0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in










ধারাবাহিক


গার্ড 
নন্দিনী সেনগুপ্ত 



২ 

গ্রামের অন্য কোনও পরিবারে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া বাঁধলে স্বামীরা বলতে শুরু করেছিল, 

-‘এহ, আমাকে কি মিঃ ঠীলের মতো ভেড়া পেয়েছ নাকি?’ 

স্ত্রীরা ঝগড়া থামিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলত ‘সত্যি, হিংসে করবার মতো কপাল বটে বউটার!’ 

হ্যাঁ, লোকে বলত যে মিঃ ঠীলকে তার দ্বিতীয় স্ত্রী কতকটা ভেড়ার মতই পোষ মানিয়ে রেখেছিল। এমন পোষ মানিয়েছিল যে বলার নয়। ভেড়ার মত। সত্যিকারের ভেড়া হলে কখনও না কখনও ক্ষেপে গিয়ে ঠিক গুঁতিয়ে দিত। অমন গুঁতো খেয়ে যদি বা বউটার একটা শিক্ষা হত! 

যাইহোক, মিঃ ঠীলের বিশাল পেশিবহুল দুটো হাত থাকলেও, সে সেগুলো প্রয়োগ করবার ব্যাপারে কখনই আগ্রহী ছিল না, এবং লোকে এইসব ব্যাপারে ক্ষেপে থাকলেও তার নিজের বিশেষ কোনও মাথাব্যথা ছিল না। বেশির ভাগ সময় সে নীরবে সহ্য করে যেত স্ত্রীর অবিরাম বাক্যবাণ। এক আধ বার মৃদু এবং শান্তভাবে সে কিছু বলবার বা বোঝাবার চেষ্টা করলেও তার স্ত্রীর ওই উচ্চস্বরের চিৎকারের নিচে সব চাপা পড়ে যেত। কিন্তু এসব কোনওকিছুতেই সে বিশেষ বিচলিত হত না। বাইরের জগতে যাইই ঘটুক না কেন, সে যেন নিজের অন্তর্জগতে এক অদ্ভুত শান্তিতে ডুবে থাকত। 

তবে তার এই শান্ত স্বভাবের নিচে একটা অদ্ভুত জায়গা ছিল, যেখানে কেউ হাত দেবার সাহস করত না। সেটা হল তার ছেলে টোবিয়াস। তার ছেলের ব্যাপারে যদি কেউ কিছু বলত, তার শান্ত, দয়ালু প্রকৃতি যেন এক ভয়ানক কঠিন বর্মে ঢেকে যেতো। সেই জায়গাটায় এমনকি তার স্ত্রী লেনার অপ্রতিরোধ্য মেজাজও ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসতো। 

তবে মিঃ ঠীলের ওই কঠিন মেজাজ কালেভদ্রে দেখা যেত এবং সময়ের সাথে সাথে ব্যাপারটা ক্রমে ক্রমে বিলুপ্ত হয়ে যেতে থাকলো, লোকে এরকমটাই বলে। বিয়ের প্রথম বছরে লেনার সাঙ্ঘাতিক ক্ষমতালিপ্সার যতখানি বিরুদ্ধাচরণ সে করেছিল, দ্বিতীয় বছরে সেরকম কিছু করেনি। যদি করত, তাহলে হয়তো সে নিজে ধীরে ধীরে এতখানি উদাসীন হয়ে পড়ত না সংসারের ব্যাপারে; তাকে হয়ত বার বার লেনাকে অনুরোধ-উপরোধ করতে হত না, যাতে সে ভালো আচরণ করে; হয়ত ব্রান্ডেনবুর্গ পাইন অরণ্যের ভিতরে একা একা নিজের ডিউটিতে সময় কাটানোর ব্যাপারটা তার এতখানি প্রিয় হয়ে উঠত না। সেখানে সে তার মৃত প্রথম স্ত্রীর কথা চিন্তা করে অনেকখানি সময় কাটিয়ে দিত, যেটা লোকালয়ে অন্য জীবিত মানুষের সংস্পর্শে বিশেষ বিঘ্নিত হত। প্রথমদিকে সে নিজের ডিউটি থেকে বাড়িতে ফেরবার ব্যাপারে এত উদাসীন ছিল না, কিন্তু ধীরে ধীরে ব্যাপারটা এরকম দাঁড়িয়ে গেলো যে কিছুক্ষণ বাড়িতে থেকেই আবার সে সময় গুণতে শুরু করত কতক্ষণে নিজের ডিউটিতে ফিরবে ওই জঙ্গলের ভিতরে। 

প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে তার আত্মিক প্রেম হয়েছিল। লেনার সঙ্গে সেরকম কিছু না হলেও প্রবৃত্তি এবং ভবিতব্য তাদের এক করে দিয়েছিল এবং গার্ড ঠীল ধীরে ধীরে সমস্ত সাংসারিক ব্যাপারে লেনার উপরে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল। কিন্তু একেক সময় তার ইচ্ছে হত সময়ের উল্টো দিকে হেঁটে যদি অতীতের সবকিছু ফের ঠিকঠাক করে দেওয়া যেত। সেটা সম্ভব নয় বুঝতে পেরে সে বিষণ্ণ হয়ে পড়ত মাঝে মাঝেই। তবে এই বিষাদ থেকে বেরিয়ে আসার তার নিজস্ব কিছু পন্থা ছিল। যাতে সে একা জঙ্গলের ভিতরে অনেকটা সময় কাটাতে পারে, সেজন্য সে রেলওয়ে লাইনে এবং তার নিজের বাড়িতেও চুপিচুপি কিছু অদ্ভুত কথা বলে রেখেছিল। সে বলেছিল যে জঙ্গলের ভিতরের তার আউটপোস্টের চারপাশের জমিতে নাকি রহস্যময় মৃত আত্মাদের বসবাস। এসব গল্প শুনে কেউ বিশেষ ওইদিকে ঘেঁষতো না, এমনকি লেনাও কখনও ওই দিকে যাওয়ার সাহস দেখাতো না। 

এভাবেই চলছিল। লেনা জানতো না যে জঙ্গলের মধ্যে ঠিক কোনদিকে গেলে মিঃ ঠীলের আউটপোস্ট খুঁজে পাওয়া যাবে। কত নম্বর পোস্টে সে কাজ করে, এটাও জানা ছিল না। অদ্ভুতভাবে মিঃ ঠীল জীবিত এবং মৃত স্ত্রীর মধ্যে নিজের সময়টুকু ভাগাভাগি করে নিয়েছিল। এভাবেই সে নিজের বিবেকের কাছে জবাবদিহি করে চলছিল। সে একান্তে জঙ্গলের মধ্যে তার মৃত স্ত্রীর চিন্তায় সময় কাটাতো; সে যখন আত্মিকভাবে মিলে থাকতো তার সঙ্গে, তখনও অবশ্য মাঝেমধ্যে নির্মম বাস্তব উঁকি দিয়ে যেত সত্যের আলোয় এবং সে আরও বিরক্তবোধ করতো। 

মিঃ ঠীলের ডিউটি দিনের বেলায় থাকলে সে প্রথম স্ত্রীর সাথে আমোদে- আহ্লাদে যে সময়টুকু কাটিয়েছিল, সেই চিন্তায় এবং ধ্যানে সময় কাটিয়ে দিত। আর রাতের ডিউটি থাকলে জঙ্গলের হিমেল ঝড়ো হাওয়ার মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা তার আউটপোস্টের কুটিরটি যেন এক গির্জার উপাসনাঘরে পরিণত হত, যেখানে সে একটা লণ্ঠন জ্বালিয়ে আধ্যাত্মিক ভাবনায় ডুবে থাকত, গভীর ভালোবাসায় স্মরণ করত তার মৃত স্ত্রীকে। 

তার টেবিলে থাকত মৃত স্ত্রীর একটা বিবর্ণ ফটোগ্রাফ, একখানা বাইবেল এবং প্রার্থনাগীতির বই। রাতের ডিউটিতে সে প্রায় সারা রাত ধরে বাইবেল পাঠ করতো এবং প্রার্থনাগীতি গেয়ে যেত। তবে একটানা পারতো না, খেপে খেপে; কারণ মাঝে মধ্যে ট্রেন আসতো। দুটো ট্রেন আসবার মাঝের সময়টুকু সে গভীর ধ্যানে ডুবে যেত এবং এইরকম তূরীয় অবস্থায়, মাঝে মধ্যে সে তার মৃত স্ত্রীকে দেখতে পেতো। টানা দশ বছর ওইখানে পোস্টিং থাকার সুবাদে সে নিশ্চিন্তে নির্বিঘ্নে চালিয়ে গিয়েছিল তার আধ্যাত্মিক সাধনা। সমস্ত লোকালয় থেকে অনেকখানি দূরে ছিল এই রেলওয়ে ক্রসিং, যেখানে গার্ড ঠীল ডিউটি করতো। সবচেয়ে কাছের গ্রামে পৌঁছাতেও প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট লেগে যেতো। কী শীত, কী গ্রীষ্ম - দিনের পর দিন, মাসের পর মাস কেটে যেত, কিন্তু গার্ড ঠীল বা তার এক আধ জন সহকর্মী যারা ওই লাইন দিয়ে ট্রেনে পাস করতো, তারা ছাড়া ওই ক্রসিং-এ বিশেষ কোনও মানুষের পা পড়ত না। বদলে যাওয়া ঋতুকাল এবং আবহাওয়ার বদল ছাড়া ওই পাণ্ডববর্জিত জায়গায় আর তেমন কোনও পরিবর্তন হত না। তাছাড়া বিগত দশ বছরের মধ্যে দুটো অ্যাকসিডেন্ট ছাড়া, গার্ড ঠীলেরও সেভাবে কোনও ডিউটি ব্রেক হয়নি; কাজেই ছোটখাট যেকোনো পরিবর্তন মনে দাগ কেটে যেতো। যেমন, বছর চারেক আগে এই লাইন দিয়ে একটা রাজকীয় সেলুন কারওয়ালা এক্সপ্রেস পাস করছিল; সেই ট্রেনে ব্রেসলাউয়ের সম্রাট ছিলেন। শীতের রাতে ওই এক্সপ্রেসটা একটা মদ্দা হরিণকে ধাক্কা মেরেছিল। আবার এক গ্রীষ্মের দিনে, ডিউটির লাইনে ইন্‌সপেকশানের সময় গার্ড ঠীল একটা একদম ছিপি-আঁটা ওয়াইনের বোতল কুড়িয়ে পেয়েছিল। সেটা ধরতে গেলে ছ্যাঁকা লাগে, এরকম প্রচণ্ড গরম ছিল। ঠীলের মতে সেটা ভালই, কারণ এতে কারণবারির ফারমেন্‌টেশান পরিপূর্ণ হয়ে, স্বাদ আরও খোলতাই হবার কথা। জঙ্গলে লেকের এককোণে সে বোতলটা ঠাণ্ডা করবার জন্য চুবিয়ে রেখেছিল, কিন্তু পরে গিয়ে সেটা আর খুঁজে পায়নি। বহুদিন ধরে ঠীলের মনে এটা নিয়ে বেশ আফসোস ছিল। 
মাঝেমধ্যে অবশ্য এক-আধ জন গার্ডের জঙ্গলের কুটিরের কাছে যাতায়াত করত, কারণ কুটিরের পেছনেই ছিল একটা ঝর্ণা। ডিউটিতে থাকাকালীন তৃষ্ণার্ত রেলওয়ে কর্মী বা টেলিগ্রাফের কর্মীরা অনেকসময় সেই ঝর্ণা থেকেই জল খেত, অবশ্যই তারা সেইসময় এসে ঠীলের সাথে একটু আধটু কথাবার্তা বলে যেত। এছাড়াও ফরেস্টের রেঞ্জারও মাঝেমধ্যে জল খেতে আসত ওই ঝর্ণায়। 
টোবিয়াস ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠছিল। দুবছর বয়সে সে কথা বলতে এবং হাঁটাচলা করতে শিখেছিল; বাবার প্রতি বিশেষ দুর্বলতা দেখাতো। সে ধীরে ধীরে বুঝতে শেখায়, বাবারও তার প্রতি বিশেষ স্নেহ আবার জেগে উঠেছিল। পিতাপুত্রের প্রীতি বৃদ্ধি পাওয়ায়, টোবিয়াসের প্রতি তার সৎমায়ের স্নেহ কমে এসেছিল এবং কমতে কমতে একেবারে বিতৃষ্ণায় বদলে গিয়েছিল যখন নতুন বছরে লেনা নিজেই আরেকটি শিশুপুত্রের জন্ম দিয়েছিল। 



. (চলবে) 

[গেরহার্ট হাউপ্টমান রচিত ‘বানভ্যার্টার ঠীল’ গল্প অবলম্বনে রচিত] 









0 comments: