0

গল্প - অশ্রুকণা রায়

Posted in

গল্প


দিন-অদিনের গল্প
অশ্রুকণা রায়


প্রায়ান্ধকার ঘরটির ঘুণধরা তক্তপোষে শুয়ে দিন কাটে নিবারণের। পাশ ফিরলেই ক্যাঁচ ক্যাঁচ আওয়াজ ওঠে, নিবারণ স‌ইতে পারে না এ আর্তনাদ, নিজেও ককিয়ে ওঠে মাঝে মাঝে আর তখন‌ই কাঁচা ঘুম ভেঙে ঘরের মেঝেতে পাতা বিছানায় উঠে বসে প্রচণ্ড বকুনি দেয় নাতনি ঝুমকি। তারপর আবার শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। নিবারণের আর ঘুম আসেনা, ঝুমকির কান বাঁচিয়ে বিড়বিড় করে -- "জানিরে জানি, আর‌ আমারে ব‌ইতে পারিস নে, সব্বাঙ্গে ব্যাথা তোর, দোষটাই বা কি, বয়েসটা কি তোর‌ও..." মাথার নীচেকার ছেঁড়া কাপড়ের পুঁটুলিটাকে একটু সরাতে যেতে‌ই আবার শুনতে পায় বুকফাটা কাতরানি, ...একবার বাইরে যাবার দরকার ছিল, কিন্তু...

চটের ওপর ছেঁড়া কাপড় পাতা বিছানা থেকে রোজ না হলেও মাঝে মধ্যে এইরকম টেনে হিঁচড়ে নামায় তাকে ঝুমকি,অবিশ্রান্ত গালাগালির বন্যা ছোটে তখন, টানতে টানতে উঠোনের কুয়ো তলায় ঠুকে বসিয়ে তক্তবোষের বস্তা পাল্টায় আর মুখ ছোটায়, "গত জন্মের মহাপাপ আমার, বাপ নয়, ঠাকুদ্দা নয়, কি সম্পক্ক? না বাপের মাতুল! তোর গু মুত আমি কেন ঘাঁটবো রে অলপ্পেয়ে বুড়ো? তা ও যদি বুঝতুম হাঁটা চলার ক্ষ্যামতা হারিয়েচে। তা তো নয়, পাশবাড়ির ঘুনিদাদু বিরানব্বুই বচ্ছরেও দিব্যি হাটবারে ক্ষেতের আনাজ, গাছের নারকোল নিয়ে হাটে বসে, আর এ ড্যাগরা সাড়ে তিনকুড়ি পেরিয়েছে কি পেরায়নি, গঙ্গাযাত্তির মতো ভান করে বিসনায় কাজ সারে!" কুয়োতলার বালতিতে তোলা জল ভাঙা মগে করে গায়ে ঢালতে ঢালতে বিড়বিড় করে নিবারণ, "তা করবোটা কি শুনি? বড্ড কাতরাচ্ছিল যে ওটা, নামতি গেলে যদি অক্কা পায়, তাই তো ওখানেই..."
তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে ঝুমকি, বুড়োর মুখের সামনে আঙুল উঁচিয়ে বলে, "আর একটা দিন দেখি বিসনা নোংরা কত্তে, বাইরে বস্সে দে ঘরে তালাচাবি মারবো, দেখোখনে, পিথিমিসুদ্দু সকলের কাতরানি শুনতে পাও, সারাদিন গতর পিষছি, সে কাতরানি কানে ঢোকে নে?" 
এলুমিনিয়ামের সানকিতে একদলা আলুভাতে আর খানিকটা জলসুদ্ধ পান্তা বেড়ে দেয় সে। উঠোনের দড়ি থেকে গামছাখানা টেনে নিয়ে পুকুরে চানে যেতে যেতে বুড়োকে শাসায়, "খেয়ে গিয়ে এখুনি টঙে উটবেনে বলে দিলুম, উটোন ভত্তি কাটকুটো, জামা কাপড়। বড্ড ছিঁচকের আমদানি হয়ছে, দুকুরের দিকটা তক্কে তক্কে থাকে..." ঝুমকি দাঁতে গুড়াকু ঘষতে ঘষতে পুকুরঘাটের দিকে এগোয়।
আলুভাতে মাখা পান্তার গ্রাস মুখে তুলতে তুলতে নিবারণ তার অদৃষ্টকে দোষে। কার অভিশাপে কে জানে জ্ঞান হ‌ওয়া ইস্তক চারপাশে যত আর্তনাদ তার কানেই পৌঁছে গেছে আগে। সেবার পালংক্ষেতের চারা পালংগুলো বেশ ফলফলে হয়ে উঠেছিল। বাপকে হরিজ্যাঠা কি একটা ওষুধ ছড়াতে বললে পোকা লাগবে না বলে। ওষুধ দেবার সঙ্গে সঙ্গে কাতর চিৎকার শুনতে পেয়েছিল সে সারা ক্ষেতজুড়ে। দুকানে হাত চাপা দিয়ে বাপকে বিরত করতে চেয়ে কাকুতি মিনতি করেছিল। বাপ তার কথায় কর্নপাত তো ক‍রেইনি ‌উল্টে চড় তুলে এগিয়ে এসেছিল । পরেরদিন মাটির সঙ্গে মিশে যাওয়া পালংগাছগুলোর দিকে তাকিয়ে বাপ বলেছিল, "ওষুধটা বোধায় বেশী পড়ে গিছিল জানিস... কিন্তুক তুই টের পেয়েছিলি কি করে?"
কি করে যে সে টের পেত সেটা তার নিজের কাছেই ধাঁধা ছিল। ছ'বছরে গ্রামের প্রাথমিক স্কুলে প্রথম শ্রেনীতে ভর্তি হয়েছিল, হেডমাস্টার অবনীবাবু নিবারণের বাপকে বলেছিল - "হারু, তোর ছেলেটার মাথা খুব ভালো, কিন্তু বড্ড বাচাল, সব কিছুতেই কথা বলা চাই ছোঁড়ার!" সেদিন ইস্কুল ছুটি ছিল কিজন্য যেন, নিবারণ হেডস্যারের বাড়ীর পাশ দিয়ে যাচ্ছিল লাটাই আর আঠার সরা নিয়ে সূতোয় মাঞ্জা দেবে বলে, বড় মাঠটার কাছে আসতেই চোখে পড়ল স্যারের গাইগরুটা খোঁটায় বাঁধা, মাসখানেক আগে বিয়োনো বাছুরটা কাছাকাছি নেই। গরুটা মাঝে মাঝেই ভয়ার্ত চিৎকার করে উঠছিল, নিবারণের মনে হচ্ছিল ওটা বাঁচাও, বাঁচাও বলছে। হাতের জিনিসপত্রগুলো নামিয়ে রেখে সে ছুটেছিল হেডস্যারের বাড়ী, ঘরের দাওয়ায় বসে তিনি তখন মুড়ি খাচ্ছিলেন, নিবারনের কথা শুনে বললেন - তুই খেলগে যা, দুধ দোয়ার জন্যে বাছুরটাকে বেঁধে রাখা হয়েছিল তো, তাই চিল্লোচ্ছে। রাখালকে বলছি, বাছুরটাকে মায়ের কাছে দিয়াস্তে।" যুক্তিটা নিবারণের মনঃপুত হলো না। গাইটার ডাক তো অন্যরকম মনে হলো তার। বাছুর কাছে না থাকলেও অমন প্রাণ বাঁচানোর মরিয়া চিৎকার করবে কেন গাইটা? রাস্তাটা ঘুরে আবার গরুটার কাছে গেল সে, আর গিয়েই চক্ষুস্থির হলো তার, গরুটা যেখানে বাঁধা তার হাত চারেক দূরেই এক বিশাল গোখরো ফনা তুলে অল্প অল্প দুলছে, সাপের লেজের খানিকটা তখন‌ও কেঁটকি ঝোপের মধ্যে ঢুকে রয়েছে। গরুটা লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে যত খোঁটা ওপড়ানোর চেষ্টা চালাচ্ছিল, ছোবল দেবার জন্য লক্ষ‍্য বস্তুটা সাপের কাছে তত স্পষ্ট হচ্ছিল। আর সময় নেই ভেবে হাতের আঠা ভর্তি সরাটা ছুড়ে দিয়েছিল সাপের দিকে আর অব্যর্থভাবে সেটা গিয়ে লেগেছিল সাপের মাথায়। অতবড় সাপটা মুহূর্তের মধ্যে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে সমস্ত শরীরটা আছাড়ি বিছাড়ি করছিল। একটুও দেরী না করে নিবারণ গরুর খোঁটাটা উপড়ে দিয়েছিল, তারপর লাটাইটাকে শক্ত হাতে ধরে ধীরে ধীর এগোচ্ছিল সাপটার দিকে। ভয়ংকর একটা কিছু ঘটে যেতে পারতো, কিন্তু ঘটল না তার কারণ ঐ সময়েই দুজন পথচলতি মানুষের চোখে পড়ে ঘটনাটি এবং তারাই দৌড়ে এসে শিশুটিকে এক ঝটকায় সরিয়ে নেয় মরনোন্মুখ সাপের উদ্যত ছোবল থেকে।

খাওয়া শেষ করে তোবড়ানো স্টিলের গ্লাসের জলে হাত ধুয়ে নেয় নিবারণ। তারপর এঁটো থালাবাসনগুলো দাওয়ার একধারে রেখে ছেঁড়া ফতুয়ার পকেট থেকে দেশলাই বার করে বিড়ি ধরাতে ধরাতে নিজের মনেই হাসে, ঝুমকি রাণী মুখে যত তেজ দেখাক না কেন মনে ভালোই জানে এই ভিটে, ভিটের লাগোয়া জমি, এক বিঘে দো ফসলী ধানজমি সব‌ই এই নিবারণ বুড়োর দান। রাতে চায়ের দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করে ঘরে এসে তার মাথার কাছে বিড়ির বান্ডিল আর বিস্কুটের ঠোঙাটা রাখতে ভোলেনা তাই। মজিলপুর ছেড়ে এই পশ্চিম মেদিনীপুরের অজ পাড়াগাঁয়ে যখন পাকাপাকি ভাবে আশ্রয় নিতে পালিয়ে আসে, তখন ঝুমকির বাপ বছর পাঁচেকের ছেলে। অভাবের সংসারে আর‌ও একটা পেট বাড়ল ভেবে দিদি সুরো চিন্তিত হয়ে পড়েছিল, তা তার সে চিন্তা ঘুচে গেল দু দিনেই। বিশ বছরের সা জোয়ান নিবারণ দিন কয়েকের মধ্যেই সুরোদিদির সংসারের হাল ধরল। সুরোর স্বামী নব চিররুগ্ন, মাঝে মাঝেই তার হাঁপের টান উঠতো, আর গঞ্জের চায়ের দোকানটা মাসের অর্ধেক দিন‌ই বন্ধ থাকতো। নিবারণ দোকানটাকে ঢেলে সাজালো, মামুলি বিড়ি, সিগারেট, চা বিস্কুটের সঙ্গে বাচ্চাদের পছন্দস‌ই সস্তা চিপস্, কাঠি লজেন্স, ছোটখাটো ছেলে ভোলানো খেলনা তার চায়ের দোকানে রাখল। রোজকার খদ্দেররা ছাড়াও হাটবারে বেশ ভীড় জমছিল মেয়ে খদ্দেরদের। তাই দেখে চুলের ফিতে, ক্লীপ, সস্তা স্নো, পাউডার নানা প্রসাধনী জিনিস সাজিয়ে রাখল দোকানে। হাটুরেদের মন বুঝে ঠেক থেকে আমদানি করল চোলাই মদ। হাটবারে ভীড় জমতো ভাল‌োই। থানাকে হাতে রাখতে কিছু দক্ষিণা যেত কিন্তু এসব করেও যা হাতে জমতো তাতে সুরোর সংসারের হাল ফিরে গেল। দিদির ভিটের লাগোয়া দিনু মণ্ডলের এক কাটা জমি কিনে আর‌ও দু কামরা মাটির ঘর তুলল নিবারণ। ভাগ্নে গগন বড় হচ্ছে, এক ঘর দাওয়ায় তার নিজের‌ও খুব অসুবিধা হচ্ছিল। নব'র এক বিঘে ধানজমি অনাবাদীই পড়ে থাকতো, নিবারণ আর‌ও একবিঘে জমি কিনে চাষ আবাদ শুরু করল। সংসারটা যখন সবে একটু সুখের মুখ দেখছিল সেই সময় নব চলে গেল। সুরোদিদির সংসারের সব দায়িত্ব এসে পড়ল নিবারণের ঘাড়ে। সুরো তার ভাই এর বিয়ে দিয়ে সংসারে থিতু করতে চায় কিন্তু কিছুতেই রাজী করানো যায় না তাকে। দিদির কান্নাকাটিতে মাঝে মাঝে একটু নিমরাজি হতো, রাতে বালিশে মাথা রেখে যখন‌ই পাশে কোনও মেয়েমানুষকে কল্পনা করত তখন‌ই মাথার পুরোনো পোকাটা নড়ে চড়ে উঠতো। নরম মাখনের মতো একটা শরীরের রূপ রস বর্ণ গলতে গলতে, মাঝদরিয়ার জলে মিশে যেতে যেতে গাঙচিলের তীব্র আর্তনাদ হয়ে উঠতো, আর দুকানে হাত চেপে মাঝরাতে নিবারণ ছুটতো নদীর ঘাটে। জোয়ারের ফনা তোলা ঢেউদের মাঝখানে তার দুটি চোখ খুঁজে ফিরত চন্দন আর কমলালেবুর গন্ধমাখা এক মৎসকণ্যাকে।

তখন জোয়ান বয়েস, বাপ কাজে লাগালে রামচন্দ্র চৌধুরীর বাড়িতে, মজুরের কাজ। গোয়াল পরিষ্কার, বাগানের আগাছা সাফ করা, গোলায় ধান তোলা, পান বরজের পান পাইকেড়েদের কাছে পোঁছে দেওয়া এমন হাজারগণ্ডা কাজ। লোকে বলত রাম চৌধুরীর অনেক ব্যবসা,আলো এবং অন্ধকার সবখানে। কানাঘুষো শোনা যেত ডাকাত দল‌ও পোষে নাকি, বাপকে জিজ্ঞেস করে একবার খুব বকুনি খেয়েছিল সে। হারু ছেলেকে বুঝিয়েছিল, "আমরা হলুম গে আদার ব্যাপারী, জাহাজের খবরে কি কাজ? ওসব কথা মাথায় না রাকাই ভালো।"
চৌধুরী মশা‌ই বিপত্নীক, একমাত্র ছেলের জন্ম দিয়েই গিন্নীমা সগ্গে গেলে তিনি আর বিয়ে থা করেননি। ছেলেকে কলকাতায় রেখে পড়াশোনা শিখিয়ে মানুষের মতো মানুষ করে, বিয়ে দিয়ে, ঘর আলো করা বৌ এনেছেন। সবাই জানে, নিজের গ্রামে, শহরে একাধিক উপপত্নী রাখলেও ছেলের গায়ে পাঁকের ছিটে লাগতে দেয়নি রাম চৌধুরী। রান্নাবাড়ির উঠোনে সারি সারি পাত পড়ত দুপুরে, চাকর বাকর, কর্মচারীরা খেতে বসতো সার বেঁধে, কালি ঝি আর মানুর মা ভাত তরকারি পরিবেশন করত। একদিন খেতে বসে নিবারণ দেখেছিল কালি ঝিকে ঝকঝকে কাঁসার বাটিতে কাঁচা হলুদ আর কমলার খোসা মিশিয়ে বাটতে, বাটা হলে রান্না ঘরের দুধের কড়াই থেকে মোটা সর তুলে দেওয়া হলো তাতে তারপর সেটা মানুর মার হাত দিয়ে চালান করা হলো ওপরে। ও জিনিসটা কি আর কিসের কাজে লাগবে জানার অপার কৌতুহল চেপে রাখতে পারেনি, বাপের বারণ সত্বেও পুকুরে আঁচাতে গিয়ে কালি ঝিকে জিজ্ঞেস করে ফেলেছিল। কালি ঝি হাতমুখ নেড়ে বলেছিল, "কি আবার, ঠসর! দাদাবাবুর হুকুমে মানুর মা এখন রাজকন্যের শরীরে ঐ সর হলুদ দলাই মলাই করবে, তাতে নাকি সোনার বন্ন আর‌ও ঝকবে। ফুল নেই, ফল নেই গাছের গোড়ায় সার!" ঠাকমার কাছে শোনা রূপকথার রাজকন্যার কথা মনে হয়েছিল তার। রাজপুত্র ছোটবাবু তাহলে রোজ রাতে সোনার কাঠি মাথায় দিয়ে রাজকন্যের ঘুম ভাঙায়? আহা একদিন যদি একটুখানি দেখতে পেত রাজকন্যেকে! কোনও কল্পতরু নয়, পুকুর পাড়ের কলকে ফুলের গাছের নীচে দাড়িয়ে এ ইচ্ছে প্রকাশ করেছিল সে। কিন্তু ওপর‌ওলা হলেন দিল দরিয়া, যাকে দেবেন বলে মনস্থ করেন তাকে ছপ্পর ফেঁড়ে দেন... সেদিন ছাদের পায়রা ঘরে কাজ পড়েছিল তার। পায়রাদের সারবন্দী খোপগুলো পরিষ্কার করার, কাজ করতে করতে খেয়াল ছিল না কখন ছোটবাবু পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন। রূপে রাজপুত্তুর‌ই বটে পূর্ণিমার আলো যেন ঠিকরে পড়ছে গা থেকে! খুব মনোযোগ দিয়ে তার কাজ দেখছিলেন তিনি, নিবারণের কেন জানি মনে হয়েছিল কাজ নয় তার সদ্য জোয়ান শরীর, তার বুকের ছাতি, সরু কোমর, হাতের গুলি লক্ষ্য করছেন ছোটবাবু জহুরীর চোখে। কেমন যেন অসোয়াস্তি হচ্ছিল তার, চোখাচোখি হতে জিজ্ঞাসা করলেন,
--"তুমি হারুদার ছেলে?"
---"হ্যাঁ, বাবু"
অতি গোপনীয় কিছু কাজ করতে বলার ভঙ্গিমায় তাকে অনুসরণ করতে ইঙ্গিত করলেন তিনি। তাঁকে অনুসরণ করতে গিয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় নিবারণ সেদিন প্রথম কমলা, চন্দনের গন্ধে ভরপুর রাজপুরীর নিষিদ্ধ চৌকাঠ পেরোল। আর ঠিক তখন‌ই তার দু কানে আছড়ে পড়ল হাহাকার ধ্বনি। মেহগনি কাঠের ময়ূরপঙ্খী খাট, পঙ্খের কাজকরা দেওয়াল, হলুদ, কমলা, সর ভর্তি কাঁসার বাটি সব হাহাকার করে উঠল। অবাক চোখে নিবারণ দেখল, পালঙ্কে শোয়া রাজকন্যের বিষাদ মাখা মুখ। রাজপুত্তুর তার ঘুম ভাঙাতে পারেনি! সে কাজ ছোটবাবুর হুকুমে তাকেই করতে হবে। এটা ঈশ্বরের শাস্তি না পুরস্কার বুঝতে না পেরে টলতে টলতে পালঙ্কের দিকে এগোতে এগোতে শুনতে পেল পিছনের দরজা বন্ধ হলো। কখন কিভাবে বাড়ী ফিরেছিল নিবারণের মনে নেই, শুধু মনে আছে সেই রাতেই ধূম জ্বর এসেছিল। বেহুঁশ জ্বরে মনে হচ্ছিল উথাল পাথাল সাগরে ময়ূরপঙ্খী ভাসিয়ে চলেছে সে...অচিনপুরের রাজকন্যার ঘুম ভাঙা হাসি আদর হয়ে গলে গলে পড়ছে সাগরের জলে আর ঢেউ এর মাথায় মাথায় সাদা ফেনার মুকুট হয়ে যাচ্ছে। দিনকতক নানা ছুতোয় আর চৌধুরী বাড়ী যাচ্ছিল না সে , শেষে একদিন বাপ খুব আহ্লাদ করে একসরা মণ্ডা এনে জানাল কবিরাজ আজ জানিয়ে গেছে চৌধুরী বাড়ীতে বংশধর আসছে, রাম চৌধুরী সবাইকে তাই মণ্ডা বিলিয়েছেন। বিস্ময়াবিষ্ট নিবারণ মনে মনে রাজকন্যার কোলে ফুটফুটে এক শতদল কামনা করেছিল, কেমন একটা ঘোরের মধ্যে কেটেছিল তার সারাটা দিন রাত। পরের দিন মায়ের ধাক্কাধাক্কিতে ঘুম ভেঙে শুনেছিল সে খবরটা -- ছোটবাবু ছাদের ঘরে বন্দুক দিয়ে আত্মহত্যা করেছে, গুলিটা মাথা ফুঁড়ে দেওয়ালে গিয়ে লেগেছিল। অত সুন্দর মুখটা নাকি চেনা যাচ্ছিল না...
শ্রাদ্ধ শান্তি চুকে গেল তিন দিনে, কোনও উত্তেজনার আঁচ‌ও পাওয়া গেল না, চতুর্থ দিন সকালে পোয়াতি বিধবা বৌটার শোকে সান্তনা দিতে বাপের বাড়ী পাঠালেন রাম চৌধুরী, বড় গাধা বোটটা ভিড়ল ঘাটে, ঝোপ ঝাড়ের ফাঁক দিয়ে নিবারণ দেখেছিল নৌকোর মাঝিদের সঙ্গে রয়েছে নুটু, চৌধুরীবাবুর পোষা ঠ্যাঙাড়ে। মনটা কু গেয়ে উঠেছিল। পরদিন‌ই রটে গেল, চৌধুরীবাড়ীর আর‌ও এক সব্বনাশ হয়েছে, রাম চৌধুরীর ভবিষ্যত বংশধরকে গর্ভে নিয়ে নৌকোডুবিতে নিখোঁজ হয়েছে তার পুত্রবধূ। হিংস্র বাঘের থাবা পড়তে লাগল এবার এখানে ওখানে... মানুর মা আর কালি ঝির হাত পা বাঁধা বিকৃত লাশ পাওয়া গেল বাদা বনে, অন্দর মহলের রক্ষণাবেক্ষনে গাফিলতি এবং কোনও সন্দেহজনক ব্যাক্তিকে সনাক্ত না করতে পারার শাস্তি। এই পরিস্থিতিতে কখন কার ওপর কোপ পড়ে ভেবে চৌধুরীবাড়িতে যাতায়াত ছিল এমন অনেক পুরুষ কর্মচারী গা ঢাকা দিল। প্রাণ বাঁচাতে সে ও পালিয়ে এসেছিল এই সিঙ্গুরে। তারপর কেটে গেল এতগুলো বছর ....

"কি গো দাদু, খুঁটি ঠেস দিয়ে ঘুমুচ্ছ নাকি? রাগ করেছ আমার ওপর?" মাথায় গামছা জড়িয়ে, ভিজে কাপড়ে সপসপ শব্দ তুলে ঝুমকি এসে দাঁড়াল উঠোনে। বছর তিরিশেক বয়েস হলো মেয়েটার। যুবতী শরীরের স্বাভাবিক আকর্ষণ থাকলেও তা চোখ টানেনা মুখের বামদিক জোড়া কালো আঁচিলটার জন্য। সোজাসুজি তাকালে বড় কুৎসিত লাগে মুখটা। এই মেয়ের জন্ম দিয়ে মা ভেগেছিল আড়তদার সনাতন জানার সঙ্গে। ভাইটাকে বিয়ে দিতে না পারায় বড় ক্ষোভ ছিল সুরোর মনে, তাই গগন কুড়ি পেরতেই পাশের গ্রামের কুন্তীর সঙ্গে বিয়ের কথা পাকা করে ফেলেছিল নিবারণ। রূপসী কুন্তীকে পেয়ে সুরো আহ্লাদে আটখানা, কিন্তু কদিন যেতেই বুঝল ঘর গেরস্থালীতে মন নেই এ মেয়ের। দিন রাত পটের বিবির মতো সেজেগুজে ঘুরে বেড়াতে চায় সে, গগন পোষা বেড়ালের মতো তার পায়ে পায়ে ঘোরে। ফি হাটে তাকে নিয়ে যেতে হতো গগনকে, ব‌উয়ের মন পেতে মামাকে লুকিয়ে ব্যবসার টাকা ভেঙে তার পছন্দের শাড়ী, গয়না, প্রসাধনী কিনতে হতো। অশান্তির ভয়ে সুরো বা নিবারণ সব মেনে নিত। কিন্তু তাতেও শেষরক্ষা হলোনা। তিনমাসের শিশুকন্যাকে ফেলে আশিকের সঙ্গে ঘর ছাড়ল কুন্তী। গগনটা পাগলের মতো হয়ে গেল, দিনরাত শুঁড়িখানায় পড়ে থাকতো আর আকন্ঠ মদ গিলতো। শেষে একদিন মত্ত অবস্থায় রাস্তা পেরোতে গিয়ে বাসের চাকার তলায় পিষে গেল। ঝুমকির বয়েস তখন বছর তিনেক। ভাঙা সংসারের হাল ধরতে হলো নিবারণকে। একদিকে শোকে মুহ্যমান সুরোদিদি অন্যদিকে এই শিশুকন্যাটির যত্ন নিতে হতো তাকেই। দিন গড়াতে গড়াতে মেয়েটা ডাগর হলো, ইতিমধ্যে সুরো‌দিদি ও গত হলো। রূপহীনা নাতনিটিকে পাত্রস্থ করতে নিবারণকে যথেষ্ঠ বেগ পেতে হলো। এক বিঘে জমি আর নগদ দশ হাজার টাকার বিনিময়ে পাত্রপক্ষ ঝুমকিকে নিয়ে যেতে রাজী হলো। ঝুমকির শ্বশুরঘর করতে যাবার সময় বাতাসে সেই গগনভেদী আর্তনাদ আবার শুনতে পেয়েছিল নিবারণ, ছমাস‌ও কাটল না, শাঁখা, সিঁদুর খু‌ইয়ে শ্বশুরঘর থেকে বিতাড়িত হলো সে। ভাটিখানায় মদের বিষক্রিয়ায় যে পনেরো জনের মৃত্যু হয়েছিল তাদের মধ্যে ঝুমকির স্বামীও ছিল। 
-- "জানো দাদু, গাড়ী কারখানার লোকজন সব এসে গেছে, কত সব যন্তরপাতি এইছে, আমাদের জমিটাও কারখানার চ‌ওড়া পাঁচিলের ভিতরে ঢুক্কে গেছে, সক্কলে বলছে কারখানা হলি এখেনে কেউ বেকার থাকবেনি। আমরা সব্বাই কাজ পাবো। তবে কোথাও কোথাও নাকি মিটিন হচ্ছে যে এখানে কারখানা কত্তি দেওয়া হবেনি, বাইরে কার অনেক নতুন নতুন লোকজন‌ও আমদানি হচ্ছে দেখছি। কি হবে বলতো দাদু, চাষের জমিটুকু দে দিলুম আমরা, কারখানা কি হবেনি, কাজ পাবনি আমরা? "
নিবারণ দাওয়ার খুঁটি ধরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। মেয়েটাকে মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে কোনও লাভ নেই, ঐ লোহার বড় বড় বিম, কংক্রিটের দেওয়াল, ভিতরকার যন্ত্রপাতি সহ এই ভ্রূণ শিল্প কারখানাটির গর্ভপাত হলো বোধহয়, নাহলে চারপাশ থেকে ভেসে আসা এত বিলাপ ধ্বনি‌ যা কেউ শুনতে পাচ্ছে না, এ পোড়া কানে এসে ঢুকছে কি করে? চিরকাল দুনিয়ার যত অশুভ বার্তা সব তার কানে আগে ঢুকতে চায় ! না চা‌ইলেও তারা জানান দিয়ে গেছে বারবার আর শুনবে না নিবারণ, কিছুতেই না... দাওয়ার এক কোণে পড়ে থাকা অর্ধেক খালি কীটনাশকের শিশিখানা ফতুয়ার পকেটে পুরে নিয়ে অন্ধকার ঘরে ঘুণধরা তক্তপোষের দিকে এগিয়ে যায় সে।



0 comments: