0

প্রবন্ধ - সব্যসাচী রায়

Posted in








আপনি কিছু বুঝতে পারছেন না। কারণ আপনি ভাবছেন, যদি কাউকে আটকানো হয়, তাহলে আদালত বসবে, বিচারক থাকবে, আইনজীবী থাকবে, কাগজপত্র থাকবে। কিন্তু এখানে নেই কিছুই। আছে শুধু একটা প্যাটার্ন। একটা অ্যালগরিদম। আর শর্তাবলী, যা আপনি কখনও পড়েননি—ক্লিক করেছেন “অ্যাকসেপ্ট” করে। এখন সেটাই যথেষ্ট। কোনও আদালতের আদেশ নেই। কোনও সাক্ষর লাগে না। শুধু নীরবে, ধীরে ধীরে আপনার অধিকারগুলো সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এমনভাবে, যেন আপনি ভুলেই যান যে কখনও সেই অধিকার ছিল।

২০০১ থেকে অ্যালগরিদমিক নাগরিকত্বের উত্থান। ২০০১ – “প্যাট্রিয়ট অ্যাক্ট”—নামটা শুনলেই বোঝা যায় কতটা দেশপ্রেমিক! এর আড়ালে শুরু হল নাগরিকদের উপর নজরদারি। ২০০৮ আর্থিক ধসের পর জন্ম নিল “ঝুঁকি-পূর্বাভাস” শিল্প। ২০১৩, স্নোডেন ফাঁস করল গোটা মেটাডেটা নজরদারির খেলা। আমরা কাঁধ ঝাঁকালাম। ২০১৬–২০২০, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ঢুকে পড়ল চাকরির ইন্টারভিউতে, টেলি-হেলথে, মেজাজ মাপার সফটওয়্যারে। ২০২০, হেলথ সার্ভেইল্যান্স হয়ে গেল “স্বাভাবিক।” ২০২১–২০২৩, সেফটি আর ওয়েলনেস নামে ভবিষ্যদ্বাণী করা এআই মেইনস্ট্রিম হয়ে গেল। ২০২৪–এখন, ট্রাস্ট স্কোর, ইমোশনাল প্রোফাইল, ঝুঁকি মডেল ঢুকে গেছে আপনার প্রতিদিনকার অ্যাপে। অপ্ট আউট করার সুযোগ নেই।

ওয়েলনেস অ্যাপস (মমতার আড়ালে নজরদারি?): ঘুম মাপা? মুড ট্র্যাক করা? কেমন নিরীহ, তাই না? কিন্তু আপনার ঘুম ভেঙে তিনটের সময় অনলাইন শপিং করলে সেই অ্যাপ বলে দেয় আপনি “আবেগিকভাবে অস্থির এবং আর্থিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ।” এবং সেই ডেটা চলে যায় বীমা কোম্পানির ঝুঁকি মডেলে। আপনি ভাবছেন, অ্যাপটা কেবল মজার কোটস দিচ্ছে? হ্যাঁ, সেই কোটসের পেছনে নীরবে বীমার প্রিমিয়াম পাল্টে যাচ্ছে।

এআই ঝুঁকি স্কোরিং, হাসি মাপা হয়, গলা মাপা হয়। আপনার এইচআর ইন্টারভিউ এখন আর শুধু কথার উপর নির্ভর করে না। আপনার মুখের ভঙ্গি, চোখের পলক, ইমেইলের টোন—সব বিশ্লেষণ করছে অ্যালগরিদম। আপনি স্ল্যাক-এ কম উত্তর দিচ্ছেন? কল মিস করছেন? আপনার নামের পাশে লেগে যাচ্ছে “ইমোশনালি কম রেজিলিয়েন্ট” ট্যাগ। অফিস শেষে গাড়িতে বসে কাঁদলে? সেটা-ও ঝুঁকি সংকেত।

মেন্টাল হেলথ প্রোফাইলিং। BNPL (বাই নাউ পে লেটার) অ্যাপ আপনার ফোন মডেল, ইমোজি ব্যবহার, রাতের শপিং—সব যোগ করে ঠিক করছে আপনি “বিশ্বাসযোগ্য” কিনা। একইসাথে, আপনার সার্চ হিস্টরি দেখে বলছে আপনি ডিপ্রেশন প্রবণ কিনা।

টেলিহেলথ আর চ্যাটবট থেরাপি। এআই থেরাপিস্ট নোট করেছে, “দীর্ঘস্থায়ী দুঃখ।” আপনি ফলো-আপ করেননি। ডেটা চলে গেছে “নন-কমপ্লায়েন্ট” ট্যাগে। পরের ডাক্তার বলে দিল, “দুঃখিত, আমরা এখন নতুন পেশেন্ট নিচ্ছি না।”

সেফটি ফিল্টার আর প্রেডিক্টিভ পুলিশিং। আপনি ইনস্টাগ্রামে ভুল মেম শেয়ার করেছেন। একটা রাজনৈতিক হ্যাশট্যাগ বেশি ফলো করেছেন। অ্যালগরিদম ভুল বুঝেছে। আপনাকে ব্লক করেনি। শুধু কম রিচ দিয়েছে, পোস্টে কেউ সাড়া দেয় না। আপনি হয়ত টেরই পাবেন না, শুধু ভাববেন “অ্যালগরিদম খারাপ চলছে।”

এখনকার টুলস। হায়ারভিউ – মুখের ভঙ্গি দেখে চাকরির ইন্টারভিউয়ের স্কোর দেয়। পিমেট্রিক্স – নিউরোসায়েন্স গেম দিয়ে আপনার “ইমোশনাল এজিলিটি” মাপে। প্যালান্টির – সরকার আর পুলিশের প্রেডিক্টিভ মডেল চালায়। সিফট – আপনার অনলাইন ব্রাউজিং, কেনাকাটা থেকে ট্রাস্ট স্কোর বানায়। অনফিডো – মুখ চিনে আচরণ প্রোফাইল তৈরি করে। বেটারহেল্প এবং টকস্পেস – “অ্যানোনিমাইজড” ডেটা বেচে মানসিক স্বাস্থ্যের ট্রেন্ড বানায়। বেনেভোলেন্টএআই – আপনার মানসিক স্বাস্থ্য ডেটা “অপ্টিমাইজ” করে। (মানে: ট্র্যাক করে, টার্গেট করে।)

ডিজিটাল জাতপাত। এখন এই জাতপাত কাগজে লেখা নয়। এটা আপনার ইমোশনাল টেম্পারেচার দিয়ে মাপা হয়। নতুন নাম: “ডিজিটাল ওয়েলনেস প্রোটোকল”, “ইউজার ট্রাস্ট অ্যালগরিদম”, “হার্ম রিডাকশন ফ্রেমওয়ার্ক”, “বিহেভিয়রাল অ্যাস্যুরেন্স স্কোর”। আসলে বলছে: “আমরা আপনার আত্মার স্কোরিং অটোমেট করেছি।” আপনি এখন থার্মোস্ট্যাটের মত, শুধু আপনার এঙ্গজাইটি বেশি।

এগুলো কাল্পনিক নয়। হিথ্রোতে এক মহিলাকে বোর্ডিংয়ে আটকানো হল, কারণ তার ট্র্যাভেল হিস্ট্রিতে “মেন্টাল হেলথ ফ্ল্যাগ।” এক ডেলিভারি পার্টনার উবার ইটস থেকে বাদ পড়ল, কারণ তার প্যাটার্ন “অস্বাভাবিক।”আপনাকে সরাসরি ব্যান করা হয়নি, শুধু আপনার পাশে লেখা হয়েছে: “লো ভ্যালু।” নতুন ব্ল্যাকলিস্ট। আপনি একা নন। আপনার বন্ধুর ডেটা, ভাইবোনের দেউলিয়াত্ব, রুমমেটের লেট পেমেন্ট—সব মিলিয়ে যাচ্ছে। কে আসলে করেছে তা জরুরি নয়, আপনি কার সঙ্গে মিশছেন সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। অ্যালগরিদমিক দোষ ভাগাভাগি। এটাই ডিজিটাল টেম্পারামেন্ট ট্রেনিং। আপনাকে ‘সফটনিং আপ’করা হচ্ছে। ছোট করা হচ্ছে। “কমপ্লায়েন্স” এর জন্য নতুন করে গড়া হচ্ছে।

গভীরতর সমস্যা। এই সিস্টেমটা আপনাকে কেবল আটকাচ্ছে না, বদলে দিচ্ছে, জানিয়ে দিচ্ছে আপনি কেমন মানুষ হবেন। আপনি রাত জাগতে ভয় পাচ্ছেন কারণ ফোন মাপছে। আপনি মুড লিখতে ভয় পাচ্ছেন কারণ সেই মুড কোথাও গিয়ে ডেটা হয়ে যাচ্ছে। আপনি আস্তে আস্তে এক অ্যালগরিদমিক শিষ্টাচার তৈরি করছেন—যেন মেশিনকে খুশি রাখতে হবে। আপনার হাসি, রাগ, প্রেম—সব কিছু ফিল্টার হয়ে যাচ্ছে যেন আপনি “ঝুঁকিপূর্ণ” না হন।

এটাই আসল বিপদ। আপনি নিজের নয়, কারও ডেটা মডেলের সংস্করণ হয়ে যাচ্ছেন। আপনি একটা ‘ঝুঁকি প্রোফাইল’। এক ‘ট্রাস্ট স্কোর’। এবং এর মধ্যে কোনও মানবিক বিতর্ক নেই। কোনও ভোট নেই। কোনও প্রতিবাদ নেই—কারণ আপনি জানেন না ঠিক কিসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে হবে। একদিন দেখবেন, আপনি শুধু নিজের অধিকার হারাননি, নিজের স্বভাবটাই হারিয়ে ফেলেছেন।

এখানে আসল প্রশ্ন শুধু প্রযুক্তি নয়, নৈতিকতা। যে অ্যালগরিদম আমাদের ঝুঁকি মাপে, সেটা কে বানায়? তার মানদণ্ড কী? আপনি কি জানেন, এই মডেলগুলোর অনেকটাই ট্রেন হয় পুরনো পক্ষপাতের বর্ণ, লিঙ্গ, আর্থিক অবস্থা? ফলাফল: পুরনো বৈষম্য নতুন নামে ফিরছে। ডিজিটাল জাতপাত।

একটা সময় ছিল, মানবাধিকার মানে ছিল: “আপনি মানুষ বলেই কিছু অধিকার আপনার।” এখন অধিকার মাপা হচ্ছে আপনি কতটা “লো রিস্ক।” যদি আপনার বন্ধুর দেউলিয়াত্ব, মুড সুইং, বা পুরনো কোনও রাজনৈতিক পোস্ট আপনার নামের পাশে ঝুঁকি যোগ করে, আপনি অজান্তে এক অদৃশ্য নিম্নস্তরের নাগরিক হয়ে যাচ্ছেন। এটা শুধু ব্যক্তি নয়, সমাজকেও পাল্টে দিচ্ছে। মানুষ খোলামেলা কথা বলার বদলে অ্যালগরিদম-বান্ধব আচরণ শিখছে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কাগজে আছে, কিন্তু বাস্তবে কমে যাচ্ছে—কারণ অ্যালগরিদমিক ভয়। এর ফলে তৈরি হচ্ছে এমন একটা সংস্কৃতি যেখানে সবাই একটু বেশি নীরব, একটু বেশি সাবধানী, একটু বেশি নিরপেক্ষ দেখাতে চায়।

প্রশ্ন হলো: আমরা কি এমন সমাজ চাই যেখানে মেশিন আমাদের চরিত্র নির্ধারণ করবে? যেখানে নৈতিকতা আর মানবিক ভুলের জায়গা নেই, শুধু ডেটা প্যাটার্নের জেল? এই প্রশ্ন এখনই করতে হবে—কারণ একবার প্যাটার্ন লিখে গেলে, তা মুছতে পারবে না কেউ।

শেষে, আপনার আচরণ এখন “কনটেন্ট।” আপনার মুড এখন “মেট্রিক।” আপনার সুনাম এখন একটা অদৃশ্য শেয়ারবাজারে কেনাবেচা হচ্ছে। কোনও অনুমতির দরকার নেই, শুধু প্যাটার্ন চাই। আপনি আইনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছেন না। আপনাকে শর্তাবলীর মাধ্যমে বন্দি করা হচ্ছে। আপনার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়নি, আপনাকে শুধু “ঝুঁকি মিটিগেশনের জন্য রিক্যালিব্রেট” করা হয়েছে। কোনও বিচার নেই। কোনও আপিল নেই। কোনও নোটিফিকেশন নেই।

শুধু একদিন দেখবেন: আপনি একটু কম দেখতে পাচ্ছেন, একটু কম বুঝতে পারছেন। আর এক কোণে পড়ে আছে সেই মানসিক ওয়েলনেস সার্ভে, যা আপনি কখনও শেষ করেননি।এই সবই, এখনো পর্যন্ত পাশ্চাত্য, বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অগ্রগতি। কিন্তু আমরাও একই পথে যাচ্ছি।

0 comments: