0

প্রবন্ধ - সোমেন দে

Posted in


প্রবন্ধ


কলকাতার মেসবাড়ি এবং বাংলা সাহিত্য 
সোমেন দে 



কলকাতা শহরের বেশিরভাগটাই গড়ে উঠেছে অপরিকল্পিত ভাবে। এ শহরটাতো আসলে একটা করপোরেট হাউসের তৈরি শহর। বলা যেতে পারে দুনিয়ার সব চেয়ে বড় কর্পোরেটের হাউসের তৈরি। যার নাম ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। এ শহরে ব্যাবসা পত্তর ঠিক মতো জমে উঠবে কিনা সে বিষয়ে কোম্পানির কত্তাদের প্রথমদিকে বেশ সংশয় ছিল। জায়গাটা ছিল রীতিমত অস্বাস্থকর। কলেরা ম্যালেরিয়া প্লেগের উৎপাতে সাহেবরা ছিলেন নাজেহাল। তবে শেষ পর্যন্ত সব বাধা সরিয়ে কলকাতা হয়ে দাঁড়ালো মহানগর। এ শহরে মধ্যভাগে সাহেবপাড়ার বাইরে বাকি শহর নিয়ে ইংরেজদের বিশেষ মাথা ব্যাথা ছিলনা। তাই এ শহরে গ্রাম বা মফস্বল থেকে আসা নেটিভদের বসতি গড়ে উঠলো নেহাতই এলোমেলো ভাবে। শহর যখন বাড়তে থাকল তখন ক্রমশ অনেক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের অফিস খুলতে লাগল। খুলল নতুন লতুন স্কুল কলেজ দোকান পাট। সাহেবরা মধ্য কোলকাতাকে তাদের লন্ডনের মতো করে সাজাতে লাগলেন। ডালহৌসি অঞ্চলে গড়ে উঠলো অফিসপাড়া। ফিটন-ছ্যাকরা গাড়ির যায়গায় এলো ঘোড়ায় টানা ট্রাম। গ্যাসের বাতি সরিয়ে এলো বিদ্যুতের আলো। আর উত্তর কলকাতায় ক্রমশ বাঙ্গালিদের বসত বাড়ি গড়ে উঠতে লাগল। সে সব বাড়ির বেশির ভাগের তেমন ছিরি ছাঁদ নেই। এ শহরে শরীরের শিরা উপশিরার মতো ছড়িয়ে গেল কিনু গোয়ালার গলির নানা সংস্করণ। ছোট খাটো রাজারা, রাজার দেওয়ানরা, জমিদাররা, ইংরেজদের বদান্যতাপুষ্ঠ রাজকর্মচারীরা, যুদ্ধের বাজারে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হওয়া ব্যবসায়ীরা এরা সব উত্তর কলকাতায় এখানে ওখানে চক মেলান দালান বাড়ি গড়লেন, আর তার গা ঘেঁষে মধ্যবিত্ত কেরাণীরা গড়লেন এলোমেলো ভাবে ‘একটূকু বাসা’। তার অদুরেই গতর খাটা মজুররা গড়লেন বারো ঘর এক উঠোনের বস্তি। কাজেই এ শহরে কোনো বিশেষ অঞ্চলে অভিজাতদের মৌরসি পাট্টা নেই, আবার গরোবগুর্বোদের একচেটিয়া দখলদারীও নেই। সব আছে মিলেমিশে। তার মধ্যে এক একটা পাড়া গড়ে উঠল। পাড়ার ভিতরে বাড়িগুলোতে থাকত গাড়িবারান্দা, লাল সিমেন্টের মেজে এক ফালি রোয়াক, রট আয়রনের গ্রিল রেলিং, কড়িকাঠ, খড়খড়ি, বৈঠকখানাঘর। সব মিলে এই সব পাড়ায় একটা কোথাও নাগরিক বাঙ্গালিয়ানার জন্ম হলো । 

কলকাতা চিরকালই হা-ঘরেদের জন্যে হাট করে দ্বার খোলা রেখেছে। এ শহরের ভাবখানা - ‘নাহয় হবে, ঘেঁষাঘেঁষি, এমন কিছু নয় সে বেশি, নাহয় কিছু ভারী হবে আমার তরীখান-- তাই বলে কি ফিরবে তুমি আছে, আছে স্থান!’ 

এই উদার ছন্দের ফলে কলকাতার লেন-বাইলেনের বিন্যাস হয়ে গেল অনেকটা প্রাচীন বটগাছের শিকড়ের মতো। একটা বড় রাস্তা থেকে শুরু হয়ে যেখানে যেমন পেরেছে বাঁক নিয়েছে, সরু হয়েছে, চওড়া হয়েছে, তার পর আবার আর একটা বড় রাস্তার হাত ধরেছে। প্রসাধনের ভনিতা নেই। চাকচিক্যের বাহার নেই। 

শহরে ব্যাবসা পত্তর বাড়তেই চাকরির খোঁজে, কলেজ ইউনিভারসিটিতে পড়াশনা করতে গ্রাম থেকে মফস্বল থেকে, আসতে লাগল মধ্যবিত্ত নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষ, দলে দলে। আলাদা বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকার মতো রেস্ত নেই তাদের। প্রয়োজন হলো কম খরচে মাথা গোঁজায় জায়গার। গজিয়ে উঠল মেসবাড়ি নামের সস্তার আস্তানা। শুরু হলো বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা মানুষের একধরণের সম্পর্কহীন যৌথ জীবনযাপন, রক্তের আত্নীয়তাবিহীন একান্নবর্ত্তীতা। এই সব মেসবাড়িগুলো গড়ে উঠল হ্যারিসন রোড, কলেজ স্ট্রিট, মির্জাপুর, আমহার্স্ট স্ট্রিট, শিয়ালদা, মানিকতলা অঞ্চলে। মেসবাড়িগুলোর পরিকল্পনাহীন ভাবে গড়ে উঠলেও সেগুলোর মোটামুটি একটা ধরণ ছিল। দুই বা তিন তলা, বারো চোদ্দ কামরার বাড়ি। মেজে লাল সিমেন্টের, কড়িকাঠের সিলিং। খড়খড়ি লাগানো জানলা। বেশ মোটা কাঠের সদর দরজা দিয়ে ঢুকলে সামনে এক ফালি উঠোন। তার একদিকে মেসের ম্যানেজরের ঘর, অন্য কোনায় রান্নাঘর আর পাত পেড়ে খাবার জায়গা। তারই একদিকে কলতলা, সারাদিন বাড়িতে আলোর চেয়ের অন্ধকারের দখল বেশি থাকে। ম্যানেজার থাকলেও বোর্ডারদের আসল তত্বাবধানের দায়িত্বে থাকত একজন পরিচারক এবং একজন পরিচারিকা। 

বোর্ডাররা হতেন মূলত সদাগরী অফিসের কনিষ্ঠ কেরানী, খুচরো ব্যাবসায়ী, উকিল, মুহুরি, ফেরিওয়ালা, ইন্সুরেন্সের দালাল, ছাত্র, শিক্ষক, অধ্যাপক এবং চাকরীসন্ধানরত বেকার। এ ছাড়া আরও কিছু মানুষ থাকতেন, যারা কিছু বিশেষ স্বপ্ন বুকে নিয়ে মহানগরে এসেছেন, একদিন বিখ্যাত অভিনেতা, গায়ক, শিল্পী কবি বা লেখক হবেন। অনিশ্চিত জীবন। মেসবাড়ির সামান্য ভাড়াও মাঝে মাঝে বাকি পড়ে যায়। দিনের পর দিনে চেষ্টা চালিয়ে যেতে যেতে কেও অবশেষে খুঁজে পেতেন পায়ের তলার মাটি, কেওবা রণে ভঙ্গ দিয়ে তা ফিরে যেতেন আবার দেশবাড়িতে। 

বাঙ্গালির সৌভাগ্য আমাদের সাহিত্যের অনেক উজ্বল ব্যাক্তিত্যর প্রতিভার আঁতুড়ঘর এই মেসবাড়ি। সৌভাগ্য এই জন্যে এই মেসবাড়ির জীবন থেকে পাওয়া অভিজ্ঞতা হয়ত কোনোভাবে সম্বৃদ্ধ করেছে তাঁদের। 

শরৎচন্দ্রের ‘দেবদাস’ উপন্যাসের পটভুমি বিংশ শতাব্দীর প্রথমের দিকে। সাহিত্য হিসাবে ‘দেবদাস’ যে উচ্চমানের হয় নি সে কথা শরৎচন্দ্রের নিজেরই অভিমত ছিল। কিন্তু তা সত্বেও এ দেশে বাঙ্গলার বাইরে অন্য প্রদেশে ‘দেবদাস’ শরৎবাবুর সবচেয়ে পরিচিত উপন্যাস। সেটা অবশ্যই চলচ্চিত্রের কল্যানে। উপন্যাসে তালসোনাপুর গ্রামের জমিদারপুত্র যখন গ্রাম ছেড়ে কলকাতায় এলেন প্রথমে উঠেছিলেন মামার বাড়িতে। তার পরে মামাবাড়ি ছেড়ে একটি মেসবাড়িতে গিয়ে পড়লেন। সেই মেসবাড়িতে দেবদাসের পাশের ঘরেই থাকতেন চুনিলাল। যে কিনা ‘আজ নয় বৎসর হইতে বাস করিয়া আসিতেছেন। তাঁহার এই দীর্ঘ কলিকাতা বাস বি এ পাস করিবার জন্য অতিবাহিত হইয়াছে – ‘আজও তিনি সফলকাম হইতে পারেন নাই বলিয়া এখনো এইখানেই তাঁহাকে থাকিতে হইয়াছে’। অর্থাৎ ধরে নেওয়া যেতে পারে সেই সময় মেসবাড়ি কলকাতায় ভালো ভাবেই প্রচলিত হয়ে গেছে। 

এই চুনিলালের সঙ্গে দেখা হওয়াই দেবদাসের জীবনের টারনিং পয়েন্ট। এখান থেকেই হয় দেবদাসের জীবনের যত কিছু ‘স্থলন পতন ত্রুটি’র শুরু। কলকাতার মেসবাড়ির বোর্ডার থেকে ভারতবিখ্যাত হয়ে যাওয়া মাতাল আইকনটিকে চলচ্চিত্রে বিভিন্নভাবে ফুটিয়ে তোলবার চেষ্টা করেছেন – প্রমথেশ বড়ূয়া, দিলীপকুমার, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, প্রষেনজিৎ, শাহরুখ খান এবং আরো অনেকে। 

দেবদাসের স্রষ্টা শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নিজেও কিছুদিন কলকাতায় মেসবাড়িতে বসবাস করেছিলেন। সে বাড়িটির ঠিকানা ছিল ২৭ নং বাদুড় বাগান লেন। সুকিয়া স্ট্রিটের বাই লেন। এই বাড়িতেই বাস করেছিলেন প্রখ্যাত কবি এবং সাহিত্য সমালোচক মোহিতলাল মজুমদার। মোহিতলাল কাচড়াপাড়া থেকে কলকাতায় রিপন কলেজে ভর্তি হন। তাঁর কবিতায় প্রথম দিকে রবীন্দ্রনাথের প্রচুর প্রভাব থাকলেও পরে তিনি লেখার অভিমুখ পরিবর্তন করেন। তিনি কাজি নজরুলেরও আগে বাংলা কবিতায় উর্দু এবং ফার্সি শব্দ প্রয়োগ করেছিলেন। সেই সময় তাঁর কবিতায় দেহাশ্রয়ী প্রেমের আভাষ এনেছিলেন বলে আধুনিক কবিদের দ্বারা বন্দিত এবং রক্ষনশীলদের কাছে নিন্দিত হন। পরে অবশ্য মোহতলাল সাহিত্য সমালোচক হিসেবেই বেশি খ্যাতিলাভ করেন। এই মেসবাড়িতেই থাকতেন আরও এক কবি এবং সমালোচক সজনীকান্ত দাস। তিনি অবশ্য শনিবারের চিঠির সম্পাদক হিসাবেই বেশি বিখ্যাত। বর্ধমানের প্রত্যন্ত গ্রামের থেকে যান বেনারসে ইঙ্গিনিয়ারিং পড়তে। সে পড়া মাঝপথে ছেড়ে দিয়ে চলে আসেন কলকাতায়। সম্ভবত সাহিত্যের টানেই। শনিবারের চিঠিতে প্রথমের লেখক ও পরে সম্পাদক হন। মোহিতলাল তাঁর বেশির ভাগ লেখা দিতেন শনিবারের চিঠিতেই। হয়ত এই বাদুড় বাগানের মেসেই দুজনে মিলে বসে হতো তুমুল সাহিত্যচর্চা। এবং তার ফসল বাংলা সাহিত্যের সম্পদ হয়ে আছে। 

দেবদাসের পরে বাংলার বাইরে বাংলা সাহিত্যের সব চেয়ে পরিচিত চরিত্র সত্যান্বেষী ব্যোমকেশ। ব্যোমকেশের সব গল্পই অজিতের বয়ানে লেখা। কিন্তু এই অজিতের সঙ্গে ব্যোমকেশের দেখা হ্যারিসন রোডের এক মেসবাড়িতে। ব্যোমকেশ সিরিজের প্রথম গল্প সত্যান্বেষীতে একই মেসে থাকতে এসে অজিতের সঙ্গে ব্যোমকেশের পরিচয়। অজিতের সেই প্রথমদেখা ব্যোমকেশের একটি অতি সংক্ষিপ্ত বিবরণ ছিল - বয়স বোধকরি তেইশ-চব্বিশ হইবে, দেখিলে শিক্ষিত ভদ্রলোক বলিয়া মনে হয়। গায়ের রঙ ফরসা, বেশ সুশ্রী সুগঠিত চেহারা-মুখে চোখে বুদ্ধির একটা ছাপ আছে। 

এই চরিত্র সৃষ্টির সময় লেখকের নিশ্চয় পরবর্তী কালে ব্যোমকেশের কালজয়ী হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনার কথা সুদূর কল্পনাতে ছিল না। কিন্তু অনেক কটা যুগ পেরিয়ে ব্যোমকেশ বিখ্যাত হয়েছেন সিরিয়াল এবং সিনেমার কল্যানে। ঈদানীং তো ব্যোমকেশকে নিয়ে সিনেমা করার রীতিমত হুড়োহুড়ি পড়ে গেছে। বলা যেতে পারে এই ব্যোমকেশও মেসবাড়ির দান। 

পরে অবশ্য ব্যোমকেশ মেসবাড়ি ছেড়ে উঠে যান কেয়াতলা রোডে নিজের বাড়িতে। 

ব্যোমকেশের স্রষ্টা শরদিন্দু বন্দোপাধ্যায় নিজেও এক সময় থাকতেন ৬৬ নং হ্যারিসন রোডের প্রেসিডেন্সি বোর্ডিং হাউস নামের মেস বাড়িতে। এখান থেকেই পেয়েছেন ব্যোমকেশ সৃষ্টির প্রেরণা। 

এই বাড়িতেই একসময় থাকতেন জীবনানন্দ দাশ। ১৯২২ সালে যখন সিটি কলেজে ইংরেজী শিক্ষকের চাকরি পান তখন তিনি থাকতেন এই বোর্ডিং-এ। মেসবাড়ির ঘর তাঁর অনেক রচনার আঁতুড়ঘর। তাঁর রোজনামচায় এবং বেশ কিছু গল্প উপন্যাসে এই মেস-জীবনের উল্লেখ আছে। 

পরে অবশ্য তিনি যখন স্ত্রীকে কলকাতায় নিয়ে আসেন, তখন বাসা নেন রাসবিহারী মোড়ের কাছে ল্যান্সডাউন রোডের একটি গলিতে। 

বাংলা সাহিত্যের আর একটি অতি জনপ্রিয় চরিত্র প্রেমেন্দ্র মিত্রের অনবদ্য সৃষ্টি ঘনাদা। তিনিও থাকতেন মেসবাড়িতে। তাঁর পুরো নাম ঘনশ্যাম দাশ। ঘনাদার কথায় ইয়োরোপের লোকে চেনে ‘ডস’ বলে। মেসের সদস্যরা তাকে ডাকত ঘনাদা বলে। ঘনাদা জমিয়ে যে গল্প ফাঁদেন তা বাঙ্গালির ট্রেড মার্ক গুল মারা হলেও সে সব গল্পের ভিত্তিতে আছে কল্প-বিজ্ঞান, আছে ভুগোল, আছে ইতিহাস। এ সব গল্প শুধু বাগাড়ম্বর নয়। গল্পের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে আছে ঘনাদার পাণ্ডিত্য, প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব, আর উদ্ভাবনী শক্তির পরিচয়। বাংলা সাহিত্যে ঘনাদার আবির্ভাব ঘটে ১৯৪৫ সালে। দেবসাহিত্য কুটির থেকে প্রতি বছর একটি করে ছোটোদের জন্যে পুজাসংখ্যা বেরোতো। প্রতি বছর সে পত্রিকার একটি নতুন নাম দেওয়া হতো। সে বছর নাম ছিল আলপনা। গল্পের নাম ছিল মশা। 

প্রথম গল্পেই জানা গেছল ঘনাদা একটি মেসের চিলেকোঠায় থাকেন। ঘনাদা ধুমপায়ী, ভোজনবিলাসী, স্বভাবে কিঞ্চিৎ আয়েসী, চেহারা লম্বা, গায়ের রঙ কালো। এই মেসবাড়িতে থাকেন চার বাসিন্দা শিবু শিশির গৌর আর ঘনাদার গল্পের কথক সুধীর। 

প্রথম গল্পে এই মেসবাড়ির ঠিকানা না জানা যায়নি। তাঁর ষষ্ঠ গপ্ল ‘টুপি’তে জানা যায় সে মেসবাড়ির ঠিকানা ৭২ নং বনমালী লস্কর লেন। 

তবে মেসবাড়িকে যিনি সবচেয়ে মহিমান্বিত করেছেন তিনি হচ্ছেন শিবরাম চক্রবর্তী। বাংলাসাহিত্যের একজন প্রখ্যাত লেখক হওয়া সত্বেও তিনি তাঁর সারা জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন উত্তর কোলকাতার একটি মেসে। মুক্তারাম বাবু স্ট্রীটের সেই মেসবাড়িটি প্রায় তাঁরই মতো বিখ্যাত হয়ে গেছে। কারণ তাঁর অদ্ভুত জীবনযাপনের যে গল্প তিনি আমাদের শুনিয়েছেন তাতে এই মেসবাড়িটি একটি বিশেষ চরিত্র। 

তাঁর জীবন থেকে নেওয়া এসব গল্প এই সময়ে দাঁড়িয়ে পড়লে শিব্রাম চরিত্রটিকে একটি বাস্তব চরিত্র বলে মনে হয় না। সরস গল্প লিখে মানুষকে হাসানো এক ব্যাপার, কিন্তু নিজের জীবনযাপনের পরতে পরতে এমন নির্লিপ্ত নির্মল পরিহাসের অনুপান ভরে দেওয়া বড় কঠিন কাজ। একটা আতস কাঁচ দিয়ে তার উদ্ভট সব কান্ড কারখানা ভালো করে দেখার চেষ্টা করলে মনে হয় যেন তিনি এক শুধু রসিক মানুষ নন, কোথাও একটা বেশ তেজী বিদ্রোহী ছিলেন। হাস্যরসের আড়ালে বোধ হয় তাঁর ছিল স্বভাবে বাঙালি মধ্যবিত্ত জীবনযাপনের প্রচলিত ছকটিকে তামাশা করার এক অভিনব স্পর্ধা। সফলতাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে, উচ্চাশাকে মুখ ভেংচিয়ে, এক আশ্চর্য নিরাসক্ত ভাবে এই মেসবাড়ির ঘরের ‘মুক্ত আরামে’, ছারপোকা পোষিত ‘তক্তারামে’ শুয়ে শুয়ে, দিনের পর দিন শুক্তারাম খেয়ে তিনি নট-নড়ন-চড়ন হয়ে কাটিয়ে দিয়েছেন অনেকটা জীবন ১৩৪ নং মুক্তারাম বাবু স্ট্রিটের মেসবাড়ির দোতলার একটি ঘরে। যখন তাঁর বেশ নামডাক হয়েছে, তিনি এ বাড়ি ছেড়ে যেতেই পারতেন। কিন্তু তাঁর কথায় – এখান থেকে নড়বেন কি করে, কলকাতায় তাঁর কোনো যাবার জায়াগাই ছিল না, যেতে গেলে তো সেই যেখান থেকে উঠে এসেছেন সেখানেই গিয়ে জুটতে হতো – সেই সাবেক সাকিন ফুটপাত। 

কেমন ছিল এই মেসবাড়ির ঘরটি? 

একবার কয়েকজন বন্ধু এসেছেন তাঁর মেসবাড়ির ঘরে তার সঙ্গে দেখা করতে, ঘরে ঢোকার আগে তাঁরা বাইরে জুতো খুলে ঘরে ঢুকেছেন দেখে শিবরাম বললেন – ও তোমাদের দামী জুতোতে ময়লা লেগে যাবে এই ভয়ে বুঝি জূতো খুলে এলে? 

আর একবার এক সাংবাদিক এসেছেন তাঁর কাছে, ঘরে প্রচুর জঞ্জাল দেখে একটু ইতস্তত করছেন দেখে শিবরাম তাকে বললেন – পায়ে নোংরা লেগে থাকলে মুছে নিন না আমার বিছানায়! হতভম্ব সাংবাদিক প্রশ্ন করলেন বিছানায় মুছবো? নির্বিকার শিবরাম বললেন – বিছানায় মানে ওই চাদরের নিচে একটা কম্বল আছে না, ওটাতেই মুছে নিন, আমিও তাই করি, চাদরটা চাকনচিকন থাকলেই হলো, চাদরের নিচে আর কে দেখতে যাচ্ছে! 

সেই ঘরের দেওয়ালে পেনসিলে লেখা অজস্র টেলিফোন নম্বর আর ঠিকানা লেখা। তাই বাড়িওয়ালাকে কিছুতেই চুনকাম করতে দিতেন না। কয়েকদিন আগে একটি খবরের কাগজে দেখলাম সেই ঘরটির দেওয়ালে নাকি এখনও তাঁর লেখা কিছু টেলিফোন নম্বর রয়ে গেছে।

বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের নাম উঠলে বাঙালি পাঠক অবধারিত ভাবে ঘাটশিলা নামটি জুড়ে দেন। আর জুড়ে দেন ইছামতী-লবটুলিয়া-ঘেঁটু-আকন্দ-পুঁইমাচা-গাংশালিক-নিশ্চিন্দিপুর। আমাদের মনে হয় যেন শহর কলকাতার সঙ্গে তাঁর তেমন পরিচয় গড়ে ওঠেনি। শহর সন্মন্ধে তিনি উদাসীন। কিন্তু তা বোধহয় পুরোপুরি সত্যি নয়। তিনি যে জীবনের মধ্যে দিয়ে গেছেন সেখান থেকেই কিছু খুঁজে নিয়েছেব লেখার উপাদান। জীবনের উপান্তে তিনি যখন মাঝে মাঝে ঘাটশিলায় থাকতেন তখন তাঁর টানে টানে অনেক লেখকই মাঝে মাঝে সেখানে গিয়ে হাজির হতেন। ১৯৫০ সালে পুজোর সময় ঘাটশিলায় রাজবাড়িতে তাঁকে একটি সম্বর্ধনা দেওয়া হয়েছিল। সেই সভায় কলকাতা থেকে গিয়েছিলেন প্রমথ বিশী, প্রবোধ স্যান্যাল মশাই এবং আরো অনেকে। তাঁকে দেওয়া সম্বর্ধনার উত্তরে বলবার সময় বিভুতিবাবু বলেছিলেন তরুণ বয়সে কলকাতায় মেসে তিনি বেশ কিছুদিন কাটিয়েছিলেন। সেই মেসের বোর্ডাররা সবাই প্রায় চাকুরীজীবী ছিলেন। তাই সকাল দশটায় সবাই অফিসে চলে যেতেন। আর বিভুতিভূষণ এই সময়ে ফাঁকা মেসবাড়িতে বসে গোগ্রাসে গিলতেন বটতলার উপন্যাস। তিনি বলেছিলেন এই সময়কার স্মৃতি তাঁকে পরবর্তী জীবনে লেখার উপাদান জুগিয়েছে। মেসবাড়িটি সম্ভবত ছিল মির্জাপুর স্ট্রিটে। 

যেহেতু সাহিত্যে মেসবাড়ির প্রভাব পড়েছে, আর সিনেমা এককালে সাহিত্যের হাত ধরে চলত তাই বেশ কিছু সিনেমাতেও এসেছে মেসবাড়ি। 

এর মধ্যে যে সিনেমাটি সময়ের দলিল হয়ে মেসবাড়ির জীবনের অম্লমধুর প্রতিচ্ছবি তুলে ধরে রেখেছে আগামীকালের বাঙ্গালির জন্যে তার নাম ‘সাড়ে চুয়াত্তর’। তিন চার প্রজন্ম পেরিয়ে যে জুটির জন্যে আজও বাঙালি মোহাবিষ্ট সেই উত্তম-সুচিত্রা প্রথম বার জুটি বাঁধার ঘটনাটি ঘটানোর জন্যে এই সিনেমাটি ইতিহাস হয়ে আছে। তবে সেই সঙ্গে কলকাতার হারিয়ে যাওয়া সমস্ত মেসবাড়ির প্রতিনিধি ‘অন্নপুর্না বোর্ডিং হাউস’কে সেলুলয়েডে ধরে রাখার জন্যেও ছবিটির অসীম মূল্য আছে। এ ছাড়া সপ্তপদী থেকে বসন্তবিলাপ অনেক ছবিতেই এসেছে মেসবাড়ি। এসেছে হিন্দিতে বিমল রায়ের পরিচালনায় কিশোরকুমার অভিনীত নৌকরী ছবিতে। শক্তি সামন্তের অমর প্রেম ছবিতে। 

কলকাতার নাগরিক জীবন বদলে গেছে সময়ের দাবী মানতে মানতে। উত্তর কলকাতার অলিগলির চেহারা হয়ত বিশেষ পালটায়নি। পুরোনো কিছু মেসবাড়ি আজও টিকে থাকলেও থাকতে পারে। তবে সেখান থেকে লেখক শিল্পী উঠে আসবেন এমন সম্ভাবনা বিলীন হয়ে গেছে। শুধু লেখক বা কবি হবার জন্যে নিবেদিত প্রাণ সেই সব রোমান্টিক মানুষেরা এখন আর নেই। এখনকার সাহিত্যযশপ্রার্থীরা অনেক বাস্তববাদী। মেসবাড়ির ক্লিষ্ট জীবন থেকে গল্প কবিতার উপাদান খোঁজার মতো ভুল তারা করেন না। 

ছাত্রছাত্রীদের জন্যে, অন্যপ্রদেশ থেকে আসা চাকুরেদের জন্যে কলকাতায় এখন চালু হয়েছে একধরণের ‘পিজি’ ব্যাবস্থা। মেসবাড়ি শব্দটিতে মেসের সঙ্গে বাড়ি শব্দ জুড়ে দেওয়ার পিছনে একটা অঘোষিত কারণ ছিল। এই মেসবাড়ির ভাবনায় কোথাও একটা বাড়ির বিকল্প হয়ে ওঠার চেষ্টা ছিল। পিজিতে সে চেষ্টা নেই। ওখানে নেহাতই ঘর শেয়ার করা, আর কিছু শেয়ার করা নয়। তাই ওখান থেকে কোন গল্প তৈরি হয় না।

0 comments: