ধারাবাহিক - সুজিত নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়
Posted in ধারাবাহিক
ধারাবাহিক
সুজিত নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়
Diary Entry - 22
3rd. October, 1942, Saturday.
প্রিয় কিটী,
গতকাল আবার শুধু শুধু একটা ঝামেলা হয়েছে। আমার সাথে মায়ের। মা কোথাও কিছু নেই, অকারণে আমার ওপর ভয়ংকর রেগে প্রায় চীৎকার করে আমায় বকতে শুরু করেন। কাছেই বাবা ছিলেন। মা তাঁকে দেখে আরও উৎসাহিত হয়ে, যেন বকার জন্যে বিশেষ জোর পেয়ে গেলেন। তাঁর দিকে তাকিয়ে, তার উদ্দেশ্যে আমায় তিরস্কারের কারণগুলো বলতে থাকেন। আমায় বকাবকি করার মূল কারণ বা আমার বিরুদ্ধে মায়ের প্রধান অভিযোগ হলো, আমি তাঁকে কোনও কাজেই সাহায্য করি না, বা সঠিক বললে করতে চাই না। সব সময় নিজেকে নিয়েই নিজে ব্যস্ত থাকি। মায়ের মতে আমার বয়সী কোনও মেয়ের পক্ষে এটা শোভা পায় না। বাবাকে উদ্দেশ্য করে অভিযোগের বন্যা বইয়ে দেওয়ার পরই, তাঁর চোখ দিয়ে জল পড়তে শুরু করে। এটাই মায়ের স্বভাব। জানিনা এ’টা আনন্দের না দুঃখের, না’কি অভিমানের! প্রথমে মায়ের তীব্র তিরস্কার, তারপর মায়ের চোখে জল দেখে, আমিও অঝোরে কাঁদতে শুরু করি। চোখের জল ভীষণ ছোঁয়াচে। কিন্তু কাঁদতে গিয়ে যে আর থামতে পারব না, এটা প্রথমে বুঝিনি। যখন বুঝলাম, তখন অনেকটা কান্নাই হয়ে গেছে। এতটাই কাঁদা হয়েছে, যে শেষ পর্যন্ত আমার মাথার যন্ত্রণা শুরু হয়। একটু পর বাবা আমাকে কাছে টেনে মাথায় সান্ত্বনার হাত বোলায়। বাবা মাথায় হাত বোলালেই আমার কান্না থেকে যায়। আমি শান্ত হয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরে স্বীকার করি, যে, আমি মায়ের চেয়ে বাবাকেই বেশী ভালবাসি। অবশ্য সঙ্গে সঙ্গে এ’অভিযোগও করি যে, মাও আমাকে মারগটের মতো ভালবাসে না। বাবা আমার অভিযোগ শুনে আমায় বললেন, ‘আমার এটা ঠিক হচ্ছে না। মা আর বাবার মধ্যে কোনও তফাৎ নেই। মাকেও আমার সমান ভালবাসা উচিৎ।'
কিন্তু আমার মনে হয় না, আমি সেটা কখনও পারব! মা সবসময় আমাকে বকাবকি করে, তিরস্কার করে। কথায় কথায় মারগটের সঙ্গে তুলনা করে। এ’সব স্বত্বেও আমি মাকে বাবার মতই ভালবাসব, এ’টা কি করে সম্ভব? বাবা বললেন, “মাঝে মাঝে মাকে তাঁর কাজে সাহায্য করা উচিৎ। নিজে থেকেই আমার এই কাজগুলোতে এগিয়ে যাওয়া দরকার।" বাবার কথায়, বিশেষ করে, মা যখন মাথার ব্যাথায় কষ্ট পাবে, তখন আমার উচিৎ এগিয়ে গিয়ে তাঁকে সাহায্য করা। কিন্তু সত্যিই আমি তা’ কখনই করি না। ইচ্ছাকৃত কি’না বলতে পারব না, তবে এটা ঠিক, মায়ের কষ্ট আমি সবসময় যথাযথভাবে অনুভব করি ন। অথচ এ’টা আমার করা দরকার। মেয়ে হিসাবে এটা আমার কর্তব্য। পরিবর্তে আমার সবটুকু অবসর সময়, আমি ফরাসী ভাষা পড়তে পড়তেই কাটিয়ে দিই। এ’ছাড়া এখন আমি আরও একটা কিশোর উপন্যাস পড়ছি। নাম La Belle Nivernaie ।
ইতি,
অ্যানি।
অনুবাদকের সংযোজন
La Belle Nivernaie হল এক ফরাসী লেখকের ফরাসী ভাষায় লিখিত কিশোর উপন্যাস। মূল কাহিনীর পাত্র পাত্রী হলো একটি মাঝারি নৌকা ও তার নাবিক ও যাত্রী দল। বইটিতে বেশ কিছু স্কেচ আছে, যা যথাযথই বিশেষত্ব দাবি করতে পারে। এর মধ্যে আবার কয়েকটি আছে কালি আর পেন দিয়ে আঁকা স্কেচ। এইগুলির অভিনবত্ব ভিন্ন ধরণের। উপন্যাসটি সুপাঠ্য ও সুসমাপ্ত এক ইচ্ছাপূরণের গল্পে সমৃদ্ধ। গল্পে একদিকে অনাথ কিশোর তার যাত্রাপথে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া বাবা-মাকে খুঁজে পায়। উপন্যাসের শেষে সেই অনাথ কিশোর তার কৈশোরের প্রেমিকাকে বিয়ে করে সুখী হয়। আর তার বাবার ধনী হওয়ার সুপ্ত ইচ্ছা পরিপূর্ণতা লাভ করে। তাদের সকলের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়। তবে শুধু সহজ সরল পথে ইচ্ছাপূরণের গল্প বলাই উপন্যাসের প্রধান উপজীব্য ছিল না। এর মধ্যে জীবনের বহু ওঠাপাড়া সমস্যা জর্জরতা সব কিছুই উপন্যাসের মূল উপজীব্য অবিচ্ছেদ্য বিষয়ের অংশ হয়ে উঠেছে। এমনকি উনবিংশ শতাব্দীতে বশীকরণের সাহায্যে শিশু চুরি, তাকে অর্ধ বিকলাঙ্গ করে ভিক্ষাবৃত্তিতে নিযুক্ত করা, তাদের সামাজিক দৈহিক অসুস্থতার বিস্তারিত বিবরণ ইত্যাদি সবকিছুই উপন্যাসের বিভিন্ন পরতে বর্ণনা করা হয়েছে। আর এই সবের প্রেক্ষাপট হলো ফ্রান্সের প্রাকৃতিক দৃশ্য সমৃদ্ধ নৌকার বহমানতাকে কেন্দ্র বিন্দুতে রেখে ।
0 comments: