Next
Previous
Showing posts with label রম্যরচনা. Show all posts
0

রম্যরচনা - ধ্রুবজ্যোতি চক্রবর্ত্তী

Posted in


রম্যরচনা


শ্রীকমলাকান্ত উবাচ - ২
ধ্রুবজ্যোতি চক্রবর্ত্তী 




ডিজিটাল পৃথিবীতে অ্যানালগ জীবনযাত্রা 

আজকাল লিখতে বসলেই কমলাকান্ত এসে হাজির হয়। 

লক্ষ্য করে দেখেছি মাঝরাতে আমার দাদামশায়ের প্রিয় কুক কেলভি দেওয়াল ঘড়িটা যখন রাত বারোটার বারো নম্বর ঘণ্টাটা পিঠছে ঠিক তখনই আমি আমার লেখার টেবিলের আশেপাশে তার উপস্থিতিটা উপলব্ধি করতে পারি। 

ঠিক বলে বোঝানো মুশকিল, তবে সদাশিব সরল ব্রাহ্মণ মানুষটির হালকা শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ ঘরের চলন্ত সিলিং ফ্যানের আওয়াজকে ছাপিয়ে খুব মৃদু ভাবে আমার কানে আসে; আর সেই সঙ্গে প্রসন্ন গোয়ালিনীর খাঁটি দুধ-দই-ননী লাঞ্ছিত শরীরের পাগল করা একটা কস্তুরী গন্ধ আমায় বিচলিত করে তোলে। মনে হয় আমার লেখার টেবিলের ওপর রাখা ল্যাম্প শেডটার আলোর উজ্বলতাটাও যেন একটু কমে আসে… এই রকম আরও বেশ কিছু ঘটনার ঘনঘটা, যা শাণিত বুদ্ধি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না, আমায় সচকিত করে তোলে। 

বুঝতে পারি কমলাকান্ত আমার সাথে তার নিত্যকার বৈঠকি আলাপ-আলোচনায় এসে হাজির হয়েছে। আসলে সেও আফিম ভক্ত আর আমিও এইসময় আমার নিত্যকার গাঁজাখুরি লেখাপত্তরের সেরস্তায় গতি আনবার জন্য একটু সোমরসাসিক্ত থাকি। তাই দুজনের ভাবের আদানপ্রদানটা বেশ মনোহর হয়ে ওঠে। 

কমলাকান্তের সঙ্গে এই নিয়মিত আড্ডাটা আমার কাছে ধীরে ধীরে বেশ আকর্ষনীয় হয়ে উঠেছে। আমি তাই আমার লেখার টেবিলের পাশে আর একটা চেয়ারের ব্যবস্থা করে রেখেছি। প্রথম ক’দিন সে একটু কিন্তু-কিন্তু করলেও কয়েকদিন পর থেকে দেখলাম বৃটিশ সায়েব-সুবোদের আমলে ভারতীয় নেটিভদের কেদারায় বসার অমার্জনীয় অপরাধের ভয়টা সদালাপী নিরীহ ব্রাহ্মণ কাটিয়ে উঠেছে। এখন তাই তিনি চেয়ারে বসাটা বেশ রপ্ত করে ফেলেছেন। খেটো ধুতির কোঁচাটা দিয়ে চেয়ারটা একটু ঝেড়ে নিয়ে বসে পড়েন। শুধু বসার ঢংটা পাল্টাননি। জোড়াসনে বসার অভ্যাসটা তিনি পরিত্যাগ করে উঠতে পারেননি। আর আমিও তাই প্লাস্টিকের হাতলওয়ালা চেয়ারটা সরিয়ে নিয়ে আমার দাদামশায়ের হাতলহীন একটা কাঠের চেয়ার আমার লেখার টেবিলের পাশে রেখে দিয়েছি। 

গিন্নী একবার ঘর পরিষ্কারের সময় অবাঞ্ছিত সেই চেয়ারটা দেখে ভুরু কুঞ্ছিত করে উঠতেই আমি তড়িঘড়ি করে বলে উঠেছিলাম, “আসলে পুরোনো আমলের কিছু লেখা লিখতে গেলে আমি লক্ষ্য করে দেখেছি যে এই অ্যান্টিক চেয়ারটায় বসলে আমার লেখাতে বেশ একটা সমসাময়িক প্রভাব পড়ে আর সেটা লেখার মানও বহুগুন বাড়িয়ে তোলে।” 

গিন্নী “পাগলে কি না বলে আর ছাগলে কি না লেখে” টাইপের একটা লুক দিয়ে আমায় ক্ষমাঘেন্না করে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলে আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলাম!

ভীষ্মদেব খোশনবীস মহাশয় কমলাকান্তকে বড়ই দাগা দিয়েছিলন। নিরুদ্দেশ হবার আগে কমলাকান্ত তার দপ্তরটি ভীষ্মদেববাবুর জিম্মায় রেখে দিয়ে গেছিলেন। কিছুদিন পর ভীষ্মদেববাবু কমলাকান্তেরর সেই দপ্তরটি বঙ্গদর্শন পত্রিকার সম্পাদকের কাছে বেচে দিয়ে কিছু কামিয়ে নিয়েছিলেন। পরবর্তী কালে কমলাকান্ত সেটা জানতে পেরে খুবই মর্মাহত হয়। তাই আমার সাথে দেখা হবার সময় কমলাকান্তকে খুবই বিমর্ষ দেখতে পেতাম। দপ্তর লেখা তো সে ছেড়েই দিয়েছে উপরন্তু কোন কাজে ঠিক মন দিতে পারে না। 



(২) 

তারপর ধীরে ধীরে আমার সাথে তার নিয়মিত যোগাযোগের ফলে সে অনেকটা সহজ হবার পর সে আমাকে তার মনঃকষ্টের কথা জানায়। সেটা শুনে আমি অত্যন্ত মর্মাহত হয়ে তার সমব্যাথী হই। আমার গিন্নীর মতে যতই ছাইভস্মের লেখা লিখি না কেন আমি সত্যি সত্যি লেখক কমলাকান্তের মনের দুঃখের গভীরতাটা ভীষণ ভাবে উপলব্ধী করতে পেরেছি। আমাদের এই আত্মিক যোগাযোগের ফলেই কমলাকান্ত আস্তে আস্তে আমার কাছে তার সেই হারানো রহস্যময় হাসি নিয়ে খুশীয়াল রূপে আবার ফিরে এসেছে।

এরপর একদিন সুযোগ বুঝে তাকে আমি আবার তার দপ্তর লেখার কাজে আবার মনোনিবেশ করতে বলাতে সে ভীষণ ভাবে উত্তেজিত হয়ে ওঠে। তারপর আমাকে আমার লেখার কলমের দিব্যি দিয়ে অঙ্গীকার করিয়ে নেয় যে ভবিষ্যতে আমি যেন আর কোনো দিনও তাকে এই অনায্য অনুরোধটি না করি। আর যদি করেই বসি তাহলে সেইদিনই আমাদের বন্ধুত্বতার সমাপ্তি ঘটবে। নাক-কান মুলে তার কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নিলেও আমি সেদিন বুঝতে পেরেছিলাম যে ভীষ্মদেব খোশনবীসের ওপর কি ভয়ানক এক অভিমানে এই সরল সাত্বিক ব্রাহ্মণ তার লেখনীকে গলা টিপে হত্যা করে বসে আছে। 

এরকম একটা অত্যন্ত গুরুতর বিষয়ে আমার আর বিশেষ কিছু বলার নেই। তবুও আমি শুধু এটুকুই বলতে চাই যে কমলাকান্তের দপ্তরটি বঙ্গদর্শন পত্রিকার সম্পাদকের কাছে বেচে দিয়ে ভীষ্মদেব খোশনবীস মহাশয় ক’টি স্বর্ণমুদ্রার মালিক হয়েছিলেন সেটা আমার সঠিক জানা নেই বটে তবে তিনি বঙ্গসাহিত্য জগতের যে প্রভূত ক্ষতি চিরকালের তরে করে দিয়ে গেছেন সে বিষয়ে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। 

আজ তাই এই অত্যন্ত হাই IQ সম্পন্ন ঊনবিংশ শতাব্দীর ব্রাহ্মণ যখন একবিংশ শতাব্দীর সমস্যা সকল নিয়ে আমার সাথে আলোচনায় বসে তখন আমি যারপরনাই স্তম্ভিত হই আর এই ভেবে দুঃখ পাই যে বঙ্গসাহিত্য বর্তমান যুগের কমলাকান্ত’র দপ্তর নামক কি এক আনমোল রতন থেকে বঞ্চিত হয়েছে।

আমার এই সমস্ত লেখাই আমাদের মধ্যে ঘটিত আলোচনার ফসল মাত্র। এতে আমার বিন্দু মাত্র কোনো কৃতত্ব নেই। এই লেখাগুলোতে যা কিছু কমতি আছে তা সবই আমার। আমার একবিংশ শতাব্দীর অপরিণত মস্তিষ্ক ঊনবিংশ শতাব্দীর সেই ক্ষুরধার বুদ্ধি সম্পন্ন ব্রাহ্মণের সমস্ত যুক্তিপূর্ণ কথার সঠিক মূল্যায়ণ না করতে পারবার ফলে এই অপাংতেয় রচনাটিতে বহু কৃষ্ণগহ্বরের সৃষ্টি হয়েছে বলেই আমার ধারনা। 

যাইহোক আজ দেখলাম কমলাকান্তের মেজাজটি বেশ শরীফ। হাতলহীন কেদারায় জোড়াসনে বসে সে আমায় জিজ্ঞেস করে, “বলি লেখক, এক পয়সার কালি আর দু-পয়সার কাগজে তো হাবিজাবি অনেককিছুই লিখিয়া যাও, বলি বর্তমান কালের খবর কিছু রাখ?” 

তার কাছ থেকে এই প্রশ্ন শুনে আমি যাকে বলে বাক্যিহারা! 

মনে মনে বেজায় রেগে গেলেও বুঝলাম পাগলা ব্রাহ্মণ ক্ষেপে গেলে আখেরে আমারই ক্ষতি। আজকাল বঙ্গসাহিত্য জগতে লেখার প্লটে বড্ড একঘেয়েমিতা এসে গেছে। সেই ধর্ষণ, খুন, জখম, পরকীয়া প্রেম, রূপোলী পর্দার গুজব, সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ আর দেশের রাজনৈতিক নেতাদের সার্কাস আর তার সঙ্গে পুটিন-কিম-জিং আর ট্রাম্প সাহেবদের “এই দিলাম তোদের মাথায় এটম বোম ফাটিয়ে” ধরনের তর্জন-গর্জন! এই ব্রাহ্মণের দৌলতে মরুভূমিতে মরুদ্যানের মত কিছু বৈচিত্রের সন্ধান পাওয়া যায় দেখে তার বিরুদ্ধাচরন করি না কখনও। দেখাই যাক আজ কমলাকান্তের রহস্যময় ভাঁড়ার থেকে কি হীরে জহরত আত্মপ্রকাশ করে! 



(৩)

তাই একগাল হেসে জিজ্ঞেস করি, “না মানে সেরকম অঘটন ঘটাবার মত কোনো খবর তো আমার কাছে আসেনি। এই তো সবে আমার ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটস অ্যাপ, স্ন্যাপ চ্যাট সমস্ত অ্যাকাউন্ট থেকে আপডেটেড হয়েই তো সবে লেখার টেবিলে এসে বসতে না বসতেই আপনি এসে হাজির।”

আলো আঁধারির ধূপছায়ায় দেখতে পেলাম কমলাকান্তের মুখে সেই রহস্যময় মুচকি-মুচকি হাসিটা আবার ফিরে এসেছে যেটা দেখে প্রায় দু-শতাব্দী আগে এক এজলাসের চাপরাশী কমলাকান্তকে জিজ্ঞেস করেছিল,“হাস কেন?”

কমলাকান্তের দিকে তাকিয়ে দেখি সে তার ঊড়ুনিটা দিয়ে একবার ভাল করে মুখটা মুছে নিল। পথশ্রমের ক্লান্তি থেকে নিজেকে মুক্ত করে কোমরের গেঁজে থেকে একটি রূপোর চ্যাপ্টা ডিবে কৌটো বের করে এনে সেটা একটু চাপ দিয়ে খুলে তার থেকে গুঁড়ো দুধের ছোট্ট একটা প্যাকেট বের করে আনল। চোখ তুলে আমার হাঁ-করা মুখের দিকে তাকিয়ে একটু মুচকি হাসল মাত্র। আমি অবাক চোখে তার কার্যকলাপ দেখে যেতে লাগলাম। 

নীল রঙের ছোট্ট দুধের প্যাকেটটা হুবহু তারকা হোটেলের ঘরে রাখা কমপ্লিমেণ্টারি চায়ের সরঞ্জামের সঙ্গে দেওয়া গুঁড়ো দুধের প্যাকেটের মতো। শিবরাম এই গুঁড়ো দুধকেই বোধহয় “রাবড়ি চূর্ণ” বলতেন। 

কৌতুহল বশতঃ কমলাকান্তর খোলা চ্যাপ্টা ডিবের দিকে নজর করে দেখি ডিবেটিতে বেশ কতকগুলো ছোট ছোট ধূসর রঙের মার্বেলের গুলির মতন জিনিস। 

বুড়ো আঙুল আর তর্জনী দিয়ে ডিবে থেকে একটি গুলি তুলে আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়েই মা’কালীর মতন এক হাত লম্বা জিভ কেটে কমলাকান্ত বলে ওঠে, “ও…হো…হো, তুমি তো আবার এ-রসে বঞ্চিত।” বলেই হাতের গুলিটি গালে ফেলে গুঁড়ো দুধের ছোট্ট প্যাকেটটি একটানে ছিঁড়ে মুখের মধ্যে প্যাকেটের পুরো দুধটা ঢেলে দিল। তারপর তারই জন্য নির্দিষ্ট আমার টেবিলে্র ওপরে রাখা পেতলের ঘটির জল খানিকটা মুখে নিয়ে কুলকুচো করে গিলে ফেলল। 

আমার হাঁ-করা মুখের দিকে তাকিয়ে কমলাকান্ত বলে ওঠে, “এক্ষণে তো আর প্রসন্ন নাই, তাই আফিমের সঙ্গে প্রয়োজনীয় দুধের ব্যবস্থা এই প্রকার সাব্যস্ত করিয়াছি। অস্থানে-কুস্থানে দুধের জন্য আর ঘুরিয়া মরিতে হয় না। প্রসন্ন বিহনে কিয়ৎকাল বড়ই অসুবিধা হইয়াছিল। এক্ষণে আর কোনো সমস্যা নাই।”

আমার হাঁ-করা মুখের অবস্থা বড়ই করুণ। মাঝে-মাঝেই চিমটি কেটে দেখতে ইচ্ছে করছে “একি সত্য, সত্য… সকলই সত্য?” কিনা! কিন্তু পাছে আমার সন্দেহবাতিকতার জন্য কমলাকান্ত চটে গিয়ে ফেরত চলে যায় এই ভেবে ভয়ে ভয়ে আমি স্ট্যাটাসকো বজায় রাখলাম। 

আফিমের মৌতাতে চোখ বুঁজে বুঁদ হয়ে জোড়াসনে আদুড় গায়ে বসা শুভ্রকান্তি কমলাকান্ত যেন কোনো এক ধ্যানস্থ ঋষি। নিমীলিত আঁখিতে একটা শান্ত স্নিগ্ধ ভাব। সারা ঘর জুড়ে এক অদ্ভুত প্রশান্তি বিরাজ করছে। 

আমি সেই নিস্তবদ্ধতাকে সম্মান জানিয়ে নিশ্চুপ হয়ে অতি ধীরে ধীরে আমার নিশ্বাস-প্রশ্বাসকে জারি রাখলাম। 

কিছুক্ষন পরে কমলাকান্ত চোখ খুলল। মুখে আবার তার সেই রহস্যময় হাসিটা ফিরে এসেছে। এবার পূর্ণ দৃষ্টিতে সে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “বলি লেখক মশাই, ক্রিষ্টোফার নোলানের নাম শুনিয়াছ কি?”

আমি আমতা আমতা করে বললাম, “হ্যাঁ...মানে শুনেছি বটে তবে এখন সঠিক মনে আসছে না।”

“আচ্ছা, তুমি তো বিলিতি চলচিত্র দেখিয়া থাক বলিয়া জানি।” কমলাকান্ত আমার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। 


(৪)

ঝটিতি মনে পড়ে গেল যে অস্কার প্রাপ্ত “ডানকার্ক” নামক বিখ্যাত ইংরেজি সিনেমার প্রখ্যাত পরিচালক হচ্ছেন ক্রিষ্টোফার নোলান। অতি সম্প্রতি তিনি তাঁর প্রযোযোক পত্নী ও চার পুত্র-কন্যাসহ মুম্বাই শহর ঘুরে গেছেন। অতি গর্বের সঙ্গে তৎক্ষণাত কমলাকান্তের কাছে আমি আমার সাধারন জ্ঞানের বহরের পরিচয় জাহির করি। 

কমলাকান্ত আমার প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের পরিচয় পেয়ে বলে ওঠে, “অতি উত্তম।”

গর্বে আমার বুকের ছাতি ফুলে ওঠে। মুখে আমি একটা সবজান্তা ভাব জাগিয়ে কমলাকান্তের দিকে তাকিয়ে থাকি। চোখদুটো আবার বুজিয়ে ফেলে কমলাকান্ত আবার ধ্যানস্থ। সেই অবস্থায় আবার বলে, “সংবাদপত্রের এক সাক্ষাৎকারে নোলান সাহেব কি বলিয়াছেন তাহার খবর রাখ কি?”

এইবার বিপদে পড়লাম। 

সাহেব সপরিবারে দিন কয়েকের জন্য মুম্বাই শহরে এসেছিলেন এই খবরটা খবরের কাগজে দেখেছি; তবে খবরের ভেতরে ঢোকা হয়নি। লজ্জার মাথা খেয়ে স্বীকার করে নিতেই হলো যে সাহেবের সাক্ষাৎকারটা আর পড়া হয়ে ওঠেনি। 

আমার কথাটা ধর্তব্যের মধ্যে না এনে কমলাকান্ত বলে ওঠে, “সাহেব একটা বড় ভাল কথা বলিয়া গিয়াছেন। আমার খুব মনে ধরিয়াছে বলিতে পার।”

আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই কমলাকান্ত বলে ওঠে, “আমার ইংলন্ডের রাণীর আমলের ভঙ্গুর ইংরেজী অভ্যাস আর বর্তমান কম্পিউটার যুগের অর্ধ কলস পূর্ণ জ্ঞান দ্বারা যাহা বুঝিয়াছি, তোমার আপত্তি না থাকিলে তাহার দ্বারা তোমাকে একপ্রকার বুঝাইতে সচেষ্ট হইতে পারি।” 

বুঝতে পারলাম কমলাকান্ত আজ একটা বিশেষ মিশন নিয়ে আমার সাথে এক ওজনদার আলোচনায় বসতে এসেছে। কাজেই না বলবার প্রশ্নই ওঠে না।

আমার আপত্তি নেই শুনে খুশী হয়ে কমলাকান্ত শুরু করে, “সংবাদপত্রের সাংবাদিক সাহেবকে প্রশ্ন করিয়াছিল যে আপুনি এই ডিজটাল যুগে বাস করিয়াও চলমান দূরভাষ এবং বৈদ্যুতিন ঠিকানা, (মানে তোমরা যাহাকে মোবাইল ফোন আর ই-মেল বলিয়া থাক আরকি!) ব্যতীত জীবনযাত্রা কি করিয়া বহন করিয়া চলিতেছেন? সাহেব মুচকি হাসিয়া উত্তর করিয়াছেন যে আমরা ডিজিটাল যুগে বাস করিয়াও অ্যানালগ পৃথিবীতেই জীবনযাপন করিয়া থাকি! অহো! কি অসাধারন উপলব্ধি!” 

আমি বিশেষ কিছু না বুঝে বোকার মতো কমলাকান্তের দিকে তাকিয়ে আছি দেখে সে তার সেই পেটেন্ট রহস্যময় হাসিটা ঠোঁটের কোনে ঝুলিয়ে নিজেই আমাকে জিজ্ঞেস করে, “বুঝিতে অসুবিধা হইল বুঝি?”

আমি আমার অজ্ঞানতা না লুকিয়ে সহজ ভাবেই স্বীকার করে নিলাম যে ইয়ে বাত কুছ হজম নেই হুই। 

একটা বড় লেকচার দেবার প্রস্তুতি নিয়ে কমলাকান্ত শুরু করে, “তাহা হইলে শুন। গুহামানবের পর হইতে মানব উন্নয়ন কালের সকল পর্যায়গুলিকে যে বেশ কয়েকটি যুগে বিভক্ত করা হইয়া থাকে তাহা তো তোমার অবগত আছে বলিয়াই আমার ধারনা।”

কমলাকান্ত আমার কাছ থেকে উত্তরের আশা করছে দেখে আমি সম্মতি সূচক মাথা নাড়ালাম।

আমার কাছ থেকে উত্তর পেয়ে কমলাকান্ত দ্বিগুণ উৎসাহে আবার শুরু করে, “প্রস্তর যুগ হইতে শুরু করিয়া তাম্র, লৌহ ইত্যাদি যুগ পার হইয়া মানুষ আগুন আর গোলাকৃতী চক্রের ব্যবহার শিখিয়া ক্রমে ক্রমে বাস্পের আবিস্কারের মাধ্যমে ১৭০০ খ্রীষ্টাব্দে শিল্প বিপ্লবের যুগে প্রবেশ করে। ইহার পর ১৮০০ খ্রীষ্টাব্দে বিদ্যুৎ এবং বিংশ শতাব্দী শেষ লপ্তে গণক যন্ত্র যুগ যাহাকে কম্পিউটার যুগ বলা হইয়া থাকে তাহার প্রাদুর্ভাবের ফলে যথাক্রমে দ্বিতীয় এবং তৃতীয় শিল্প বিপ্লবের সুরুওয়াত।”


(৫)

সেই কবে ইস্কুল-কলেজ ছেড়ে পড়াশোনার গণেশ উল্টে দিয়েছি। আবার মনে হছে যেন সেই ক্লাস রুমে ঢুকে পড়েছি। ব্যপারটা আমার মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে দেখে কমলাকান্ত একটু ব্রেক দেওয়া স্থির করল। আর আমিও আমার গেলাসের পাণীয়তে লম্বা একটা চুমুক দিয়ে খানিকটা ধাতস্ত হলাম। 

কমলাকান্তও তার ডিবে থেকে ইতিমধ্যে আর একটি গুলি পূর্ব প্রক্রিয়া মোতাবেক গলাধঃকরন করে আবার তার লেকচার শুরু করে, “এই কম্পিউটার যন্ত্রের আগমনের প্রভাবেই যুগ পরিবর্তন বড়ই দ্রুত হইতে লাগিল এবং ইহার ফলে অতি সত্বর বর্তমান কালের চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের আবির্ভাব। ইহাকে পন্ডিতগন Industry 4.0 অর্থাৎ I4.0 বলিয়া অভিহিত করিয়াছেন। এই যুগে কৃত্রিম মেধার উন্নয়ণ বড়ই পরিলক্ষিত হইবে। ইহাকে তোমরা Artificial intelligence নামে পরিচিতি দিয়াছ।” 

এইবার বেশ বুঝতে পারছি; কমলাকান্তের বক্তব্যের ঠাস মালটা মাথায় যেন ঢুকতে শুরু করেছে। আমার ক্ষেত্রে আমি লক্ষ্য করে দেখেছি যে কোনো ভারি বিষয়ের সাথে যদি পছন্দ মতো পাণীয়ের ব্যবস্থা থাকে তবে ভারি বিষয়টি আমার সহজেই বোধগম্য হয়ে ওঠে। আজকেও তার কোনো ব্যতিক্রম দেখলাম না। 

তাই আমি আমার সমস্ত পরিচিত আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, পাঠক-পাঠিকা সবাইকেই এই টোটকাটির ইস্তেমাল করার জন্য উপদেশ দিচ্ছি। আশাকরি হাতে হাতে ফল পাওয়া যাবে। 

আমি একটু অন্যামনস্ক হয়ে পরেছি দেখে কমলাকান্ত আবার তার বক্তব্যের খেই ধরে শুরু করে, “এই পরিপ্রেক্ষিতেই ক্রিষ্টোফার নোলান সাহেব হক কথার এক কথা বলিয়াছেন। ধীরে ধীরে মনুষ্য সমাজে যান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার প্রচলন হইতে চলিয়াছে। এই যান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রচলন কালে মনুষ্য সম্প্রদায়কে ইহা ভুলিলে চলিবে না যে পৃথিবীতে তাহারা বসবাস করিতেছে তাহা অতিমাত্রায় স্বাভাবিক এবং অ-কৃত্রিম। কাজেই কৃত্রিম যান্ত্রিকতার আতিশয্য যদি মনুষ্যজীবনের স্বাভাবিকতা এবং অ-কৃত্রিমতাকে প্রভাবিত করিতে শুরু করে তবে তাহা এই মনুষ্য সভ্যতার মুষল পর্বের প্রচলনের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপনা করিবে মাত্র। মনে রাখিতে হইবে এই মুষল পর্বেই কিন্তু শ্রীকৃষ্ণের যাদব সম্প্রদায়ের ধ্বংসের যে ইতিহাস রচিত হয় তাহা রক্ষা করিবার ক্ষমতা স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণেরও জানা ছিল না। কাজেই নোলান সাহেবের কথার ধরতাই ধরিয়া বলিতে গেলে বলিতে হয় যে এই ডিজিটাল যুগেও অ্যানালগ অর্থাৎ স্বাভাবিক জীবনযাত্রা খুবই জরুরী নতুবা মানব সভ্যতার শেষের সে দিন দুয়ারে আসিয়া কড়া নাড়িতে থাকিবে। একটা কথা ভুলিলে চলিবে না যে বহু উন্নত প্রাচীন সভ্যতা কিন্তু কালের প্রভাবে হারাইয়া গিয়াছে। হরপ্পা, মহেঞ্জোদর ইত্যাদি সভ্যতার সফলতা আজ ইতিহাস মাত্র। কাজেই ডিজিটাল আর অ্যানালগ ব্যবস্থা যদি তাল মিলাইয়া চলিতে না পারে তবে I4.0 শিল্পযুগও অতিশীঘ্রই অস্তগামী হইবে বলিয়াই আমার ধারনা।”

একসঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বলে কমলাকান্ত একটু হাঁপিয়ে ঊঠেছে মনে হল। এক নিঃশ্বাসে ঘটির বাকি জলটা শেষ করে ঘটিটা টেবিলে রেখে মুখটা একটু বিকৃত করে ঘটিটা একবার ভাল করে দেখে ঊঠে দাঁড়িয়ে বলে, “আমাদের শাস্ত্রে বলে ‘তমসমার্গমায় জ্যোতির্ময়’। বিজ্ঞান মনুষ্য সমাজকে অন্ধকার থেকে আলোকের সন্ধানে যেমন চালিত করে আবার তেমনি এই বিজ্ঞানের উপাসকেরাই যে শাসক সম্প্রদায়ের অঙ্গুলি হেলনে তাহাকে মানব সংহারে নিয়োজিত করে থাকেন তাহার উদাহরন ইতিহাসের পৃষ্ঠায় কম নাই। নোলান সাহেবের কথাটি আমায় ভীষণ ভাবে নাড়া দিয়াছে বলিয়া আজি তোমার সাথে আলোচনা করিয়া কিছুটা হালকা হইলাম।”

কথা কটি বলিয়া আমাকে কিংকর্ত্যব্যবিমূঢ় অবস্থায় রেখে কমলাকান্ত তাহার নিজের ডেরায় চলে গেল। একটু টলছে মনে হলো। আফিমের মৌতাত আজ বেশ জাঁকিয়েই বসেছে মনে হচ্ছে। 


(৬)

কমলাকান্ত চলে গেলে আমার মাথায় ভাবনার আকাশ ভেঙে পড়ল। আমার মনে হল এই ডিজিটাল যুগে ব্যক্তিগত সমস্ত খবরাখবর ঊন্মোচিত হয়ে যাবার ফলে পৃথিবীব্যাপী আমার মতো সাধারন মানুষের জীবনযাত্রার সমস্ত সংবাদ আজ দিনের আলোর মতই স্বচ্ছ। রাবণের মৃত্যুবাণের মতই আজ তা আমাদের হাতছাড়া হবার জোগাড়। এবং তা কখন আমাদের বিরুদ্ধেই ব্যবহৃত হবে তা আমরা জানিনা। 

ঠাণ্ডা ঘরে বসে কোন রিংমাষ্টার মহাপুরুষ কম্পিউটারের মাধ্যমে তাঁর Artificial intelligence-এর একজন রোবোটকে চালিত করে আমায় তাঁর দাসত্বে বেঁধে ফেলবেন অথবা তাঁর হাতের পুতুলে পরিণত করে ফেলবেন এটা ভাবতেই আমার শিরদাঁড়া দিয়ে একটা হিমশীতল ঢেউ বয়ে গেল। 

ছেলেবেলাতে দাদামশায়ের কাছ থেকে একটা ব্রাহ্মণের গল্প শুনেছিলাম। সেই ব্রাহ্মণ এক ভূতকে মন্ত্রের সাহায্যে বশ করে তাকে দিয়ে তার সংসারের সব কাজ করাত। ব্রাহ্মণ আসলে ভুতটাকে তার ক্রীতদাস বানিয়ে রেখেছিল। 

আমি দিব্যদৃষ্টিতে স্পষ্ট দেখতে পেলাম যে আঙ্কেল টম’স কেবিন-এর ক্রীতদাসদের মতো আমিও কোনো এক Digitally powerful এক প্রভুর কাছে দাসত্ব করে চলেছি। 

ভাবতেই মাথা গরম হয়ে উঠলো। কমলাকান্ত যে কি এক ঢপের লেকচার দিয়ে গেল যার ফলে আমার বাকি রাতের ঘুমটাই চৌপাট হয়ে গেছে। 

তার ওপর আবার সর্বনাশের মাথায় বাড়ি! 

ঊচাটন মন আর শরীরকে একটু শান্তি দেবার জন্য বোতলের পাণীয় গেলাসে ঢালতে গিয়ে দেখি যে বোতল্টাই ফাঁকা! 

কখন অন্যমনস্ক ভাবে আমি আমার বোতলের বাকি পানীয়টা কমলাকান্তের ঘটির জলে ঢেলে দিয়েছি তা আমারই খেয়াল নেই!
1

রম্যরচনা - পল্লববরন পাল

Posted in


রম্যরচনা


ডিম
পল্লববরন পাল


আমাকে বউ ডিম কিনতে দেয়না কিছুতেই। আমি ডিম কিনলে নাকি তারা বেশিক্ষণ আস্ত থাকেনা। বাড়ি ঢোকবার আগেই তারা ফেটে যায়। 

এই তথ্যটা আমাদের পাড়ার চেনাশোনা চৌহদ্দির সবাই জানে। বন্ধু শত্রু নির্বিশেষে। আত্মীয়স্বজন জ্ঞাতিগুষ্টি তাঁরাও সবাই। আমার বউয়েরা চার বোন - তাদের শ্বশুরবাড়ি, আমার নিজের দিদির আর ছোটভাইয়ের শ্বশুরবাড়ি – আমার মাসতুতো খুড়তুতো পিসতুতো ভাইবোন, তাদের নিজের নিজের শ্বশুরবাড়ির লোকজন - তারাও জানে। আমার বউসহ এদের প্রত্যেকের মুখবই বন্ধুবান্ধবীরা পর্যন্ত জানে। তাদের কেউ কেউ আবার আমারও বন্ধুতালিকায় আছেন। তারা সবাই সামনে পেছনে হাসিচাঁদমুখ সাজিয়ে এই তথ্যটা আমার দেওয়ালে লিখে আমাকেও জানিয়েছেন। চাঁদমুখগুলো ভারি সুন্দর দেখতে - ডিমের কুসুমের মতো। 

আমার বউ কোনোদিন মিথ্যে বলেনা। যদিও আমার স্মৃতিতে একবার, মাত্র একবারই – বউয়ের নির্দেশমতো আমি ডিম কিনে চারশ’ ফুট অনুভূমিক আর চারতলা উল্লম্ব অতি সতর্ক হয়ে হেঁটেও চারটে আস্ত ডিম আমার বউয়ের হাতে তুলে দিতে পারিনি। অথচ আমি খুব দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি, লোকনাথ ভাণ্ডার থেকে বাড়ির দরজা অবধি ওই চার শ’ ফুট এবং পরবর্তী চারতলা সিঁড়ি – এই পুরো পথটা আমি অত্যন্ত সতর্ক হাতে ব্যাগটা ধরে ছিলাম – একবারের জন্যও দোলাইনি, কোথাও ধাক্কা লাগাইনি। কারন, আমার বউ সেরকমই আদেশ দিয়েছিলো - আমার সতর্কতায় এক শতাংশ-ও খাদ ছিলোনা। আমি জানি। কিন্তু আমার বউ জানে যে আমি সতর্ক ছিলাম না। সুতরাং আমার সতর্কতায় অবশ্যই খাদ ছিলো। হয়তো বা আমার অজান্তেই। এবং তাই বউ বলে – ওই, আমি ডিম কিনলেই নাকি --- যেন এই সূর্য-চন্দ্র-দিবা-রাত্রির মতো বউবাণীও শাশ্বত সত্য, যেন সাকুল্যে অন্তত দু’শো ছাপ্পান্নবার ঘটে গেছে এমন, অর্থাৎ দোকান থেকে বাড়ি ফেরার মধ্যবর্তী সময়ে আমার হাতে ডিম ফেটে গেছে। আমার জানা নেই। কিন্তু আমার বউ তো আর মিথ্যে বলতে পারেনা। তাই আমি আর কোনোদিন ইচ্ছে হলেও ডিম কিনতে পারিনা। আমি ইচ্ছে না হলেও মাছ কিনি, মাংস কিনি, বাঁধাকপি আলু পালংশাক গরম মশলা দারচিনি, মাসকাবারে চাল ডাল চিনি চা-পাতা স্যারিডন এন্টাসিড সাবান শ্যাম্পু - সব কিনি। 

শুধু ডিম কেনে পাঁচুর মা। 

এই একটা ব্যাপারে আমি পাঁচুর মাকে খুব হিংসে করি। যদিও পাঁচুর মা ওই ডিম দিয়ে ফার্স্টক্লাস ওমলেট বানায়, ফ্রেঞ্চ টোস্ট বানায়। সেগুলো ব্রেকফাস্ট হিসেবে আমার ভীষণ প্রিয়। আমি ডিম খেতে খুব ভালোবাসি। আমার বউয়েরও ডিম হট ফেভারিট। আমাদের বিয়ের পরে ওকে নিয়ে একবার একটা ঝিংচ্যাক রেস্টুরেন্টে গিয়েছিলাম। এয়ারকন্ডিশণ্ড আলোআঁধারি চুপচুপ রেস্টুরেন্ট। বিদেশী গানের ফিসফিস আবহ। আগে কোনদিন স্পর্ধাও হয়নি এমন রেস্টুরেন্টে ঢোকার। সেদিন সদ্য বিয়ে করা বউকে নিয়ে ঢুকে বেশ রাজাবাদশার মতো মেজাজে বললাম – বলো, কী খেতে ইচ্ছে করছে? বউ মেনুকার্ড তন্নতন্ন পড়ে একগাল হেসে বললো – ডিমের কারি আর পরোটা। 

অন্তত এই ডিমের বিষয়ে বিচার করলে আমরা দু’জন আদর্শ দম্পতি। 

ডিমের প্রতি এ হেন অপত্য প্রেম আমার আশৈশব। সপ্তাহে শুধু রবিবার সকালের ব্রেকফাস্টে একটা করে গোটা ডিমসেদ্ধ বরাদ্দ ছিলো আমাদের তিন ভাইবোনের জন্য। ওঃ, সে কতক্ষণ ধরে তারিয়ে তারিয়ে নুন গোলমরিচ লাগিয়ে আমি ডিম খেতাম। দিদি বা ছোটভাইয়ের এতো ডিমপ্রেম ছিলোনা। ওরা চটপট খেয়ে নিতো। তাই পড়তে বসতে দেরি হওয়ার জন্য শুধু আমিই মায়ের বকুনি খেতাম। নিয়মিত। ডিমে ডিমাকার অবস্থায় ওই বকুনিটাও আমার কাছে তখন গোলমরিচের ঝাঁঝের মতো, মন্দ লাগতো না। 

আমাদের বাবা ছিলেন পুরোনো দিনের কমিউনিষ্ট পার্টির সদস্য। প্রতি রোববার আমাদের বাইরের ঘরে বাবাদের পার্টি মিটিং হতো। আমরা তিন ভাইবোন ভেতরের দালানে বইখাতা খুলে বসতাম। আমার কান থাকতো খাড়া বাইরের ঘরের দিকে। হাওয়ায় ভেসে আসতো ‘মার্ক্সবাদ’ ‘পুঁজিবাদ’ ‘প্রলেতরিয়েত’ ‘সমাজতন্ত্র’ ‘সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত’-র মতো কঠিন কঠিন শব্দ। মানে বুঝতামনা। কিন্তু শব্দগুলোর মধ্যে একটা ভীষণ জোর আছে সেটা টের পেতাম। 
বুঝলাম কলেজে এসে। তবে সক্রিয় রাজনীতিতে আমার উৎসাহ তেমন ছিলোনা। আমার পছন্দের দিক নাটক, গান। সে সব নিয়েই মেতে থাকতাম। ইউনিয়ন লাল। তার ওপর আমি আবার কমিউনিষ্ট-সন্তান। সুতরাং একটু বেশিই ঘনিষ্ঠতা সুত্রে শব্দগুলোর অর্থ বুঝলাম। বুঝলাম, সোভিয়েত দুর্গ পতনের পরে সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত সারা পৃথিবী জুড়ে আরও বেশি শক্তিশালী। আরও হিংস্র। আরও সক্রিয় ও সর্বত্রগামী। কলেজ ক্যান্টিনে তখন 'পুঁজিবাদ' 'প্রলেতরিয়েত' 'সমাজতন্ত্র' 'সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত' মেখে পাঁউরুটি ডিমের ঝোল আমার রোজকার রুটিন। কী স্বাদ তার। আনন্দ। 

এখন এ বাড়িতে আমরা নিঃসন্তান দুটি প্রাণী। আমি আর বউ। না না স্যরি, বউ আর আমি। ছোটভাই ইঞ্জিনীয়ার। বিদেশে থাকে। সন্তান নেই বলে আমাদের দু'জনেরই মনে চাপা দুঃখ। আমাদের যেদিন দু:খ উপচে ওঠে, আমরা সেদিন ডিম খাই। যেদিন ওই দুঃখটা মনে থাকেনা, সেদিনও অবশ্য আমরা ডিম খাই। আমার বউয়ের আর কোনও দ্বিতীয় দুঃখ নেই। আমার দ্বিতীয় দুঃখ - আমাকে আমার বউ ডিম কিনতে দেয়না। আমি ডিম কিনলেই নাকি বাড়ি ঢোকবার আগেই তারা ফেটে যায়।

ওই একটাই গোপন কাঁটা আমার শুধু ডিম খাবার নয়, জীবনের বাকি সব আনন্দ মাটি করে দিয়েছে। 

আমার স্থির বিশ্বাস – এর পেছনে একটা গভীর চক্রান্ত আছে। কিন্তু চক্রান্ত থাকলে তার এক বা একাধিক কারণ থাকবে। এর পেছনে কে বা কারা, তাদের মতলবটাই বা কী – এই সব কঠিন কঠিন ব্যাপার নিয়ে চিন্তা শুরু করতে গেলেই আমার কেমন যেন বুক কেঁপে ওঠে, শিরদাঁড়া শক্ত হয়ে ওঠে, আমি ঘামতে শুরু করি। আর ঘাম হলেই আমি শারীরিকভাবে খুব চাঙ্গা হয়ে উঠি। তখনই ফেলুদার মতো সিগারেট ধরিয়ে ভাবতে থাকি – বিশ্লেষণ করতে থাকি ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের - কার কার কী কী স্বার্থ থাকতে পারে। 

চক্রান্তকারী এক নম্বর – বউ। ধ্যুত্তেরিকা – এই লিস্টে বউ এলো কোত্থেকে? ছিঃ, বউ চক্রান্তকারী?? আমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেলো নাকি? বউকে নিয়ে এরকম অসম্ভব অসম্ভব চিন্তা করাও পাপ। বউ তো সবসময়েই সত্যি। ধ্রুব সত্য। সুপ্রিম কোর্ট। রাষ্ট্রসঙ্ঘ। যা ধ্রুব, তার আবার ডিসেকশন হয় নাকি? বউয়ের আবার কিসের স্বার্থ? বউ সব সন্দেহের উর্ধে। সুতরাং – বউ কাটা। 

দু’নম্বর – পাঁচুর মা। ওর সঙ্গে বাড়ির কাজের যা যা শর্ত, তার মধ্যে অবশ্যই নিয়মিত ডিম কেনা নেই। শুধুমাত্র ডিম কেনার জন্য ও মাসের মাইনেতে কোনও অতিরিক্ত বোনাস পায়না। মানে অতিরিক্ত দেওয়া তো হয়ই না, দেওয়ার কথা ভাবাও হয়না। শ্রেণীগত শোষণের চরিত্র বজায় থাকে। ডিম কেনার টাকা থেকে খুচরো ইচ্ছে হলেও লুকিয়ে আঁচলস্থ করার কোনও সুযোগ নেই। যদিও পাঁচুর মা মানুষটা খুবই নিরীহ ও সজ্জন। বাজার ফেরত আমার থেকেই রোজ পাই-টু-পাই হিসেব বুঝে নেয় বউ। পরিমলের দোকানে একদিন খুচরো বাটিতে ওর আধুলি ছিলোনা। আমি বলেছিলাম – ছাড়ো তো পরিমল, আট আনার জন্য অতো চাপ নিয়োনা, বাকি খদ্দেরদের দেখ, সবাই অফিস-তাড়ায় আছে - বরং মনে থাকলে পরে অ্যাডজাস্ট কোরো। রাত্রে আমি অফিস থেকে ফিরতে না ফিরতে চায়ের কাপ টেবিলে ঠকাস্ – সামনে কোমরে আঁচল জড়িয়ে বউ দাঁড়িয়ে - সকালে আট আনা কম ফেরৎ দিয়েছো। এরকম ঘটনা প্রথম প্রথম পাঁচুর মায়ের সাথেও হয়েছে। তবে নিতান্তই দু’একবার। তাড়াহুড়োয় সঙ্গে সঙ্গে ফেরৎ টাকাটা দিতে ভুলে গেছে হয়তো, কিম্বা হয়তো আমার অফিসের তাড়া বুঝে শিলনোড়ায় মশলাটা বেটে দিয়ে নইলে ঘরদোর ঝাঁট দিয়ে তারপর হিসেব করে ফেরৎ দেবে বলে ঠিক করেছিলো পাঁচুর মা। কিন্তু মিনিট দু’তিন অপেক্ষার পরেই আমার বউয়ের গলা ধৈবতে – কী হলো পাঁচুর মা? ফেরৎ আসেনি কিছু? ব্যাস, ঝাঁটা ফেলে কিম্বা গ্যাসউনুনের সুইচ ঘুরিয়ে দৌড়ে এলো পাঁচুর মা – দাদা বেরুবেন, তাই ভাবছিলুম ঝাঁটটা দিয়ে নি আগে, অথবা তরকারিটা নেগে যাচ্ছিলো তাই – কিন্তু ভবি ভোলেনি। ওই প্রথম দু’একবারের পরে পাঁচুর মা-ও আর ওই ভুল করেনি কোনদিন। কাজেই পাঁচুর মায়ের কেসটাও যুতসই দাঁড়াচ্ছে না। পাঁচুর মাও কাটা। 

বউ গেলো, পাঁচুর মাও গেলো। তিন নম্বর কে? এই চক্রান্ত রহস্যের মধ্যে আমাকে ছাড়া আর তো কোনও মনুষ্যচরিত্র নেই। মনুষ্যচরিত্রের বাইরে আছে ডিম। তাকে বিশ্লেষণ করে ফেসবুকের হাসিচাঁদমুখের মতো স্বর্ণালি কুসুম ছাড়া আর কিছু বেরবেনা। তার মানে, চক্রান্তটা গভীর এবং সুদূরপ্রসারী। সরাসরি মঞ্চে অবশ্যই আর কোনও চরিত্র নেই। কিন্তু উইংসের পাশে, ব্যাক স্টেজে? অডিটোরিয়ামের বাইরে? রাস্তার ওফুটে? গঙ্গার ধারে? অন্য শহরে? অন্য দেশে?

যেমন - লোকনাথ ভাণ্ডার। মানে যার মালিক শেখর। মানে যে দোকান থেকে আমাদের বাড়িতে ডিম আসে, মানে যে দোকান থেকে কিনে বাড়ি আসতে আসতে আমার হাতে চারটে ডিম ফেটে গিয়েছিলো কবে সেই দ্বাপর যুগে একবার – আচ্ছা, ডিমগুলো আমার হাতে ফেটেছিলো নাকি ফাটা ডিমই আমাকে দেওয়া হয়েছিল? সেই শেখর কি সন্দেহের আওতায় নেই? তার তো ডিম বিক্রি হওয়া নিয়ে কথা। সে আমিই কিনি বা পাঁচুর মা কিনুক। তাতে শেখরের কিছু আসা-যাওয়ার কথা নয়। সেই শেখর হঠাৎ আমাকে বেছে বেছে ফাটা ডিম দেবেই বা কেন? কী মতলবে? আমি কি ওর শত্রু? শেখরের বয়স চল্লিশের কোঠায়। আমার চেয়ে বছর কয়েক ছোটোই হবে। পাঁচুর মাকেও বলতে নেই দেখতে একেবারে অবিকল আর দশজন পাঁচুর মায়ের মতোন - হাড়গিলে ছিবড়ে চেহারা। শেখরের সেরকম উরুসন্ধির দোষ আছে কিনা জানিনা, থাকলেও এ ক্ষেত্রে তেমন ভাববার অবকাশ নেই। শেখর বিজেপি করে, তাই হয়তো দোকানের নাম রাখে লোকনাথ। আমি কংগ্রেস সিপিএম বা তৃণমূল সমর্থক - এমন কোনও তথ্যও ওর কাছে থাকার কথা নয়, কারণ, আমি কাকে ভোট দিই, সেটা আমার বউই জানেনা, শেখর তো কোন ছার। কাজেই আমাকে শুধুশুধু জব্দ করার কোনও কারণ নেই। এই ষড়যন্ত্রে কোনও রগরগে অথবা লোকাল রাজনৈতিক গন্ধও পাওয়া যাচ্ছেনা। 

তাহলে এই সম্ভাব্য চক্রান্তকারীদের তালিকা থেকে শেখর বাদ। ডিম বাদ। বউ বাদ। পাঁচুর মাও বাদ। মাও যখন বাদ, তখন মার্ক্সও বাদ। লেনিনও বাদ। পুঁজি অর্থাৎ ডিম তো আগেই বাদ হয়ে গেছে। তাহলে আর হাতে রইল সাম্রাজ্যবাদ। অর্থাৎ চক্রান্তটা আরও অনেক বড়ো এবং গভীর! এরকম কথা আগেও শুনেছি – সাম্রাজ্যবাদী শক্তি চায়, পৃথিবী থেকে কমিউনিজমকে একেবারে মুছে ফেলতে। ব্যাপারটা বিশদে বুঝতে পারবেন হয়তো পোড় খাওয়া রাজনীতিবিশারদরা। আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে যা মনে হচ্ছে – পৃথিবী জুড়ে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন কৌশলে যে কমিউনিষ্ট নিধন চলছে, সোভিয়েত পতন দিয়ে যার শুরু, আমার ব্যাপারটা তারই হয়ত একটা ব্যর্থ প্রচেষ্টামাত্র। আরে বাবা, আমি কমিউনিস্ট পার্টি করিনা ঠিকই, কিন্তু আমার বাবা তো কমিউনিস্ট ছিলেন। ওনার সেই কমিউনিস্ট রক্ত তো আমার শরীরেও বইছে। সেই বাঘ ও মেষশাবকের গল্প – তুই না হলে তোর বাবা ঝর্ণার জল এঁটো করেছিল - তাই হয়তো আমিও ওদের অন্যতম টার্গেট। 

হ্যাঁ, এই তো! এইবার পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি - কিভাবে সাম্রাজ্যবাদীর অদৃশ্য কালো হাত আমার হাতে ধরা ব্যাগের মধ্যে ঢুকে ঠোঙার দিকে সকলের নজর এড়িয়ে এগিয়ে আসছে। আমিও টের পাচ্ছিনা। ডিমগুলোকে গোপনে স্পর্শ করছে। এক একটা ডিম ফাটবার কথা ভয়ঙ্কর পারমাণবিক বোমার মতো। একের পর এক। নি:শব্দে। 

কিন্তু ফাটেনি। ফসকে গেছে। সেবার। ওরা ব্যর্থ হয়েছে। আমি বুঝিনি। আমার বউ নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছে। এবং এটাও নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছে যে, পৃথিবী থেকে কমিউনিষ্টদের বিনাশের জন্য ওরা আবার চেষ্টা করবে। আঃ, এতোদিনে বুঝলাম, আমার বউ কেন আমাকে আর কোনোদিন ডিম কিনতে পাঠায়নি।

বউ, তোমার জন্য গর্বে আমার বুক আরো ফুলে উঠলো। আর মিঃ আমেরিকান প্রেসিডেন্ট, আমার বিরুদ্ধে এই ঘৃণ্য চক্রান্তের জন্য আমি আপনাকে অভিযুক্ত করলাম।
0

রম্যরচনা - দীপারুণ ভট্টাচার্য

Posted in

রম্যরচনা


সীমানার ওপারে
দীপারুণ ভট্টাচার্য


দেশের সীমানা পেরিয়ে যাওয়াটা সব সময়ই বেশ রোমাঞ্চকর। সে হোকনা সবথেকে কাছের দেশে যাওয়ার মুহূর্ত। দেশ বিভাগের আগে আমার পূর্বপুরুষেরাও ছিলেন ওই অঞ্চলেরই বাসিন্দা। এখনও অনেক আত্মীয়তা রয়েছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। আসলে বাংলাদেশকে সঠিক অর্থে বিদেশ ভেবে নেওয়া কঠিন। তবুও আন্তর্জাতিক সীমানা পেরিয়ে যাওয়ার মধ্যে রয়েছে কিছু নিয়ম নীতি। পাসপোর্ট ও ভিসা তার মধ্যে অন্যতম। খুব ছোটবেলায় কয়েকবার গিয়েছি সেখানে। তখন কতই বা বয়স! বোঝার মতো বয়স যখন হলো তখন আর যাওয়ার প্রয়োজন হয়নি। ওপারের আত্মীয়রা অবশ্য সঙ্গে মাঝে মধ্যে আসতেন এপারে। কখনও বা চিকিৎসার প্রয়োজনে, কখনও বিয়ের বেনারসীর কিনতে বা আরও অন্যান্য দরকারে। কয়েকবার তাদের আমি বর্ডারে আনতেও গিয়েছি। তাদের যাতায়াতের অভিজ্ঞতার গল্প শুনে বাংলাদেশ বর্ডার সম্পর্কে আমার সামান্য ধারণা হয়েছিলো।

বছর খানেক আগে অফিসে একটা পদ-পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে আমি আসি আন্তর্জাতিক ব্যবসাতে। আর তখন থেকেই বাংলাদেশ হয়ে ওঠে আমার আরেকটি কর্মক্ষেত্র। এখন সেদেশে যাওয়াটা নিতান্তই পেটের দায়। কিন্তু কর্মসূত্রে যাওয়া তো, তাই প্রতিবারই বাংলাদেশ গিয়েছি বিমানে, ঢাকা হয়ে। সে অভিজ্ঞতা বেশ ভালো। তবে সেবারে কাজছিলো খুলনার আশেপাশে। তাই ঢাকা হয়ে যাওয়াটা বোকামি বলেই মনে হলো। কেননা দিল্লি থেকে ঢাকা হয়ে খুলনা যেতে যতটা সময় ও অর্থ ব্যয় হবে তার চেয়ে অনেক কম অর্থ ও সময়ে কোলকাতা হয়ে খুলনা পৌঁছনো সম্ভব বেনাপোল বর্ডার পেরিয়ে। এই পরিকল্পনা মতো বিধাননগর স্টেশন থেকে বনগাঁ লোকাল ধরে যখন বনগাঁ স্টেশনে পৌঁছালাম তখন বেলা দশটা বাজে। স্টেশন থেকে বর্ডার নয় কিলোমিটার। লাইন দিয়ে ক্রমাগত চলছে আটো রিক্সা। আটো যেখানে নামায় তার একশো মিটারের মধ্যেই ইমিগ্রেশন অফিস। আটো থেকে নামার সাথে সাথেই দালাল চক্রে ছেকে ধরলো। এ ছবিটা অবশ্য আমার অচেনা নয়। আসলে এরা সবাই এজেন্ট। এদের পরিষেবা এবং রেটও মোটামুটি বাঁধা। এপারে পাসপোর্ট পিছু একশো আবার ওপারে একশো। এপারের সব মানিকদেরই একটি করে জোড় রয়েছে সীমানার ওপারেও। এই দুইশো টাকার সেবাতে রয়েছে খানিকটা কুলিগিরি আর বাকিটা পূজা সামগ্রী। 

একটু খুলে বলা যাক। আসলে আমার মত অফিসের প্রয়োজনে এই পথে যাতায়াত করেন, এমন মানুষ নিতান্তই নগন্য। এই বর্ডার দিয়ে মূলত ওই পারের মানুষ ভারতে আসেন চিকিৎসার প্রয়োজনে, বিয়ে বা ইত্যাদির বাজার করতে এবং দেশ ভ্রমণে। এবাদে ছোট ব্যাবসায়ীরা বিভিন্ন মালপত্র এপার ওপর করেন। তাছাড়া চলে সরকারি পথে আমদানি রপ্তানি। এই পথে সাধারণত মানুষ প্রচুর মালপত্র ভারত থেকে বাংলাদেশ নিয়ে যায়। আর ওদেশ থেকে আসে জামদানি শাড়ি, টাঙ্গাইল শাড়ি ইত্যাদি। আর এই কারণেই এখানে কাস্টমস অফিসারদের রমরমা। আগে শুনেছি তারা সরাসরি টাকা নিতেন। কয়েক বছর হলো মাঝখানে এসেছে এই দালাল চক্র। কিভাবে? শুনুন তবে।

ধরা যাক আটো থেকে নেমে আপনি যে দালালকে বেছে নিলেন তার নাম পাঁচু। প্রথমে এই পাঁচু আপনাকে স্বযত্নে বসতে দেবে তার ছোট্ট অফিস ঘরে। হাসি মুখে খোশগপ্প করবে খানিক্ষণ। যাতে সীমানা পেরিয়ে যাওয়া সম্পর্কে আপনার মনে কোনো টেনশন না থাকে। এবার সে যত্ন করে চা খাওয়াবে যাতে ওপারে যাওয়ার আগে শরীরটা বেশ ঝর ঝরে লাগে। চাইলে দুয়েকটা মেরি বিস্কুটও পেতে পারেন। কিছু টাকা দিলে ফাইফর্মাস খাটা ছেলেটি এনে দেবে কচুরি তরকারি ও জিলিপি। বনগাঁ অঞ্চলের রসগোল্লা ও মাখা সন্দেশ কিন্তু অপূর্ব। কচুরি তরকারির পর পেটে জায়গা থাকলে কোন ভাবেই এই স্বাদ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করা ঠিক নয়। আপনি যতক্ষণ প্রাতরাশে ব্যস্ত, পাঁচু ততক্ষণে মনযোগ সহকারে ভর্তি করবে ইমিগ্রেশন ফর্ম। এবারে একটা কুলি গোছের লোকের সঙ্গে আপনাকে পাঠিয়ে দেবে ইমিগ্রেশন অফিসে। বিদায়ের আগে অবশ্য সে বুঝে নেবে তার পাওনাটুকু। 

কুলিটি শ্রদ্ধা ভরে বইবে আপনার ব্যাগ খান। আর ইমিগ্রেশন বাবুর কাছে আপনার পাসপোর্টটি এগিয়ে দিয়ে বলবে, "পাঁচু দা"। তিনি তৎক্ষণাৎ ছাপ্পা মারবেন ফেরাবেন আপনার পাসপোর্ট খানা। আর সাদা কাগজে লিখে রাখবেন, "পাঁচু -১"। দিনের শেষে পাঁচু হিসাব পত্র সহ ইমিগ্রেশন বাবুর পূজা সামগ্রী পৌঁছে দেবেন নির্দিষ্ট মন্দিরে। মনে হয় এই বিষয়ে এদের বেশ সততা রয়েছে। তাই কুলি "পাঁচুদা" বললে ইমিগ্রেশন বাবু সন্দেহ প্রকাশ করেন না এ সত্যিকারের "পাঁচু" কিনা!

কিন্তু আমার কাছে রয়েছে Business Visa তাও আবার multiple entry। তাই "পাঁচুদা" চক্করে 'নৈব নৈব চ'। এই ভেবে দালাল চক্রকে বুড়ো আঙুলটি দেখিয়ে গট গটিয়ে চললাম ইমিগ্রেশনের অফিসের দিকে। প্রথমে ডলার পাল্টে বাংলা টাকা নিলাম। তারপর ফর্ম ভরে দাঁড়ালাম ইমিগ্রেশন লাইনে। আমার পাসপোর্ট হাতে নিয়ে বাবু একটু করুণ মুখে বললেন, 'আপনি কি একা?'
- 'অফিসের কাজতো তাই একাই যেতে হয় স্যার।' কিঞ্চিৎ তির্যক ভাবে ছাড়লাম লেগ স্পিনটা। দেখলাম লেগে গেল। ঝপ ঝপ ছাপ মেরে পাসপোর্ট ফেরিয়ে একটু ঠোঁট উল্টে বললেন, আসুন তবে। 

ইমিগ্রেশন পেরিয়েই দেখি বিরাট লাইন। প্রথমে ভাবলাম ব্যাগ চেক হচ্ছে বোধ হয়। আমার পাশ দিয়ে কুলি সহযোগে পর পর বেরিয়ে যাচ্ছেন পাঁচুদা'র লোকেরা। একটু বাদেই বুঝলাম লাইনে আমার মতোই কিছু বোকা লোক দাঁড়িয়ে রয়েছেন। প্রায় আধা ঘন্টা লাইনে থাকার পর দরজার ভিতরে গিয়ে দেখি, X-Ray যন্ত্রগুলো বন্ধ আর লোকজনও কেউ নেই। বুঝলাম সঠিক অর্থেই দাঁড়িয়ে ছিলাম বোকার দলে। এবারে জোরে জোরে কয়েক কদম ফেলতেই দেখতে পেলাম প্রকৃত আন্তর্জাতিক সীমানা। পর পর দুটি বিরাট বিরাট লোহার গেট। এদিকে BSF আর ওদিকে BDR। তাদের পাসপোর্ট দেখিয়ে প্রবেশ করলাম বাংলাদেশের ভিতরে। এবারে বাংলাদেশ ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস। 

দেখলাম অফিস ঘরের সামনে কয়েকজন লোক নানান রকমের স্টিকার হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। বুঝলাম এরা এপারের মণি-মানিক্য। হতে পারে ওপারের পাঁচু'র দোসর এখানে নাসিম বা ইসমাইল। নামটা পাঁচুই বলে দেবে, আপনার কাজ শুধুমাত্র মনে রাখা। দেখলাম লোকেরা নাম বলছেন আর ছেলেটি তাদের বুকে বা কাঁধে লাগিয়ে দিচ্ছে স্টিকার। তাতে লেখা "ইসমাইল", "সত্তার" বা "রেজাউল"।
ছেলেটি আমাকেও করলো একই প্রশ্ন, 'নাম বলেন'? 
পিতৃদত্ত নামটি ছাড়া আমার আর বলার কি ছিলো! শুনে সে একটু থমকে গেল কিন্তু পথ ছাড়লোনা। 
- 'পাসপোর্ট টা দেন, কার সাথে যাবেন?'
এবার এগিয়ে গেলাম খানিকটা জোর করেই। কয়েক পা চলতেই বুঝলাম এপারে দালালের সংখ্যা ও প্রভাব ওপারের থেকে অনেক অনেক বেশি। কিন্তু আমিতো পণ করেছি একাই যাবো! তাই ফর্ম খুঁজতে লাগলাম। অদ্ভুত ব্যাপার হলো কোথাও ফর্ম খুঁজে পেলাম না। এমন সময় একজন এগিয়ে এসে একটা ফর্ম দেখিয়ে বলল, 'আপনারে কি ফরম খান ভৈরে দেবো?'
একটু গম্ভীর হয়ে বললাম, 'আমি নিরক্ষর নই ভাই। ফর্ম নিজেই ভরতে পারি।'
- 'ওঃ, ভরেন তাইলে। বলে একটা মুচকি হাসি দিলো সে।'
- 'দিন, একটা ফর্ম দিন।'
- 'যান যান ওই পুলিশের কাছে চান গে।' বলেই লোকটা অন্য মক্কেল ধরতে এগিয়ে গেল।
বুঝলাম এদের কাছে ফর্ম পাওয়া যাবে না। 

এবার পুলিশের কাছে গিয়ে ফর্ম চাইতেই তিনি পরিষ্কার ভাষায় বললেন, 'কিছু টাকা দেন, ফরম আমরা ভরে দিবানে।'
চোখে মুখে চূড়ান্ত বোকামির মুখোশ টেনে প্রশ্ন করলাম, 'আমি ফর্ম ভরলে কি আপনার অসুবিধা হবে?'
এই প্রশ্নের উত্তর মনে হল তক্ষুনি লোকটা দিতে চাইলেন না। মুচকি হাসি দিয়ে পাশের সহকর্মীটিকে বললেন, 'ও ভাই একটা ফরম দাও। এলোক নিজেই ভরবে বলতিছে।'

দেখলাম পাশাপাশি দুটো লাইন। কিন্তু কোনটা যে আমার জন্য সঠিক, ঠিক বুঝে উঠতে না পেরে অন্য একজন পুলিশের কাছে গেলাম। তারও সেই এক প্রস্তাব। খানিকটা তর্কাতর্কি হয়ে গেল। এবার একজন সাধারণ যাত্রী এগিয়ে এলেন। ফিসফিস করে বললেন, 'আপনার Business Visa তাই, বেশি কিছু করবে না। তবে এদের সাথে মুখ না লাগানোই ভালো।'

অগত্যা ডান দিকের লাইনটাতেই দাঁড়ালাম। প্রায় আধাঘন্টা পর কাউন্টারে পৌঁছে বুঝলাম এই লাইনটা আমার জন্য সঠিক নয়। এবার বাঁদিকের লাইন দাঁড়াবার পালা। ওই পুলিশটি আমাকে দেখে যেন একটু মুচকি হাসলেন। বুকে ছাপ্পা মারা লোকগুলো একের পর এক বেরিয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ বেরিয়ে যাচ্ছে সরাসরি বাংলা নোটের জোরে। দেখলাম আমার মতোই হতভাগ্য আরও জনা দুয়েক আছেন এই লাইনে। আমার আগে যিনি দাঁড়িয়ে আছেন তিনি বৃদ্ধ মানুষ। সব চুল সাদা। বেশ দুঃখ করেই বললেন, 'আমার দাদা থাকেন যশোরে। ৫০ সালে সবাই ভারতে চলে আসি, সে আসেনি। আমি প্রতি বছর একবার তাকে দেখতে যাই। টাকা দিয়ে যাই না তো তাই এই রকম দেরি হয় প্রতিবার। কি করবো বলো, সামান্য একশো টাকা মন তবু সায় দেয় না। তবে অবস্থা আগের চেয়ে অনেকটা ভালো হয়েছে।'

পাসপোর্টে ছাপ মেরে সেই পুলিশটি বললেন, 'অকারণ দাঁড়ালেন ভাই।' কথা না বাড়িয়ে আমি চুপচাপ এগিয়ে গেলাম। এবার কাস্টমস। এখানে X-ray যন্ত্রটি চলছে কিন্তু সেদিকে দেখার কেউ নেই। ব্যাগ খুলে স্বচক্ষে দেখতেই এদের আগ্রহ বেশি। আমাকেও ব্যাগ খুলতে বলল একজন। মুখে একরাশ বিরক্তি টেনে বললাম, 'X-ray তে কি দেখলেন?' আমার কথায় অফিসার সম্পূর্ণ হতবাক, 'মানে?'
- 'মানে হলো, X-ray তে দেখার পর সন্দেহ হলে তবেই তো ব্যাগ খোলা, না হলে আর মেশিনটা রয়েছে কেন?'
তিনি পাশের জনের দিকে তাকিয়ে বললেন, 'এ লোক তো ব্যাগ খোলবে না বলতিছে!'
এবার গলার জোর বাড়ানো ছাড়া উপায় নেই বুঝলাম। পরিষ্কার প্রশ্ন করলাম, 'আপনি কি বাংলা ভাষা বোঝেন না?'

খানিকটা মজা লুটতে এবার উঠে এলেন এতক্ষণ উদাস নয়নে চেয়ারে বসে থাকা একজন কাস্টমস অফিসার, 'কি ভাই, বিষয় টা কি?'
হিন্দি ছবিতে CBI অফিসার সেভাবে তাদের কার্ড দেখান কতকটা সেই ভঙ্গিতেই পাসপোর্টটা তুলে ধরে বললাম, 'Business Visa তে আছি, ব্যাগ খুলবো না; খুললেও কিছু পাবেন না!'
হঠাৎ যেন সবকটা মুখ পানসে হয়ে গেল। একজন বলল, 'ঠিক আছে, ঠিক আছে ভাই, আপনি যান।'

এবারে একদম বাইরে বেরিয়ে এলাম। বেরিয়ে এলাম বাংলাদেশের মুক্ত বাতাসে। কোথায়ও একটাও টাকা না দিয়ে আসতে পেরেছি ভেবে যখন ভেতরে ভেতরে বেশ গর্ব অনুভব করছি, ঠিক তখনই একটি বছর পঁচিশের ছেলে এসে দাঁড়াল পাশটিতে। ছেলেটি বাংলাদেশ ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস এলাকা তে অনেক্ষণ ধরেই ঘোরাফেরা করছিলো লোক নিয়ে, অনেকবার চোখাচোখি হয়েছে। সে একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে বলল, 'এসেই কটা টাকার দিলি, এতখুনে যশোর যেতি পারতেন। দশ মিনিটের পথ দুই ঘন্টায় পর হওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ নয় ভাই।' কথাটা বলে একমুহূর্ত না দাঁড়িয়ে ছেলেটা চলে গেল। 

তার অযাচিত উপদেশ শুনে হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। এবার পিঠে কে যেন হাত রাখলেন। পিছন ফিরে দেখি লাইনের সেই বৃদ্ধ মানুষটি। 
- 'ভালোই ফাইট দিয়েছো ভায়া। তোমার মধ্যে আমার যৌবন দেখলাম যেন। যাকগে, যশোরে হয়েই তো খুলনা যাবে, এসো আমার সঙ্গে।'

সীমানার কোন্দল ভুলে এবার ফেরার পথে যাওয়ার পালা।



1

রম্যরচনা - পিনাকী চক্রবর্তী

Posted in


রম্যরচনা


একটা কাল্পনিক ট্রেনযাত্রা, সঙ্গে একটা সত্যি গল্প
 পিনাকী চক্রবর্তী



এই যে ট্রেনে উঠেই সবাই হয় খেতে লাগে আর নাহলে নাক ডাকিয়ে ঘুমায়, এইটাই আমার একদম পছন্দ না, জ্যেঠু …

তাহলে, আর কি করতে বলো তুমি বাপু? একে তো রাতের ট্রেন, তায় কামরায় আলোর যা অবস্থা! এতে তো একটা গল্পের বইও পড়া যাবে না।

বই পড়তে কে বলছে ? আড্ডা আছে, গল্পগাছা আছে, আর আপনি তো সঙ্গেই আছেন, আমাদের চলমান রচনাবলী! আপনিই ধরুন না একটা গল্প! দেখবেন সবকটা গুটি গুটি এসে বসে পড়বে!

আমি? আরে, না, না, আমিও একটু পরেই উঠে যাবো ওপরের বাঙ্কে। বুড়ো মানুষ, ঘুম পায় না আমার?

জ্যেঠু, আবার আপনি ট্রেনে ঘুমানোর কথা বলছেন? আপনার না ট্রেনে ঘুমানো বারণ! আপনি ঘুমিয়ে পড়লেই নাকি আপনার স্যুটকেস পত্তর সব চুরি হয়ে যায়?

আরে বাবা, সে তো একা একা ট্রেনে চড়ার সময়ে, হে! এখানে তোমরা সবাই আছো! তার ওপরে, এই আস্ত ট্রেনটাই তো তোমার। আচ্ছা, এটাকে কি করে পেলে হে! আমি অনেকদিন আগে টিভিতে একটা হাসির সিরিয়ালে দেখেছিলাম, কে যেন একটা রোড রোলার জিতেছিল লটারিতে। তারপরে তার কি হাঁড়ির হাল হয়েছিল, সেই নিয়ে গল্প!

হ্যাঁ জ্যেঠু, ওটা ছিল মালগুড়ি ডেজ – এ।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক ঠিক। কিন্তু তোমার এই হামাগুড়ি ডেজ-টাকে পেলে কোথায়? এর চালচলন তো দেখি সেই “গুড় গুড় গুড় গুড়িয়ে হামা” টাইপস! সাঁতরাগাছি পৌঁছাতেই এত আমড়াগাছি করছে! 

স্পীডের কথাটা পরে বলছি, জ্যেঠু। আসলে আস্ত ট্রেনটা তো না, ট্রেনের একটা কামরাই জিতেছি শুধু, রেলের সঙ্গে একটা মামলায় জিতে, ক্ষতিপূরণ হিসাবে। পেছনের গার্ডের কামরাটা রেলেরই ডিসপোজাল সেল থেকে কিনেছি, সস্তায়। ওটা না থাকলে ট্রেনটা চালাতে দিত না আমাদের, তাই! মামাকে রিকোয়েস্ট করেছি আজ রাতটা ওখানে থাকতে। একটু রেসপনসিবল কাউকে তো রাখতে হবে ওখানে, বলুন! আর রেলের থেকে ইঞ্জিনটা ওয়েট লীজে নেওয়া। মানে ড্রাইভার, ফায়ারম্যান, কয়লা, জল… সব সমেত ভাড়া করা। তা কয়লার ইঞ্জিন তো আজকাল পড়েই থাকে, তাই পড়ে থেকে থেকে আমাদের ইঞ্জিনটা বোধহয় একটু ডিফেক্টিভ হয়ে গেছে, স্পীড তুলতে পারছে না, হামাগুড়ি দিচ্ছে। সে যাকগে, আপনি একটা গল্প বলুন। 

আমার গল্প মানেই তো তেল আর গ্যাসের গল্প হে! লোকে বেদম বোর হয়ে যাবে। যে ক’টা জেগে আছে, তাদেরও ঘুম এসে যাবে।

কি যে বলেন! আপনার গল্পে বোর হবে কেউ? আপনি নিজে বিশ্বাস করেন এ’কথা? এই তো, আপনার সেদিনের ঝুমরিতিলাইয়ার গল্পটা! লোকে তো আপনাকে আর এগোতেই দিলো না। ঝুমরিতিলাইয়া নিয়ে প্রশ্নে প্রশ্নে আপনাকে জর্জরিত করে ফেললো সবাই। কিন্তু আপনি তো যাচ্ছিলেন চম্পারণ না মধুবনীতে, কি সব গ্যাস শো অনুসন্ধান করতে! সেটাই শেষ করুন আজকে নাহয়!

সেবার আমার যাত্রা ছিলো পূর্ব চম্পারণ জেলার ঘোড়াসাহান গ্রামের উদ্দেশ্যে। নেপালের বর্ডারের কাছে।

জ্যেঠু, এক মিনিট! আমি একটু সবাইকে ডেকে আনি, নাহলে পরে লোকে আমাকে কথা শোনাবে। এই, সবাই এদিকে এসো! পিনাকী জ্যেঠু গল্প শোনাচ্ছেন। পরে আমাকে কেউ দোষ দিও না, “তোমাদের ডাকা হয়নি কেন ?” বলে …

সে কি পিনাকীদা, এখনও ঘুমোননি আপনি? আরে, গল্প শুরু হয়ে গেছে নাকি? তা, এবার কোথায় চললেন?

ওই তো, কলকাতা থেকে ধানবাদ, ঝুমরিতিলাইয়া, পাটনা, মতিহারি হয়ে চম্পারণ জিলার ঘোড়াসাহান গ্রামে।

আপনি দাদা, সবসময় খালি দূরে দূরে ঘুরে বেড়াতেন। ঘরের কাছে কোথাও তেল গ্যাস খুঁজতে যাননি কোনওদিন?

তাও গিয়েছিলাম তো! বারাসাতের কাছে …

এ কি, দাদা, গল্প বলছেন নাকি? আমরাও শুনবো!

এসো, এসো, বসো। আমি বলছিলাম ঝুমরিতিলাইয়ার গল্প, কিন্তু …

না, না, দাদা, ওই বারাসাতের কাছের গল্পটা বলুন।

“বারাসাতের কাছেই” কি পিনাকীদার আগামী সিরিয়ালের নাম?

দূর! বারাসাতের কাছে, মানে ... একবার বেড়াচাঁপার একটা পুকুর থেকে গ্যাস বেরিয়েছিল। সে কি কেচ্ছা! কিন্তু সেটা অন্য গল্প…

ওটাই শুনবো। নতুন মানেই অন্য, তা বলে কি গপ্পো শুনবো না?

মেজদি, পিনাকী জেঠু গল্প শোনাচ্ছেন। হাত ধুয়ে, সটান এদিকে চলে এসো।

হিমালয় মা দুর্গাকে দিয়েছিলেন সিংহ। আমার বস আমাকে দিলেন তাঁর গাড়িটা, ড্রাইভার সমেত। 

কেন দাদা, ব্যাপারটা কি ছিলো ?

আসলে কোথাও থেকে যদি তেল বা গ্যাস বেরোনোর খবর পাওয়া যায়, তাহলে আমাদের নিকটতম অফিস থেকে কাউকে গিয়ে সেই ঘটনাটার ডিটেইলড ইনভেস্টিগেশন করতে হয়। আমার চাকরী জীবনের প্রথম দিকে সেই “কাউকে”-র ভারটা আমার কাঁধে যখন তখন এসে পড়তো। এবারেও তাই হয়েছিলো। আমি ...

শুধু আপনি? মানে আপনি একাই গেলেন ?

না, মানে আরও ছিলেন আমার দুই অফিসতুতো সিনিয়র দাদা। আমাকে পাহারা দিয়ে নিয়ে যাবেন বলে সাথে এলেন তাঁরা। আমি যত বলি, পাহারা কেন লাগবে, দাদা? তো তাঁরা বললেন, লাগে, লাগে, zআন্তি পারিস না! পরে বুঝবি

বসের অ্যাম্বাসেডার গাড়ির পেছনে দুই দাদা। আমি যন্ত্রপাতি নিয়ে সামনের সীটে।

কি জ্বালা! যন্তর-মন্তর সব তো ডিকি-তে রাখবেন তো!

উঁহু! কাচের শিশি বোতল, গ্যাস জার... ও সব ভেঙে যেত ডিকিতে। তো, তাপ্পর চলতে চলতে চলতে চলতে গাড়ী এসে দাঁড়ালো চাঁপাডালির মোড়ে। ওটা, বুঝলি, বারাসতের একটা ল্যান্ডমার্ক, চাঁপাডালির মোড়।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, চাঁপাডালির মোড় খুব চিনি। 

এদিকে আমার আবার শ্বশুরমশাইয়ের শ্বশুরবাড়ি বারাসত। এই ঘটনার ক'দিন আগেই বিয়ের পরে পেত্থম আমার দিদিশাশুড়ীকে পেন্নাম করতে গেছিলাম সেখানে।

আরে, এ তো মেগাসিরিয়াল হচ্ছে! খালি, কি বলে, আসলি গ্যাসের গপ্পো কিধার গ্যয়ী?

আরে, হচ্ছে হচ্ছে, গল্পই তো হচ্ছে। এত তাড়াহুড়ো কিসের? সে কি ঝামেলি, বুঝলি, এক বাড়ী মামাশ্বশুর, তার ওপর এক গাড়ী মামীশাশুড়ি, আর সর্বোপরি এক কিন্ডারগার্টেন ভত্তি মামাতো শালা শালি। পেন্নাম কত্তে গিয়ে কেস খেয়ে গেছি। মহিলামহলে সে কি হাসাহাসি! ক’টা এক্স্ট্রা প্রণাম ঠুকেছি, কে জানে? তা সে যাই হোক, সব্বাই বলে, বাঃ কি সুন্দঅঅঅঅর জামাই। হইচই শুনে পাড়াপড়শীরাও এসে হাজির। তা, তারাও বললো, বাঃ জামাই, বেশ জামাই, খাসা জামাই! চলো জামাই, সিনেমা দেখাবে চলো!

শেষে লালী সিনেমায় সিলসিলা দেখাতে নিয়ে যেতে হয়েছিলো সব্বাইকে। ইনক্লুডিং মামাজ, মামীজ এন্ড পাড়াপড়শীজ ...

তারপরে জ্যোতি মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে নিয়ে গিয়ে ভেজিটেবল চপ আর তালশাঁস। হাঁসফাঁশ অবস্থা হয়ে গিয়েছিলো আমার সেদিন প্রায়… আমি তাপ্পর থেকে সব সিনেমা দেখি, হলে অথবা টিভিতে, সঅঅঅঅব সিনেমা! শুধু সিলসিলা ছাড়া… আমার বোধহয় সিলসিলা ফোবিয়া হয়ে গেছে। আমার আর জয়াদির... 

তা সে যাই হোক, আমি যাচ্ছি গ্যাস বের করতে বেড়াচাঁপার পুকুর থেকে…

এর মধ্যে চাঁপাডালির মোড়ে পৌঁছাতেই দুই দাদা পেছন থেকে বললেন... এই! পৃথিবীর গাড়ীটা থামাও। আমি (মানে আমি না, ওঁরা) নেমে যাবো।

আমি বললাম, সে কি? এটা তো বারাসত! আমাদের তো যেতে হবে বসিরহাটের দিকে... বেড়াচাঁপা

দাদারা বললেন, সে আমরা কি জানি? তোকে পাঠিয়েছে, তুই যাবি। আমরা এই পর্যন্ত তোকে পাহারা দেবো ঠিক করেছি। এতদূর গার্ড দিয়ে নিয়ে এলাম... এর পরের টুকু তুই বুঝে নে! নাহলে চাকরী কত্তে এয়েছিস কেন?

বোঝো ঠ্যালা, দাদার দাদারা সব "কেটে পড়ি ভেগে পড়ি"-র ধান্দা করতেছেন!

আমি বললাম, তাইলে এটুকুই বা এলেন কেন? আমার আসল সাহায্যের দরকার তো ওখানে...

তাঁরা বললেন, বাচ্চা ছেলে, বাচ্চাদের মতো থাকবি। বাচ্চাদের বেশী কতা কইতে নেই। আর শোন, বেড়াচাঁপা ঢোকার মুখেই একটা থানা পড়বে রাস্তার বাঁ হাতে। ওই থানাতে গিয়ে নিজের আই ডি দেখিয়ে দুটো পুলিশ নিবি সাথে। পুলিশ ছাড়া একদম ঢুকবি না ওদিকে, বুঝলি... 

বলেই দাদারা সুড়ুত করে কোথায় যেন কেটে পড়লেন।

কি বিচ্ছিরি সব দাদা জোগাড় করেছিলেন আপনি, দাদা!

তা আমি তখন একা পড়ে গিয়ে মনের দুঃখে জ্যোতি মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে গিয়ে দুটো সিঙ্গারা আর চা নিয়ে ড্রাইভারের সঙ্গে ভাগ করে খাচ্ছি। চা পেয়ে ড্রাইভারের হঠাৎ মৌনীব্রত ভাঙল। সে বললো, স্যার, এই দুজনকে এনেছেন কেন সঙ্গে?

আমি বললাম, এঁরা আমার বস হে! না এনে কি উপায় আছে? 

সে বললো, আপনি নতুন ঢুকেছেন, কিছু জানেন না। এনাদের অন্য ধান্দা আছে।

আমি জিজ্ঞেস করলাম সেটা কি ?

ড্রাইভার বললো, আমাকে বলেছে ফেরার সময়ে ওদেরকে নোয়াপাড়া থেকে তুলে নিতে। 

আমি, কোথায় নোয়াপাড়া, কেন নোয়াপাড়া … এ সব কিছুই না বুঝে ভ্যাবলার মতো বললাম, আচ্ছা !

এমন সময়ে মিষ্টির দোকানের মালিক বললেন, আপনি দুলালের জামাই না? আমি ঘাবড়ে গিয়ে বললাম, আমার শ্বশুর মশাইয়ের নাম দুলাল নয়। তিনি বললেন, আরে তোমার শ্বশুর অইলো অগো জামাই। আমি তোমারে চিনসি ... তুমি তো দুলালের ভাগ্নী জামাই।

আমি কাতর গলায় বললাম, আমাকে ছেড়ে দিন, আমি আর কক্ষনো আপনার দোকানে আসবো না ! 

ভদ্রলোক বললেন, তুমারে ছাড়বো ক্যান? তুমি তো এই দুকানের লক্ষ্মী। 

আমি বললাম, আমি লক্ষ্মীও নই, সরস্বতীও নই। আমাকে ছেড়ে দিন। আজকে আমি অফিসের কাজে এসেছি। পকেটে মাত্তর পঞ্চাশটা টাকা আছে।

ভদ্রলোক বললেন, তুমি আমাগো জামাই, তোমাত্থে পয়সা নিমু না। 

আমি মনে মনে বললাম, দেড়শ টাকা যেদিন বিল হয়েছিলো, সেদিন কি আমি আপনাদের জামাই ছিলাম না? এখন এক টাকা তিরিশ পয়সা ছেড়ে দিয়ে জামাই আদর দেখাচ্ছেন? মুখে বললাম, না, এই টাকাটা আপনি নিয়ে নিন। আর কোনওদিন এখানে আসবো না …

তারপরে শুনি দোকানদার ভেতরে গিয়ে একটা ছেলেকে বলছেন, দুলালের বাড়ীত য্যায়া কয়্যা আয়, তাগো জামাই আইসে! শুনেই আমি টেবিলের ওপর পয়সা রেখে, এক ঢোঁকে এক ভাঁড় দুধের সর-ওয়ালা চা ক্যোঁৎ করে গিলে, দে দৌড়। দৌড়তে দৌড়তে গাড়ীতে উঠে সোজা বেড়াচাঁপা পি এস। মানে থানা।

সেখানে দেখি সেকেন্ড অফিসার নেই, থার্ড অফিসার রাউন্ডে গেছেন – এই রকম অবস্থা। শুনলাম বসতে হবে। খানিকক্ষণ উশখুশ করে বললাম, মেজবাবু কোথায় গেছেন? খুব তাচ্ছিল্যের সাথে উত্তর এলো, সে জেনে আপনি কি করবেন? আমি বললাম, আমার একটু তাড়া আছে। ছোটবাবু বললেন, আরে রাখুন মশায় আপনার তাড়া! একটা পুকুর দুম ফটাস হয়ে যেতে বসেছে, আর আপনি বলছেন তাড়া !

পুকুর দুম ফটাস মানে কি? আরে, এ তো মনে হচ্ছে আমারই পুকুর! ছোটবাবু বললেন, আপনার পুকুর মানে? এটা অমুকের খাস জমিতে খোঁড়া চলছে, আর আপনি বলছেন আপনার পুকুর? কে আপনি, হরিদাস পাল? আমি বললাম, দেখুন... ওই পুকুরের ইনভেস্টিগেশন করতেই আমি এসেছি। তিনি এবার উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ইনভেস্টিগেশন করার আপনি কে, মশাই? ইনভেস্টিগেশন করে পুলিশ। আপনি কে? সি বি আই?

এমন সময় মেজোবাবু এলেন। মাথায় টুপি নেই। ঘর্মাক্ত কলেবর। ঘাম মুছতে মুছতে চেয়ারখানা পা দিয়ে ফ্যানের নিচে টেনে এনে বসতে বসতে ছোটবাবুকে বললেন, প্রেস আসছে! শালা **** আমাদেরও ফাঁসাবে এইবার! 

ছোটবাবু আমার দিকে ইশারা করে বললেন, সি বি আই!

মেজোবাবুর আর চেয়ারে বসা হলো না। তিনি ঝপাং করে লাফিয়ে উঠতেই আমি আমার আই কার্ডটা দেখালাম। তিনি ও সব দেখতেই চান না, খালি বলেন, দিল্লী? দিল্লী? 

আমি বললাম, না স্যার, আমি কলকাতা থেকে আসছি।

কেন? কেন? কলকাতা থেকে আসছেন কেন? 

আমি বললাম, কলকাতাতেই ছিলাম তো! আমার অফিস কলকাতায়। এই যে আমার আই কার্ড। 

ভদ্রলোক কার্ড দেখতেই চান না। আমাকে টপকে পেছনের চেয়ারে বসা ছোটবাবুকে জিজ্ঞেস করলেন, বাইরে গভর্নমেন্ট অফ ইন্ডিয়া লেখা সাদা অ্যাম্বাস্যাডারটা কার? ছোটবাবু আমাকে দেখিয়ে দিলেন ... তখন মেজোবাবু আমার দিকে ফিরে বললেন, স্যার, দিস ইজ এ কেস অফ লোকাল পলিটিকাল রাইভালরি। উই শ্যাল সাবমিট আওয়ার ইনভেস্টিগেশন রিপোর্ট টুডে টু দা সিআই অ্যান্ড এসডিপিও অফিস। ইউ নীড নট গেট ইনটু দিস।

আমি বললাম, আই হ্যাভ অলরেডী গট ইনটু দিস। কিচ্ছুটি করার নেই। আমার ওই গ্যাসটা পরীক্ষা করে স্যাম্পল নেওয়া দরকার। আপনি দয়া করে দুয়েকজন কনস্টেবলকে আমার সঙ্গে দিয়ে দিতে পারবেন, যাতে আমার কাজে অসুবিধে না হয় ?

মেজোবাবু বললেন, আপনি কে? কি কাজ করেন? কোথায় থাকেন? আপনার পরিচয় কি? 

আমি বললাম, আপনাদের ছোটবাবুর মতে, আমার নাম হরিদাস পাল। আমি সি বি আই -তে চাকরী করি। আপনাদের কাজ নিজের ঘাড়ে নেবো বলে এখানে এসেছি। আর বাইরের গাড়ীটা আমার।

কিন্তু আসলে, আমার নাম পিনাকী চক্রবর্তী। পেশায় জিওলজিস্ট। আপাতত আমি কেন্দ্রের তেল গ্যাস বিভাগ থেকে আসছি। দেশে কোন জায়গা থেকে তেল বা প্রাকৃতিক গ্যাস বেরোতে থাকলে, এবং সেটা সরকারের কানে গেলে, আমাদের মতো কিছু লোককে সেটা পরীক্ষা করতে পাঠানো হয়। আমাকে সেই কাজে পাঠানো হয়েছে। আর বাইরের গাড়ীটা আমাদের ডাইরেক্টরের। তাঁর কাছে কেন্দ্রীয় তেল মন্ত্রকের থেকে খবর এসেছে এই পুকুর থেকে গ্যাস বেরোনোর। তিনি স্বয়ং নিজের গাড়ী দিয়ে আমাকে এখানে পাঠিয়েছেন। এবারে বলুন আপনি আমাকে কি ভাবে সাহায্য করতে পারেন ?

ওব্বাবা, মেজোবাবুকে চমকালেন তো ভালোই !

আমি চমকাইনি। ভদ্রলোক প্রেস টেস নিয়ে এমনিতেই চিন্তিত ছিলেন। তার ওপর ছোটবাবুর ছ্যাবলামোটা ওনার চিন্তিত মাথায় ঠিকমতো ঢোকেনি। ওদের মধ্যেই একটু ভালোমানুষ টাইপস ... ঘোঁ ঘুররর ঘুঁৎ ...

ও দাদা, ঘুমালেন নাকি? ও পিনাকীদা!

উঁ? অ্যাঁ? এহে, ঘুমিয়ে পড়েছিলাম নাকি? ওই ট্রেনে উঠলে আমার কিরকম যেন ঘুম পেয়েই যায়। তা ... কি যেন বলছিলাম ... হ্যাঁ, মনে পড়েছে! মেজোবাবুর কথা। মেজোবাবু বললেন, আপনার কি ধরনের সাহায্য চাই, স্যার? ইয়ে, মানে আমি ছাপোষা মানুষ, বাড়ীতে একপাল পুষ্যি। এখানে স্যার, বুঝলেন না, ব্যাপারটায় একটু গণ্ডগোল আছে। আপনাকে সাহায্য করতে গিয়ে আমি যদি ফেঁসে যাই !

ই কি কারবার রে বাবা! আমি সরকারী চাকুরে, সরকারী কাজে এসেছি পুলিশের কাছে! আর পুলিশ বলে কি না আমাকে সাহায্য করলে ফেঁসে যাবে? বললাম, আপনাকে কিচ্ছু করতে হবে না। আপনি শুধু আমাকে বলুন যে কি হয়েছে! ঘটনাটা কি ঘটেছে এখানে? কথা নেই বার্তা নেই... একটা পুকুর থেকে শুদুমুদু গ্যাস বেরোতে লাগলো! ধুর মশাই, ওরকম হয় নাকি?

ছোটবাবু এর মধ্যে একটা ছোকরাকে ধরে নিয়ে এসেছেন। সে একটা চ্যাটচ্যাটে কাচের গেলাসে গাঢ় বাদামী রঙের চা রেখে গেল আমার সামনে। উপস্থিত আর সবাইকেও দিলো। মেজোবাবু বললেন, নিন স্যার, চা খান।

আমার চায়ের দরকার ছিলো না, এইমাত্তর জ্যোতি মিস্টান্ন ভাণ্ডারের সর দিয়ে মাখামাখি চা খেয়ে এসেছি। তাও নিলাম গেলাসটা। মেজোবাবু বললেন, ওই স্যার, একটা পুকুর খোঁড়া হচ্ছিলো। আমি বললাম, কার পুকুর? মেজোবাবু বললেন, কেন স্যার? কার পুকুর, তা দিয়ে কি দরকার? আমি বললাম, এটা তো আমাকে লিখতে হবে রিপোর্টে, যে পুকুরটা কার? মানে যদি সত্যিই আমাদের কাজের গ্যাস, মানে প্রাকৃতিক গ্যাস বেরিয়ে থাকে পুকুরটা খোঁড়ার সময়, তাহলে তো ওই জমি অধিগ্রহণ করতে হবে, তারপর ...! 

মেজোবাবু বললেন, স্যার, জমি অধিগ্রহণ করতে হবে না ! আসলে, গ্যাস বেরোয়নি ! 

আমি চমকে উঠে বিষম খেলাম! আমি চমকে উঠলেই বিষম খাই। ওটা আমার বদ অভ্যাস। তা, নিজের পকেট থেকে রুমাল বের করে টেবিলটার আমার সামনের অংশটা পরিষ্কার করতে করতে মেজোবাবু বললেন, স্যার, বিষম তো খাওয়ারই কথা! এতক্ষণে আপনার কথা নিশ্চয়ই জানাজানি হয়ে গেছে, আর আপনাকে সবাই নিশ্চয়ই গালমন্দ করছে! শুনে আমি আবার বিষম খেলাম।

এবার অনেকটা সময় নিয়ে ঝেড়ে কেসে গুছিয়ে নিয়ে বললাম, প্রথমে বলুন, ‘গ্যাস বেরোয়নি’ মানে কি? তাহলে কি মিনিস্ট্রিতে ভুল খবর দেওয়া হয়েছে? আচ্ছা, সে যাক! সে খবর ঠিক হোক, ভুল হোক, আপনি একটা কাগজে আমাকে লিখে দিন যে এখানে, মানে বেড়াচাঁপাতে কোন পুকুর থেকে অতীতে কোন গ্যাস বেরোয়নি, বা ভবিষ্যতেও বেরোবে না। তারপর নিচে সই করে থানার স্ট্যাম্প লাগিয়ে দিন। আমারও কাজ শেষ, আপনারও ঝামেলার হাত থেকে ছুটী।

মেজোবাবু বললেন, গ্যাস বেরোয়নি, মানে বেরিয়েছে। মানে গ্যাস বের করা হয়েছে! 

অ্যাঃ, লোকটা কি খারাপ খারাপ কথা বলছে! আমি বিরক্ত হয়ে অন্যদিকে তাকালাম। তাই দেখে ছোটবাবু দয়াপরবশ হয়ে বলে দিলেন, স্যার, পুকুরটা খুঁড়ছিল একটা ডিসপিউটেড জমিতে। তাই অন্য পার্টি এসে পুকুরে কার্বাইড ফেলে দিয়েছে। তাইতেই গ্যাস বেরিয়েছে। হেঃ হেঃ হে !

আচ্ছা জ্যেঠু, ফেলতে হলে তো ড্রাই আইস-ই ফেললে পারত... ভুড়ভুড় করে জলে বুদবুদ উঠে ধোঁয়া বেরোতো... লোকে আরও ভয় খেত।

সে নাহয় ভয় খেত, কিন্তু আমার আর ড্রাই আইস লাগবে না… ছোটবাবুর সব্বোনেশে কথা শুনেই আমার তখন মাথায় বুদবুদ বেরিয়ে ধোঁয়া উঠছ! বলে কিনা, কে বা কাহারা পুকুরে কার্বাইড ফেলেছে, অ্যাঁ! সে কি কাণ্ড! গ্যাস মানে তো তাহলে অ্যাসিটিলীন? আরে, এ তো বিপজ্জনক ব্যাপার! তা আপনারা কি করলেন? 

মেজোকত্তা খুব ক্ষুণ্ণ মনে বললেন, আঃ, আপনি আবার এসব কথা তুললেন কেন, ছোটবাবু? ওনার ডিপার্টের ব্যাপার না, এটুকু বললেই চলতো! কে কার্বাইড ফেলেছে, কে পুকুর খুঁড়ছিল, এত কথায় ওঁর কাজ কি? না স্যার, আমরা যা জানি, আপনাকে বলেছি। হেডকোয়ার্টারেও জানিয়ে দিয়েছি। এখন আপনি যা চান, করতে পারেন।

আমি বললাম, আমার সঙ্গে দুজন কনস্টেবল দিন। আমি ওখানে গিয়ে গ্যাসের স্যাম্পল কালেক্ট করা যায় না কি, দেখবো। আপনার লোক আমার সঙ্গে থাকবে শুধু, ওদের স্যাম্পল নিতে হবে না। আমি পারলে স্যাম্পল নেবো, না পারলে ফেরত চলে যাবো। ফিরে গিয়ে রিপোর্ট দেবো। সে রিপোর্ট যাবে দিল্লী। ব্যাস, আমার কাজ শেষ। 

মেজোবাবু বললেন, আমার কনস্টেবল ওখানেই আছে। আপনি চলে যান। গিয়ে যা পারেন করুন। কিন্তু মারধোর খেলে আমার কাছে আসবেন না কমপ্লেন করতে। আমি কিন্তু আপনাকে ওখানে যেতে একবারও বলিনি। বলে তিনি অভিমান ভরা ছোট বাচ্চার মতো অন্য দিকে মুখ করে বসে থাকলেন।

আমি দুগগা দুগগা করে তো গেলাম পুকুরপারে। গাড়ীটা বড় রাস্তাতেই ছেড়ে রেখে বোতল টোতল, বালতি টালতি কোলে কাঁকে ঝুলিয়ে গুটিগুটি পায়ে হেঁটে গেলাম। তা, সেখানে দেখি বিরাট ভিড়। সেই ভিড় ঠেলে পুকুরের সামনে গিয়ে খুঁজতে লাগলাম সেই পুলিশের কনস্টেবল কোথায়! দেখি সে উল্টোদিকের গাছতলায় বসে বসে ঢুলছে। তার কাছে গিয়ে গাছতলায় পোঁটলাপুঁটলি নামিয়ে তাকে জাগালাম। জিগেস করলাম, পুকুরটা যিনি কাটাচ্ছেন, তিনি কোথায় ?

আমাকে অচেনা লোক দেখে গ্রামের অনেক ছেলে ছোকরাই দল বেঁধে কাছ ঘেঁষে এসেছিলো। তাদের একজন বললো, লোক জোগাড় করতে গেছে বাড়ীতে। ফিরে এসে লাশ নামিয়ে দেবে ! 

কার লাশ, কে জানে! কিন্তু ওটুকু শুনেই আমার অবস্থা টাইট! তাও জিগালাম, নামটা কি সেই ভদ্রলোকের? সবাই সমস্বরে একটা নাম বললো। তার পরে বললো, চুরি করে পুকুর কাটছিলো, ধরা পড়ে গিয়ে তড়পাচ্ছে!

ওরেব্বাবা, এক্কেরে লাশ ? শুনে লাগে হাঁসফাঁস !

বাপরে ক্ষি কাণ্ড !

চুরি করে পুকুর কাটা আগে শুনিনি ! 

একেই বোধহয় বলে পুকুর চুরি ! 

সে যাই হোক, আমি দেখলাম একটা দিকে পুকুরে অল্প জল আছে। আর অন্য দিকটায় বাঁধ দিয়ে আলাদা করা আছে। সে দিকে একটা পাম্পও লাগানো আছে। কাটার সুবিধের জন্যে জলটা ছেঁচে বাইরে ফেলার জন্যে। আর যা দেখলাম, তাতে আমার চোখ খুলে গেলো। দেখতে পেলাম মাটির ফুট দশ পনেরো নিচে একটা কালো লেয়ার। পাতলা, দুই তিন ফুটের লেয়ার, কিন্তু দেখে কয়লা কয়লা লাগছে। এটা তাহলে নিশ্চয়ই ক্যালক্যাটা পীট।

ক্যালকাটা পীট কি ?

পীট হলো কচি কয়লা, বাচ্চা বয়েস, সবে জন্মেছে - এখনও কয়লা হয়ে ওঠেনি। কিছুদিন (কয়েক লক্ষ বছর) মাটীর নিচে কাটালে লিগনাইট হবে। তার পরে কপাল ভালো থাকলে আরও লাখ কুড়ি বছর পর হয়তো বিটুমিনাস কোল হবে, যা আমরা ব্যবহার করি।আর আরও বিবর্তন হলে হালকা ফুলকা অ্যান্থ্রাসাইট হবে। নাও হতে পারে। সে যাক, কিন্তু এই ক্যালক্যাটা পীট লেয়ারটা আমাদের বাড়ীর কাছে (টালীগঞ্জে) মাটির অনেক গভীরে পাওয়া যায় - মেট্রো রেলের খোঁড়াখুঁড়ির সময়ে দেখেছিলাম। কলেজের ল্যাবে নিয়ে গিয়ে টেস্টও করেছিলাম। এই পীটের সঙ্গে অনেকটাই মিথেন বা মারশ গ্যাস মিশে থাকে। চাপ পড়লে বেরিয়ে আসে...

বেড়াচাঁপায় ক্যালকাটা পীট, বটে বটে, কি আনন্দ !

আসলে দক্ষিণবঙ্গের উপকূলবর্তী অঞ্চল আস্তে আস্তে দেবে যাচ্ছে মাটির নিচে। তাই যত দক্ষিণে যাওয়া যায়, একেকটা লেয়ার মাটির মধ্যে আরও গভীরে পাওয়া যায়। সবই কাদা মাটি হলে চেনা যেত না। কিন্তু এইরকম পীটের লেয়ারগুলো কাদা মাটির মধ্যে এক রকম মারকার হিসাবে কাজ করে। এরা বোঝায় সে সুন্দরবন টাইপের জঙ্গল এককালে এই অঞ্চলে ভরে ছিলো। কোন এক প্রাকৃতিক দুর্যোগে হঠাৎ মাটি চাপা পড়ে যায়। সেই মাটির ওপরে আবার জঙ্গল গজায়। আবার তার গাছপালারা চাপা পড়ে। এই করে করে এই ক্যালক্যাটা পীটের সৃষ্টি ...

দারুণ তো, দাদা !

খুব সুন্দর। জ্ঞান বাড়লো। জয় গুরু !

গ্যাস দেখতে গিয়ে পুকুরচুরি, তাপ্পর নবজাতক কয়লা, এপ্পর আরও কি আছে জ্যেঠু ?

এপ্পর আছে চামর! মানে চামরমণি... কিন্তু সে নাহয় হবে পরে। আপাতত এই ক্যালক্যাটা পীটকে সামলাই। এই ক্যালক্যাটা পীটকে ঘাঁটাঘাঁটি করলে একটু আধটু মিথেন বেরোতেই পারে। কাজেই স্যামপলটা নেওয়া দরকার। তাই আমি আশপাশের ছেলেগুলোকে বললাম, আমি একটু গ্যাসের স্যাম্পল নেবো। আপনারা একটু জায়গাটা খালি করে দেবেন ? 

তারা বললো, আপনি নিন না যত খুশী গ্যাস। শুধু আমাদের জন্যেও একটু রেখে দেবেন, যাতে রাতের রান্নাটা হয়ে যায়। আর একটু আলো জ্বালানো যায়।

এখানে যা অবস্থা, এদেরকে আর বোঝাতে গেলাম না যে এই গ্যাসে আলো না, আলেয়া জ্বলে। আমি বললাম, কাজটা একটু বিপদজনক। পুকুর হঠাৎ করে দুম ফটাশ হতে পারে (থানার ছোটবাবু বেশ ভালো আইডিয়া দিয়ে দিয়েছিলেন মাথার মধ্যে) …

এই ধরনের সতর্কবাণীতে বিহার ইউ পি থেকে ত্রিপুরা পর্যন্ত দেখেছি লোক সড়াৎ করে হাওয়া হয়ে যায়। কিন্তু বেড়াচাঁপার লোক বেশ চালাক চতুর। আলোকপ্রাপ্তও বটে... অত অল্পে ঘাবড়ায় না। ছোকরাগুলো বললো, আপনি লেগে পড়ুন দাদা। আপনার কিছু হলে আমরা বডি তুলে বাড়ি পাঠিয়ে দেবো …

মেজাজটা গরম হয়ে গেল, কিন্তু নিজেকে খালি বোঝাতে লাগলাম, এখানে খাপ খুলোনা শিবাজী, এ হলো পলাশী! যাই হোক, তারপর গ্যাস জার, ফানেল, টিউব, বালতি টালতি সব নিয়ে জলে নেমে পড়লাম, যা থাকে কপালে...

পুকুরে যেদিকে জল ওই পীটের লেয়ারটাকে ঢেকে রেখেছে, সেখান দিয়ে সমানে বুদবুদ উঠছে। আমি সেগুলোকে ফানেল চাপা দিলেই সে গ্যাস সেখান থেকে সরে গিয়ে অন্য কোথাও দিয়ে বেরচ্ছে। আসলে ওদের এই একটা গ্যাস জারে ঢুকে নিজেদের সদ্যপ্রাপ্ত মুক্তিযোগটা হারানোর কোনই ইচ্ছে নেই। সিরিঞ্জ দিয়ে টেনে হিঁচড়েও ওদেরকে কোনমতেই বোতলে ঢোকানো যাচ্ছে না। আমি একদিকে চেষ্টা চরিত্র করার সময়ে ওরা অন্য দিকে গিয়ে বুড়বুড়ি কাটছে ... আমি ওদের পেছনে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে দৌড়চ্ছি, দৌড়তে গিয়ে কাদা আর পাঁকের মধ্যে আছাড় খাওয়ার উপক্রম ... এই সবই পাড়ের ওপর দাঁড়ানো জনতার বেশ হাসির খোরাক হচ্ছে। 

তাই দেখে আমি বললাম, আচ্ছা, দাঁড়াও ! হাসি বের কচ্ছি! বলে, পকেট থেকে দেশলাই বের করে একটা কাঠি জ্বেলে আমি ওই বুড়বুড়ির মধ্যে ফেলে দিতেই পুকুরের ওপর একটা ছোট্ট আগুনের শিখা এদিক ওদিক করতে করতে মিলিয়ে গেলো। পাড়ের থেকে একটা সম্মিলিত "সর, সর" ধ্বনি শোনা গেলো। কিন্তু একটু সরে গেলেও, কেউ পারমানেন্টলি পালালো না। বরং সবাই একটু প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠলো। একটা ছেলে আমাকে বললো, এই দিকে না, ওই দিকে দেখুন দাদা, ওই গ্যাসটা ধরুন। বলে পুকুরের একদিকে একটা ঢ্যালা ছুঁড়ে মারলো। আমার কানের পাশ দিয়ে বোঁ করে বেরিয়ে গেলো সেটা। আমি তাড়াতাড়ি দুটো বোতলেই জল আর হাওয়া ভরে নিয়ে, দুটো পীটের স্যাম্পল তুলে নিয়ে বড় রাস্তায় পালিয়ে এলাম প্রাণ বাঁচিয়ে।

পুকুরপাড় থেকে এক দৌড়ে বড় রাস্তায় উঠে এসে দেখি ড্রাইভার বুদ্ধি করে গাড়ীর মুখ উল্টোদিকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে রাস্তার এপাশে ঘাসের ওপর পার্ক করে রেখেছে। কিন্তু গেল কোথায় ব্যাটা? ড্রাইভার দাদা, কোথায় গেলেন ভাই, আমাকে এই শত্রুপুরীতে ফেলে! এই অসময়ে কেউ চা খেতে যায়? আমার দুই হাতে দুটো গ্যাস জার, এক বগলে ঢাউস ফানেল আর লটর পটর পাইপ, অন্য হাতের কনুই থেকে ঝোলানো বালতি – সে দৃশ্য দেখলে অতি পাষাণহৃদয়ও গলে যাবে। কিন্তু আমার পেছনে উৎসাহী দর্শকদের মন গলছে না। তার ওপর আবার আছে লাশ ফেলে দেওয়া পাব্লিক। তার সঙ্গে তো এখনও দেখাই হয়নি... ওরে বাবারে! ওরে ব্যাটা ড্রাইভার, গেলি কোথায় লক্ষ্মণ ভাই আমার? 

সত্যিই তো, গেল কোথায় সে আপনাকে ফেলে?

পুকুর পারে গিয়ে বসে নেই তো? দেখুন, মজা দেখতে ওখানেই গেছে নিশ্চই!

আরে যাক না, পুকুরপারে! আমি কি মানা করেছি নাকি? কিন্তু আমাকে পালাতে দেখে, ওরও তো পালিয়ে আসা উচিৎ ছিলো! সে ব্যাটা নিজেও তো ওখানে অচেনা লোক! জনতা দেখতে পেলে তো পেঁ... না, না ঠেঙিয়ে বৃন্দাবন দেখিয়ে দেবে! 

স্যার, আপনি এসে গেছেন? আমি তো আপনাকেই খুঁজতে গেছিলাম। দাঁড়ান, পেছনটা খুলে দিই, স্যার? 

আপনাকে কষ্ট করে কিছু খুলে দিতে হবে না। শুধু এই বালতিটা একটু ধরবেন? আর এই জারটা? উফ, এই বোতলটা হে বোতলটা, এটাকেই জার বলে। আরে, আরে, উল্টাবেন না ওটাকে! যেমন আছে তেমনই রাখুন, নইলে সব গ্যাস বেরিয়ে যাবে!

স্যার, উল্টো তো আপনিই ধরেছেন। দৌড়ে আসতে গিয়ে আপনার কিছু খেয়াল নেই !

আপনি দাঁড়ান তো এগুলো ধরে। আমাকে আগে উঠে বসতে দিন। 

সামনের সীটে বসে, গাড়ির মেঝের কার্পেটে একটা জারের কর্কটা রেখে দুই হাঁটু দিয়ে সেটাকে পজিশনে ফিক্স করলাম। এবার ওর হাত থেকে দ্বিতীয় জারটা নিয়ে আমার কোলের মধ্যে উল্টো করে রেখে প্রিয়তমার মতো জাপটে ধরলাম। এবার বালতিটাকে পায়ের সামনে স্থান দিয়ে মনে মনে হিন্দ মোটরস কম্পানীকে ধন্যবাদ দিলাম। গাড়ী একটা বানিয়েছে বটে, ট্যাঙ্ককে বলে ওদিকে থাক। মুখে বললাম, নিন, এবার চালান, চালান – কিন্তু প্রাণের মধ্যে থেকে ডাক আসছিলো, পালান পালান !

যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালানোর ট্রেনিং পাওয়া আছে এনার। অন্তত দেখে তাই মনে হলো। বাঁইবাঁই করে গাড়ি লোকালয় ছাড়িয়ে বেরিয়ে এলো। চারপাশে চষাক্ষেত। বললাম, গাড়ী থামান। 

অনিচ্ছাস্বত্বেও তিনি গাড়ি স্লো করলেন। কেন, স্যার? 

আরে, বোতলগুলো সীল করতে হবে না? গাড়ীটা একটু সাইড করে থামান। 

দেগঙ্গা ছাড়িয়ে দাঁড়ালে হতো না, স্যার? 

আরে, কোথায় দেগঙ্গা কে জানে? এখানটা বেশ নির্জন আছে। এখানেই দাঁড়ান। 

ওই দেখতেই নির্জন স্যার, আসলে খেত খামারে লোকজন ভর্তি আছে। 

থাক লোক, আপনি দাঁড়ান।

রাস্তার ধারের ঘাসের ওপর গাড়ী থামিয়ে নামা গেল। ড্রাইভার দাদাকে বসালাম আমার জায়গায়, বোতল ধরে।

আপনার ড্রাইভার কখনও দাদা, কখনও আবার লক্ষ্মণ ভাই, তাই না দাদা !

আরে এখনও লক্ষ্মণ ভাই-ই আছে। ওনাকে বললাম লক্ষ্মণ ভাই ধরো, আর উনি বোতল ধরে বসে গেলেন। আর আমি বসলাম ঘাসের ওপর, স্পিরিট ল্যাম্প জ্বেলে, তার ওপর একটা বাটিতে মোমের বড় একটা ডেলা রেখে।

এসব আবার কোথায় ছিলো ? 

আরে ওই বালতিটা আমার দাদুর দস্তানা। কি নেই ওর মধ্যে? এ সব তো তুশ্চু! যাই হোক, খানিকক্ষণের মধ্যে মোম গলে গেল। এবার এক নম্বর বোতলটার কর্ক শুদ্ধু চুবিয়ে দিলাম ওই গলানো মোমের মধ্যে। বোতলের কান, নাক, গলা যখন মোমে ঢেকে গেল, তখন তুলে নিলাম তাকে। মোমটা শুকোতে মিনিট খানেক লাগলো। এর পর পরেরটারও ওই এক ব্যবস্থা। সব যখন চুকেবুকে গেল, তখন বালতি, ফানেল, নল, দময়ন্তী... সব চালান করলাম গাড়ীর পেছনে। তারপর গাড়িতে উঠে দুই কোলে দুই বোতল নিয়ে রওনা দিলাম আবার বারাসতের পথে।

বারাসতে এসে গাড়ী দেখি কলকাতার দিকে না ঘুরে উল্টোদিকে চললো বহরমপুরের দিকে। আমি আঁতকে উঠে বললাম, এ কি? এদিকে কেন ? 

লক্ষ্মণ ভাই বললেন, এদিকে নোয়াপাড়া। 

সে কি? নোয়াপাড়া? নোয়াপাড়া কি? নোয়াপাড়া কেন? 

ড্রাইভার দাদা বললেন, আপনাকে সকালে বলেছিলাম না, স্যার, নোয়াপাড়া! ওখানে একটা দোকানে ভালো চাল পাওয়া যায়।

চাল! চাল মানে? চাল কেন? কিসের চাল? 

আজ্ঞে, ভাতের চাল। আপনার দাদারা এয়েচেন না, সঙ্গে? তাঁরা এয়েছেন চাল কিনতে। 

কেন, চাল কিনতে এতদূর কেন? আর বসের গাড়িতেই বা কেন? এনারা তো এসেছেন আমাকে পাহারা দিয়ে নিয়ে আসতে আর নিয়ে যেতে, তাই না?

আরে না না স্যার, আপনি কিছুই বোঝেন না! আসলে স্যার, এখানে ভালো চাল সস্তায় পাওয়া যায়। আর জানেন তো, চাল এখন এক জেলার থেকে আর এক জেলায় নিয়ে যাওয়া মানা? জানেন তো, নাকি জানেন না? বাইরের চাল কলকাতায় চালান করলে পুলিশে ধরে, শোনেননি? কাগজেও পড়েননি? সে কি, স্যার? রোজ কত কেস হয়, রেলস্টেশনে আর বাসের গুমটিতে...

অ্যাঁ? তাহলে কি হবে? দাদারা যদি বস্তা বস্তা চাল তোলেন এই গাড়িতে, আর ওই থানার ছোটবাবু যদি রাউন্ডে বেরিয়ে আমাদের গাড়ী দাঁড় করিয়ে সার্চ করেন, তখন? 

আরে না, না, স্যার, এই গাড়ীতে গরমেন্ট লেখা আছে না? গরমেন্টের গাড়ী পুলিশ ধরে না, তা সে পচ্চিমবঙ্গ সরকারই হোক অথবা ভারত সরকার। আপনার স্যার, এখনও অনেক কিছু শেখা বাকী আছে !

তা, দাদা, শেষমেষ কত চাল উঠলো?

কুড়ি কুড়ি...