0

সম্পাদকীয়

Posted in


সম্পাদকীয়


ইদানিং গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা বিশ্বায়িত উষ্ণায়নের কল্যানে শীতকালের সঙ্গে শীতের আর খুব একটা সম্পর্ক নেই, বরং শীতকাল মানে আপাতত শুধুই সাড়ে পাঁচটায় সকুয়াশা সন্ধ্যে, শীতকাল মানে মাফলার-সোয়েটারের নিচে ঘামনদীর কুলকুল, শীতকাল মানে হোয়াটস্‌আপে মেরি ক্রিসমাস আর হ্যাপি নিউইয়ার – কেক আর মদ, শীতকাল মানে পিঠে-পাটিসাপটা, শীতকাল মানে রুটি আর নলেন গুড়, শীতকাল মানে বইমেলায় সেলফি, শীতকাল মানে হাঁউমাঁউ উৎসব, শীতকাল মানে সরস্বতীপুজো আর টোপাকুল, ধুতিপাঞ্জাবি আর বাসন্তিরঙের শাড়ি, শীতকাল মানে ভ্যালেন্টাইন উৎসব – হিহি হাহা ধ্যাৎ কী অসভ্য - এতো সব পেরিয়ে ভাষাদিবসে এসে কোমরে হাত, জিভ বের করে হ্যাহ্‌ হ্যাহ্‌ - টার্মিনাস। হ্যাপি ভাষা দিবস! 

আর ভাষাদিবস মানে?

‘লিসন্‌ বেবি, ডোন্ট ফর্গেট আজ ভাষা ডে, উই মাস্ট টক্‌ ইন বেঙ্গলি টুডে’ 

এই ভণ্ডামিসর্বস্ব আপাতজীবনেই আমরা এখন আত্মমগ্ন সুখী – চারপাশের ঘটনাবহুল সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতাকে সন্তর্পনে ল্যাপটপ বা স্মার্টফোনের জানলার বাইরেই রাখি, ভারি পর্দা টপকে ঘরে ঢুকতে দিইনা – বধূহত্যা ধর্ষণ খুন আত্মহত্যা – দৈনিক এ সব খবরে আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি – গরুর মাংস ফ্রিজে রাখার জন্য পিটিয়ে হত্যা – আমরা হাই তুলে পাশ ফিরে শুয়েছি – গৌরী লঙ্কেশ হত্যা – তো? আমার কি? আমি তো মুখপুস্তকে চোখের জল ফেলেছি – সম্প্রতি সিরিয়ায় নির্মম গণহত্যা – আমরা শ্রীদেবী নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম, স্যরি, কী স্যাড্‌!

মাঝখানে কিছু মোমবাতি মিছিল দেখতাম রাজপথে মাঝে মাঝে, বিভিন্ন সামাজিক ইস্যুতে অহিংস ও নরম প্রতিবাদ হিসেবে – এখন আবার সবাইকে জড়ো করো রে, দাদাদিদিদের অনুমতি নাও রে, মোমবাতি কেনো রে, রাস্তায় হাঁটো রে – ধ্যুস্‌, অতো পোষায় না গুরু। 

‘আকাশে তবু রয়েছে রঙ ছড়ানো,
এখনও তার খানিক দিয়ে
হৃদয় যায় ভরানো।
এখনও ক্ষয়ক্ষতির খাতা
ওঠেনি ভরে, ভরিও না তা,
হাওয়ার হাতে এখনও পাতা
ঝরানো
হয়নি শুরু, হৃদয়ে রঙ
এখনও যায় ছড়ানো।
(নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী – ‘রঙছুট’) 

হাতে হাতে রঙ নিয়ে ঋতবাক নেমেছে রাস্তায় – আজ বসন্ত।

শুভেচ্ছা নিরন্তর...

0 comments:

0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - অলকরঞ্জন বসুচোধুরী

Posted in

প্রচ্ছদ নিবন্ধ


ভাষা-সাহিত্য-স্বাধীনতাঃ প্রেক্ষিত বাংলা ও বাঙ্গালি 
অলকরঞ্জন বসুচোধুরী 



প্রথম পর্ব

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস এই গালভরা নামে যে দিনটি বর্তমানে চিহ্নিত অর্থাৎ কিনা একুশে ফেব্রুয়ারি, সেটি যে আদতে ছিল অতীতের পূর্ববঙ্গের (ওপার স্বাধীন বাংলাদেশ) ভাষা-শহীদ দিবস, তা অন্যেরা জানুক বা না জানুক, ভারতের বাঙালিরা ভালোভাবেই জানে। তারা এই ইতিহাস সম্পর্কেও ওয়াকিবহাল যে বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন সঞ্জাত ঐ আবেগ ও চেতনাই কালক্রমে জন্ম দিয়েছিল সে দেশের মুক্তিযুদ্ধ স্বাধীনতা সংগ্রামের নিজের মাতৃভাষার সম্মান ও অধিকারের দাবিতে রক্ত ও জীবনদানের উজ্জ্বল ঐতিহ্য অসমের বঙ্গভাষীদের থাকলেও ভাষার সঙ্গে স্বাধীনতা সংগ্রাম যুক্ত হয়ে যাওয়াতে একুশে ফেব্রুয়ারি র‍্যাডক্লিফ রেখার দুপারের বাঙালিকেই একটি আলাদা আবেগে যেন উদ্বেল করে তলে। ঐতিহ্য-উদ্বেল সেই দিনটিকে সামনে রেখে আজ ভেবে দেখা যায় যে, পূর্ববঙ্গের ঐতিহাসিক অনুষঙ্গটি ছাড়াও বাঙলা ও বাঙালির ভাষা ও সাহিত্যের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে মিশে আছে স্বাধীনতা চেতনার এক আবহমান উত্তরাধিকার। 

স্বাধীনতা শব্দটা বহু প্রচলিত, শিক্ষিত ব্যক্তিমাত্রই নিজের মতো করে স্বাধীনতা সম্পর্কে একটা ধারণা তৈরি করে নেন। আমরা যদি বিশেষভাবে বলি সাহিত্যের স্বাধীনতা বা শিল্পীর স্বাধীনতা, তাহলে আমরা কি বুঝব? অল্প কথায় এর উত্তর দিতে গেলে বলতে হয় সভ্য মানুষের সার্বিক স্বাধীনতা স্পৃহারই একটি বিশেষ পরিপ্রকাশ এই শিল্পীর স্বাধীনতা। এই শিল্পী মূলত একজন স্রষ্ট্রা এবং শিল্পীর স্বাধীনতা বলতে সৃজন শীল মানুষের অভিব্যক্তির স্বাধীনতাকেই বোঝায় সাহিত্যের স্বাধীনতা তারই অন্তর্গত। আমাদের দেশে প্রাচীনকাল থেকেই সৃজনশীলতার চর্চায় কবি বা সাহিত্যশিল্পীকে নিরুঙ্কুশ কর্তৃতের অধিকারী বলে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। -'নিরুঙ্কুশঃ কবয়ঃ'। সৃষ্টির বিশাল সাম্রাজ্যে কবিকে সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার মর্যাদা দিয়ে বলা হয়েছে-"অপারে কাব্য সংসারে কবিরে কো প্রজাপতি!" 

যুগাগত এই সব প্রবাদ প্রবচনগুলির পরেও প্রশ্ন থেকে যায়, সতিই কোন কবি, সাহিত্যিক বা শিল্পীর স্বাধীনতা বাস্তবে নিরুঙ্কুশ হতে পারে! আমরা জানি যে, শিল্পী-সাহিত্যিক কেন, কোনো মানুষের স্বাধীনতাই সভ্যসমাজে প্রশ্নহীন বা শর্তহীন হতে পারে না। যদি তা হতো, তা হলে স্বাধীনতা হয়ে উঠতো স্বেচ্ছারের নামান্তর। স্বাধীনতা যেমন মানুষের একটি স্বাভাবিক প্রবৃত্তি বা মনুষ্যতের অন্যতম উপাদান, তেমনই সমাজ ও মানুষের স্বাধীন মনেরই সৃষ্টি। ব্যক্তি-মানুষের স্বাধীনতা যাতে ক্ষমতা প্রতিপত্তিশালীর পেষণে ক্ষুণ্ণ বা খর্ব না হয়, সেজন্য সমাজ তৈরি করেছে কিছু অনুশাসন, যা সভ্য মানুষ সাধারণভাবে মান্য করবে, এটাই প্রত্যাশিত, কারণ সর্বসাধারণের কল্যাণেই এই নিয়মকানুন বা অনুশাসনের প্রর্বতন করা হয়ে থাকে। এই কথাগুলো আমরা সবাই জানি ও বাল্যকাল থেকেই সমাজবিদ্যার এই পাঠ আমাদের শেখানো হয়। কিন্তু এর পরেও কিছু প্পশ্ন ওঠে। সমাজের এই অনুশাসনগুলো কি দেশকাল নির্বিশেষে অভিন্ন বা অপরিবর্তনীয়? বিভিন্ন সামাজিক বা ধর্মীয় বিধিবিধান মানুষ স্বেচ্ছায় মেনে নেয় ও দৈনন্দিন জীবনে পালনও করে থাকে, এতে সন্দেহ নেই। কিন্তু একটু খেয়াল করলে আমরা দেখতে পাব যে এই সব অনুশাসন সব দেশে বা সব সমাজেই একরকম নয় ও সময়ের সঙ্গে সমাজে নানা পরিবর্তনের ফলে এই সব বিধিবিধানের পরিবর্তন বা সংস্কার প্রয়োজন অনির্বার্য হয়ে ওঠে। জ্ঞান ও বিজ্ঞানের অগ্রগতি ও মানুষের নব নব অভিজ্ঞতার নিরিখে সমাজের বিধিব্যবস্থার প্রয়োজনীয় বদল না হলে সমাজ হয়ে ওঠে স্বাধীনতা প্রিয় মানুষের কাছে অন্ধ্রকূপ, তার বিধিবিধান হয়ে ওঠে মানব প্রগতির বন্ধনশৃঙ্খল। 

কাজে কাজেই মানুষের সংস্কৃতির ইতিহাস চেখে রাখলে আমরা বুঝতে পারি যে, সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে আজকের অনুশাসন আগামীকাল পরিণত হয় কুসংকার, তা তখন অগ্রসরমান মানুষের সৃজনশীল অভিব্যক্তির খর্ব করে, তখন তা হয়ে ওঠে স্বাধীনতার বাধক। আপাতদৃষ্টিতে এ-কথা কিছুটা স্ব-বিরোধী মনে হতে পারে। যে ব্যক্তি-স্বাধীনতার রক্ষার জন্য একদিন অনুশাসনের জন্ম হয়েছিল, তা কালক্রমে কিভাবে স্বাধীনতা হন্তারক হতে পারে! এই ধাঁধার সোজা উত্তর এই যে, সমাজের কোন স্থির আদর্শ থাকতে পারে না, কারন মানব প্রগতির কোনো বিরাম নেই। সমাজের লক্ষ্য বা আদর্শ সবসময় আপেক্ষিক, তার ভাঙাগড়ার, পুনর্নিমাণের অধিকারটাও তাই মানুষের স্বাধীনতারই শর্ত। আরও পরিস্কার করে বলতে গেলে মানুষের মনীষার সজীবতার ও সচলতার শর্ত। এই গতিশীলতা পরিবর্তনের অঙ্গীকার যে সব দেশে সব সমাজের সময় একইরকমভাবে স্বীকার করা হয়, তা অবশ্যই নয়। তাই বুদ্ধদেব বসু মনে করেছেন যে সব সমাজ ভালো নয়, "সেই সমাজই ভালো, যার বিধানের মধ্যেই পরিবর্তনের অঙ্গীকার থাকে।" (স্বাধীনতার মুল্য) 

এখন দেখতে হবে কে বা কারা সমাজের অনুশাসনে এই পরিবর্তন বা সংস্কারের ভার নেবে? সাধারণ মানুষ তো আর দিনানু দৈনিক জীবনে পুরোনো নিয়মের বাধাপথে চলবেই স্বেচ্ছায় বা ক্ষমতাশালী সমাজপতিদের প্রভাব পড়ে- যাকে বলা হয় গড্ডালিকাবৃত্তি। কিন্তু সব দেশে সব কালে সব সমাজে তা সে ধর্ম হোক, রাজনীতি বা সাহিত্যের ক্ষেত্রে হোক কিছু ক্ষণজন্মা মানুষের আবির্ভাব হয়, যারা শুধু পরিবর্তনের প্রয়োজন বুঝতেই পারেন না, অতীত অনুশাসনের নিগড় ভাঙার ডাক দেন এবং তা ভেঙে দিয়ে নূতন বিধান প্রবর্তনের চেষ্টা করেন। কখনও তাঁরা এই প্রয়াসে ব্যর্থ হন, কখনও সফল, কিন্তু মনে রাখতে হবে এঁরাই প্রকৃত অর্থে স্বাধীনতার সৈনিক এবং গতানুগতিকতার বিরুদ্ধে তাঁদের অসন্তোষ, প্রশ্ন আর বিদ্রোহই হচ্ছে মানব স্বাধীনতার অভ্রান্ত চরিত্র লক্ষণ। এ-প্রসঙ্গে বুদ্ধদেব বসুর লেখা থেকে একটু উদ্ধৃত করিঃ "... মাঝে মাঝে বিশেষ কোন মানুষ দেখা দেন যাঁদের মধ্যে স্বাধীনতার সতেজ প্রকাশ ঘটে থাকে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় এঁরাই হলেন ব্যক্তি - অর্থাৎ এঁরা সম্পূর্ণরূপে ব্যক্ত হতে পারেন, সমাজের পক্ষে সম্মত হবার জন্য নিজেকে সংকুচিত করেন না। ...এঁদের মনে লুকানো সত্য উঁকি দেয়, নতুন চিন্তার আন্দোলন ওঠে। এঁরা সৃষ্টিশীল বলেই সকলের সঙ্গে একমত হন না, আবিষ্কারে সচেষ্ট বলেই শাস্ত্রে ও লোকাচারে বিশ্বাস হারান। জীবৎকালে এঁরা অনেকেই ছিলেন নিগ্রহভোগী, ধর্মদ্রোহী ও সমাজদ্রোহী বলে নিন্দিত; কিন্তু বিপদের মুখেও এঁরা বিরত হননি সত্যানুসরণ থেকে, নির্জিত হয়েও বিরত হননি, ব্যর্থ হয়েও বিরত হননি, ব্যর্থ হয়েও মেনে নিতে পারেননি অসংখ্যের ধ্যানধারণা..." (ঐ, পৃঃ৩০৬) 

এখানে প্রশ্ন হতে পারে এই যে সব বিদ্রোহী সংগ্রামীদের আমরা স্বাধীনতার সৈনিক বলে পরিচায়িত করেছি,সমাজে তাঁদের নিগ্রহের জন্য দায়ী কে বা কারা? স্বল্প কথায় দায়ী এই অচলায়তন সমাজের নানা গোষ্ঠী ও প্রতিষ্ঠান, যেগুলি একদা মানুষের অধিকারের রক্ষা বা অনুশীলনের জন্য প্রতিষ্ঠিত হলেও কালক্রমে হয়ে ওঠে নবযুগের স্বাধীনতার দাবির বিরুদ্ধে রক্ষণশীলতার দুর্গ। এগুলি হতে পারে ধর্মীয় রাজনৈতিক বা সাহিত্যিক সংগঠন এমন কি হতে পারে সরকার স্বয়ং। আমরা সাহিত্যের ক্ষেত্রেও দেখেছি, আজ যে প্রতিষ্ঠান বিরোধী, কাল সেই প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠে, নিজস্ব নিয়ম নীতির প্রবর্তন করে অনায়াসে ছড়ি ঘোরাতে চায় অন্যের সৃজনশীলতা ও অভিব্যক্তির নিয়ন্ত্রণ করার জন্য, আধিপত্য কায়েম করে খর্ব করতে চায় সৃষ্টির স্বাধীনতাকে। এ-ব্যাপারটিতে একটু বিশদে যাবার আগে আমরা একটু দেকে নেবো আমাদের বাঙলা সাহিত্যের দুনিয়ায় এই স্বাধীনতার ধ্যান ধারণাটির ভূমিকা কেমন ও কতটুকু। 



বাঙলা সাহিত্য, বাঙালি ও স্বাধীনতার আর্দশ 



আমরা জানি সুপ্রাচীনকাল থেকেই বঙ্গভূমি ও এখানকার অধিবাসীরা নির্বিচারে ব্রাহ্মণ্য বাদী সংস্কৃতির আধিপত্য মেনে নেয়নি। যাগযজ্ঞ ইত্যাদি ধর্মীয় আচার ও বিধিবিধানের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলেছে যুক্তি সাজিয়েছে বঙ্গ-মগধ ও সন্নিহিত অঞ্চলের মানুষ, এমন কি ঈশ্বরের অস্তিত্বে আস্থাহীন সাংখ্য দর্শনের উদ্ভবও এই অঞ্চলে। এ কারণেই উত্তর ভারতের বাদ বাকি মানুষের কাছে বঙ্গদেশ নিন্দিত, তার কপালে জুটেছে পাণ্ডব বর্জিত দেশ ইত্যাদি নানা ঘৃণাসূচক অভিধা! বাঙলাদেশ তথা বাঙালীদের এই যুক্তিবাদ, মুক্তবুদ্ধি আর শাস্ত্রবিরোধীতার ঐতিহ্য আদিকাল থেকেই প্রতিফলিত হয়েছে বাংলা সাহিত্যের ধারাতেও। চর্যাপদের মধ্যে আমরা লক্ষ্য করি ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতি ও সমাজবিধির বিরুদ্ধে সহজিয়া বৌদ্ধতান্ত্রিক সাধকদের বিদ্রোহ। তারপর মঙ্গলকাব্যের যুগে দেখি এক আর্যেতর লৌকিক জীবনের স্পন্দন- শিব যেন সেখানে ব্রাহ্মণ্য শক্তিরই প্রতিভূ, আর শক্তি বহুজনের প্রাণর্ধমী বিদ্রোহের প্রতীক। মঙ্গলকাব্যগুলোতে এই ভাবেই চিত্রিত হয়েছে ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতিতে লৌকিক আর্দশের অধিকার প্রতিষ্ঠার কাহিনী। আর চৈতন্যের জীবন ও ভাবান্দোলনভিত্তিক গ্রন্থগুলোর কথা তো বলা-বাহুল্য, কারণ ব্রাহ্মণ্য কৌলীন্যের বিরুদ্ধে সর্বজনের অধিকার প্রতিষ্ঠায় চৈতন্যের বৈষ্ণব ভাবধারা কিভাবে হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল, তা আমরা সবাই জানি। 

আধুনিক যুগেও বাংলা সাহিত্যে আমরা কিন্তু সেই চিন্তা ও সৃজনের মুক্তি ও শাস্ত্রবিরোধী বিদ্রোহের বাণীই দেখতে পাই। যে বঙ্কিমচন্দ্র অনেকের চোখে সনাতনপন্থী ও রক্ষণশীল বলে প্রতিভাত হয়েছেন, তিনিও কিন্তু মূলত যুক্তিবাদী মননে অভ্যস্ত ছিলেন। তাঁর শ্রীমদ্ভাগবদগীতায় তিনি খণ্ডন করেছেন প্রচলিত শাস্ত্রীয় ব্যখ্যাকে, এমন কি মনুসংহিতার বিধানের বিরুদ্ধেও সোচ্চার হয়েছেন। তিনি এমন মন্তব্যও করেছেন, "মনুতে যাহা কিছু আছে, তাহাই ধর্ম নহে।" তাঁর 'ধর্তত্ত্ব' গ্রন্থে দান করলে অক্ষয় স্বর্গলাভ হবে, হিন্দু শাস্ত্রের এই বিধানের সমালোচনা করে তিনি বলেছেন, "স্বর্গ লাভার্য ধনদান করার অর্থ মূল্য দিয়া স্বর্গে একটু জমি খরিদ করা, ...ইহা ধর্ম নহে, বিনিময় বা বাণিজ্য। এরূপ দানকে ধর্ম বলা ধর্মের অবমাননা।" এই যুক্তিবাদ, শাস্ত্রবিরোধীতার মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার অনুশীলন ও বিদ্রোহ বাংলা সাহিত্যের একটি যুগচরিত বৈশিষ্ট্য। 

বঙ্কিম ছাড়াও যারা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জন্য নানাসময়ে কলম ধরেছেন, রামমোহন-বিদ্যাসাগর থেকে শুরু করে কালীপ্রসন্ন বা প্যারীচাঁদ তাঁদের অনেকেই ছিলেন ব্যক্তি জীবনে সমাজ সংস্কারের পথচারী, যুক্তি প্রেমী ও বিদ্রোহী। সমাজের নানা ক্ষমতাশালী প্রতিষ্ঠানের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে তাঁরা নানা যুগে বিদ্রোহের ধ্বজা তুলে ধরেছেন; এর ফনে কখনও শরৎচন্দ্র বা বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায়ের গ্রন্থ রাজরোষে নিষিদ্ধ হয়েছে, সাহিত্য রচনার জন্যই কারাদন্ড ভোগ করতে হয়েছে কাজি নজরুলকে, সাম্রাজ্যবাদী শাসকের বর্বরতার প্রতিবার করে রবীন্দ্রনাথ বর্জন করেছেন তাঁর সাহিত্য কৃতির অভিজ্ঞানসূচক সম্মানচিহ্ন। বাংলা সাহিত্যে সেই সৃষ্টির স্বাধীনতার অনুশীলনের যুগাগত পরম্পরাকে বহন করে চলেছেন আধুনিক কালের তসলিমা নসরিনের মতো সাহিত্যিকেরা, যারা তাঁদের স্বাধীন শাস্ত্রবিরোধী চিন্তার জন্য সেই ক্ষমতাশালী প্রতিষ্ঠানের রোষানলে পড়েছেন ও স্বদেশ সমাজ ছেড়ে স্বেচ্ছা নির্বাসন বরণ করেছেন। এ ক্ষেত্রে হয় তো সেই প্রতিষ্ঠান মূলত রাজনৈতিক নয় ধর্মীয়, তবু আমরা জানি ভারতীয় উপমহাদেশে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ দল বা সরকারের ওপর ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলির প্রভাব নিতান্ত কম নয়। 

[পরবর্তী পর্বে সমাপ্ত]

0 comments:

1

প্রবন্ধ - সুজন ভট্টাচার্য

Posted in


প্রবন্ধ


তৃতীয় ভাষা আন্দোলনের পটভূমি
সুজন ভট্টাচার্য


ঘটনাস্থল কলকাতার গায়ের উপরেই এক বিশাল ঢাকঢোল পেটানো বইমেলা। মাঠে ঢোকার মুখ থেকেই লাইন দিয়ে পরপর বিভিন্ন প্রকাশনীর স্টল। মাঠে প্রচুর ব্লিচিং পাওডার ছেটানো হয়েছে বলে মারার মতো একটা মশাও হাতের কাছে নেই। কাজেই স্টলের ভিতরের মানুষগুলো হাত গুটিয়ে ব্যাজার মুখে বসে আছেন। বই আছে, বিক্রেতা আছে; খদ্দের নেই, বইয়ের গায়ে হাত বুলিয়ে দেখার মতো কোনও দরদি মানুষ নেই। ভুল বললাম। আছে, আছে। তবে তারা সকলেই ভিড় জমিয়েছেন ২১ নম্বর স্টলের সামনে। কী বলছেন? সেখানে কোনও নামজাদা সাহিত্যিক এসেছেন? আজ্ঞে না। সেখানে শুধু ইংরেজি বই আছে, ইংরেজি। আগে পরের অন্য সমস্ত স্টলে যে বাংলা বই। কাজেই খদ্দের আসছেন না। হাইলি এডুকেটেড বাঙালীর আজকাল বাংলা বইয়ে অ্যালার্জি হয়ে গেছে তো।

২১ ফেব্রুয়ারি আর ১৯ মে নিয়ে বিস্তর বাতেলা করতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি। ঠিক যেমন অভ্যস্ত হয়ে গেছি বাংলা সাহিত্য নিয়ে বাকতাল্লা করতে। পড়ি আর নাই পড়ি, রবীন্দ্রনাথ – জীবনানন্দ – শক্তি – সুনীল – বিনয় নামগুলো তুলসীপাতার মতো নানাবিধ অপকর্মের উপর ছিটিয়ে দিতে আমাদের ভুল হয় না। অতএব বাঙালীর সংস্কৃতি জিন্দাবাদ, বাংলা সাহিত্য জিন্দাবাদ। মিছিলে বাঙালীর টান বহুকালের। সে দুর্গাপুজোর ভাসানই হোক কিংবা চিত্রতারকার শোকযাত্রা। মিছিলে নানান শ্লোগান থাকেই। তাই বাঙালীরও নানান শ্লোগান আছে। তার মধ্যে বাঙালীর বড় ভালবাসার শ্লোগান হলো “আ মরি বাংলা ভাষা”। শ্লোগান মিছিলেই মানায়, ঘরের মধ্যে নয়। তাই মিছিল শেষ হলেই বাঙালীও শ্লোগানগুলো গুছিয়ে তুলে রাখে ঘরের তাকে, পঞ্জিকা অনুযায়ী লগ্ন এলে আবার পরিষ্কার করে নামাবে বলে। 

বিষয়টা পরিহাসের নয়। কিন্তু কোনও কোনও সময় আসে যখন তীব্র জ্বালা প্রকাশের ন্যায্য রাস্তা না পেয়ে নিজেকেই বিদ্রূপ করে মশকরার ঢঙে। এই জ্বালার দায় থেকেই কালীপ্রসন্ন সিংহ লিখে ফেলেছিলেন হুতোম প্যাঁচার নকশা। সেখানে কশাঘাত আছে অবশ্যই। কিন্তু একটু তলিয়ে পড়লেই বোঝা যায়, চাবুকের প্রতিটা আঘাত লেখককেই রক্তাক্ত করছে সবার আগে। নিজের রক্তস্নানে তিনি ঘুম ভাঙাতে চাইছেন আশপাশের মানুষের। কিসের রক্তস্নান? এই তো মাসকয়েক আগের কথা। রাজ্য সরকার ঘোষণা করলেন, মাধ্যম-নিরপেক্ষভাবে পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত স্কুলে বাংলা ভাষা শিক্ষা বাধ্যতামূলক হবে। আজ্ঞে না, প্রতিবাদ অবাঙালী সম্প্রদায়ের কাছ থেকে এল না। এল তাদের কাছ থেকেই যারা নিজেদের আগমার্কা বাঙালী এবং বিশ্বব্রহ্মাণ্ডবাদী বলে দাবি করেন। গেল গেল রব উঠে গেল রাস্তাঘাটে এবং সোশ্যাল মিডিয়ায়। না, সরকারের ঘোষণাটা আদৌ কথার কথা ছিল কিনা বোঝা গেল না এদের হুল্লোড়ের চোটে। যথা সময়ে দেখা গেল সরকারি প্রস্তাবের গঙ্গাযাত্রা হয়ে গেছে।

অথচ তামিলনাড়ু এবং কর্ণাটকে স্কুলস্তরে যথাক্রমে তামিল ও কন্নড় ভাষাশিক্ষা বাধ্যতামূলক। এমনকি কেন্দ্রিয় বিদ্যালয়েও। সেই নিয়ে কোন তামিল বা কন্নড় তীব্র প্রতিবাদ করেছেন কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ায় চিমটি কেটেছেন, এমনটা খুব শোনা যায়নি। বাঙালী বুদ্ধিজীবী অক্লেশে করেছে। কারণ বাঙালী বুদ্ধিজীবী মনে করেন ভাষা নিয়ে আন্তর্জাতিক হবার এক্তিয়ার একমাত্র তার নিজেরই আছে। কারণ ২১শে ফেব্রুয়ারির ঢাকা আর ১৯শে মে শিলচরের ভাষাশহীদরা তারই ভাষাতুতো দাদাদিদি। হায়রে! এরা জানেনও না, তার বহু আগেই মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সীতে তামিল ভাষার স্বাধিকারের দাবীতে দলেদলে সাধারণ তামিল জনতা পুলিশি অত্যাচারকে পরোয়ানা করেই আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন। 

অপ্রাসঙ্গিক মনে হলেও একটু সেই অজানা ইতিহাসটা একটু ছুঁয়ে দেখা যাক। ভারতবর্ষ তখনো পরাধীন। ১৯৩৭ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে জিতে কংগ্রেস সরকার গঠন করল মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সীতে। না, তখনও তামিলনাড়ু বলে কোন রাজ্য ছিল না। ১৪ই জুলাই চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারী প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ নিলেন। আর এক মাসের মধ্যেই ১১ই আগস্ট সমস্ত স্কুলে বাধ্যতামূলক হিন্দি শিক্ষার নীতি ঘোষণা করা হলো। সঙ্গে সঙ্গেই গোটা মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সী জুড়ে শুরু হয়ে গেল গণবিক্ষোভ। আন্দোলনের সর্বজনগ্রাহ্য নেতা হয়ে উঠলেন ই ভি রামস্বামী পেরিয়ার। সত্যাগ্রহ, অনশণ, ধর্না ইত্যাদির মাধ্যমে গণবিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়তে থাকে। আন্দোলন দমন করার জন্য সরকারও পিছিয়ে রইল না। ১১৯৮ জন আন্দোলনকারী গ্রেপ্তার হলেন। এদের মধ্যে ৭৩ জন মহিলা ও ৩২ জন শিশুরও কারাদণ্ড হলো। জেলখানায় থালামুথু ও নটরাজন নামে দুই আন্দোলনকারীর মৃত্যুও হয়। শেষ পর্যন্ত ১৯৪০ সালে গভর্নর সরকারি নির্দেশ প্রত্যাহার করেন। 

যদি ভাষা আন্দোলনের কথা বলতে হয় তাহলে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সীর এই আন্দোলনের কথাই সবার আগে আসা উচিত। এবং ভারতীয় সংবিধানে যে ত্রি-ভাষা সূত্র রাখা হয়, তার পিছনেও তামিল চাপটাই ছিল সবথেকে বেশি। মাথায় রাখতে হবে স্বাধীনতার আগেই গণ পরিষদ ও ভবিষ্যৎ সংবিধানের একমাত্র ভাষা হিসাবে হিন্দিকে বেছে নেবার দাবী উঠেছিল। এই দাবির সমর্থনে ১৯৪৬ সালের ১০ ডিসেম্বর পণ্ডিত রঘুনাথ বিনায়ক ধুলেকরগণ পরিষদের বক্তৃতায় বলেন – “People who do not know Hindustani have no right to stay in India. People who are present in the House to fashion a constitution for India and do not know Hindustani are not worthy to be members of this assembly. They had better leave” (Constitution Assembly Debates – Official Report, LokSabha Secretariat, 1988, Volume – I, P-26-27)।এই পরিস্থিতিতেও যে ভাষা কমিশনের হাত ধরে শেষ পর্যন্ত ত্রি-ভাষা সূত্র সরকারিভাবে গৃহীত হয়েছিল, তার জন্য প্রধান চাপ এসেছিল দক্ষিণ ভারত থেকেই। 

ভাষা একটা অঞ্চলের মানুষের মানসিক ও দৈনন্দিন কাজকর্মের প্রধান সংযোগসূত্র। আবার সেই ভাষাই হয়ে ওঠে আত্মনিয়ন্ত্রণ কিংবা অবদমনের হাতিয়ার। অর্থাৎ ভাষা একটা রাজনৈতিক অস্ত্রও হয়ে উঠতে পারে। পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষার মর্যাদার দাবিতে যে রক্তদানের ঘটনা ঘটেছিল, মাত্র উনিশ বছরের মধ্যেই তার পরিণতি ঘটেছিল স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায়। এই একটা ঘটনাই চোখে আঙুল তুলে দেখিয়ে দেয় ভাষার রাজনৈতিক গুরুত্বের কথা। এই ঘটনাটা হয়তো একটা চরম উদাহরণ। কিন্তু রাজনৈতিক প্রভুত্বের প্রয়োজনে ভাষাকে ব্যবহার করার ইতিহাস অনেক প্রাচীন। আবার স্বকীয়তা নির্মাণের জন্য ভাষাকে অবলম্বন করাটাও। মধ্যযুগের ইউরোপে এই কারণেই ছিল ল্যাটিনের দাপট, পোপ-সম্রাট যুগলবন্দীর ক্ষমতার বাহন হিসাবে। যেমন প্রাচীন ভারতে ছিল সংস্কৃতের অপ্রতিহত প্রতাপ কিংবা পরবর্তীকালে ফারসির। 

ভাষার সঙ্গে জনগোষ্ঠীর আবেগ, অনুভূতি কিংবা ইতিহাস জড়িয়ে থাকে। সেটাই স্বাভাবিক। যে ভাষার জন্য একজনেরও অন্তর কাঁদে না, সেই ভাষা যতই দাপুটে হোক না কেন, আসলে মৃত। তার কোন ভবিষ্যৎ নেই। আবার একটা ভাষার বিবর্তন মানে একটা ভৌগলিক অঞ্চলের অধিবাসীদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক বিবর্তনের ধারাভাষ্য। কথাটা শুনতে কানে হয়তো খটকা লাগছে। কিন্তু একটু ভেবে দেখলেই বোঝা যাবে যে কথাটা পুরো সত্যি। ডলপুতুলের মতো যেসব সুন্দরীদের দেখলে আমরা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাই, কখনো ভেবে দেখেছেন কি, ইংরেজরা এদেশে না এলে এই ডলউপমাটা তাদের মুকুটে আর জুটতই না! এমনটাই হয়। হিন্দু-বাঙালীর ঘরের বাচ্চারা তাই বাবা ডাকে; অথচ শব্দটা আদ্যন্তফারসি। আবার মুসলিমরা বলেন আব্বা, যে শব্দটা আবার আরবির বিকৃত উচ্চারণ। এই দুটো আমদানিই সম্ভব হয়েছিল ভারতে তুর্ক আগমনের ফলেই। 

ইতিহাস দেখিয়ে দেয়, একটা জনগোষ্ঠীর উপর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণকে সামাজিক বাস্তবতায় প্রতিষ্ঠা করার জন্য ভাষা ও সাংস্কৃতিক অবদমন খুব জরুরী। এই জন্যই একটা দেশ দখল করার পর বিজয়ী শক্তি সেই দেশের উপর নিজেদের ভাষা চাপিয়ে দেয়। এইভাবেই ভারতে ক্রমান্বয়ে সংস্কৃত, ফার্সি বা ইংরেজির দখলদারি হয়েছে। আবার সেই ক্ষমতার প্রতিষ্পর্ধী জনসত্ত্বার পরিচিতি হিসাবেই আঞ্চলিক ভাষাগুলোর জন্ম ও বিকাশ হয়েছে। এই টানাপোড়েনের মধ্য দিয়েই ঘটেছে প্রতিটা ভাষার বিকাশ ও পরিবর্তন। যে পরিমাণেঅর্থনীতি ও রাজনীতির পট-পরিবর্তন হয়, সেই মাত্রাতেই একটা জনগোষ্ঠীর ভাষা বদলে বদলে যায়। যে ভাষায় অন্তত হাতগুনতি কিছু মানুষও কথা বলে, তাদের সবার ক্ষেত্রেই এটা ঘটতে বাধ্য। কারণ তাদের দৈনন্দিন প্রয়োজনের সংযোগ সাধনের জন্যই ভাষা। যেভাবে আশপাশ বদলায়, সেভাবেই সংযোগের কথন বদলায়, বদলায় শব্দের চরিত্র। আমার ঠাকুর্দার ঠাকুর্দা জানতেনই না – মেট্রো রেলের কাউন্টার থেকে যে টিকিট কাটা হয়, সেগুলো আসলে প্লাস্টিকের চাকতি। আমিও জানি না – চতুষ্পাঠীতে পাঠান্তে ব্যোপদেবের ভুর্জপত্রের পুঁথি কীভাবে শালুতে মুড়ে রাখতে হয়। 

কাজেই আজকের পশ্চিম বাংলায় বাংলা ভাষা যে দুই শতাব্দী আগের বাংলার সাথে মিলবে না, সেটাই বাস্তব এবং সেটাই কাঙ্খিত। সমস্যাটা সেখানে নয়। বিবর্তনের সীমানা ছাড়িয়ে আজ বাংলা ভাষা অবলুপ্তির সম্ভাবনার মুখে দাঁড়িয়ে আছে। অনেকেই হয়তো আপত্তি জানাবেন, ধুর, এটা আবার হয় নাকি! দুই বাংলা, ঝাড়খণ্ড, আসাম, ত্রিপুরা, বিহার, আন্দামান, ছত্তিশগড় মিলিয়ে কমসে কম তিরিশ কোটি মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলেন। তাহলে বাংলা ভাষা অবলুপ্তির চক্করে পড়ে গেছে কথাটা তো ভিত্তিহীন। আজ্ঞে না। মুখের কথা আর ব্যবহারিক ভাষা এক জিনিষ নয়। ধরুন বিহার। যদি আপনাকে প্রশ্ন করা হয়, বিহারের অধিকাংশ মানুষ কোন ভাষায় কথা বলেন, আপনারা একসুরে উত্তর দেবেন, হিন্দি। পুনশ্চ, না। বিহারের অধিকাংশ মানুষ হিন্দিতে কথা বলেন না। জনসংখ্যার হিসাবে সব থেকে বেশি মানুষের কথ্যভাষা হলো ভোজপুরি; তারপর ক্রমান্বয়ে মৈথিলী, মগহি বা মাগধী এবং অঙ্গিকা। কিন্তু একমাত্র মৈথিলী বাদে আর একটি বিহারী ভাষারও সাংবিধানিক মান্যতা নেই। বিহারের সরকারি ভাষা হলো হিন্দি ও উর্দু। যাবতীয় সরকারি কাজ ইংরেজি ছাড়া এই দুটি ভাষাতেই হয়। পড়াশুনোর মাধ্যমও তাই।

সঙ্গে সঙ্গেই অনেকেই নিশ্চয়ই আঙুল উঁচিয়ে বলবেন, এতটা খারাপ অবস্থা বাংলার কখনই নয়। নয়, ঠিকই। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ভাষা বাংলা; যাবতীয় সরকারি কাজ বাংলাতেই হয়। এপারেও বাংলারাজ্যস্তরের সরকারি ভাষা; ইংরেজির পাশাপাশি বাংলাতেও সরকারি কাজ হবার কথা। কথা, ঐ কথা পর্যন্তই। পঞ্চায়েত বা স্থানীয় প্রশাসনিক স্তরে দরখাস্ত বাংলায় করা যায়। কিন্তু ফাইলের কাজকর্ম হয় সেই ইংরেজিতেই। আর সর্বোচ্চ স্তরের কাজে বাংলার কোন স্থানই নেই। যাবতীয় সরকারি আইন, বিধি বা নির্দেশ প্রকাশ পায় ইংরেজি ভাষাতেই। পশ্চিমবঙ্গের বাংলাভাষী রাজ্য সরকারি আধিকারিকদের অন্যান্য কয়েকটি বিষয়ের সঙ্গে হিন্দির একটা পরীক্ষা দিতে হয়; যাতে কৃতকার্য না হলে স্থায়ীকরণ হয় না। এতদিন সে পরীক্ষা খুব নমোনমো করেই হতো। সম্প্রতি শোনা যাচ্ছে, সেই পরীক্ষাতে নাকি প্রতিটি প্রশ্নে নির্ধারিত নম্বর না পেলে ফেল করিয়ে দেওয়া হবে। পশ্চিমবঙ্গের অ-বাংলাভাষী কর্মচারীদের বাংলা ভাষার পরীক্ষাতেও পাশ করতে হয়। সেখানে কিন্তু কোনো বজ্র আঁটুনির গল্প শোনা যাচ্ছে না। কেন?

এখানেই আদত প্রশ্ন। তাহলে কি বাংলার ব্যবহারিক প্রয়োজন কমছে? একটা আঞ্চলিক পরিসংখ্যান নিলেই বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে যাবে। ১৯৯০ সালে উত্তর চব্বিশ পরগনার জেলা সদরে অনুমোদিত ইংরেজি মাধ্যম সেকেন্ডারি স্কুল ছিল মাত্র একটা। সেই সংখ্যাটা বর্তমানে আট। আর এই সাতাশ বছরেবাংলা মাধ্যম অনুমোদিত স্কুলের সংখ্যা বেড়েছে মাত্র দুই। প্রতিটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলই বেসরকারি। তারা নিশ্চয়ই জনসেবার জন্য স্কুল খোলেনি; খুলেছে ব্যবসার জন্য। একজনের ভালো ব্যবসা হচ্ছে দেখেই বাকিরাও লাফ দিয়ে চলে এসেছে। ব্যবসার বাড়বাড়ন্ত হচ্ছে কেন? কারণ আজ পশ্চিমবঙ্গের বাঙালী বাবামায়েরাও মনে করছেন, ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল করতে গেলে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশুনো বাধ্যতামূলক। এই যে সাংস্কৃতিক বিচলন, এটাকে মাথায় না রাখলে বাংলা ভাষার সঙ্কটকে বোঝা যাবে না। এই সমস্ত স্কুলের বাঙালী ছাত্রছাত্রীদের একটা বড় অংশ বাংলা পড়ে ক্লাস এইট পর্যন্ত, নবম-দশম ক্লাসে হাতগুনতি বাচ্চারই দ্বিতীয় ভাষা থাকে বাংলা। ভাবুন, রাজ্যটার নাম পশ্চিমবঙ্গ; জেলাটার নাম উত্তর চব্বিশ পরগনা; শহরটার নাম বারাসাত, যেখানে পাঁচ বছর ছিলেন স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্র। 

কেন এটা হতে পারছে? শিক্ষা নিয়ে যতই বড় বড় গালভরা কথা বলা হোক না কেন, মানুষ আসলে শিক্ষায় আগ্রহী হয় উপার্জনের সুবিধার জন্য। বোধের বিকাশ ইত্যাদি আনুষঙ্গিক প্রাপ্তি; হলেও হলো, নাহলেও ক্ষতি নেই। তাহলে আজ বাঙালী বাবামায়েরা মনে করছেন, তাদের ছেলেমেয়েদের উপযুক্ত জীবিকা অর্জন করতে হলে বাংলাকে পরিহার করতে হবে। মোদ্দা কারণ বোধহয় এটাই যে পশ্চিমবঙ্গে বসে উচ্চস্তরের জীবিকা সংগ্রহের সম্ভাবনা দিন দিন সংকুচিত হয়ে আসছে। এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। কোনো বিশেষ দলের প্রতি আঙুল না তুলেই বলা যায়, ভারতের আর্থিক মানচিত্রে পশ্চিমবঙ্গের ভূমিকা ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। আর এইজন্যই পশ্চিমবঙ্গের যুবকযুবতীরা দলে দলে চলে যাচ্ছে তামিলনাড়ু, হরিয়ানা কিংবা কর্ণাটক। স্বভাবতই ইংরেজিতে তাদের দক্ষতা বা অনর্গল কথা বলতে পারার ক্ষমতা বাড়তি সুবিধা দিচ্ছে। কিন্তু তার সাথে বাংলা না পড়ার সম্পর্ক কোথায়?

এখানে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ কথা মাথায় রাখতে হবে। চাকরির প্রয়োজনে বাঙালী সুদূর অতীতেও ভারতবর্ষের সর্বত্র দৌড়েছে। তাতে বরং বাঙালীর সাংস্কৃতিক পতাকাই ছড়িয়েছে। বাংলা সাহিত্যের চর্চা হয়েছে ভাগলপুর থেকে ইম্ফল, সর্বত্র। আর আজ বাঙালীর ছেলেমেয়ে স্রেফ পড়ার জন্য দৌড়চ্ছে বেঙ্গালুরু থেকে ভুবনেশ্বর, দিল্লী থেকে গুয়াহাটি। এটাই বাঙালীর সাংস্কৃতিক জীবনে একটা মস্তবড় ধাক্কা দিয়েছে। আর তার হাত ধরেই এসেছে বাংলা ভাষার প্রতি টান কমে যাওয়া, বাংলা সাহিত্যের চর্চা, বাংলা বই না পড়ার প্রবণতা। আজ বাঙালীর সুযোগ্য পুত্র রেগে গিয়ে ধেত্তেরেকি না বলে উগড়ে দেয় শিট। সে অবশ্য বাঙালী তার বাছাবাছা গালিগালাজের জন্য চিরকালই হিন্দুস্থানী ভাষার কাছে ঋণী। কিন্তু আজ বাঙালীর সন্তান “মমোতা”র বদলে উচ্চারণ করেন “মম্ তা”। খেয়াল করেছেন? হিন্দি উচ্চারণ রীতি কীভাবে গ্রাস করছে আমাদের সন্তানদের? আমরা হিসাবেই রাখি না। কারণ আমরা তো গর্বের সাথে বলি, বাংলাটা খুব টাফ বলে বাচ্চাকে হিন্দিতেই ঠেলে দিলাম। 

মাতৃভাষা টাফ? তাহলে তো সেই মানবককে গরুছাগলের ভাষাতেই কথা বলতে দেওয়া উচিৎ। না, এমন কথার কোনো প্রতিবাদ আমরাও করি না। কারণ ভিতরে ভিতরে আমরাও জেনে গেছি, যে ভাষাচর্চায় স্রেফ স্কুলমাস্টারি ছাড়া অন্য কিচ্ছু জোটানো সম্ভব নয়, বিশ্বায়নের যুগে তা স্রেফ অচল। বাংলা ভাষার আসল সঙ্কট এখানেই। বাংলা নিশ্চিতভাবেই সাধারণের মুখের ভাষা হিসাবেই থাকবে। কিন্তু ব্যবহারিক প্রয়োজন যদি এইভাবে কমতে থাকে, তাহলে বাইরের প্রয়োজনে বাংলা না পড়ার প্রবণতা আরো বাড়বে। সেক্ষেত্রে একটা আইনি প্রতিবিধান হয়তো খানিকটা কার্যকরী হতেই পারে। কিন্তু সবার আগে চাই একটা সাংস্কৃতিক উত্থান, আন্দোলন। কিন্তু সেই মানসিক বাতাবরণ কি আজ আর আদৌ অবশিষ্ট আছে? 

পূর্ব পাকিস্তান ভাষা আন্দোলনের পথ খুঁজে নিয়েছিল বাইরে থেকে জোর করে উর্দু চাপিয়ে দেবার কারণে। আসামের বরাক উপত্যকাও পথে নেমেছিল বাংলা ভাষার উপর সরকারি জবরদস্তির কারণে। দুই ক্ষেত্রেই বাইরে থেকে এমন এক ভাষাকে চাপানোর চেষ্টা হয়েছিল যা বাঙালীর স্বাভাবিক অর্জন নয়। কিন্তু আজ তো বাঙালী নিজেই তার ভাষার উত্তরাধিকার খারিজ করে দিচ্ছে। বাঙালী নিজেই গর্ব অনুভব করছে, তার সন্তান বাংলা পড়তে পারে না। এই আত্মঘাতী অবক্ষয় যখন সবকিছু গ্রাস করতে চায়, তখনই ঘুরে দাঁড়ানোর সময়। হয়তো আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই আমাদের দেখতে হবে তৃতীয় ভাষা আন্দোলনের মিছিল, পশ্চিমবঙ্গের বুকেই। হয়তো আমাদেরও মিছিলে গলা ফাটিয়ে বলতে হবে – বাঙালী, বাংলা বলো; বাঙালী, বাংলা পড়ো। 

1 comments:

3

প্রবন্ধ - ময়ূরী মুখোপাধ্যায়

Posted in


প্রবন্ধ


বটানি, ল্যাটিন নাম এবং বাংলা সিনেমা ও সাহিত্যে বটানিস্ট চরিত্রেরা
ময়ূরী মুখোপাধ্যায়


মানবসভ্যতার ইতিহাস সবথেকে বেশি কৃতজ্ঞ থেকেছে যে দুটি গাছের কাছে, তাদের অবস্হান দুটি ভিন্ন মহাদেশে, প্রায় হাজার বছরের ব্যবধানে। লিংকশ্যয়রের উলস্থ্রপ ম্যানর আর বুদ্ধগয়া। বুদ্ধগয়ার অশ্বত্থ গাছটি, যার তলায় এক সংসারত্যাগী রাজপুত্র হয়ে উঠেছিলেন দিগদর্শী বোধিসত্ত্ব…আর তার সহস্রাব্দ পরে উলস্থ্রপ ম্যানরের নিভৃত গৃহকোণের নিরীহ আপেলগাছ, একনিষ্ঠ বৈজ্ঞানিককে সূত্র ধরিয়েছিল অভিকর্ষের।

জীবনে পাঁচবছর টানা যে বিষয়টি নিয়ে পড়েছি, যার জন্য এখনো একটা কেন্দ্রীয় সরকারের ফেলোশিপ জুটিয়ে করেকম্মে খাচ্ছি, তাকে আমি বলি বটানি, আমি বাদে বাকি সবাই বলে বোটানি। বেকার ল্যাবের দোতলা এবং আড়াইতলার অর্ধেকটা জুড়ে চমৎকার একটা ডিপার্টমেন্ট ছিল আমাদের, ছিল প্রতিটা ক্লাসে ছাব্বিশ জন ছাত্র-ছাত্রী আর সবমিলিয়ে তেরোজন বিদগ্ধ শিক্ষকের অকল্পনীয়, প্রায় অবিশ্বাস্য 2:1 অনুপাত। হ্যাঁ, ছিল। এখন আর সে রামও নেই, সে অযোধ্যাও অন্তর্হিত। আমরা ছিলাম কলেজের লাস্ট ব্যাচ,কলেজ এখন ইউনিভার্সিটি, আমার ডিপার্টমেন্টটাই abolished হয়ে গেছে।

একজন বটানির স্টুডেন্টকে সারাজীবনে সবথেকে বেশিবার যে প্রশ্নটার সামনে পড়তে হয়, তা হল আশপাশে রাস্তার ধারে কোনো গাছ দেখিয়ে গাছটার নাম জানতে চাওয়া। এই গাছ চেনার শিক্ষাটা আমাদের পুরো সিলেবাসের একটা অংশ, ট্যাকসোনমি গুরুত্বপূর্ণ ঠিকই, কিন্তু একই (কখনও বা বেশিও) গুরুত্ব বায়োকেমিস্ট্রি, ফিজিওলজি, জেনেটিক্স, বায়োটেকনোলজিরাও দাবি করে। মুশকিলটা হচ্ছে, অন্তত শদুয়েক খটোমটো ল্যাটিন নাম মুখস্থ করবার চক্করে অনেকেই প্রাণপণে একে এড়িয়ে থাকার চেষ্টা করে যায়।

বিশ্বাস করুন, গ্রামে বা মফস্বলে ছোটবেলা কাটানো মানুষেরা অনেক বেশি গাছপালা চেনেন, বহু বটানি ডিগ্রিধারীর থেকে অনেক বেশি। আমার নিজের জ্ঞানই আমার মা বাবার পরিধির অর্ধেকও পৌঁছায় না। কিছুটা আগ্রহ ছিল বলে কয়েকটা ল্যাটিন নাম শিখেছিলাম সিলেবাসের বাইরে, তাও তারা গাছ নয়, আগাছা (herbs, not tree)। পাঁচিলের গায়ে, ফুটপাথের পাশে ফুটে থাকা ছোট্ট লিনডেনবার্জিয়া, বেগুনি রুয়েলিয়া দের বাংলা নাম আজও জানা হয়নি আমার। সত্যি বলতে কি, অনেকক্ষেত্রেই আক্যাডেমিক প্রয়োজনের বাইরে খুব একটা প্রাসঙ্গিকও নয়।

নিকট্যানথেস আর্বর-থ্রিস্টিস (Nyctanthes arbor-thristis) শুনলে কস্মিনকালেও কী কারও মাটি বিছিয়ে পড়ে থাকা শিউলি ফুলের কথা মনে পড়ে, না পড়া সম্ভব! ভাসুক না আকাশে যতই পেঁজা তুলোর মত মেঘ, থাকুক না বাতাসে যতই পুজো পুজো গন্ধ। হোক না শিউলি পশ্চিমবঙ্গের স্টেট ফ্লাওয়ার। ভরা বিয়ের মরশুমে ভরপেট খেয়ে যদি ফোয়েনিকুলাম ভালগারে (Foeniculum vulgare) আর এরিকা ক্যাটেচু (Areca catechu) দেওয়া (মৌরি-সুপারি) পানপাতা চিবাতে হয়, পরিতৃপ্তির একটা উদ্গার ও যে উঠবে না!

ল্যাটিন নামের কচকচি বটানি থেকে বাদ দিলে সবার আগে স্কুলপাঠ্য বইয়ের যে না-সঠিক ধারণাটা মনে পড়ে থাকে তা হল “আচার্য জগদীশচন্দ্র বোস গাছের প্রাণ আছে আবিষ্কার করেছিলেন”। বীজ থেকে ধীরে ধীরে বড় হতে থাকা গাছপালাকে ফুলেফলে ভরে ওঠার পর শুকিয়ে মারা যেতে দেখেও তাদেরকে জড় পদার্থ ভাবার কোনও কারণ আসলে তার অনেক অনেকদিন আগে থেকেই মানুষের ছিল না। জগদীশচন্দ্র বোসের এই ক্ষেত্রের বিশেষ অবদান হলো যেকোনও উত্তেজনাতে, ব্যথা বেদনাতে, জলকস্ট বা অতিবৃষ্টির সময়ে গাছেরাও তার আঁচ পেয়ে আমাদের মত সাড়া দেয় (যা অব্যক্ত), দিতে পারে — এই হাইপোথিসিসের পরীক্ষা প্রতিষ্ঠিত প্রমাণ। লজ্জাবতীর স্পর্শকাতরতা, সুন্দরবনের লবণাক্ত মাটি ভেদ করে ওঠা ম্যানগ্রোভের শ্বাসমূল, হলুদ-কমলা- সিঁদুররাঙা রাশিরাশি পাতা ঝরানোর ফলকালার্স এদের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সাড়া দেওয়ার বিভিন্ন ভাষ্য, যা আমার আপনার কাছে অপাঠযোগ্য। উদ্ভিদ মাত্রেই sensible এবং responsive, শুধুমাত্র জীবিতই (living) নয়।

তবে বটানির সবথেকে জনপ্রিয় (অন্তত বাংলাতে) প্রশ্নের সামনে পড়তে হয়েছিল শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়কে, ফিজিক্সের প্রফেসার হয়ে বটানির কলিগ উত্তমকুমারের প্রক্সি দিতে এসে।“গাঁদা আর সূর্যমুখী ফুল নয় কেন?” এই লা-জবাব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে ক্রাশকে প্রভাবিত করতে সিনেমার বেচারই চরিত্রটিকে বইচুরি করতে অবধি যেতে হয়। প্রথমে“চিংড়ি মাছ যেমন মাছ নয়, গাঁদাও তেমন ফুল হলেও ফুল নয়” বলে ম্যানেজ করার বিফল চেষ্টা, পরিণামে স্বীকারোক্তি ও অবশেষে অঙ্গুরীয় প্রদানে বাগদান। প্রশ্নের উদ্দেশ্য নাহয় এখানে দোষ স্বীকার করে নেওয়ায় চাপা পড়ে গেল, কিন্তু সবথেকে আফসোসের বিষয়টা হলো এই যে, ছদ্মবেশী উত্তমকুমার সিনেমার শেষে ড্রাইভারের ছদ্মবেশ ঝেড়ে ফেলে স্বভূমিকায় প্রতিষ্ঠিত হয়েও উত্তরটা দিয়ে গেলেননা। ফলতঃ, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে অন্তত দশবার আমাকে এই প্রশ্নোত্তর ব্যাখ্যা করতে হয়েছে।

একটা গাঁদা বা সূর্যমুখী আসলে একক ফুল নয়। একেকটি সম্পূর্ণ পুষ্পমঞ্জরী (inflorescence)। কৃষ্ণচূড়া বা রঙ্গনের একগোছা/একথোকা ফুলের কথা মনে করুন, সেখানে মঞ্জরীর ধারণা চাক্ষুষ করা খুব সহজ। গাঁদা, সূর্যমুখীর যে একককে আমরা সাধারণভাবে ফুল ভাবি, তা আসলে অনেকগুলো ফুলের পরিবর্তিত একটা গুচ্ছ, যেখানে প্রতিটা সাধারণ পাপড়ি এক একটা পুষ্পিকা (floret)। গাঁদা, বাহারি ডালিয়া, ক্রিসেন্থেমামের ক্ষেত্রে পুরো মঞ্জরীতে কেবল একই রকম ফ্লোরেট, যেখানে সূর্যমুখীর বা ক্যালেন্ডুলার মঞ্জরী সাজানো দুধরনের ফ্লোরেট দিয়ে (বাইরের উজ্জ্বল হলুদ, ভেতরের গোলাকার অংশে কালো ছোট্ট ফ্লোরেট)। আমার মতো বটানির লোকজন এই বিশেষ ধরনের মঞ্জরীকে বলবে ‘ক্যাপিচিউলাম’(capitulum) বা ‘হেড’(head) , আর আরও অজস্র বিশ্রী বাংলা অনুবাদের মতো এরও পরিভাষা ‘মস্তক’। বিবর্তনের বিচিত্র পথে এই বিশেষ ফুলসজ্জায় অতিথি ভ্রমরের (বা অন্যান্য পরাগসংযোগকারী পতঙ্গের) একবার পরিভ্রমণে একাধিক ফুল গর্ভধারণ করে পরের প্রজন্মের পৃথিবীতে আসা সুনিশ্চিত করার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। কী অনবদ্য নৈপুণ্য!

হিন্দি “চুপকে চুপকে”য় অমিতাভ বচ্চনকে জয়া ভাদুড়ির corolla সংক্রান্ত প্রশ্নটায় তেতো করলার প্রসঙ্গ টেনে মান বাঁচানোর চেষ্টা করতে হয়। যদিও উৎরোয়নি তেমন। আমি ব্যাখ্যা দিলেও উৎরোবে না বিশেষ কারণ corolla ফুলের সবকটি পাপড়ির বটানিক term, যাকে বাংলায় দলমন্ডল বলি, এই মাত্র। একজন কলেজের ছাত্রী এই সামান্য প্রশ্নটা কেন জানতে চাইবে, সেটা আমার মাথায় কখনওই ঢোকেনি।

অনেক ভেবেও বাংলা সাহিত্যে তিন চারজনের বেশী বটানির প্রফেসর এর কথা মনে পড়ল না। বিমল করের কোনও এক সরস গল্পে কুসুমকানন বলে এক ভদ্রলোক ছিলেন, কিন্ত বিষয়টার একটিমাত্র উল্লেখ হয়েছিল একটা জবরদস্তি সম্পর্কের সূচনায়, আমার ভালো লাগেনি। আমার অত্যন্ত প্রিয়, শীর্ষেন্দুর পার্থিবে ছিলেন কৃষ্ণজীবন, পৃথিবীর নিদারুণ অপমানে দুঃখী, অসহায় অথচ অনুপম দরদী হৃদয়ের এক বিষণ্ণ এনভায়রনমেন্টালিস্ট । আমার দুর্ভাগ্য, এই অসামান্য উপন্যাসেও ভারী বটানির বইয়ের একটিমাত্র প্রসঙ্গ এসেছে এক অপ্রীতিকর দাম্পত্য কলহের ইন্ধন হিসেবে।

একমাত্র সত্যজিৎ রায়ের বিভিন্ন গল্পে বিভিন্ন ভাবে বটানিস্টরা ঘোরাফেরা করে, মূলত পার্শ্বচরিত্রে। জেরেমি সন্ডার্স, শঙ্কুর ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে একবারই, একশৃঙ্গ অভিযানে দেখেছি বটানিস্ট হিসেবে, ডুংলুং ডো তে অচেনা পাতা-ফুল-ফলের নমুনা সংগ্রহে। মিরাকিউরলের উৎস স্বর্ণপর্নী সংগ্রহে শঙ্কু ছিলেন একা কিন্তু মানরো দ্বীপের অমৃত ফল অ্যামব্রোজিয়া সন্ধানকারী টীমের একজনও বটানিস্ট না থাকায় দুঃখ পেয়েছি। ভুলে যাইনি, একজন বটানিস্টের আমন্ত্রণেই গল্পের প্রোটাগনিস্টকে বন্দুক ধরতে হয়েছিল ভয়াবহ মাংসাশী সপ্তপাশের ক্ষিদে থেকে বন্ধু অভিজিৎ আর পোষা ম্যাস্টিফ, বাদশাকে বাঁচাতে। বটানিতে একটা ডিগ্রী ছিল যার মৃত্যুকে ঘিরে গ্যাংটকে গণ্ডগোল বাঁধে, সেই শিবকুমার শেলভাঙ্করের, ইন্টারভিউ বোর্ডের কথাবার্তা থেকে জানা যায় প্রতিদ্বন্দ্বীর সিদ্ধার্থ চৌধুরীরও।

বইয়ের পৃষ্ঠায় তেমন উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি নেই বটানিস্টদের, বাংলা সিনেমার পর্দায় তো আরওই শোচনীয়। এই কতিপয় উল্লেখেও সর্বত্র বটানিস্টরা পুরুষ, এবং এই তথ্যের কোনও ব্যতিক্রম নেই, এটা আমাকে একটু পীড়া দেয়। অবশ্য সমগ্র বাংলা গদ্যসাহিত্যের গভীরতার তুলনায় আমার আয়ত্তাধীন অংশ তো বলতে গেলে সিন্ধুতে বিন্দুপ্রায়, তাই এই সামান্য তালিকায় আরও কয়েকজনের নাম যুক্ত হলে আমি নিজে খুশি বৈ দুঃখ পাবনা।

3 comments:

1

প্রবন্ধ - মিনতি ঘোষ

Posted in


প্রবন্ধ


THE GREAT DICTATOR - শ্রদ্ধায়, স্মরণে চার্লি চ‍্যাপলিন
মিনতি ঘোষ




we must laugh in the face of our helplessness against the forces of nature - or go insane - প্রকৃতির সমস্ত শক্তির বিরুদ্ধে, আমাদের অসহায়তার সামনে দাঁড়িয়ে আমাদের অবশ‌্যই হেসে যেতে হবে নতুবা পাগল হয়ে যাও।

চার্লি চ‌্যাপলিন এমনই। বুকের খামে কান্না ভরে রেখে হাসির মলাট মুখে। তাঁর সমস্ত সৃষ্টিতে এই দর্শন বরাবর ছুঁয়ে আছে। সমস্ত প্রতিকুলতাকে হেসে জয় করতে হবে…

He dazzles everybody - the intellectual, the simple, the cunning, and even those who meet him everyday - তিনি সবাইকে চমকে দিয়েছেন - বুদ্ধিমান, সরল, শঠ - এমনকি প্রতিদিন যাদের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়, তাদেরকেও 


The Great Dictator-এর আগের ছবিগুলি ছিল তীব্র জীবন সংগ্রামের ছবি - যা হাসির কোটিং দিয়ে পরিবেশিত হয়েছে। ছোটখাট মানুষটি তার বেঢপ পোষাক, প্রজাপতি গোঁফ, বোকা হাসি, আর চোখের অদ্ভূত ঔজ্জ্বল‌্য নিয়ে দর্শকদের হাসিয়ে, মাতিয়ে রাখছেন, কষ্টের চোরা স্রোতবুকের মধ‌্যে ছলাৎ ছল বয়ে যায়। এ ছবি অন‌্য রকম। এখানে হাসির মোড়ক খুলে গিয়ে বেরিয়ে এলো এক মঙ্গলময় বার্তা - যুদ্ধ বিরোধী প্রতিবাদ। ওরে হাল্লা রাজার সেনা… তোরা যুদ্ধ করে করবি কি তা বল … রাজ‌্যে রাজ‌্যে পরস্পরে দ্বন্দ্বে অমঙ্গল। তাঁর অন‌্যতম জীবনীকার, ইউরোপের বিখ‌্যাত সিনেমা সমালোচক David Robinson বলছেন, The Great Dictator remains an unparalleled phenomenon, an epic incident in the history of mankind... মানবতার ইতিহাসে এক মহাকাব‌্যিক ঘটনা ।


হিটলার এবং চার্লির চেহারায় এক অবিশ্বাস‌্য সাদৃশ‌্য - অথচ মানবিকতার দু প্রান্তে দু জন দাঁড়িয়ে। ইউরোপের অনেকের ধারণা সারা পৃথিবী ব‌্যাপী এত ভালবাসা, এত আনুগত‌্য চার্লির প্রতি - তাই দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে হিটলার চার্লির গোঁফের ফ‌্যাশনটি স্রেফ ঝেপেছেন। এই প্রসঙ্গে একটি ঘটনা উল্লেখ করা প্রয়োজন। Konard Bercovici চার্লির বিরুদ্ধে কোর্টে গেলেন কেননা 1930 এর মাঝামাঝি তিনি চার্লিকে অনুরোধ করেছিলেন তাঁর ছবিতে হিটলারের ভূমিকায় অভিনয় করতে - চার্লি তখন রাজি হননি অথচ Great Dictator এ চার্লি Hinkyl এর চরিত্রে অভিনয় করেন যা কিনা হিটলারের আদলে তৈরী এবং ছবিটি করেন 1939-40 সালে। যাই হোক অনেক পরে চার্লি দুঃখ করে বলেন, যদি আমার জার্মান কনসেনট্রেসন ক‌্যাম্পের বাস্তবিক বীভৎসতা জানা থাকতো, আমি কিছুতেই এই ছবি করতে পারতাম না । আমি কোনভাবেই নাজিদের এই উন্মত্ত খুনের মত্ততা নিয়ে মজা করতে পারতাম না - Had I known of the actual horrors of the German concentration camps, I could not have made The Great Dictator, I could not have made fun of the homicidal insanity of other Nazis. 

সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পরা যুদ্ধের বীভৎসতার বিরুদ্ধে বারবার প্রতিবাদ করেছেন - দেশে এবং বিদেশেও। 1938 এপ্রিলে ফরাসী চলচিত্র ম‌্যাগাজিন Cinemondeতে তাঁর বিখ‌্যাত ছোটগল্প Rhythme অনুবাদ হয়ে প্রকাশিত হয় - গল্পটি একজন স্প‍্যানিশ দেশভক্ত, মজার লেখকের হত‍্যার ঘটনার উপর লেখা। যুদ্ধ শুরু হবার আগে ফায়ারিং স্কোয়াডের ভারপ্রাপ্ত প্রধান অফিসারের সাথে এই সাজাপ্রাপ্ত মানুষটির গভীর বন্ধুত্ব ছিলো। যুদ্ধের সময় তাঁরা মতাদর্শগত ভাবে পৃথক হয়ে গেলেও, এই অফিসার আর ফায়ারিং স্কোয়ার্ডের অন‍্যান‍্য সৈনিকরা মনে মনে চাইছিলেন এ শাশ্তি যেন রদ্ হয়ে যায়। কমান্ডের চারটি ধাপ - Attention!…Shoulder arms!...Present arms!....Fire!  

অফিসার প্রথম তিনটি উচ্চারণ করলেন ...দ্রুত ছুটে আসা পদশব্দ শুনে বুঝতে পারলেন শাস্তি রদের হুকুম আসছে...কমান্ড দিলেন Stop! ঘাতক সৈন‌্যরা শুধু fire কমান্ড শুনেই অভ‌্যস্ত, Stop বুঝলো না - six men each held a gun. Six men had been trained through rhythm. Six men, hearing the shout - Stop!  fired.  - এই ঘটনায় বুঝতে পারা যায় চুড়ান্ত যান্ত্রিকীকরণ কি ভাবে এক মর্মান্তিক পরিণামের দিকে এগিয়ে যায়। এই যান্ত্রিকীকরণের হাস‍্যকর ভয়াবহতা তাঁর Modern Times এও দেখানো হয়েছে ।

The Great Dictator চার্লির প্রথম সবাক ছবি । চার্লির কাজের ধরণও এই ছবি করার সময় পাল্টে যায়। আগে তিনি ছবি করতে করতে ধাপে ধাপে গল্পটিকে লিখতেন - একটি একটি স‌্যুটিং পর্ব শেষ হলে, পরের পর্বের জন‌্য লিখতেন। এখন সম্পূর্ণ গল্পটি প্রথমেই লিখে ফেললেন। 1938 থেকে লিখতে শুরু করেন এবং 1939এর তেসরা সেপ্টেম্বর The Great Dictator এর ফাইনাল স্টেনসিল্ড কপি তৈরী খরে ফেলেন। - ঠিক এই দিনটিতে ব্রিটেন জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। স্ক্রীপ্ট ৩০০ পাতার, ২৫ টি ভাগ এবং প্রতিটি ভাগ পেজিং করে তা বর্ণের(alphabet) মাধ‍্যমে সূচিত করা হয়। ছয় সেপ্টেম্বর থেকে রির্হাসাল শুরু হয় এবং নয় সেপ্টেম্বরে ঘেট্টোর দৃশ‍্য দিয়ে সুটিং শুরু হয় । গল্পটি তো সবার জানা - শাসক Hinkle এর সাথে চেহারার সাদৃশ‌্য থাকার জন‌্য কনসেনট্রেসন ক‌্যাম্প থেকে পালানো নাপিত চার্লিকে Hinkle ভেবে ধরেবেঁধে সৈন‌্যদের জমায়েতের সামনে ভাষণ দেবার জন‌্য ঠেলে দেওয়া হয় - আর উল্টৌভাবে Hinkleকে পলাতক নাপিত ভেবে ধরে নিয়ে বন্দি করা হয়। বোকা, ক্লাউনের মতো চার্লি সেই বিশাল জমায়েত দেখে প্রথমে বেশ ভ‌্যাবাচ‌্যাকা খেয়ে যায়, যেখানে সামনের সারিতে অপেক্ষা করছে বেশ কিছু অষ্ট্রিচ দেশপ্রেমিক - যারা এসেছে Hinkle কে হত‍্যা করতে। নাপিতের প্রেমিকার বাবা তার কানে কানে বলে, তোমাকে এখন কথা বলতেই হবে! এটাই আমাদের বাঁচার একমাত্র সুযোগ! ভগবানের দোহাই - কিছু বলো ...You’ve got to talk now! It’s our only chance! For God’s sake, say something.  Hinkle এর প্রধানমন্ত্রী Herring প্রথমে ভাষণ দেয়া শুরু করেন, যা বেতার তরঙ্গে সারা বিশ্বের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে ...নিজের ভাষণে প্রথমে গণতন্ত্রের অবসান ঘটানোর ডাক দিয়ে বিশ্বজয়ী শাসক Hinkleকে জনতার সামনে উপস্থিত করেন - এই শাসককে মান‍্যি করতে হবে, নতুবা…. তারপর ভাষণ দিতে বাধ‍্য হয় নাপিত চার্লি। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে ধীরে ধীরে বলতে শুরু করে...কথা বলতে বলতে নিজের মধ‍্যে এক অপ্রতিরোধ‍্য শক্তি টের পায় ছোটখাটো মানুষটি...একসময় ক্লাউনের খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসে একজন ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা মানবতাবাদী সন্ত - the clown turns into the prophet ‘ যে বক্তব‍্য উপস্থিত সৈনিকদের মধ্যেই শুধু নয়, বেতার তরঙ্গের মাধ‌্যমে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পরে । যুদ্ধবিরোধী, বৃহত্তর মানবতার সপক্ষে আজও পর্যন্ত এমন জোরালো শক্তিশালী বক্তব‍্য কোন বিনোদন মাধ‍্যমে প্রচারিত হয়নি। The Great Dictator - এই কারণেই চার্লির অন‍্য সমস্ত ছবির থেকে শ্রেষ্ঠত্বের বিচারে এগিয়ে থাকে। আশ্চর্যের বিষয় এই ছবিটি কিন্তু প্রথমে আমেরিকায় একদমই আদৃত হয়নি। চার্লি নিজেও খুব নার্ভাস ছিলেন এই ব‍্যাপারে। ইউরোপের বিস্তৃত অঞ্চল তখন হিটলারের নাজি বাহিনীর পদানত। হলিউড নাজি শাসন বিরোধী ছবিকে মেনে নিতে পারেনি সেদিন। এক জনসমীক্ষায় জানা যায় ইউরোপে যখন যুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছিলো, তখন আমেরিকার ছিয়ানব্বই শতাংশ মানুষই যুদ্ধ-যোগদানের বিরুদ্ধেই ছিল। ডিস্ট্রিবিউটররা পর্যন্ত বললেন - You’ll lose a million dollars… and he said, Well I don't care if it's five million… এমনকি রাশি রাশি ভয় দেখানো চিঠিও পেলেন - বুঝতে পারলেন ফ‌্যাসিস্ট সমর্থকরা বেশ ভাল ভাবেই সক্রিয় তখন আমেরিকায়। অথচ সারা বিশ্ব জুড়ে এই ছবির জন‌্য তাঁকে এক অনন‌্য শ্রদ্ধার আসনে বসানো হলো। - তাঁর ইচ্ছা ছিল স্পেন, চিন, জার্মানীর রাস্তায়, ইহুদি ঘেট্টোতে এই বক্তৃতা দেওয়া হচ্ছে এমন ভাবে দৃশ‍্যায়িত করার…

এই বক্তব‍্য যেন মানুষের বিবেককে জাগ্ৰত করছে। তিনি দেখাতে চেয়েছিলেন তাঁর এই বক্তৃতা শুনতে শুনতে স্প‌্যানিস ফায়ারিং স্কোয়াড যেন অস্ত্র ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছে, জাপানী সৈন‌্যরা বম্ব না ফেলে প‌্যারাসুটে করে চিনের বাচ্চাদের খেলনা পাঠাচ্ছে, একজন নাজি সৈন‌্য নিজের জীবন তুচ্ছ করে একটি বাচ্চা ইহুদি মেয়েকে বাঁচাচ্ছে! যদিও বিভিন্ন কারণে এইভাবে দৃশ‍্যায়িত করা যায়নি। The Great Dictator অবশেষে আমেরিকায় নয়, 16ই ডিসেম্বর 1940 এ লন্ডনে মুক্তি পায় এবং অচিরেই ব্রিটিশ জনতার মন জয় করে ।


The Great Dictator এর বিশ্বব‍্যাপী এই জনপ্রিয়তা - শ্রেষ্ঠত্বের মূলে আছে ছ মিনিটের বিখ‍্যাত সেই বক্তৃতা। এক ভয়ংকর বিধ্বংসী যুদ্ধের সামনে দাঁড়িয়ে, অত‍্যন্ত সহজ, আঁটোসাঁটো ভাষায় তিনি তাঁর ভয়ের কথা বললেন, এক উজ্জ্বল ভবিষ‍্যতের স্বপ্নও দেখালেন :-

  The way of life can be free and beautiful, but we have lost the way. Greed has poisoned men’s soul - has barricaded the world with hate… We have developed speed, but we have shut ourselves in. Machinery that gives abundance has left us in want. Our knowledge has made us cynical …We think too much and feel too little. More than machinery we need humanity. More than cleverness we need kindness and gentleness. Without these qualities, life will be violent and will be lost.


জীবনের পথ মুক্ত এবং সুন্দর হতে পারে, কিন্তু আমরা পথ হারিয়েছি। লোভ মানুষের আত্মাকে বিষাক্ত করে তুলেছে - ঘৃণা দিয়ে পৃথিবীকে অবরুদ্ধ করেছে… আমরা বাড়িয়েছি গতি কিন্তু নিজেদের ঘরের ভিতর বন্দী রেখেছি। যন্ত্রপাতি প্রাচুর্য দিয়েছে, আমাদের ফেলে দিয়েছে চাহিদার আবর্তে, আমাদের জ্ঞান আমাদেরকে নিন্দুক করে তুলেছে… আমরা চিন্তা অনেক করি, কিন্তু অনুভব করি কম। যন্ত্র নয় আমাদের প্রয়োজন মানবতা - চালাকি নয়, দয়া আর নম্রতা দরকার আমাদের। এইসব গুণ ছাড়া জীবন হয়ে উঠবে ভয়ংকর এবং একসময় আমরা পরাজিত হবো… 

আজ এতদিন পরেও, এই বক্তৃতার একটি অংশও পুরনো হয়নি, ক্লিশে বা অর্থহীন হয়ে যায়নি । তবে বক্তৃতার শেষে যে আশার বাণী তিনি শোনালেন তাও কি আজকের পৃথিবীতে ফলবতী হয়েছে ?

   We are coming out of the darkness into the light ! We are coming into a new world… আমরা অন্ধকার থেকে আলোয় উদ্ভাসিত হচ্ছি! আমরা এক নতুন পৃথিবীতে আসছি… 

1 comments:

0

বইপোকার বইঘর - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in
বইপোকার বইঘর


নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ীর 'মন্দকথা'
অনিন্দিতা মণ্ডল


নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ীর লেখার আমি মুগ্ধ পাঠক। তাঁর উচ্চতার কোনও স্রস্টাকে পড়ে নিজের মতামত ব্যক্ত করা কঠিন কাজ। কারণ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মতের মধ্যে মুগ্ধতার অবশ্যম্ভাবী প্রভাব থেকে যায়। মন্দকথা তাঁর চিরাচরিত মহাকাব্য ও পুরাণের বিনির্মাণ জাতীয় লেখা নয়। এ বইতে তিনি হালকা চালে নিজের মনের কথা বলে গেছেন। শুরুতে আমার অন্তত সৈয়দ মুজতবা আলীকে মনে পড়ল। বৈদগ্ধ্যে জারিত আত্মকথা বা আড্ডা গোছের লেখায় তিনি অনুপম। মন্দকথা পড়তে পড়তে আমি আরও এক দার্শনিক ও ইন্টেলেকচুয়াল লেখককে পেলাম। হালকা কথার মধ্যেও কি সুন্দর তিনি বুনে দিয়েছেন জীবনের গূঢ় দর্শন! উদাহরণ দিতে গেলে পুরো বইটাই তুলে দিতে হয়। তবে ওঁকে অনুসরণ করে বোদলেয়ারের সেই অমোঘ উক্তিটি উদ্ধৃত করি। কিছু না করার চেয়ে খারাপ কিছু করে ফেলা ঢের ভালো। 
মানুষ চাইলেও তাঁর অধীত বিদ্যা তাঁর কর্মে পরিস্ফুট হবেই। বাইশটি ভিন্ন ভিন্ন রচনায় আদ্যন্ত খোশমেজাজী নৃসিংহপ্রসাদ অবশেষে বুনে দিয়েছেন তাঁর সেই জারিত দর্শন। লেখায় মহাভারত গীতা পুরাণ সংস্কৃত কাব্য, সব কিছু থেকেই চলে এসেছে উপমা। তুলনামূলক বিচারে পাঠক যাতে এই সময়ে দাঁড়িয়েও বুঝে নিতে পারেন ত্রিকালজয়ী সেই সব উচ্চারণ। এখনও কত বেশি প্রযোজ্য সেগুলি। 
যারা ভারী লেখা পড়তে ভালোবাসেন না, তারা বইটি পড়ে যেমন আনন্দ পাবেন, তেমন শিক্ষণীয় জীবনবোধও ফিরে পাবেন। নৃসিংহপ্রসাদ কিন্তু এই আড্ডায় চলিত শব্দ ও অপশব্দের বিপুল প্রয়োগ করেছেন। বইটি মাঝে মাঝেই পড়তে হবে আমায়। ঠিক যেমন পঞ্চতন্ত্র পড়ি।

0 comments:

0

প্রাচীনকথা - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in


প্রাচীনকথা


রাজোচিত
অনিন্দিতা মণ্ডল


পর্ব ৩
ভিক্ষু সোমদেব দেখছেন এক অপরূপ দর্শন যুবক। এত সুন্দর মানুষ হয়? দীপ্ত মধ্যাহ্নসূর্যের ন্যায় গাত্রবর্ণ। নীলনয়ন যেন সমুদ্র। মুখে কি সারল্য! অথচ নৃশংস প্রবৃত্তিপরায়ণ এই যুবক। ভালো করে দেখছেন ভিক্ষু। নাহ, এর মধ্যে লোভের প্রবৃত্তি তো নেই! বরং জগতের প্রতি এক প্রবল বিরাগে যেন সে এই ধ্বংসলীলা শুরু করেছে। যেন কিসের সন্ধানে ধরিত্রীর দেহ ছিঁড়েখুঁড়ে দেখতে চাইছে। অথচ সে বস্তুর সন্ধান পেলে সে শান্ত হয়ে যাবে। এমন হত্যালীলা আর সম্ভব হবেনা। আপাতত যুবক চাইলেন – “বলুন কি প্রয়োজনে এসেছেন? কোনও গোপন সংবাদ দিতে চান?” শত্রুসৈন্যকে গোপনে সংবাদ সরবরাহের দারুন পুরস্কার আছে। সোমদেব জানেন। ভিক্ষু কথার উত্তর না দিয়ে অভ্রভেদী দৃষ্টিতে দেখছেন যুবককে। ধীরে ধীরে কালের পর্দা অপসারিত হচ্ছে। তিনি দেখতে পাচ্ছেন এ যুবক ইন্দ্রস্থানের পশ্চিম সীমানা থেকেই চিরতরে ফিরে যাবে। এ পবিত্রভুমির অন্দরে প্রবেশ ঘটবেনা তার। শুধু তাই নয়। এই প্রস্থান তার জীবনসীমার অন্তিম সূচক। ভিক্ষু লক্ষ্য করেছেন যুবকের ভোগও একরকমের নিঃস্পৃহতায় আচ্ছন্ন। লালসা নয়, যেন বিরক্ত ভক্ষক। তিনি স্মিত হাস্যে বললেন – বিদেশী রাজা। আমি শুনেছি আপনি পণ্ডিত, মেধাবী। বহু দার্শনিক পণ্ডিতের কাছে বিদ্যাগ্রহণ করেছেন। মাত্র কিছুকাল আগে ইন্দ্রস্থানে এক মহামানব এসেছিলেন। তিনি অহিংসার বাণী প্রচার করেছেন। তাঁর দর্শনে প্রাচ্যভূমি প্লাবিত, মুগ্ধ। আমি তাই নিয়ে আপনার বিদ্বানসভায় আলোচনা করতে চাই। পারস্পরিক মতের আদানপ্রদানে দর্শনশাস্ত্র সমৃদ্ধ হয়। রাজপুত্র মৌন। ভিতরে ভিতরে হতাশ হয়ে পড়ছেন। কে এই ভিক্ষু? এখন কি তাঁকে প্রমাণ করতে হবে যে তাঁর দেশের দর্শন এদেশের চেয়ে বহুপরিমানে উন্নত? গ্রীকদর্শন হীন? ক্রোধ বাড়ছে। এই কয়েক বছরে বহু সাধু সন্ন্যাসীর সঙ্গে তাঁর আলাপ হয়েছে। তাঁদের কারুকে কারুকে তিনি ম্যাসিডোনিয়ায় নিয়ে যেতে চেয়েছেন। কেউ কেউ রাজীও হয়েছেন। এখন শিবিরে তাঁরাও আছেন। কিন্তু আজ যেন কি কারণে তিনি বিরক্ত হচ্ছেন। ক্রোধ জাগছে। তিনি শুনেছেন সৈন্যরা আর যুদ্ধে উৎসাহী নয়। অনুগত সৈন্যদল ছাড়া জয় অসম্ভব। আর আনুগত্যহীনতায় তিনিই কি কিছু অভ্যস্ত নাকি? ভিক্ষু তখনও বলে চলেছেন – আমাদের দর্শনে ক্ষমা ও করুণা সমস্ত হৃদয়বৃত্তির মধ্যে মহত্তম। রাজপুত্র স্পষ্টতই বিরক্ত, অন্যমনস্ক। ইশারায় একটি হাত তুললেন। আঁটসাঁট বর্মে শিরস্ত্রাণে ঢাকা দুটি রক্ষক ছুটে এলো। ইঙ্গিত স্পষ্ট। ভিক্ষু সোমদেব বুঝলেন। এরপর আর কথা বলা নিরর্থক। অভিবাদন করে সভা থেকে বিদায় নিলেন। তবু উপলব্ধি করলেন, রাজপুত্রের মহানুভবতা। ইচ্ছে করলে দণ্ডিত করতেই পারতেন। 

পবিত্র নদী বাণগঙ্গা ও মাঝির সঙ্গমস্থলে দাঁড়িয়ে প্রস্তরনির্মিত ত্রিগর্ত দুর্গ। চন্দ্রভাগা নদীর একটি শাখানদী এই বাণগঙ্গা। ত্রিগর্ত ও কাশ্মীর রাজের মধ্যে বাণগঙ্গার জলধারা নিয়ে কিছু অস্বস্তি আছে। রাজা পরমানন্দ চন্দ্র জানেন বন্যা হলে ত্রিগর্তর প্রজাদের ক্ষতি হয় বেশি। কাশ্মীররাজ অভিসার সাংঘাতিক কূটনীতি বোঝেন। তাঁর সীমান্ত রাজ্যটি বহিঃশত্রুর আক্রমণে যাতে পর্যুদস্ত না হয়, তাই চিরদিন তাদের সঙ্গে সন্ধি স্থাপন করে এসেছেন। এর ফলে ইন্দ্রস্থানের বাকি রাজাদের সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্ক থাকেনা বললেই চলে। কিন্তু রাজা পরমানন্দ প্রত্যক্ষ শত্রুতায় জড়িয়ে পরেননা। আলোচনার মাধ্যমে দুই দেশের সীমা ও নদীমধ্যে বাঁধ ও জলসংক্রান্ত সমস্যা মিটিয়ে নেবার চেষ্টা করেন। তাঁর দুর্গটি বহুকালের। কথিত আছে তাঁদের পূর্বপুরুষ মহাভারতের কালে এটি নির্মাণ করেছিলেন। সম্ভবত কুরু রাজ্যের সীমায় যাতে পতিত হতে না হয় সেই জন্য। মগধরাজ জরাসন্ধ তাঁদের সমর্থন করতেন। এরই ফলস্বরূপ গঙ্গাহৃদির গঙ্গাবংশীয়রা এবং নন্দবংশীয়রা ত্রিগর্তকে প্রচ্ছন্ন সমর্থন জুগিয়ে আসছে। অবশ্য রাজা পরমানন্দ চন্দ্র বীরপুরুষ। তিনি রাজ্যরক্ষাব্যাপারে কারো মুখাপেক্ষী নন।

এখন শরতের সকালে দুর্গের উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে মেয়েরা আল্পনা দিচ্ছে। আসন্ন অম্বাপূজা উপলক্ষে চারিদিকে সাজসাজ রব। কাটোচ বংশ অম্বার পূজক। বেদবাদী ব্রাহ্মণ্য আরাধনার ধারার সঙ্গে মাতৃপূজার ধারাটি কবে কি উপায়ে মিলিত হয়েছে তা এখন আর কেউ মনে করতে পারেননা। ঠিক যেমন বাণগঙ্গা আর মাঝির মিলনপ্রহর সকলের অজ্ঞাত। একটি উঁচু বেদীতে বসে আছেন রাজা। নীচে পর্বতের সানুদেশে এখনই বাতাস উষ্ণ হয়ে উঠেছে। কিন্তু এই সুউচ্চ দুর্গশিখরে বাতাস শীতল ও নির্মল। নীচে বর্ষার প্রবল জলোচ্ছ্বাসে নদীর গর্জন শোনা যায়। স্থানটি মনোরম ও দুর্গম। শত্রুসৈন্য এ দুর্গে পৌঁছনো কার্যত অসম্ভব। সব দিক চিন্তা করেও ত্রিগর্তরাজের কপালে চিন্তার ভাঁজ। উৎসব বা আবহাওয়া, কোনটিই তাঁকে স্বস্তি দিতে পারছেনা। একটু দূরে বড় বড় কাঠের দোলায় চিত্র আঁকছে চিত্রকর। বনফুলের গভীর রঙের প্রলেপ পড়ছে। সবুজ নীল লাল হলুদ রঙে অম্বার মূর্তি ফুল লতা পদ্ম শঙ্খের চিত্র আঁকা চলছে। শারদ উৎসবে রাজ্যের নানা প্রান্ত থেকে দেবী অম্বার মূর্তি দোলায় চড়ে আসবে দুর্গ প্রাঙ্গণে। একটি মাস ধরে মেলার মতন দুর্গ প্রাঙ্গন মেতে থাকবে পূজায়। উৎসব শেষে প্রতি প্রান্তের পূজিতা অম্বার বিগ্রহ দোলায় করে ফিরে যান আপন আপন মন্দিরে। রাজা পরমানন্দ আসন্ন উৎসবের আয়োজন দেখছেন বটে, কিন্তু জয়বর্মার প্রেরিত সংবাদ তাঁকে বিমনা করছে। সাভতির বেলুবন বিহার থেকে ভিক্ষু সোমদেব স্বয়ং যাত্রা করেছিলেন এক বিদেশীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন বলে। সাভতি পর্যন্ত সংবাদ পৌঁছেছে যে এক যবন রাজপুত্র নাকি ইন্দ্রস্থানের সীমায় এসেছে। এর আগেও আক্রমণ হয়েছে, কিন্তু এতদূর আসেনি কেউ। এই রাজপুত্র সিন্ধুর পারে এসে শিবির ফেলেছেন। ভিক্ষু সোমদেবের সঙ্গে জয়বর্মা দুটি গুপ্তচর প্রেরন করেছিলেন। ভিক্ষু সেই রাজাকে দেখে বিস্মিত হয়েছেন। রাজার সঙ্গে তাঁর সৈন্যদল ছাড়াও বহু জ্ঞানীগুনী পণ্ডিত এসেছেন। রাজা অবসরে তাঁদের সঙ্গে জ্ঞানবিজ্ঞান আলোচনা করেন। এরা নিজেদেরকে পৃথিবীর সবচেয়ে সভ্যজাতি বলে মনে করেন। আবার রাজা প্রবল ভোগাসক্ত। দুটি একসঙ্গে কিভাবে হয় তা ভিক্ষুর চিন্তার অতীত। গুপ্তচর দুটি এই অবসরে জেনে এসেছে, রাজার সৈন্যদল ভারী পটু। যেকোনো যুদ্ধ জয়ে তারা প্রানপাত করে। কিন্তু আপাতত তারা বিরক্ত। রাজা বড়ই নিষ্ঠুর। সৈন্যরা বহুকাল স্বদেশ ছাড়া। গৃহে ফেরার জন্য উন্মুখ। রাজা কম যুদ্ধ তো করলেন না। সুস্থিত হয়ে প্রজাপালনে মন দেবেন এ সুযোগ তিনিও তো এতদিনে পেলেন না। শত্রুরাজ্যের বন্দীদের ওপরে অকারণে ভীষণ হয়ে ওঠেন। এবং সর্বোপরি নিজের সৈন্যদের সুবিধের দিকে তাঁর নজর নেই এতটুকু। এইটুকু সংবাদেই গুপ্তচররা আশার আলো দেখছে। শত্রুর সঙ্গে সমরে তাঁর কোনও সমস্যা নেই, কিন্তু উৎসবের সময়ে এই যুদ্ধবিগ্রহ তাঁর বিরক্তির কারণ হয়েছে।

রাজা পরমানন্দ চন্দ্র যদিও পঞ্চাশটি বছর অতিক্রম করেছেন, তবু তিনি বৃদ্ধ নন। পার্বত্য শরীরে বয়সের চিহ্ন আসতে চায়না। তার ওপরে তিনি শক্তিশালী পুরুষ। এখন অদূরে তাঁর প্রিয়তমা কন্যাটি আলপনায় ব্যাস্ত। সে একটি বিরাট পদ্ম চিত্রিত করছে। পিতাকে অন্যমনস্ক দেখে সে ডাকল – পিতা সহস্রদল কেমন হয়েছে? পিতা কন্যার মাথায় হাত রাখলেন। তারপর মধুর হাস্যে বললেন – সুন্দর হয়েছে মা। তবে যে হাতে চিত্র এঁকেছ সেই হাতে কি অস্ত্র চালনা করতে পারবে? দেবী অম্বার মতন? রাজকন্যা অম্বিকার মুখে হাস্যোজ্জ্বল দীপ্তি – পিতা আমি অস্ত্র ধরতে জানি। প্রয়োজনে দেবী অম্বাকে স্মরণ করব। কিন্তু এখন কি যুদ্ধ পিতা? পিতা হাসলেন। অর্বাচীন। পুত্রী বিবাহযোগ্যা। নিঃশঙ্ক কন্যার একটি উপযুক্ত পাণিগ্রহীতা চাই।

সোপানে কার পদশব্দ। রাজা তাকালেন। বহু মানুষের কোলাহলে প্রাঙ্গন মুখর। তার মধ্য দিয়েও তিনি পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছেন। উঠে আসছেন জ্যেষ্ঠ পুত্র যুবরাজ দ্বিতীয় পরমানন্দ। বড় আদরের। বড় নির্ভরের। পুত্র অসামান্য বীর। কিন্তু একটিই চিন্তা। তিনি অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা করেন কম। তবুও মহারাজ জানেন পুত্র পরমা তাঁকে কোনও যুদ্ধে হারতে দেবেননা। পুত্র এখন সংবাদ এনেছেন যবনরাজ উন্মুখ হয়েছেন আক্রমণের জন্য। কিন্তু তার স্বদেশীয় পণ্ডিত তাঁকে বাঁধা দিচ্ছেন। এ দেশের সব কিছুই তাঁদের চোখে অদ্ভুত ঠেকছে। সবিশেষ না জেনে না বুঝে অগ্রসর হতে বারণ করছেন। কিন্তু রাজপুত্র পরমার বিশ্বাস এই যবনরাজা কারোর বারণ শুনবেন না। ভিক্ষু সোমদেব এমনই বলে গিয়েছেন। শুধু তাই নয়, ভিক্ষু বলে গিয়েছেন, যুদ্ধে এ নিরস্ত হবেনা ঠিকই, কিন্তু পরাজিত হবে। নতমস্তকে চলে যেতে হবে। আর হয়ত পৃথিবী শাসন তার দ্বারা হয়ে উঠবেনা। তবে এ যুদ্ধে ত্রিগর্তর একটি বড় হানি তিনি উপলব্ধি করেছেন। সেটি কি তিনি তা বলেননি। শ্রমণ ভিক্ষুদের এমন অলৌকিক শক্তি আছে তা ইন্দ্রস্থানের বাসিন্দারা জানেন। এঁরা যোগবলে এমন ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারেন।

সন্ধ্যায় প্রাকারের নিভৃত প্রকোষ্ঠে মন্ত্রনায় বসেছেন রাজা সেনাপতি মন্ত্রীগণ ও যুবরাজ। ত্রিগর্ত মেতে আছে উৎসবের প্রস্তুতিতে। সবে বর্ষা গিয়েছে। নদী বিপুলা। পথঘাট পিচ্ছল। অশ্ব ও হস্তীর পক্ষে প্রতিকুল না হলেও রথ ও পদাতিক সৈন্যদের কাছে এই বিজাতীয় ভূমি নিরাপদ নয়। এই গ্রীক রাজা নাকি নানা প্রকার ব্যুহ রচনায় পারদর্শী। অপরাজেয়। কিন্তু সে কি চক্রব্যুহ রচনা করতে জানে? বৃত্তাকার চলনে একটির পর একটি ঘূর্ণনে তৈরি ব্যুহ। সে চক্রে প্রবেশ করলে মৃত্যু নিশ্চিত। তারপর আছে রণহস্তী। হস্তীর আক্রমণের উত্তর দিতে পারা এদের পক্ষে অসম্ভব। এমন বিপুলকায় পশু এরা দেখেনি। গঙ্গাবংশীয় রাজকন্যা পরমানন্দর গৃহে রাজ্ঞী। তিনি জানেন, রণহস্তীর অপ্রতুলতা ঘটবেনা। একটু ধৈর্য ধরে এগোলে যুদ্ধে জয় নিশ্চিত। 

রাজা আদেশ দিলেন। দুর্গ যেমন মেতে আছে, থাক। সৈন্য সাজানো হোক। রণভেরির দামামা শুনলেই তিনি রওনা হবেন। চন্দ্রভাগার উত্তর গতিতে ষাটক্রোশ দূরে যে বিস্তীর্ণ, প্রায় সমতল চারণভূমি আছে, যুবরাজ সেখানে সৈন্য নিয়ে যান। কারণ, পার্বত্য ভূমিতে সুবিধা করতে না পারলে গ্রীক সৈন্য চন্দ্রভাগার পশ্চিমতীর ধরে উত্তরে যাবে। সেখানে যুবরাজ থাকবেন।

0 comments:

0

প্রাচীনকথা - ঋতুপর্ণা চক্রবর্তী

Posted in

প্রাচীনকথা


মিথ-কথন
ঋতুপর্ণা চক্রবর্তী



গ্রীক পুরাণের বিভিন্ন গল্পে নানা জনপ্রিয় এবং তুলনামূলক কম জনপ্রিয় কিছু চরিত্র বারবার উঠে এসেছে। এই গল্পগুলি জানার জন্য এই চরিত্রগুলির সম্পর্কে একটু ধারণা থাকা দরকারী। আগামী কিছু পর্বে আমরা গ্রীক পুরাণ নিয়ে কথা বলব। এখানে মূলতঃ পুরাণের বিভিন্ন চরিত্রের পরিচয় এবং তাঁদের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে একটু আলোচনা করা হল।



পর্ব 8 – আদি দেবদেবীরা এবং আন্ডারওয়ার্ল্ড



আমরা টাইট্যানদের নিয়ে আলোচনা শুরু করেছিলাম সবার আগে। তারও আগে ছিলেন আদি দেবদেবী বা প্রাইমরডিয়াল ডেইটিরা (Primordial Deity)। এই আদি দেবদেবীরা ছিলেন;ইথার, অ্যানাকে, ক্যাওস, ইরেবাস, ইরস, গায়া, হেমেরা, নিক্স, ফ্যানেস, পন্টোস, টারটারাস, থ্যালাসা, ইউরেনাস। এঁদের মধ্যে গায়া, টারটারাস, ইউরেনাস এঁদের নিয়ে আলোচনা হয়েছে আগেই। বাকিদের নিয়েও এবার স্বল্পকথায় কিছু আলোচনা করে নিচ্ছি।



ক্যাওস (Chaos) - গ্রীক মিথ অনুযায়ী ক্যাওস হল প্রথম বস্তু যা সৃষ্টি হয়েছিল। ক্যাওস আসলে কিছুই না, খানিকটা অদেখা হাওয়া বা অজানা কুয়াশা। গ্রীক শব্দ ক্যাওসের অর্থ স্বর্গ এবং পৃথিবীর মধ্যেকার ফাঁক বা শূন্যতা। ক্যাওসকে প্রথম সৃষ্টি হিসাবে ধরে নিলে গ্রীকদের সবথেকে আদি দেবতা বা দেবী বলে ধরে নেওয়া হয়। এরকমই আরো কিছু আদি দেবদেবী এঁর পরপরই সৃষ্টি হয়েছিল।



থিসিস (Thesis) - এঁর উল্লেখ গ্রীক মিথে বেশ কম আছে, তবে এঁর কথা লিখতেই হবে, কারণ আদি দেবদেবীর লিস্টে এঁর উল্লেখ না থাকলেও ইনি সৃষ্টির দেবী। এঁর সঙ্গী ছিলেন হাইড্রোস (Hydros) বা জল। এই দেবী হলেন, আদি দেবী অ্যানাকের মা। আমরা না ভেবেই বলে দিই, অমুক থিসিস লিখছেন বা পিএইচডি করছেন। এই থিসিস কথাটা কিন্তু এখান থেকেই এসেছে। মানে কিছু সৃষ্টি করা। থিসিস সবসময় মৌলিক কিছু সৃষ্টি করে, কাজেই এঁকে বাদ দেওয়া একেবারেই সম্ভব নয়। একটি মিথ অনুযায়ী ইনি ক্রোনোস (Chronus) বা সময়ের মা। অর্থাৎ এই মিথে গায়াকে ক্রোনোসের মা বলে স্বীকার করা হয়নি।



এর পরের জনের কথা বলার আগে গ্রীক মিথ অনুযায়ী সৃষ্টির সম্পর্কে একটু বলে নেওয়া প্রয়োজন। গ্রীকরা মনে করতেন প্রথমে একটা বিশাল ডিম (Orphic Egg or Cosmic Egg) ছিল। সেই ডিমটা দুজন সাপ জড়িয়ে ছিল। সাপেরা নিজেদের প্যাঁচ খুলতেই ডিমটা ফেটে যায়। সেখান থেকে সৃষ্টি শুরু হয়। এবার এই থিয়োরি মাথায় রেখে পরের কয়েকজন দেবদেবীর কথা আসছে।



অ্যানাকে (Anake) - থিসিসের সন্তান বলা হয় এই দেবীকে। এই আদিদেবী হলেন প্রয়োজনীয়তার (Necessity) দেবী। এক মিথ অনুসারে ক্রোনোসের প্রথম সঙ্গিনী (যদি ক্রোনোসকে থিসিসের সন্তান হিসাবে ধরে নেওয়া হয়)। মিথানুসারে, এই কসমিক ডিমকে অ্যানাকে আর ক্রোনোস প্রকান্ড সর্পের আকারে জড়িয়ে ছিলেন। তাঁরা প্যাঁচ খুলতেই ডিম ফুটে ফ্যানেস (Phanes) বেরিয়ে আসেন। ফ্যানেস হলেন প্রাণ। ফ্যানেসকে সবথেকে আদিপুরুষ হিসাবে ধরা হয়। কারণ ফ্যানেস প্রথম নারীপুরুষের সঙ্গমের ফলে নতুন প্রাণ সন্তান সৃষ্টি করার ধারণা নিয়ে আসেন। তার আগে সবাই আবির্ভুত হত সম্ভবত। একটি মতে ফ্যানেসের স্ত্রী হলেন নিক্স।



নিক্স (Nyx) হলেন রাত্রির আদিদেবী। নিক্সের জন্ম সম্পর্কেও কিছু সেরকম জানা যায় না। মনে করা হয় ইনিও সৃষ্টির পরেপরেই আবির্ভুতা হন। গ্রীকমহাকবি হেসিওডের মিথ অনুসারে নিক্স ক্যাওস থেকেই আবির্ভুতা হয়েছেন। আর প্রায় তাঁর সাথেই এসেছেন ইরেবাস (Erebus) বা অন্ধকার। নিক্স এবং ইরেবাসের সন্তান হলেন ইথার (Aether) বা আলো এবং হেমেরা (Hemera) বা দিবস। এঁরা টারটারাসে থাকেন। মা আর মেয়ের বনে না খুব একটা। তাই নিক্স এলেই হেমেরা পৃথিবীতে চলে যান, এবং হেমেরা ফিরলেই নিক্স চলে যান। এইভাবেই দিনরাত্রি চলতে থাকে। নিক্সের আরো কিছু বিখ্যাত সন্তানদের কথায় একটু পরে আসছি।



হেমেরা বা দিবসের সঙ্গী হলেন তাঁরই ভাই ইথার বা আলো। এঁদের সন্তান হলেন থ্যালাসা (Thalassa)। থ্যালাসা হলেন সমুদ্রের আদি দেবী। একেবারে প্রথম পর্বে পন্টোসের (Pontus)কথা বলা হয়েছিল। পন্টোস বা সমুদ্র হলেন গায়ার সন্তান? সেই পন্টোস হলেন থ্যালাসার সঙ্গী। এঁরা দুজনে মিলে মাছ, সামুদ্রিক ঝড়ের জন্ম দিয়েছিলেন। একটি মিথ অনুসারে এঁরা অ্যাফ্রোদিতির মা এবং বাবাও।



এরস (Eros) হলেন আরেকজন আদি দেবতা। ইনি বংশবৃদ্ধির বা যৌনতারও আদিদেব। অনেক মিথে এঁকে এফ্রোদিতির সন্তান হিসাবে মনে করা হয়। ইনিই যৌনতার দেবতা বা কিউপিড (Cupid)। এঁকে অনেকসময় ফ্যানেসের সাথে এক করেও দেখা হয়।



গায়া, ইউরেনাস, টারটারাসের মত এঁরাও এক একটা আদিম জায়গা বা শক্তির প্রতীক। এঁদের স্থান দখল করে টাইট্যানরা। তারপর অলিম্পাসের দেবতারা। কিন্তু আরো অনেক দেবদেবী আছেন, যারা অলিম্পাসের প্রধান বারোর মত বিখ্যাত না হলেও প্রচুর খ্যাতি ছিল এবং প্রচুর মান্যতা পেতেন। সবাই যে অলিম্পাসে থাকতেন তাও নয়। বিভিন্ন স্থানে থাকতেন। তাঁদের কথাও আলোচনা করছি।



অলিম্পাসের প্রধান বারোর পরেই যার কথা বলতে হবে, তিনি হলেন হেডিস। হেডিস হলেন আন্ডারওয়ার্ল্ড বা পাতালের দেবতা। ইনি মৃতমানুষের পাপপুণ্যের হিসাব করেন, খানিকটা আমাদের যমরাজের মত। পাপীদের শাস্তি দেওয়াও এঁর কাজ। এছাড়াও হেডিস উর্বর জমির দেবতা, এর সাথে জমি খনন করে পাওয়া যেকোনো গুপ্তধন বা খনিতে পাওয়া ধাতু বা অধাতুর দেবতাও ইনি। ক্রোনোস এবং রিয়ার সবথেকে বড় পুত্রসন্তান।



এই পাতাল বা আন্ডারওয়ার্ল্ড যায়গাটা তো ছোট নয়, এটা বেশ কিছু ভাগে বিভক্ত। এর মধ্যে ইরেবাস বা অন্ধকার আছে বেশ কিছুটা অঞ্চলে। সেখানে নিক্স আর ইরেবাসের বেশ কিছু দেবদেবী সন্তানরা থাকেন। তাঁদের কথায় পরে আসছি। এছাড়া আছে স্টিক্স নদী। পৃথিবী ও পাতালের মধ্যে সীমানা নির্দেশ করে স্টিক্স (Styx)। আমাদের বৈতরণীর মত, স্টিক্স পার করলেই মৃত্যুর রাজত্ব শুরু হয়। মনে করা হয় স্টিক্স একজন নদী এবং দেবীও। অসীম শক্তিশালী এই দেবী টাইট্যানযুদ্ধের সময়ে জিউসের পক্ষে যুদ্ধ করেছিলেন। প্রসন্ন হয়ে জিউস বর দেন স্টিক্সের নামে শপথ করলে সেই শপথ পালন করতেই হবে। আমরা যেমন কথায় কথায় মা কালীর দিব্যি বলি আর তারপর ভুলে যাই, ব্যাপারটা তত সরল মোটেই নয়। উদাহরণ স্বরূপ, ডায়নিউসের মানবী মাতা সিমিলিকে জিউস স্টিক্সের নামে শপথ করতে বাধ্য হয়েছিলেন যে তিনি সত্যিই দেবতাদের রাজা জিউস, পরিণামে তাঁকে স্বরূপ দেখাতেই হয় এবং সিমিলি মারা যান। এছাড়াও স্টিক্সের জলে অবগাহন করলে সে অপরাজিত হয়। কথিত আছে গ্রীক হিরো আকিলিসের (Achilles) মা থেটিস (Thetis) স্টিক্সের জলে খোকাকে একবার চুবিয়ে নিয়েছিলেন। তাই আকিলিস প্রায় অপরাজিত ছিলেন। একমাত্র তাঁর গোড়ালি ছাড়া। সেখানটাই একমাত্র দুর্বল ছিল কারণ থেটিস ওই জায়গাটাই ধরে ছিলেন। এছাড়াও আছে এক আশ্চর্য যায়গা যার নাম এলাইসিয়াম (Elysium) বা এলাইসিয়ান মাঠ। খানিকটা আমাদের তেপান্তরের মাঠের মত হলেও আসলে এই যায়গা হল ওদের স্বর্গ। কারন যতই পুণ্যাত্মা হও না কেন শরীরে দেবদেবীর রক্ত না থাকলে বা ডাক না পেলে অলিম্পাসে যাওয়া যায় না। এদিকে যারা জীবনে কোনো পাপ করেননি, ডেমিগড বা হিরোর আত্মীয়স্বজনরা তো আর দুষ্টুলোকের মত নরকের কড়াইতে ভাজা হতে পারেন না, তাই তাঁদের জন্য এলাইসিয়াম। সেখানে এঁরা সবাই আনন্দময় জীবন কাটান, যা চান তাই পান এবং যে কাজ করে সবথেকে বেশি আনন্দ পেয়েছেন, সেই কাজই জীবিকা হিসাবে পান। এছাড়া টাইট্যান এবং রাক্ষসজাতীয়রা পরাজিত হলে টারটারাসে বন্দী থাকেন; সে কথা আগেই বলেছি। আদতে পাতাল হলেও আন্ডারওয়ার্ল্ড যায়গাটায় অনেকগুলো বিভাগ আছে, তাই আমরা এর পর থেকে ওই যায়গাকে আন্ডারওয়ার্ল্ডই বলব, পাতাল নয়।



এ হেন আন্ডারওয়ার্ল্ডের রাজা হওয়ার পর হেডিসের খুব বিয়ে করতে ইচ্ছে হল। সে জিউসকে ধরে বলল, ভাই তোমার একটা সুন্দরী মেয়ে আমায় দাও, বিয়ে করব। জিউস তাঁর আর ডিমিটারের সন্তান পার্সিফোনিকে (Persephone) বিয়ে করতে বললেন। হেডিস বুদ্ধিমান, তিনি বুঝলেন, শ্বাশুড়ী কোনোমতেই মত দেবেন না। হাজার হোক তাঁর নিজের বোন ডিমিটার,তাঁকে তিনি হাড়ে হাড়ে চেনেন। তাই তিনি কোনো ঝুঁকি না নিয়ে পার্সিফোনিকে হরণ করে নিয়ে সোজা তাঁর প্রাসাদে চলে যান। এদিকে ডিমিটার তো মেয়েকে খুঁজে খুঁজে পাগলপারা। রাগের চোটে তিনি পৃথিবীর উপরে দারুণ এক অভিশাপ দিলেন। যতদিন তাঁর মেয়েকে পাওয়া না যাবে ততদিন কোনোপ্রকার ফসল ফলবে না। এরফলে মানবজাতি প্রায় নিশ্চিহ্ন হতে বসেছিল। শেষে জিউস বাধ্য হয়ে হেডিসকে বলেন পার্সিফোনিকে প্রত্যার্পণ করতে। হেডিস সেটা করতে বাধ্য হয়েছিলেন, তবে ততদিনে পার্সিফোনি আবিষ্কার করেছেন পাতালে ফাটাফাটি রকমের ভালো বেদানা পাওয়া যায়। তাই তিনি বছরে কিছুদিনের জন্য পাতালে চলে যান। এই সময়ে ডিমিটরের মেজাজ খারাপ থাকে তাই পৃথিবীতে কিছুই ফলে না, শীতকাল চলে।



পার্সিফোনি পাতালের রানী হওয়া ছাড়াও ফলের দেবী। এছাড়াও শীতে পাতালে থেকে তিনি বসন্তকাল নিয়ে আবার ফিরে আসেন, এবং বসন্তে নানারকম ফল ফলে বলে তাঁকে বসন্তকালের দেবীও বলা হয়।



দেবী হেকেটির (Hecate) কথা এখানে বলতেই হবে। ডিমিটারের সাথে হেকেটিও পার্সিফোনিকে জোড়ামশাল হাতে চারদিকে খুঁজে বেরিয়েছেন। হেকেটি হলেন যাদু, কালা-যাদু, রাত, চাঁদ ( গা ছমছমে অর্থে) ভুত এবং ন্যাক্রোম্যান্সির (Necromancy) দেবী। আপনিও নিশ্চয়ই আমার মতই ভাবছেন ন্যাক্রোম্যান্সিটা কি বস্তু? সোজা করে বলতে গেলে মৃত মানুষের সাথে কথা বলা। প্ল্যানচেটের মিডিয়াম হয় না? সেটাই। ইনিও পাতালেই থাকেন। এঁর প্রতীক হল জোড়ামশাল, ছুরি, কুকুর, সাপ ইত্যাদি। হেকেটির নাকি তিনমাথা। তবে রবীন্দ্রনাথ কি কারণে কাদম্বরী দেবীকে হেকেটি বলে ডাকতেন, আমি বুঝিনি।



কথায় কথায় যখন আন্ডারওয়ার্ল্ডের কথা উঠেই গেলো তখন আরো কিছু দেবদেবীর কথা এসে পরে সাথে সাথেই। এঁদের বেশিরভাগই নিক্স আর ইরেবাসের সন্তান। আন্ডারওয়ার্ল্ডের অন্তর্গত ইরেবাস নামক চির অন্ধকারের দেশে এঁরা থাকেন।নিক্স এবং ইরেবাসের সন্তানদের মধ্যে প্রথমেই আসেন হিপনোস (Hypnos)। ইনি ঘুমের দেবতা। ইরেবাস এক বিরাট অন্ধকার গুহা, সেই গুহা থেকে লিথি (Lethe) নদী বয়ে চলেছে। এই নদীর বৈশিষ্ট্য হল এখানে একবার ডুব দিলে বা ডুবে গেলে স্মৃতি পুরোপুরি চলে যায়। আর সেই গুহাতেই দিন আর রাত এসে মেলে, আর এখানেই হিপনোস থাকেন। ইনি মানুষদের গভীরভাবে ঘুম পাড়ান। আর ঘুমোনোর সময়ে মানবজীবনের সেই অর্ধ তাঁর প্রাপ্য হয়।  



থ্যানাটোস (Thanatos) হলেন হিপনোসের জমজ ভ্রাতা। ইনিও ওই বিরাট গুহাতে থাকেন, ইনি মৃত্যুর দেবতা। আমাদের সকলের কাম্য যে মৃত্যু, মানে তাড়াতাড়ি আসবে, রোগে দীর্ঘকাল ভোগাবে না, টপ করে মারা যাব, সেই মৃত্যুর দেবতা ইনি। গ্রীক মিথোলজিতে এঁর উল্লেখ অনেকবার থাকলেও, দেবতা হিসাবে প্রকাশ খুবই কম। মানুষ তো বটেই দেবতারা অমর হলেও এঁকে অপছন্দ করেন। কারণ তাঁর হৃদয় নাকি লোহার, আর আত্মা দস্তার (Bronze)। তাঁর মায়ামমতা কিছুই নেই। হিপিনোস তাঁর সব গল্পেই দয়াবান হয়ে দেখা দিয়েছেন,সেই তুলনায় থ্যানাটোসকে সবাই ভয় পান। থ্যানাটোসকে একা দেখা যায়না , বেশিরভাগ ছবিতেই তিনি যমজভাই হিপনোসের সাথেই আছেন। গভীর ঘুমই মৃত্যুর দ্যোতক এই ধারণা থেকে হয়তো এই ছবিগুলির জন্ম।



হিপনোসের অনেক সন্তান, প্রায় এক হাজার। তাঁদের নাম অনেইরাই (Oneiroi বহুবচনে, একবচনে অনেইরাস)। এঁরা হলেন নানা স্বপ্নের উপদেবতা। এঁদের মধ্যে যে দলপতি তিনি হলেন মরফিয়াস(Morpheus)। মরফিয়াস স্বপ্নের প্রধান দেবতা। ইনিই নাকি রাজাদের স্বপ্নে আসতেন দেবতাদের নির্দেশ নিয়ে। অনেইরাইদের মধ্যে কিছু নাকি সত্যি দেবতাদের নির্দেশ বহন করে সাধারণ মানুষদের স্বপ্নে আসেন, বাকিরা মিথ্যে মিথ্যে। অনেইরাই আসার জন্য নাকি দুটো দরজা আছে। প্রথমটা শিঙের (Horns) তৈরি, সেখান দিয়ে এলে দেবতাদের নির্দেশ বা সত্যি হওয়ার স্বপ্ন। আর অপরটি হাতির দাঁতের তৈরি, সেখান দিয়ে এলে সেই স্বপ্ন একদম মিথ্যে, বা কখনো পুর্ণ হবে না এমন স্বপ্ন; তবে কারোর উপর অনেইরাই রেগে গেলে তখন তাঁরা মেলাস অনেইরাস (melas oneiros) হয়ে যান, অর্থাৎ কালো স্বপ্ন বা দুঃস্বপ্ন।



আরেকজন দেবতা আছেন যিনি নিক্স আর এরেবাসের পুত্র। পৃথিবীতে এখন তাঁর বড়ই রমরমা। ইনি হলেন মোমাস (Momus)। চিনতে পারলেন না তো? একদিকে এত রমরমা আর অন্যদিকে চেনা যাচ্ছে না? ইনি হলেন স্যাটায়ার আর ঠাট্টার দেবতা, নির্দোষ ইয়ার্কি না কিন্তু, দস্তুর মত অন্যকে ছোট করার জন্য যে ঠাট্টামস্করা চলে তাই; আজকাল ডার্কমিম নামে যা বিখ্যাত সেটাই। মোমাসের ছবিটি কিন্তু এখনো আমরা প্রায়ই দেখতে পাই। কোথায়? এক প্যাকেট তাসে যে জোকারটি থাকে সেটিই আদতে মোমাস। তাঁর হিসেবমত পৃথিবীতে এমন কেউ নেই যাকে নিয়ে ঠাট্টা করা যাবে না। শুধুমাত্র অ্যাফ্রোদিতি বাদে। তিনিই নাকি একমাত্র যিনি সমস্ত রকম ঠাট্টামষ্করার ঊর্ধে। ইনি এছাড়াও দোষারোপ (Blame) করার দেবতা। ঝাল ঝাল ব্যঙ্গাত্মক কথা শোনানোর জন্য অলিম্পাস পর্বত থেকে জিউসের দ্বারা নির্বাসিত হয়ে আন্ডারওয়ার্ল্ডে থাকেন। আর এঁর যমজ বোন হলেন ওইজিস(Oizys) , তিনি দুঃখ, কষ্ট, উদ্বেগ এবং বিষন্নতার দেবী।



নেমেসিস (Nemesis) - ফসিলসের সেই বিখ্যাত গান আমরা প্রায় সবাই জানি, “আর তোর হয়তো জানা নেই, দৃষ্টান্ত আছে সামনেই, একদম শেষে হানা দেয় নেমেসিস”; এবার প্রশ্ন হলএই নেমেসিস আদতে কি? বিপর্যয়, শাস্তি, খারাপ কাজ এবং অন্যায়ভাবে লাভ করা সৌভাগ্যের দেবী। শেষ কথাটির মানে হল, ধরুন, আপনি প্রচন্ড নচ্ছার টাইপের স্বার্থপর লোক,নিজের বৃদ্ধা পিসির দিকে তাকিয়েও দেখেননি একবারও, কিন্তু পিসি মারা যেতে তার সব সম্পত্তি আপনি পেলেন। এই যে আপনি অন্যায়ভাবে পিসতুতো সম্পত্তির মালিক হলেন, এই সৌভাগ্য আসলে নেমেসিসের দপ্তর। এছাড়া প্রেমের ক্ষেত্রেও এঁর অবাধ আনাগোনা। যে প্রেমিক বা প্রেমিকাকে আপনি একদম ভাগিয়ে দিলেন, একটুও পাত্তা দিলেন না, হয়তো সেএকদম রোগা বলে বা পয়সাকড়ি নেই বলে, বছর পাঁচেক পর তাকে গুবদুগাবদু বাচ্চাসহ শপিংমলের দামী দোকানে কেনাকাটা করতে দেখা হলে যে মনস্তাপ হয় আপনার, সেই মনস্তাপ এই দেবীই সৃষ্টি করেন। প্রতিশোধ এবং শাস্তিও এই দেবীর আনুকুল্যেই সফলতা পায়।



টাইকি (Tyche or Tykhe) – শুনতে নাইকির মত হলেও আদতে নেমেসিসের সাথে অঙ্গাঙ্গী জড়িয়ে আছেন এই দেবী। সত্যি বলতে কি নেমেসিসকে টাইকির অবনমিত রূপ বলা হয়েছে অনেক ক্ষেত্রেই। যদিও জনপ্রিয়তার দিক থেকে টাইকির থেকে নেমেসিস অনেক বেশী উল্লেখযোগ্য। ইনি সৌভাগ্য, সাফল্য এবং স্বাচ্ছন্দ্যের দেবী। এই সৌভাগ্যই অন্যায় ভাবে লাভ করলে নেমেসিস তার দেবী, কিন্তু ভালোভাবে অর্জন করলে টাইকি হবেন দেবী। বিভিন্ন গ্রীক মৃৎপাত্রে আঁকা ছবিতে নেমেসিস আর টাইকিকে একসাথে আঁকা হয়েছে। এই দেবী দুই টাইট্যান ওশেনাস আর টেথিসের সন্তান।



আদিদেবতা আর আন্ডারওয়ার্ল্ডে থাকা দেবদেবীদের লিস্টি এখানেই শেষ। আরো অনেকেই আন্ডারওয়ার্ল্ডে থাকেন, তবে একটু বেশীই উল্লেখযোগ্য এঁরা। পরবর্তী পর্বে আরো এরকম কিছু দেবদেবী নিয়ে আলোচনা হবে, যারা অলিম্পাসের প্রধান বারো নন, কিন্তু প্রায়ই উল্লেখিত হয়েছেন বিভিন্ন মিথে।

0 comments:

0

কৈশোরনামা - অনসূয়া

Posted in


কৈশোরনামা


প্রিন্সেস
অনসূয়া

সেদিন ছুটির দিন ছিল।তাই এসপ্ল্যানেড গেছিলাম কিছু জিনিষ কিনতে। রাস্তার পাশে ফুটপাথের ওপর কত্ত কি বিক্রি হচ্ছে। পাপোশ, ব্যাগ, কানের দুল, রুমাল, পাজামা, জুতো, চুড়ি, ছোট্ট টেবিল, গামছা থেকে শুরু করে নাকের নথ অবধি কি নেই। সেসবই দেখতে দেখতে হাঁটছিলাম। দেখি এক দাদু বসে আছে এক নিরিবিলি কোনায়। সেখানে লোকের ভীড় নেই।সারি সারি গাড়ি দাঁড়ানো। তাদেরই এক কোণে দাদু বসে বসে চাবি দিচ্ছে আর গামলার জলে ঘুরে বেড়াচ্ছে ছোট্ট স্পীড বোট। সাদার উপর নীল বর্ডার। মাথার উপর সোনালী অক্ষরে ছোট্ট করে লেখা, প্রিন্সেস। তীর বেগে জল কেটে গোল গোল ঘুরপাক খাচ্ছে। দেখেই আমার মনে পড়ে গেল, রামসায়রের মাঠে কালিপুজোয় কেমন মেলা বসতো। জিলিপি, মোমো, এগরোল চিনিকাঠি, রেউড়ি আরও কত খাবারের দোকান। থরে থরে গজা, খাজা, জিলিপি, মালপোয়া সাজানো থাকতো।আমি পেটু বলে খাবারের দোকানেই আগে নজর যেত। তারপর গয়নার দোকান, খেলনার দোকান, কাঁচের বাসন, কাঠের জিনিশ, মাটির পুতুল কত কি থাকতো।এরকম একটা নৌকা দেখেছিলাম। সেটার চাকা ছিল। চাবি দিলে মাটির ওপরই সাঁই সাঁই করে দৌড়তো। কিন্তু এই দাদুর কাছের বোট একেবারে আসলের মতো। এমন সত্যিকারের বোট দেখেছিলাম, সেবার গঙ্গার পারে। কি এক নেভি অফিসারের পরিবার আসাতে তাদের জন্য নিরাপত্তা আর এমন এক বোটের ব্যবস্থা হয়েছিল। এই ছোট্ট বোটটা হুবহু সেরকম।
আমায় হাঁ করে থাকতে দেখে দাদু ফিচিক করে পানের পিক ফেললো প্রথমে। তারপর আরেকটা পান মুখে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, নিবে নাকি মামনি? ঘোর কাটা চোখে বললাম, না পয়সা নেই। বোটটা তখনও বোঁঁ ও ও ও করে ঘুরে চলেছে। ফিচ ফিচ করে হেসে উঠলো দাদুটা। বেজায় ফিচেল হাসি। বলে, ন্যাহ ট্যাকা নেই। ষোল টাকার রোল খেয়েছ পাশের গলিতে। পকেটে এখনও পাঁচশোর তিনটে নোট কড়কড় করছে। একটা পঞ্চাশও আছে। মা দিদির জন্য ব্যাগ কিনতে বলেছে। নিজে কিনবে বটুয়া। বলে আবার, পয়সা নেই।
কথা শুনে আঁতকে উঠলাম। বলে কি? কি করে জানলো? গুণীন টুনীন নয়তো, কি মেয়ে ধরা? মা বলেছিল, যেখানে সেখানে যাওয়া মেয়েদের ঠিক না। শুনিনি। বোধহয় ধরে নিয়ে মেয়েদের মাথা মুড়ে চুল বিক্রি করে ষ্টেশনের পাশের ঝুপড়িতে ফেলে রাখে। আর ট্রেনে ট্রেনে গান গাইতে হয় হারমোনিয়াম বাজিয়ে। আর বাকি সময়ে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখে। কিচ্ছু বলার যো নেই কাউকে। ভাবতেই গা শিউড়ে উঠলো। সেটাও টের পেয়ে গেল নাকি দাদুটা। বলল, ভয়ের কিছু নেই। রুস্তমের সাথে থেকে থেকে এসব বলা টলা অভ্যাস হয়ে গেছে। এই বোট একটাই আছে। নেবে নাকি? দশ টাকা।
রুস্তম কে? জ্যোতিষ টোতিষ নাকি? বাবা এসবের ঘোর বিরোধি। মা লুকিয়ে মন্দিরের বাবাজীর কাছে যায়, আমার কবে আক্কেল হবে জানতে। বাবাজীর বিশাল কাঁচাপাকা দাঁড়ি। শক্ত কাঠ কাঠ। দেখলেই গাল কুটকুট করে। ইয়া বড়ো সিঁদুরের টিপ আঁকা কপালে।গলায় বিশ পঁচিশটা রুদ্রাক্ষের মালা। লাল লাল চোখ আধবোজা। গায়ে লাল কাপড়ের শালু জড়ানো।নাকি তারাপীঠ থেকে পাশ করা জ্যোতিষী। একবার গেছিলাম মায়ের আর মাসির সাথে তারাপীঠে। বড্ড ভীড় আর নোংরা। কোথাও কোন কলেজ দেখতে পাইনি। বড়মামা সাথে ছিল। জিজ্ঞেস করেছিলাম। মামা হো হো করে হেসেছিল। কে জানে বাবা। হাসির কি আছে? শুধু তো বলেছিলাম, আমিও পড়তে চাই। ফর্ম কোথায় মিলবে?
রুস্তম কেমন জ্যোতিষ কে জানে? নাম শুনে কেমন ফকির টকির লাগছে। 
- নেবে নাকি??
- নাহ।
ওই বোট নিয়ে কি করবো? তাই না বলে ঘুরে চলে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ শুনি,দাদু চেঁচাচ্ছে, না নেবে তো আমার এতো সময় নষ্ট করলে কেন। সময়ের দাম নেই নাকি? এই বোটের মতো সময় ঘোরে কিন্তু এক জায়গায় আর ফেরে না। বলি যেমন আমার সময় পিছিয়ে দিলে, থাকো এবার বোটের মতো ঘুরতে। তাও যদি দশ টাকা দিয়ে বোটখানা কিনতে। 
বলে কি? পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি, দাদু কোথায়, বোট কোথায়, গামলা কোথায়। কোত্থাও কিচ্ছু নেই।
প্রতিটা গাড়ি দেখলাম। আর তাদের নীচটাও। নাহ কোত্থাও নেই। কাছাকাছি কোন গলিও নেই যে তাতে ঢুকে পড়বে। পুরোটাই দেওয়াল। 
খানিক মাথা চুলকে, ঘাবড়ে মেট্রোর দিকে পা বাড়ালাম। ব্যাগ ট্যাগ তখন শিকেয় উঠেছে। টিকিট কেটে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামলে তবে প্ল্যাটফর্ম। আজ খুব ভীড় মেট্রোয়। থিক থিক করছে মানুষ। শুধু মাথা আর মাথা। যেন দুর্গাপুজো চলছে। টিকিটঘরের সামনেও লম্বা লাইন। যা হোক করে টিকিট কেটে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামলাম। ট্রেন এলেই বেড়িয়ে পড়বো। ওমা দেখি সেখানেও লম্বা লাইন। ট্রেনের লাইনটাও দেখতে পেলাম না। যা ভীড়। চুপচাপ লাইনে দাঁড়িয়ে গেলাম। লাইন এগোতে দেখি সবাই টিকিট কাটছে। আরে আমার কি মাথা খারাপ হলো? স্বপ্ন দেখলাম যেন একটু আগে টিকিট কাটলাম। দাদুর জন্য বোধহয় মাথাটা গড়বড় করছে। যাই হোক টিকিট কেটে, গেট দিয়ে ঢুকে নীচে নামলাম সিঁড়ি দিয়ে। ট্রেন এলেই উঠে পড়বো। ভীড়ে দমবন্ধ হবার জোগাড়। লাইন পড়েছে। লাইনে দাঁড়ালাম। লাইন এগোচ্ছে। ট্রেন এখনও এলো না। দেখতে না পেলেও আওয়াজ তো পাবো। আমি এগিয়ে চললাম লাইনের সাথে। আমার পালার বিশ পঁচিশজনের আগেই দেখি, একি আবার টিকিটঘর কোত্থেকে এলো? এই তো টিকিট কাটলাম। ব্যাগপত্তর আঁতিপাঁতি করে ঘেঁটে, সব নামিয়ে গুচ্ছের কাগজ, হজমোলা, কফি বাইটের প্যাকেট সব পেলাম। টিকিট পেলাম না। প্লাস্টিকের গোল চাকতি। ব্যাগে তিনটে পাঁচশোর নোট ছিল। চারটে দশ। সেগুলোও বহাল তবিয়তে ব্যাগেই আছে। মানে চুরি যায়নি কিছু।
এবার মাথা ঝিমঝিম করতে শুরু করলো। আরও একবার টিকিট কাটলাম এবারও একই ব্যাপার। কি করবো বুঝলাম না। ভীড়টায় তাকালাম। যেন কারুর সাথেই এমনটা হচ্ছে না। সবাই নিজের মতো ব্যস্ত। কাউকে চেনাও মনে হচ্ছে না। কি করি, বুকের ভেতর খুব ধড়ফড় হচ্ছে। দাদুর কথা কি তাহলে ফলে গেল নাকি? বোটের মতো ঘুরছি আমি? এবার তাহলে কি করবো? দাদুকে এখন কোথায় পাই? রোলটা না খেয়ে বোটটা কিনে নিলেই হতো। কাঁদবো কিনা মনে হতেই দেখি আলখাল্লা পরা এক ফোকলা পাগল গোছের লোক এসে আমার জামার হাতা ধরে খুব হাসি হাসি মুখ করে দাঁড়ালো। যেন কতদিনের চেনা। বলল, বোটটা কিনিসনি বেটি? তাই তো? 
তুমি কে? জিজ্ঞেস করতেই বললো, আমি রুস্তম পাগলা। আমার ভাইয়ের সাথে দেখা হয়েছিল তোর। ওকে বলি জাদু করিসনা। ছেড়ে দে। তা শোনে না। আমাদের গুরুর বারণ আছে। আমরা ভিক্ষে করে খাই। ভাইটা বোট বেচে খায়। তা ওই একখানাই বোট। যে কিনলো, কিনলো। না কিনলেই ওর রাগ। 
আমার তো চক্ষু চড়কগাছ। সব ভুলে, রুস্তমের পায়ে পড়ে গেলাম, বাবা আমায় বাঁচাও। আমি বাড়ি যাই। আর কক্ষনো করবো না এমন। 
রুস্তম বলল,বোটটা চাই যে।
- সে কোথায় পাবো।আমি তো এখান থেকে বেরোতেই পারছি না। 
- আমার কাছে আছে। পঞ্চাশ টাকা দে।
- অ্যাঁ পঞ্চাশ? দশ চাইলো যে তখন?
- সময় নিয়েছিস,তার দাম ধরবি না বুঝি? সময়ের দাম খুব। সোয়া পাঁচ মিনিট প্রতি দেড় টাকা করে এখন। 
- সে কে ঠিক করে?
- সময় নিজেই ঠিক করে। ব্যাণ্ডেল চার্চে গেলে জানতে পারবি। ওখানে অনেক বড় বড় পুরোনো ঘড়ির সময় আছে। এখন দে দেখি পঞ্চাশটা টাকা।
বলে যেই পঞ্চাশ টাকা বের করে দিয়েছি হাতে। অমনি দেখি ঝোলা থেকে একটা গামলা বের করেছে, তাতে জল ভরা। এতো জলসুদ্ধু ঝোলায় ভরেছিল কেমন করে?
তারপর দেখি সেই বোটটা। সাদার ওপর নীল বর্ডার। তাতে সেইরকম ভাবেই লেখা 'প্রিন্সেস'। গামলার জলে সেটাকে চাবি দিয়ে ছেড়ে বললো, তাকিয়ে দেখ। আমি হাঁটু মুড়ে গামলার পাশে বসে পড়ে দেখতে লাগলাম। 
দেখতে দেখতে দেখতে দেখতে আমার চোখ বন্ধ হয়ে এলো।
ঘুম ভাঙ্গতেই দেখি বিছানায় রোদ পড়েছে জানলা দিয়ে। পাশের ঘরে দিদি, পুলিকে খাওয়াচ্ছে আর মা ওকে গান গেয়ে শোনাচ্ছে।
চাদরটা পেঁচিয়ে ওই ঘরে গিয়ে দাঁড়ালাম। শুনি, মা পুলিকে বলছে, দেখো মিমি কি এনেছে! বোট, দেখো কেমন ঘুরছে।
দেখি,পুলির স্নানের গামলায় সাঁতার কাটছে সাদার ওপর নীল বর্ডার দেওয়া একটা বোট। হাতে তুলে দেখি বোটটার মাথায় সোনালী অক্ষরে অবিকল এক নাম লেখা। প্রিন্সেস।
ঘড়িতে টুংটুং করে তখন ন'টা বাজলো। আজ আর অফিস যাব না। ভাবছি ব্যাণ্ডেল চার্চে একবার ঘুরেই আসি।

0 comments: