1

প্রবন্ধ - মিনতি ঘোষ

Posted in


প্রবন্ধ


THE GREAT DICTATOR - শ্রদ্ধায়, স্মরণে চার্লি চ‍্যাপলিন
মিনতি ঘোষ




we must laugh in the face of our helplessness against the forces of nature - or go insane - প্রকৃতির সমস্ত শক্তির বিরুদ্ধে, আমাদের অসহায়তার সামনে দাঁড়িয়ে আমাদের অবশ‌্যই হেসে যেতে হবে নতুবা পাগল হয়ে যাও।

চার্লি চ‌্যাপলিন এমনই। বুকের খামে কান্না ভরে রেখে হাসির মলাট মুখে। তাঁর সমস্ত সৃষ্টিতে এই দর্শন বরাবর ছুঁয়ে আছে। সমস্ত প্রতিকুলতাকে হেসে জয় করতে হবে…

He dazzles everybody - the intellectual, the simple, the cunning, and even those who meet him everyday - তিনি সবাইকে চমকে দিয়েছেন - বুদ্ধিমান, সরল, শঠ - এমনকি প্রতিদিন যাদের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়, তাদেরকেও 


The Great Dictator-এর আগের ছবিগুলি ছিল তীব্র জীবন সংগ্রামের ছবি - যা হাসির কোটিং দিয়ে পরিবেশিত হয়েছে। ছোটখাট মানুষটি তার বেঢপ পোষাক, প্রজাপতি গোঁফ, বোকা হাসি, আর চোখের অদ্ভূত ঔজ্জ্বল‌্য নিয়ে দর্শকদের হাসিয়ে, মাতিয়ে রাখছেন, কষ্টের চোরা স্রোতবুকের মধ‌্যে ছলাৎ ছল বয়ে যায়। এ ছবি অন‌্য রকম। এখানে হাসির মোড়ক খুলে গিয়ে বেরিয়ে এলো এক মঙ্গলময় বার্তা - যুদ্ধ বিরোধী প্রতিবাদ। ওরে হাল্লা রাজার সেনা… তোরা যুদ্ধ করে করবি কি তা বল … রাজ‌্যে রাজ‌্যে পরস্পরে দ্বন্দ্বে অমঙ্গল। তাঁর অন‌্যতম জীবনীকার, ইউরোপের বিখ‌্যাত সিনেমা সমালোচক David Robinson বলছেন, The Great Dictator remains an unparalleled phenomenon, an epic incident in the history of mankind... মানবতার ইতিহাসে এক মহাকাব‌্যিক ঘটনা ।


হিটলার এবং চার্লির চেহারায় এক অবিশ্বাস‌্য সাদৃশ‌্য - অথচ মানবিকতার দু প্রান্তে দু জন দাঁড়িয়ে। ইউরোপের অনেকের ধারণা সারা পৃথিবী ব‌্যাপী এত ভালবাসা, এত আনুগত‌্য চার্লির প্রতি - তাই দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে হিটলার চার্লির গোঁফের ফ‌্যাশনটি স্রেফ ঝেপেছেন। এই প্রসঙ্গে একটি ঘটনা উল্লেখ করা প্রয়োজন। Konard Bercovici চার্লির বিরুদ্ধে কোর্টে গেলেন কেননা 1930 এর মাঝামাঝি তিনি চার্লিকে অনুরোধ করেছিলেন তাঁর ছবিতে হিটলারের ভূমিকায় অভিনয় করতে - চার্লি তখন রাজি হননি অথচ Great Dictator এ চার্লি Hinkyl এর চরিত্রে অভিনয় করেন যা কিনা হিটলারের আদলে তৈরী এবং ছবিটি করেন 1939-40 সালে। যাই হোক অনেক পরে চার্লি দুঃখ করে বলেন, যদি আমার জার্মান কনসেনট্রেসন ক‌্যাম্পের বাস্তবিক বীভৎসতা জানা থাকতো, আমি কিছুতেই এই ছবি করতে পারতাম না । আমি কোনভাবেই নাজিদের এই উন্মত্ত খুনের মত্ততা নিয়ে মজা করতে পারতাম না - Had I known of the actual horrors of the German concentration camps, I could not have made The Great Dictator, I could not have made fun of the homicidal insanity of other Nazis. 

সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পরা যুদ্ধের বীভৎসতার বিরুদ্ধে বারবার প্রতিবাদ করেছেন - দেশে এবং বিদেশেও। 1938 এপ্রিলে ফরাসী চলচিত্র ম‌্যাগাজিন Cinemondeতে তাঁর বিখ‌্যাত ছোটগল্প Rhythme অনুবাদ হয়ে প্রকাশিত হয় - গল্পটি একজন স্প‍্যানিশ দেশভক্ত, মজার লেখকের হত‍্যার ঘটনার উপর লেখা। যুদ্ধ শুরু হবার আগে ফায়ারিং স্কোয়াডের ভারপ্রাপ্ত প্রধান অফিসারের সাথে এই সাজাপ্রাপ্ত মানুষটির গভীর বন্ধুত্ব ছিলো। যুদ্ধের সময় তাঁরা মতাদর্শগত ভাবে পৃথক হয়ে গেলেও, এই অফিসার আর ফায়ারিং স্কোয়ার্ডের অন‍্যান‍্য সৈনিকরা মনে মনে চাইছিলেন এ শাশ্তি যেন রদ্ হয়ে যায়। কমান্ডের চারটি ধাপ - Attention!…Shoulder arms!...Present arms!....Fire!  

অফিসার প্রথম তিনটি উচ্চারণ করলেন ...দ্রুত ছুটে আসা পদশব্দ শুনে বুঝতে পারলেন শাস্তি রদের হুকুম আসছে...কমান্ড দিলেন Stop! ঘাতক সৈন‌্যরা শুধু fire কমান্ড শুনেই অভ‌্যস্ত, Stop বুঝলো না - six men each held a gun. Six men had been trained through rhythm. Six men, hearing the shout - Stop!  fired.  - এই ঘটনায় বুঝতে পারা যায় চুড়ান্ত যান্ত্রিকীকরণ কি ভাবে এক মর্মান্তিক পরিণামের দিকে এগিয়ে যায়। এই যান্ত্রিকীকরণের হাস‍্যকর ভয়াবহতা তাঁর Modern Times এও দেখানো হয়েছে ।

The Great Dictator চার্লির প্রথম সবাক ছবি । চার্লির কাজের ধরণও এই ছবি করার সময় পাল্টে যায়। আগে তিনি ছবি করতে করতে ধাপে ধাপে গল্পটিকে লিখতেন - একটি একটি স‌্যুটিং পর্ব শেষ হলে, পরের পর্বের জন‌্য লিখতেন। এখন সম্পূর্ণ গল্পটি প্রথমেই লিখে ফেললেন। 1938 থেকে লিখতে শুরু করেন এবং 1939এর তেসরা সেপ্টেম্বর The Great Dictator এর ফাইনাল স্টেনসিল্ড কপি তৈরী খরে ফেলেন। - ঠিক এই দিনটিতে ব্রিটেন জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। স্ক্রীপ্ট ৩০০ পাতার, ২৫ টি ভাগ এবং প্রতিটি ভাগ পেজিং করে তা বর্ণের(alphabet) মাধ‍্যমে সূচিত করা হয়। ছয় সেপ্টেম্বর থেকে রির্হাসাল শুরু হয় এবং নয় সেপ্টেম্বরে ঘেট্টোর দৃশ‍্য দিয়ে সুটিং শুরু হয় । গল্পটি তো সবার জানা - শাসক Hinkle এর সাথে চেহারার সাদৃশ‌্য থাকার জন‌্য কনসেনট্রেসন ক‌্যাম্প থেকে পালানো নাপিত চার্লিকে Hinkle ভেবে ধরেবেঁধে সৈন‌্যদের জমায়েতের সামনে ভাষণ দেবার জন‌্য ঠেলে দেওয়া হয় - আর উল্টৌভাবে Hinkleকে পলাতক নাপিত ভেবে ধরে নিয়ে বন্দি করা হয়। বোকা, ক্লাউনের মতো চার্লি সেই বিশাল জমায়েত দেখে প্রথমে বেশ ভ‌্যাবাচ‌্যাকা খেয়ে যায়, যেখানে সামনের সারিতে অপেক্ষা করছে বেশ কিছু অষ্ট্রিচ দেশপ্রেমিক - যারা এসেছে Hinkle কে হত‍্যা করতে। নাপিতের প্রেমিকার বাবা তার কানে কানে বলে, তোমাকে এখন কথা বলতেই হবে! এটাই আমাদের বাঁচার একমাত্র সুযোগ! ভগবানের দোহাই - কিছু বলো ...You’ve got to talk now! It’s our only chance! For God’s sake, say something.  Hinkle এর প্রধানমন্ত্রী Herring প্রথমে ভাষণ দেয়া শুরু করেন, যা বেতার তরঙ্গে সারা বিশ্বের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে ...নিজের ভাষণে প্রথমে গণতন্ত্রের অবসান ঘটানোর ডাক দিয়ে বিশ্বজয়ী শাসক Hinkleকে জনতার সামনে উপস্থিত করেন - এই শাসককে মান‍্যি করতে হবে, নতুবা…. তারপর ভাষণ দিতে বাধ‍্য হয় নাপিত চার্লি। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে ধীরে ধীরে বলতে শুরু করে...কথা বলতে বলতে নিজের মধ‍্যে এক অপ্রতিরোধ‍্য শক্তি টের পায় ছোটখাটো মানুষটি...একসময় ক্লাউনের খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসে একজন ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা মানবতাবাদী সন্ত - the clown turns into the prophet ‘ যে বক্তব‍্য উপস্থিত সৈনিকদের মধ্যেই শুধু নয়, বেতার তরঙ্গের মাধ‌্যমে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পরে । যুদ্ধবিরোধী, বৃহত্তর মানবতার সপক্ষে আজও পর্যন্ত এমন জোরালো শক্তিশালী বক্তব‍্য কোন বিনোদন মাধ‍্যমে প্রচারিত হয়নি। The Great Dictator - এই কারণেই চার্লির অন‍্য সমস্ত ছবির থেকে শ্রেষ্ঠত্বের বিচারে এগিয়ে থাকে। আশ্চর্যের বিষয় এই ছবিটি কিন্তু প্রথমে আমেরিকায় একদমই আদৃত হয়নি। চার্লি নিজেও খুব নার্ভাস ছিলেন এই ব‍্যাপারে। ইউরোপের বিস্তৃত অঞ্চল তখন হিটলারের নাজি বাহিনীর পদানত। হলিউড নাজি শাসন বিরোধী ছবিকে মেনে নিতে পারেনি সেদিন। এক জনসমীক্ষায় জানা যায় ইউরোপে যখন যুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছিলো, তখন আমেরিকার ছিয়ানব্বই শতাংশ মানুষই যুদ্ধ-যোগদানের বিরুদ্ধেই ছিল। ডিস্ট্রিবিউটররা পর্যন্ত বললেন - You’ll lose a million dollars… and he said, Well I don't care if it's five million… এমনকি রাশি রাশি ভয় দেখানো চিঠিও পেলেন - বুঝতে পারলেন ফ‌্যাসিস্ট সমর্থকরা বেশ ভাল ভাবেই সক্রিয় তখন আমেরিকায়। অথচ সারা বিশ্ব জুড়ে এই ছবির জন‌্য তাঁকে এক অনন‌্য শ্রদ্ধার আসনে বসানো হলো। - তাঁর ইচ্ছা ছিল স্পেন, চিন, জার্মানীর রাস্তায়, ইহুদি ঘেট্টোতে এই বক্তৃতা দেওয়া হচ্ছে এমন ভাবে দৃশ‍্যায়িত করার…

এই বক্তব‍্য যেন মানুষের বিবেককে জাগ্ৰত করছে। তিনি দেখাতে চেয়েছিলেন তাঁর এই বক্তৃতা শুনতে শুনতে স্প‌্যানিস ফায়ারিং স্কোয়াড যেন অস্ত্র ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছে, জাপানী সৈন‌্যরা বম্ব না ফেলে প‌্যারাসুটে করে চিনের বাচ্চাদের খেলনা পাঠাচ্ছে, একজন নাজি সৈন‌্য নিজের জীবন তুচ্ছ করে একটি বাচ্চা ইহুদি মেয়েকে বাঁচাচ্ছে! যদিও বিভিন্ন কারণে এইভাবে দৃশ‍্যায়িত করা যায়নি। The Great Dictator অবশেষে আমেরিকায় নয়, 16ই ডিসেম্বর 1940 এ লন্ডনে মুক্তি পায় এবং অচিরেই ব্রিটিশ জনতার মন জয় করে ।


The Great Dictator এর বিশ্বব‍্যাপী এই জনপ্রিয়তা - শ্রেষ্ঠত্বের মূলে আছে ছ মিনিটের বিখ‍্যাত সেই বক্তৃতা। এক ভয়ংকর বিধ্বংসী যুদ্ধের সামনে দাঁড়িয়ে, অত‍্যন্ত সহজ, আঁটোসাঁটো ভাষায় তিনি তাঁর ভয়ের কথা বললেন, এক উজ্জ্বল ভবিষ‍্যতের স্বপ্নও দেখালেন :-

  The way of life can be free and beautiful, but we have lost the way. Greed has poisoned men’s soul - has barricaded the world with hate… We have developed speed, but we have shut ourselves in. Machinery that gives abundance has left us in want. Our knowledge has made us cynical …We think too much and feel too little. More than machinery we need humanity. More than cleverness we need kindness and gentleness. Without these qualities, life will be violent and will be lost.


জীবনের পথ মুক্ত এবং সুন্দর হতে পারে, কিন্তু আমরা পথ হারিয়েছি। লোভ মানুষের আত্মাকে বিষাক্ত করে তুলেছে - ঘৃণা দিয়ে পৃথিবীকে অবরুদ্ধ করেছে… আমরা বাড়িয়েছি গতি কিন্তু নিজেদের ঘরের ভিতর বন্দী রেখেছি। যন্ত্রপাতি প্রাচুর্য দিয়েছে, আমাদের ফেলে দিয়েছে চাহিদার আবর্তে, আমাদের জ্ঞান আমাদেরকে নিন্দুক করে তুলেছে… আমরা চিন্তা অনেক করি, কিন্তু অনুভব করি কম। যন্ত্র নয় আমাদের প্রয়োজন মানবতা - চালাকি নয়, দয়া আর নম্রতা দরকার আমাদের। এইসব গুণ ছাড়া জীবন হয়ে উঠবে ভয়ংকর এবং একসময় আমরা পরাজিত হবো… 

আজ এতদিন পরেও, এই বক্তৃতার একটি অংশও পুরনো হয়নি, ক্লিশে বা অর্থহীন হয়ে যায়নি । তবে বক্তৃতার শেষে যে আশার বাণী তিনি শোনালেন তাও কি আজকের পৃথিবীতে ফলবতী হয়েছে ?

   We are coming out of the darkness into the light ! We are coming into a new world… আমরা অন্ধকার থেকে আলোয় উদ্ভাসিত হচ্ছি! আমরা এক নতুন পৃথিবীতে আসছি… 

1 comment:

  1. অত্যন্ত প্রিয় এই চলছবি নিয়ে আলোচনাটি বেশ মনোগ্ৰাহী।
    দোলা সেন

    ReplyDelete