কৈশোরনামা - অনসূয়া
Posted in কৈশোরনামা
কৈশোরনামা
প্রিন্সেস
অনসূয়া
সেদিন ছুটির দিন ছিল।তাই এসপ্ল্যানেড গেছিলাম কিছু জিনিষ কিনতে। রাস্তার পাশে ফুটপাথের ওপর কত্ত কি বিক্রি হচ্ছে। পাপোশ, ব্যাগ, কানের দুল, রুমাল, পাজামা, জুতো, চুড়ি, ছোট্ট টেবিল, গামছা থেকে শুরু করে নাকের নথ অবধি কি নেই। সেসবই দেখতে দেখতে হাঁটছিলাম। দেখি এক দাদু বসে আছে এক নিরিবিলি কোনায়। সেখানে লোকের ভীড় নেই।সারি সারি গাড়ি দাঁড়ানো। তাদেরই এক কোণে দাদু বসে বসে চাবি দিচ্ছে আর গামলার জলে ঘুরে বেড়াচ্ছে ছোট্ট স্পীড বোট। সাদার উপর নীল বর্ডার। মাথার উপর সোনালী অক্ষরে ছোট্ট করে লেখা, প্রিন্সেস। তীর বেগে জল কেটে গোল গোল ঘুরপাক খাচ্ছে। দেখেই আমার মনে পড়ে গেল, রামসায়রের মাঠে কালিপুজোয় কেমন মেলা বসতো। জিলিপি, মোমো, এগরোল চিনিকাঠি, রেউড়ি আরও কত খাবারের দোকান। থরে থরে গজা, খাজা, জিলিপি, মালপোয়া সাজানো থাকতো।আমি পেটু বলে খাবারের দোকানেই আগে নজর যেত। তারপর গয়নার দোকান, খেলনার দোকান, কাঁচের বাসন, কাঠের জিনিশ, মাটির পুতুল কত কি থাকতো।এরকম একটা নৌকা দেখেছিলাম। সেটার চাকা ছিল। চাবি দিলে মাটির ওপরই সাঁই সাঁই করে দৌড়তো। কিন্তু এই দাদুর কাছের বোট একেবারে আসলের মতো। এমন সত্যিকারের বোট দেখেছিলাম, সেবার গঙ্গার পারে। কি এক নেভি অফিসারের পরিবার আসাতে তাদের জন্য নিরাপত্তা আর এমন এক বোটের ব্যবস্থা হয়েছিল। এই ছোট্ট বোটটা হুবহু সেরকম।
আমায় হাঁ করে থাকতে দেখে দাদু ফিচিক করে পানের পিক ফেললো প্রথমে। তারপর আরেকটা পান মুখে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, নিবে নাকি মামনি? ঘোর কাটা চোখে বললাম, না পয়সা নেই। বোটটা তখনও বোঁঁ ও ও ও করে ঘুরে চলেছে। ফিচ ফিচ করে হেসে উঠলো দাদুটা। বেজায় ফিচেল হাসি। বলে, ন্যাহ ট্যাকা নেই। ষোল টাকার রোল খেয়েছ পাশের গলিতে। পকেটে এখনও পাঁচশোর তিনটে নোট কড়কড় করছে। একটা পঞ্চাশও আছে। মা দিদির জন্য ব্যাগ কিনতে বলেছে। নিজে কিনবে বটুয়া। বলে আবার, পয়সা নেই।
কথা শুনে আঁতকে উঠলাম। বলে কি? কি করে জানলো? গুণীন টুনীন নয়তো, কি মেয়ে ধরা? মা বলেছিল, যেখানে সেখানে যাওয়া মেয়েদের ঠিক না। শুনিনি। বোধহয় ধরে নিয়ে মেয়েদের মাথা মুড়ে চুল বিক্রি করে ষ্টেশনের পাশের ঝুপড়িতে ফেলে রাখে। আর ট্রেনে ট্রেনে গান গাইতে হয় হারমোনিয়াম বাজিয়ে। আর বাকি সময়ে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখে। কিচ্ছু বলার যো নেই কাউকে। ভাবতেই গা শিউড়ে উঠলো। সেটাও টের পেয়ে গেল নাকি দাদুটা। বলল, ভয়ের কিছু নেই। রুস্তমের সাথে থেকে থেকে এসব বলা টলা অভ্যাস হয়ে গেছে। এই বোট একটাই আছে। নেবে নাকি? দশ টাকা।
রুস্তম কে? জ্যোতিষ টোতিষ নাকি? বাবা এসবের ঘোর বিরোধি। মা লুকিয়ে মন্দিরের বাবাজীর কাছে যায়, আমার কবে আক্কেল হবে জানতে। বাবাজীর বিশাল কাঁচাপাকা দাঁড়ি। শক্ত কাঠ কাঠ। দেখলেই গাল কুটকুট করে। ইয়া বড়ো সিঁদুরের টিপ আঁকা কপালে।গলায় বিশ পঁচিশটা রুদ্রাক্ষের মালা। লাল লাল চোখ আধবোজা। গায়ে লাল কাপড়ের শালু জড়ানো।নাকি তারাপীঠ থেকে পাশ করা জ্যোতিষী। একবার গেছিলাম মায়ের আর মাসির সাথে তারাপীঠে। বড্ড ভীড় আর নোংরা। কোথাও কোন কলেজ দেখতে পাইনি। বড়মামা সাথে ছিল। জিজ্ঞেস করেছিলাম। মামা হো হো করে হেসেছিল। কে জানে বাবা। হাসির কি আছে? শুধু তো বলেছিলাম, আমিও পড়তে চাই। ফর্ম কোথায় মিলবে?
রুস্তম কেমন জ্যোতিষ কে জানে? নাম শুনে কেমন ফকির টকির লাগছে।
- নেবে নাকি??
- নাহ।
ওই বোট নিয়ে কি করবো? তাই না বলে ঘুরে চলে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ শুনি,দাদু চেঁচাচ্ছে, না নেবে তো আমার এতো সময় নষ্ট করলে কেন। সময়ের দাম নেই নাকি? এই বোটের মতো সময় ঘোরে কিন্তু এক জায়গায় আর ফেরে না। বলি যেমন আমার সময় পিছিয়ে দিলে, থাকো এবার বোটের মতো ঘুরতে। তাও যদি দশ টাকা দিয়ে বোটখানা কিনতে।
বলে কি? পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি, দাদু কোথায়, বোট কোথায়, গামলা কোথায়। কোত্থাও কিচ্ছু নেই।
প্রতিটা গাড়ি দেখলাম। আর তাদের নীচটাও। নাহ কোত্থাও নেই। কাছাকাছি কোন গলিও নেই যে তাতে ঢুকে পড়বে। পুরোটাই দেওয়াল।
খানিক মাথা চুলকে, ঘাবড়ে মেট্রোর দিকে পা বাড়ালাম। ব্যাগ ট্যাগ তখন শিকেয় উঠেছে। টিকিট কেটে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামলে তবে প্ল্যাটফর্ম। আজ খুব ভীড় মেট্রোয়। থিক থিক করছে মানুষ। শুধু মাথা আর মাথা। যেন দুর্গাপুজো চলছে। টিকিটঘরের সামনেও লম্বা লাইন। যা হোক করে টিকিট কেটে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামলাম। ট্রেন এলেই বেড়িয়ে পড়বো। ওমা দেখি সেখানেও লম্বা লাইন। ট্রেনের লাইনটাও দেখতে পেলাম না। যা ভীড়। চুপচাপ লাইনে দাঁড়িয়ে গেলাম। লাইন এগোতে দেখি সবাই টিকিট কাটছে। আরে আমার কি মাথা খারাপ হলো? স্বপ্ন দেখলাম যেন একটু আগে টিকিট কাটলাম। দাদুর জন্য বোধহয় মাথাটা গড়বড় করছে। যাই হোক টিকিট কেটে, গেট দিয়ে ঢুকে নীচে নামলাম সিঁড়ি দিয়ে। ট্রেন এলেই উঠে পড়বো। ভীড়ে দমবন্ধ হবার জোগাড়। লাইন পড়েছে। লাইনে দাঁড়ালাম। লাইন এগোচ্ছে। ট্রেন এখনও এলো না। দেখতে না পেলেও আওয়াজ তো পাবো। আমি এগিয়ে চললাম লাইনের সাথে। আমার পালার বিশ পঁচিশজনের আগেই দেখি, একি আবার টিকিটঘর কোত্থেকে এলো? এই তো টিকিট কাটলাম। ব্যাগপত্তর আঁতিপাঁতি করে ঘেঁটে, সব নামিয়ে গুচ্ছের কাগজ, হজমোলা, কফি বাইটের প্যাকেট সব পেলাম। টিকিট পেলাম না। প্লাস্টিকের গোল চাকতি। ব্যাগে তিনটে পাঁচশোর নোট ছিল। চারটে দশ। সেগুলোও বহাল তবিয়তে ব্যাগেই আছে। মানে চুরি যায়নি কিছু।
এবার মাথা ঝিমঝিম করতে শুরু করলো। আরও একবার টিকিট কাটলাম এবারও একই ব্যাপার। কি করবো বুঝলাম না। ভীড়টায় তাকালাম। যেন কারুর সাথেই এমনটা হচ্ছে না। সবাই নিজের মতো ব্যস্ত। কাউকে চেনাও মনে হচ্ছে না। কি করি, বুকের ভেতর খুব ধড়ফড় হচ্ছে। দাদুর কথা কি তাহলে ফলে গেল নাকি? বোটের মতো ঘুরছি আমি? এবার তাহলে কি করবো? দাদুকে এখন কোথায় পাই? রোলটা না খেয়ে বোটটা কিনে নিলেই হতো। কাঁদবো কিনা মনে হতেই দেখি আলখাল্লা পরা এক ফোকলা পাগল গোছের লোক এসে আমার জামার হাতা ধরে খুব হাসি হাসি মুখ করে দাঁড়ালো। যেন কতদিনের চেনা। বলল, বোটটা কিনিসনি বেটি? তাই তো?
তুমি কে? জিজ্ঞেস করতেই বললো, আমি রুস্তম পাগলা। আমার ভাইয়ের সাথে দেখা হয়েছিল তোর। ওকে বলি জাদু করিসনা। ছেড়ে দে। তা শোনে না। আমাদের গুরুর বারণ আছে। আমরা ভিক্ষে করে খাই। ভাইটা বোট বেচে খায়। তা ওই একখানাই বোট। যে কিনলো, কিনলো। না কিনলেই ওর রাগ।
আমার তো চক্ষু চড়কগাছ। সব ভুলে, রুস্তমের পায়ে পড়ে গেলাম, বাবা আমায় বাঁচাও। আমি বাড়ি যাই। আর কক্ষনো করবো না এমন।
রুস্তম বলল,বোটটা চাই যে।
- সে কোথায় পাবো।আমি তো এখান থেকে বেরোতেই পারছি না।
- আমার কাছে আছে। পঞ্চাশ টাকা দে।
- অ্যাঁ পঞ্চাশ? দশ চাইলো যে তখন?
- সময় নিয়েছিস,তার দাম ধরবি না বুঝি? সময়ের দাম খুব। সোয়া পাঁচ মিনিট প্রতি দেড় টাকা করে এখন।
- সে কে ঠিক করে?
- সময় নিজেই ঠিক করে। ব্যাণ্ডেল চার্চে গেলে জানতে পারবি। ওখানে অনেক বড় বড় পুরোনো ঘড়ির সময় আছে। এখন দে দেখি পঞ্চাশটা টাকা।
বলে যেই পঞ্চাশ টাকা বের করে দিয়েছি হাতে। অমনি দেখি ঝোলা থেকে একটা গামলা বের করেছে, তাতে জল ভরা। এতো জলসুদ্ধু ঝোলায় ভরেছিল কেমন করে?
তারপর দেখি সেই বোটটা। সাদার ওপর নীল বর্ডার। তাতে সেইরকম ভাবেই লেখা 'প্রিন্সেস'। গামলার জলে সেটাকে চাবি দিয়ে ছেড়ে বললো, তাকিয়ে দেখ। আমি হাঁটু মুড়ে গামলার পাশে বসে পড়ে দেখতে লাগলাম।
দেখতে দেখতে দেখতে দেখতে আমার চোখ বন্ধ হয়ে এলো।
ঘুম ভাঙ্গতেই দেখি বিছানায় রোদ পড়েছে জানলা দিয়ে। পাশের ঘরে দিদি, পুলিকে খাওয়াচ্ছে আর মা ওকে গান গেয়ে শোনাচ্ছে।
চাদরটা পেঁচিয়ে ওই ঘরে গিয়ে দাঁড়ালাম। শুনি, মা পুলিকে বলছে, দেখো মিমি কি এনেছে! বোট, দেখো কেমন ঘুরছে।
দেখি,পুলির স্নানের গামলায় সাঁতার কাটছে সাদার ওপর নীল বর্ডার দেওয়া একটা বোট। হাতে তুলে দেখি বোটটার মাথায় সোনালী অক্ষরে অবিকল এক নাম লেখা। প্রিন্সেস।
ঘড়িতে টুংটুং করে তখন ন'টা বাজলো। আজ আর অফিস যাব না। ভাবছি ব্যাণ্ডেল চার্চে একবার ঘুরেই আসি।
0 comments: