রম্যরচনা - ধ্রুবজ্যোতি চক্রবর্ত্তী
Posted in রম্যরচনা
রম্যরচনা
শ্রীকমলাকান্ত উবাচ - ২
ধ্রুবজ্যোতি চক্রবর্ত্তী
ডিজিটাল পৃথিবীতে অ্যানালগ জীবনযাত্রা
আজকাল লিখতে বসলেই কমলাকান্ত এসে হাজির হয়।
লক্ষ্য করে দেখেছি মাঝরাতে আমার দাদামশায়ের প্রিয় কুক কেলভি দেওয়াল ঘড়িটা যখন রাত বারোটার বারো নম্বর ঘণ্টাটা পিঠছে ঠিক তখনই আমি আমার লেখার টেবিলের আশেপাশে তার উপস্থিতিটা উপলব্ধি করতে পারি।
ঠিক বলে বোঝানো মুশকিল, তবে সদাশিব সরল ব্রাহ্মণ মানুষটির হালকা শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ ঘরের চলন্ত সিলিং ফ্যানের আওয়াজকে ছাপিয়ে খুব মৃদু ভাবে আমার কানে আসে; আর সেই সঙ্গে প্রসন্ন গোয়ালিনীর খাঁটি দুধ-দই-ননী লাঞ্ছিত শরীরের পাগল করা একটা কস্তুরী গন্ধ আমায় বিচলিত করে তোলে। মনে হয় আমার লেখার টেবিলের ওপর রাখা ল্যাম্প শেডটার আলোর উজ্বলতাটাও যেন একটু কমে আসে… এই রকম আরও বেশ কিছু ঘটনার ঘনঘটা, যা শাণিত বুদ্ধি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না, আমায় সচকিত করে তোলে।
বুঝতে পারি কমলাকান্ত আমার সাথে তার নিত্যকার বৈঠকি আলাপ-আলোচনায় এসে হাজির হয়েছে। আসলে সেও আফিম ভক্ত আর আমিও এইসময় আমার নিত্যকার গাঁজাখুরি লেখাপত্তরের সেরস্তায় গতি আনবার জন্য একটু সোমরসাসিক্ত থাকি। তাই দুজনের ভাবের আদানপ্রদানটা বেশ মনোহর হয়ে ওঠে।
কমলাকান্তের সঙ্গে এই নিয়মিত আড্ডাটা আমার কাছে ধীরে ধীরে বেশ আকর্ষনীয় হয়ে উঠেছে। আমি তাই আমার লেখার টেবিলের পাশে আর একটা চেয়ারের ব্যবস্থা করে রেখেছি। প্রথম ক’দিন সে একটু কিন্তু-কিন্তু করলেও কয়েকদিন পর থেকে দেখলাম বৃটিশ সায়েব-সুবোদের আমলে ভারতীয় নেটিভদের কেদারায় বসার অমার্জনীয় অপরাধের ভয়টা সদালাপী নিরীহ ব্রাহ্মণ কাটিয়ে উঠেছে। এখন তাই তিনি চেয়ারে বসাটা বেশ রপ্ত করে ফেলেছেন। খেটো ধুতির কোঁচাটা দিয়ে চেয়ারটা একটু ঝেড়ে নিয়ে বসে পড়েন। শুধু বসার ঢংটা পাল্টাননি। জোড়াসনে বসার অভ্যাসটা তিনি পরিত্যাগ করে উঠতে পারেননি। আর আমিও তাই প্লাস্টিকের হাতলওয়ালা চেয়ারটা সরিয়ে নিয়ে আমার দাদামশায়ের হাতলহীন একটা কাঠের চেয়ার আমার লেখার টেবিলের পাশে রেখে দিয়েছি।
গিন্নী একবার ঘর পরিষ্কারের সময় অবাঞ্ছিত সেই চেয়ারটা দেখে ভুরু কুঞ্ছিত করে উঠতেই আমি তড়িঘড়ি করে বলে উঠেছিলাম, “আসলে পুরোনো আমলের কিছু লেখা লিখতে গেলে আমি লক্ষ্য করে দেখেছি যে এই অ্যান্টিক চেয়ারটায় বসলে আমার লেখাতে বেশ একটা সমসাময়িক প্রভাব পড়ে আর সেটা লেখার মানও বহুগুন বাড়িয়ে তোলে।”
গিন্নী “পাগলে কি না বলে আর ছাগলে কি না লেখে” টাইপের একটা লুক দিয়ে আমায় ক্ষমাঘেন্না করে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলে আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলাম!
ভীষ্মদেব খোশনবীস মহাশয় কমলাকান্তকে বড়ই দাগা দিয়েছিলন। নিরুদ্দেশ হবার আগে কমলাকান্ত তার দপ্তরটি ভীষ্মদেববাবুর জিম্মায় রেখে দিয়ে গেছিলেন। কিছুদিন পর ভীষ্মদেববাবু কমলাকান্তেরর সেই দপ্তরটি বঙ্গদর্শন পত্রিকার সম্পাদকের কাছে বেচে দিয়ে কিছু কামিয়ে নিয়েছিলেন। পরবর্তী কালে কমলাকান্ত সেটা জানতে পেরে খুবই মর্মাহত হয়। তাই আমার সাথে দেখা হবার সময় কমলাকান্তকে খুবই বিমর্ষ দেখতে পেতাম। দপ্তর লেখা তো সে ছেড়েই দিয়েছে উপরন্তু কোন কাজে ঠিক মন দিতে পারে না।
(২)
তারপর ধীরে ধীরে আমার সাথে তার নিয়মিত যোগাযোগের ফলে সে অনেকটা সহজ হবার পর সে আমাকে তার মনঃকষ্টের কথা জানায়। সেটা শুনে আমি অত্যন্ত মর্মাহত হয়ে তার সমব্যাথী হই। আমার গিন্নীর মতে যতই ছাইভস্মের লেখা লিখি না কেন আমি সত্যি সত্যি লেখক কমলাকান্তের মনের দুঃখের গভীরতাটা ভীষণ ভাবে উপলব্ধী করতে পেরেছি। আমাদের এই আত্মিক যোগাযোগের ফলেই কমলাকান্ত আস্তে আস্তে আমার কাছে তার সেই হারানো রহস্যময় হাসি নিয়ে খুশীয়াল রূপে আবার ফিরে এসেছে।
এরপর একদিন সুযোগ বুঝে তাকে আমি আবার তার দপ্তর লেখার কাজে আবার মনোনিবেশ করতে বলাতে সে ভীষণ ভাবে উত্তেজিত হয়ে ওঠে। তারপর আমাকে আমার লেখার কলমের দিব্যি দিয়ে অঙ্গীকার করিয়ে নেয় যে ভবিষ্যতে আমি যেন আর কোনো দিনও তাকে এই অনায্য অনুরোধটি না করি। আর যদি করেই বসি তাহলে সেইদিনই আমাদের বন্ধুত্বতার সমাপ্তি ঘটবে। নাক-কান মুলে তার কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নিলেও আমি সেদিন বুঝতে পেরেছিলাম যে ভীষ্মদেব খোশনবীসের ওপর কি ভয়ানক এক অভিমানে এই সরল সাত্বিক ব্রাহ্মণ তার লেখনীকে গলা টিপে হত্যা করে বসে আছে।
এরকম একটা অত্যন্ত গুরুতর বিষয়ে আমার আর বিশেষ কিছু বলার নেই। তবুও আমি শুধু এটুকুই বলতে চাই যে কমলাকান্তের দপ্তরটি বঙ্গদর্শন পত্রিকার সম্পাদকের কাছে বেচে দিয়ে ভীষ্মদেব খোশনবীস মহাশয় ক’টি স্বর্ণমুদ্রার মালিক হয়েছিলেন সেটা আমার সঠিক জানা নেই বটে তবে তিনি বঙ্গসাহিত্য জগতের যে প্রভূত ক্ষতি চিরকালের তরে করে দিয়ে গেছেন সে বিষয়ে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।
আজ তাই এই অত্যন্ত হাই IQ সম্পন্ন ঊনবিংশ শতাব্দীর ব্রাহ্মণ যখন একবিংশ শতাব্দীর সমস্যা সকল নিয়ে আমার সাথে আলোচনায় বসে তখন আমি যারপরনাই স্তম্ভিত হই আর এই ভেবে দুঃখ পাই যে বঙ্গসাহিত্য বর্তমান যুগের কমলাকান্ত’র দপ্তর নামক কি এক আনমোল রতন থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
আমার এই সমস্ত লেখাই আমাদের মধ্যে ঘটিত আলোচনার ফসল মাত্র। এতে আমার বিন্দু মাত্র কোনো কৃতত্ব নেই। এই লেখাগুলোতে যা কিছু কমতি আছে তা সবই আমার। আমার একবিংশ শতাব্দীর অপরিণত মস্তিষ্ক ঊনবিংশ শতাব্দীর সেই ক্ষুরধার বুদ্ধি সম্পন্ন ব্রাহ্মণের সমস্ত যুক্তিপূর্ণ কথার সঠিক মূল্যায়ণ না করতে পারবার ফলে এই অপাংতেয় রচনাটিতে বহু কৃষ্ণগহ্বরের সৃষ্টি হয়েছে বলেই আমার ধারনা।
যাইহোক আজ দেখলাম কমলাকান্তের মেজাজটি বেশ শরীফ। হাতলহীন কেদারায় জোড়াসনে বসে সে আমায় জিজ্ঞেস করে, “বলি লেখক, এক পয়সার কালি আর দু-পয়সার কাগজে তো হাবিজাবি অনেককিছুই লিখিয়া যাও, বলি বর্তমান কালের খবর কিছু রাখ?”
তার কাছ থেকে এই প্রশ্ন শুনে আমি যাকে বলে বাক্যিহারা!
মনে মনে বেজায় রেগে গেলেও বুঝলাম পাগলা ব্রাহ্মণ ক্ষেপে গেলে আখেরে আমারই ক্ষতি। আজকাল বঙ্গসাহিত্য জগতে লেখার প্লটে বড্ড একঘেয়েমিতা এসে গেছে। সেই ধর্ষণ, খুন, জখম, পরকীয়া প্রেম, রূপোলী পর্দার গুজব, সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ আর দেশের রাজনৈতিক নেতাদের সার্কাস আর তার সঙ্গে পুটিন-কিম-জিং আর ট্রাম্প সাহেবদের “এই দিলাম তোদের মাথায় এটম বোম ফাটিয়ে” ধরনের তর্জন-গর্জন! এই ব্রাহ্মণের দৌলতে মরুভূমিতে মরুদ্যানের মত কিছু বৈচিত্রের সন্ধান পাওয়া যায় দেখে তার বিরুদ্ধাচরন করি না কখনও। দেখাই যাক আজ কমলাকান্তের রহস্যময় ভাঁড়ার থেকে কি হীরে জহরত আত্মপ্রকাশ করে!
(৩)
তাই একগাল হেসে জিজ্ঞেস করি, “না মানে সেরকম অঘটন ঘটাবার মত কোনো খবর তো আমার কাছে আসেনি। এই তো সবে আমার ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটস অ্যাপ, স্ন্যাপ চ্যাট সমস্ত অ্যাকাউন্ট থেকে আপডেটেড হয়েই তো সবে লেখার টেবিলে এসে বসতে না বসতেই আপনি এসে হাজির।”
আলো আঁধারির ধূপছায়ায় দেখতে পেলাম কমলাকান্তের মুখে সেই রহস্যময় মুচকি-মুচকি হাসিটা আবার ফিরে এসেছে যেটা দেখে প্রায় দু-শতাব্দী আগে এক এজলাসের চাপরাশী কমলাকান্তকে জিজ্ঞেস করেছিল,“হাস কেন?”
কমলাকান্তের দিকে তাকিয়ে দেখি সে তার ঊড়ুনিটা দিয়ে একবার ভাল করে মুখটা মুছে নিল। পথশ্রমের ক্লান্তি থেকে নিজেকে মুক্ত করে কোমরের গেঁজে থেকে একটি রূপোর চ্যাপ্টা ডিবে কৌটো বের করে এনে সেটা একটু চাপ দিয়ে খুলে তার থেকে গুঁড়ো দুধের ছোট্ট একটা প্যাকেট বের করে আনল। চোখ তুলে আমার হাঁ-করা মুখের দিকে তাকিয়ে একটু মুচকি হাসল মাত্র। আমি অবাক চোখে তার কার্যকলাপ দেখে যেতে লাগলাম।
নীল রঙের ছোট্ট দুধের প্যাকেটটা হুবহু তারকা হোটেলের ঘরে রাখা কমপ্লিমেণ্টারি চায়ের সরঞ্জামের সঙ্গে দেওয়া গুঁড়ো দুধের প্যাকেটের মতো। শিবরাম এই গুঁড়ো দুধকেই বোধহয় “রাবড়ি চূর্ণ” বলতেন।
কৌতুহল বশতঃ কমলাকান্তর খোলা চ্যাপ্টা ডিবের দিকে নজর করে দেখি ডিবেটিতে বেশ কতকগুলো ছোট ছোট ধূসর রঙের মার্বেলের গুলির মতন জিনিস।
বুড়ো আঙুল আর তর্জনী দিয়ে ডিবে থেকে একটি গুলি তুলে আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়েই মা’কালীর মতন এক হাত লম্বা জিভ কেটে কমলাকান্ত বলে ওঠে, “ও…হো…হো, তুমি তো আবার এ-রসে বঞ্চিত।” বলেই হাতের গুলিটি গালে ফেলে গুঁড়ো দুধের ছোট্ট প্যাকেটটি একটানে ছিঁড়ে মুখের মধ্যে প্যাকেটের পুরো দুধটা ঢেলে দিল। তারপর তারই জন্য নির্দিষ্ট আমার টেবিলে্র ওপরে রাখা পেতলের ঘটির জল খানিকটা মুখে নিয়ে কুলকুচো করে গিলে ফেলল।
আমার হাঁ-করা মুখের দিকে তাকিয়ে কমলাকান্ত বলে ওঠে, “এক্ষণে তো আর প্রসন্ন নাই, তাই আফিমের সঙ্গে প্রয়োজনীয় দুধের ব্যবস্থা এই প্রকার সাব্যস্ত করিয়াছি। অস্থানে-কুস্থানে দুধের জন্য আর ঘুরিয়া মরিতে হয় না। প্রসন্ন বিহনে কিয়ৎকাল বড়ই অসুবিধা হইয়াছিল। এক্ষণে আর কোনো সমস্যা নাই।”
আমার হাঁ-করা মুখের অবস্থা বড়ই করুণ। মাঝে-মাঝেই চিমটি কেটে দেখতে ইচ্ছে করছে “একি সত্য, সত্য… সকলই সত্য?” কিনা! কিন্তু পাছে আমার সন্দেহবাতিকতার জন্য কমলাকান্ত চটে গিয়ে ফেরত চলে যায় এই ভেবে ভয়ে ভয়ে আমি স্ট্যাটাসকো বজায় রাখলাম।
আফিমের মৌতাতে চোখ বুঁজে বুঁদ হয়ে জোড়াসনে আদুড় গায়ে বসা শুভ্রকান্তি কমলাকান্ত যেন কোনো এক ধ্যানস্থ ঋষি। নিমীলিত আঁখিতে একটা শান্ত স্নিগ্ধ ভাব। সারা ঘর জুড়ে এক অদ্ভুত প্রশান্তি বিরাজ করছে।
আমি সেই নিস্তবদ্ধতাকে সম্মান জানিয়ে নিশ্চুপ হয়ে অতি ধীরে ধীরে আমার নিশ্বাস-প্রশ্বাসকে জারি রাখলাম।
কিছুক্ষন পরে কমলাকান্ত চোখ খুলল। মুখে আবার তার সেই রহস্যময় হাসিটা ফিরে এসেছে। এবার পূর্ণ দৃষ্টিতে সে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “বলি লেখক মশাই, ক্রিষ্টোফার নোলানের নাম শুনিয়াছ কি?”
আমি আমতা আমতা করে বললাম, “হ্যাঁ...মানে শুনেছি বটে তবে এখন সঠিক মনে আসছে না।”
“আচ্ছা, তুমি তো বিলিতি চলচিত্র দেখিয়া থাক বলিয়া জানি।” কমলাকান্ত আমার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়।
(৪)
ঝটিতি মনে পড়ে গেল যে অস্কার প্রাপ্ত “ডানকার্ক” নামক বিখ্যাত ইংরেজি সিনেমার প্রখ্যাত পরিচালক হচ্ছেন ক্রিষ্টোফার নোলান। অতি সম্প্রতি তিনি তাঁর প্রযোযোক পত্নী ও চার পুত্র-কন্যাসহ মুম্বাই শহর ঘুরে গেছেন। অতি গর্বের সঙ্গে তৎক্ষণাত কমলাকান্তের কাছে আমি আমার সাধারন জ্ঞানের বহরের পরিচয় জাহির করি।
কমলাকান্ত আমার প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের পরিচয় পেয়ে বলে ওঠে, “অতি উত্তম।”
গর্বে আমার বুকের ছাতি ফুলে ওঠে। মুখে আমি একটা সবজান্তা ভাব জাগিয়ে কমলাকান্তের দিকে তাকিয়ে থাকি। চোখদুটো আবার বুজিয়ে ফেলে কমলাকান্ত আবার ধ্যানস্থ। সেই অবস্থায় আবার বলে, “সংবাদপত্রের এক সাক্ষাৎকারে নোলান সাহেব কি বলিয়াছেন তাহার খবর রাখ কি?”
এইবার বিপদে পড়লাম।
সাহেব সপরিবারে দিন কয়েকের জন্য মুম্বাই শহরে এসেছিলেন এই খবরটা খবরের কাগজে দেখেছি; তবে খবরের ভেতরে ঢোকা হয়নি। লজ্জার মাথা খেয়ে স্বীকার করে নিতেই হলো যে সাহেবের সাক্ষাৎকারটা আর পড়া হয়ে ওঠেনি।
আমার কথাটা ধর্তব্যের মধ্যে না এনে কমলাকান্ত বলে ওঠে, “সাহেব একটা বড় ভাল কথা বলিয়া গিয়াছেন। আমার খুব মনে ধরিয়াছে বলিতে পার।”
আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই কমলাকান্ত বলে ওঠে, “আমার ইংলন্ডের রাণীর আমলের ভঙ্গুর ইংরেজী অভ্যাস আর বর্তমান কম্পিউটার যুগের অর্ধ কলস পূর্ণ জ্ঞান দ্বারা যাহা বুঝিয়াছি, তোমার আপত্তি না থাকিলে তাহার দ্বারা তোমাকে একপ্রকার বুঝাইতে সচেষ্ট হইতে পারি।”
বুঝতে পারলাম কমলাকান্ত আজ একটা বিশেষ মিশন নিয়ে আমার সাথে এক ওজনদার আলোচনায় বসতে এসেছে। কাজেই না বলবার প্রশ্নই ওঠে না।
আমার আপত্তি নেই শুনে খুশী হয়ে কমলাকান্ত শুরু করে, “সংবাদপত্রের সাংবাদিক সাহেবকে প্রশ্ন করিয়াছিল যে আপুনি এই ডিজটাল যুগে বাস করিয়াও চলমান দূরভাষ এবং বৈদ্যুতিন ঠিকানা, (মানে তোমরা যাহাকে মোবাইল ফোন আর ই-মেল বলিয়া থাক আরকি!) ব্যতীত জীবনযাত্রা কি করিয়া বহন করিয়া চলিতেছেন? সাহেব মুচকি হাসিয়া উত্তর করিয়াছেন যে আমরা ডিজিটাল যুগে বাস করিয়াও অ্যানালগ পৃথিবীতেই জীবনযাপন করিয়া থাকি! অহো! কি অসাধারন উপলব্ধি!”
আমি বিশেষ কিছু না বুঝে বোকার মতো কমলাকান্তের দিকে তাকিয়ে আছি দেখে সে তার সেই পেটেন্ট রহস্যময় হাসিটা ঠোঁটের কোনে ঝুলিয়ে নিজেই আমাকে জিজ্ঞেস করে, “বুঝিতে অসুবিধা হইল বুঝি?”
আমি আমার অজ্ঞানতা না লুকিয়ে সহজ ভাবেই স্বীকার করে নিলাম যে ইয়ে বাত কুছ হজম নেই হুই।
একটা বড় লেকচার দেবার প্রস্তুতি নিয়ে কমলাকান্ত শুরু করে, “তাহা হইলে শুন। গুহামানবের পর হইতে মানব উন্নয়ন কালের সকল পর্যায়গুলিকে যে বেশ কয়েকটি যুগে বিভক্ত করা হইয়া থাকে তাহা তো তোমার অবগত আছে বলিয়াই আমার ধারনা।”
কমলাকান্ত আমার কাছ থেকে উত্তরের আশা করছে দেখে আমি সম্মতি সূচক মাথা নাড়ালাম।
আমার কাছ থেকে উত্তর পেয়ে কমলাকান্ত দ্বিগুণ উৎসাহে আবার শুরু করে, “প্রস্তর যুগ হইতে শুরু করিয়া তাম্র, লৌহ ইত্যাদি যুগ পার হইয়া মানুষ আগুন আর গোলাকৃতী চক্রের ব্যবহার শিখিয়া ক্রমে ক্রমে বাস্পের আবিস্কারের মাধ্যমে ১৭০০ খ্রীষ্টাব্দে শিল্প বিপ্লবের যুগে প্রবেশ করে। ইহার পর ১৮০০ খ্রীষ্টাব্দে বিদ্যুৎ এবং বিংশ শতাব্দী শেষ লপ্তে গণক যন্ত্র যুগ যাহাকে কম্পিউটার যুগ বলা হইয়া থাকে তাহার প্রাদুর্ভাবের ফলে যথাক্রমে দ্বিতীয় এবং তৃতীয় শিল্প বিপ্লবের সুরুওয়াত।”
(৫)
সেই কবে ইস্কুল-কলেজ ছেড়ে পড়াশোনার গণেশ উল্টে দিয়েছি। আবার মনে হছে যেন সেই ক্লাস রুমে ঢুকে পড়েছি। ব্যপারটা আমার মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে দেখে কমলাকান্ত একটু ব্রেক দেওয়া স্থির করল। আর আমিও আমার গেলাসের পাণীয়তে লম্বা একটা চুমুক দিয়ে খানিকটা ধাতস্ত হলাম।
কমলাকান্তও তার ডিবে থেকে ইতিমধ্যে আর একটি গুলি পূর্ব প্রক্রিয়া মোতাবেক গলাধঃকরন করে আবার তার লেকচার শুরু করে, “এই কম্পিউটার যন্ত্রের আগমনের প্রভাবেই যুগ পরিবর্তন বড়ই দ্রুত হইতে লাগিল এবং ইহার ফলে অতি সত্বর বর্তমান কালের চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের আবির্ভাব। ইহাকে পন্ডিতগন Industry 4.0 অর্থাৎ I4.0 বলিয়া অভিহিত করিয়াছেন। এই যুগে কৃত্রিম মেধার উন্নয়ণ বড়ই পরিলক্ষিত হইবে। ইহাকে তোমরা Artificial intelligence নামে পরিচিতি দিয়াছ।”
এইবার বেশ বুঝতে পারছি; কমলাকান্তের বক্তব্যের ঠাস মালটা মাথায় যেন ঢুকতে শুরু করেছে। আমার ক্ষেত্রে আমি লক্ষ্য করে দেখেছি যে কোনো ভারি বিষয়ের সাথে যদি পছন্দ মতো পাণীয়ের ব্যবস্থা থাকে তবে ভারি বিষয়টি আমার সহজেই বোধগম্য হয়ে ওঠে। আজকেও তার কোনো ব্যতিক্রম দেখলাম না।
তাই আমি আমার সমস্ত পরিচিত আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, পাঠক-পাঠিকা সবাইকেই এই টোটকাটির ইস্তেমাল করার জন্য উপদেশ দিচ্ছি। আশাকরি হাতে হাতে ফল পাওয়া যাবে।
আমি একটু অন্যামনস্ক হয়ে পরেছি দেখে কমলাকান্ত আবার তার বক্তব্যের খেই ধরে শুরু করে, “এই পরিপ্রেক্ষিতেই ক্রিষ্টোফার নোলান সাহেব হক কথার এক কথা বলিয়াছেন। ধীরে ধীরে মনুষ্য সমাজে যান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার প্রচলন হইতে চলিয়াছে। এই যান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রচলন কালে মনুষ্য সম্প্রদায়কে ইহা ভুলিলে চলিবে না যে পৃথিবীতে তাহারা বসবাস করিতেছে তাহা অতিমাত্রায় স্বাভাবিক এবং অ-কৃত্রিম। কাজেই কৃত্রিম যান্ত্রিকতার আতিশয্য যদি মনুষ্যজীবনের স্বাভাবিকতা এবং অ-কৃত্রিমতাকে প্রভাবিত করিতে শুরু করে তবে তাহা এই মনুষ্য সভ্যতার মুষল পর্বের প্রচলনের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপনা করিবে মাত্র। মনে রাখিতে হইবে এই মুষল পর্বেই কিন্তু শ্রীকৃষ্ণের যাদব সম্প্রদায়ের ধ্বংসের যে ইতিহাস রচিত হয় তাহা রক্ষা করিবার ক্ষমতা স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণেরও জানা ছিল না। কাজেই নোলান সাহেবের কথার ধরতাই ধরিয়া বলিতে গেলে বলিতে হয় যে এই ডিজিটাল যুগেও অ্যানালগ অর্থাৎ স্বাভাবিক জীবনযাত্রা খুবই জরুরী নতুবা মানব সভ্যতার শেষের সে দিন দুয়ারে আসিয়া কড়া নাড়িতে থাকিবে। একটা কথা ভুলিলে চলিবে না যে বহু উন্নত প্রাচীন সভ্যতা কিন্তু কালের প্রভাবে হারাইয়া গিয়াছে। হরপ্পা, মহেঞ্জোদর ইত্যাদি সভ্যতার সফলতা আজ ইতিহাস মাত্র। কাজেই ডিজিটাল আর অ্যানালগ ব্যবস্থা যদি তাল মিলাইয়া চলিতে না পারে তবে I4.0 শিল্পযুগও অতিশীঘ্রই অস্তগামী হইবে বলিয়াই আমার ধারনা।”
একসঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বলে কমলাকান্ত একটু হাঁপিয়ে ঊঠেছে মনে হল। এক নিঃশ্বাসে ঘটির বাকি জলটা শেষ করে ঘটিটা টেবিলে রেখে মুখটা একটু বিকৃত করে ঘটিটা একবার ভাল করে দেখে ঊঠে দাঁড়িয়ে বলে, “আমাদের শাস্ত্রে বলে ‘তমসমার্গমায় জ্যোতির্ময়’। বিজ্ঞান মনুষ্য সমাজকে অন্ধকার থেকে আলোকের সন্ধানে যেমন চালিত করে আবার তেমনি এই বিজ্ঞানের উপাসকেরাই যে শাসক সম্প্রদায়ের অঙ্গুলি হেলনে তাহাকে মানব সংহারে নিয়োজিত করে থাকেন তাহার উদাহরন ইতিহাসের পৃষ্ঠায় কম নাই। নোলান সাহেবের কথাটি আমায় ভীষণ ভাবে নাড়া দিয়াছে বলিয়া আজি তোমার সাথে আলোচনা করিয়া কিছুটা হালকা হইলাম।”
কথা কটি বলিয়া আমাকে কিংকর্ত্যব্যবিমূঢ় অবস্থায় রেখে কমলাকান্ত তাহার নিজের ডেরায় চলে গেল। একটু টলছে মনে হলো। আফিমের মৌতাত আজ বেশ জাঁকিয়েই বসেছে মনে হচ্ছে।
(৬)
কমলাকান্ত চলে গেলে আমার মাথায় ভাবনার আকাশ ভেঙে পড়ল। আমার মনে হল এই ডিজিটাল যুগে ব্যক্তিগত সমস্ত খবরাখবর ঊন্মোচিত হয়ে যাবার ফলে পৃথিবীব্যাপী আমার মতো সাধারন মানুষের জীবনযাত্রার সমস্ত সংবাদ আজ দিনের আলোর মতই স্বচ্ছ। রাবণের মৃত্যুবাণের মতই আজ তা আমাদের হাতছাড়া হবার জোগাড়। এবং তা কখন আমাদের বিরুদ্ধেই ব্যবহৃত হবে তা আমরা জানিনা।
ঠাণ্ডা ঘরে বসে কোন রিংমাষ্টার মহাপুরুষ কম্পিউটারের মাধ্যমে তাঁর Artificial intelligence-এর একজন রোবোটকে চালিত করে আমায় তাঁর দাসত্বে বেঁধে ফেলবেন অথবা তাঁর হাতের পুতুলে পরিণত করে ফেলবেন এটা ভাবতেই আমার শিরদাঁড়া দিয়ে একটা হিমশীতল ঢেউ বয়ে গেল।
ছেলেবেলাতে দাদামশায়ের কাছ থেকে একটা ব্রাহ্মণের গল্প শুনেছিলাম। সেই ব্রাহ্মণ এক ভূতকে মন্ত্রের সাহায্যে বশ করে তাকে দিয়ে তার সংসারের সব কাজ করাত। ব্রাহ্মণ আসলে ভুতটাকে তার ক্রীতদাস বানিয়ে রেখেছিল।
আমি দিব্যদৃষ্টিতে স্পষ্ট দেখতে পেলাম যে আঙ্কেল টম’স কেবিন-এর ক্রীতদাসদের মতো আমিও কোনো এক Digitally powerful এক প্রভুর কাছে দাসত্ব করে চলেছি।
ভাবতেই মাথা গরম হয়ে উঠলো। কমলাকান্ত যে কি এক ঢপের লেকচার দিয়ে গেল যার ফলে আমার বাকি রাতের ঘুমটাই চৌপাট হয়ে গেছে।
তার ওপর আবার সর্বনাশের মাথায় বাড়ি!
ঊচাটন মন আর শরীরকে একটু শান্তি দেবার জন্য বোতলের পাণীয় গেলাসে ঢালতে গিয়ে দেখি যে বোতল্টাই ফাঁকা!
কখন অন্যমনস্ক ভাবে আমি আমার বোতলের বাকি পানীয়টা কমলাকান্তের ঘটির জলে ঢেলে দিয়েছি তা আমারই খেয়াল নেই!