প্রাচীন কথা - অনিন্দিতা মণ্ডল
Posted in প্রাচীন কথা
প্রাচীন কথা
রাজোচিত
অনিন্দিতা মণ্ডল
পর্ব ৪
উৎসব শুরু হয়ে গিয়েছে। যুদ্ধও। ত্রিগর্তর সাধারণ মানুষজন যুদ্ধ নিয়ে খুব যে চিন্তিত তা নয়। যুদ্ধ রাজার কর্ম। রাজায় রাজায় ক্ষমতার লড়াই চলবে। সৈন্যরা সে লড়াইয়ে প্রাণ বাজি রাখবে। সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা তাইতে ব্যাহত হবে কেন? অন্তত এই ভূখণ্ডে তেমনটাই রীতি। বিতস্তার দুই পারে আপাতত সমরসজ্জা সম্পূর্ণ। পশ্চিমতীরে গ্রীক সৈন্যদল। সুবিশাল শৃঙ্খলাপরায়ণ বিরাট বাহিনী। সম্মুখে পদাতিক। তারপর অশ্বারোহী। একেবারে পিছনে রথ। দুই পাশ থেকে তূরী ভেরি দামামা শঙ্খ বাজিয়ে চলেছে যুদ্ধের আহ্বায়ক সৈন্যরা। পূর্বতীরে অপেক্ষাকৃত ছোট সৈন্যবাহিনী। এই বাহিনীর অশ্বগুলিকে অশ্ব না বলে অশ্বেতর বলাই সমীচীন। পার্বত্য ভূমিতে এদের বহুল ব্যবহার। ভালো মোট বইতে পারে। তবে অশ্বের মতো ক্ষিপ্র বা বুদ্ধিমান নয়।
সেনাপতি জয়বর্মা এবং যুবরাজ পরমানন্দ শলা করেছেন। যুবরাজের বক্তব্য, রাজাকে সম্মুখসমরে নেতৃত্ব দিতে না দেওয়াই ঠিক। বয়স হয়েছে। শত যুদ্ধে জয়ী তিনি। এবার একটু বিশ্রাম করুন। যুবরাজ নবীন। তিনিই বরং সামনে থেকে যুদ্ধ করার অভিজ্ঞতা লাভ করবেন। শত্রু ও সমর তো রাজনীতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যতদিন রাজ্য থাকবে ততদিন রাজার প্রাথমিক দায়িত্ব রাজ্যকে শত্রুমুক্ত রাখা। জয়বর্মা যুবরাজের কথায় খুশি। তবে কেমন যেন বুঝতে পারছেন যে এ শত্রু সহজ নয়। সমগ্র আকামেনেদীয় সাম্রাজ্যকে যে পদানত করেছে তাকে শৃগাল ভাবা ভুল। যুবরাজ ছেলেমানুষ। অনভিজ্ঞ। এই বয়সে কিছু দুঃসাহস ধরছেন বুকে। তার ওপরে গূঢ়পুরুষ খবর দিয়েছে যে এই যবন রাজপুত্র যুদ্ধের নিয়মনীতি ব্যাপারে আসুরিক। আক্রান্ত রাজ্যের প্রজাদের ওপরে ভীষণ নির্যাতন করে। নারীধর্ষণ, শিশুহত্যা কিছুই বাদ যায়না। মানুষ ভয়ে অত্যাচারে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। সৈন্যরা মনোবল হারিয়ে ফ্যালে। এই ধরণের যুদ্ধের সঙ্গে ইন্দ্রস্থান পরিচিত নয়। জয়বর্মা মনে মনে ভাবছেন, এ কি রাজার নীতি? রাজার চরিত্রে এমন নীচতা কি করে থাকে? প্রজা মাত্রই তো রাজার সন্তান। যে রাজ্য অধিকার করতে চলেছি জয় হলে সে রাজ্যের প্রজারাও তো সন্তান হবে! রাজার প্রতি অসন্তুষ্ট প্রজাদের কি করে শাসন পালন করা সম্ভব? তিনি যুবরাজকে বলতে চাইলেন, রাজা নিজে এ যুদ্ধের নেতৃত্ব দিলে মঙ্গল। কিন্তু যুবরাজ স্মরণ করিয়ে দিলেন। “আচার্য জয়বর্মা, ভিক্ষু সোমদেব কিন্তু বলেছেন এ যুদ্ধে গ্রীক রাজপুত্র পরাজিত হবেন। তবে তার সঙ্গে এও বলেছেন, এ যুদ্ধে ত্রিগর্তর একটি বড় হানি হবে। পিতাকে নিয়ে আমার চিন্তা হয়। ত্রিগর্ত কোনোভাবেই তার রাজাকে হারাতে পারেনা।” জয়বর্মা চমকিত হলেন। যুবরাজ পিতার প্রাণের আশঙ্কা করছেন। ঠিক একইভাবে পিতা পুত্রকে নির্দেশ দিয়েছেন অপেক্ষাকৃত নিরাপদ স্থানে সৈন্য নিয়ে যাবার। রাজা নিজে এই অজেয় বিদেশীকে যুদ্ধে পরাজিত করতে চান। পুত্রের কোনও ক্ষতি না হয়। আপাতত জয়বর্মা রাজপুত্রের মতকে গুরুত্ব দিলেন। তাঁর নিজের ওপরে ভরসা কিছু কম নয়। দক্ষ সেনাপতি তিনি। যুবরাজকে সর্বপ্রকারে রক্ষা করতে তাঁর অসুবিধে হবার কথা নয়।
বিতস্তার তীরে এসে আলেকজান্ডার বিপুল বিস্ময়ে লক্ষ করলেন ছোট একটি সৈন্যদল এসেছে তাঁর এত বড় বাহিনীর মোকাবিলায়। ভিতরে ভিতরে উত্তপ্ত হয়ে উঠছেন। এরা কি তাঁর শক্তিকে হীন ভেবেছে? মাত্র একশো কুড়িটি রথ ও কিছু অশ্বারোহী দ্বারা সজ্জিত সেনাবাহিনী তাঁর বিরুদ্ধে জ্যদ্ধে এসেছে? তিনি যুদ্ধ আরম্ভের নির্দেশ দেবেন, ঠিক তখনই চোখে পড়ল ছোট সৈন্যদলটির পিছনে যেন ঘন মেঘের ছায়া। দিগন্ত চোখে পড়েনা। অরন্য বা শ্যামল বনানীও নজরে আসেনা। এমন ঘনঘোর জলদ সমাগম! বিচিত্র! কিন্তু মেঘের এমন অদ্ভুত গতি কেন? তারা আকাশ ছেড়ে বসুধা আশ্রয় করেছে কেন? তিনি শ্যেন দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করছেন। এবং স্তব্ধ হয়ে দেখছেন, এ মেঘ নয়। এ এক প্রকাণ্ড হস্তীযূথ। রণহস্তীই নিশ্চিত। অসম সাহসী তিনি। এ অভিজ্ঞতা আগে না থাকলেও তাঁকে যুদ্ধ করতেই হবে। দুপক্ষে শঙ্খধ্বনি রণভেরী বেজে উঠেছে। দুপক্ষের অশ্বারোহী ও পদাতিক সৈন্য একে অপরের দিকে এগিয়ে চলেছে। গ্রীক সৈন্য প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত। নিমেষে এক বর্গাকার ব্যুহ রচনা করে ত্রিগর্তর সৈন্যদলকে ঘিরে ফেলতে লাগল। উল্লসিত গ্রীক সৈন্যদের হর্ষধ্বনি যুদ্ধক্ষেত্র ভরিয়ে ফেলছে। এমন সময়ে সেই বিপুল হর্ষধ্বনি ছাপিয়ে যেন বজ্রপাতের শব্দ হলো। কিন্তু ঠিক বজ্রপাত নয় তো! এ যেন কোনও বিপুলকায় পশুর স্বর! সেনাপতি জয়বর্মা লক্ষ করেছেন, যেভাবে গ্রীকসৈন্য ব্যুহ রচনা করেছে, আর যে অল্প সময়ে এই পদাতিক ও অশ্বারোহীদের ঘিরে ফেলেছে যে প্রতিব্যুহ রচনা করার সময় আর নেই। তিনি একটি তীক্ষ্ণ শিষ দিয়ে সেই হস্তীযূথের দিকে ফিরে দাঁড়ালেন। ততক্ষণে ত্রিগর্তর বহু পদাতিক ও অশ্বারোহী ভূমিশয্যা নিয়েছে। বিপক্ষের সে তুলনায় সামান্যই। তাঁর শিষে এক সম্মিলিত বৃংহণ যেন বজ্রপাতের মতোই শোনালো। গ্রীক সৈন্য যেন থমকে দাঁড়ালো। জয়বর্মা আর একটি শিষ দিয়ে ব্যুহ মধ্যে অশ্বারুঢ় যুবরাজ পরমানন্দের প্রতি নির্দেশ দিলেন। মুহূর্ত মধ্যে অশ্ব ও হস্তীপৃষ্ঠ থেকে শত শত পাথরের গোলা ছুটে যেতে লাগল গ্রীক সৈন্যদলের দিকে। চমকিত গ্রীক সৈন্য হতচকিত হয়ে পড়ল। আলেকজান্ডার নিজে অমিতবিক্রমে যুদ্ধ করে চলেছেন। সহসা তাঁর সামনে এসে পড়েছে একটি শ্বেতশুভ্র অশ্ব। রাজকীয় গরিমা তার ভঙ্গিমায়। অশ্বটির উপরে বসে আছেন যুবরাজ পরমানন্দ। মুক্ত তরবারির সংঘাত অনিবার্য। অথচ দুই যোদ্ধা পরস্পরের দিকে নিস্পলক চেয়ে আছে। যুবরাজ দেখছেন এক অনিন্দ্যকান্তি দেবতুল্য রাজপুরুষ মুক্ত তরবারি হাতে আক্রমণে উদ্যত। কিন্তু তিনিও মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়েছেন। এই অবসরে অন্য একটি গ্রীক অশ্বারোহী পাথরের গোলা হানল যুবরাজ পরমানন্দর দিকে। গোলাটি পলকে যুবরাজের মাথায়। অশ্বপৃষ্ঠ থেকে পড়তে পড়তে যুবরাজের মুখ নীল হয়ে গেলো। আচার্য জয়বর্মা ঘটনার আকস্মিকতায় হতচকিত হয়ে গেলেন। ততক্ষণে গ্রীক সৈন্য মহা উল্লাসে জয় ঘোষণা করে ফেলেছে। আচার্য জয়বর্মার সামনে থেকে গ্রীক সৈন্য গমনোদ্যত হতেই তিনি পুনরায় শঙ্খ বাজালেন। এর অর্থ সকলেই বোঝে। যুদ্ধ শেষ হয়নি। রাজা এখনও যুদ্ধে নামেননি।
ত্রিগর্তর স্কন্ধাবারে একটি শুভ্রশয্যায় শয়ান যুবরাজ পরমানন্দর দেহ। শরীরে কোনও ক্ষতচিহ্ন নেই। সম্ভবত মস্তিষ্কে আভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণেই মৃত্যু ঘটেছে। বিপক্ষ সৈন্য শিরে আঘাত হেনেছিল। মুহূর্তের অসাবধানতায় জয়বর্মা পাশের রথের দিকে মনোযোগ হারিয়েছিলেন। যুবরাজ নিশ্চয় নিশ্চিন্ত ছিলেন। সেনাপতি স্বয়ং তাকে ছায়ার মতো রক্ষা করছেন। কিন্তু কি অদ্ভুত! এতটুকু ছিদ্র দিয়ে মৃত্যু এগিয়ে এলো! অথচ জয়বর্মা যুবরাজের প্রতি আস্থা রেখেছিলেন। ভারী বুদ্ধিমান। কি কৌশলে যে গোলাবর্ষণ করে বিপক্ষের সৈন্যদের ব্যুহ ছত্রভঙ্গ করে চলেছিলেন! এখন সমূহ বিপর্যয়। যুদ্ধক্ষেত্রে আহত হবার পর জয়বর্মা যুবরাজকে স্কন্ধাবারে শুশ্রূষার জন্য পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তখনও দেহে প্রাণ ছিল। আবশ্যিক চিকিৎসার কথা জানিয়ে তিনি নিজে যবন সৈন্যকে বিপুল আঘাতে পর্যুদস্ত করেন। যবন সৈন্য পিছু হটে ফিরে গিয়েছে। নতুন কৌশল নিয়ে আক্রমণ করবে আবার। তিনি দুর্গে সংবাদ পাঠিয়েছেন। রাজপুত্র বীরের মৃত্যু বরণ করেছেন। দুর্গের দিক থেকে দীর্ঘ সময় ধরে শঙ্খধ্বনি শোনা যাচ্ছে। এ ধ্বনি বীরের সদ্গতির কথা জানান দিচ্ছে। প্রজাদের গৃহ থেকে প্রতিধ্বনি উঠছে সেই শঙ্খধ্বনির। ধীরে ধীরে সারা রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ছে রাজপুত্রের বীরগতির কথা।
0 comments: