0

স্মৃতির সরণী - বিপুল দাস

Posted in
 

স্মৃতির সরণী


কথামালা 
বিপুল দাস


(পর্ব ২)
একা একা ঘুরে বেড়াই। বাড়িতে একাচোরা, বাইরে একলসেঁড়ে। মনখারাপের আলো ছড়িয়ে আছে আকাশজুড়ে। ধুস্‌, কিচ্ছু ভালো লাগে না। একা একা অনেক দূরে, সেই ঘোষালবাগান পার হয়ে ফুলেশ্বরী নদীর দিকে চলে যেতে ইচ্ছে করে। বাড়িতে দিদির রচনা বই’একের ভিতরে চার’ এর সব রচনা পড়া শেষ। ‘একটি বর্ষার দুপুর’ পড়ে কেমন নেশা-নেশা লাগে। এখানে সেখানে গল্পের বই খুঁজে বেড়াই। মায়ের তালাখোলা ট্রাঙ্কে এভাবেই একদিন পেয়ে গেলাম বিশালগড়ের দুঃশাসন, রত্নদ্বীপ, একশটি সহজ ম্যাজিক। ভাবতে থাকি শকুনের ডিমের ভিতরে পারদ পুরিয়া খাইলে উড়িতে পারা যায় – সত্যি নাকি। সিক্সটি ওয়ানে দাদার বিয়ে। আমার ক্লাস সিক্স। দোল দোল চতুর্দোলায় আর পান্নাহিরে চুনি তো নয় তারার মালা ... পাশের ঘটকবাড়ির অমলদা রেকর্ডে পিন পালটে দিচ্ছে। একটা বেশ মোটা কবিতার বই, রবীন্দ্রনাথের ‘সঞ্চয়িতা’ কেউ উপহার দিয়েছিল।

কবিতা তা হলে এ রকমও হয়। আশ্চর্য হয়ে গেলাম। ফাল্গুনে বিকশিত কাঞ্চন ফুল আর কোন দেশেতে তরুলতা ছাড়াও অন্য রকম কবিতা হয় তা হলে। ে কী অসাধারণ শব্দের রহস্য ! ছন্দের ঝংকার ! আমার প্রাণ জেগে উঠল। সত্যি সত্যি ‘ কেমনে পশিল গুহার আঁধারে প্রভাত পাখীর গান, না জানি কেন রে এতদিন পরে জাগিয়া উঠিল প্রাণ’। নেশায় আমি চুর হয়ে গেলাম, ভোঁ হয়ে গেলাম। আশ্চর্য এক জগৎ। যেন স্বপ্নময়। কিছুই চিনি না, অথচ চেনা-চেনা মনে হয়। আমি এক ‘গুপ্ত’ সাম্রাজ্যের অধীশ্বর হয়ে বসলাম। তার পথে পথে হিরেমানিক। আশ্চর্য এক জগতে আমার ভ্রমণ শুরু হ’ল।

দূরে একদিন দেখেছিনু তব কনকাঞ্চল-আবরণ

নবচম্পক-আভরণ।

কাছে এলে যবে হেরি অভিনব

ঘোর ঘননীল গুণ্ঠন তব,

চলচপলার চকিতচমকে করিছে চরণ বিচরণ—

কোথা চম্পক-আভরণ।।

চ-এর অনুপ্রাশে শরীর শিরশির করে। মাথার ভেতরে ঘোর লাগে। বিশ্বাস করুন, আমি সেই বয়সেই এক চির-রহস্যময়ীর অস্তিত্ব অনুভব করতে পারি। এই পৃথিবীজুড়ে, নদীর ওপারের ওই পলাশবনে, ভোরবেলার কুয়াশামাখা ধানখেতে, সন্ধ্যাবেলা পশ্চিমে সূর্যডোবায় আমি দৃশ্যমানতার বাইরেও অস্পষ্ট কিছু টের পাই। এখনও, এই বয়সেও আমি তাকে স্পষ্ট বুঝি না। কনকাঞ্চলের ইশারাটুকু শুধু টের পাই। বাতাসে সেই আঁচলখানি যখন ওড়ে, তখন হঠাৎ “ ওই ওই রব ওঠে, ওই ওই / তারপর সব শান্ত নিরুদ্বেগ সবুজ পৃথিবী,/ ধোয়া তুলসিপাতা”। -- (শঙ্খ ঘোষ)

এক ভিক্ষু ‘জল দাও’ বললে চণ্ডালিকার হাত কেঁপে উঠেছিল। বেঁচে থাকার জন্য জলহীন মানুষও কাতর প্রার্থনায় দু’হাত তুলে ধরে চণ্ডাল আকাশের দিকে। আল্লা মেঘ দে, আল্লা পানি দে। বেঁচে ওঠার মন্ত্র, বেঁচে থাকার কলমা। সৃষ্টির আদিতে দেখ সেই কারণবারি। মাতৃগর্ভের পিচ্ছিল তরল। অন্ধকারময়। ওম্‌-এই প্রণবধ্বনি উচ্চারিত হলে প্রসবকালীন জল ভাঙে। জলই তো প্রাণের গোপন কথা।

H2O – এই সংকেত বড় শুকনো। মানুষের বুকের গভীরে যে টলটলে জল, তার কোনও খবর দিতে পারে না এই সংকেত। এই ফর্মুলায় প্রকৃত জলের বড় অভাব। পৃথিবীর তিন-চতুর্থাংশে সাম্রাজ্য বিস্তারকারী জলের কথা, লক্ষ লক্ষ জলচর প্রাণীর কথা, গঙ্গা, নীলনদ, হোয়াং হো, এমন কী ছোট্ট ধরলা ও তার পারে ফাঁদেপড়া বগার কথা কিছুই বলা হয়ে ওঠে না এই ফর্মুলা দিয়ে।

লাইফলাইন বলে যদি কিছু থাকে, তবে সেটি জলপ্রবাহ। মানবসভ্যতার ইতিহাসে এই প্রবাহ প্রকৃতপক্ষে রক্তবাহী ধমনি। নাব্য নদী বেয়ে আসে ভাস্কো দা গামা, জোব চার্ণক। নগর সভ্যতার পত্তন হয়। বণিক যায় এলাচ, লবঙ্গ, চিনাংশুক, চুয়াচন্দন নিয়ে। নদীপথে চলেছেন একজন পর্যটক আমাজনের উৎস সন্ধানে। নদীপথে চলেছেন ধর্ম-প্রচারক। কারও হাতে বাইবেল কারও হাতে তথাগতের বাণী। নদীপথে চলেছে হাসেম আলি, কাঁধে মাছধরার জাল। নদীপথে বোটের ওপর বসে আছেন কবি। এই জলেই আমাদের তর্পণ। আমাদের সব অনুতাপ অঞ্জলি করে ভাসিয়ে দিই গাঙের জলে। দূর দক্ষিণে ভেসে যায় একমুঠো ফুল। এই নদী বেয়ে এক নারী পৌঁছে যায় ইন্দ্রের সভায়। ছিন্ন খঞ্জনার মত নাচে। নদীর মতই জীবনপ্রবাহ এগিয়ে যায় সামনের দিকে।

“সম্মুখের বাণী/নিক তোরে টানি/মহাস্রোতে/পশ্চাতের কোলাহল হতে/অতল আঁধারে অকূল আলোকে...”

পাহাড় থেকে গড়িয়ে নেমেই মহানন্দা সমতলে এসেছে শিলিগুড়িতে। পাহাড় গড়িয়ে পাথর আসে। পাথর গড়িয়ে চূর্ণীভবন চলে দীর্ঘকাল ধরে। নদীর গর্ভে বালি জমে। এখন ওই রুগ্ন, কঙ্কালসার নদীর দিকে তাকালে আমার বুকের ভেতরে কষ্টটা টের পাই। থাক, আমি দুঃখটা বালিচাপা দিয়ে রাখি।

কিছুদিন আগে আগে হঠাৎ মনে হ’ল যাই, একটু সেই নদীকে দেখে আসি। আমার প্রিয় মহানন্দা। রাস্তা পার হয়ে নতুন বসতির ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে নদী আর খুঁজেই পাই না। এ কী রে বাবা, পুকুরচুরি শুনেছি, আস্ত নদীটাও চুরি হয়ে গেল নাকি। যেখান দিয়ে হেঁটে এলাম, একদিন সেখানে ডুবজলে সাঁতার কাটতাম। অনেক সরে গেছে নদী। শেষে পাওয়া গেল। ঘরবাড়ি শেষ হওয়ার পর একটা ফাঁকা জায়গা দেখে দাঁড়ালাম। এখানে অন্ধকার। একটা বড় গাছও হয়ে গেছে এ ক’বছরে। হিসেব করে দেখলাম তা প্রায় চল্লিশ বছর পরে আবার নদীর পারে এসে দাঁড়িয়েছি। গাছ তো বড় হতেই পারে।

গাছটার নীচে গিয়ে বসলাম। আমার ছেলেবেলার নদী। আমার পায়ের কাছে মহানন্দা। উত্তরে তাকালে স্পষ্ট দেখা যায় তিনধারিয়া, কার্শিয়াং-এর আলো। অন্ধকারে কালো জল পাড়ে এসে ছলাত্‌ ছলাত্‌ শব্দে ভেঙে পড়ছে। সেই চিরকালের চেনা নদীকে ভীষণ অচেনা মনে হয়। কোথা থেকে এসেছে এই নদী ? কত যুগ ধরে বয়ে চলেছে এই নদী ? এর নাম কে রেখেছে মহানন্দা ? জগদীশচন্দ্র বসুর সেই বিখ্যাত লেখাটার কথা মনে পড়ল। ভাগীরথীর উৎস সন্ধানে। আমি তো বিখ্যাত মানুষ নই, তবু ইচ্ছে হ’ল নদীর সঙ্গে কথা বলতে। ফিসফিস করে উচ্চারণ করলাম –

নদী, তুমি কোথা হইতে আসিয়াছ ?

কার্শিয়াং-এর কাছে একটা ছোট্ট সরোবরে আমার জন্ম।

নদী, তোমার যাত্রাপথের গল্প বলো।

পাহাড়ে কত শত চঞ্চল ঝর্ণা এসে আমার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তাদের সবাইকে নিয়ে পাহাড়ের বন্ধন ছেড়ে নেমে এলাম শিলিগুড়ির সমতলে। আমার পবিত্রতা নষ্ট হয়ে গেল। এ শহরের মানুষ নদীকে ভালোবাসে না। আমি কলুষিত হলাম। ওদিকে সুকিয়াপোখরি থেকে বালাসন এসে আমার সঙ্গে মিলিত হ’ল। শিলিগুড়ি পার হয়ে বাংলাদেশের সীমান্ত বরাবর এগিয়ে চলেছি। গজলডোবা থেকে তিস্তা ক্যানাল হয়ে তিস্তার জল এসে পড়েছে আমার বুকে। লকগেট বন্ধ করে সেই জল পাঠিয়ে দেওয়া হয় পশ্চিমে। শুখা মরশুমে ফসল ফলায় উত্তর আর দক্ষিণ দিনাজপুরের সুখা জমিতে।

তারপর ?

তারপর বিহারে ঢুকে পড়েছি। নেপাল থেকে আসা মেচি নদীর সঙ্গে দেখা হ’ল কিষাণগঞ্জের কাছে। সমস্ত জলসম্পদ নিয়ে ক্রমে আরও দক্ষিণে এঁকে বেঁকে, কতবার দিক পালটে অনেক পথ পার হওয়ার পর নাগর ও কুলিকের মিলিত ধারা এসে মালদহ জেলার মহানন্দপুরের কাছে আমার সঙ্গে মিশে গেল। তখন আর আমার সেই পাহাড়ি চঞ্চল খরধারা নেই। কিছুটা অলস ছন্দে আমার এগিয়ে চলা। কত স্ফীত হয়েছি।

তারপর ?

বরেন্দ্রভূমির ভিতর দিয়ে অলসগমনে যেতে যেতে ইংরেজবাজারের নিমাসরাই-এ কালিন্দির সঙ্গে দেখা। সে তার সব জলভার আমাকে দিল। এরপর বাংলাদেশের সীমান্তে টাঙনের সঙ্গে দেখা। আমি তখন মিলিত জলভারে বিপুলা। আমাদের পাশপোর্ট-ভিসা নাই। অক্লেশে বাংলাদেশে ঢুকে গেছি। এরপর পুনর্ভবা এসে যুক্ত হয়েছে আমার সঙ্গে। শেষ পর্যন্ত রাজশাহী জেলার গোদাবাড়ি ঘাটে পদ্মায় আমার সমর্পণ। মোট তিন’শ কিলোমিটার পথ পার হয়েছি। কত পাহাড়, সমতল ভূমি, নগর, বন্দর, কত জনপদ পার হয়েছি। কত জনপদের উত্থান পতন দেখলাম। কত বন্যা, ঘাটে বসে গাঁয়ের বধূর কান্না, আমার শীতল জলে চিরজীবনের মত জ্বালা জুড়িয়েছে কত মানুষ। কান পাতলে সব শুনতে পাবে। ইতিহাসে সব লেখা থাকে না। লোকগাথায়, জনপ্রবাদে, গ্রামীন ছড়ায়, পূজাপার্বণে,লোকাচারে, সারিগানে, ভাটিয়ালিতে, ভাওয়াইয়ায় নদীর কথা ছড়িয়ে থাকে।

নদী, তুমি কি প্রাচীনা ?

পাহাড়ে কিন্তু আমার নাম মহলদি। লেপচা শব্দ মহলদির অর্থ বাঁকা। আমি প্রাচীনা, তবে সুপ্রাচীনা নই। নদীপথ চিরদিন স্থির থাকে না। পূর্বের গতিপথ থেকে অনেক সরে গেছি আমি। তিস্তা বা ত্রিস্রোতার পশ্চিমধারা পুনর্ভবার সঙ্গে আমার মিলন ছিল আইয়রগঞ্জের কাছে। পরে রামপুর-বোয়ালিয়ার কাছে পদ্মায় মিশে যেতাম। তারও আগে লক্ষণাবতী পার হয়ে করতোয়ার সঙ্গে আমার জলধারা মিশে যেত। কী বিশ্বাস হয় না ? ফান ডেন ব্রোকের নক্‌শায় দেখ আমার গতিপথ ছিল আরও পশ্চিমে। মহানন্দার প্রাচীন প্রবাহের কথা ইতিহাস খুঁজলে ঠিকই পাবে। নদীবহুল এই অঞ্চলের নদীগুলো ক্রমাগত খাত পাল্টেছে। যে জাতি নদীকে ভালোবেসেছে, নদীও তাকে পত্রেপুষ্পে, ফুলেফলে উর্বরা করে গোলায় ফসল ভরে দিয়েছে। মানুষের চেয়ে নদী অনেক প্রাচীন। নদীকে শাসন করা যায় না।

স্তব্ধ হয়ে অনেক ক্ষণ বসে রইলাম। নদীকথা শুনতে শুনতে সব ভুলে গিয়েছিলাম। উত্তরে পাহাড়ের আলোকমালা, দক্ষিণে অনেকদূরে নতুন ব্রিজের আলো। অবিশ্রান্ত ছোট ছোট ঢেউ এসে ছলছল শব্দে ভেঙে যাচ্ছে। মিলিয়ে যাচ্ছে অনন্ত ধারায়। লোকে বলে বটে – জলের মত সহজ। জল অত সোজা নয়। মানুষ অবজ্ঞা করে বলে -- সব কিছু জলে গেল। অথচ শেষ পর্যন্ত সব কিছু জলেই ভাসিয়ে দিতে হয়। গঙ্গাজল মুখে দিতে হয়। এই নশ্বরদেহ পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে গেলে জলে পুঁতে দিতে হয় অবশেষ। জলেই পিতৃপুরুষের তর্পণ। নদী উদাসীন থাকে। সে শুধু দেখে যায় মানুষের আসা-যাওয়া।

“ফিরে নাহি চাও,

যা কিছু তোমার শুধু দুই হাতে ফেলে ফেলে যাও।

কুড়ায়ে লও না কিছু, কর না সঞ্চয়;

নাই শোক, নাই ভয় –

পথের আনন্দবেগে অবাধে পাথেয় কর ক্ষয়”

বড় হতে থাকি। ষাট ফোঁটা রক্তের তাৎপর্য বন্ধুরা খুব সাঁটে বুঝিয়ে দেয়। শুনেই বুকের ভেতরে হুড়ুমদাড়ুম শব্দ হতে থাকে। মনে হয় বাড়িতে ফিরলে আমার মুখ দেখেই মা সব বুঝে ফেলবে। মালা সিনহা, সায়রা বানু, আশা পারেখ, নন্দা – এদের নিয়ে তুল্যমূল্য আলোচনা হয়। একজন কেউ তাত্ত্বিক নেতা গভীর ভাবে আমাদের ভেতরের কথা বোঝানোর চেষ্টা করে, কিন্তু আমার খুব সন্দেহ হয়, নিজের অভিজ্ঞতা বলে চালানোর চেষ্টা করলেও মনে হয় গল্পে জল আছে। কিন্তু দাদার ভয়ে সন্ধের আগেই বাড়ি ফিরতে হয়। বন্ধুরা ফুটবল খেলার শেষে পি ডাব্লিউ অফিসের সামনে হেলানো শিরীষ গাছে বসে পা দোলায় আর সদ্য-শোনা গল্প নিজের মনের মাধুরী মিশায়ে পুনর্নির্মাণ করতে থাকে। দীপককে সবাই রিকোয়েস্ট করে আঈ মিলন কি বেলা শোনানোর জন্য। দীপক টুসকি দিয়ে চারমিনারের লেজ ছুঁড়ে ফেলল।

দীপক কিছুক্ষণ ঘাড়ের চুল আঙুল দিয়ে ঘোরালো, তারপর বলল আজ ও অন্য গান গাইবে। গাতা রহে মেরা দিল দীপক হেভি গাইত। তার বাঁ পা ছিল কংক্রিটের পিলারের মত, ডান পা ছিল বটের ঝুরির মত, দু’বগলে ক্রাচ। ও মেরে হামরাহি – বলে দুটো হাত ফ্রি করে সামনে বাড়িয়ে দিত দীপক। মনে হত সত্যি বুঝি ওয়াহিদা মাঠ পেরিয়ে লেন, লেন পেরিয়ে পি ডাব্লিউ রোডের দিকে চলে যাচ্ছে। দেব আনন্দের লিপের সমস্ত গান দীপকের মুখস্থ। ভালো গাইত। আঁখো হি আঁখোমে ইশারা হো গয়্যা – সি আই ডি, আভি না যাও ছোড় কর – হামদোনো, তুঝে জীবন কি ডোর সে বাঁধ লিয়া হ্যায় – আসলি নকলি। সব অ্যাকিউরেট সুরে গাইত।

দীপক হাতদুটো সামনে এনে ডিং ডাং টারা ডিং ডাং গিটার বাজানোর ভঙ্গি করল, মুখে সাউন্ড দিল। একটু আগেও কানাই-এর একটা গানের সঙ্গে ভাট্টা দু’টো দশ নয়া দিয়ে তাল রেখেছে। দীপক আর একবার চুল ঘুরিয়ে নিল। আভি না যাও ছোড় কর ... ট্রিং টিক টিক ... কে দিল আভি ভরা নেহি... সামনে হাত বাড়িয়ে দিল দীপক। এটা ওর কায়দা। ওর ধারণা অনেকটাই দেবানন্দ্‌ হয় এতে। এমনভাবে সামনে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল, সবাই মাঠের ঘন অন্ধকারে তাকিয়েছিলাম আমরা, যেন সাধ্‌না অন্ধকারের আড়াল নিয়ে কোথাও চলে যাচ্ছে। ওদের মনে হয় সাধ্‌নার কপালের সামনে সেই বিখ্যাত ঝুরোচুল অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। হায় হায় শব্দ ওঠে বুকের ভেতরে। দু’একজনের কান্না পায়। আভি আভি তো আঈ হো বাহার বনকে ছাঁঈ হো... আমাদেরও অস্পষ্ট ঠোঁট নড়ে। তখন দীপক বুঝতে পারে হিট করেছে গানটা।

শৈলেন্দ্র স্মৃতি পাঠাগারের চাঁদা চার আনা। আমি মেম্বার হয়ে গেলাম। ওই চার আনাই ছিল চিচিং ফাঁক। তখন স্বর্গের দরজা খুলিয়া গেল। সত্তর দশকের মাঝামাঝি লিটল্‌ ম্যাগাজিন বের করার পরিকল্পনা হল। মূলত আমি, গীতাংশু কর ও নিখিল বসু। তার আগে খুচখাচ কবিতা লিখছি। সব পড়ছি। যা পাচ্ছি, সব। টাউন স্টেশনের ক্যান্টিনে চুটিয়ে আড্ডা। আমার কাছে 'ফিরে এসো চাকা' আছে শুনে নিখিল অবাক হয়ে গেল। 'পাহাড়তলি' নামটা নিখিলই ঠিক করল। আমাকে বলল -- তুমি গল্প লিখবে। বুঝলাম ব্যাপারটা সিরিয়াস। এমনি সময় আমাকে 'তুই' করে বলে।
পাহাড়তলি ছাপা হত পটলডাঙার 'অমি প্রেস' থেকে। কমল সাহার সঙ্গে খুব বন্ধুত্ব হল। তখনই কমল খুব ভালো ছবি আঁকছে। যোগাযোগ হল অঞ্জন সেন, পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল, নিশীথ ভড়দের সঙ্গে। কলকাতা থেকে লেখা সংগ্রহ, প্রেসে গিয়ে পাহাড়তলির প্রুফ দেখা ওরা সানন্দে করত। প্রথম সংখ্যায় স্যামুয়েল বেকেট সম্পর্কে লিখলেন অশ্রুকুমার সিকদার। কবিতা লিখেছিলেন অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, শংকর চট্টোপাধ্যায়,মোহিত চট্টোপাধ্যায়, দেবারতি মিত্র, অঞ্জন সেন, রানা চট্টোপাধ্যায়, শিবশম্ভূ পাল, আরও অনেকে। পর পর কয়েকটি সংখ্যার প্রচ্ছদ করলেন শ্যামল দত্তরায়। চতুর্থ সংখ্যায় ছিল অনন্য রায়ের 'হে স্মৃতি, ঘুম আসছে না' শীর্ষক বিখ্যাত কবিতা। ঈনিডের অনুবাদ প্রসঙ্গে আলোচনা ছিল অমিতাভ গুপ্তের। পঞ্চম সংখ্যায় উদয়নারায়ণ সিংহ, বীতশোক ভট্টাচার্য, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের লেখা। ষষ্ঠ সংখ্যা ছিল বিশেষ কবিতা সংখ্যা। মধুসূদনের 'বঙ্গভাষা', বিষ্ণু দে'র 'সেই অন্ধকার চাই', সমর সেনের 'মদনভস্মের প্রার্থনা' নিয়ে আলোচনা করেছিলেন যথাক্রমে পুষ্কর দাশগুপ্ত, সজল বন্দ্যোপাধ্যায় ও অশ্রুকুমার সিকদার। একটি, দুটি ও তিনটি করে কবিতা ছিল অমিয় চক্রবর্তী, অরুণ মিত্র, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ, আলোকজ্যোতি রায়, শোভন চক্রবর্তী, তুষার বন্দ্যোপাধ্যায়, পুণ্যশ্লোক দাশগুপ্ত, অলোকনাথ মুখোপাধ্যায়, অন্যমন দাশগুপ্ত, মনোজ রাউত, অমিতাভ গুপ্ত, বিশ্বদেব মুখোপাধ্যায়, সমর চক্রবর্তী, অঞ্জন সেন, বিপুল দাস, সৈয়দ কওসর জামাল, নিখিল বসু, গীতাংশু কর, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত ও আলোক সরকারের।

আজ ভাবতে গিয়ে খুবই অবাক হয়ে যাই সত্তরের দশকে শিলিগুড়িতে বসে আমরা কী ভাবে 'পাহাড়তলি' প্রকাশ করেছি। অবশ্য কলকাতার বন্ধুরা, ধুপগুড়ি থেকে পুণ্যশ্লোক -- সবাই না হলে এটা হত না। পরবর্তী কালে নিখিল বসু শিলিগুড়ি ছেড়ে চাকরিসূত্রে ধুপগুড়ি চলে যায়। সেখানে গিয়েও সে 'লালনক্ষত্র' সম্পাদনা করতে থাকে। গীতাংশু চাকরির জন্য কলকাতায়। আমি একা শিলিগুড়িতে। পাহাড়তলি বন্ধ হয়ে গেল। কিন্তু আমি সিরিয়াসলি লেখালেখির জগতে ঢুকে পড়লাম।

(ক্রমশ)

0 comments: