0

গল্প - পিনাকি

Posted in


গল্প


রক্ত মাখানো মানুষের হাত 
পিনাকি 

১ 

জঙ্গলের ভিতর, নিরাপদ দূরত্বে, হাঁটু গেঁড়ে বসে রয়েছে একটি যুবক। ফর্সা আর ঋজু শরীরের গঠন। দুটো চোখ ভরা আভিজাত্যের ঝলক। ঘাড় ছুঁয়ে রয়েছে ধূসর কালো রঙের কেশগুচ্ছ। সেখানেই এক যুবতীর নরম কনুই ছুঁয়েছে! তপ্ত নিঃশ্বাসে উড়ছে যুবকের খোলা চুলের গোছা। 

যুবকটির পেশীবহুল হাতে ধরেছে একটি ভারী বর্শা। ফলা এতটাই ছুচলো, সে মুহূর্তে শত্রুর দেহ ছিন্নভিন্ন করে দেবে। এই ধরণের অস্ত্র, সকলের কাছে থাকে না, কেননা বর্শার ফলা পাথরের নয়, শক্ত ধাতুর তৈরী। এই ধরণের অস্ত্র প্রয়োগের বিশেষ এক কৌশলে যুবক অত্যন্ত পারদর্শী। তার আর সেই লক্ষ্যটির মধ্যে মাত্র পূর্ণবয়স্ক মানুষের পঞ্চাশ পা দূরত্ব। 

খুব বেশী সময় নষ্ট করা যাবে না। বর্শাটিকে, কাঁধের উপরে রাখল, ডানহাত দিয়ে। বাঁ হাত বর্শাটির মুখের কাছে ধরে, সমস্ত শক্তি দিয়ে ছুঁড়ে দিয়েছে। কিছুক্ষণের জন্য উভয়ের নিঃশ্বাস গিয়েছে থেমে! 

এক দানবীয় প্রাণের হুঙ্কার, নিঃশ্বাসের প্রাবল্য আর ঘাসে ভরা ভূমিতে যন্ত্রণা কাতর আর্তনাদের সঙ্গেই, বিশাল আকৃতির সাপটি মৃতদেহ হয়ে গেল! 

যুবকটি সেই দিকে ছুটে গেল, বেশ কিছুক্ষণ কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে নিশ্চিত হয়েছে, দানব আকৃতির সাপটি এখন মৃত। যুবতীটির দিকে হাত নেড়ে, কাছে আসতে বলল। 

-দেখলি, এই ছিল তোদের ভয়! 

-হ্যাঁ দেখছি। তুমি যদি আজ একে হত্যা না করতে, আমাদের আরও অনেক পরিচিতরা এই দানবের পেটে যেত! বাঁচিয়ে দিলে। 

যুবতীটির কথা শুনে, সদ্য আঠারো বসন্তে পা রাখা যুবকটি বেশ জোরেই হেসে উঠেছে। 

-কিচ্ছু হতো না। পৃথিবীতে অপরাজেয় বলে কিছুই নেই। পরিকল্পনা আর সুযোগ দরকার। আমরা খুব অল্পতেই মাথা নুইয়ে দিয়েছি। আত্মসমর্পণ করে ফেলি! এখানে বাঁচবার নীতি হচ্ছে, লড়াই চালিয়ে যাওয়া। এই যে বর্শাটা দেখছিস, দেখ এর ফলায় শুকনো রক্তের দাগ এখনও শুকিয়ে যায়নি। আমার আগেও এই অস্ত্র ব্যবহার করেছে, আমার পূর্বপুরুষেরা। আমার পরেও ব্যবহার হবে। আমি চাইছি, আমার প্রজারাও যেন এমন অস্ত্র ব্যবহার করতে শেখে। সেটাই একটা জাতির উন্নতির মাপকাঠি। বুঝলি? 

- না, বুঝলাম না। আমার অত বুদ্ধি থাকলে, তোমার রাণী হতে পারতাম। শুধুই সঙ্গিনী হয়ে থাকতাম না! 

মুখে কিছুটা রাগ। থুথনি ছুঁয়ে যুবক বলল – বুদ্ধি নেই বলছিস? 

-হ্যাঁ। 

-সাহস আছে, তাই বা কম কিসের? আমি এখানে এসেছি, তুই সঙ্গে এলি। আর কেউ ভয়ে আসেনি। আমার উপরেও তাদের বিশ্বাস নেই! আসেনি ভালই হয়েছে, নতুবা এই দানব আকৃতির সাপকে দেখে মূর্ছা যেত! পিতাকে বলেছিলাম, কিছু সেনা পাঠাতে। শিকার করব আমিই। তবে, এই দেহ ছিন্নভিন্ন করা। চামড়া ছাড়িয়ে, নিয়ে যেতেও অনেক লোকের দরকার। 

-তুমি চিন্তা করছ কেন? আমার পরিচিতদের খবর দেওয়া আছে। আমরা এখন চলে যাই, ওরা আসুক ... 

-ক্ষেপেছিস! ততক্ষণে দেখবি আমার এই বীরত্বের খবরটা বিষ্ণু নিজের দেবত্ব জাহির করতে ব্যবহার করবে। আর বাবা একবার যদি আমাকে অপদস্ত করবার সুযোগ পায়, বুঝতেই পারছিস। 

-অমন ভাবে বলছ কেন? বৈরাজ মনুর বংশে, রাজা অঙ্গের একমাত্র বংশধর তুমি। বেণের সাহস আর যুদ্ধকৌশল ইতিমধ্যেই বেশ জনপ্রিয়। প্রজারা তোমাকে বরণ করে নিয়েছে। এইসব কিছু রাজা অঙ্গ মেনে নিয়েছেন। তোমাকে ভালোবাসেন বলেই না! 

-তুই অন্তত এই কথা বলিস না! উনি জানেন আমি ওনার বংশধর না হলেও, ওনার বংশকে এগিয়ে নিয়ে যাব। ওনার ক্ষমতাকে ধরে রাখব। আমায় সেই কারণেই মেনে নিয়েছেন। তাই সবাই যেটা দেখে, তা এক অক্ষম মনুর বোঝাপড়া। এই বোঝাপড়াই, পিতার ভালোবাসা বলে ভুল করে সবাই! 

-দেখো, আমি তোমাদের ব্যাপার কিছুই বুঝতে পারিনা। এই যে রাজা অঙ্গ নিজের সন্তান নেই বলে যজ্ঞ করলেন। বিষ্ণুর দয়ায় পুত্র রূপে তোমায় পেলেন। তাও কেন তোমাকে মেনে নিতে পারছেন না? আবার তুমিও বিষ্ণুকে জন্ম থেকেই কেন নিজের শত্রু ভেবে এসেছো? আমার কাছে সবটাই কুয়াশায় ঢাকা। তুমি কেন এমন জ্বালা নিয়ে বেঁচে আছো? আমি টের পাই, তোমার ভিতরে এক তীব্র যন্ত্রণা। আমাকে ভাগ দিতে পারনা? 

যুবকটির নাম বেণ। সে যুবতীকে নাম ধরে ডাকল, 

-বেল্লি, জন্মের বেশ কয়েক বছর পরেই, আমার যখন জ্ঞান হয়েছে, তখন এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছি! বলতে পারিস দুঃস্বপ্নের মুখোমুখি হয়েছিলাম। আমি যেন, ডুবন্ত তরী, কূলের খুব কাছে গিয়েও নিজেকে বাঁচাতে পারিনি। মুদিত চোখে, সেই স্বপ্নের সঙ্গে সহবাস করছি! এক বিভীষিকা, অত শৈশবে দেখেছি। আমার যেই সময়টা ভোরের নরম আলোর নির্মলতা স্পর্শ করত ; নিষ্ঠুর অভিজ্ঞতা আমাকে নির্মম করে দিল! আমি এখন আগ্নেয়গিরি। অগ্নুৎপাত, ক্রমশই অভিসম্পাত করছে আমার অন্তঃকরণে মনভূমিকে। আমি বেঁচে রয়েছি, এটাই অনেক। 

বেল্লি, হাত ধরে বলল – আমায় বলতে পারবে? 

বেণের দুটো শক্ত চোখের কোণ বেয়ে পাতলা জলের রেখা, গড়িয়ে নামছে। চোখ শক্ত, হৃদয় নরম। চোখ প্রকাশ করছে, অন্তর্ভেদী বাতুলতা! হ্যাঁ, কান্নাটা তার কাছে পাগলামো ছাড়া আর কিছু নয়। নিজেকে বুঝিয়েছে, ক্ষমতা দখল আর স্বাধীন থাকাটাই লক্ষ্য। এর জন্য তাকে বড় যোদ্ধা হয়ে উঠতে হবে। 

বেণের চোখের জল, নরম তাম্র বর্ণের চেটো দিয়ে মুছে বেল্লি বলল – আমরা নিরিবিলিতে বসি। আমার লোক আসতে, এখনও অনেক সময় বাকী আছে। তুমি আজ আমাকে বলবে তোমার সেই রহস্যের কথা। হাল্কা হবে। আমি আছি তোমার সঙ্গে। 

-তোমার লোক বলতে? 

- আমার চেনা পরিচিত। আমার পায়রাকে ওদের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছি। ওরাই দানব আকৃতির সাপটির মৃতদেহকে খণ্ডিত করবে। এখন এইসব কথা থাক। 

-তাহলে? 

-তুমি তোমার কথা বলো। 

-শুনবে? এই কথা, এই রহস্য আমি জেনেছি। আমার বংশের লোকের বাইরে সাধারণ প্রজারা জানেনা। 

-আমাকে বলতে পারবে? 

-বলব ... 



২ 

রাজা অঙ্গ বুঝতে পারলেন, তিনি সন্তান উৎপাদনে অক্ষম। তাঁর বংশ আর বেশী দিন মনুর – পদমর্যাদা ভোগ করতে পারবে না! বলতে গেলে বৈরাজ মনুর বংশ, শেষ হতে চলেছে। এক তীব্র যন্ত্রণা নিয়ে তিনি নিজের কক্ষে শুয়ে রয়েছেন। এখন গভীর রাত। কক্ষে একা নিঃসঙ্গ জীবন্ত মৃতদেহ হয়ে রয়েছেন। তিনি নিজেও বুঝতে পেরেছেন, সময় হয়ে এসেছে। বাইরে রাত, নদীর স্রোতের মতনই প্রবাহিণী। 

কালো কাপড় দিয়ে মুখ ঢাকা, দু’জন লোক এসেছে। সঙ্গে রাজার একান্ত সচিব। কক্ষে প্রবেশের অনুমতি চেয়ে নিল। সহচর কানে – কানে বলল – মৃত্যু, লোক গুপ্ত বার্তাবাহক পাঠিয়েছেন। আপনি শুনুন। আমি আসছি। 

সচিব চলে যেতেই, দু’জন লোক কক্ষে প্রবেশ করে হাত জোর করে প্রণাম করল। একজন ভারী গলায় ধীরে –ধীরে বলল - রাজা, আমরা রাজা মৃত্যু প্রেরিত গুপ্ত - বার্তাবাহক। অনুগ্রহ করে আমাদের মুখ দেখাতে বলবেন না। এটা নীতি বিরুদ্ধ। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন, গোপন বার্তা গোপন থাকবে। 

-ঠিক কাছে। এইবার গোপন বার্তাটি বলতে পারো। 

-রাজা মৃত্যু, চাইছেন আপনার বংশ লোপ না পায়। 

-আমি বুঝলাম না। 

-আপনি সন্তান উৎপাদনে অক্ষম। এই সত্য রাজা মৃত্যু জেনে গিয়েছেন। তিনি সহমর্মী এবং সমব্যথী। এখন কথা হচ্ছে, আপনি নিয়োগ প্রথায় রাণী সুনীথার গর্ভে সন্তান দিতেই পারেন। মনে রাখবেন, ভবিষ্যতে সে যে আপনার বাধ্য হবে, তেমন কোনও নিশ্চয়তা আছে কি? 

-তাহলে? 

-আপনি ভাবুন। রাজা মৃত্যু শুধু একটা প্রস্তাব দিয়েছেন। 

-বলো। 

-উনি, রাণী সুনীথার গর্ভে সন্তান দিতে প্রস্তুত। আপনি ভেবে দেখুন। 

এক লহমায়, কেঁপে উঠল রাজা অঙ্গের ভিতরটা। বললেন, 

-পিতা নিজের, কন্যাকে সন্তান দেবে! এমন ধারণা পোষণ করাও যে পাপ! 

-মনুর যুগে, পাপ আর তার শাস্তির বিধান মনু নিজেই ঠিক করেন। আপনি তো বংশধর না পেলে মনুর পদমর্যাদাই ধরে রাখতে পারবেন না। সেই বিষয়ে চিন্তা করুন। স্বয়ং ব্রহ্মা নিজে এই পাপ করেছেন। 

-তাঁকে শাস্তিও দেওয়া হয়েছিল। 

-মানছি। এই মুহূর্তে, এই বিকল্প রাস্তা ছাড়া আর কোনও উপায় দেখা যাচ্ছে না। তাছাড়া, মনুর শাসনে নারী সর্বদা ব্যবহারের উপাদান। যে, যেমন খুশি তাকে ব্যবহার করতে পারবে। নারী কেবলই সমাজের আনন্দের জন্য তৈরী হয়েছে। তাদের উপর কোনও নৈতিকতার নিয়ম নেই। পুরুষ যেমন চাইবে, তেমনই তাদের ভবিতব্য। 

-পিতা হয়ে এমন চিন্তা! 

-না, পিতা না। এক ক্ষমতা প্রিয় গোষ্ঠীপতি মৃত্যু এমন চিন্তাই করবেন। 

-সমাজ স্বীকৃতি দেবে? 

-দেবে। বিষ্ণুর পরিচয়ের স্বীকৃতি দরকার। 

রাজা অঙ্গের সামনে বিকল্প আছে? এই আলো –অন্ধকারে ভরা কক্ষে, তিনি নতুন পথ খুঁজছিলেন ... 

বেণের জন্মের পরেই, সব কিছু পাল্টাতে শুরু করল। রাজা অঙ্গ সিংহাসনে বসলেও, ক্রমশই তিনি নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছিলেন। তিনি দেখতে পাচ্ছিলেন, মৃত্যুর ছায়া যেন শিশু থেকে যুবক হবে। সিংহাসনে বসবে। তিনি বুঝতে পেরেছেন, মৃত্যু এমন ভাবেই মনুর পদমর্যাদা ভোগ করছে! অঙ্গ কিছুতেই এই পরাজয় মেনে নিতে পারছেন না। এই পরাজয় নিয়েই বেণের দিকে তিনি পরাজিত শত্রুর মতনই চেয়ে থাকতেন। 

বেণের কাছে, এক নির্জন দুপুরে, মৃত্যু গোপন কক্ষে, এইসব রহস্য স্বীকার করলেন। ক্ষণিকের জন্য বেণের পা কেঁপে উঠেছে। যাকে মাতামহ মনে করে এসেছে, সে আসলে তার জন্মদাতা! এটা সত্যি না হলেই ভালো হতো। বালক সেই মুহূর্তেই ক্ষমতার প্রাপ্তবয়স্কে উপনীত হয়ে গিয়েছে। তার কাছে সম্পর্ক আসলে ক্ষমতা দখলের সিঁড়ি। সম্পর্কের ভিতরে যত দায়বদ্ধতা, সবটাই যেন স্বার্থসিদ্ধির রক্ষা কবচ! 

সেই দিন থেকে বুঝতে পেরেছে - এই পৃথিবীতে বেণ একা নয়, আরেক জন তার মতনই নিঃসঙ্গ। প্রতারিত। বন্দী। নিজের মা, সুনীথার কথা ভেবেই, খুব কাঁদতে ইচ্ছা করছে। 

সেই দুপুরে মৃত্যু বেণকে নিজের লক্ষ্য সম্পর্কে সজাগ হতে বলেছিলেন। বিষ্ণু এমনিই মৃত্যুর পুত্রকে স্বীকৃতি দেয়নি। এর পরিবর্তে আজীবন, দাসত্বের অঙ্গীকার করতে হবে। এই চুক্তি মৃত্যু মানতে পারবে না। বেণের দায়িত্ব হচ্ছে, অপমানের প্রতিশোধ নেওয়া। মনুর পদমর্যাদায় বসেই, বিষ্ণুর সাম্রাজ্যবাদী চিন্তার অবসান ঘটানো। ক্ষমতা মানেই, তা অন্যের উপর চাপিয়ে দেওয়া নয়। স্বীকৃতি মানেই, দাসত্বের অভিশাপ নয়। 

বেণের কথা যখন শেষ হলো, আকাশের গমগমে সূর্যের তেজ কমে গিয়েছে। সে দেখল, বিল্লির পরিচিতরা - দূরে সাপের খণ্ড –খণ্ড দেহটি, গাছের গুঁড়িতে বেঁধে নিয়ে যাচ্ছে। 

সেখান থেকেই একজন অনুচর এসে বলল - বেণ খবর ভালো নয়। আজ সকাল থেকেই, আপনি এখানে আসবার কয়েক প্রহর বাদেই, রাজা অঙ্গকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না! মনে হচ্ছে তিনি স্বেচ্ছায় সিংহাসন ত্যাগ করেছেন। 

বেণের বুকে যেন কেউ, বর্শা বিঁধে দিয়েছে! কিন্তু কেন? 

এই লোকটির সঙ্গে কোনও সম্পর্কই নেই। তিনি শুধু মাত্র তার পিতার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। পালক পিতাও নন। ছোটবেলা থেকেই বেণ মায়ের কাছেই মানুষ। তাহলে অঙ্গের ভূমিকা কী? আজ এই অপরাহ্ণের বিদায় আলোয় অবগাহন করে, সে বুঝতে পেরেছে --- এখনও তার হৃদয়ে করুণা রয়েছে। ভালোবাসবার তাগিদ রয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে অঙ্গ কোথায় গিয়েছে? সে কি খুঁজে আনতে পারবে? 



৩ 

অমীমাংসিত রহস্যের মতনই অঙ্গ হারিয়ে গিয়েছেন! তিনি যেন ছোট্ট বিন্দু, এই সংসারে তাঁর মিশে যাওয়াটা, তেমন ভাবে প্রভাব ফেলেনি। বেণ খুঁজেছিল, তাও পায়নি। সেই বিন্দুর অদৃশ্য হয়ে যাওয়া অস্তিত্ব আজও, রাতে জাগিয়ে রাখে। একজন মানুষ এমনিই হারিয়ে গিয়েছে, হয়ত বুঝতে পেরেছিলেন অঙ্গ, সিংহাসনে তিনি আর বেশি দিন থাকতে পারবে না। নিজে থেকেই চলে গিয়েছে। 

বেণকে মনুর পদে বসিয়েছে দেশের ঋষিরা। তাদের সংঘের সিদ্ধান্ত-- সিংহাসনে কোনও শক্তিশালী যোদ্ধাকে বসাতে হবে। মনুর পদ দীর্ঘ সময় ধরে ফাঁকা রাখা বিপদজনক। অঙ্গের আচমকাই চলে যাওয়ার জন্য, দেশে অরাজকতা ফিরে এসেছিল। তখনই বেণকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। 

সিংহাসনে বসেই খুব অল্প সময়ের মধ্যেই, বেণ ছাপিয়ে গিয়েছে, আগের মনুদের! সে অন্যান্য মনুদের থেকে অনেকটাই আলাদা। নিজের মতন শাসন করতে ভালোবাসে। প্রজাদের আত্মনির্ভর হতে বলেছে। সে বিশ্বাস করে, এই পৃথিবীতে যে নিজেকে বিশ্বাস করতে পারে না, সে যোদ্ধা নয় ; প্রতিনিয়ত সংগ্রামেও টিকে থাকতে পারবে না। নিজের রক্ষাকর্তা নিজেকেই হতে হবে। 

এখান থেকেই শুরু হয়েছে নতুন করে সংঘর্ষ। 

রাজ্যে বিষ্ণুর আরাধনা নির্দেশ জারি করে বন্ধ করেছে। শুধু তাই নয়, এখন থেকে বিষ্ণুর সঙ্গে কোনও রকমের ব্যবসায়িক সম্পর্ক রাখা হবে না। বিষ্ণু গোষ্ঠীর লোকদের শুল্ক দিতে হবে। যজ্ঞের জন্য কোনও রকমের সহায়তা করা হবেনা। বলা যেতে পারে, বেণের এমন পদক্ষেপের ফলে প্রশাসনের এক অংশ তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করেছে। তারা বিকল্প খুঁজছে, তাই অনেকবার আকার ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিল। 

এইসব কিছু ভাবতে - ভাবতে বিকেলের আলো, মিশে যাচ্ছে সামনের ঝোপে। বহুদিন বাদে মন ভর্তি মনখারাপ নিয়ে বেণ এই অরণ্যে, নিভৃতে – দেখা করতে এসেছে। 

বিল্লি আজ আসবে? মেয়েটা এখন অন্য একজনের যৌন দাসী। বেণের মা, এক পুরোহিতের কাছে উপহার দিয়েছে। এই খবর কানে এলেও, কিছুই করে উঠতে পারেনি। কেননা বিরোধীদের সঙ্গে লড়াইয়ে ব্যস্ত ছিল বেণ। 

আজ অনেকদিন বাদে, কেন জানি বিল্লির কথা খুব মনে পড়ছিল! যে মেয়েটির সংকটে, বেণ পাশে থেকেও, অঙ্গীকার রাখতে পারেনি, সেই বিল্লি আজ আসবে? সে বিল্লির প্রতি অন্যায় করেছে। অন্যের হাতে মেয়েটিকে নাও তুলে দিতে পারত! 

-তুমি, এখন এখানে আসলে কেন? 

ঘাড় ফিরেই বেণ দেখল, বিল্লি এক মুখ উদ্বিগ্নতা নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। 

-তুই! 

-কেন? 

-আমি ভাবতেই পারিনি। আমার জন্য আসবি! মালিক জানতে পারলে খুব মারবে তোকে। আমি কিন্তু বাঁচাতে পারব না। 

-সে আমি মার খাব। আমরা এমনিতেও মনুর যুগে কেউ বেঁচে নেই। আমি তার যৌনদাসী, প্রিয়া নই। বাদ দাও, এখানে এসেছি একটা কথা বলতে - তুমি, সাবধানে বাড়ি যাবে। খবর পেয়েছি ওরা তোমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। প্রজারা তোমার সঙ্গে রয়েছে, তাই সরাসরি যুদ্ধে যাবে না। তাদের তোমার সঙ্গে লড়াই করবার সাহস নেই। গোপনে তোমাকে শিক্ষা দেবে। আমার ভয় করছে ... 

-বিল্লি আমায় মাপ কর। 

-মানে! 

-আমি তোর প্রতি কোনও দায়িত্ব পালন করিনি। অথচ আজ আমার একডাকে এখানে চলে এলি, প্রাণের ভয় করলি না। আমি চুপ না থাকলে, তোকে এমন ভাবে কষ্ট পেতে হতো না! 

বিল্লি হাসতে – হাসতে বলল – আমার কষ্ট না হয় কমত। আমার জায়গায় অন্য কেউ! এমন ভাবেই চলবে বেণ? তুমি পারনা নতুন করে, নিয়ম বাঁধতে? নারীদের অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচাতে হবে তোমাকে। তাই তোমার জীবন আমাদের সকলের কাছে মূল্যবান। আর নারীর ভালোবাসা বলছ? তোমাদের কাছে নারী যৌন দাসী হতে পারে। আমাদের ভালোবাসা খাঁটি। মেয়েরা একবার যাকে ভালোবাসে; বিপদে তাকে ছেড়ে চলে যায় না। আমরা ভালোবাসলে, সব কিছু উজাড় করে দিতে পারি। 

-জানিনা আর কখনোও দেখা হবে কিনা। 

বিল্লির ঠোঁটে চুমু খেয়ে বেণ বলল, আমায় ক্ষমা করে দিস ... 



৪ 

মন্ত্রণা কক্ষে চার পুরোহিত মুখোমুখি বসে রয়েছে। মোটা থলথলে পুরোহিত বাকীদের উদ্দেশ্যে বলল – সময় এসে গিয়েছে। মনে হচ্ছে বেণকে শাস্তি দেওয়ার সময় হয়ে এসেছে। 

-কেউ যদি বুঝতে চায়, আমরা বোঝানোর চেষ্টা করব। কেউ বুঝতে না চায়? দেখো সরাসরি লড়াই করে জিততে পারব না। প্রজা বিদ্রোহ করতে পারে। 

-আমরা ওকে গুপ্তহত্যা করব, সেই কথা কেউ জানতেও পারবে না। 

-যদি জেনে ফেলে! 

-অঙ্গের কথা কেউ জেনেছে? মৃত্যুর পরামর্শ মতন অঙ্গকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিয়েছি। মৃত্যু নিজেও বুঝতে পাচ্ছে, শুধু বিষ্ণুই নয় এরপর বেণ রাজা, নিজের জন্মদাতা মৃত্যুর বিরোধীতা করতেও পিছপা হবে না! মায়ের উপর হওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ করবে। আমরা বলতেই পারি মৃত্যু এই হত্যার প্রতিবাদ করবে না। ক্ষমতাই শেষ কথা... 

খুব সকালে কুয়াশাচ্ছন্ন দিনের আলোয়। জনপদের পাথর ছড়িয়ে থাকা রাস্তায়, বিল্লি দেখল-- প্রজাদের ভিড়ের মধ্যেই ভূমিতে শুয়ে রয়েছে, বেণের প্রাণহীন দেহ। সামনে সুনীথা, জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। সবাই বলছিল, বিষ্ণুর বিরোধীতায়, তার ভক্তরা সামান্য কুশ ঘাসের দ্বারা হত্যা করেছে। বিষ্ণু এমনই ক্ষমতাবান। তার স্তুতি অবজ্ঞা করবার শাস্তি পেয়েছে বেণ। 

বেণের নীল হয়ে যাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে বিল্লি মনে – মনে বলল - বিষ! তীব্র বিষের চিহ্ন। 

ওই চোখ দু’টো খুব শান্ত। এমন মৃত্যুই সে চাইছিল কি? সরাসরি লড়াই করবার সাহস, এদের নেই। সবাই ষড়যন্ত্রকারী। 

বিল্লি দেখছে, মানুষগুলোর হাতে রক্ত মেখে রয়েছে! অদৃশ্য ষড়যন্ত্রের রক্ত।

0 comments: