0

গল্প - উত্তম বিশ্বাস

Posted in


গল্প


বেলুন
উত্তম বিশ্বাস



বাবা ঘরে থাকলেই বাড়িটা কেমন যেন বাঘের খাঁচা বাঘের খাঁচা মনে হয় মনসিজের। আর দশাসই মা’কেও তখন যেন মেকুর মেকুর মনে হয়!—“যত বীরত্ব সবই আমার ওপর তাই না?”—কথাটা এখন মনসিজ প্রায়শই ঠোঁট ফুলিয়ে ফুলিয়ে ফেরৎ দেয় তার মা’কে। আজ রিম্পার বার্থডে। “আর এই দিনই যতরাজ্জির পড়ার চাপ, হোমটাক্স, তবলাবাঁয়া সাঁতার হাডুডু হারমোনিয়াম সবই ভাজতে হবে! রবিবারের দুপুরে দুঘণ্টা ঘুম মাস্ট; না হলে মা ঘুমের বড়ি বেটে খাওয়াবে। বিকালে ব্যাডমিন্টনের জন্যে বুড়ো বটু কাকা হ্যাংলার মতো এসে পড়ে থাকবে সোফায়। আরে বাবা এককাপ কড়া কফি, আর মাস গেলে আড়াই হাজার পেলে, এত চাপ নেয় নাকি কেউ! আমার ত নিজের মতো করে দুটো মিনিট কাটাতে ইচ্ছা করে না কি!” এত সব ভাবতে ভাবতে অন্তরে অন্তরে অস্থির হয়ে ওঠে মনসিজ। বাবা বাথরুমে। ফোন বেজে উঠতেই দৌড়ে গিয়ে রিসিভ করল, “হ্যালো আন্টি, মা যাবে বলেছে। আমিও যাব। আমার আজ একটাও হোমটাক্স পেইন্ডিং নেই; আগে আগে সব কমপ্লিট করে ফেলেছি। জানো, মা আজ নতুন ব্লাউজ পরে যাবে। তনু টেলারসের ছোটনকাকু এইমাত্র আমাদের বাড়ি এসে দিয়ে গেল। রিম্পার জন্মদিন ত, তাই মা চাপ দিচ্ছিল খুব।” ঠাস করে একটা চড় পড়ল পিঠে। সুনীতা ফোনটা কেড়ে নিল,--“হ্যাঁ স্বপ্না বল। আর বলিস নে, ছেলেটা খুব ডেঁপো রে! তোর মতো একটা মিষ্টি মেয়ে হলে আমার আয়ু আরো বেড়ে যেত জানিস! কী বলছিস?---ওর ভালো রেজাল্ট--? ছাড় এসব। আর বলিস কেন, পরীক্ষাটা ও দেয়, নাকি আমি, জিজ্ঞাসা করিস তো! ও কেমন উচ্চিংড়ি তুই ত জানিস। আর এখন হয়েছে আর এক উৎপাত—বিয়েবাড়ি থেকে অন্নপ্রাশন, ছটপুজো থেকে দুগগাভাসান,-- সব অকেশানেই ওকে অ্যাটেন করা চাই চাই,-- নইলে বাড়ি মাথায় করবে। রিম্পার কি একজ্যাক্ট আজই বার্থডে?” কিছুক্ষণ কথা-ক্যানেল ব্লক হয়ে যায়। তারপর ফোনের আলো দেখে আবার বলল, “আচ্ছা দেখছি কী করা যায়। কিছু যদি না মনে করিস,--- ওর শীতের পোশাক আছে রে? আইমিন সোয়েটার টোয়েটার?-- ওফ! একদম ভুলে গেছি, আজ সন্ধ্যায় আমার একটু পার্লারে যাবার ছিল। রাখ বুঝলি, সন্ধ্যা আগে আসুক ত!” মনসিজ সুনীতার জামা ধরে ঝুলতে থাকে, “মা মা আমার কাছে দাও।– হ্যালো আন্টি, রিম্পাকে একটু দাও না প্লিজ!—হ্যালো রিম্পা, আমি না গেলে কিন্তু বেলুন ফাটাস না। তোর জন্যে অনেকগুলো টফি আছে সারপ্রাইজ। তুই হাঁ হয়ে যাবি বুঝলি!-- আমার অ্যামেরিকার ভালো দিদুন দিয়েছিল, আমি খাইনি, তোর জন্যে রেখেদিয়েছি। বড় বেলুনটা ফুলিয়ে দেব, তারপর ওগুলো ওর মধ্যে পুরে দিয়ে ফটাসসসসসস! তখন দেখবি কী দারুণ---!” ফোনের ওপার থেকে কেবলমাত্র অপার বিস্ময়ের গরম বাষ্প ঠ্যালা হুশহুশ আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই ভেসে এল না! হয়ত রিম্পা খুব অবাক হচ্ছে, এসব ভেবে মনসিজ আরও কথার ফুলঝুরি ফোটাতে থাকে! 

সুনীতা আর স্বপ্নাদের বাড়ির ফাঁকে মাত্র পাঁচটা বাড়ির দূরত্ব। তবু যা কিছু কথাবার্তা সবই ফোনে ফোনে সারতে হয়, চাইলেই কি আর বেরনো যায়? –মেয়েদের সংসার বড় বালাই! সুনীতার বর বড় ব্যবসায়ী। স্বপ্নারা সে তুলনায় ওদের কাছে চুনোপুঁটি। তবু সুনীতাবৌদি স্বপ্নাকে এতটা ভালোবাসে,--এটা কি কম ঈর্ষার ব্যাপার! হয়ত ওরও কিছু অভাব আছে, না হলে এত পাত্তাই বা দেবে কোন দুঃখে! এসব ক্ষত মাঝে মাঝে ধরা পড়ে মনসিজের আক্ষেপে, “জানো মা, আমার বাপির অনেক টাকা আছে ত, তাই কেউ আমার সাথে ভালো করে কথা বলে না! শুধুমাত্র স্বপ্না আন্টি আর রিম্পা আমাকে খুব ভালোবাসে! আজ আমরা একটা আইসক্রিম দু’জনে এমাথা ওমাথা শেয়ার করেছি। জানো মা, আমার রিম্পার সাথে খেলতে খুব ভালো লাগে!” কথাগুলো আজও সকালে শুনিয়ে শুনিয়ে তবেই সাঁতার প্র্যাকটিসে গিয়েছিল মনসিজ। ছেলের নিঃসঙ্গতার বেদনায় সুনীতার ভেতরটাও ভেপার পাওয়া আইচের মতো নীরবে গলতে থাকে,--গলতেই থাকে! একটা মাত্র সন্তান, প্রাচুর্যের পাহাড়েও এত বেদনার হিমানী আছে,-- আগে স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি সুনীতা। --“ছেলে ত আর মঙ্গলগ্রহ নিয়ে লুফালুফি করতে চাইছে না, এটুকু ইচ্ছা সব মায়েরাই পূরণ করতে পারে।– আভিজাত্য নিয়ে কি আর ধুয়ে খাব!” এসব একা একাই সান্ত্বনা নেয় সুনীতা। তাই আজকাল পার্কে এলেই সুনীতা রিম্পাকে খুঁজতে থাকে, সেই সাথে স্বপ্নাকেও। ইদানীং স্বপ্না না এলে পার্কটা কেমন যেন পানসে পানসে লাগে সুনীতার। সুখ-দুঃখের দুটো কথা, বাচ্চাদের নিয়ে আকাশকুসুম কল্পনা,--কত কিছুই না আলোচ্য বিষয় থাকে মেয়েদের। ওরা রাইডে চড়ে, দোল খায়, আর এদিকে ছায়ায় বেদীতে মুখোমুখি দুটি নারী,-- ঠোঁটের ফাটল, পিঠের আঁচিল, আর অবাঞ্ছিত মেদ-মহিমার কারণ অনুসন্ধানে, স্বামী সংসার নারীজনমের যাতনা সবই ভুলে যেতে থাকে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। তখনো অনেক কথাই বাকী থেকে যায়। সুনীতার ইচ্ছে হয়, স্বপ্নাকে ওর ঘরে নিয়ে টিভি চালিয়ে দিয়ে সিরিয়ালের গল্প করবে কিছুক্ষণ। কিন্তু দীপায়নকে দিয়ে সুনীতার বিশ্বাস নেই। সুনীতার স্বামী। ইদানীং বয়স বাড়ার সাথে সাথে ওর হ্যাংলামিটাও যেন বেড়েই চলেছে, এটা বেশ বুঝতে পারে সুনীতা। আগে দু’চার দিন স্বপ্নাকে এন্ট্রি দিয়ে দেখেছে, দীপায়ন চা’ চা’ করে বাড়ি অস্থির করে তুলবে, আর একটু দেরি হলেই নিজেই কেমন আগবাড়িয়ে কিচেনে গিয়ে স্বপ্নাকে কিছু একটা খাওয়ানোর অছিলায় অস্থির হয়ে উঠবে! তার চেয়ে থাক বাবা, মেয়েদের সাথে,--- মাঠই ভালো!



একটিমাত্র মেয়ে স্বপ্নার, কোনোকিছুর সঙ্গেই তাই কম্প্রোমাইজ করতে চাই না সে। সবার সন্তানের যদি বার্থডে সেলিব্রেশান হয়, তবে ওর মেয়ের ক্যান নয়? –“হবে আলবাৎ হবে!” নির্দিষ্ট দিন আসতেই জিদ চেপে বসল স্বপ্নার। মেয়েকে আচ্ছারকম সাজিয়েছে সে। সকালে যখন সুনীতাবৌদি জিজ্ঞেস করেছিল, রিম্পার ভালো সোয়েটার আছে কি না, তখন এই ছোট্ট কথাটায় কতটা খোঁচা লেগেছিল স্বপ্নার মাতৃসত্ত্বায়, তা খানিকটা হলেও আঁচ করা যায় টালিরঘরের রিম্পার পোশাকপরিচ্ছদের বাহুল্য দেখে! হরতোষের মা একেবারে হামাগুড়ি দিয়ে এলেন যেন, -“হেই আর বলো না, কর্তা ত রেগে টং! বলে কী জান, পার ইভিনিংএ কটা করে বার্থডে পার্টি অ্যাটেন করতে হয় শুনি? বাচ্চাগুলোর মাথা ভালোই ত--!” স্বপ্না সংকোচ ঢাকতে পায়েসের ঢাকনা সরিয়ে হাঁড়ির মধ্যে উঁকি মারে। গরম বাষ্পের ছ্যাকা তার মুখেও লাগল বুঝি! রিম্পা দৌড়ে এসে সুনীতাকে জড়িয়ে ধরল,-- “আন্টি আন্টি, মনসিজ কই?-- বলল যে বেলুন ফাটাবে!” সুনীতা রিম্পার চিবুক ধরে মুখে চুকচুক আওয়াজ করে বলল, --“হ্যাপি বার্থডে টু ইউ অ্যামেরিকান টফি! হ্যাপি বার্থডে মাই মিষ্টি মামণি!—এই নাও তোমার সারপ্রাইজ!”
--“মনসিজ আসবে না আণ্টি?”
--“তুমি ত বেঙ্গলি মিডিয়ামে পড়, ওর প্রবলেম তোমাকে বোঝায় ক্যামন করে?” রিম্পা আর প্রশ্ন করার সাহস দ্যাখায় না। সে মুঠোভর্তি চকলেট নিয়ে পাশের কামরায় ঢুকে যায়। বড় বেলুনটা এখনো ফোলানো হয়নি, এগুলির জন্যে বোধহয় অপেক্ষা করছিল রিম্পা।



রাত বাড়ার সাথে সাথে স্বপ্নারও সংকোচ আর হীনমন্যতা বাড়তে লাগল চড়চড়িয়ে। বাণ্টির মা খুব আবেগভরা গলায় বলল, “ভুল বুঝো না স্বপ্না, বোঝ ত রাত পোহালেই সোমবার, ফাইনাল এগজাম বলে কথা! আমরাও ত আজকাল বুঝেশুনে দিন ফেলি। পরীক্ষার মুখে এসব পাগলামো করে নাকি কেউ?” সোমা আন্টির কথা শুনে চোখ মোটা মোটা হয়ে আসে রিম্পার। এসব ব্যাপার স্যাপার আগে ত জানা ছিল না। পরীক্ষার মুখে কারো বার্থডে আসতে নেই, দিনক্ষণ হিসাব কষে ফেলতে হয়! চোখ দুটো উপচে পড়ে রিম্পার! তাহলে কি কেউ আসবে না? গোগোল, ঝুম্পা, তিনা--- এরা ত সবাই বাংলা মিডিয়ামে পড়ে?—ত--? এরাও কি আজকাল বাণ্টিদের দ্যাখাদেখি একটু বেশিরকম আদিখ্যেতা দ্যাখানোর চেষ্টা করছে নাকি? হাজার চিন্তা তালগোল পাকিয়ে যায় রিম্পার মনের মধ্যে। বান্টির মা হাতে হাতে চেয়ারগুলো সাজিয়ে দেয়। হরতোষের মা ঘর থেকে কেক এনে ওর মধ্যে মোমবাতি পুঁতে দিতে থাকে। সুনীতা ঢুকে যায় কিচেনে। স্বপ্নার ছোট্ট সংসার, তবু এতো মানুষের অনুকম্পা আর সহানুভূতিতে সে আবেগতাড়িত হয়ে পড়ে। বাচ্চাদের না আসার দুঃখ খানিকক্ষণের জন্যে হলেও মন থেকে মুছে ফ্যালার চেষ্টা করে সে। স্বপ্নার বর বাইরে থাকে। পাঞ্জাব লরির ড্রাইভার। আসলেও বছরে দুবারের বেশি ঘরে আসে না রিম্পার বাপি। অনেকে বলাবলি করে রিম্পার বাপি নাকি আর একটা---! স্বপ্নার সংসারে পুরুষশূন্য পরিবেশে মেয়েরা এসে যে যার মতো করে গলা ঝেড়ে ক্লিয়ার করে নেয় ভেতরের জমানো দুঃখ রাগ অভিমান আর না পাওয়ার যন্ত্রণার ধুলো! মনসিজ হরতোষ, বাণ্টি—এরা কেউই আসে নি। কাল ওদের ফাইনাল একজাম। রিম্পা পড়ার কামরায় গিয়ে নিজের বইগুলো নেড়েচেড়ে দেখতে থাকে। বাংলা মিডিয়ামের বই, কী বা আর দেমাগ দ্যাখানো যায় এসব নিয়ে! পরীক্ষা দিলেও সই, না দিলেও সই!—সবাই ত স্কুলে যায় কন্যাশ্রী আর সাইকেল পাবার আশায়!-- এমনই হয়ত ধারণা পোষণ করে রিম্পার ব্যাপারে? রিম্পা মনে মনে ভাবে, আর খুব খুব দুঃখ পায়! ঝিম মেরে বসে থাকে বইগুলো কোলে নিয়ে। “পরীক্ষার মুখে জন্মদিন আসতে নেই”,-- মনে মনে শতবার বলে মনের ক্লেদ মুছে ফেলার চেষ্টা করে রিম্পা! 



খাবার টেবিলে হাসির হল্কা ছুটতে লাগল টালিচুলি ভেঙে! ওরা হাতে হাতে হেল্প করছে সব্বাই। স্বপ্না কেবল এঁটো পাতাগুলো কাঁচাতেই ব্যস্ত। হরতোষের মা হাসতে হাসতে একদম গড়িয়ে পড়ল, “হেই, তোরা কী রে! কেক কাটা হলো না, তার আগেই বসে পড়লি?” বাণ্টির মা ঠোঁট মুছতে মুছতে বলল, “আহা, আমার বুড়ো ধাড়ি রে! উনার এখন কেক কাটার শখ হয়েছে! আসুক না বাচ্চারা তখন কাটবে খনে! কেউ না কেউ ত আসবেই; সবার ত আর আমাদের মতো এত চাপ নেই!” স্বপ্নার হিসাবে গোলমাল মিশে যেতে থাকে। দু’একটা চামচ, হাতা-খুন্তি হাতফসকে ফ্লোরে পড়ে যেতে থাকে। রূপার মা সুনীতার কাছে আবদার করে, “আপনাকে না বললাম, স্যোসাল স্টাডির খাতাটা একটু আনবেন! আমার গাধিটা গতসপ্তাহে কিছুই লিখতে পারেনি। রশ্মি ম্যাম নাকি লেখার সাথে সাথেই হোয়াইট-বোর্ড মুছতে শুরু করেন! বুঝুন একবার, গাদাগুচ্ছো টাকা ঢালছি কি কেবল ওনার ঠাটভাট দ্যাখার জন্যে? তাছাড়া গাধিটাও তেমনি, এখনই যদি স্যোসাল স্টাডিতে এতটা অ্যালার্জি,-- ভবিষ্যতে ও কি আর সমাজমুখী হবে বলুন?” সুনীতা জিভ কাটে,--“এই রে, ভুলে গেছি একদম! কাল ম্যাসেঞ্জারে পাঠিয়ে দেব বুঝলে! তোমার বর কিন্তু আমার হোয়াটসয়াপে মাঝে মাঝেই আসে! পাঠাব ওনাকে?” রূপার মা লজ্জায় লাল হয়ে উঠল! এদিকে ক্রমশ ফিকে হতে থাকে রিম্পার মুখের মেকআপ। কথার উল্কি উঠতে থাকে অন্য জগতের। এত কড়া শীতেও সুনীতা চাদরছাড়া বাইরে এসেছে দেখে বাণ্টির মা ঠিক ধরে ফ্যালে, “তোমার ব্লাউজটা কিন্তু সেইইই! কে কেটেছে গো? ছোটন?--- ও একটা ছাগল!—আমার জারদৌসির পিসটা কবে থেকেই ফেলে রেখেছে! এবার দোকানে যাই একবার!” হরতোষের মায়ের গোড়ালি ফেটেছে, এ নিয়ে রাতের ঘুম উড়ে যাচ্ছে রোজ। সুনীতা ঠোঁট চিতিয়ে বলে,- “স্পা করে ছ্যাতার মাথা হয়! ওরচে আলু সেদ্দ করে জাব দিয়ে রাখলেও স্কিন সফট থাকে বুঝলে!” এমন সময় কথার মধ্যে ঢুকে পড়ে সমীরের মা। কোলে আড়াই বছরের নাতি। উনি দুঃখ করে বলেন, “এমা, বাচ্চাটা একা একা কামরায় বসে রয়েচে, আর তোমরা এদিকে---! তোমরা পারোও বটে বাপু!” বাণ্টির মা মনে মনে তেতে উঠল, “অই এলেন একজন! তোমার হাতে এত সময় আছে যখন তুমিই এসব করো না! নিয়মকানুন যা আছে, সারারাতজুড়ে করো!-- কে বারণ করেছে!” হরতোষের মা লজ্জা পায়, এই রিম্পা আয়, এই দ্যাখ, পুচু এসেছে এবার বেলুন ফাটাবি আয়। স্বপার মুখের কথা ফুরিয়ে যায়। রিম্পার মুখখানাও যেন চোপসানো বেলুনের মতো দ্যাখাচ্ছে! রিম্পার এবার খুব অপমানিত বোধ হয়। একরত্তি পুচকে হাঁটতে পারে না এখনো ভালো করে তাকে দিয়ে ইসসসসসস! দশম বর্ষীয়া রিম্পার খুব কান্না পায়! দুপদাপ পা ফেলে ঘরে দরজা দেয় রিম্পা!



একে একে খেয়েদেয়ে সবাই চলে গেল। রিম্পা দরজা খুলে বাইরে এসে মায়ের আঁচল ধরে শুকনো স্বরে জানতে চাইল, “আমার বার্থডে সেলিব্রেশান হবে না মা?” স্বপ্না শামুকের মতো গুটিয়ে যেতে যেতে উত্তর দিল, “হলো ত। সবাই সবকিছু খেয়েছে। খুব ভালো বলে গেছে সুনীতা আন্টি, শুনলে না?”
--“ও ত কেবল খাওয়াদাওয়া! কেক কাটা, বেলুন ফাটানো এসব হবে না মা?” স্বপ্না ঠাস করে একটা চড় কষিয়ে দেয় রিম্পার গালে! কিন্তু মুহূর্তের মধ্যেই স্বপ্নার চোখদুটো কাচের গুলির মতো শক্ত হয়ে উঠল! অসম্ভব জিদ চেপে বসল ওর মধ্যেও,--“হবে! আলবাৎ হবে! আয়, আমার সাথে চল!” বলেই মেয়ের হাত ধরে বাড়ির বাইরে পা বাড়াল স্বপ্না। 



ডোরবেল বাজতেই বাথরুম থেকে সুনীতা আওয়াজ দিল, “অ্যাই, আমি ফ্রেশ হচ্ছি; বেরুতে লেট হবে। একটু দ্যাখো না কে!” দীপায়ন দরজা খুলল। স্বপ্না সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে একবাটি পায়েস। দীপায়ন শুতে যাবার প্রস্তুতি নিতে নিতে দরজা খুলতে এসে ফেঁসে গেছে। সম্পূর্ণ খালি গা। জ্যোস্নালোকিত আমগাছের ছায়ার নীচে পায়েসের বাটি হাতে দাঁড়িয়ে আছে স্বপ্না। সুজাতার মতো পবিত্র লাগছে আজ ওকে! দীপায়ন কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে স্বপ্নার মুখের দিকে। তারপর কাঁপা কাঁপা ঠোঁটে বলল, “ওর মা গিয়েছিল ত, আবার কেন?” 
হাতে খুবই অল্প সময়, স্বপ্নার সংকোচ দ্যাখানোর সময় না, সে মরমে মরে জিজ্ঞাসা করল, “মনসিজ কি ঘুমিয়ে পড়েছে? খুব শখ করে পায়েস রাঁধলাম!—ওকে খুব ভালোবাসি কিনা---!”
--“না ঘুমোয় নি। জিওমেট্রিটা এখনো কমপ্লিট হয়নি, জেগে আছে ডেকে দিই?” দীপায়নের ডাকার আগেই মনসিজ কখন যেন পেনসিলকম্পাস হাতে করে দাঁড়িয়ে পড়ে বাপির পেছনে। দীপায়ন এবার বলল,--“দিন, কী এনেছেন, ওকে দিন। সুনীতা হয়ত আর বাইরে আসবে না, তাই আর গেট খুলছি না কেমন? এমনিতেই যা ঠাণ্ডা দিচ্ছে, অমন বাচ্চা নিয়ে বাইরে বেরোয় নাকি কেউ!” দীপায়নের কথায় টুপটুপ করে দুফোটা ঝরে গেল অলক্ষ্যেই! পায়েসের বাটি হাতে স্বপ্না সরে দাঁড়াল। মায়ের পেছন থেকে রিম্পা সামনের সিঁড়িতে টো উঁচু করে দাঁড়িয়ে, ফোলানো বেলুনটা মনসিজের দিকে বাড়িয়ে দিল। মনসিজ নির্লিপ্ত মনে পেনসিলকম্পাসের আগা দিয়ে একটা খোঁচা দিল। ফটাসসসসসসস করে জোর আওয়াজ হবার কথা ছিল, হলো না;-- হাওয়া ফুরিয়ে এসছিল বুঝি! আসলে বাঁধন শক্ত না হলে যা হয় আর কী! সিঁড়ির নীচে আলোছায়ায় ছড়িয়ে পড়ল স্বপ্নমাখা অ্যামেরিকান টফি! ওগুলো তখন আর দেখা যাচ্ছিল না। এমনিতেই ঠণ্ডায় চোখদুটো ঝাপসা হয়ে আসছিল রিম্পার! এমনসময় ঘরের ভেতর থেকে হুট করে আলোটা অফ হয়ে গেল। 

পায়েসের বাটিটা পড়েই রইল আলগা আকাশের নীচে। স্বপ্না ছোট্ট রিম্পার হাতখানি ধরে এগিয়ে চলেছে আগলহীন—অভিভাবকহীন-- টালির ঘরখানির দিকে। চারিদিকে নিস্তব্ধতা! কিন্তু বোসপাড়ার জ্যোস্নার মায়ামাখা সরু গলিপথে তখনো শীতকুঞ্চিত গাছেদের পাতাচোঁইয়ানো মোটামোটা নিশিরবিন্দুগুলি সমানে বলেই চলেছে,-- “হ্যাপি বার্থডে টু ইউ রিম্পা! হ্যাপি বার্থ---!”

0 comments: