2

গল্প - স্বাতী রায়

Posted in


গল্প


ফেয়ারওয়েল 
স্বাতী রায় 



ভালবাসি, ভালবাসি! সবাই এই মুহূর্তে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে বিদেশকে। আর সবার ভালোবাসা-ভরা কথা নিষিক্ত করে চলেছে বিদেশকে। খুবই ভাল, ভাল সব কথা। শুনতে শুনতে বিদেশের নিজেরই নিজেকে কেমন অজানা অচেনা মনে হচ্ছে। বাব্বা এত গুণ তার ছিল তাই তো জানত না সে! ওর ডিপার্টমেন্টের সবে মাস খানেক হলো যোগ দেওয়া দুজন ফ্রেশার এই মাত্র এসে হাতে হাত মিলিয়ে গেল। বলল, মিস করব তোমাকে বস। বিদেশ একটু দেঁতো হাসি হাসার চেষ্টা করল। মনে পড়ল, ওদের একটা ডকুমেন্টেশনের কাজ দিয়েছিল কদিন আগে। একটা তিন-পাতার ডকুমেন্ট দুজনে মিলে এক সপ্তাহে করে উঠতে পারেনি। বিদেশ তুমুল ঝাড় দিয়েছিল ওদের। সেদিন লাঞ্চের পরে ওর পাশের কিউবের সুকান্ত এসে বলেছিল ছেলে দুটো নাকি ক্যান্টিনে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি দিচ্ছিল বিদেশকে। বিদেশও ওদের হাতে হাত মিলিয়ে বলল, আমিও মিস করব তোমাদের। বলার সঙ্গে সঙ্গে দেখল ওর হাতের আঙ্গুলগুলো বেঁকে গেল – আর কিছুতেই সোজা করতে পারল না। 

একটু আগেই হয়ে গেছে ফেয়ারওয়েল বক্তৃতা। ওদের ডিপার্টমেন্টের হেড, মিঃ রণদিভে বেশ একটা আবেগ জর্জরিত ভাষণ দিয়ে শুরুটা করে দিলেন। যার মূল বক্তব্য বিদেশের মতো উদ্যমী, সমর্পিত-প্রাণ কর্মী পাওয়া মোটেই সহজ কথা নয়। আর অমন কোয়ালিটি-সচেতন কর্মী লাখে একটা মেলে। শুনতে শুনতে বিদেশের চোখটা ট্যারা হয়ে গেল। মণিগুলো প্রায় বড় হয়ে ঠেলে বেরিয়ে আসতে লাগল। মনে পড়ল এক বছর আগে যখন মায়ের অসুখের সময় বিদেশ মাস খানেক বাড়ি থেকে কাজ করার অনুমতি চেয়েছিল, তখন এই রণদিভেই চিবিয়ে চিবিয়ে যা বলেছিল তার মর্মার্থ এই যে তোমরা বাঙ্গালীরা খুব কামচোর। ভাত ছড়ালে কাকের অভাব হয় না – তাই এক মাস বাড়িতে বসে থাকলে বিদেশ আর ফিরে এসে চেয়ারটি পাবে না। সেটা বুঝে যেন সে কাজ করে। বলাই বাহুল্য এরপর বিদেশ আর ওয়ার্ক-ফ্রম-হোম করেনি। তার পর বলতে উঠলেন অ্যাকাউন্টের রজত পারেখ। বললেন আহা বিদেশের মতন মিঠি-জুবান আজকালকার দিনের ছেলেদের মধ্যে মেলে না। বলতেই বিদেশের মুখটা বিচ্ছিরি ভাবে একদিকে বেঁকে গেল। এই সেদিনই হিসেব-পত্তর বুঝে নিতে গিয়ে বিদেশ দেখেছিল যে ওঁর হিসেবে গণ্ডগোল আছে। সে কথা বলতেই পারেখসাহেব খেপে গিয়ে তুমুল চেঁচামেচি জোড়েন, তাঁর পঞ্চাশ বছরের অ্যাকাউন্টের জ্ঞান আর সেদিনের বেতমিজ ছোকরা কিনা তাঁর হিসেবে ভুল ধরে! পরে অবশ্য অ্যাকাউন্টসের অন্য ছেলেটির হস্তক্ষেপে ভুলটা সংশোধন হয়। কিন্তু ততক্ষণে গোটা অ্যাকাউন্টসের সবাই জেনে গেছে যে বিদেশের মতো বেয়াদব ছোকরা ভু-ভারতে দুর্লভ! 

সভার শেষ কর্তৃপক্ষীয় বক্তা মানব-সম্পদের নিধি মিশ্র। এক হাতে শাড়ির খসে পড়া আঁচল, আরেক হাতে কপালের উপর নেমে আসা অলকগুচ্ছ সামলাতে সামলাতে তিনি কাতর কণ্ঠে বললেন, বিদেশের মতো কোমলহৃদয় মানুষ সবার আদর্শ। অফিসের কর্পোরেট সোশ্যাল রেস্পন্সিবিলিটির জন্য বিদেশ যা করেছে, তা বলতে গেলে মহাভারত হয়ে যাবে। বিদেশের মনে পড়ল, কিছু দিন আগে একটি গরীব মেয়ের উচ্চশিক্ষার জন্য টাকা সংগ্রহ করছিল সে। ঘুরতে ঘুরতে টাকার আশায় এইচ-আরে যেতেই নিধি মিশ্র ব্যঙ্গ করে বলেছিলেন যে এই সব ফালতু কাজ না করে নিজের কিসে উন্নতি হয়, তাই ভাব। আর একটি পয়সাও চাঁদা দেয়নি। বিদেশের বুকের ভিতরটা কে যেন খামচে ধরল! চোখের সামনেটা অন্ধকার - সব ঝাপসা – যখন আবার সব কালো কেটে গেল, তখন শুধু বুকের মধ্যে যেন একটা পাথর পুরে দিয়েছে কেউ। 

এবার বিদেশের পালা। স্বভাব-লাজুক বিদেশের পক্ষে সবার মাঝখানে বক্তৃতা দেওয়া যে কতখানি বিড়ম্বনা, সেটা জানত বলেই পকেটে একটা কাগজ গুঁজে দিয়েছিল সোমা। সোমার অবশ্য ঘোরতর আপত্তি ছিল এই অকাল-রিটায়ারমেন্টে। কিন্তু বিদেশের গোঁ-র কাছে সে হার মেনেছে। সাধারণ জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় সঞ্চয় হয়ে গেছে তাদের। এবার বিদেশের ছুটি। নামী এমএনসির চাকরী এমন ভাবে কেউ ছাড়ে! অনেক বাক-বিতণ্ডা হয়েছে, চোখের জল ঝরেছে। শেষে বাধ্য হয়ে মানতে হয়েছে সোমাকে। আজকের অনুষ্ঠানে সোমার নেমন্তন্ন ছিল - সে আসতে চেয়েছিল। কিন্তু সেও বিদেশ আসতে দেয়নি। বলেছিল, এই শেষদিনটা আমাকে একা থাকতে দাও, প্লীজ। এরপর তো সবসময়ই তোমার সঙ্গে থাকব। অগত্যা সোমার আর আসা হয়নি। বিদেশ পকেট থেকে কাগজ বার করে পড়তে শুরু করল, গত কুড়ি বছর ধরে আপনাদের সঙ্গে আমার ওঠা-বসা ছিল। এই অফিস ছিল আমার নিশ্বাসে –প্রশ্বাসে ... বুকের ভিতরটা কেমন যেন ফেটে যাচ্ছে – একটু হাওয়া, একটু হাওয়া – আর কিছু মনে নেই বিদেশের। যখন জ্ঞানে ফিরল তখন দেখল সে গুটগুট করে হেঁটে গিয়ে নিজের চেয়ারে বসছে। আর আশ্চর্য! সবাই হাততালি দিচ্ছে। 

তারপর খাওয়া-দাওয়া, গল্পগুজবের পালা। বিদেশকে ঘিরে জটলা চলছিল। এমনিতেও সবারই কৌতূহল যে বিদেশ এবার কি করবে! কোনও প্ল্যান হাতে না থাকতে চাকরী ছাড়ার গল্পটা বিশেষ হজম হয়নি কারোর। বিদেশের অবশ্য কাউকে কিছু বোঝানোর দায় নেই কোনও। তাই সে চুপচাপ শুনছে। কিন্তু তাতেও রেহাই নেই। এক একজনের এক একটা মন রাখা মেকি কথায় বিদেশের এক একটা অঙ্গ অকেজো হয়ে যাচ্ছে। কি যে হচ্ছে কিছু বুঝতে পারছে না বিদেশ। তার এই বেঁকা মুখ, ঠেলে বেরিয়ে আসা মণি – এসব কি এদের কারোর চোখে পড়ছে না! তবে এটুকু বুঝছে যে এখনি এখান থেকে কেটে পড়া দরকার! নিজের পায়ে জোর থাকতে থাকতে। 

কোনওক্রমে সবার থেকে বিদায় নিয়ে বিদেশ বেরিয়ে এলো। নিবারণদা গাড়ীর কাছেই ছিল। কোন ফাঁকে অফিসের লোকেরা এক গাদা উপহারের বাক্স, ফেয়ারওয়েল কার্ড এ সব এনে তুলে দিয়েছে গাড়ীতে। তারপাশে কোনওক্রমে একটু জায়গা করে বসে পড়ল বিদেশ প্রায়-বিকল হওয়া শরীরটাকে নিয়ে। গাড়ীটা যখন বাইপাসে উঠল হঠাৎ বিদেশ গুঙিয়ে উঠল, নিবারণদা দাঁড়ান। একটু সাইড করে দাঁড়ান। ওই যে বড় গাছটা রয়েছে, ওটার পাশে গিয়ে দাঁড় করান। 

তারপর সারা শরীর এক করে সাপটে ধরে ত্রিভঙ্গমুরারী হয়ে এক এক করে সব ঊপহারের বাক্সগুলো নিয়ে গিয়ে জড়ো করল এক ঝুপসি বটগাছের তলায়। সবার উপরে সাজিয়ে রাখল ফেয়ারঅয়েলের কার্ড। তারপর দমাদ্দম লাথি মারতে লাগল তাতে। পা দুটো এখনও সতেজ আছে বুঝি এই জন্যেই। নিবারণ এতক্ষণ গাড়ীর ভিতর থেকে অবাক হয়ে বিদেশের কাণ্ড দেখছিল। এবার তাড়াতাড়ি নেমে এসে বিদেশকে ধরল, দাদা করেন কি, করেন কি! বিদেশ ততক্ষণে ঘেমে স্নান করে গেছে – শার্টটা চপচপে হয়ে গায়ে চিটকে গেছে। আলগা টাইটা কোনক্রমে গলা থেকে ঝুলছে। মাথার চুল উস্কো-খুস্কো। মুখের থেকে লালা ঝরছে। প্রায় অস্পষ্ট উচ্চারণে জড়িয়ে জড়িয়ে বললে, শালা ওরা ভেবেছেটা কি! কটা উপহার দিয়ে আমার বাকী জীবনটাকেও নষ্ট করে দেবে! ওগুলো চোখের সামনে থাকলে আমি কোনওদিন ওই ভামগুলোর মুখ ভুলতে পারব? মাথা তুলে দাঁড়াতে পারব? আমি চাকর, শালা চাকর-ই থেকে যাব সারা জীবন? আমি কাল থেকে রাজার মতো বাঁচব রে, বাঞ্চোতের দল! তোদের উপহারের মুখে আমি মুতি...

তারপর জিভ বার করে কুকুরের মতন হাঁপাতে হাঁপাতে প্যান্টের চেন খুলে হিসি করতে থাকল বাক্সগুলোর উপর। 

নিবারণ পায়ে পায়ে পিছিয়ে গিয়ে আবার গাড়ীতে বসল। এসব নাটক না করে ওগুলো দাদা তাকে দিয়ে দিলেই পারত! কত ক্ষণে এ সব নকশাবাজি বন্ধ হবে কে জানে! তারপর দাদাকে বাড়িতে পৌঁছে বৌদির হাতে গাড়ীর চাবি জমা দিয়ে তবে তার ছুটি। আজকের মতো। আবার কাল, তার পরের দিন, পরের পরের দিন... 

2 comments:

  1. খুব ভালো ।
    দোলা সেন

    ReplyDelete
    Replies
    1. অনেক ধন্যবাদ. এই যে আপনি মতামতটি জানালেন, বড় ভাল লাগল.

      Delete