতে মিয়েপ গিয়েস নামে উল্লেখ করা হয়েছে। মিয়েপ গিয়েস ছিলেন ডাচ নাগরিক। অ্যানিদের অন্তরালবর্তী জীবনে তাদের কাছে অন্যতম সাহায্যকারী। ১৯০৯ সালে অস্ট্রিয়ায় জন্মগ্রহণ করার পর, ১৯২০ সালে এক ডাচ পরিবার তাকে পালিত কন্যা হিসাবে গ্রহণ করেন এবং তিনি সেখানেই বড় হয়ে ওঠেন। প্রথমে তাকে মাস কয়েকের জন্যে পালিত পরিবারের কাছে পাঠানো হলেও, পরে অসুস্থতার কারণে তিনি আর অস্ট্রিয়ায় ফিরে যাননি। ঐ পরিবারের সঙ্গে নেদারল্যান্ডেই থেকে যান। ১৯৩৩ সালে তিনি ওটো ফ্রাঙ্কের কোম্পানীতে যোগ দেন। তার কিছু আগে ওটো ফ্রাঙ্ক হিটলার ও নাৎসি বাহিনীর ভয়ে, জার্মান ছেড়ে নেদারল্যান্ডে চলে আসেন, এবং সেখানে নতুন করে ব্যবসা শুরু করেন। ওটো ফ্রঙ্কের ব্যবসা যোগ দেওয়ার পর থেকে মিয়েপ ক্রমেই তাদের বিশ্বস্ত কর্মচারীতে পরিণত হন। তিনিই অ্যানি ফ্রঙ্কের ডাইরি উদ্ধার করে ওটো ফ্রাঙ্কের হাতে দিয়েছিলেন। অ্যানিরা গ্রেপ্তার হওয়ার পর, তিনি গেস্টাপো বাহিনীর চোখের আড়ালে ডাইরিটা সরিয়ে রাখেন, এবং ১৯৪৫ সালে আউশুইতজ বন্দী শিবির থেকে ওটো ফ্রাঙ্ককে উদ্ধার করার পর, তিনি মিয়েপের কাছে জানতে পারেন যে তাঁর পরিবারের আর কেউই বেঁচে নেই। তার কাছ থেকেই ওটো ফ্রাঙ্ক অ্যানির বিখ্যাত লাল রঙের ডাইরিটা পান।
0 comments: